০৯. পা ছুঁয়ে কদমবুসি

টেবিলের নিচে রহমান সাহেবের পা। সেই পা ছুঁয়ে কদমবুসি করতে হলে প্রায় হামাগুড়ির পর্যায়ে যেতে হয়। তাহের তাই করল। নিজেকে এখন তার সত্যি সত্যি কুকুর কুকুর লাগছে।

রহমান সাহেব বললেন, থাক এক। সালাম লাগবে না। স্ত্রীকে নিয়ে এসেছো?

জ্বি স্যার।

গুড। দুজনে মিলে বাড়ি দেখে-শুনে রাখ। স্যারের শখের বাড়ি।

জি আচ্ছা, স্যার।

কামরুলের জ্বর কমেছে?

বলতে পারছি না স্যার। ও গতকাল বাড়ি থেকে বের হয়েছে–বলেছে সদরঘাট যাবে। সেখানের কোন হোটেলে নাকি তার দূর সম্পর্কের এক ভাই থাকে। সেই যে গেছে আর ফিরে আসেনি।

রহমান সাহেবের মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে গেল। তিনি রাগী গলায় বললেন, এই হারামজাদা বিরাট বদ। আগেও এরকম করেছে। কুকুর তিনটাকে ফেলে দু দিনের জন্যে উধাও হয়ে গেছে। দিন কুকুর তিনটা শিকল দিয়ে বাধা হিল–খাওয়া নাই, পনি নাই। তখনি হারামজাদাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা উচিত ছিল। স্যারের জন্যে করতে পারিনি। এইবার আমি একশান নেব। স্যার রাগ করুন আর যাই করুন। তুমি কুকুর তিনটার মোটামুটি দেখা শোনা করতে পারি তো?

পারি স্যার। ভয় ভয় লাগে, তবু…

ভয় লাগার কিছু নেই–চেনা মানুষকে এরা কিছু করে না। তুমিই দেখে-শুনে রাখ। হারামজাদা যদি আসে আমি বাড়িতে ঢুকতে দেবো না। সরাসরি আমার কাছে পাঠাবে। দরকার হলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কুকুরের জন্যে নতুন লোক রাখব। এই কদিন তুমি চালিয়ে নিতে পারবে না?

পারব স্যার।

এদের যত্ন করে রাখ। স্যার খুশি হবেন। স্যারের অতি প্রিয় কুকুর। অসুখের মধ্যেও টেলিফোনে কুকুরের খবর জানতে চান। ছেলেপুলে নাই তো। কুকুরগুলি তাঁর সন্তানের মত।

আমি স্যার চেষ্টা করব যত্ন করতে।

আপাতত তুমি এবং তোমার স্ত্রী দুজনে মিলে এদের দেখাশোনা কর। কুকুরের জেন্যে বরাদ্দ টাকা নিয়ে যাও। ওদের ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করাবে। সপ্তাহে একদিন গোসল দেবে। কুকুরের দেখাশোনার জন্যে যে এক্সট্রা এলাউন্স আছে সেটাও তুমি নাও। হারামজাদা কামরুলকে আমি রাখব না।

আমি কি যাব স্যার।

যাও।

তাহের আবার কদমবুসির জন্যে নিচু হল। আবার তার কাছে নিজেকে কুকুরের মত লাগছে। রহমান সাহেব বললেন, থাক আক, এত সালাম লাগবে না। কথায় কথায় কদমবুলির কোন প্রয়োজন নেই।

 

তাহেরকে অফিস থেকে বেরুবার সময় মনিকার সামনে দিয়ে বেরুতে হয়। কিছু বলবে না বলবে না করেও সে বলে ফেলল, আমার একটা বড় সুসংবাদ আছে। আমি প্রমোশন পেয়েছি। এখন আমি কুকুরের সর্দার। আমার জন্যে একটু দোয়া রাখবেন।

মনিকা তাকাল। তার চোখে গভীর বিতৃষ্ণা। একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের দিকে এমন বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকায় কিভাবে? একটি পশু যখন অন্য একটি পশুর দিকে তখন কি তার চোখেও বিতৃষ্ণা থাকে?

তাহের বলল, আজ আপনাকে অন্য দিনের চেয়েও সুন্দর লাগছে।

মনিকা কঠিন গলায় বলল, কমপ্লিমেন্টের জন্যে ধন্যবাদ।

সবাইকে সব রঙে মানায় না। আপনার জন্যে সবুজ রঙ। সবুজ রঙে আপনাকে অদ্ভুত লাগে।

মনিকা বলল, আপনার নাম তো তাহের তাই না?

জ্বি তাহের। আবু তাহের।

আপনি বসুন। আপনার সঙ্গে দুটা কথা বলব।

বলুন।

মনিকা শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে বলল, কেন আপনি আমাকে বিরক্ত করেন?

বিরক্ত করি?

হ্যাঁ বিরক্ত করেন। অসম্ভব বিরক্ত করেন।

আমি কিন্তু আপনাকে বিরক্ত করি না। আমি যেহেতু দারোয়ান শ্রেণীর একজন মানুষ সেহেতু আমার কথাগুলি আপনার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। আমি যদি দারোয়ান না হয়ে অফিসার গোত্রের কেউ হতাম তাহলে আমার কথা শুনে আপনি বিরক্ত হতেন না। আর আমি যদি বিখ্যাত কেউ হতাম তাহলে আমার কথাগুলি আপনার কাছে অসাধারণ মনে হত। আপনি আমাকে তখন বিনীতভাবে নিমন্ত্রণ করতেন এক কাপ কফি খেয়ে যাবার জন্যে। কফি না খাইয়ে ছাড়তেন না।

মনিকা বলল, কফি খাবেন?

জ্বি খাব।

মনিকা কফি পটের দিকে গেল। তার হাতের কাছেই পার্কোলেটার কফি বীনস সিদ্ধ হচ্ছে। চারদিকে কফির নেশা ধরা গন্ধ।

ক্রীম দুধ দিয়ে দেব?

দিন।

তাহের শান্ত মুখে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে। মনিকা তাকিয়ে আছে। তাহের বলল, অনেকদিন আমি আর আপনাকে বিরক্ত করব না।

কেন?

খুব ব্যস্ত থাকতে হবে। বড় সাহেবের কুকুর তিনটার দায়িত্ব এসে পড়েছে। এদের গোসল করানো, খাওয়ানো, খেলা দেয়া–অনেক কাজ। এদিকে আসা হবে না। আর এলেও আপনার সঙ্গে দেখা করব না।

দেখা করবেন না কেন?

কুকুরের সঙ্গে দিনরাত থাকব তো–গায়ে কুকুরের গন্ধ হয়ে যাবে। কুকুর কুকুর গন্ধ নিয়ে তো আর আপনার সঙ্গে দেখা করা যায় না।

আপনি কি আমাকে একটা সত্যি কথা বলবেন?

অবশ্যই বলব। ইদানিং আমি অবশ্যি সত্যি কথা বলা ভুলে যাচ্ছি। ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলছি। তবে আপনাকে সত্যি কথাই বলব।

মনিকা ইতঃস্তত করে বলল, আপনি প্রায়ই যেচে আমার সঙ্গে কথা বলতে আসেন। কেন?

সবদিন কিন্তু আসি না। যেদিন আপনার গায়ে সবুজ শাড়ি থাকে সেদিনই আসি। সেদিনই কথা বলি।

সবুজ শাড়ির ব্যাপারটা আমি লক্ষ্য করিনি। তবু স্বীকার করে নিচ্ছি। এখন বলুন কেন সবুজ শাড়ি পরা দেখলেই কথা বলতে আসেন?

তাহের কফির মগ নামিয়ে রাখল। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমার যখন সাড়ে তিন কিংবা চার বছর বয়স তখন আমার মার দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়। বাবা মারা গিয়েছিলেন, মার বিয়ে করা ছাড়া কোন পথ ছিল না। মার দ্বিতীয় স্বামী বিপত্নীক একজন মানুষ। ইংল্যাণ্ডে তার হোটেলের ব্যবসা। কথা ছিল ভদ্রলোক আমাকেও নিয়ে যাবেন। বিয়ের পর আমাকে সঙ্গে নিতে রাজি হলেন না। শুধু মাকে নিয়ে যাবেন বলে ঠিক হল। মা এখন আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে আসেন তখন খুব সেজেগুজে এসেছিলেন। তাঁর পরনে ছিল সবুজ সিল্কের শাড়ি। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক।

আমি অবাক হয়ে আমার সাজ-পোশাক দেখছি। মা হাসিমুখে বললেন, তোকে শেষবারের মত দেখতে এসেছি রে খোকন। আমার সুন্দর চেহারাটা যেন তোর মনে থাকে এই জন্যেই সেজে এসেছি। তোর জন্যেই সেজেছি আমি, কোলে আয়। আমাকে কোলে নিলেন। এবং চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, আমার খোকনের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমার খোকনের সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।

তিন-চার বছরের কোন স্মৃতি মানুষের থাকে না। আমারো নেই। শুধু মার সবুজ শাড়িটার কথা মনে আছে। আপনার পরনে যখন সবুজ শাড়ি দেখি তখন…

আপনার মার সঙ্গে আপনার আর দেখা হয়নি?

জ্বি না। মা ইংল্যাণ্ডে যাবার ছবছরের মাথায় মারা যান। ঐখানেই তার কবর বাঁধানো আছে। কোন দিন যদি টাকা হয়–মার কবরটা ছুঁয়ে দেখার জন্যে একবার ইংল্যাণ্ডে যাব।

আপনি কি আরেক কাপ কফি খাবেন

জ্বি-না।

প্লীজ খান, প্লীজ।

না না–লাগবে না। চা-কফি এম্নিতেই আমি খাই না।

তাহের বের হয়ে গেল। কোথায় যাবে সে বুঝতে পারছে না। বাসায় ফিরতে ইচ্ছা। করছে না। আজকের দিনটাও সে বাইরে বাইরে ঘুরবে। সন্ধ্যার পর ফিরবে। কাল থেকে বাসাতেই থাকবে। কুকুরের যত্ন করবে। বাগান করবে। লনের ঘাস বড় হয়ে গেছে। ঘাসগুলি ছেটে সমান করে দিতে হবে। মালীর কাজও সে-ই করবে। যেন নীলা হাউসে অন্য কেউ ঢুকতে না পারে।

এখন কোথায় যাওয়া যায়? পল্টু সাহেবের ফার্মেসিতে গেলে কেমন হয়? উপশম। উনার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করা যেতে পারে। ভদ্রলোককে বলতে হবে, স্যার, আমার জন্যে চাকরি খুঁজতে হবে না। আমি খুব ভাল আছি। সুখেই আছি। I am a happy man.

পল্টু সাহেব ফার্মেসিতে ছিলেন না। কোথায় গিয়েছেন কেউ বলতে পারল না। সকাল বেলাই বেরিয়ে গেছেন। তার গাড়ি নেননি।

তাহেরের কেন জানি মনে হল, উনি গিয়েছেন নীলা হাউসে। পারুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন।

তাহের পার্কের দিকে রওনা হল। বেঞ্চিতে শুয়ে আজ বিশ্রাম করবে। কাল থেকে নানান কাজ–বিশ্রামের সময়ই পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যা পর্যন্ত একটা জমাট ঘুম দেবে। নাক ডাকিয়ে ঘুমুবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *