পূর্বপাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী জানো?
জানি না স্যার। সবাই জানে, তুমি কেন জানবা না। তুমি দেখি ছাগলের ছাগল।
গভর্নর মোনায়েম খান সাহেবের কথায় যিনি মাথা নিচু করলেন তিনি পূর্বপাকিস্তানের একজন বুদ্ধিজীবী। সম্মানিত মানুষ। অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। সঙ্গত কারণেই তার নাম উল্লেখ করা হলো না। এই অধ্যাপক মোনায়েম খানের মাসিক বেতার ভাষণ মাঝে মাঝে লিখে দেন। এ মাসের বেতার ভাষণ লিখে এনেছেন। মোনায়েম খান এখনো তা পড়েননি। দেশের বড় সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসেছেন।
মোনায়েম খান অধ্যাপকের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেশের বড় সমস্যা হলো মালাউন সমস্যা। হিটলার যেমন ইহুদির গুষ্টিনাশ করেছিল, আমরাও যদি সেরকম মালাউনের গুষ্টিনাশ করতে পারতাম তাহলে শান্তির একটা দেশ পাওয়া যেত। ঠিক বলেছি কি না বলো?
ঠিক বলেছেন।
গ্যাসের কোনো টোটকা তোমার জানা আছে?
কিসের টোটকা বুঝলাম না!
মন দিয়ে না শুনলে কীভাবে বুঝবে? তোমার মন অন্যত্র পড়ে আছে। গ্যাসের টোটকা চিকিৎসা আছে কি না বলো। আমার পেটে গ্যাস হচ্ছে।
বেশি করে পানি খান স্যার।
মোনায়েম খান পানি দিতে বললেন। সাধারণ পানির সঙ্গে এক দুই ফোটা জমজমের পানি মিশিয়ে খাওয়া তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস।
গ্যাসের সমস্যাটা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। শশী-ক্ষিরা এই জাতীয় ফল তার পেটে কখনো সহ্য হয় না। গভর্নর হাউসের বাগানের এক কোনায় মালি কিছু সবজির আবাদ করেছে। এর মধ্যে আছে শশা, কাকরুল, বরবটি তিনি কচি শশা ঝুলতে দেখে লোভে পড়ে তিন-চারটা খেয়ে ফেলেছেন। পাঁচ কোষ কাঁঠাল খেয়েছেন। এই দুইয়ে মিলে পেটে কঠিন গ্যাস তৈরি হয়েছে।
মোনায়েম খান দুই গ্লাস পানি খেয়ে বললেন, বিশিষ্ট মানুষের গ্যাসের সমস্যা—কঠিন সমস্যা। সাধারণ মানুষের জন্যে এটা কিছু না। বিশিষ্ট মানুষের জন্যে বিশিষ্ট সমস্যা। ধরো তোমার পেটভর্তি গ্যাস। ক্লাসে গিয়েছ। ছাত্র পড়াচ্ছ। হঠাৎ ‘পাদ মারলা। কিছু ছাত্র হাসল। ঘটনা এইখানেই শেষ। আমার কথা চিন্তা করো। আজ রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাইস এডমিরাল এ আর খানের সঙ্গে আমার ডিনার। সেখানে যদি হঠাৎ পাদ দেই, বিষয়টা কী রকম হবে?
স্যার, বক্তৃতাটা পড়ে দেখবেন ঠিক হয়েছে কি না?
সবুর করো। এত ব্যস্ত কেন? তুমি যে বক্তৃতা লিখে নিয়ে এসেছ, তার পাখা নাই যে উড়াল দিয়ে চলে যাবে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ আছে, সেগুলা সারব। তারপর বক্তৃতা।
তিনি সেক্রেটারিকে বললেন, ডিআইজি সাহেবকে টেলিফোনে ধরো। পাঁচ মিনিট সময়, এর মধ্যে লাইন লাগিয়ে দিবে।
সেক্রেটারি তিন মিনিটের মাথায় লাইন লাগিয়ে দিলেন।
স্যার মালিকুম।
স্লমালিকুম বলবেন না। স্লা আর শালার মধ্যে তফাত কিছু নাই। পরিষ্কার করে বলবেন আসসালামু আলায়কুম।
জি স্যার। এখন থেকে তাই বলব।
ময়মনসিংহ থানার ওসির নাম কী?
একটু জেনে তারপর বলি।
জেনে বলতে হবে না। তার নাম আখলাকুর রহমান। তাকে বদলি করে দেন দুর্গম কোনো জায়গায়। রামু, নাইক্ষংছড়ি আর কী সব আছে না।
বদলি করে দেব?
অবশ্যই। তবে আপনার কাজ সহজ করে দিচ্ছি—বদলির অর্ডার যাবে। তিন দিনের মাথায় অর্ডার ক্যানসেল হবে। সে যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে।
বিষয়টা স্যার বুঝতে পারছি না।
কিছু বোঝার কি প্রয়োজন আছে? অর্ডার পেয়েছেন অর্ডার পালন করবেন। এর জন্যে কি আপনার আইজির পারমিশন লাগবে?
জি-না।
গুড। আপনাকে অত্যন্ত স্নেহ করি, এটা কি জানেন?
জেনে ভালো লাগল স্যার।
আমি খবর পেয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক গোপনে মদ্যপান করে। তার তালিকা প্রস্তুত করে আমাকে দিবেন।
জি স্যার।
আচ্ছা বিদায়।
খোদা হাফেজ স্যার।
খোদা হাফেজ আবার কী? বলেন আল্লাহ হাফেজ।
স্যার সরি। আল্লাহ হাফেজ।
ইসলাম বিষয়টা মাথার মধ্যে রাখবেন এবং কথায় কথায় বলবেন, আল্লাহু আকবর। এতে দিলে সাহস হবে। আপনারা পুলিশ অফিসার। আপনাদের সাহসের দরকার।
মোনায়েম খান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। সাহসের তারই প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। ভাইস এডমিরাল এ আর খানের সঙ্গে রাতে খানা খেতে হবে ভেবে এখনই যেন শরীর কেমন করছে। সে আবার শরাব খায়। পরিমাণে বেশি খেয়ে ফেললে উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করবে। মান্যগণ্য করে কিছু বলবে না। আর আগের বার তার পিঠে থাবা দিয়ে বাংলায় বলেছে-গভর্নর! তুমি দুষ্ট আছ!
অল্প বাংলা শেখার এই ফুল। দুষ্ট হবে পলাপান। তার মতো বয়স্ক একজন মানুষকে দুষ্ট বলা আদবের বরখেলাফ। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে ইংরেজিতে। এটা একটা বিরাট সমস্যা। কথার পিঠে ইংরেজিতে কথা বলা মানে মুসিবত।
মোনায়েম খান অধ্যাপকের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, দেখি কী লিখেছ। না থাক, দেখব না। তুমি পড়ে শোনাও। দেশবাসী ভাই ও বোনেরা বাদ দিয়ে পড়ো।
অধ্যাপক পড়া শুরু করলেন—’পূর্বপাকিস্তানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুষ্কৃতিকারীরা ঘাঁটি পেতেছে।
মোনায়েম খান বিরক্ত মুখে বললেন, তোমাকে কতবার বলেছি কঠিন শব্দ ব্যবহার করবে না। তোমার বন্ধ্র ফন্দ্র কয়টা লোকে বুঝবে? ডিকশনারি হাতে নিয়ে কেউ বক্তৃতা শোনে না! লেখো—‘দেশের আনাচে-কানাচে দুষ্কৃতিকারী। তাদের একটাই পরিকল্পনা, ইংরেজিতে যাকে বলে Master Plan. দেশকে ইভিয়ার হাতে বিক্রি করা।’ লিখেছ?
একটু আস্তে আস্তে বললে লিখতে পারি।
আমি মূলটা বলি, তুমি গুছিয়ে লেখো। মূল হলো, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মামলার বিচারের জন্যে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বসেছে। ট্রাইব্যুনালের প্রধান সাবেক বিচারপতি জনাব এম এ রহমান। সঙ্গে থাকবেন বিচারপতি জনাব মুজিবুর রহমান খান এবং বিচারপতি জনাব মকসুমুল হাকিম। এই ট্রাইব্যুনাল কুর্মিটোলা সেনানিবাসে আটক শেখ মুজিবসহ ৩৫ জন দেশদ্রোহীর বিচার করবে। এই ট্রাইব্যুনালের রায় মাথা পেতে নিতে হবে। রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল চলবে না।
সবশেষে লিখবে পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনতা এই নগ্ন দেশদ্রোহিতার বিচার চায়। আল্লাহু আকবার। পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ। শুরু করবে আয়ুব খানের উন্নয়নের দশক দিয়ে। বলবে, জাতি এই মহামানবের অবদান কখনো ভুলবে না।
মোনায়েম খান বেল টিপে তার সেক্রেটারিকে ডেকে বললেন, তথ্য সচিবকে জানাও যে আমি তার উপর কিঞ্চিৎ নাখোশ। ঢাকা টেলিভিশন উন্নয়নের দশক ঠিকমতো প্রচার করছে না। এখন তথ্য সচিব কে? বাঙালি না?
জি-মা সার। উনি মুলতানের।
তাহলে থাক, কিছু বলার প্রকার নাই।
মোনায়েম খান পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলেন। সেখানে চুনি পাথরের একটা তসবি আছে। ছোট ছোট দানা। মন অস্থির হলে তিনি গোপনে তসবি জপ করেন। এতে মন শান্ত হয়। আজ তার মন নানান কারণে অস্থির। তিনি চোখ বন্ধ করে পড়ছেন—ইয়ামুকাদ্দেমু। ইয়া মুকাদ্দেমু। হে অগ্রসরকারী। হে অগ্রসরকারী।
অধ্যাপক পাশের ঘরে চলে গেছেন। বক্তৃতা লিখবেন। মোনায়েম খান একা আছেন। দু’বার তসবি টানা শেষ হলো। মোনায়েম খানের অস্থিরতা কমল না, বরং বাড়ল। কিছুদিন নির্জনে থাকতে পারলে ভালো হতো। এক ফাঁকে উমরা হজ্ব করে আসবেন কি না ভাবলেন। এখানেও জটিলতা। আয়ুব খানের কাছে উমরা হজ্বের বিষয়টা তুলেছিলেন। আয়ুব খান বলেছেন, বেশির ভাগ মানুষ পাপ কাটানোর জন্যে হজ্বে যায়। আপনি সুফি মানুষ। আপনার হজ্বের প্রয়োজন কী। মমানায়েম খান সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, তা ঠিক, তা ঠিক।
আয়ুব খান বললেন, দেশসেবা হজ্বের মতোই।
তা ঠিক। তা ঠিক।
এখন আপনার প্রধান কাজ ছাত্র ঠান্ডা রাখা। ছাত্ররা ঠান্ডা আছে না?
মোনায়েম খান বললেন, অবশ্যই ঠান্ডা। গাঙের পানির মতো ঠান্ডা। cold like river water.
ছাত্রদের জন্যে আমি অনেক কিছু করেছি। ভবিষ্যতে আরও করার ইচ্ছা আছে। সিনেমার টিকেটের দাম অর্ধেক করে দিয়েছি।
মোনায়েম খান বললেন, সিনেমা পুরোপুরি ফ্রি করে দিলে কেমন হয়? দিনরাত সিনেমা দেখবে, হাঙ্গামার কথা মনে থাকবে না।
এটা ঠিক হবে না। লোকে অন্য অর্থ করবে। আমি ছাত্রদের জন্যে ট্রেন ভাড়া, বাস ভাড়া সব অর্ধেক করেছি, সেই সঙ্গে সিনেমাও হাফ করেছি। তুমি যা করবে তা হচ্ছে ছাত্রদলগুলি যেন একদল আরেকদলের সঙ্গে লেগে থাকে, সেই ব্যবস্থা। নিজেরা নিজেরা কাটাকাটি করতে থাকুক।
অবশ্যই। ব্যবস্থা করা আছে। সব দলেরই উপরের দিকে কিছু নেতা আমাদের পে লিস্টে আছে।
পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্বপাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রীতি আরও বৃদ্ধি করতে হবে। Student exchang প্রোগ্রাম আরও জোরদার করতে হবে। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ইন্টার মারেজ হবে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দুই অংশের দুশ ছেলেমেয়ের বিয়ে হলো। গভর্নর ভবনে সংবর্ধনা। প্রস্তাবটা কেমন?
এরচেয়ে ভালো প্রস্তাব হতে পারে না। এই দু’শ ছেলেমেয়ের মধ্যে আমার দূরসম্পর্কের ভাইস্তি থাকবে, তার নাম নাদিয়া। M.Sc. পড়ছে। অত্যন্ত ভালো মেয়ে।
Inter province marriage-এর বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখবে। উন্নয়নের দর্শকের সঙ্গে মিলিয়ে দিবে। যখন কোনো ঝামেলা হয়, তখন জনগণের দৃষ্টি ফেরাতে হয়। এই ঘটনায় দৃষ্টি ফিরবে। বুঝেছ?
ইয়েস স্যার।
পশ্চিম পাকিস্তানের যুবকরা বাঙালি মেয়েদের বিষয়ে আগ্রহী। বিয়েতে সমস্যা হবার কথা না। তবে পূর্বপাকিস্তানের কিছু ফকির মিসকিন পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু ফকির মিসকিনকে বিয়ে করে লোক হাসাক তা আমি চাই না।
স্যার, আমি তো আমার ভাইস্তির কথা বলেছি, এরকম আরও জোগাড় হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।
মোনায়েম খান গভীর চিন্তা থেকে জেগে উঠলেন। আবার তাঁর হাত চলে গেল পাঞ্জাবির পকেটে।
তিনি তসবি টানতে টানতে বললেন, বান্দরের বাচ্চা কী লিখেছে দেখছ?
অধ্যাপক চিন্তিত মুখে তাকালেন। বান্দরের বাচ্চা বিষয়টা ধরতে পারলেন না।
মোনায়েম খা বললেন, ইত্তেফাকে কী লিখেছ দেখো নাই? লিখেছে ১৯৬৫৬৬ সালে পূর্বপাকিস্তানে আমদানি করা হয়েছে ৫২ কোটি টাকার পণ্য আর পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৬ কোটি টাকার পণ্য। জনতা ক্ষেপাতে চায়। গাধা সাংবাদিক বুঝে না একটা যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধটা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্বপাকিস্তানে না। ওদের পণ্য বেশি লাগবে।
অধ্যাপক বললেন, কথা সত্য।
মোনায়েম খান বললেন, কথা সত্য হলে এই বিষয়ে লেখালেখি করো। মুখে বড় বড় কথা বললে তো হবে না। মোনায়েম খান বিরক্ত মুখে চোখ বন্ধ করলেন। হঠাৎ প্রবল ঘুমে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। এই ব্যাপারটা তার ঘনঘন ঘটছে। অসময়ে ঘুম পাচ্ছে।