অধ্যায় নয় – প্রতিক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া
১. খিলাফত ও স্বরাজ আন্দোলন
কিন্তু চিন্তারাজ্যের এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা আমার বেশি দিন বরদাশত হইল না। জানি না’ এবং জানা সম্ভব নয় এই ধরনের কথাই আমার ধাতে সহিত না। শৈশবে যখন মুরুব্বিদের কাছে কোনও ব্যাপারে এই ধরনের কথা শুনিতাম, তখন আমি। মনে মনে উহা অগ্রাহ্য করিতাম। তমিয-লেহাযের খাতিরে মুখে মুখে কিছু না বলিলেও মনে মনে জিদ করিতাম, ওটা আমাকে জানিতেই হইবে।
কাজেই আমার শ্রদ্ধেয় গুরুদেব অধ্যাপক ভট্টাচার্যের এবং আমাদের উভয়ের গুরু ইম্যানুয়েল কান্টের অজ্ঞেয়বাদ শেষ পর্যন্ত আমার প্রাণে অশান্তি ও অস্বস্তির আগুন জ্বালাইয়া দিল। আমার চিন্তারাজ্যে অবর্ণনীয় ঝড়-তুফান ও ওলট-পালট চলিতে থাকিল।
এই সময় দেশ খিলাফত ও স্বরাজ আন্দোলনের বন্যায় ভাসিয়া গেল। আমিও ভাসিলাম। এই আন্দোলনের ইনটেলেকচুয়াল দিকটা সহজেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। আমি মহাত্মা গান্ধীর ইয়ং ইন্ডিয়ার গ্রাহক হইলাম। শুরু হইতে উহার লেখা পড়িবার জন্য ব্যাক নাম্বারের কপিগুলির একত্রে বাঁধন কপি কিনিয়া ফেলিলাম। মহাত্মাজীর লেখার মধ্যে আমি খিলাফত স্বরাজ আন্দোলনের আধ্যাত্মিক দিকের সন্ধান পাইলাম। মহাত্মাজীর লেখা ছাড়া এই সময় আমি স্বামী বিবেকানন্দের ও রবীন্দ্রনাথের কতকগুলি লেখা পড়িয়া একদম আকৃষ্ট হইয়া পড়িলাম।
শেষ পর্যন্ত আমি যখন খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করি, তখন আমি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মানুষ। এই পরিবর্তন দেহ-মন উভয় দিক থনেই হইয়াছিল। মনের দিককার কথা পরে বলিতেছি। আগে দেহের। কথাটাই বলিয়া নেই।
আমি পোশাকের বাবুগিরি একদম বর্জন করিলাম। খদ্দরের তহবন্দ ও কল্লিদার লম্বা কোর্তা (পাঞ্জাবির চেয়ে বেশি লম্বা বটে, কিন্তু মৌলবী সাহেবদের কোর্তার চেয়ে কম লম্বা) পরিলাম। মাথায় গান্ধী টুপি বসাইলাম। শেভ করা ছাড়িয়া দিলাম। ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই চাপদাড়িতে গাল ভরিয়া উঠিল। মোহাম্মদী আলেমদের মধ্যে সুন্নতি বাবরি চুল রাখার রেওয়াজ আছে। আমিও সুন্নতি বাবরি রাখিলাম। সুন্নতি বাবরি মানে ঘাড়ের সমান কাটা বাবরি। হিন্দু-সন্ন্যাসী, মুসলমান শাহ ফকির বা শিখেরা মেয়ে লোকের মত লম্বা চুল রাখিয়া যে ধরনের বাবরি রাখে সুন্নতি বাবরি তেমন নয়। পয়গম্বর সাহেবের সুন্নত বলিয়া কাঁধ সমান উঁচা একটা বাঁশের লাঠিও লইলাম। গান্ধীজির অনুকরণে জুতা ছাড়িয়া প্রথমে খালি পায়ে এবং কিছুদিন খড়ম পায়েই আন্দোলন শুরু করিয়াছিলাম। কিন্তু খড়ম পায়ে বেশি দূর চলাফেরা করা যায় না। অথচ পুরাতন ডার্বি অক্সফোর্ডেও ফিরিয়া যাওয়া যায় না। কাজেই আগাগোড়া সুন্নতি লেবাছের সাথে খাপ খাওয়াইয়া বিহারিদের মত দেলওয়ারী’ জুতা পরিলাম। দেলওয়ারী মানে নাগরা বা সেলিমশাহী নয়। দেলওয়ারী জুতার মাথা চোখাই হউক আর ভোতাই হউক, ওটা লাল চামড়ার হইবে এবং সবুজ চামড়ার মেইন বর্ডার থাকিতে হইবে। আজকাল এ ধরনের জুতা আমার নজরে পড়ে না বলিয়াই এই কথা কয়টা বলা দরকার বোধ করিলাম। এই ভাবে আমি পুরা সুরতি বা পোশাকি মুসলমান হইয়া গেলাম।
.
২. পুনরায় ধর্মে মতি
এইবার দেখা যাক সিরাতে বা চরিত্রে কতটুকু মুসলমান হইলাম। নামাজ রোযা পুরা মাত্রায় শুরু করিলাম ঠিক; কিন্তু এবার নামাজ-রোযাকেই আমি একমাত্র বা শ্রেষ্ঠ এবাদত বলিয়া মনে মনে মানিয়া লইলাম না। নিয়মিত নামাজ-রোযা ধরিলাম নিজের কথা ও কাজে সংগতি রাখিবার জন্য। কংগ্রেস ও খেলাফতের বড় বড় জনসভায় কোরআন-হাদিস হইতে মূল আরবি আয়াত (অবশ্য ছোট ছোট) আবৃত্তি করিয়া বক্তৃতা করিতাম। ছেলেবেলা হইতেই খোশ-ইলহানে দরায় গলায় কোরআনের কেরাত আবৃত্তি করা আমার অভ্যাস ছিল। মাঝখানে চার বছর নামাজ পড়ি নাই, কেরাতও আবৃত্তি করি নাই। অবিশ্রান্ত ফুট ও বাঁশি বাজাইয়া গলা নষ্ট করিয়াছি। কিন্তু স্বরাজ খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়া বিলাসিতার বস্তু হিসাবে ফুট-বাঁশি বর্জন করিয়াছি এবং নিয়মিত নামাজও ধরিয়াছি। এতে আশ্চর্য রকম অল্পদিনে আমার কেরাতি গলা ফিরিয়া আসিল। দুই-এক সভায় মগরেবের নামাজের এমামতি করিয়া নিজের খোশ-ইলহানকে আবার মশহুর করিয়াছিলাম। কাজেই এমামতিতে আমার ডাক পড়িয়া গেল। কিন্তু বুঝিলাম ইলহানই শুধু আসিল, খোশ আর আসিল না। গলা আসিল কিন্তু দায় আসিল না। মুখরেজ-তালাফুযে আমার কাবেলিয়াত আমাদের অঞ্চলের আলেম-ওলামাদেরও জানা ছিল। কাজেই খুব উচা দরজার মওলানা-মৌলবী উপস্থিত না থাকিলে আলেমরাও আমাকেই এমামতি করিতে ঠেলিয়া আগাইয়া দিতেন। অনেক সময় মুকতাদিদের দাবিতেই আলেমরা এই ত্যাগ স্বীকার করিতেন।
স্বরাজ-খেলাফতের বক্তৃতা করিতে করিতে আমি সহবক্তা আলেমদের মত কিছু কিছু ওয়ায-নসিহত করিতাম। এই ওয়াযে আমি আলেমদের মামুলি বক্তৃতার অনুকরণে রোযা-নামাজের কথা বলিতাম না। ছেলেবেলা হইতে আলেম-ফাযেলদের ওয়াযের নিয়মিত শ্রোতা হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা এই যে, আলেমরা যে তাদের ওয়াযে শুধুই নামাজ-রোযা, হজ যাকাতের কথা বলেন, সাধারণ শ্রোতাদের এটা পছন্দ হয় না। একই কথা। একই ধরনে শুনিতে শুনিতে শ্রোতারা ঐ সব ওয়াযে কোনও রস পায় না। ওয়ায শুনিলে সওয়াব হয়, আলেমরা তাদের প্রত্যেক বক্তৃতায়ই কোরআন হাদিস দ্বারা তা প্রমাণ করিয়া থাকেন। শ্রোতারা এসব কথা বিশ্বাস করে। তাই শুধু সওয়াবের আশাতেই শ্রোতারা ওয়াযের মজলিসে বসিয়া থাকে। একটু জ্ঞান হইয়াছে অবধি আমি এই ধরনের ওয়ায না-পছন্দ করিতাম। ব্রাহ্ম ও খৃষ্টান বক্তাদের বক্তৃতার মধ্যে শ্রোতাদের শিখিবার মত অনেক কথা থাকে, এ অভিজ্ঞতা আমার হইয়াছে। শুধু সওয়াবের আশায় নহে, কিছু শিখিবার জন্যও মুসলমান শ্রোতারা ওয়ায শুনুক, এ কথা আমার মনে। আগে হইতেই জাগরূক হইয়াছিল। অনেক আলেম বন্ধুকে আমার মনের কথা বলিয়াছি। শুধু নামাজ-রোযা, হজ-যাকাত ও হায়েয-নেফাসের মসলা মসায়েল না বলিয়া চরিত্র গঠন, সত্য কথন, স্বাস্থ্য পালন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, পরোপকার, নাগরিক কর্তব্য, প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য, ব্যবসা বাণিজ্য, হক-হালাল রুজি-রোযগার ইত্যাদি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে বক্তৃতা করিবার জন্য আমি অনেক মৌলবী বন্ধুকে উপদেশ দিয়াছি। যে কোনও কারণেই হউক, তাঁরা কেউ আমার কথায় কান দেন নাই।
.
৩. ওয়াযে নূতনত্ব
কাজেই খিলাফত স্বরাজের সভা-সমিতিতে আমি নিজেই যখন স্বরাজ স্বাধীনতার কথার সাথে ওয়ায-নসিহত শুরু করিলাম, তখন নিজের বহুদিনের পোষা অভিমতকে নিজেই কাজে লাগাইবার চেষ্টা করিলাম। আমার বক্তৃতায়। শরিয়ত ও মসলা-মসায়েলের কথা খুব কমই থাকিত। ঐ সব ব্যাপারে সামান্য একটু ভূমিকা করিয়াই আমি শ্রোতাদের বাস্তব ও ব্যবহারিক জীবনের কর্তব্যের কথা বলিতে শুরু করিতাম ও চাষবাসের কাজে ব্যাঘাত না ঘটাইয়াও কীভাবে সকল ছেলেমেয়েকেই প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া যায়, তার সহজ ফন্দি-ফিকির বাতলাইতাম। সকল অবস্থার চাষি ভাইরাই যে কাপড়ের খরচা এক পয়সা না বাড়াইয়াও যার-তার বাড়ির মেয়েদেরে কোর্তা পরাইতে পারেন, কাপড়ের গজ ইঞ্চি সিলাইর খরচা হিসাব করিয়া তা বুঝাইয়া দিতাম। বনে-জঙ্গলে ও বাড়ির পিছাড়িতে যেখানে সেখানে পেশাব-পায়খানা না করিয়া সামান্য খরচে কীভাবে পুরুষ ও মেয়েদের জন্য বাড়ির ভিতরে ও বাইরে দুইটি স্বতন্ত্র পায়খানা নিজ হাতে তৈয়ার করা যায়, কাঠ-বাঁশের হিসাব করিয়া তার সহজ সাধ্যতা এবং উপকারিতা বুঝাইতাম। বাড়ির আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করা, পুষ্করিণী, কুয়া-ইন্দারা সাফ রাখা, গোহাল পরিচ্ছন্ন রাখা, বাড়ির ভিতর বাহির উঠান ঝাড়ু দেওয়া, বাড়ির সামনে দু-চারটা ফুলের গাছ ও বাড়ির পিছনে শাক-সবজির গাছ লাগাইবার সহজ উপায় ও উপকারিতা বর্ণনা করিতাম।
সদা সত্য বলায়, পরোপকার করায়, এমনকি রোযা-নামাজেও যে গরীব জনসাধারণের বাস্তব অসুবিধা আছে সে কথা সরলভাবে উল্লেখ। করিতাম। কেউ যে ইচ্ছা করিয়া মিথ্যা বলে না, পরের অনিষ্ট করে না, নামাজ-রোযা তরক করে না, নিতান্ত বাধ্য হইয়াই যে করিয়া থাকে, দরদের সাথে এই সব কথা বলিয়া শ্রোতাদের মন জয় করিয়া ফেলিতাম। তাঁরা মনে করিত, তাদের অভাব-অসুবিধা আমি বুঝি এবং দরদ দিয়াই তাদের অবস্থা বিবেচনা করিয়া থাকি। আমি বহুবার লক্ষ করিয়াছি, এসব কথা বলিবার সময় শ্রোতারা গলা বাড়াইয়া, কান খাড়া করিয়া, হা করিয়া আমার কথা শুনিয়াছে। এই সব কথার মধ্যে দুইটা কথার জন্য আমার খুব নাম পড়িয়া গিয়াছিল বলিয়া কথা দুইটা আজও আমার মনে আছে। আমি অনেক বক্তৃতায় এই ধরনের বক্তৃতা করিতাম : আমাদেরে সদা সত্য কথা বলিতে উপদেশ দেওয়া হয়। সেটা যে উচিৎ তাও আমরা বুঝি। কিন্তু তা। সম্ভব না। ঘর-সংসার করিতে গেলে, দেনা-পাওনার মধ্যে অভাবের সংসার চালাইতে গেলে, ঝগড়া-ঝাটি না করিয়া কায়-কারবার ও বেচা-কেনা করিতে গেলে, অনেক সময় দু-চারটা ছোটখাটো মিছা কথা বলিতেই হয়। পরোপকার করা বিশেষত প্রতিবেশীর উপকার করা সওয়াবের কাজ, এটাও আমরা বুঝি। কিন্তু নিজের দুঃখ-ধান্ধা লইয়াই আমরা এত ব্যস্ত যে, দম ফেলিবার ফুরসত পাই না। পরের উপকার করিব কখন? সে জন্য আমার উপদেশ এই যে সদা সত্য কথা বলার চেষ্টা বাদ দিয়া আপনারা যার-তার সুবিধামত সপ্তাহের একটি দিন ঠিক করেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, ঐ দিনটিতে আপনি মিছা কথা বলিবেন না; অন্ততপক্ষে একটি লোকের একটি উপকার করিবেন। সে উপকার যতই ছোট হউক। কাজে না হউক মুখের কথায় হউক, তাতে কিছু মনে করিবেন না, বড় উপকারও উপকার, ছোট উপকারও উপকার। কাজ দিয়া উপকারও উপকার, কথা দিয়া উপকারও উপকার। উপকার কথাটা শুনিয়াই আমরা ঘাবড়াইয়া যাই। মনে করি, টাকা-পয়সা খরচ দরকার। ওটা ভুল। একজনের গরুতে আরেকজনের ক্ষেত খাইতেছে, আপনি ইচ্ছা করিলেই ঐ গরুটা খেদাইয়া খেতওয়ালার উপকার করিতে পারেন। একজনের আইলের পল্লাটা ভাঙ্গিয়া ক্ষেতের পানি সরিয়া যাইতেছে। হউক না ক্ষেতওয়ালা আপনার অনাত্মীয় বা শত্রু। আপনি যদি এক টুকরা মাটি ফেলিয়া পল্লাটা বন্ধ করিয়া দেন, তবে ক্ষেতওয়ালার যে উপকার হইবে, সে তা জানিবে না সত্য, কিন্তু সকলের উপরের যিনি দেখনেওয়ালা তিনি দেখিবেন। উপকৃতের অজ্ঞাতে উপকারের যে কী সওয়াব আল্লা দিবেন না আপনারা কল্পনা করিতে পারিবেন না।
.
৪. পীরগিরির উপক্রম
এমনি দৃষ্টান্ত হাজার দিতাম। সবই পল্লিজীবনের ঘটনা। এই ধরনের ওয়ায পাড়া-গাঁয়ে একদম নূতন। শুধু এই নূতনত্বের জন্যই আমার বক্তৃতা জনপ্রিয় হইল। চারদিক হইতে আমার ডাক পড়িতে লাগিল। কারো কাজ বা চাল-চলন ভাল লাগিলেই আমাদের জনসাধারণ তাকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করিয়া বসে এবং প্রাপ্যাধিক মর্যাদা দিয়া থাকে। এখানে আমার কথাগুলি নূতন; আমি বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা ইংরাজিওয়ালা লোক; কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি নামাজ-রোযা করিতাম না বলিয়াও জনসাধারণ কানাঘুষা করিয়াছে! সেই লোকটার মুখে এমন সব নূতন কথা! এটা ত সাধারণ ব্যাপার নয়। নিশ্চয়ই লোকটা কোনও বুযুর্গের সহবত অথবা দোওয়া পাইয়াছে। খুবই সম্ভব। এদের বংশে ত এই ধরনের লোক আগেও হইয়াছে।
বস্, আর যায় কোথায়? দোওয়া-তাবিজ ও পানিপড়া, সজ-পড়ার জন্য লোকজন আমার কাছে আসিতে লাগিল। এসব ব্যাপারে ‘না’ করাও যায় না। আমি কিছু জানি না বলিলেও কেউ বিশ্বাস করিবে না। বরঞ্চ তাতে বুযুর্গি আরো বাড়িয়া যাইবে। সুতরাং তাবিজ-কবচ, পানি-পড়া, সজ-পড়া, মাটি পড়া দিতে লাগিলাম। নক্শে-সোলেমানী’ চার খণ্ড আমাদের বাড়িতেই ছিল। উহা দেখিয়া তাবিজ দিতে লাগিলাম। কখনও কোরআনের এক-আধটা আয়াত পড়িয়া কখনও ‘আল্লা এই রোগীকে ভাল করিয়া দাও, মনে মনে বাংলায় এইটুকু বলিয়াও পড়া দিয়াছি। মনে করিয়াছি, যে একবার যাইবে সে আর আসিবে না। কিন্তু তা হয় নাই। অনেকেই উপকার পাইয়াছে। আমার তাবিজে বা পানি-পড়ায় রোগী সঙ্গে সঙ্গে ভাল হইয়া গিয়াছে। কাজেই আর দুইটা নূতন রোগীর জন্য পানি-পড়া নিতে আসিয়াছে। এই সব রোগী বা তাদের আত্মীয়স্বজন প্রথমে ডালিম, আনারস, তার পর মুর্গী, খাসি এবং পরে টাকাপয়সা নজর লইয়াও আসিয়াছে।
আশ্চর্য হইয়া ভাবিয়াছি, এমনি ঝরে বক মরার সুযোগ লইয়া অনেক শাহ ফকির তাঁদের কেরামত বাড়াইয়াছেন এবং প্রচুর রোযগার করিতেছেন। এমনি ব্যবসা আরো অনেক শ্রেণীর লোকেরাই অবশ্য করিতেছে। জ্যোতিষী বা হস্ত-রেখা পরীক্ষা করিয়া যারা রোযগার করিতেছেন, তাদের কাজও প্রায় এই রূপ। যতই আন্দাযি ভবিষ্যদ্বাণী করুন, দু-চারটা মিলিয়া যাইবেই। ভাল চিকিৎসাবিজ্ঞানীর মুখে শুনিয়াছি, শতকরা পঞ্চাশের বেশি রোগ এমনি ভাল হইয়া যায়। প্রকৃতি নিজেই রোগের সঙ্গে লড়াই করিয়া জয়লাভ করে। কাজেই বিনা চিকিৎসায়ও ঐসব রোগী ভাল হইয়া যাইত। পক্ষান্তরে দেশের শ্রেষ্ঠ ডাক্তারের হাতেও রোগী মারা যায়। এই কারণে সাধারণ ডাক্তারের কাজ কতকটা ঐ গণকদের মতই। দোওয়া-তাবিজ, পানি-পড়াও তাই। কাজেই গণক বা ডাক্তারদের ব্যবসা দোষের না হইলে তাবিজ-পানি পড়াওয়ালাদের ব্যবসাটাই দোষের হইবে কেন?
কিন্তু তাবিজ-পানি-পড়াওয়ালাদের ব্যবসা নিছক চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ থাকে না। আরোগ্যের জন্য তাবিজ দিতে দিতে এঁরা শেষ পর্যন্ত আখেরাতের জন্যও তাবিজ দিতে শুরু করেন। স্বাস্থ্য বিক্রয়ের ব্যবসা হইতে প্রমোশন পাইয়া এরা ক্রমে বেহেশত বিক্রয়ের ব্যবসা আরম্ভ করেন। এঁরা নিজেরা বদমায়েশি বুদ্ধি হইতেই যে এই ব্যবসা শুরু করেন, তা নয়। বিশ্বাসপ্রবণ জনসাধারণই এঁদের পীর-ফকির বানাইয়া থাকে। ঘুষখোরদের সম্বন্ধে কথা আছে যে গোড়াতে এরা ভাল মানুষ ছিল। পাবলিকই প্রথমে এটা-ওটা শেষে টাকাপয়সা দিয়া এদেরে খারাপ করিয়াছে। প্রথমে পয়সা সাধিলে প্রথম প্রথম যারা চটিয়া যাইত, পরে তারাই পয়সা দাবি করিয়াছে। না দিলে কাজ করে নাই। কোনও কোনও পীর সম্বন্ধেও এই কথা সত্য। সাধারণ একটা প্রক্রিয়া বা মুষ্টিযোগে দুই-একজন লোক রোগমুক্ত হওয়ার পর হৈচৈ পড়িয়া গিয়াছে লোকটা গায়েবি ঔষধ বা দোওয়া পাইয়াছে। লোকের ভিড় হইয়াছে। সে লোক শাহ-সাব হইয়া গিয়াছে। মানুষ ত মানুষ, গাছ-বৃক্ষ ও নদী পুকুরের পানি পর্যন্ত বুযুৰ্গি হাসিল করিয়া ফেলিয়াছে। পা-ভাঙ্গা একটা গরু গড়াইয়া এক পুকুরে পড়িয়াছিল। গরুটা যখন সাঁতরাইয়া পাড়ে উঠিল তখন দেখা গেল গরুটার পা ভাল হইয়া গিয়াছে। আর যায় কোথায়? ঐ পুকুরের পানি নিবার জন্য লোকের ভিড় হইল। মেলা বসিল। পুকুরের পানি কাদা হইয়া গেল। তবু বুযুৰ্গি কমিল না।
কাজেই আমার দোওয়া-তাবিজের বরকত ঐ ‘ঝড়ে বক মরার থনে একটুকুও বেশি ছিল না। তবু আমার কেরামত বাড়িল। দুই-একজন শুধু তাবিজ, পানি-পড়া নিয়াই সন্তুষ্ট থাকিল না। আমার মুরিদ হইতে চাহিল। পীরগিরি শুরু করিতে উৎসাহ দিল। আমি আঁতকাইয়া উঠিলাম। নিজের জনপ্রিয়তাকে আমি ডরাইলাম। পীরগিরিকে আমি ভণ্ডামি বলি। পীরদেরে আমি ঘৃণা করি। সেই আমিই পীরগিরি করিব? ঘটনাচক্রে এই সময় আমি নিজের গ্রাম ও জিলা ছাড়িয়া কলিকাতা গেলাম। একটা আসন্ন আত্মিক পতনের হাত হইতে বাঁচিয়া গেলাম।
.
৫. নূতন পরিবেশ
কলিকাতা গিয়া দেখিলাম শুধু আমি একার নয়, মুসলিম তরুণ মাত্রেরই মধ্যে একটা চিন্তার বিপ্লব চলিতেছে। যাদের চিন্তার সাথে নিজের চিন্তার ঐক্য দেখিলাম, তাঁদের মধ্যে বিশেষ করিয়া ইয়াকুব আলী চৌধুরী, ডা. লুত্যর রহমান, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মি. এস ওয়াজেদ আলী, আব্দুল মতিন চৌধুরী, মি. আয়েনূল হক খাঁ প্রভৃতির নাম না করিয়া পারিতেছি না। আমার বাল্যবন্ধু শামসুদ্দীন ত ছিলই। মুসলমান সমাজে নবজাগরণ আনা সকলেরই উদ্দেশ্য। কিন্তু তা করা যায় কেমন করিয়া? এককালে বিশ্ব-শাসক মুসলমান কেন আজ অধঃপতিত? জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, কৃষ্টি-সভ্যতায়, শিল্পে-বাণিজ্যে মুসলমানেরা আজ দুনিয়ার সবার পিছনে পড়িয়া কেন? কেন দুনিয়ার চল্লিশ পঞ্চাশ কোটি মুসলমানের মধ্যে একটি শিল্পী, একটি বিজ্ঞানী, একটি আবিষ্কারক নাই? কেন মুসলমানরা সকল ব্যাপারে এমনকি তাদের মাথার টুপি ও জায়নামাজ তৈরির ব্যাপারেও অমুসলমানের উপর নির্ভরশীল? বস্তুত দরিদ্র মেসের ভাঙ্গা চৌকির ময়লা-ছেঁড়া বিছানায় শুইয়া-বসিয়া এমনি ভাবে দুনিয়ার মুসলমানদের ভাগ্য আলোচনা করিতাম। সে আলোচনায় সিদ্ধান্ত এই হইল যে মুসলমানদের বুদ্ধি আড়ষ্ট ও চিন্তা অবরুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। ইসলামের ভাল আদর্শ ত্যাগ করিয়া মুসলমানরা শুধু আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই ধর্ম সাধনাকে সীমাবদ্ধ করিয়াছে। নামাজ-রোযাকেই তারা একমাত্র ধর্মকার্য মনে করে। ফলে তারা জ্ঞান লাভের চেয়ে সওয়াব হাসিলের দিকে মন দিয়াছে বেশি। স্কুল-কলেজ স্থাপনের চেয়ে মসজিদ নির্মাণকেই বেশি দরকারি কাজ মনে করিতেছে।
মুসলমানদের এই সার্বিক অধঃপতনের জন্য দায়ী মোল্লারা। তারাই ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করিয়া মুসলমান জনসাধারণকে অজ্ঞান ও দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবাইয়া রাখিয়াছে। দুনিয়ার ধন-দৌলত কাফেরদের জন্য মুসলমানদের জন্য বেহেশতে বালাখানা ও হুর গিলমান অপেক্ষা করিতেছে, ইত্যাদি কু-প্রচারণা করিয়াই মুসলমানদেরে বিপথগামী করিয়াছে। ও সব ব্যাপারে আমরা প্রায় সবাই একমত ছিলাম। কাজেই সবাই মোগ্লাবিরোধী লেখা চালাইতাম। ডা. লুৎফর রহমান, এস ওয়াজেদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, হুমায়ুন কবির, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও আমি চুটাইয়া মোল্লাবিরোধী অভিযান শুরু করিলাম। এটাই আমার আয়নার যুগ। সওগাত-এর সম্পাদক মৌ, নাসির উদ্দীন আমাদের পুরা সমর্থক ছিলেন। অতএব সওগাতকে কেন্দ্র করিয়া আমরা একটি বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন শুরু করিলাম। আমাদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকিলেও ঢাকা হইতে একই সময়ে অধ্যাপক আবুল হোসেন ও কাজী আবদুল ওদুদের নেতৃত্বে শিখা সম্প্রদায় একই আন্দোলন শুরু করিলেন।
আমি কিন্তু শুধু লেখাতেই এই সংস্কার প্রয়াস সীমাবদ্ধ রাখিলাম না। পোশাক-পাতিতে, চালে-চলনেও এই সংস্কার প্রবর্তন করিলাম। দাঁড়িয়ে কেঁচি লাগাইলাম। কোর্তা খাট করিয়া পাঞ্জাবি বানাইলাম। তহবন্দ ফেলিয়া। পায়জামা ধরিলাম। বাবরি কাটিয়া আলবার্ট ফ্যাশন করিলাম।
.
৬. মোল্লাকি-বিরোধী লীগ
কিন্তু তাতেও তৃপ্ত হইলাম না। কতিপয় বন্ধুতে মিলিয়া ‘এন্টি মোল্লা লীগ’ গঠনের সংকল্প করিলাম। এই সময়ে আমি আমার রাজনৈতিক ও সাংবাদিক গুরু মৌ, মুজিবর রহমান সাহেবের দি মুসলমান-এর সহকারী সম্পাদক। স্বনামধন্য মৌ, আবুল কাসেমের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মৌ, আবুল হায়াত, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও আবুল কালাম শামসুদ্দিন তখন আমার সহকর্মী। আমরা সকলে মিলিয়া ঐ সংকল্প করিয়া মৌ. মুজিবর রহমান সাহেবকে উহার সভাপতি হইবার অনুরোধ জানাইলাম। আমাদের আদর্শ ও কর্মপন্থার সমর্থন করিয়াও প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত নামে আপত্তি করিলেন। তিনি তখন নিষ্ঠাবান গান্ধীবাদী কংগ্রেসী। কাজে ও চিন্তায় তিনি অহিংসায় বিশ্বাসী। তিনি আমাদেরে বুঝাইলেন, ঐ নামে হিংসা আছে। মোল্লারা ব্যক্তিগতভাবে সমাজের শত্রু নয়; তাদের মোল্লাকিটাই সমাজের শত্রু। যেমন বৃটিশ জাতি আমাদের শত্রু নয়, তাদের সাম্রাজ্যবাদই আমাদের শত্রু। আমরা ইংরাজ জাতকে খতম করিতে চাই না, ইংরাজ সাম্রাজ্যবাদকেই খতম করিতে চাই। তেমনি আমরা মোল্লাদেরে খতম করিতে চাই না। মোল্লাকি খতম করিতে চাই। আমরা মৌলবী সাহেবের যুক্তির কাছে হার মানিলাম। তাঁর কথামত প্রতিষ্ঠানের নাম রাখিলাম : লীগ এগেনস্ট মোল্লাইযম’। তিনি সভাপতিত্ব গ্রহণ করিলেন। অতঃপর এই নবগঠিত প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী সভার আয়োজন করিলাম আলবার্ট হলে।
এই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করিবার জন্য আমরা মওলানা আজাদ সাহেবকে অনুরোধ করিলাম। মওলানা সাহেব ঐ সময় বিশেষ কাজে অনেকদিন দিল্লি থাকিবেন বলিয়া নিজে সভাপতিত্ব করিতে পারিবেন না বলিলেন। কিন্তু তার প্রিয় সহচর ও প্রাইভেট সেক্রেটারি মওলানা আবদুর রাজ্জাক মলিহাবাদীকে সভাপতি করিতে উপদেশ দিলেন। মওলানা মলিহাবাদী মাত্র কিছুদিন আগে মিসরের জামেউল-আযহার হইতে কৃতিত্বের সঙ্গে ফাইনাল ডিগ্রি লইয়া দেশে ফিরিয়া আসিয়াছেন। তাঁর বিদ্যাবত্তার প্রশংসা দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। কাজেই মওলানা আজাদকে না পাওয়ার নৈরাশ্য আমাদিগকে খুব বেশি ব্যথিত করিতে পারিল না।
.
৭. মওলানা মলিহাবাদী
আমরা মওলানা মলিহাবাদীর সাথে দেখা করিলাম। মওলানা আজাদ আগেই বলিয়া রাখিয়াছিলেন। অতএব তিনি আমাদের সভাপতিত্ব করিতে রাজি হইলেন। দেখিলাম, মওলানা মহিলাবাদী ফুটফুটে গৌরবর্ণ খুব-সুরত সুপুরুষ। মুখ ও বুকভরা লম্বা চাপদাড়ি। চোখ-মুখ হইতে প্রতিভা ও জ্ঞানের নূর ফাটিয়া পড়িতেছে। খুশি হইলাম। ভাবিলাম, হ! তারিফের চেহারা বটে। এমন সুরতি-সিরতি পাক্কা মুসলমান আলেম দিয়াই আমাদের মোল্লাবিরোধী জেহাদ ভালরূপ চলিবে।
সভায় বিপুল জনসমাগম হইল। মওলানা মলিহাবাদী মুদ্রিত উর্দু অভিভাষণ দিলেন। উহা যেমন সুলিখিত, পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও যুক্তিপূর্ণ হইয়াছিল, তেমনি জনপ্রিয় হইয়াছিল। তিনি সহী হাদিস ও কোরআন শরিফের বহু উক্তি উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, মোল্লারা সকল ব্যাপারে ইসলামের কদর্থ করিয়া ইসলামের বদনাম ও বেইজজত করিয়াছে এবং মুসলমানদের অধঃপতন ঘটাইয়াছে। মওলানা সাহেবের অভিভাষণের যে অংশটি সভাস্থলে সবচেয়ে বেশি অভিনন্দিত হইয়াছিল, তা ছিল এই : তিনি সহী হাদিস হইতে পয়গম্বর সাহেবের উক্তি উদ্ধৃত করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, দাড়ি-মোচ মুড়ান। বর্তমানে মুসলমানদের জন্য সুন্নতে মোয়াক্কেদা। কারণ পোশাক-পাতি ও চেহারা-ছবিতে তৎকালীন সভ্য জাতি রোমানদের অনুসরণ করিতে উপদেশ দিতে গিয়াই পয়গম্বর সাহেব মুসলমানদিগকে দাড়ি রাখিতে এবং চৌগা পরিতে নির্দেশ দিয়াছিলেন। পোশাক-পাতিতে সর্বস্বীকৃত সভ্য জাতির অনুকরণ না করিলে অমুসলমানেরা মুসলমানদিগকে অসভ্য জাতি মনে করিবে এবং ইসলামের সৌন্দর্য বুঝিবার চেষ্টা না করিয়াই আগে হইতে ইসলামের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করিয়া বসিয়া থাকিবে। তারা বলিবে ঐ অসভ্য ও নোংরা আরবদের আবার একটা ধর্ম কী? ফলে ইসলাম প্রচারে ও প্রসারে বিঘ্ন হইবে। শুধু প্রচারকের পোশাকের দোষে ইসলামের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য সম্বন্ধে মানুষ অজ্ঞ থাকুক, এটা যাতে না ঘটে, সেই উদ্দেশ্যেই পয়গম্বর সাহেব চেহারা ও পোশাকে তৎকালীন সভ্য জাতির অনুকরণে মুসলমানদেরে দাড়ি রাখিতে নির্দেশ দিয়াছিলেন। অতএব, মওলানা মলিহাবাদীর যুক্তি এই : বর্তমান যুগে পাশ্চাত্য জাতিসমূহ সর্বস্বীকৃত মতে শ্রেষ্ঠতম সভ্য জাতি, মুসলমানের পোশাকে-পাতিতে তাদেরে অনুকরণ না করিলে ইসলামের প্রতি বিশ্ববাসীর হেকারত-নফরত ডাকিয়া আনা হইবে। এই কারণে মুসলমানদেরও দাড়ি-মোচ মুড়াইয়া চেহারা-পোশাক আধুনিক হইতে হইবে।
মওলানা সাহেবের উদ্ধৃত হাদিসের প্রামাণ্যতা বিচারের কোনও অধিকার আমার তখনও ছিল না, এখনও নাই। কিন্তু তার মুদ্রিত অভিভাষণের কোনও নির্ভরযোগ্য প্রতিবাদ আমার নজরে পড়ে নাই। উদ্ধৃত হাদিসসমূহকে বিশ্বাসযোগ্য ধরিয়া নিলে মওলানা মলিহাবাদীর যুক্তির সারবত্তা স্বীকার না করিয়া উপায় নাই। মওলানা সাহেবের এই বিপ্লবাত্মক উক্তির সঙ্গে তিনি বিপ্লবী একটি কাজও করিয়াছেন। এই সম্মিলনী উপলক্ষে তিনি তাঁর সুন্দর লম্বা দাড়িটি শেভ করিয়া ফেলিয়াছিলেন। এই ঘটনার পরে আরো পঁচিশ বছর মওলানা সাহেবের সাথে দেখা-শোনা হইয়াছে। ঐ সময় পর্যন্ত তিনি আর দাড়ি রাখেন নাই। মওলানা আজাদের অনুসারী হইয়াও তিনি বাটোয়ার আগে পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দেন নাই। বাটোয়ারার পরেও ভারতেই থাকিয়া যান। পরে তিনি কংগ্রেস বিরোধী বামপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহের সমর্থক হন। মাত্র কয়েক বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করিয়াছেন।
আমার বন্ধুবর আবুল হায়াত সাহেবকে প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি নির্বাচন করিয়াছিলাম। তিনি খুব উৎসাহী কর্মী ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে আমরা কিছু কিছু সাহিত্য সৃষ্টি ও কয়েকটা সভা-সমিতিও করিয়াছিলাম। তৎকালে মুসলিম শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অধিকাংশ এবং ছাত্র-সম্প্রদায়ের প্রায় সকলেই মতবাদের দিক দিয়া মোল্লাকি-বিরোধী হওয়ায় কোনও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান চালাইবার দরকার ছিল না বলিয়াই বোধ হয় আমাদের প্রতিষ্ঠান অল্পবয়সে মারা যায়।
.
৮. মোল্লা-বিরোধের প্রসারিত রূপ
কিন্তু আমার বিরোধিতা ক্রমেই প্রবল হইতে থাকিল। মোল্লা-বিরোধিতা শেষ পর্যন্ত আমাকে ইসলামের তথা সমস্ত ধর্মেরই আচার-অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপ-বিরোধী করিয়া তুলিল। আমি বুঝিলাম, খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়া আমি যে নামাজ বন্দেগি আবার ধরিয়াছিলাম, সেটা কতকটা রাজনৈতিক ঝোঁকের মাথায়, কতকটা তৎকালীন পরিবেশের সহিত সংগতি রাখার জন্য। আমি অল্পদিনেই আবার নামাজবিরোধী হইয়া উঠিলাম। নামাজবিরোধী যুক্তিগুলি অধিকতর প্রবলবেগে মাথা চাড়া দিয়া উঠে। নামাজ আচারমাত্র। আচারনিষ্ঠা শেষ পর্যন্ত মানুষকে আচার-সর্বস্ব করিয়া তোলে। ধর্মের স্পিরিট বর্জন করিয়া শুধু আচার-অনুষ্ঠান পালন করিলে মানুষ মনের দিক হইতে অধঃপতিত হইতে বাধ্য। আচার-অনুষ্ঠান নিতান্তই দৈহিক। মনের উপর তার কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব নাই। কাজেই যারা বেশি মাত্রায় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে, তারা আল্লা সম্পর্কে চিন্তা করিবার অবসরই পায় না। অথচ মুসলমানদের মধ্যেই নামাজ বন্দেগির বাড়াবাড়ি সবচেয়ে বেশি। একসময় আমি নিজেই দৈনিক পাঁচ ওয়াকত নামাজ, রাত্রে তাহাজ্জদ ও হরেক রকমের নফল নামাজের জন্য অমুসলমানদিগের নিকট গৌরব করিতাম। এখন আমার মনে হইতে লাগিল, অতিরিক্ত নামাজের বোঝাই মুসলমানদের বুদ্ধির ঘাড় ভাঙ্গিয়াছে। বন্ধুবর আবুল হায়াত বলিতেন : মুসলমানরা সারাদিন নামাজ পড়িতেই ব্যস্ত, কাজ করিবে কখন? আমি তার উপর আরো এক ডিগ্রি চড়াইয়া বলিতাম : মুসলমানরা দিন-রাত নামাজ পড়াতেই ব্যস্ত, খোদাকে স্মরণ করিবে কখন? শ্রদ্ধেয় বন্ধু ইয়াকুব আলী চৌধুরী আমাদের কথায় ব্যথা পাইতেন। তিনি বলিতেন : মসজিদগুলির দিকে তাকাইয়া দেখ, শতকরা পঁচিশ জন মুসলমানও নামাজ পড়ে না। নামাজে যদি অনিষ্ট হইত, তবে শুধু এই পঁচিশ জনেরই হইত। বেনামাজি বাকি পঁচাত্তর জনের তবে উন্নতি হয় না কেন?
.
৯. আচার-সর্বস্বতার কুফল
চৌধুরী সাহেবের এই যুক্তি একা চৌধুরী সাহেবের নয়। অনেক মুসলমানেরই ধারণা তাই। কিন্তু যুক্তিটা ত্রুটিপূর্ণ। শতকরা কতজন মুসলমান নামাজ পড়িল, আর কতজন পড়িল না, প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্নটা হইল ঈমানের দিক হইতে প্রায় সব মুসলমানই নামাজকেই ধর্মকাজ মনে করিয়া থাকে। যারা পড়িল তারা পুণ্যবান, যারা পড়িল না তারা আত্মস্বীকৃত অপরাধী। নামাজি বেনামাজি কেউই নামাজ ছাড়া অন্য কাজকে বড় ধর্মকাজ ও পুণ্যের কাজ মনে করে না। কাজেই জ্ঞান ও কর্মে তাদের উৎসাহ নাই। নামাজ পড়িলে আর কোনও ভাল কাজ করার দরকার নাই, বরঞ্চ ঠিকমত নামাজ পড়িয়া। আপনি একশ একটা পাপ করিতে পারেন। মোল্লারা হাদিস-কোরআনের ভুল ব্যাখ্যা করিয়া হাজার হাজার বই-পুস্তক প্রকাশ করিয়া মুসলমানদের মাথায় ঢুকাইয়াছে যে প্রতি ওয়াকত নামাজেই নামাজিদের আগিলা-পিছিলা সব গোনা-খাতা মাফ হইয়া যাইতেছে। বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ ধরনের নফল নামাজ পড়িলে আগিলা-পিছিলা সত্তর বছরের পাপ ধুইয়া-মুছিয়া যায়। হজ, পীরের কবর যিয়ারত, বিশেষ ধরনের তসবিহ তেলাওত, ‘দোওয়া হাবিবী’, ‘দোয়া গাঞ্জল আরশ’ বলিয়া কথিত বিশেষ বিশেষ দোয়ার বরকত ও ফজিলত সম্বন্ধে মোল্লারা এত সব অদ্ভুত চিত্রাকর্ষক বর্ণনা দিয়া থাকেন যে, ওর যে কোনও একটা কাজ করিয়াই জীবনের সমস্ত অন্যায় ও পাপের শাস্তি হইতে রেহাই পাওয়া ও বেহেশতের হকদার হওয়া যায়। সব ধর্মেই বোধ হয় কম-বেশি আচার-উপাসনার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মুসলমানদের তুলনায় নিশ্চয়ই আর সকলেরটা নিতান্ত নগণ্য।
কাজেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমার মন যত বেশি রুষ্ট হইতে লাগিল, মুসলমানদের প্রতি আমার দরদ-সহানুভূতি তত বাড়িতে লাগিল। আমার মনে হইতে লাগিল, মোল্লা-মৌলবী, শরা-শরিয়ত, পীর পয়গম্বর ও কথিত লৌকিক ধর্ম হইতেছে যালেম, আর মুসলমানরা হইতেছে। মযলুম। যালেমের প্রতি ছেলেবেলা হইতেই আমার মন বিরূপ ছিল। মযলুমের প্রতি আমার মমত্ববোধ ছিল একেবারে ইনসুটিংকটিভ উৎপ্রেরণাজাত। জমিদার ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে যে কারণে আমি রুষ্ট ছিলাম, সেই কারণেই আমি আনুষ্ঠানিক ধর্ম বা শরিয়তের উপর রুষ্ট হইলাম। ভাবিলাম, জমিদারের যুলুম হইতে কৃষক-প্রজাদেরে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীর কবল হইতে ভারতবাসীকে মুক্ত করার মতই এবং সঙ্গে সঙ্গেই মুসলমান সমাজকেও শরিয়তের যুলুম হইতে লিবারেট করিতে হইবে। মুসলমানদিগকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্পে-সাহিত্যে দুনিয়ার অন্যান্য সভ্য জাতির সমকক্ষ করিতে হইলে ঐটা করিতেই হইবে।
.
১০. ধর্মান্তর গ্রহণ অনাবশ্যক
মুসলমানদিগকে ইসলামের হাত হইতে বাঁচাইতে হইলে কি তাহাদিগকে একযোগে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করাইতে হইবে? এ নিয়াও আমি বহু চিন্তা করিয়াছি। কিন্তু দুইটা কারণে আমি মন হইতে এই চিন্তাকে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি। প্রথম কারণ, আমি এই সময় ছিলাম শরিয়তি ইসলামবিরোধী ঘোরতর মুসলমান। এই কথাটার ব্যাখ্যা আমি অন্যত্র দৃষ্টান্তসহ করিব। এখানে শুধু এইটুকু বলিলেই হইবে যে আমি মুসলমান পরিচয় দিতে গৌরব বোধ করিতাম। দ্বিতীয় কারণ, ধর্মান্তর গ্রহণ করাকে আমি অনাবশ্যক ও আত্মসম্মানবিরোধী অপমানজনক লাঞ্ছনা-ব্যঞ্জক কাজ মনে করিতাম। এটা অনাবশ্যক এই জন্য যে, ধর্মত্যাগ না করিয়াও মানুষ তার ঈপ্সিত ভাল কাজ করিতে পারে। “আমার পৈতৃক ধর্মে এই দোষ বা অসুবিধা ছিল বলিয়া আমি ধর্মান্তর করিলাম”–এ কথা যে বলে সে হয় মূর্খ, না হয় ভণ্ড মতলববাজ। হামবাগ ত নিশ্চয়ই। কারণ পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ না করিয়াও ঐ ধর্মের দোষ সে ত্যাগ করিতে এবং নয়া ধর্মের গুণটুকু গ্রহণ করিতে পারিত। কোনও ধর্মেরই অখণ্ড একটা রূপ নাই। বিভিন্ন মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠান লইয়াই ধর্ম। এই মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠানের দুই-একটা তোমার না-পছন্দ হইলেই তুমি তোমার পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করিতে বাধ্য, এটা ঠিক নয়। তেমনি অন্য ধর্মের দুই-একটা মতবাদ ও ক্রিয়াকলাপ পছন্দ হইলেই ঐ ধর্ম তোমার গ্রহণ করিতেই হইবে, এমনও কথা নয়। ময়লার জন্য কেউ কাপড় ফেলিয়া দেয় না, ধুইয়া লয়। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। হিন্দু ধর্মে বিধবা-বিবাহ নিষিদ্ধ। তাই বলিয়া যে সব হিন্দু বিধবা-বিবাহের সমর্থক তারা কি হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করিয়া মুসলমান বা খৃষ্টান হইবে? কোনও দরকার নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্মের এ বিধানটুকু বদলাইয়া খৃষ্টান ও মুসলমানদের বিধানটুকু গ্রহণ করিলেই এই কারণে ধর্ম ত্যাগ করার কোনও দরকার থাকে না। হিন্দুরা এখন তাই করিয়াছে। তাতে হিন্দুদের কোনও অপমান হয় নাই। হিন্দু ধর্মের কোনো অসম্মান হয় নাই। সেইরূপ, ইসলাম বলে, নারীর পর্দা করিতে হইবে; দাড়ি রাখিতে হইবে, মানুষের মূর্তি আঁকিতে পারিবে না। এখন আমি মুসলমান নারীর মুক্তির জন্য শেভ করিবার জন্য এবং ফটো তুলিবার জন্য ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করিব? কোনও দরকার নাই। আমরা মুসলমান থাকিয়াই নিজেদের ফটো তুলিতেছি; ঘরে ঘরে কায়েদে আযমের ফটো লটকাইবার সরকারি নির্দেশ দিতেছি। ভাস্কর্য ও চিত্রবিদ্যা শিখিবার জন্য স্কুল-কলেজ খুলিতেছি। সিনেমা করিতেছি, নাচিতেছি, গাইতেছি, দাড়ি কামাইয়া কোট-পাতলন-নেকটাই ধরিয়াছি। তাতে মুসলমানদের অপমান হয় নাই। ইসলামেরও অমর্যাদা হয় নাই। এটা গেল ধর্ম ত্যাগের অনাবশ্যকতার দিক।
.
১১. ধর্মত্যাগ অসম্মানসূচক
ধর্মত্যাগ অপমানজনক ও আত্মমর্যাদাবিরোধী বটে। আমি যেমন ইচ্ছা করিলেই বাপ-মা বদলাইতে পারি না, তেমনি ইচ্ছা করিলেই ধর্মও বদলাইতে পারি না। পিতা-মাতা, দেশ ও ধর্ম আমার ইচ্ছাধীন নির্ধারিত জিনিস নয়। এটা অ্যাকসিডেন্ট-অব-বার্থ। যারা আল্লায় বিশ্বাস করে, তারা স্বীকার করিবে যে, সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায়ই এটা হইয়াছে। মঙ্গলময় সৃষ্টিকর্তা জানিয়া-শুনিয়াই বিশেষ উদ্দেশ্যে সকলের মঙ্গলের জন্যই আমাকে এই। পিতা-মাতার ঘরে, এই দেশে, এই ধর্মে, এই সমাজে জন্ম দিয়াছেন। আমার বাপ-মার প্রতি যেমন আমার কর্তব্য আছে, আমার দেশ, সমাজ ও ধর্মের প্রতিও আমার তেমনি কর্তব্য আছে। আমার বাপ-মা যেমন লোকই হউন, তাঁদেরে ভক্তি করিতে, তাঁদেরে সেবা করিতে, তাঁদেরে প্রতিপালন করিতে হইবে। তারা যদি দরিদ্র হন, তাঁদের অভাব দূর করিতে হইবে; তাঁরা। যদি মূর্খ-জ্ঞানহীন হন তাঁদেরে জ্ঞান দান করিতে হইবে। তারা যদি দুষ্ট লোক হন, তাঁদেরে সৎপথে আনিতে হইবে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই তাঁদেরে ত্যাগ করা চলিবে না। সেটা হইবে চরম ঘৃণ্য স্বার্থপর অকৃতজ্ঞতা এবং পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য-জ্ঞানহীনতা। সমাজ, দেশ ও ধর্ম সম্বন্ধেও আমার কর্তব্য তাই। এ অবস্থায় ভাল ধর্মের সন্ধানে যদি পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করিতে হয়, তবে ভাল সমাজের সন্ধানে আমার সমাজ, ভাল দেশের তালাশে আমার দেশ ও ভাল পিতা-মাতার তালাশে বর্তমান বাপ-মাও ত্যাগ করিতে হয়। এই যুক্তিতেই আমি ধর্ম প্রচার ও প্রসলিটাইজিং-এরও বিরোধী হইলাম। আমি বলিতাম : আমাকে আমার ধর্ম ত্যাগ করিয়া তোমার ধর্ম গ্রহণ করার, দাওয়াত করার অর্থ আমার বাবাকে বাবা ডাকা ছাড়িয়া দিয়া তোমার বাবাকে বাবা বলার দাওয়াত করা। আমার এই যুক্তি শুনিয়া আমার বহু বন্ধু-বান্ধব হাসিত, অনেকে রাগ করিত। কিন্তু যুক্তি হিসাবে আমার কথা কেউ খণ্ডন করিতে পারিত না, অর্থাৎ আমি মনে করিতাম, পারিত না। কাজেই আমার মতে আমি দৃঢ় ছিলাম।
.
১২. ধর্মে-ধর্মে টলারেন্স
নিজে ঐ যুক্তির ফাঁদে পড়িয়াই এই সময় আমি সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ ও প্রচার করিতে লাগিলাম। যে ব্যক্তি নিজের বাপ-মাকে ভক্তি করে, সে অপরের বাপ-মাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা না করিয়া পারে না। যে ব্যক্তি নিজের দেশকে ভালবাসে, সে ব্যক্তি অপরের দেশ-প্রেমকে শ্রদ্ধা না করিয়া পারে না। ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি নিজের ধর্মকে ভালবাসে, সে অপরের স্বধর্মপ্রীতিকে শ্রদ্ধার চোখে না দেখিয়া পারে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অপরের বাপ-মাকে গাল দেয়, সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই নিজের বাবা-মাকেও গাল দেয়। যে ব্যক্তি অপরের দেশ-প্রেমকে অশ্রদ্ধা করে, তার নিজের দেশ-প্রেমটা নিশ্চয়ই ভণ্ডামিমাত্র। ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি অপরের ধর্মের নিন্দা করে, নিজের ধর্মের প্রতি তার কোনও শ্রদ্ধা নাই।
আমার এই মতবাদ ক্রমেই এতদূর গেল যে, আমি ধর্মে-ধর্মে টলারেন্স বা পরধর্ম-সহিষ্ণুতা ও খুব জোরের সঙ্গে প্রচার করিতে লাগিলাম। আমি বলিতে লাগিলাম : এই টলারেন্স যে ধর্মের মধ্যে যত বেশি, সে ধর্ম তত বেশি মানব-কল্যাণমুখী। আমি এই সময় কোরআন শরিফের ‘লা-ইকরাহফিদ্দিন, ধর্মের ব্যাপারে জোর-যবরদস্তি নাই’, ‘লাকুম দিনুকুম ওলিয়া দিন, তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার’; উদউ ইলাসসাবিল,… মিষ্ট ভাষায় ধর্মের দাওয়াত কর’–এই সব কথার উল্লেখ করিয়া ইসলামের কল্যাণমুখিতা প্রচার করিতাম। আমি বলিতাম, মুসলমানরা যদি কোথাও ইসলামের মূল শিক্ষা হইতে বিচ্যুত হইয়া থাকিয়া থাকে, তা এইখানে। এই ব্যাপারে হিন্দু ধর্মের শিক্ষার দিকে আমি অতিশয় আকৃষ্ট হইয়া পড়ি। হিন্দুশাস্ত্রের শিক্ষা এবং সাধারণ হিন্দুরও বিশ্বাস এই : ভগবান মহাসাগর; বিভিন্ন ধর্মমত নদী-উপনদী মাত্র। সব নদীর পানিই যেমন শেষ পর্যন্ত মহাসাগরে গিয়া পড়ে, তেমনি সব ধর্মই মানুষকে ভগবানের সান্নিধ্যে লইয়া যায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যেদিন দুনিয়ার সব ধর্ম-মতের লোকেরা এই মহাশিক্ষা গ্রহণ করিবে, সেদিন ধর্ম সত্য-সত্যই মানুষের কল্যাণ সাধন করিবে।
.
১৩. সর্বধর্ম-সমন্বয় বনাম সর্বধর্ম-পরিচয়
এই সময় ইউরোপের কোনও কোনও চিন্তানায়ক মানব-প্রেমিক দুনিয়ার সমস্ত ধর্মের সার-নির্যাস লইয়া একটা কমন-ফেথ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলিতে শুরু করেন। এ ধরনের চেষ্টা এই ভারতবর্ষের আকবর বাদশাহ, গুরুনানক ও কবির করিয়াছিলেন। কিন্তু সে চেষ্টার ফলে এক একটা নূতন ধর্মের সৃষ্টি হইয়াছে মাত্র। এ সম্পর্কে লর্ড এভারবেরী, ডা. স্মাইলস ও আরো কোনও কোনও মনীষীর কথা এইরূপ : ‘এভরি অ্যাটেম্পট অ্যাট ইউনিফিকেশন অব-রিলিজিয়নস হ্যাঁজ অনলি অ্যাডেড টু দেয়ার নাম্বার।’ অর্থাৎ ধর্মসমূহকে এক করিবার প্রত্যেক চেষ্টাই ধর্মের সংখ্যা বাড়াইয়াছে মাত্র। কাজেই ‘কমন-ফেথ’ প্রতিষ্ঠার নয়া স্লোগানে আমি খুব বেশি উৎসাহ পাইতাম না। বরঞ্চ ধর্মে-ধর্মে টলারেন্স স্থাপন এবং সব ধর্মকেই বাস্তবপন্থী করার মধ্যেই মানবকল্যাণ নিহিত রহিয়াছে বলিয়া আমি দৃঢ় মত পোষণ করিতাম।
প্রিন্সিপাল জে আর ব্যানার্জীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই সময় কলিকাতায় এবং বাংলায় অনেক জিলাতেই সর্বধর্ম-সমন্বয় সম্পর্কে বছরে বছরে একটি আলোচনা সভা হইত। তাতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও ব্রাহ্মসমাজের বিভিন্ন বক্তা নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা করিতেন। এই সভার উদ্যোক্তারা একবার আমাকে ঐ সভায় বক্তৃতা করিতে বলেন। আমি এই শর্তে বক্তৃতা করিতে রাজি হই যে, বক্তারা যার-তার ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা না করিয়া অপর যে কোনও ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা করিবেন। আমি হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা করিতে রাজি হই। সভায় সে রকম ব্যবস্থা হয়। আমি হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা করি। হিন্দু ধর্ম পলিথিস্ট বা বহু ঈশ্বরবাদী পৌত্তলিক ধর্ম, আমার বক্তৃতায়। আমি ঐ অভিযোগ খণ্ডন করি। হিন্দু ধর্মে এক খোদার বদলে তেত্রিশ কোটি খোদা মানা হয়, এটাকে উচ্চস্তরের দার্শনিক মতবাদ বলিয়া ব্যাখ্যা করি। আমি বলি : এই মতবাদের অর্থ এই যে, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। প্রত্যেক ব্যক্তির বিবেকই তার খোদা। একজনের বিবেকের কাছে যা পাপ, অপরের বিবেকের কাছে তাই পুণ্য। দৃষ্টান্ত : মুসলমান ডাকাতেরা আল্লাহু আকবর’ বলিয়া হিন্দু বাড়ি এবং হিন্দু ডাকাতেরা কালী মাই কি জয়’ বলিয়া মুসলমানের বাড়ি লুট করে। গত মহাযুদ্ধে জার্মান কায়সর ও মিত্র পক্ষের উইলসন-লয়েড জর্জ উভয় পক্ষই যুদ্ধ জয়ের জন্য বাইবেল হাতে গির্জায় প্রার্থনা করিয়াছিলেন।
.
১৪. ‘ইসলাম-হিতৈষী’ বনাম ‘মুসলিম-হিতৈষী’
সুতরাং ইসলামের উপর আমি ঘোরতর খাফা হইলেও মুসলমানদের কল্যাণের জন্য ইসলাম ত্যাগ করা প্রয়োজন মনে করিলাম না। আমার উদ্দেশ্য মুসলমানদের কল্যাণ করা। আল্লাহ যখন আমাকে মুসলমান সমাজে মুসলমান পিতা-মাতার ঘরে পয়দা করিয়াছেন, তখন আমার পিতা-মাতা তথা সমাজের প্রতি একটা কর্তব্য দিয়াই আমাকে পয়দা করিয়াছেন। মুসলমানদের প্রতি এই কর্তব্য করিতে গিয়া ইসলাম ধর্মকে যদি আমি প্রতিবন্ধক মনে করি, এই প্রতিবন্ধক দূর করিবার জন্য যদি মুসলমানদেরে একযোগে ইসলাম ত্যাগ করিয়া খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করিবার উপদেশ দেই, মুসলমানরা আমার উপদেশ গ্রহণ করিয়া যদি একযোগে খৃষ্টান হইয়া যায় এবং তার ফলে তাদের যদি উন্নতি হয়, তবে সে উন্নতি মুসলমানদের হইল না, হইল খৃষ্টানদের। কারণ তখন তারা আর মুসলমান নাই, খৃষ্টান-ধর্মী হইয়া গিয়াছে। কিন্তু গোড়ায় আমার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের উন্নতি করা, খৃষ্টানদের উন্নতি করা নয়। তাদের প্রতি আমার জন্মগত কোনও দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল না।
অতএব মুসলমানদিগকে মুসলমান রাখিয়াই তাদের কল্যাণ করিতে হইবে। মুসলমান সমাজে, ইসলাম ধর্মে ও মুসলিম পিতা-মাতার ঘরে পয়দা করিয়া সৃষ্টিকর্তা আমার উপর এই কর্তব্য আরোপ করিয়াছেন। আমি যদি মুসলমান বাপ-মার ঘরে পয়দা না হইয়া হিন্দু বাপ-মার ঘরে জন্মাইতাম, তবে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের প্রতি আমার অবিকল এই কর্তব্য হইত। এই কথাটাই আমি গোঁড়া মুসলমান বন্ধুদেরে উত্ত্যক্ত করিবার জন্য বারে বারে বলিতাম। তারা যখন ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় মুখে খই ফুটাইত তখনই আমি বলিতাম : তুমি যদি হিন্দু বাপ-মার ঘরে পয়দা হইতে, তবে খুব গোঁড়া হিন্দু হইতে; হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় ও ইসলামের কুৎসায় তোমার মুখে এমনি খই ফুটিত।