০৯. পেটারকে আমি জিজ্ঞেস করি

মঙ্গলবার, ২ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি

শনিবার সন্ধ্যেবেলায় পেটারকে আমি জিজ্ঞেস করি, বাপিকে আমাদের ব্যাপার কিছুটা জানানো আমার উচিত কিনা; খানিকটা আলোচনার পর এই মতে পৌঁছোয় যে, আমার জানানো উচিত। শুনে আমার ভালো লাগল, পেটার ছেলেটার মধ্যে সততা আছে। নিচে নেমে গিয়ে তৎক্ষণাৎ বাপির সঙ্গে আমি গেলাম খানিকটা পানি আনতে; সিঁড়িতে যেতে যেতে বাপিকে বললাম, বাপি তুমি হয়ত শুনেছ, পেটার আর আমি একসঙ্গে হলে আমরা দুজনের মধ্যে তেপান্তরের দুরত্ব রেখে বসি না। তুমি কি সেটা অন্যায় বলে মনে কর?’ বাপি একটু চুপ করে থেকে তারপর বললেন, ‘না, আমি অন্যায় মনে করি না। তবে তুমি একটু সাবধান হয়ো, আনা; এখানে এত বদ্ধ জায়গার মধ্যে তোমাদের থাকতে হয়। যখন আমরা ওপরতলায় গেলাম, একই বিষয়ে উনি অন্য কয়েকটা কথা বললেন। রবিবার সকালে বাপি।

আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আনা, তোমার কথাটা নিয়ে আমি আরও খানিকটা ভেবে দেখলাম-’ শুনেই তো আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। এখানে এই বাড়িতে সত্যি বলতে, ওটা ঠিক উচিত কাজ নয়। আমি ভেবেছিলাম তোমরা দুজনে দুজনের নিছক প্রাণের বন্ধু। পেটার কি প্রেমে পড়েছে।

আমি বললাম, ‘উঁহু, একেবারেই নয়।’

‘তুমি জানো, তোমাদের দুজনকেই আমি বুঝি; কিন্তু এক্ষেত্রে তোমাকেই নিজের রাশ টেনে ধরতে হবে। অত ঘন ঘন তুমি ওপরে যেয়ো না, যতটা না দিলে নয় ততটাই ওকে উৎসাহ দেবে। এসব জিনিস ছেলেরাই সবসময় উদ্যোগী হয়; মেয়েরা তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থা হলে এসব কথা ওঠে না। যেখানে চলাফেরার স্বাধীনতা থাকে, সেখানে আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হয়, কখনও কখনও দূরে কোথাও যেতে, খেলাধুলো করতে এবং আরও অনেক কিছু করতে পারো। কিন্তু এখানে, যদি কেবলই একসঙ্গে থাকো, কোথাও চলে যেতে চাইলে যেতে পারবে না; ঘণ্টায় ঘন্টায় দুজনে দুজনকে দেখছ–বলতে গেলে অষ্ট্রপ্রহর। নিজেকে বাঁচিয়ে চলো, আনা–এটাকে বড় বেশি গুরুত্ব দিও।’

‘আমি তা দিই না, বাপি। কিন্তু পেটার খুব ভদ্র ছেলে, সত্যিই খুব চমৎকার ছেলে।

‘হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু খুব একটা শক্ত ধাতুতে গড়া ছেলে সে নয়; যেমন সহজেই প্রভাব খাঁটিয়ে ওকে ভালোর দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, তেমনি খারাপের দিকেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ওর ভালোর জন্যে আমি আশাকরি ওর ভালো দিকটাই সব কিছু ছাপিয়ে উঠবে–কারণ, স্বভাবের দিক থেকে ও তাই।’

আমরা কিছুটা কথা বলার পর বাপি রাজী হলেন পেটারের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলতে।

রবিবার সকালে পেটার আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলেছ, আনা?’

আমি বললাম, হ্যাঁ। কী কথা হল বলছি। বাপি এ জিনিসটাকে খারাপ বলে মনে করেন। কিন্তু ওঁর মতে, এখানে, সারাক্ষণ এত কাছাকাছির মধ্যে, সহজেই খটাখটি বেধে যেতে পারে।

‘কিন্তু মনে নেই, আমরা কথা দিয়েছিলাম কক্ষনো ঝগড়া করব না; আমি সে প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।’

‘আমিও কথা রাখব, পেটার। কিন্তু বাপির বক্তব্য তা ছিল না, উনি কেবল ভেবেছিলেন। আমরা দুজনে প্রাণের বন্ধু; তোমার কি মনে হয়, এখনও আমরা তা হতে পারি?

‘আমি পারি–তুমি নিজের সম্পর্কে কী বলো?’

‘আমিও পারি। বাপিকে আমি বলেছি তোমাকে আমি বিশ্বাস করি; বাপিকে যতটা বিশ্বাস করি ততটা। তোমাকে আমি আমার বিশ্বাসের যোগ্য বলে মনে করি; ঠিক নয়, পেটার?’

‘আশা করি, ঠিক।’ (পেটার খুব লজ্জা পেয়েছিল, মুখটা ওর রাঙা হয়ে উঠেছিল।)

আমি বলতে লাগলাম, তোমার ওপর আমার ভরসা আছে পেটার। আমি মনে করি তোমার অনেক সদ্‌গুণ আছে এবং জীবনে তুমি উন্নতি করবে।

এরপর অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলাপ করলাম। পরে বললাম, ‘যখন আমরা এ জায়গা ছেড়ে যাব, আমি ভালো করেই জানি তখন আর আমাকে নিয়ে তুমি মাথা ঘামাবে না।’

পেটার দপ করে জ্বলে উঠল। ‘মোটেই তা সত্যি নয়, আনা–মোটেই সত্যি নয়। আমার সম্বন্ধে তুমি এ রকম ভাববে, তা হয় না।’

এই সময় নিচের তলায় আমার ডাক পড়ল।

বাপি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন। ও আমাকে আজ সে কথা বলল। ও বলল, তোমার বাবা বললেন আমাদের ভাব আজ হোক কাল হোক ভালবাসায় পরিণত হতে পারে। তার উত্তরে আমি বললাম নিজেকে আমরা সংযত করে রাখব।

বাপি আজকাল সন্ধ্যেগুলোতে আমাকে ওপরে যেতে দিতে ততটা চান না। সেটা আমার মনঃপূত নয়। পেটারের সঙ্গে সময় কাটাতে আমার ভালো লাগে বলে শুধু নয়–আমি ওকে বলেছি যে, আমি ওকে বিশ্বাস করি। আমি ওকে যে বিশ্বাস করি তাতে ভুল নেই এবং সেটা আমি ওকে দেখাতেও চাই–আমি যদি বিশ্বাসের অভাবের দরুন নিচে বসে থাকি, তাহলে আর সেটা হয় না।

না, আমি যাচ্ছি।

ইতিমধ্যে ডুসেলের নাটকটা সুভালাভালি চুকে গিয়েছে। শনিবার সন্ধ্যেবেলা খাওয়ার টেবিলে সুললিত ডাচ ভাষায় ডুসেল তার ভুলের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করলেন।

ফান ডান তৎক্ষণাৎ সুন্দর ভাবে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিলেন। ডুসেলের নিশ্চয়ই সারাটা দিন লেগে গিয়েছিল অন্তর থেকে ঐ ছোট্ট শিক্ষাটা মেনে নিতে।

রবিবার, ওঁর জন্মদিন, নির্ঝঞ্ঝাটে কেটে গেল। আমরা ওঁকে দিলাম ১৯১৯-এর এক বোতল ভালো পুরনো মদ, ফান ডানদের (এখনও ওঁদের উপহার দেওয়ার মুরোদ আছে) দেওয়া, এক বোতল আচার আর এক প্যাকেট দাড়ি কামানোর ব্লেড, ক্রালারের কাছ থেকে লেবুর জ্যাম এক বয়াম, মিপের দেওয়া একটি বই, ‘ক্ষুদে মার্টিন’ আর এলির কাছ থেকে একটি গাছের চারা। উনি আমাদের প্রত্যেককে একটি করে ডিম খাওয়ালেন।

আজ এ পর্যন্ত থাক। কাল আবার কথা হবে।

তোমার আনা।

.

বুধবার, ৩ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

প্রথম, কেবল সপ্তাহের খবরাখবর। রাজনীতি থেকে আমরা একটি দিন ছুটি পেয়েছি। ঢাক পিটিয়ে বলবার মত একেবারেই কোনো খবর নেই। এখন আমিও আস্তে আস্তে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি যে আক্রমণ আসছে। শত হলেও, রুশরা সব চেঁছেছে নিয়ে যাবে, সেটা ওরা হতে দেবে না। সেদিক থেকে ওরাও এক্ষুনি কিছু করছে না।

রোজ সকালে আজকাল আবার কুপহুইস আসছেন। পেটারের ডিভানের জন্যে উনি নতুন স্প্রিং আনিয়েছেন। কাজেই পেটারকে এখন খানিকটা ডিভানে গদি লাগানোর কাজ করতে হবে। ব্যাপারটাতে ও-যে মোটেই উৎসাহী নয়, সেটা বিলক্ষণ বোঝা যায়।

আমি কি তোমাকে বলেছি, বোখার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না? যাকে বলে, একেবারে নিখোঁজ। গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবারের পর থেকে ওর আর টিকি দেখা যায়নি। আমার ধারণা, ও এখন গঙ্গাপ্রাপ্ত হয়ে বেড়ালের স্বর্গে এবং কোনো জীবপ্রেমিক ওটা থেকে রসালো পদ বানিয়ে আস্বাদন করছে। হয়ত ওর চামড়ায় তৈরি ফারের টুপি কোনো ছোট মেয়ের মাথায় শোভা পাবে। পেটারের এই নিয়ে খুব মন খারাপ।

শনিবারের পর থেকে আমাদের দ্বিপ্রহরিক খাবারের সময় বদলে সকাল সাড়ে এগারোটা করা হয়েছে; ফলে এক কাপ ভর্তি ডালিয়া খেয়ে আমাদের টিকে থাকতে হবে। এতে এক বেলার খাবার বাঁচবে।

তরিতরকারি এখনও খুব দুর্ঘট; আজ সন্ধ্যেবেলা আমাদের পচা লেটুসের পাতা সেদ্ধ খেতে হল। কাঁচা লেটুস পালংশাক আর লেটুস সেদ্ধ ছাড়া আর কিছু নেই। এর সঙ্গে আমরা খাচ্ছি পচা আলু, সুতরাং উপাদেয় মিশ্রণ।

সহজেই এটা কল্পনা করতে পারে যে, এখানে আমরা প্রায়ই সখেদে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি, ‘যুদ্ধবিগ্রহে কী লাভ, বলো তো, কী লাভ? লোকে কেন শান্তিতে একসঙ্গে বসবাস করতে পারে না? এত সব ধ্বংসকাণ্ড কেন?’

খুবই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন; কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পায়নি। এটা ঠিক, কেন ওরা বানিয়ে চলেছে আরও আরও রাক্ষুসে প্লেন, আরও ভারী ভারী বোমা, আর একই সঙ্গে, পুনর্গঠনের জন্যে পূর্বনির্মিত ঘরবাড়ি? কেন যুদ্ধের জন্যে খরচ হবে রোজ কোটি কোটি টাকার আর চিকিৎসার খাতে, শিল্পীদের আর গরিব মানুষদের কপালে একটি কানাকড়িও জুটবে না?

পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন বাড়তি খাবার পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কেন তখন কিছু লোককে না খেয়ে মরতে হচ্ছে? মানুষের কেন এমন মাথা খারাপ?

শুধু বড় বড় লোক, রাষ্ট্রনায়ক আর পুঁজিপতিরাই যে এর জন্যে দায়ী, আমি তা মনে করি না। যে কেউকেটা, সেও সমান দায়ী–নইলে দুনিয়ার মানুষ অনেক দিন আগেই বিদ্রোহে ফেটে পড়ত। লোকের ভেতর একটা প্রবৃত্তি রয়েছে ভেঙেচুরে ফেলার, আছে মেরে ফেলার, খুন করার আর ক্ষিপ্ত হওয়ার প্রবৃত্তি; যতদিন ব্যক্তি নির্বিশেষে সমস্ত মনুষ্য সমাজে বড় রকমের পরিবর্তন না আসে, ততদিন যুদ্ধ হতেই থাকবে, যা কিছু গড়া হয়েছে, বাড়ানো আর ফলানো হয়েছে–সবই ধ্বংস আর বিকল হয়ে যাবে, তারপর মানুষকে সবকিছু আবার কেঁচেগণ্ডুষ করতে হবে।

আমি অনেক সময় ম্রিয়মাণ হই, কিন্তু কখনও মুষড়ে পড়ি না। আমাদের এই অজ্ঞাতবাসকে আমি এক বিপজ্জনক সাহসী কাজ বলে মনে করি, যা একাধারে রঙদার আর রসালো। আমার ডায়রিতে অভাব-অনটন নিয়ে যা কিছু সবই আমি রসিয়ে রসিয়ে লিখেছি। এখন আমি ঠিক করে ফেলেছি যে অন্য মেয়েদের চেয়ে আলাদা রকম জীবন আমি যাপন করব এবং এরপর আমার জীবন হবে সাধারণ বাড়ির বউদের চেয়ে পৃথক। আমার আরম্ভটাই হয়েছে এত মজাদার ভাবে যে, শুধু সেই কারণেই সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্তগুলোর কৌতুকময় দিকটা নিয়ে আমাকে হাসতেই হয়।

আমার বয়স কম এবং আমার মধ্যে নিহিত অনেক গুণ আছে; আমার আছে তারুণ্য আর শক্তি সামর্থ্য। আমার বেঁচে থাকাটাই একটা রোমাঞ্চকর অভিযান। আমি এখনও তার মাঝখানে রয়েছি এবং আমার পক্ষে সারাদিন গাইগুই করা সম্ভব নয়। হাসিখুশি স্বভাব, প্রচুর খোশমেজাজের ভাব আর দৃঢ়তা–এমন অনেক কিছুই আমি পেয়েছি। আমি ভেতরে ভেতরে যে বেড়ে উঠছি, মুক্তির দিন যে এগিয়ে আসছে, প্রকৃতি কী যে সুন্দর, চারপাশের মানুষজন কী যে ভালো, এই দুঃসাহসিক অভিযান যে কী মজাদার–এটা আমি প্রতিদিন অনুভব করছি! তাহলে আমার কী হয়েছে যে, আমি মূষড়ে পড়তে যাব?

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ৫ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

বাপি আমার ওপর প্রসন্ন নন; উনি ভেবেছিলেন রবিবারে ওঁর সঙ্গে আমার কথা হওয়ার পর আমি আপনা থেকেই রোজ সন্ধ্যেবেলা ওপরে যাওয়া ছেড়ে দেব। উনি চান কোনো গলা জড়াজড়ি’ হবে না, কথাটা শুনলেই আমার পিত্তি জ্বলে যায়। এ নিয়ে বলাকওয়া করাটাই খারাপ, তার ওপর কেন উনি অমন বিশ্রী করে বলবেন? ওঁর সঙ্গে এ নিয়ে আজ আমি কথা বলব। মারগট আমাকে কিছু ভালো উপদেশ দিয়েছে। সুতরাং শোনো; মোটের ওপর আমি যা বলতে চাই তা এই

বাপি, আমার মনে হয় আমার কাছ থেকে তুমি একটা জবানবন্দী চাও; আমি তাই তোমাকে দেব। তুমি আমার কাছ থেকে আরও বেশি সংযম আশা করেছিলে, না পেয়ে আমার ওপর তুমি বীতশ্রদ্ধ হয়েছ। আমার ধারণা, তুমি চাও আমি চৌদ্দ বছর বয়সের খুকী হয়ে থাকি। কিন্তু সেইখানেই তোমার ভুল।

১৯৪২-এর জুলাই থেকে কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত, সেই যবে থেকে আমরা এখানে আছি দিনগুলো আমার খুব সুখে কাটেনি। তুমি যদি জানতে, সন্ধ্যে হলে আমি কত যে কেঁদেছি, কত যে অসুখী ছিলাম আর কত যে নিঃসঙ্গ বোধ করেছি–তাহলে তুমি বুঝতে কেন আমি ওপরে যেতে চাই।

এখন আমি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যখন আমি সম্পূর্ণভাবে নিজের ভরসায় বাঁচতে পারি–মা-মণি বা, সেদিক থেকে, আর কারো ওপরই আমাকে নির্ভর করতে হবে না। কিন্তু এ জিনিস রাতারাতি ঘটেনি; লড়াইটা হয়েছে কঠিন আর তীব্র এবং আজ এই যে আমি আত্মনির্ভর হয়েছি তার পেছনে আছে অনেক অশ্রুজল। তুমি আমাকে ঠাট্টা করতে পারো এবং আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো, নাও করতে পারো, তাতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। আমি জানি আমার কাছে এক পৃথক ব্যক্তিসত্তা এবং তোমাদের কারো কাছে আমার একটুও কোনো দায় নেই। আমি তোমাকে এটা বলছি তার একটাই কারণ; না বললে পাছে তুমি আমাকে মনে-এক, মুখে-আর এক ভাবো। কিন্তু আমি কী করি না করি তার জমা-খরচ আর কাউকে আমার দেবার নেই।

‘আমার কষ্টের সময় সবাই তোমরা চোখে ঠুলি আর কানে তুলো দিয়ে বসেছিলে, কেউ আমাকে সাহায্য তো করোই নি, উল্টে আঙুল নেড়ে বলার মধ্যে শুধু বলেছ আমি যেন হুড়মাতুনি না করি। যাতে সারাক্ষণ মুখ ভার করে থাকতে না হয় তারই জন্যে আমি হুড়মাতুনি করেছি। আমি গোয়ার্তুমি করেছি যাতে আমার ভেতরকার পরিত্রাহি স্বর সারাক্ষণ আমাকে শুনতে না হয়। দেড় বছর ধরে দিনের পর দিন আমি প্রহসন চালিয়ে গিয়েছি; গাইগুই করা, খেই হারিয়ে ফেলা, সেসব কখনও হয়নি–আর আজ, সে লড়াই আজ ফতে। আমার জিৎ হয়েছে। দেহে বলো, মনে বলো আমি এখন স্বাধীন। এখন আর আমার মায়ের। দরকার নেই, এইসব ঠোকাঠুকি আমাকে পোক্ত করে তুলেছে।

 ‘আর আজ, আমি আজ যখন এসব ছাড়িয়ে উঠেছি, আজ তখন জানি আমার যা লড়াই তা করেছি, সেই সঙ্গে এখন আমি চাই যাতে আমার নিজের রাস্তায় চলতে পারি, যে রাস্তা আমি ঠিক বলে মনে করি। আমাকে চৌদ্দ বছরের মেয়ে বলে মনে করলে চলবে না, কারণ এই সব কষ্ট দুঃখ আমার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে; আমি যা করেছি তার জন্যে আমি দুঃখবোধ করব না, বরং আমি যা পারি বলে মনে করি তাই করে যাব। বাপু-বাছা বলে আমার ওপরে যাওয়া তুমি আটকাতে পারবে না; হয় তুমি সেটা নিষিদ্ধ করে দেবে, নয় আমাকে তুমি সর্ব অবস্থায় বিশ্বাস করবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাকে সেই সঙ্গে শান্তিতে থাকতে দিও?’

তোমার আনা।

.

শনিবার, ৬ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

কাল সন্ধ্যেবেলায় খেতে বসার আগে বাপির পকেটে আমি একটা চিঠি রেখে দিই; কাল তোমাকে যেসব জিনিস খোলাসা করে জানিয়েছিলাম, চিঠিতে সেই সবই লেখা ছিল। চিঠিটা পড়ার পর, মারগট বলল, বাপি নাকি বাকি সন্ধ্যেটা খুবই বিচলিত হয়ে কাটিয়েছেন। (আমি ওপরতলায় তখন বাসন মাজতে ব্যস্ত) বেচারা পিম, আমার জানা উচিত ছিল ঐ ধরনের চিঠির ফল কী দাঁড়াবে। এমনিতেই যা স্পর্শকাতর! সঙ্গে সঙ্গে পেটারকে বলে দিলাম ও যেন এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করে বা কিছু না বলে। পিম আমাকে এ নিয়ে আর কিছু বলেননি। পরে বলার জন্যে তুলে রেখেছেন না কী?

তা এখানে সবকিছুই আবার কমবেশি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। বাইরে জিনিসের দরদাম আর মানুষজন সম্পর্কে যা সব শোনা যাচ্ছে, তা প্রায় অবিশ্বাস্য। আধ পাউণ্ড চায়ের দাম ৩৫০ ফ্লোরিন (এক ফ্লোরিন আনুমানিক আটাশ সেন্টের মতো) এক পাউও কফি ৮০ ফ্লোরিন, মাখন এক পাউণ্ড ৩৫ ফ্লোরিন, ডিম একটি ১.৪৫ ফ্লোরিন। বুলগেরিয়ায় এক আউন্স কিনতে লাগে ১৪ ফ্লোরিন। প্রত্যেকেই কালোবাজারি করে; যে ছেলেরা ফাইফরমাশ খাটে তাদের প্রত্যেকের কাছেই কিছু না কিছু কিনতে পাওয়া যাবে। আমাদের রুটির দোকানের ছেলেটা খানিকটা রেশমের সুতো জুটিয়েছে, সেই সরু একগাছা সুতোর দাম ০.৯ ফ্লোরিন; যে লোকটা দুধ যোগায়, সে যোগাড় করে আনছে চোরাই রেশন কার্ড; যে লোকটা গোর দেয়, সে পৌঁছে দিচ্ছে পনির। দৈনিক চলছে বাড়িতে সিঁদ কাটা, মানুষ খুন আর চুরি। পুলিশ আর রাতের চৌকিদাররা দাগী আসামীদের মতোই আদাজল খেয়ে লেগেছে, প্রত্যেকেই তার খালি পেটে কিছু না কিছু ভরতে চায়। মজুরি বৃদ্ধি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় লোকে ঠগবাটপারি করবে না তো কী করবে। রোজই পনেরো, মোল, সতেরো এবং তারও বেশি বয়সের মেয়েরা বেপাত্তা হয়ে যাচ্ছে তাদের খোঁজে পুলিস ক্রমাগত পাড়ি দিয়ে চলেছে।

তোমার আনা।

.

রবিবার সকাল, ৭ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

কাল বিকেলে বাপির সঙ্গে আমার বহুক্ষণ ধরে কথা হল। আমি প্রচণ্ড কাঁদলাম, বাপিও না। কেঁদে পারেননি। জানো, কিটি, বাপি আমাকে কী বললেন? ‘আমার জীবনে ঢের ঢের চিঠি পেয়েছি, কিন্তু এমন অরুচিকর চিঠি আর পাইনি। তুমি, আনা, মা-বাবার কাছ থেকে কম ভালবাসা পাওনি; তোমার মা-বাবা সব সময়ই তোমাকে সাহায্য করার জন্যে তৈরি, যে বিপদই আসুক তারা সবসময় তোমাকে বুক দিয়ে রক্ষা করে এসেছেন তাঁদের প্রতি কোনো দায়িত্ব বোধ করো না, এ কথা তুমি বলো কী করে? তুমি মনে করো তোমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে এবং তোমাকে পরিত্যাগ করা হয়েছে; না, আনা, আমাদের প্রতি তুমি খুবই অবিচার করেছ।

‘হয়ত তুমি তা বলতে চাওনি, কিন্তু তুমি তা লিখেছ। না, আনা, তোমার কাছ থেকে এ ভৎসনা আমাদের প্রাপ্য নয়।’

ইস, আমি ডাহা হেরে গিয়েছি। আমার জীবনে সবচেয়ে উঁছা কাজ নিঃসন্দেহে এটাই। কেঁদেকেটে, চোখের পানি ফেলে আমি কেবল চেষ্টা করছিলাম দেখাতে, নিজেকে বড় বলে প্রতিপন্ন করতে, বাপি যাতে আমাকে মান্য করেন।

আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি সন্দেহ নেই, কিন্তু যে পিম এত ভালো, যিনি বরাবর এবং আজও আমার জন্যে কী না করেছেন, তাকে দোষ দেওয়া না, সেটা এত নীচ যে। বলার নয়।

অগম্য পাদপীঠ থেকে একটি বার অন্তত আমাকে টেনে নামানো, আমার অহঙ্কারকে খানিকটা ডানা ধরে নাড়িয়ে দেওয়া–এটা ঠিক কাজ হয়েছে; কেননা নিজেকে নিয়ে আমি আবার অত্যন্ত বেশি রকম মাতামাতি করে ফেলছিলাম। মিস আনা যাই করে তাই সবসময় নির্ভুল নয়। অন্য কাউকে, বিশেষ করে যিনি ভালবাসেন বলেন, তার মনে ব্যথা দেওয়া এবং তাও ইচ্ছে করে–কাজটা গর্হিত, অত্যন্ত গর্হিত।

বাপি যেভাবে আমাকে ক্ষমা করে দিলেন, তাতে নিজের সম্পর্কে আমি আরও বেশি লজ্জিত হলাম; চিঠিটা বাপি আগুনে ফেলে দেবেন; আমার সঙ্গে তিনি এমন মধুর ব্যবহার করলেন যে, মনে হল যেন তিনিই দোষ করেছিলেন। না, আনা, তোমাকে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে, অন্যদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা আর দোষ দেওয়ার বদলে আগে সেই শেখার কাজ করো।

আমাকে দুঃখ পেতে হয়েছে বিস্তর; আমার বয়সী কাকে পেতে হয়নি? আমি ভাড়ও সেজেছি বিস্তর, কিন্তু ঠিক সজ্ঞানে নয়। নিজের সম্পর্কে আমার খুবই লজ্জিত হওয়া উচিত; আমি যথার্থই লজ্জিত।

যা হয়ে গেছে, আর তার চারা নেই। কিন্তু আর যাতে না হয়, তার ব্যবস্থা হতে পারে। আমি আবার গোড়া থেকে শুরু করতে চাই; পেটার রয়েছে, এখন আর সেটা শক্ত হবে না। ও যখন আমার সহায়, আমি পারব এবং করব।

আমি আর একা নই, পেটার আমাকে ভালবাসে। আমি পেটারকে ভালবাসি। আমার বই আছে, গল্পের বই আছে, ডায়রি আছে; আমি ভীষণ রকমের কুৎসিত নই, অসম্ভব বোকা নই; আমার হাসিখুশি মেজাজ; এবং আমি চাই ভালো রকম চরিত্রবল পেতে।

হ্যাঁ, আনা, তুমি এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছ যে, তোমার চিঠিটা ছিল অত্যন্ত রূঢ় এবং সেই সঙ্গে অসত্য। তুমি তার জন্যে এমন কি গুমর করতে, ভাবো তো। আমি বাপিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নেব এবং আমি নিজেকে উন্নত করবই করব।

তোমার আনা।

.

সোমবার, ৮ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আমাদের পরিবার সম্পর্কে তোমাকে কখনও কি সেভাবে কিছু বলেছি?

বলেছি বলে মনে হয় না; কাজেই এখন শুরু করব। আমার বাবার মা-বাবারা খুব বড়লোক ছিলেন। আমার ঠাকুরদা নিজের চেষ্টায় ছোট অবস্থা থেকে বড় হয়েছিলেন এবং আমার ঠাকুমা এসেছিলেন নামী পরিবার থেকে। ওঁরাও ছিলেন বড়লোক। সুতরাং কম বয়সে বাপি ঐশ্বর্যের মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন; ছিল হপ্তায় হপ্তায় পার্টি, বল নাচ, উৎসব-পরব, সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে, ভূরিভোজ, বিরাট একটা বাড়ি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

মা-মণির মা-বাবারাও পয়সাওয়ালা ছিলেন এবং আমরা প্রায়ই হাঁ হয়ে যাই তখন শুনি বাগ্দান উপলক্ষে আড়াইশো লোকের পার্টি, ঘরোয়া বল নাচ আর ভূরিভোজের গল্প। আজ আমাদের কেউই আর বড়লোক বলবে না, আমার সব আশা যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত শিকেয় তুলে রেখেছি।

তোমাকে এই বলে দিলাম, মা-মণি আর মারগটের মত চিড়েচ্যাপটা আর কোণঠাসা হয়ে বাঁচতে আমি মেটেই ইচ্ছুক নই। আমার কী ইচ্ছে করে এক বছর প্যারিসে আর এক বছর লন্ডনে ভাষা নিয়ে আর আর্টের ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো করে আসতে। সেখানে মারগটের ইচ্ছেটা কী দেখ–ও চায় প্যালেস্টাইনে গিয়ে ধাত্রীবিদ্ হতে। আমি সবসময় সুন্দর পোশাক আর মজাদার লোক দেখার জন্যে হেদিয়ে মরি।

আমি চাই দুনিয়াটা একটু ঘুরে দেখতে এবং এমন সব জিনিস করতে যা আমার প্রাণ মাতাবে। এ জিনিস আগেও আমি তোমাকে বলেছি। আর সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ পয়সা এলে পোয়া বারো।

আজ সকালে মিবললেন, কাল উনি এক বাগদানের দাওয়াতে গিয়েছিলেন। হবু-বর আর হবু-বউ, দুজনই খুব পয়সাওয়ালা ঘরের।

আয়োজন হয়েছিল খুবই বড় মাপের। আমাদের জিভে পানি এসে যাচ্ছিল মিপ যখন খাবারের ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন–মাংসের বড়া দিয়ে সব্জির সুপ, পনির টিকিয়া, সেই সঙ্গে ডিম আর রোস্ট বীফ দিয়ে করা রুচিবর্ধক, চিত্রবিচিত্র কেক, শরাব আর সিগারেট–যে যত খেতে পারে (কালোবাজারী)। মিপ মদ নিয়েছেন দশ দফা–শুনি এই ভদ্রমহিলাই নাকি মদ ছোঁন না? মিপই যদি এই কাণ্ড করে থাকেন, ওঁর স্বামীটি তাহলে কত গ্লাস নামিয়েছেন? স্বভাবতই নিমন্ত্রিতরা সবাই খানিকটা মাতাল হয়েছিলেন। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন ফাইটিং স্কোয়াডের দুজন পুলিস অফিসার; তাঁরা বাগদত্তদের ফটো তোলেন। মিপ্‌ তক্ষুনি ঐ দুজনের ঠিকানা লিখে নেন এই ভেবে যে, কখনও কিছু যদি হয় তো ঐ দুই ডাচ সজ্জনের সাহায্যে মিলতে পারে–এ থেকে বোঝা যায়, মিপ্‌ যখন যেখানেই থাকুন, আমাদের কথা ওঁর সবসময় মনে থাকে।

মিপের গল্পে আমাদের জিভে পানি এসেছিল। হায় রে, প্রাতরাশে আমাদের জোটে মাত্র দুই চামচ ডালিয়া; আমরা যাদের পেট এত খালি যে ক্ষিধের ভোঁচকানি লেগে যায়। আমরা যারা খেতে পাই–দিনের পর দিন শুধু আধসেদ্ধ পালং শাক (ভিটামিন বজায় রাখার জন্যে) আর পচা আলু; আমরা, যারা সেদ্ধ বা কাঁচা লেটুস, পালং এবং তারপর আবার পালং ছাড়া খালি পেটে দেবার আর কিছু পাই না। হয়ত এখনও পোপেইয়ের মতো পালোয়ান হয়ে ওঠার সময় আছে, কিন্তু বর্তমানে তার তো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

মিপ যদি আমাদের নেমন্তন্ন বাড়িতে নিয়ে যেতেন, তাহলে অন্য অতিথিদের আর টিকিয়া খেতে হত না–আমরাই সব সাবাড় করে দিতাম। তোমাকে বলছি, মিপের চারধারে গোল হয়ে বসে আমরা যেন তাঁর মুখের প্রত্যেকটা কথা গিলছিলাম যেন, এত এত সুখাদ্যের কথা, এত এত চৌকশ লোকের কথা জীবনে কক্ষনো শুনিনি।

আর এঁরা হলেন কিনা লাখপতিদের নানী। দুনিয়া এক আজব জায়গা।

তোমার আনা

.

মঙ্গলবার, ৯ মে,১৯৪৪

আদরের কিটি,

আমার এলেন পরীর গল্পটা শেষ করেছি। চমৎকার নোট কাগজে গোটাটা কপি করেছি। বেশ সুন্দর দেখতে লাগছে, কিন্তু বাপির জন্মদিনে এটা কি সত্যই যথেষ্ট? আমি জানি না। মারগট, মা-মণি, দুজনেই ওঁর জন্যে কবিতা লিখেছে।

মিস্টার ক্রালার আজ বিকেলে ওপরতলায় এসে খবর দিয়ে গেলেন যে, মিসেস ব-, ব্যবসায় যিনি প্রদর্শিকা হিসেবে কাজ করতেন, তিনি রোজ মধ্যাহ্নের পর দুটোর সময় এখানে অফিস ঘরে তার ডাবা এনে লাঞ্চ খাবেন। ভেবে দেখ! এরপর আর ওপরতলায় কেউ উঠে আসতে পারবে না, আলু যোগানো বন্ধ হবে, এলির লাঞ্চ খাওয়া হবে না, আমাদের শৌচাগারে যাওয়া চলবে না, আমাদের নড়াচড়া বন্ধ, ইত্যাদি ইত্যাদি। ভদ্রমহিলাকে ভাগাবার জন্যে আমরা যত রাজ্যের অবাস্তব সব ফন্দি আঁটতে লাগলাম। ফান। ডান বললেন ওঁর কফিতে ভালোমত জোলাপ মিশিয়ে দিলেই যথেষ্ট কাজ হবে। উত্তরে কুপহুইস বলনে, না, আমি ব্যর্থতা করছি ওটা করবেন না। তাহলে আর আমরা ডাব্বাটা কখনই ওখান থেকে সরাব না। মিসেস ফান ডান জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডাব্বা থেকে সরানো? তার মানে কী? ওঁকে ব্যাখ্যা করে বলা হল। তখন উনি বোকার মতো জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি ওটা সব সময় ব্যবহার করতে পারি?’ এলি খিলখিল করে হেসে বলল, ‘বোঝ ঠেলা। বিয়েনক-এ (আমস্টার্ডামের একটা বড়ো দোকান) গিয়ে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, ওরা বুঝতেই পারবে না কী বলা হচ্ছে।’

ও, কিটি। কী চমৎকার আবহাওয়া আজ! শুধু যদি একটু বাইরে বেরোতে পারতাম!

তোমার আনা।

.

বুধবার, ১০ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

কাল বিকেলে চিলেকোঠায় বসে আমরা কিছুটা ফরাসী নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, এমন সময় আমার পেছনে হঠাৎ ছ্যাড় ছাড় করে পানি পড়তে লাগল। আমি পেটারকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? কোনো কথা না বলে পেটার ছুটে মটকায় উঠে গেল। সেখান থেকেই পানিটা আসছিল। পেটার ওপরে উঠে মুশ্চিকে জোরসে এক ঠেলা দিয়ে ওর স্বস্থানে সরিয়ে দিল। মাটির টব ভিজে বলে মুশ্চি ওটার পাশে গিয়ে বসেছিল। এই নিয়ে বেশ খানিকটা হল্লা আর চটাচটি হল। মুশ্চি ততক্ষণে তার কাজ সেরে সা করে ছুটে নিচে চলে গেছে।

মুশ্চি ছোক ছোঁক করে তার টবের সমগোত্রীয় কিছু খুঁজতে গিয়ে কিছু কাঠের কুচি পেয়ে গিয়েছিল। তার ফলেই মটকায় ভাসাভাসি হয়ে তৎক্ষণাৎ তার ধারা, দুর্ভাগ্যক্রমে, চিলেকোঠায় আলুর পিপের মধ্যে আর আশপাশে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে। সিলিং থেকে টপটপ করে চিলেকোঠার মেঝেতে পড়ে কোথায় কোন্ ফুটো ফাটা দিয়ে কয়েকটা হলদে ফোঁটা খাবার চায়ের টেবিলে রাখা ডাই করা মোজা আর কয়েকটা বইয়ের ওপর পড়ে। হাসতে হাসতে তখন পেটে খিল ধরে যাচ্ছে আমার, যাকে অট্টহাসি বলে তাই। একটা চেয়ারের নিচে মুশ্চি কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে, পেটারের হাতে পানি, ব্লিচিং পাউডার আর ন্যাতা এবং ফান ডান চেষ্টা করছেন সবাইকে প্রবোধ দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া গেল। কিন্তু বেড়ালের নোংরা পানিতে যে বিকট গন্ধ হয়, এটা সবাই জানে। আলুর ক্ষেত্রে তা পরিষ্কার দেখা গেল এবং বাপি পোড়াবার জন্যে বালতি করে কাঠের যে কুচিগুলো এনেছিলেন, তারও একই দশা। বেচারা মুশ্চি। ছাইগাদা মেলা এখানে যে অসাধ্য, সেটাই বা তুমি জানবে কেমন করে?

তোমার আনা।

পুনশ্চ : আমাদের প্রিয় মহারানী কাল আর আজ আমাদের উদ্দেশে বাণী প্রচার করেছেন। হল্যাণ্ডে যাতে শক্তি সঞ্চয় করে ফিরতে পারেন তার জন্যে তিনি অবকাশ যাপন করতে চলেছেন। শীগগিরই যখন আমি ফিরব, দ্রুত মুক্তি, বীরত্ব আর গুরুভার–এইসব শব্দ তিনি ব্যবহার করেন।

এরপর হয় জেরব্রাণ্ডির একটি বক্তৃতা। অনুষ্ঠান শেষ হয় ঈশ্বরের কাছে এক ধর্মযাজকের প্রার্থনা দিয়ে, তাতে তিনি বলেন, ঈশ্বর যেন ইহুদিদের, বন্দীনিবাসে জেলখানায় আর জার্মানিতে যারা আছে তাদের রক্ষা করেন।

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

ঠিক এখন, আমার হাঁফ ফেলার সময় নেই। কথাটা তোমার কাছে পাগলামি বলে মনে হলেও, হাতের একগাদা কাজ কখন কিভাবে সারব ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না। তোমাকে এই কাজগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দেব কি? তাহলে শোনো। কালকের মধ্যে গালিলিও গ্যালিলি’ বইটা আমাকে শেষ করতেই হবে, কেননা ওটা তাড়াতাড়ি লাইব্রেরিতে ফেরত দেওয়ার কথা। আমি কাল সবে শুরু করেছি, তবে এর মধ্যে ঠিক শেষ করে ফেলব।

পরের হপ্তায় আমাকে পড়তে হবে ‘প্যালেস্টাইন অ্যাট দি ক্রসরোড’ আর ‘গালিলি’র দ্বিতীয় খণ্ড। এরপর কাল আমি ‘সম্রাট পঞ্চম চার্লস্’-এর জীবনীর প্রথম পর্ব পড়া শেষ করেছি এবং এ থেকে আমার সংগৃহীত সারনী আর বংশলতিকা তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। এরপর বিভিন্ন বই থেকে যোগাড় করা যাবতীয় বিদেশী শব্দ পাঠ, আর লেখা রপ্ত করতে হবে। চার নম্বর হল, আমার চিত্রতারকারা সব তালগোল পাকিয়ে আছে এবং ওদের উদ্ধার করে গুছিয়ে না ফেললেই নয়। এইসব সারতে কয়েকটা দিন লেগে যাবে। যেহেতু প্রফেসর আনা, এই বলে এখনই ডাকা হচ্ছে, গলা পর্যন্ত কাজ–সেইজন্যে এই জট সহজে ছাড়বে না।

এরপর থেসেউস, অয়েদিপুস, পেলেউস, অরফেয়ুস, জাসন আর হারকুলিস–একে একে এদের সবাইকে পর পর সাজিয়ে ফেলতে হবে, কারণ পোশাকে নক্সা করা সুতোর মত আমার মনে এদের নানা ক্রিয়াকলাপ আড়া-তেরছা হয়ে আছে। মিরন আর ফিদিয়াসকে নিয়ে পড়ারও সময় এসেছে, যদি তাদের মধ্যে সঙ্গতি পেতে হয়। সাত আর নয় বছরের যুদ্ধ নিয়েও সেই এক ব্যাপার। এই হারে চললে সব খিচুড়ি পাকিয়ে যাবে। যার স্মৃতিশক্তির এই হাল তার আর করার আছে কী। ভেবে দেখ, যখন আমার আশী বছর বয়স হবে তখন আমি কি রকম বুড়ো হয়ে যাব!

এসব বাদে, ওহে, বাইবেল! এখনও কতদিন গেলে তবে গোসলরতা সুজানার দেখা পাব? সাডোম আর গোমোরার পাপকর্ম বলতে কী বোঝায়। ইস, জানবার বুঝবার কত কী যে আছে! ইতিমধ্যে ফার্স্-এর লিসোরোকে তো আমি সম্পূর্ণ গাডড়ায় ফেলে রেখে দিয়েছি।

কিটি, দেখতে পাচ্ছ তো আমার কি রকম হাঁসফাস অবস্থা?

এবার একটা অন্য প্রসঙ্গ, তুমি অনেকদিন থেকে জান আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছে একদিন সাংবাদিক হওয়ার এবং পরে একজন নামকরা লেখক হওয়ার। মহত্ত্বের (নাকি উন্মত্ততার) দিকে এই ঝোক শেষ পর্যন্ত বাস্তবে দাঁড়ায় কিনা সেটা পরে দেখা যাবে, কিন্তু বিষয়বস্তুগুলো নিশ্চিন্তভাবে আমার মনে গাথা আছে। যেভাবেই হোক, ‘হেটু আখুটেরহুইস নাম দিয়ে একটা বই আমি যুদ্ধের পর প্রকাশ করতে চাই। পারব কি পারব না, বলতে পারছি না; তবে ডায়রিটা আমার খুব কাজে লাগবে। ‘হেট আখটেরহুইস’ ছাড়া আমার আরও নানা আইডিয়া আছে। তবে ওসব নিয়ে অন্য কোনো সময়ে আরও সবিস্তারে লিখব–যখন জিনিসগুলো আমার মনে আরও স্পষ্ট আকার নেবে।

তোমার আনা।

.

শনিবার, ১৩ মে, ১৯৪৪

প্রিয়তম কিটি, কাল ছিল বাপির জন্মদিন। মা-মণি আর বাপির বিয়ে হয়েছে আজ উনিশ বছর। যে মেয়েটি নিচে কাজ করতে আসে সে ছিল না এবং ১৯৪৪ সালে এমন ঝকঝকে রোদ আর কখনও দেখা যায়নি। আমাদের বনগোর গাছে এখন ফুল ফুটেছে, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া পাতায় গাছ এখন ভর্তি। গত বছরের চেয়েও গাছটাকে এবার বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।

বাপি পেয়েছেন কুপহুইসের কাছ থেকে লিনেয়াসের একটি জীবনবৃত্তান্ত, ক্রালারের কাছ থেকে একটি প্রকৃতিবিষয়ক বই, ডুসেলের কাছ থেকে জলপথে আমস্টার্ডাম’; ফান ডানের কাছ থেকে একটি বিশাল বাক্স, সুন্দর ভাবে মাজাঘষা করা এবং প্রায় পেশাদারের মতো সুসজ্জিত, তার ভেতর তিনটে ডিম, এক বোতল বীয়ার, এক বোতল দই, আর একটা সবুজ রঙের টাই। এর পাশে আমাদের দেওয়া এক পাত্র সিরাপ একেবারেই সামান্য। মিপ আর এলির কার্নেশনের চেয়ে গন্ধে মাত করেছিল আমার গোলাপ; কার্নেশনের গন্ধ না থাকলেও ফুলগুলো দেখতে ভারি সুন্দর ছিল। আদরে বাপির মাথা খাওয়ার ব্যবস্থা। পঞ্চাশটি চিত্র বিচিত্র পেট্রি এল। স্বর্গীয় ব্যাপার! বাপি নিজে হাতে আমাদের গুড়-আদায় তৈরি মশালাদার কেক দিলেন, ভদ্রলোকেরা পেলেন বীয়ার আর ভদ্রমহিলারা দই। খুব আমোদ-আহাদ হল।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ১৬ মে, ১৯৪৪

প্রিয়তম কিটি,

একঘেয়েমি কাটাবার জন্যে, তোমাকে মিস্টার আর মিসেস ফান ডানের মধ্যে কালকের এক ছোট্ট কথোপকথনের কথা বলব–এসব জিনিস অনেকদিন তোমাকে বলা হয়নি।

মিসেস ফান ডান–জার্মানরা নিশ্চয় আটলান্টিক প্রাচির খুবই শক্ত করেছে, ইংরেজদের ঠেকাতে ওরা যে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে তাতে সন্দেহ নেই। জার্মানদের দূর্জয় শক্তি দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়।

মিস্টার ফান ডান–’হ্যাঁ, সত্যি অবিশ্বাস্য রকমের!’

মিসেস ফান ডান–’হ্যাঁ-আ!’

মিস্টার ফান ডান–জার্মানদের শক্তি এত বেশি যে, সব কিছু সত্ত্বেও, শেষ পর্যন্ত ওরা জিতবেই জিতবে।’

মিসেস ফান ডান–হতেই পারে, এর উল্টোটা হওয়ার ব্যাপারে এখনও আমি নিঃসন্দেহ নই।’

মিস্টার ফান ডান–’আমি আর এর উত্তর দেব না।‘

মিসেস ফান ডান–আমার কথার ওপর কথা তো তুমি বলোই; প্রত্যেকবারই আমাকে টেক্কা না দিয়ে তুমি পারো না।

মিস্টার ফান ডান–’নিশ্চয় না, তবে আমার উত্তরগুলো হয় যথাসম্ভব ছোট্ট।

মিসেস ফান ডান—’তাও উত্তর দিতে তুমি ছাড়ো না এবং মনে করো তুমি যা বলবে তাই ঠিক! তোমার ভবিষ্যদ্বাণী সব সময় সত্যি হয় না।’

মিস্টার ফান ডান–’সেটা ঠিক নয়। ঠিক হলে গত বছরই সৈন্য নামত আর ফিরা এতদিনে লড়াই থেকে বেরিয়ে যেত। শীতের মধ্যেই ইতালি খতম, আর লেমবার্গ ইতিমধ্যেই রুশদের কজায়। উহ, উঁহু, তোমার ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর আমার খুব ভরসা নেই।’

মিস্টান ফান ডান (উঠে দাঁড়িয়ে) আর তোমাকে বকবক করতে হবে না। আমি যে ঠিক একদিন তোমাকে তা দেখিয়ে দেব; আজ হোক কাল হোক, দেখবার অনেক কিছু পাবে। তোমার এই গজগজ করা স্বভাব আমার সহ্য হয় না। তোমার কাজ হল মানুষকে চটানো, নিজের কর্মদোষে একদিন তুমি ভুগবে।’

আমি সত্যি না হেসে পারি নি। মা-মণিও তাই। পেটার জোর করে ঠোট বন্ধ করে রেখেছিল। বড়রা এমন বেআক্কেল! ছোটদের সাতকাহান শোনাবার আগে ওঁদের উচিত নিজেদের হাতেখড়ির ব্যবস্থা করা।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ১৯ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

কালকের দিনটা, খুবই বাজে গেছে। পেট ব্যথা এবং অকল্পনীয় যাবতীয় কষ্টে সত্যিই শরীরটা ভালো ছিল না। আজ আমি অনেক ভালো। চনচনে ক্ষিধে হয়েছে, তবে আজ আমাদের যে শিম রাধা হচ্ছে সেটা আমি মুখে দেব না।

পেটার আর আমার ব্যাপারটা নির্ঝঞ্ঝাটে চলেছে। পেটার বেচারার একটু ভালবাসা পাওয়া একান্তই দরকার আমার চেয়েও বেশি। রোজ সন্ধ্যেবেলায় আসার সময় ওকে যখন একটি চুমো খাই, ও লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে এবং আরেকটি একেবারেই চেয়েচিন্তে নেয়। ভাবি আমি ঠিকমত বোখার জায়গা নিতে পেরেছি কি তাতে দুঃখ নেই, ও যখন এটা জেনে খুশি যে ওকে কেউ ভালবাসার আছে।

অনেক কষ্টার্জিত জয়ের পর এখন গোটা অবস্থাটা আমার হাতে এসে গেছে। আমি মনে করি না, আমার ভালবাসায় ভাটা পড়েছে। ও খুব মিষ্টি ছেলে, কিন্তু তবু আমি চটপট আমার ভেতরের সত্তায় তালা লাগিয়ে গিয়েছি। ও যদি সে তালা ভাঙতে চায়, ওকে আগের চেয়ে ঢের বেশি রকম কাঠখড় পোড়াতে হবে।

তোমার আনা।

.

নিবার, ২০ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

কাল সন্ধ্যেবেলায় চিলেকোঠা থেকে নিচে নেমে এসে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি কার্নেশন। ফুলসুদ্ধ সুন্দর ফুলদানিটা মেঝেয় লুটোচ্ছে। মা-মণি হামাগুড়ি দিয়ে দিতে ন্যায় পানি মুচছেন আর মারগট মেঝে থেকে কয়েকটা কাগজ কুড়িয়ে নিচ্ছে।

আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে এখানে? এবং এমন কি উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই দূর থেকে ক্ষতির পরিমাণটা আঁচ করার চেষ্টা করলাম। আমার বংশপঞ্জীর পুরো ফাইল, খাতাপত্র, পড়ার বই সবকিছু ভিজে ঢোল। আমার তখন কাদো কাদো অবস্থা এবং রাগে আর ক্ষোভে কী যে বলেছি না বলেছি আমার ছাই মনেও নেই। মারগটের কাছে শুনলাম আমি ‘অপরিমেয় ক্ষতি’, ভয়ঙ্কর, সাংঘাতিক, এ ক্ষতি কখনও আর পূরণ হবে না। এবং আরও কি সব নাকি বলেছিলাম। বাপি হাসি চাপতে পারেননি, মা-মণি আর মারগটও তাই। আমার মাটি হওয়া এত পরিশ্রম আর এত খেটে করা সারনীগুলো তার জন্যে কিন্তু আমি অনায়াসে কাঁদতে পারতাম।

একটু খুঁটিয়ে দেখার পর বুঝলাম আমার ‘অপরিমেয় ক্ষতি’ আমি যতটা ভেবেছিলাম ততটা গুরুতর নয়। চিলেকোঠায় গিয়ে জুড়ে যাওয়া পাতাগুলো বের করে সেগুলো আলাদা করে ফেললাম। তারপর সমস্ত কাগজ নিয়ে কাপড় শুকোবার তারে টাঙিয়ে দিলাম। দেখতে যা মজার হল কী বলব; আমি নিজেই না হেসে পারিনি। পঞ্চম চার্লস, অরাঞ্জ-এর ভিলিয়াম আর মারী আঁতোয়ানেৎ এর পাশে মারিয়া দা মেদিচি। এ বিষয়ে মিঃ ফান ডানের রসিকতা হল–এটা একটা বর্ণবৈষম্যগত বলকার’। আমার কাগজগুলোর ভার পেটারকে দিয়ে আমি নিচের তলায় ফিরে গেলাম।

বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল মারগট। ওকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোন বইগুলো নষ্ট হয়েছে? মারগট বলল, ‘বীজগণিত।’ তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়ে দেখলাম বীজগণিতের বইটাও নষ্ট হয়নি। ওটা ফুলদানির ভেতরে পড়লেই ভালো হত; ঐ বইটা আমি দুচক্ষে পড়ে দেখতে পারি না। সামনের দিকে কম করে বিশটি মেয়ের নাম, বইটা আগে যাদের ছিল। পুরনো ঝরঝরে বই, পাতাগুলো হলদে হয়ে এসেছে, পাতায় পাতায় হিজিবিজি লেখা আর কাটাকুটি। এরপর কখনও যদি আমার মেজাজ খুব বিগৃড়ে যায়, বইটা আমি ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলব।

তোমার আনা।

.

সোমবার, ২২ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

২০শে মে মিসেস ফান ডানের সঙ্গে একটা বাজীতে বাপি হেরেছেন পাঁচ বোতল দই। আক্রমণ আজও হয়নি। এ কথা বললে অতিশয়োক্তি হবে না যে, সারা আমস্টার্ডাম, সারা হলান্ড, হ্যাঁ, একেবারে স্পেন পর্যন্ত ইউরোপের সারা পশ্চিম উপকূলে লোকে দিন রাত আক্রমণের কথা বলছে, তাই নিয়ে কথা কাটাকাটি করছে আর বাজী ধরছে আর… আশা করে আছে।

কী-হয় কী-হয় ভাবটা ক্রমশ চড়ছে। যাদের আমরা সাচ্চা ডাচ বলে মনে করলাম তারা সবাই ইংরেজদের প্রতি বিশ্বাসে অটল আছে, মোটেই তা নয়; প্রত্যেকেই যে ইংরেজদের ধোকা দেওয়াটাকে রণনীতির ক্ষেত্রে একটা ওস্তাদের মার বলে মনে করে, তাও নয়। আসলে লোকে শেষ পর্যন্ত দেখতে চায় কাজ, বড় দরের বীরত্বপূর্ণ কাজ। কেউই নিজের নাকের বাইরে কিছু দেখছে না, কেউ মনে করছে না ইংরেজরা তাদের নিজের দেশের জন্যে আর তাদের নিজ দেশবাসীর জন্যে লড়ছে; প্রত্যেকেই ভাবছে যত তাড়াতাড়ি পারে এবং যত ভালোভাবে পারে হল্যাণ্ডকে রক্ষা করাই ইংরেজদের কর্তব্য।

আমাদের জন্যে ইংরেজদের কিসের দায়? ডাচরা খোলাখুলি যে উদার সাহায্য চাইছে, সেটা তারা কী দিয়ে অর্জন করল? ডাচদের সেটা ভাবা ভুল হবে। ইংরেজরা যতই ধোকা দিয়ে থাকুক, অনধিকৃত ছোট বড় অন্য দেশগুলোর চেয়ে তাদের ঘাড়ে বেশি দোষ চাপানো ঠিক নয়। জার্মানি যখন নতুন করে নিজেকে অস্ত্র সজ্জিত করছিল, এটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে, তখন অন্য সব দেশ, বিশেষ করে, যারা ছিল জার্মানির সীমান্তে, তারা সবাই নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল। সুতরাং ঐ বছরগুলেতে ইংরেজরা ঘুমোচ্ছিল বলে এখন যদি আমরা বকাঝকা করি, ওদের তার জন্যে ক্ষমা চাইতে ভারি বয়েই গেছে। উট পাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থেকে আমাদের কোনোই লাভ হবে না। ইংল্যাণ্ড আর সারা দুনিয়া তা ভালোভাবে দেখেছে; সেই জন্যেই ইংরেজদের যে বিরাট ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, সেটা অন্য কারো চেয়ে কিছু কম হবে না।

কোনো দেশই শুধু শুধু তার লোকবল খোয়াতে চায় না, অন্য কোনো দেশের স্বার্থে তো আদবেই নয়। ইংল্যাণ্ডও তা করবে না। স্বাধীনতা আর মুক্তি নিয়ে একদিন আক্রমণ এসে যাবেই; কিন্তু তার দিন ধার্য করতে ইংল্যাণ্ড আর আমেরিকা–সমস্ত অধিকৃত দেশ হাজার এক রা হয়েও তা পারবে না।

এটা শুনে আমরা আঁতকে উঠি আর ব্যথা পাই যে, অনেকজাতেরই আমাদের ইহুদিদের সম্বন্ধে মনোভাবের বদল হয়েছে। আগে শোনা যায়, এ সব মহলে কেউ কখনও ইহুদিবিদ্বেষের কথা ভাবতও না, এখন তাদের মধ্যে এ জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা আমাদের সবাইকেই খুব ভাবিয়ে তুলেছে। ইহুদিদের প্রতি ঘৃণার কারণগুলো বোঝা যায়, এমন কি সময় সময় তা মানবিকও বটে, কিন্তু জিনিসটা ভালো নয়। খৃস্টানরা দোষ দিয়ে বলে যে, ইহুদিরা জার্মানদের কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে; সাহায্যকারীদের প্রতি তারা বেইমানি করেছে; আরও অনেকের কপালে যা জুটেছে, সেই একই দুর্ভাগ্য বহু খৃস্টানকে বরণ করতে হয়েছে ইহুদিদের মারফত, এবং পেতে হয়েছে ভয়াবহ শাস্তি আর সাংঘাতিক পরিণতি।

এ সবই সত্যি। কিন্তু এসব জিনিস সব সময়ই দুই তরফা দেখা উচিত। আমাদের অবস্থায় পড়লে খৃষ্টানরা কি অন্য রকমের আচরণ করত? পেট থেকে কি ভাবে কথা বের করতে হয় জার্মানরা তার কায়দা জানে। ইহুদি হোক, খৃস্টান হোক–কেউ যদি সম্পূর্ণ ভাবে ওদের মুঠোয় গিয়ে পড়ে, তাহলে সব সময় কি কথা না বলে থাকতে পারে? প্রত্যেকেই জানে, বাস্তবে তা অসম্ভব। কেন তাহলে লোকে ইহুদিদের কাছে এই অসম্ভবের দাবি করবে?

গুপ্তভাবে যারা কাজ করছে, তাদের মহলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে–যে সব জার্মান ইহুদি হল্যাণ্ড ছেড়ে এখন পোল্যান্ডে গিয়ে আছে, তাদের হয়ত এখানে ফিরতে দেওয়া হবে না; এক সময় তাদের হল্যাণ্ডে শরণাগতের অধিকার মিলেছিল, কিন্তু হিটলার চলে গেলে তাদের আবার জার্মানিতে ফিরে যেতে হবে।

এটা শুনলে স্বভাবতই তখন ভেবে অবাক লাগে, কেন আর আমরা এই দীর্ঘ আর কঠিন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা সর্বদাই শুনছি আমরা নাকি সকলে কাঁধে কাঁধ দিয়ে স্বাধীনতা, সত্য আর ন্যায়ের জন্যে লড়ছি। লড়াই করা অবস্থাতেই কি অনৈক্য মাথা চাড়া দেবে ইহুদির কুদর কি আবারও আর কারো চোখে কম বলে গণ্য হবে? এটা দুঃখের, খুবই দুঃখের যে, আবারও, এই নিয়ে কতবার যে সেই পুরনো সত্যটি প্রমাণিত হল–একজন খৃস্টান কিছু করলে তার জন্যে সে নিজে দায়ী, একজন ইহুদি কিছু করলে তার দায় সব ইহুদিদের ঘাড়ে পড়বে।’

সত্যি বলছি, এটা আমি বুঝি না–যে ডাচেরা মানুষ হিসেবে এত ভালো, সৎ, সাচ্চা। কেন তারা আমাদের এভাবে দেখবে? আমরা তো দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিপীড়িত, সবচেয়ে অসুখী এবং বোধহয় সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ।

আমার একটাই আশা, এবং সেটা হল, এই ইহুদিবিদ্বেষের ব্যাপারটা থাকবে না, ডাচেরা দেখিয়ে দেবে তারা কী, এবং তারা কখনও টলমল করবে না আর ন্যায়বোধ হারাবে না। কেননা ইহুদিবিদ্বেষ অন্যায়।

যদি এই সাংঘাতিক হুমকি কার্যত সত্যি হয়, তাহলে ইহুদিদের এই অবশিষ্ট ছোট্ট দুঃখার্ত দলটিকে হল্যাণ্ড ছেড়ে চলে যেতে হবে। ছোট ছোট পোটলাপুঁটলি নিয়ে আমাদেরও আবার পাড়ি দিতে হবে, ছেড়ে যেতে হবে এমন সুন্দর দেশ, যা আমাদের একদিন সোৎসাহে স্বাগত জানিয়েছিল এবং আজ যা আমাদের দিকে পিঠ ফিরিয়েছে।

আমি হল্যাণ্ডকে ভালবাসি। আমার কোনো স্বদেশ না থাকায় আশা করেছিলাম এটাই হয়ত তবে আমার পিতৃভূমি। আমি এখনও সেটাই হবে বলে আশা রাখি।

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

প্রত্যেক দিনই তাজা কিছু। আজ সকালে আমাদের সব্জিঅলাকে তুলে নিয়ে গেল। ওর বাড়িতে নাকি দুজন ইহুদিকে ও থাকতে দিয়েছিল। এটা আমাদের পক্ষে একটা বড় আঘাত। শুধু এজন্যে নয় যে, ঐ দুই ইহুদি বেচারা রসাতলের কিনারায় এসে টাল সামলাতে চেয়েছে; ঐ লোকটার পক্ষেও এটা খুব মর্মান্তিক।–দুনিয়ার আজ ওলটপালট অবস্থা; যারা নমস্য ব্যক্তি, তাদের পাঠানো হচ্ছে বন্দীনিবাসে, জেলখানায় আর নির্জন কুঠুরিতে; যারা নীচ, তারা থেকে গিয়ে আবালবৃদ্ধের, ধনী দরিদ্রের মাথায় ছড়ি ঘোরাচ্ছে। একজনের যদি ফাদে পা পড়ে কালোবাজার ঘুরে, তবে দ্বিতীয়জনের পড়ে অজ্ঞাতবাসে যাওয়া ইহুদি বা অন্য লোকদের সাহায্য করতে গিয়ে। স্থানীয় নাসীদের দলের লোক না হলে কবে যে কার কী হয় কেউ বলতে পারে না।

সব্জিঅলার চলে যাওয়া আমাদের খুব ক্ষতির কারণ হয়েছে। আমাদের ভাগের আলু টেনে তুলতে ছোট মেয়েরা পারে না। তাদের দেওয়াও হয় না। কাজেই একমাত্র উপায় খাওয়া কমানো। এটা আমরা কিভাবে করব বলছি। তবে তাতে কষ্টের কিছু লাঘব হবে না। মা-মণি বলছেন আমরা প্রাতঃরাশের পাট তুলে দেব। দুপুরে খাব ডালিয়া আর রুটি; সন্ধ্যের খাওয়াটা আমরা সারব ভাজা আলু এবং হয়ত সপ্তাহে দুবার সব্জি বা লেটুস দিয়ে। ব্যস, আর কিছু নয়। এতে আমাদের পেটের ক্ষিধে মরবে না; কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ার চেয়ে সেও বরং ভালো।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ২৬ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে জানালার ফোকরের সামনে আমার টেবিলে এসে নিরিবিলিতে বসতে পেরেছি। তোমাকে সব কিছু লিখে জানাব।

গত কয়েকমাসের মধ্যে নিজেকে কখনও এত মনমরা লাগেনি। এমন কি সিঁদকাটার ঘটনার পরও আমি সে সময়ে এখনকার মতো এতটা ভেঙে পড়িনি। একদিকে সব্জিঅলা, সারা বাড়িতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচিত ইহুদি সমস্যা, আক্রমনের বিলম্ব, অখাদ্য খাবার, দেহমনের ওপর ধকল, চারদিকের হতচ্ছাড়া আবহাওয়া, পেটার সম্পর্কে আমার আশাভঙ্গ; অন্যদিকে এলির বাগদানের ব্যাপার, হুইটসানের আদর অভ্যর্থনা, ফুল, ক্রালারের জন্মদিন, চিত্রবিচিত্র কেক আর সেই সঙ্গে ক্যাবারে, সিনেমা আর কনসার্টের গল্প। সেই পার্থক্য, সেই বিরাট পার্থক্য তো সব সময়ই আছে। একদিন আমরা হো হো করে হাসি, কোনো একটা অবস্থার মজার দিকটা ঠিক চোখে পড়ে; আবার ঠিক পরের দিনই আমাদের মুখ শুকিয়ে যায়; আমাদের মুখের মধ্যে ফুটে ওঠে ভয়, অনিশ্চয়তা আর হতাশ্বাস।

মিপ আর ক্রালারের মাথায় লুকিয়ে থাকা আটটি প্রাণীর গুরুভার চাপানো। মিপ্‌ যাই করুন তার স্বপনে জাগরণে আমরা। ক্রালারের কাধে এত বিরাট দায়িত্ব যে, মাঝে মাঝে অতিরিক্ত চাপে মুখ দিয়ে তার কথা বেরোয় না। কুপহুইস আর এলিও আমাদের ভালোভাবে দেখাশুনো করেন। তবে মাঝে মধ্যে তাঁরা কয়েক ঘণ্টা বা একদিন কিংবা এমন কি দুদিনের জন্যেও মাথা থেকে বোঝাটা তবু নামিয়ে রাখতে পারেন। ওঁদের সকলেরই নিজের নিজের। সমস্যা আছে; কুপহুইসের স্বাস্থ্য ভালো নয়। এলির বাদানের ব্যাপার, সেটা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। কিন্তু এ সত্ত্বেও ওঁরা একটু-আধটু কোথাও বেড়িয়ে আসতে পারেন, বন্ধুদের বাড়িতে ঢু মারতে পারেন এবং তাছাড়া ওঁদের আছে সাধারণ মানুষের মোলআনা জীবন। কিছু সময়ের জন্যে হলেও ওঁদের চোখের সামনে থেকে কখনও-কখনও অনিশ্চয়তার পর্দা সরে যায়। কিন্তু এই অনিশ্চয়তার হাত থেকে আমাদের এক মুহূর্তও রেহাই নেই। এখানে আমরা আছি আজ দুই বছর হল; এই অসহ্যপ্রায়, ক্রমবর্ধমান চাপের ভেতর আরও কতকাল আমাদের থেকে যেতে হবে?

মলনালী বুজে গেছে, কাজেই পানি ঢালা চলবে না, ঢাললেও যৎসামান্য; শৌচাগারে। গেলে পায়খানার বুরুশ আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় এবং নোংরা পানি আমরা। ওডিকোলনের একটা বড় পাত্রে জমা করে রাখি। আজকের দিনটা না হয় যে-সো করে কাটানো গেল, কিন্তু কাল যদি কলের মিস্ত্রি একা পেরে না ওঠে, তখন কী দশা হবে? পুরসভার সাফাই কর্মী তো মঙ্গলবারের আগে আসবে না।

মিপ একটা পুতুলের আকারের কিসমিস দেওয়া কেক পাঠিয়েছেন; তার গায়ে কাগজে লেখা ‘শুভ হুইটসান’। এটা যেন আমাদের প্রায় ঠাট্টা করার মতো শোনাচ্ছে; আমাদের এখনকার মনের অবস্থা এবং আমাদের অস্বস্তির সঙ্গে ‘শুভ’ কথাটা একেবারেই বেমানান। সব্জিলার ব্যাপারটা আমাদের আরও বেশি ভয় পাইয়ে দিয়েছে, চারপাশে সবাই এখন আবার ‘শ্‌ শ্‌, শ্‌ শ্‌’ করছে এবং সব ব্যাপারেই আমরা এখন আগের চেয়ে চুপচাপ হয়ে গিয়েছি।

পুলিস ওখানে দরজা ভেঙে ঢুকেছে, আমাদের এখানেও তা করতে পারে। যদি একদিন আমাদেরও… না, আমি সেটা লিখব না, কিন্তু আজ আমি মন থেকে সেটা উড়িয়ে দিতে পারছি না। উল্টে, এতদিন যে বিভীষিকার মধ্যে ছিলাম, আজ তা সমস্ত ভয়ঙ্করতা নিয়ে যেন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

আজ সন্ধ্যে আটটায় নিচের তলায় আমাকে একেবারে একা পায়খানায় যেতে হল; নিচে তখন কেউ ছিল না, কেননা সবাই তখন রেডিও শুনতে ব্যস্ত।

আমি মনে সাহস আনার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু খুব কঠিন। ওপরতলায় সব সময়ই নিজেকে আমার নিরাপদ লাগে; নিচের তলার প্রকাণ্ড, নিঃশব্দ বাড়িটাতে একা একা আমার গা ছমছম করে; ওপরতলা থেকে ভুতুড়ে সব আওয়াজ, আমি একা; রাস্তা থেকে মোটরগাড়ির প্যাক প্যাক। আমাকে তাড়াতাড়ি সারতে হবে, কেননা ঐ অবস্থাটার কথা মনে হলেই আমার কাপুনি ধরে।

বার বার আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি–আমরা যদি অজ্ঞাতবাসে না যেতাম, এত দৈন্যদশার মধ্যে গিয়ে যদি আমরা এতদিনে মরে যেতাম, সেটাই কি আমাদের পক্ষে এর চেয়ে ভালো হত না? বিশেষ করে, আমাদের রক্ষাকর্তাদের তো আর এই বিপদের মধ্যে পড়তে হত না?

কিন্তু এইসব ভাবনা থেকে আবার আমরা নিজেদের গুটিয়ে নিই। কেননা এখনও আমরা জীবনের প্রতি আসক্ত; এখনও আমরা প্রকৃতির কণ্ঠস্বর ভুলে যাইনি, এখনও সবকিছু নিয়েই আমার আশা, এখনও আশা। শীগগিরই কিছু একটা ঘটবে বলে আমি আশা করি দরকার হলে গুলি-গোলা; শুধু এই অস্থিরতাই আমাদের পিষে মারছে। কঠিন হলেও, যবনিকা পড়ুক; তাহলে আমরা অন্তত জানতে পারব শেষ পর্যন্ত আমরা জিতছি না হারছি।

তোমার আনা।

.

বুধবার, ৩১ মে, ১৯৪৪

আদরের কিটি, শনি, রবি, সোম, মঙ্গল–এতদিন এত প্রচণ্ড গরম গেছে যে, কলম স্রেফ হাতে করতেই পারিনি। সেইজন্যে তোমাকে লিখে উঠতেই পারিনি। নর্দমাগুলো শুক্রবার আবার বিগৃড়ে যায়, ফের শনিবার ঠিক করে ফেলা হয়। বিকেলে কুপহুইস এসেছিলেন আমাদের দেখতে; কোরিকে নিয়ে অনেক সাতপাঁচ বললেন এবং জানালেন ইয়োপির সঙ্গে একই হকি ক্লাবে ও আছে।

রবিবারে এসে এলি দেখে গেলেন কেউ সিঁদ কেটে ঢুকেছিল কিনা; প্রাতঃরাশ পর্যন্ত এলি ছিলেন।

সুইট মাডেতে মিস্টার ফান সান্টেন গোপন আস্তানার পাহারাদারের কাজ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবারে যাহোক জানলাগুলো খোলা গেল।

এমন সুন্দর, কবোষ্ণ, এমন কি গরমও বলা চলে, হুইটসান আগে কখনও দেখা যায়নি। এখানে এই ‘গুপ্ত মহলে’ গরম প্রচণ্ড; সংক্ষেপে তোমাকে আমি এই কলোঞ্চ দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলব এখানে কী ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।

শনিবার সকালে আমরা সবাই একবাক্যে বললাম, ‘বাহ্, কী চমৎকার আবহাওয়া।‘ বিকেলে যখন জানালাগুলো বন্ধ করতে হল, তখন বললাম, ‘ইসু, এতটা গুমোট না হলেই ভালো হত।’

রবিবার–আর সহ্য করা যায় না, এই গরম। মাখন গলে যাচ্ছে, বাড়িতে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে শরীর স্নিগ্ধ হয়, রুটিগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, দুধ একটু বাদেই টকে যাবে, জানলাগুলো খোলা যাচ্ছে না; আমরা যত আঁস্তাকুড়ের ছাই এখানে দমবন্ধ হয়ে পচে মরছি আর অন্য লোকেরা হুইটসানের ছুটিতে দিব্যি মজা করছে।

সোমবার মিসেস ফান ডান বলে চলেছেন, আমার পায়ে ব্যথা, গায়ে দেবার পাতলা জামা নেই। এই গরমে আর বাসন মাজতে পারি না। এমন বিশ্রী দিন কী বলব।

এখনও গরম আমার ধাতে সয় না; তবু ভালো যে, জোরে হাওয়া বইছে। বলে কী হবে, রোদ এখনও চনচনে।

তোমার আনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *