পাঁচশো বছর আগে গোটা পৃথিবীর মোট সম্পদের মূল্যমান ছিল ২৫০ বিলিয়ন ডলারের মত। আজ সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ ট্রিলিয়ন ডলার।
কেবল মানুষ বাড়সে বলেই কি সম্পদের এই বিস্ফোরণ? উহুঁ।
সেসময় মাথা পিছু মানুষের উৎপাদন ছিল বছর প্রতি ৫৫০ ডলার। এখন যেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৮০০ ডলার।
এই যে ভয়ানক গ্রোথ, এর পেছনে কারণটা কী?
কারণটা আর কিছুই না, আধুনিক অর্থনীতি। আধুনিক অর্থনীতি খুব জটিল একটা ব্যাপার। জটিল ব্যাপারকে সহজ করার জন্য একটা গল্প শোনাই বরং।
অনেকগুলা ক্যারেক্টার আছে এই গল্পে। দেইখেন, ট্র্যাক হারায়ে ফেইলেন না আবার:P
সৈয়দ সাহেব খুবই উঁচু বংশের লোক। ঢাকা শহরে উনার একটা ব্যাঙ্ক আছে।
চৌধুরী সাহেব ঢাকা শহরেরই একজন উঠতি কন্ট্র্যাক্টর। একটা প্রজেক্টে উনি বিরাট লাভ করলেন। সেই লাভের ১ কোটি টাকা উনি সৈয়দ সাহেবের ব্যাঙ্কে রাখলেন। তার মানে সেই ব্যাঙ্কে এখন ১ কোটি টাকার ক্যাপিটাল আছে।
টমি মিয়া তখন ঢাকায় এলেন। এসে খেয়াল করলেন, তিনি শহরের যে অংশে থাকেন, ঐ অংশে কোন ভালো ভাতের হোটেল নাই। সব স্যান্ডউইচ, বার্গার আর ফ্রাইড রাইসে ভর্তি।। নিখাদ ভাত-মাছের দোকান নাই কোন।
টমি মিয়া ঠিক করলেন, এইখানে একটা ভাতের হোটেল দিবেন। কিন্তু হোটেল যে দিবেন, তার জন্য তো টাকা লাগবে। সেই টাকা সে পাবে কই? সে গেলো ব্যাঙ্কের কাছে। ব্যাংকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বুঝাতে সক্ষম হল, যে এইখানে ভাতের হোটেল দিলে বেশ চলবে।
ব্যাঙ্ক তাকে ১ কোটি টাকা লোন দিল। সেই লোন দিয়ে সে কনট্রাক্টর ভাড়া করলো। কাকে করলো? সেই চৌধুরী সাহবেকে যে কিনা ব্যাঙ্কে টাকা রাখসিলো।
চৌধুরী সাহেব সেই টাকা ব্যাঙ্কে ডিপোজিট করলো। এইখান ঠেকে সে দরকারমত চেক ভাঙিয়ে ইট-বালু, রড-সিমেন্ট যা দরকার কিনবে।
মজার ব্যাপার হল, চৌধুরী সাহেবের টাকাই আবার তার এ্যাকাউন্টে ফেরত আসছে। ব্যাঙ্কের হিসাব খাতা দেখাচ্ছে, চৌধুরী সাহেবের এ্যাকাউন্টে এখন ২ কোটি টাকা আছে। সত্যিকার ক্যাশ কিন্তু ঐ ১ কোটিই রয়ে গেছে। টাকা কিন্তু বাচ্চা দেয় নাই।
ঘটনা এইখানেই শেষ না। ২ মাস শেষে কিছুদূর কাজ আগানোর পর কনট্রাক্টর সাহেবের মনে হইলো, যে কাজটা শেষ করতে আরো টাকা লাগবে। সে আরো ১ কোটি টাকার বিল ধরায়ে দিল।
টমি মিয়া বিল দেখে বেজার হইলো। কিন্তু কাজ অনেকখানি আগায়ে গেছে। এখন আর ফেরৎ আসাও ঠিক হবে না। সে আবার ব্যাঙ্কে দৌড় দিলো। ম্যানেজারকে বুঝায়ে সুঝায়ে আরো ১ কোটি টাকা লোনের বন্দোবস্ত করলো। এই ১ কোটি কিন্তু সেই ১ কোটি যেটা কন্ট্র্যাক্টর রড-সিমেন্ট কিনবে বলে ব্যাঙ্কে ডিপোজিট করে রেখেছিল।
যাই হোক, এই লোনের টাকা সে আবার কন্ট্রাক্টরের এ্যাকাউন্টে পাঠালো।
তো, কন্ট্রাক্টরের এ্যাকাউন্টে এখন কতো টাকা হল?
৩ কোটি টাকা। শুরুতে নিজের জমা করা ১ কোটি আর টমি মিয়ার দেয়া ২ কোটি।
আর ব্যাঙ্কে সত্যিকার অর্থে ক্যাশ টাকা আছে কত? সেই ১ কোটিই। যেই ১ কোটি চৌধুরী সাহেব বহু আগে জমা করসিলো।
এই কাজটাই বর্তমান আমেরিকান ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে ১০ বার করা যাবে। (বাংলাদেশের সিস্টেমে ক’বার করা যাবে—আমি জানি না। কেউ জানলে জানাবেন, প্লিজ) মানে কন্ট্রাক্টরের এ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকা দেখানোর জন্য ব্যাঙ্কের ভল্টে ১০ কোটি টাকা থাকা লাগবে না। ১ কোটি টাকা থাকলেই চলবে।
সোজা কথা, আমাদের সবার এ্যাকাউন্টে যে পরিমাণ টাকা আছে, ঐ পরিমাণ ক্যাশ ব্যাঙ্কে নাই। এখন দেশে যদি একটা গুজব উঠে যে সামনে যুদ্ধ, ব্যাঙ্ক সব কল্যাপ্স করবে, ব্যাঙ্কে যার যত টাকা আছে সব উঠায়ে নেও আর দেশের সব মানুষ সেটা বিশ্বাস করে ব্যাঙ্কে টাকা উঠাতে যায়, ব্যাঙ্ক কিন্তু সবার টাকা ফেরত দিতে পারবে না। দিবে কোথ থেকে? থাকলে না দিবে!
এই ব্যাপারটাই ঘটসিলো It’s a wonderful life এর নায়কের সাথে। তার ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে শুনে সবাই টাকা উঠাইতে চলে আসলো। এখন তার কাছে তো টাকা নাই। সে কাস্টোমারদয়ের বুঝাইতেই পারে না, যে সে কোন টাকার ম্যাশিন না । সে একটা সিস্টেম মাত্র। সে X এর টাকা Y কে, Y এর টাকা Z কে আর Z এর টাকা X কে ধার দিয়ে এই সিস্টেমটা চালু রাখসে মাত্র।
এখন এইটাকে আপনি ভণ্ডামি বলতে পারেন। তাহলে গোটা আধুনিক অর্থনীতিই একটা বিরাট ভণ্ডামি।
এক ভণ্ডামি না বলে বরং বলা যায়, ভবিষ্যতের উপর আমাদের অগাধ বিশ্বাস। সৈয়দ সাহেব বিশ্বাস করে যে, টমি মিয়ার হোটেল একবার চালু হয়ে গেলে সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা মুনাফা আসবে। সেই প্রফিট থেকে সে আস্তে আস্তে তার ঋণ সুদাসলে শোধ করবে। এক বোল ভাতও সিদ্ধ হয় নাই—তার আগেই সে তাই এই ঝুঁকি নিতে রাজি হইসে।
এই ব্যাপারটাকে আজ আমরা বলি Credit. ল্যাটিন Credo শব্দ থেকে এটা আসছে। এর মানে I trust you. বিশ্বাসটা যতোটা না একজন মানুষের উপর আরেকজনের, তার চেয়ে অনেক বেশি একটা সুখী, সম্দ্ধ ভবিষ্যতের। ব্যাঙ্কার আর হোটেলওয়ালা—দুই জনই একই স্বপ্নে বিশ্বাস করে বলেই এই গোটা সিস্টেমটা কাজ করতেসে। ঐ বিশ্বাসটুকু না থাকলে সিস্টেমটা মুহূর্তে ধ্বসে পড়বে।
ব্যাঙ্ক যদি টমি মিয়াকে লোন না দিত, তখন সে কী করতো? সে এমন কোন কনট্রাক্টর খুঁজে বের করতো, যে কিনা নিজের টাকায় তার হোটেলটা করে দিবে। পরে হোটেল লাভ করা শুরু করলে তার পেমেন্টটা নিবে। সমস্যা হল, এমন কনট্রাক্টর পাওয়া ভূভারতে সম্ভব না। কাজেই, তার হোটেলও বানানো হবে না। হোটেল না হলে মানুষ খেতে আসবে না। তার ট্যাঁকে পয়সা আসবে না। পয়সা ছাড়া সে কন্ট্রাক্টর পাবে না। আর কনট্রাক্টর ছাড়া তার স্বপ্নের হোটেলও হবে না।
যুগের পর যুগ ধরে মানুষ ‘না হবার’ এই দুষ্টচক্রে বন্দী হয়ে ছিল। ইতালির কিছু মানুষ সামান্য Bench এ বসে ধার দেবার যে কালচার শুরু করেছিল, সেই কালচারই ফুলেফেঁপে Bank এর রূপ ধারণ করে মানুষকে এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করেছে। আমরা মনে করি, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। ব্যাংকারদের ফিলোসফি উলটা। তাদের কথা হচ্ছে—আজকের দিন যেমন তেমন, সামনের দিন সোনার মতন।
ব্যাঙ্কগুলো আমাদের টাকা ধার দেয় না। ধার দেয় স্বপ্ন। এই স্বপ্নের কেনাবেঁচা করেই আমরা গড়ে তুলি আধুনিক সভ্যতা। বর্তমানকে বিক্রি করে কিনি সোনালী ভবিষ্যৎ।
১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীন হয়। ঐ বছরই এডাম স্মিথ একটা দুর্দান্ত বই লেখেন। বইয়ের নাম The Wealth of Nations, নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা বাদ দিলে এইটা আধুনিক প্থিবীর সবচেয়ে গ্রুত্বপূর্ণ বই।
এই বইয়ের আট নম্বর চ্যাপ্টারে স্মিথ একটা সম্পূর্ণ নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হন। আইডিয়াটা এমনঃ ধরা যাক, পুরান ঢাকার ফজলু মামার মত আপনার একটা ছোটখাটো পিঠার দোকান আছে। নিজেই পিঠা বানান, নিজেই সেটা বেঁচেন। পিঠা বেঁচে আপনার কিছু লাভও হল।
এখন এই লাভ দিয়ে আপনি কী করবেন? বিড়ি-সিগারেট খেয়ে শেষ করবেন? না দোকানের বেচাবিক্রি বাড়ানোর জন্য কোন পিচ্চি আকা কুদ্দুস আকা বাবুল নিয়োগ করবেন?
যুগ যুগ ধরে ফজলু মামারা লাভের টাকা দিয়ে গাঁজায় দম দিয়ে সেটা উড়িয়ে আসতো। এডাম স্মিথ এসে মামাকে বললেন, তুমি এই টাকা দিয়ে একটা এ্যাসিস্ট্যান্ট রাখো, ব্যবসা বড় করো। লাভের টাকা দিয়ে মৌজ না করে সেটা আবার ইনভেস্ট করো। তাইলে খালি তোমার একার লাভ তা না, আশেপাশের দশটা মানুষেরও লাভ।
শুনে মনে হতে পারে, আরে, এ আর এমন কী আইডিয়া! এই আইডিয়া তো আমিও দিতে পারি। এডাম স্মিথের জায়গায় আমি থাকলে আজকে আমি অর্থনীতির জনক হইতে পারতাম।
আমাদের এমনটা মনে হচ্ছে। কারণ, আমরা ঠিক এই ক্যাপিটালিস্টিক সমাজের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। প্রাচীন মানুষ কিন্তু একটু টাকাপয়সা হলেই এই মৌজমাস্তির খপ্পরে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল। সেটা রোম সম্রাট ক্যালিগুলা থেকে শুরু করে মোগল বাদশা শাহজাহান পর্যন্ত সবাই। এডাম স্মিথ এসে এই দুষ্টচক্র ভাঙেন। তিনি আমাদের সূত্র দেনঃ সমাজের মোট সম্পদ স্ট্যাটিক কিছু না। বরং চেষ্টাচরিত্র করে একে বাড়ানো যেতেই পারে। নিউটনের ত্তীয় সূত্রের চেয়ে এই সূত্র তাই কোন অংশে কম শক্তিশালী না।
আমাদের ধর্মে, মিথোলজিতে সবসময়ই লোভকে খারাপ চোখে দেখা হয়েছে। বলা হয়েছে, লোভে পাপ, পাপে ম্ত্যু। স্মিথই প্রথমা আমাদের বলেন—Greed is good. তুমি যদি নিজের লাভের জন্য খাটো, লোভের জন্য খাটো— তাইলে খালি নিজের না, সমাজেরই লাভ।
আচ্ছা, আমার ইচ্ছা আমি গরিব থাকবো। কার কী সমস্যা?
সমস্যা আছে। আমি গরিব থাকলে আমি বাজারের সেরা মোবাইলটা কিনতে পারবো না। তাইলে যেই লোক কষ্ট করে মোবাইলটা বানাইসে, সেও গরিব থাকবে। কারণ তার তো বিক্রি হচ্ছে না। আর আমি বড়লোক হইলে আপনিও বড়লোক হবেন। কারণ, আপনার বানানো জিনিস তখন আমি কিনতে পারবো। এটাকে বলে উইন উইন সিচুয়েশন।
ধনবানদের পাপী হিসেবে দেখা আমাদের আরেকটা ট্রাডিশন। ধন আর পাপ মোটামুটি সমার্থক ব্যাপার। স্মিথ এইসব ট্রাডিশনাল ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন। তিনি বলেন, বড়লোক মানেই পাপী না। বরং বড়লোক-ই ভালো। সে দশটা লোকের চাকরির বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে। স্বর্গের দরজা যদি খোলা হয়, তবে এই লোকটাই সবার আগে ঢুকবে। দিনরাত ইবাদত করা লোকটা তার পেছনেই থাকবে।
আমাদের অবশ্য ধারণা, আমি বড়লোক হতে হলে আশেপাশের সবাইকে দাবায়ে বড়লোক হতে হবে। স্মিথ এটারও বিরোধিতা করেন। স্মিথ বলেন, চাইলেই তুমি আশেপাশের সবাইকে নিয়েই বড়লোক হতে পারবা। লাভের গুড়টা নিজের পকেটে না পুরে সেই গূড় দিয়ে ফ্যাক্টরির সাইজ বাড়াও। নতুন প্রডাক্ট বানাও। নতুন প্রডাক্ট নিয়ে আসলে মানুষ সেটা খাবেই। তুমি দুধ-চা বানাতে। একজন এ্যাসিস্ট্যান্ট রেখে মাল্টা চা-ও বানানো শুরু করো। দুধ চা-র বিক্রি তাতে কমবে না।
এইভাবে প্রডাক্ট ডাইভার্সিটি তৈরি করে মানুষের কনজামশন বাড়ানো সম্ভব। এটাই ক্যাপিটালিজম। এটাই পুঁজিবাদ। পুঁজির সাথে সম্পদের এইখানে পার্থক্য। মিশরের ফারাওরা পুঁজিবাদী ছিলেন না। তারা ছিলেন সম্পদবাদী। স্প্যানিশ যে নাবিকটা আমেরিকায় এসে কাড়ি কাড়ি স্বর্ণ লুট করে গেছে, সেও পুঁজিবাদী না। যে লোকটা কষ্ট করে মাস শেষে কিছু টাকা জমিয়ে সেই টাকা আবার শেয়ার বাজারে রি-ইনভেস্ট করে, সেই প্রক্ত পুঁজিবাদী।
মধ্যযুগ পর্যন্ত এই পুঁজিবাদীদের দেখা পাওয়া ছিল বিরল। মধ্যযুগের বড়লোকদের দেখেন। কী জমকালো পোশাক পরে ঘুরে বেড়াইতো। আর এখনকার টাকার মেশিনদের দেখেন। সামান্য জিন্স আর টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়। অথচ আজকের জাকারবার্গদের সম্পদের পরিমাণ কিন্তু মিশরের যে কোন ফারাওর চেয়ে অনেক বেশিই হবে। সেসময় মানুষ দান খয়রাত করে পুণ্য কামাইতো। পকেটে টাকা বেশি হয়ে গেলে বউয়ের জন্য তাজমহল বানাইতো। আজকের পুঁজিপতিরা সেটাই করে লাভের টাকা আবার খাটিয়ে। সমাজে টাকার ফ্লো-টা ঠিক রেখে।
ফলাফল—মধ্যযুগে অভিজাত সমাজের কেন্দ্রে থাকা ডিউক আর নবাবদের সরিয়ে সেই জায়গাটা আজ দখল করে নিয়েছে ব্যবসায়ী আর পুঁজিপতিরা। যে মিডল ক্লাসের সুখ-দুঃখ আবেগ নিয়ে আমরা দিনরাত জিকির করি, সেই মিডল ক্লাসের জন্মও দিয়েছে আধুনিক পুঁজিবাদ।
পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় আছর পড়সে বোধয় আধুনিক বিজ্ঞানের উপর। একটা রিসার্চ গ্রান্ট যখন লেখা হয়, তখন প্রথম যে প্রশ্নটা ফেস করতে হয়, তা হল—এই প্রজেক্টটার ইকোনমিক ইমপ্যাক্ট কী? এইটা সমাজকে নতুন কিছু দিবে কিনা। বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান তখন মন খারাপ করে সাইড বেঞ্চে বসে থাকে।
আজ আমেরিকা, চীন অলমোস্ট শূন্য থেকে টাকা ছাপায়ে বাজারে ছাড়তেসে। এতো যে টাকা ছাড়তেসে—সমাজে সেই পরিমাণ সম্পদ তো তৈরি হচ্ছে না। তারপরও তারা কেন এই ঝুঁকিটা নিচ্ছে? তার কারণও বিজ্ঞানের উপর এই অগাধ বিশ্বাস। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, শিগগিরই ল্যাবগুলো থেকে নতুন নতুন সব ব্রেকথ্রু টেকনোলজি বের হবে। জন্ম নিবে নতুনতর সব ইন্ডাস্ট্রি। সামনে বাবল অবশ্যম্ভাবী। আর তা ঠেকানোর পুরো দায়িত্ব এখন এই বিজ্ঞানীদের। সারা দুনিয়া তাই তাকায়া আছে এই ল্যাবগুলোর দিকে। কখন তারা নতুন কিছু নিয়া আসবে আমাদের জন্য?
ব্যাঙ্কগুলো তো টাকা ছাপায়েই খালাস। এই টাকার আসল মূল্য তৈরি করে বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়াররাই।
ইউরোপেই প্রথম ব্যবসায়ীরা ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে শুরু করে। ব্যাপারটা এতো সহজে হয়নি। এর পেছনে কাজ করেছে এদের ক্রেডিট ইকোনমির সাফল্য।
কোন এক দুঃসাহসী লোক হয়তো মানুষজনের কাছে ধারকর্জ করে অজানার পথে পাড়ি দিল। সেখান থেকে সোনাদানা নিয়ে এসে আগের ধার ফেরত দিল। ফলে ব্যবসায়ী মহলে তার একটা ক্রেডিবিলিটি গড়ে উঠলো। পরে যখন সে আরো বড় অংকের ক্রেডিট এর জন্য এ্যাপ্লাই করলো, সেটা সহজেই মিললো। সেই টাকা দিয়ে আবার যাত্রা, আবারো লাভ, আবারো যাত্রা—এইভাবে চলতেই থাকলো। এমনকি সে নিজের লাভের টাকা থেকে অন্যকে ধারকর্জ দিতেও শুরু করলো। এইভাবে গোটা সমাজে একটা ক্রেডিট ফ্লো গড়ে উঠলো।
যে ক্রেডিট সিস্টেমের কথা আমরা বলছি, সেই ক্রেডিট সিস্টেম যে ইউরোপীয়দের একক আবিষ্কার—তা না। চায়না, ভারত এমনকি মুসলিম জাহানেও এর চল ছিল। আ্ঠারো শতক পর্যন্ত তো প্থিবীতে পুঁজির ভরকেন্দ্র এশিয়ার দিকেই হেলে ছিল।
কিন্তু প্রাচ্যের সমাজে ক্রেডিট সেই সম্মানটা পায়নি, যা সে পেয়েছে পশ্চিমে এসে। প্রাচ্যের হিরো ছিল নাদির শাহ’র মত খুনী। কিংবা অটোম্যানদের মত ব্যুরোক্র্যাটেরা। যাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল জনগণের কাছ থেকে আদায় করা ট্যাক্স। ক্রেডিট আর বণিক—দুটোকেই এখানে খুব হেয় চোখে দেখা হত।
ইউরোপের রাজারা ওদিকে প্রাচ্যের শাসকদের মত ‘খেয়ে ছেড়ে দিব’ টাইপ চিন্তাভাবনা থেকে সরে এসে ব্যবসায়ীদের মত চিন্তাভাবনা শুরু করেন। কোথায় ইনভেস্ট করলে লাভ হবে, কারে ধার দিলে সেটা দ্বিগুণ ফেরত আসবে—এই ওয়েতে। রাষ্ট্রকে তারা আর স্রেফ রাষ্ট্র রাখলেন না। একে একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আদলে চালাতে শুরু করলেন। যার মূল লক্ষ হচ্ছে প্রফিট।
শুরুটা করেন স্পেনের রাণী ইসাবেলা। কলম্বাসের যাত্রার পুরোটাই স্পন্সর করেন তিনি। কলম্বাস অবশ্য ফার্স্টেই ইসাবেলার দরবারে যাননি। তিনি গেছিলান পর্তুগাল রাজার দরবারে। পর্তুগাল সম্রাটকে কনভিন্স করতে ব্যর্থ অন তিনি। একজন সফল উদ্যোক্তার মতই তিনি থেমে যাননি। সাতঘাট ঘুরে অবশেষে ইসাবেলার মন জয় করতে সক্ষ্ম হন তিনি। বোঝান, প্থিবী গোল—এই তত্ত্বে যেহেতু আমাদের ঈমান আছে, সেহেতু পশ্চিমে যাত্রা করলে একদিন ঠিকই স্বর্গের ভারতে যাওয়া যাবে।
আজ আমরা জানি, স্পেন সেইবার বাজিমাৎ করেছিল। কলম্বাসের সফল অভিযানের পর ব্যাংকাররা এইসব অভিযানে ইনভেস্ট করতে আরো সাহস পান। স্পেন পবশ্য বেশিদিন এই সেক্টরে রাজত্ব করতে পারেনি। স্পেনের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে কিছুদিনের মধ্যে স্পেনেরই অধীনস্থ ডাচরা এই ক্রেডিট সেক্টরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।
ডাচরা ছিল স্পেনের খুবই ছোট্ট একটা উপনিবেশ। কেউ তাদের গোনাতেই ধরতো না। ১৫৬৮ সালে তারা স্পেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মাত্র আট বছরের মধ্যেই তারা স্বাধীনতা তো পায়ই, সেই সাথে স্প্যানিশদের হটিয়ে পায় সমুদ্রপথে আধিপত্য।
এই আধিপত্য কোন নাদির শাহ বা কলম্বাস এনে দেয়নি ডাচদের। এনে দিয়েছে ডাচ ব্যাংকার আর ব্যবসায়ীরা। টাকাপয়সার ব্যাপারে ডাচদের একটা সুনাম ছিল ইউরোপে। ডাচরা ছিল ইউরোপের আল-আমিন। তাই কোন যাত্রা করার আগে তারা সহজেই ধার পেত। নিজেদের কোন স্থায়ী সৈন্যবাহিনী ছিল না তাদের। ধারের টাকা দিয়ে সৈন্যবাহিনী ভাড়া করতো তারা। যাত্রা শেষে লাভের টাকা দিয়ে ধার ফেরত দিত। এই করে করে তারা গোটা ইউরোপের মহাজনদের আস্থা অর্জন করে। স্পেনের রাজপরিবার যেখানে অযথা যুদ্ধবিবাদ করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, দেনার সমুদ্রে ডুবছে, ডাচরা সেখানে পুঁজির পাহাড় গড়ে তুলছে। ডাচ সাম্রাজ্য কোন রাজাধিরাজ গড়ে তুলেনি। তুলেছে এর ব্যাংকার আর ব্যবসায়ীরা।
কীভাবে? একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
ধরা যাক, আপনার বাবা জার্মানির বিরাট মহাজন। উনি দেখলেন, ইউরোপের বাজার বড় হচ্ছে। কাজেই, তার ব্যবসাও বড় করা দরকার। তিনি আপনাকে পাঠালেন আমস্টারডাম আর আপনার ছোট ভাইকে পাঠালেন মাদ্রিদ। সাথে দিলেন ১০,০০০ করে স্বর্ণমুদ্রা।
আপনার ভাই তার টাকাটা স্পেনের রাজাকে ধার দিল। সে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যুদ্ধের রসদপাতি লাগবে না? আর আপনি দিলেন হল্যান্ডের এক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীকে। সে আটলান্টিকের ঐপারে ব্যবসা করে। তার ইচ্ছা, ম্যানহাটন নামে এক জায়গায় কিছু জমি কিনে রাখার। তার প্রেডিকশন বলে, কয় দিনের মধেয়ি এই জমির দাম হু হু করে বেড়ে যাবে। তখন সে বেশি দামে বেঁচে লাভ করবে।
ক্যালেণ্ডারের পাতা ওল্টালো। হাডসন নদীর তীর শূন্য বিরানভূমি থেকে জনবহুল ট্রেড রুটে পরিণত হলো। ডাচ ব্যবসায়ী কড়া দামে তার জমি বেঁচে ধারের টাকা ইন্টারেস্ট সহ ফেরত দিল। আপনি খুশি, আপনার বাপও খুশি।
এদিকে স্পেনের রাজাও যুদ্ধে জিতসে। কিন্তু এই ফাঁকে তুর্কীদের সাথে তার লেগে গেছে। তুর্কীদের একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। তার যে ঋণ আছে–এটা তার মাথায় আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঋণ শোধ করার চেয়ে তুর্কীদের সাইজ করাটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।
আপনার ভাই ঠিকই চেষ্টাচরিত্র চালিয়ে যাচ্ছে টাকাটা উদ্ধার করার জন্য। রাজপ্রাসাদে তার যে লিঙ্ক-টিঙ্ক আছে, ওদের দিয়ে ওদের দিয়ে ট্রাই করে যাচ্ছে। এই করে তার পায়ের জুতাই ক্ষয় হল কেবল, টাকা আর ফেরত এলো না।
অবস্থা আরো খারাপ হল যখন সে আপনার ছোট ভাইর আগের ঋণ তো শোধ করলোই না, উলটা আরো ১০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা ধার চেয়ে বসলো। এখন জলে নেমে তো আর কুমিরের কথা অমান্য করলে চলে না। আপনার ছোট ভাই আপনার বাপকে বলে আরো ১০০০০ মুদ্রা আনায়ে রাজার হাতে তুলে দিল।
আপনার ব্যবসা এদিকে ভালোই যাচ্ছে। ধার দিচ্ছেন, ফেরত পাচ্ছেন। বেশ মোটা অংকের লাভ হচ্ছে মাসে মাসে। দিন তো আর সবসময় সমান যায় না। এক ক্লায়েন্ট আপনাকে কনভিন্স করলো যে, সামনে কাঠের জুতার ট্রেন্ড আসতেসে বাজারে। এই বাজার ধরতে হলে এখনই একটা কাঠের জুতার ফ্যাক্টরি দিতে হবে। আপনি তার কথায় ইম্প্রেসড হয়ে ধার দিলেন। দুর্ভাগ্যনকভাবে, কাঠের জুতা মানুষের মন জয় করতে ব্যর্থ হইলো। সে ধার তো ফেরত দিতে পারলোই না। ফেরত চাইলে ধারের কথা বেমালুম অস্বীকার করলো।
আপনার পিতা মহাশয় গেলেন ক্ষেপে। তিনি আপনাদের দু’জনকেই বললেন আইনের আশ্রয় নিতে। কথামত আপনি আইনের দরবারে গেলেন। নেদারল্যান্ডের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন। কাজেই, আইন আপনার কথা শুনলো। শুনে আপনার পক্ষেই রায় দিল। ঐ ব্যাটা জুতাখোরকে আপনার পয়সা ফেরত দিতে বাধ্য করলো। স্পেনে কী হইলো?
স্পেনের আইন আদালত তো আর সেপারেট কোন প্রতিষ্ঠান না। সবই রাজার অঙ্গুলি হেলনে চলে। বিচারক পয়সা ফেরতের কোন বন্দোবস্ত তো করলোই না, উলটা কয়দিন পর রাজা আপনার ছোট ভাইর কাছে ২০০০০ স্বর্ণমুদ্রা চাইলো। দিতে পারলে ভালো। না পারলে তাকে জেলে পুরে রাখবে। কোন কারণে তার ধারণা হইসে, আপনার ছোট ভাই হচ্ছে টাকার খনি। যখনই চাইবো, তখনই পাওয়া যাবে।
সব শুনে আপনার বাপ সিদ্ধান্ত নিলেন, ইনাফ ইজ ইনাফ। স্পেন দেশে আর কোন বিজনেস নয়। এইসব রাজাগজার সাথে তো নয়ই। উনি ছেলের মুক্তিপণটুকু দিয়ে স্পেন থেকে তার ব্যবসা উঠায়ে নিলেন। দুই ভাইকেই আমস্টারডামে বসালেন দুটো ব্রাঞ্চের দায়িত্ব দিয়ে। অবস্থা তখন এতোই শোচনীয় তখন যে খোদ স্পেনের বণিকেরাও আর সেখানে ইনভেস্ট করার সাহস পাচ্ছে না। তারাও তাদের পুঁজি স্পেন থেকে সরিয়ে হল্যান্ডে এনে খাটাচ্ছে।
একটা শিক্ষা তো হল। পকেটে টাকা থাকলেই সেই টাকা বাচ্চা দেয় না। কিন্তু আইনের শাসন থাকলে মানুষ এসে তোমার পকেট ভর্তি করে টাকা দিয়ে যাবে।
ডাচরা তাদের এই সততা আর বিশ্বস্ততা দিয়েই হাডসনের তীরে একটা চমৎকার শহর গড়ে তুলেছিল। নিজেদের রাজধানীর নামে এর নাম দিয়েছিল নিউ আমস্টারডাম। চতুর ইংরেজরা পরে অবশ্য এটা দখল করে নেয়। আকিকা দিয়ে এর নতুন নাম রাখে নিউ ইয়র্ক।
ব্রিটিশদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য ডাচরা শহরে একটা দেয়াল গড়ে তোলে। সেই দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ-ই কালক্রমে পরিণত হয়েছে আজকের দুনিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায়। যার নাম ওয়াল স্ট্রীট।
ব্যবসায়ীদের হাতে, বা ব্যবসায়ী মাইন্ডেড লোকেদের হাতে দেশের পলিসি তুলে দেবার কিছু সমস্যাও আছে।
গল্পের শুরুটা একটা জয়েন্ট স্টক কোম্পানি দিয়ে।
কোম্পানির নাম মিসিসিপি কোম্পানি। মিসিসিপি তখন ছিল আটলান্টিকের ওপারের জলা জনমানবশূন্য একটা দেশ। এক কুমির ছাড়া এখানে বলার মত কিছু ছিল না। এই জলা জনমানবহীন জায়গা নিয়েই এই কোম্পানি তখন কল্পকাহিনী ছড়াতে শুরু করে। একে তো আমেরিকা তখন মানুষের কাছে ল্যান্ড অফ অপরচুনিটি। আর সেই সময় এই গালগপ্পো ভেরিফাই করার কোন উপায়ও ছিল না। কাজেই, ফ্রান্সের মানুষ গোগ্রাসে এই গপ্পো খেতে শুরু করে।
এই কোম্পানির যে ডিরেক্টর, উনি আবার ছিলেন ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্ণর। নিজের প্রভার আর কানেকাশান খাটিয়ে উনি প্যারিস স্টক এক্সচেঞ্জে তার কোম্পানির শেয়ার ছাড়েন। মিসিসিপি হাইপ তখন চরমে। এই হাইপকে কাজে লাগিয়ে সেই শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়িয়ে নেন। যে শেয়ারের দাম ছিল ১০০০ টাকা, তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০,০০০ টাকা। ফ্রান্সের এলিট শ্রেণী তো তার এই ফাঁদে পড়েই, সাধারণ মানুষ জায়গাজমি বেঁচে এই কোম্পানির শেয়ার কেনা শুরু করে। বড়লোক হবার এতো সোজা রাস্তা পেলে কে ছাড়ে?
কিছুদিনের মধ্যেই প্যানিক শুরু হয়। বুদ্ধিমান দুই – একজন বুঝতে পারে, শেয়ারের দাম তো এতো হবার কথা না। মিসিসিপিতে যতো সোনাদানাই থাক না কেনো, মানুষজন যে দামে শেয়ার কিনতেসে, এই পরিমাণ সম্পদ ওখানে নাই। তারা দাম বেশি থাকতে থাকতে শেয়ার বেঁচে দেয়া শুরু করে। তাদের দেখাদেখি আরো লোক দাম কমার আগেই শেয়ার হাত থেকে ঝেড়ে দিতে শুরু করে। পুরো বাজারে একটা হিস্টিরিয়া তৈরি হয়। যে শেয়ারের দাম ১০,০০০ উঠসিলো, সেটা আবার ১০০০ এ নেমে আসলো। পাকা খেলোয়াড়্ররা তথা পুঁজিপতিরা ঠিকই তাদের আখের গোছায়ে নিল। মারা খেলো সাধারণ মানুষ। অনেকে আত্নহত্যাও করলো। (আমাদের শেয়ার বাজারের কথা মনে পড়ে কি?)
মিসিসিপি বাবলের ফলাফল দুইটা। এক, এই যে ফ্রান্সের অর্থনীতি কল্যাপ্স করসিলো, প্রায় এক শতাব্দী তা আর এর ধকল কাটায়ে উঠতে পারে নাই। ফ্রান্সের অভিজাতদের দেখে আমাদের ভুল ধারণা হইতে পারে। সাধারণ মানুষের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। খুব খারাপ মানে খুবই খারাপ। এক টুকরা রুটির জন্য একজন আরেকজনকে খুন করতো—এই অবস্থা। আই ক্রাইসিসই পরে ফ্রেঞ্চ রেভোল্যুশনের রাস্তা তৈরি করে দেয়।
দুই, ফ্রেঞ্চ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর গোটা ইউরোপের আস্থা উঠে গেলো। এরা আর আগের মত বড় বড় মহাজনদের কাছ থেকে ধার পাইলো না। ফলে, উপনিবেশ নিয়া ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মধ্যে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলতেসিলো, তাতে আগায়ে গেলো ব্রিটেন। কিছুদিনের মধ্যেই অর্ধেক প্থিবীর সম্রাট হিসবে আবির্ভাব ঘটলো ব্রিটিশদের।
ব্রিটিশ পুঁজিপতিরাও প্থিবীকে শান্তি দেয়নি। ব্রিটিশ নাবিকেরা দেশে দেশে তাদের নৌতরী ভিড়িয়েছে। আর ব্রিটিশরাজ চোখ বুজে তার বণিকদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। পলাশীর যুদ্ধের কাহিনী তো আমরা সবাই জানি। পলাশীর যুদ্ধ থাক। আজ আমরা আরেকটা যুদ্ধের গল্প শুনি।
ঊনিশ শতকের শুরুর দিক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন চায়নায় আফিম বেঁচে বেশ দুই পয়সা কামাচ্ছে। এক সময় দেখা গেলো, গোটা জাতি আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। চাইনিজ সরকার নড়েচড়ে বসে। আইন করে আফিম নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশরা তো আর কারো কথা শুনে না। তারা চাইনিজদের মধ্যাঙ্গুল দেখিয়ে ঠিকই ড্রাগের চালান পাঠাচ্ছিল।
গভর্ণমেন্ট তখন কঠোর অবস্থানে যায়। ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে জব্দ করা শুরু করে। অনেকগুলো ধ্বংসও করে দেয়। এদিকে ড্রাগ কোম্পানিগুলোতে এমপি-দের একটা বড় শেয়ার ছিল।
এমপি-রা নিজের পেট বাঁচাতে একজোট হয়। ব্রিটিশরাজকে কনভিন্স করে চায়নার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায়। মুক্ত বাণিজ্যের নামে এ যুদ্ধ হলেও আসলে এটা ছিল অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। যার মূল বক্তব্য হল—আমি তোকে ভাত খাইতে বললে তুই ভাত খাবি। আর আমি তোকে গাঁজা খাইতে দিলে তুই গাঁজা খাবি। দিন শেষে আমার প্রোডাক্টই তোর বাজারে থাকবে।
অসম এ যুদ্ধে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশরা অনায়াসে জয়ী হয়। চাইনিজরা নাকে খত দিয়ে আফিমের অবাধ ট্রানজিট মেনে নিতে বাধ্য হয়। হংকং তো ব্রিটিশরা পুরোটাই দখল নিয়ে নেয়। দীর্ঘদন এই হংকং ছিল চায়নায় ব্রিটিশ ড্রাগ কার্টেলের মূল বেস।
পুঁজিবাদ এইভাবে গুটিকতক লোকের পকেট ভারি করতে গয়ে সাধারণ মানুষকে বলির পাঁঠা বানিয়েছে। কখনো খোলাখুলি প্রফিটের নামে করেছে। কখনো সেবার নামে। যদিও দুনিয়ায় নন প্রফিট অর্গানাইজেশন বলে কিছু নাই। সবই মানুষকে একটা বুঝ দিয়ে নিজেদের প্রফিট অর্গানাইজেশনের লাভ বাড়ানোর ধান্দা। ট্যাক্স না দেবার ধান্দা।
১৮৭৬ সালে বেলজিয়ামের রাজা মধ্য আফ্রিকার কঙ্গোয় একটা নন প্রফিট অর্গানাইজেশন খুলেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকা নিয়ে গবেষণা করা আর এখানে যে দাস বাণিজ্য হয়, লাখ লাখ দাসকে যে জাহাজে করে আটলান্টিকের ঐপারে পাঠানো হয়—তা বন্ধ করা। আফ্রিকার জনমানুষের জন্য স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল করাও ছিল এর অন্যতম লক্ষ্য।
কয়েক বছরের মধ্যে এই মানবিক প্রতিষ্ঠানটি দানবিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যার মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়ায় গ্রোথা আর প্রফিট। স্কুল-কলেজ লাটে উঠলো। তার জাউগায় বসানো হল কয়লার খনি আর রাবার বাগান। রাবার ছিল কঙ্গোর প্রধান রপ্তানি পণ্য। পুঁজিবাদের নিয়ম অনুযায়ী, মালিকেরা প্রতি বছর রাবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়তো। আর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে তার দায় মেটাতে হতো ক্ষকদের তাদের জীবন দিয়ে।
ধারণা করা হয়, ১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে ৬০ লক্ষ লোকের ম্ত্যু ঘটে বেলজিয়ান আর্মির হাতে। কারো কারো মতে, এই সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
এইভাবে পুঁজিবাদ মানুষকে বারবার ব্যর্থ করেছে। তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। তার পরও মানুষ পুঁজিবাদকে ছাড়তে পারেনি। এর কারণ বোধয়, তার কাছে এর চেয়ে ভালো কোন অপশন এখনো আসেনি।
কিংবা পুঁজিবাদ অনেকটা ক্ষির মত একটা টেকনোলজি। শিকারী মানুষ যেমন একবার হাল ধরার পর শত অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও আর শিকারী জীবনে ফিরে যেতে পারেনি, আমরাও পুঁজিবাদের হাজারটা ফাঁক-ফোকড় জেনেও একে ডিভোর্স দিতে পারছি না। আমাদের অর্থনীতি এখন এতোই কমপ্লেক্স যে, চাইলেই আমরা ‘গ্রামে ফিরে যাই’ নীতিতে সবকিছু ছেঁড়েছুঁড়ে সহজ একটা জীবন যাপন করতে পারবো না। বড়জোর যেটা করতে পারি, পুঁজিবাদের গলদ্গুলো শুধরে বেটার কোন মডেলে প্থিবীটাকে দাঁড় করাতে, যেন কঙ্গোর কালো মানুষটা কিংবা চা বাগানের শ্রমিকেরাও তাদের বেসিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারে।