পেপারব্যাকে উপন্যাস লেখার জন্য সিগারেটের প্যাকেটের ভেতর দিককার সাদা অংশে হুমায়ূন ভাই লিখলেন, ১০০০ (এক হাজার) টাকা বুঝিয়া পাইলাম। উপন্যাস লেখার জন্য ওটাই তাঁর জীবনের প্রথম অগ্ৰিম নেওয়া। হাতের কাছে কাগজ ছিল না বলে সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তার পেছন দিকে লেখা হলো। এই ঘটনা ঘটল মুনতাসীর মামুনের বাসায়, মগবাজারের ইস্পাহানি কলোনিতে।
সেই বাসা বা বাড়িটি বোধহয় এখনো মামুন ভাই রেখে দিয়েছেন। ইস্পাহানি কলোনির ভেতরে যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই দেখেছেন গাছপালায় ঘেরা, সামনে সবুজ ঘাসের লন, হলুদ একতলা পুরনো ধরনের স্টাফ কোয়ার্টার করেছিল ইস্পাহানি কর্তৃপক্ষ। স্নিগ্ধ নির্জন সুন্দর পরিবেশ। ও রকম কোয়ার্টারে সেই সময় থাকতেন মামুন ভাই। এখনো কোয়ার্টারটি তাঁর আছে, তবে তিনি ওখানে থাকেন না। প্রতিটি রুম ভর্তি বই। শুনেছি তিনি অনেক সময় লেখালেখির কাজ করতে যান ওখানে।
১৯৮৫ সাল। ২০-২২ দিন ধরে সংবাদপত্রে কর্মবিরতি চলছে। আলমগীর রহমান কাজ করেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রা-য়। সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী। শাহরিয়ার কবির, মাহফুজউল্লাহ, রেজোয়ান সিদ্দিকী কাজ করেন। মুনতাসীর মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক অথবা সহকারী অধ্যাপক। তার পরও বিচিত্রার সঙ্গে যুক্ত। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিচিত্ৰায়। সংবাদপত্রে কর্মবিরতি চলে বলে অফিসে বসে চা-সিগারেট খেয়ে সময় কাটে সবার।
শাহাদত চৌধুরীর মাথাভর্তি নানা রকম আইডিয়া। আলমগীর রহমানকে বললেন, কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্ৰকাশনীর মতো করে বাংলাদেশের লেখকদের মৌলিক উপন্যাস বের করুন।
আলমগীর ভাই রাজি হয়ে গেলেন। কারণ তার রক্তের সঙ্গে প্ৰকাশনা। বাবা আবদুস সোবহান বিশাল প্রকাশক। পাকিস্তান বুক করপোরেশন, স্বাধীনতার পর হলো বাংলাদেশ বুক করপোরেশন, আলমগীর ভাইয়ের বাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখনো সেই প্রতিষ্ঠান আগের মতোই সুনাম নিয়ে চলছে। বাবা বেঁচে থাকতেই আলমগীর ভাইয়ের বড় ভাই খলিলুর রহমান যুক্ত হয়েছিলেন সেই ব্যবসার সঙ্গে। এখনো তিনিই দেখছেন প্রতিষ্ঠানটি।
স্বাধীনতার দু-এক বছর আগে আলমগীর ভাইও মাঝেমধ্যে গিয়ে বসতেন পাটুয়াটুলীর পাকিস্তান বুক করপোরেশনে। পাঠ্য বই, রেফারেন্স বই প্রকাশ করত প্রতিষ্ঠানটি। আলমগীর ভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিছু মৌলিক বই প্রকাশ করবেন। কারণ তখন তার মাথায় সাহিত্যের পোকা ঘোরাঘুরি করছে। নিজে গল্প লেখেন। কামাল বিন মাহতাব সম্পাদিত ছোটগল্পের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ছোটগল্পতে নিয়মিত তার গল্প ছাপা হয়। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন কিন্তু ওই বয়সেই তাঁর আড্ডার সঙ্গী শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ। গেণ্ডারিয়ায় পুরনো আমলের বিশাল জমিদারবাড়ির মতো বাড়ি আলমগীর ভাইদের। কাছাকাছি থাকেন হায়াৎ মামুদ। হায়াৎ ভাইয়ের ছোট ভাই তাঁর বন্ধু। একসময় হায়াৎ ভাইও বন্ধু হয়ে গেলেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ তখন সিলেটের এমসি কলেজে বাংলার প্রভাষক। প্ৰবন্ধ, কবিতা, গল্প-সবই লেখেন। আলমগীর ভাই সিলেটে গিয়ে হাজির হলেন। মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধের বই ছাপবেন। মান্নান ভাই বললেন, প্ৰবন্ধ না, আমার একটা গল্পের বই ছাপুন।
আলমগীর ভাই রাজি হলেন। মান্নান সৈয়দের গল্পগ্রন্থ সত্যের মতো বদমাসএর পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঢাকায় এলেন। অতি যত্নে ছাপা হলো বই। সরকার সেই বই বাজেয়াপ্ত করল। নিষিদ্ধ হয়ে গেল সত্যের মতো বদমাস। আলমগীর ভাই হতাশ হয়ে এমএ পড়তে চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য এই ফাঁকে হায়াৎ মামুদের বইও ছাপা হয়েছিল তাদের প্রকাশনা সংস্থা থেকে।
রাজশাহীর পাট চুকিয়ে পড়াশোনা শেষ করে স্বাধীনতার পর সাংবাদিকতা শুরু করলেন আলমগীর ভাই। ১৯৮৫ সালে এসে আবার প্রকাশক হয়ে গেলেন শাহাদত চৌধুরীর বুদ্ধিতে। মুনতাসীর মামুনের বাসায় বসলেন তারা। আমিও ছিলাম সেই বিকেলে তাদের সঙ্গে। প্ৰকাশনার নাম ঠিক হলো অবসর। লেখক তালিকায় আমিও আছি। তবে প্রথম বইটি লিখবেন হুমায়ূন আহমেদ। এক হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হলো তাঁকে। হুমায়ূন ভাই লিখলেন তাঁর আদিভৌতিক বিষয়ের উপন্যাস দেবী। পেপারব্যাক সংস্করণ বেরোল।
এক বইতেই বাজিমাত। সংস্করণের পর সংস্করণ হতে লাগল। পরে হার্ড বাইন্ডিংয়েও বেরোল দেবী। এ পর্যন্ত বোধহয় এক লাখ কপির ওপর বিক্রি হয়েছে। স্টেজ নাটক হয়েছে।
ওই উপন্যাসেই প্রথম মিসির আলী নামের একটি চরিত্র এল, যে চরিত্র এখন বাঙালি পাঠকের মুখে মুখে। মিসির আলীকে নিয়ে বহু উপন্যাস পরবর্তী সময়ে লিখেছেন হুমায়ূন ভাই। তাঁর দুটি জনপ্রিয় চরিত্রের একটি হিমু অন্যটি মিসির আলী।
দেবীর পর হুমায়ূন ভাই লিখলেন নিশিথিনী। সেই উপন্যাসও জনপ্রিয়তার রেকর্ড গড়ল। আলমগীর ভাইয়ের অবসর বিশালভাবে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তিনি করলেন প্রতীক। হুমায়ূন ভাইয়ের বহু বইয়ের প্রকাশক তিনি। খণ্ডে খণ্ডে ছাপছেন হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসসমগ্র। ১০-১২ খণ্ড বোধহয় বেরিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের রুচিশীল প্রকাশনার অন্যতম অবসর ও প্রতীক। বিভিন্ন বিষয়ের অসাধারণ সব বই ছাপছেন আলমগীর ভাই। আন্তর্জাতিক মানের রান্নার বই আছে অনেক।
রান্নার বই প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যপ্রকাশও বড় ভূমিকা রেখেছে। অসাধারণ সব রান্নার বই প্রকাশ করেছে তারা। আর প্রডাকশন এত চমৎকার, হাতে নিলে মনেই হয় না। বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের বই প্ৰকাশ পেতে পারে।
হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে অন্যপ্রকাশের সম্পর্ক তৈরির ঘটনাটা বলি। তার আগে বোধহয় আমার নিজের কথাও কিছু বলা দরকার, অর্থাৎ অন্যপ্রকাশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হলো কীভাবে।
সেটা হয়েছিল হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে অন্যপ্রকাশের সম্পর্কের আগে। বোধ হয় ১৯৯০-৯১ সাল। নানা ধরনের দুঃখদৈন্য কাটিয়ে আমি একটু একটু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। সেই টিনশেডের বাসা থেকে গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের চারতলার ওপর ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠেছি। ছয়-সাত শ বর্গফুটের ফ্ল্যাট হবে। পাশের ফ্ল্যাটটি আরও ছোট। কাকলি প্রকাশনীর সেলিম ভাই থাকতেন।
কাকলিও খুব বড় প্রকাশনা সংস্থা এখন। সেলিম ভাই উত্তরায় ছয় তলা বাড়ি করেছেন। ওই অতটুকু ফ্ল্যাট ছেড়ে একসময় তিনি চলে গেলেন। সাহস করে ওই ফ্ল্যাটটাও আমি ভাড়া নিলাম। দুটি অতি ক্ষুদ্র কক্ষ। একটায় আমার বসার ব্যবস্থা, আরেকটায় লেখার টেবিল-চেয়ার, বুকশেলফ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওখানে বসে লিখি। পাশের ফ্ল্যাট থেকে চা-নাশতা পাঠান স্ত্রী। আমার কাছে কেউ এলে তারাও ওখানটায়ই বসেন।
আমার ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটে বহুবার গেছেন হুমায়ূন ভাই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এলেন একবার, সমরেশ মজুমদার এলেন দু-তিনবার, রফিক আজাদ, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেকেই।
এক দুপুরে কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে দেখি আবু ইসহাক দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে আমার মনে হয়েছিল দৃশ্যটা বাস্তব, না আমি স্বপ্ন দেখছি!
এত বড় একজন লেখক আমার ফ্ল্যাটে!
আবু ইসহাক সাহেবের হাতে একটা বই। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস পদ্মার পলিদ্বীপ। বইটি তিনি আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য বাংলাবাজার থেকে ঠিকানা জোগাড় করে আমার ফ্ল্যাটে এসেছেন।
সেটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।
পদ্মার পলিদ্বীপ-এর প্রথম নাম ছিল মুখর মাটি। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার পত্রিকায় মুখর মাটি নামে ছাপা হচ্ছিল। পাশাপাশি ছাপা হচ্ছিল। আমার প্রথম উপন্যাস যাবজীবন। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। রফিক আজাদ। বই করার সময় প্রচুর ঘষামাজা করেছেন ইসহাক সাহেব, নাম বদলেছেন। বাংলাদেশের নদী আর চরের জীবন নিয়ে পদ্মার পলিদ্বীপ-এর মতো উপন্যাস আর একটিও লেখা হয় নি। এ এক কালজয়ী উপন্যাস।
আমার ওই ফ্ল্যাটে একদিন এলেন চার যুবক। তাদের সঙ্গে পরিচয় বাংলা একাডেমীর বইমেলায়। পজিট্রন নামে একটি প্রকাশনা করেছেন। এখন অন্যদিন নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা করবেন এবং প্রকাশনা করবেন। বাংলা একাডেমীতে পরিচয়ের সময়ই আমার বই ছাপার আগ্রহ প্ৰকাশ করলেন। তখনো তাদের প্রত্যেকের নাম জানা হয় নি। যেদিন আমার ফ্ল্যাটে এলেন, নাম জানলাম চারজনেরই মাজহারুল ইসলাম, মাসুম রহমান, সিরাজুল কবির চৌধুরী (এই যুবকের ডাকনাম কমল) আর আবদুল্লাহ্ নাসের। তারা আমার বইয়ের জন্য এসেছেন।
চা খেতে খেতে মাজহার আচমকা একটা পলিথিনের শপিং ব্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে দুই লাখ টাকা আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বইমেলায় আপনার একটা বই চাই।
আমি কী করব খানিকক্ষণ বুঝতেই পারলাম না। সেদিনকার আগে দুই লাখ টাকা আমি একসঙ্গে কখনো চোখেই দেখি নি। একটা বইয়ের জন্য এত টাকা অগ্ৰিম! এই টাকা দিয়ে কী করব বুঝতেই পারছিলাম না।
মাজহারদের সেই টাকায় আমার জীবন ঘুরতে শুরু করেছিল। হুমায়ূন ভাইয়ের ক্ষেত্রে আরও বড় ঘটনা ঘটালেন এই চার যুবক। হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে গিয়ে হাজির একদিন-স্যার, আমরা আপনার একটা বই করব?
হুমায়ূন ভাইয়ের তত দিনে অনেক প্রকাশক। ঈদসংখ্যার লেখা, বইমেলার লেখা, নাটক লিখছেন বিটিভিতে (তখনো স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো আসে নি)। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললেন, একটা বইয়ের জন্য আমাকে ১০ লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হবে।
তারা একটু চমকালেন, চিন্তিত হলেন। সম্ভবত ৯৭-৯৮ সালের কথা। কোনো কথা না দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হুমায়ূন ভাই ভাবলেন, যাক ঝামেলা গেছে।
হুমায়ূন ভাই তখন সিনেমা তৈরির পরিকল্পনা করছেন। বিজয়নগরের ওদিকে একটা অফিস নিয়েছেন। মাজহাররা চারজন পরদিন সেই অফিসে গিয়ে হাজির। একজনের হাতে বাজার করার চটের বড় একটা ব্যাগ। হুমায়ূন ভাইয়ের সামনে গিয়ে ব্যাগটা উপুড় করে দিলেন- স্যার, এই যে ১০ লাখ টাকা। বই দেবেন কবে?
তার পরের ইতিহাস আর বলার দরকার নেই। এখন অন্যপ্ৰকাশ বিশাল ব্যাপার। হূমায়ুন ভাইয়ের প্রধান প্রকাশক। বাংলা একাডেমী বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে পৌঁছতে ২০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা সময় লাগে, এমন লাইন। শুধু হুমায়ূন ভাইয়ের বইয়ের জন্য।
আমি একবার বলেছিলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের কারণে বাংলা একাডেমীর বইমেলা একদিকে কাত হয়ে গেছে। শুনে তসলিমা নাসরিন খুব হেসেছিলেন।