০৯. পাহাড়ি অঞ্চলের বৃষ্টি

পাহাড়ি অঞ্চলের বৃষ্টি না-কি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এই ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি–এই নেই–পাহাড়ি বৃষ্টির এটাই না-কি ধরন। অথচ কাল সারারাতই বৃষ্টি হয়েছে। যতবার ঘুম ভেঙ্গেছে ততবারই শুনেছি বৃষ্টির শব্দ। পাকা দালানে বৃষ্টি বোঝা যায় না। এখানে বেশ বোঝা যাচ্ছে। বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসও হচ্ছে। পায়ের কাছের জানালা খোলা। খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাট আসছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ছোটখাট ঝড়ের মত হচ্ছে। গাছের পাতায় সোঁ সোঁ গর্জন। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার, ইলেকট্রিসিটি নেই। টেবিলের ড্রয়ারে মোমবাতি আছে। বাতাসের যে মাতামাতি, মোমবাতি জ্বলবে না। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকানোয় ঘরের ভেতরটা আলো হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎ চমকানো শেষ হওয়া মাত্র অন্ধকার আরো বেড়ে যাচ্ছে। বাজ পড়ছে প্রচন্ড শব্দে। মনে হচ্ছে বাজগুলি মাথার উপর পড়ার উপক্রম করছে। এই পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমি প্রচন্ড ভয় পাই। শুয়োপোকা, মাকড়সা এবং বজ্রপাতের শব্দ। শুয়োপোকা এবং মাকড়সার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। কাউকে বললেই ঝাঁটা এনে মেরে দূর করে দেবে, কিন্তু বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই। ছোটবেলায় দুহাতে শক্ত করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে থাকতাম এবং একটু পর পর জিজ্ঞেস করতাম— বাজ পড়া শেষ হয়েছে? ভয়ে কাতর হওয়া একটা বালিকার প্রশ্ন, কিন্তু বাবা এই প্রশ্ন শুনে খুবই মজা পেতেন। হাসি মুখে বলতেন, আমি কি করে বুঝব বাজ পড়া বন্ধ হয়েছে কি-না? বাজগুলি কি আমার কারখানায় তৈরি হচ্ছে?

আজো আমি ভয়ে অস্থির। শরীর গোল করে শুয়ে আছি। দুহাতে কান ঢেকে আছি। তাতে কোন লাভ হচ্ছে না। মাকে জড়িয়ে ধরে থাকলে লাভ হত। সেটা করা যাচ্ছে না কারণ আমি অন্য বিছানায় শুয়েছি। ইচ্ছা করে শুই নি— মা সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি কঠিন গলায় বলেছেন, তুই আমার সঙ্গে শুবি না। ঐ খাটে যা। আমি কথা বাড়াইনি। পাশের খাটে শুয়েছি। তখন যদি জানতাম শেষ রাতে এমন ঝড় বৃষ্টি হবে তাহলে মাকে রাজি করিয়ে তার সঙ্গেই ঘুমুতাম।

বকু বকু!

আমি দুহাতে কান চেপে রাখলেও মার গলা শুনলাম। একবার ভাবলাম জবাব দেব না, তারপরেও বললাম, কী?

আয় আমার কাছে চলে আয়।

না।

বকু কথা শোন আয়।

আমার ভয় লাগছে না মা।

আমার ভয় লাগছে।

আমি বললাম, তোমার যদি ভয় লাগে তুমি আমার খাটে আসবে। আমি কেন যাব?

মা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বালিশ এবং তাঁর বিখ্যাত ভালবাসা-কম্বল নিয়ে চলে এলেন। এমন ভাবে লাফিয়ে খাটে উঠলেন যে মনে হল সত্যি ভয় পাচ্ছেন।

বকু! খুবই ভয় পেয়েছি।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মা সত্যি ভয় পাচ্ছেন। তার হাত পা কাঁপছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। ছোট বাচ্চারা আতংকে অস্থির হয়ে যা করে তিনি তাই করছেন। গুটিশুটি মেরে একেবারে ছোট হয়ে গেছেন।

মা কী হয়েছে?

ভয় পেয়েছি।

ঝড় দেখে ভয় পেয়েছ?

না অন্য কিছু দেখেছি।

অন্য কিছুটা কী?

সকালে বলব।

সকালে না, এখনই বল।

মা ভীত গলায় বললেন, যখন ঝড় শুরু হল ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। তখন….

তখন কী?

আমি জানালাটার দিকে তাকিয়ে আছি। বৃষ্টির ছাট আসছে। উঠে গিয়ে বন্ধ করব কি-না ভাবছি তখন হঠাৎ মনে হল জানালা ধরে কে যেন দাঁড়িয়ে। অন্ধকার কিছু বোঝা যায় না কিন্তু একটা মেয়ে মানুষ যে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বোঝা যায়। বেঁটে খুব রোগা একটা মানুষ। শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর অল্প অল্প মাথা দুলাচ্ছে। ছোট বাচ্চারা যেমন শিক ধরে মাথা দুলায় সে রকম।

বাঁদর নাতো মা? এই অঞ্চলে বাঁদর আছে। পরশু রাতে জাম গাছে আমি একটা বার দেখেছি।

আমিও বাঁদর ভেবেছিলাম কিন্তু….

কী?

হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল তখন দেখলাম, বাঁদর না মানুষ।

মানুষ কী ভাবে হবে মা? দোতলার জানালা। নীচে দাঁড়াবার জায়গা নেই।

বকু কথা বলিস না চুপ করে থাক।

মা, তোমার কি ধারণা তুমি ভূত দেখেছ?

চুপ করে থাকতে বলেছি—চুপ করে থাক।

আশ্চর্য, মা থরথর করে কাঁপছেন। শুধু যে কাঁপছেন তাই না। তাঁর ঘাম হচ্ছে। আমি বললাম, পানি খাবে মা? পানি এনে দেব?

না।

ভূতটা কেমন ছিল বলতো?

মা বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। আমি দুহাতে শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুমি নিশ্চিত মনে ঘুমাওতো মা আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি।

আমি তাকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানি না। ঘুম ভেঙ্গে দেখি ঘর ভর্তি আলো ঝলমল করছে। রোদ উঠে এসেছে বিছানায়। মা বিছানায় নেই। আমি ঠিক করলাম রাতের প্রসঙ্গে মার সঙ্গে আলাপ করব না। তিনি লজ্জা পাবেন। আমার বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করছে না। আজ সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি করে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়? মাসের মধ্যে একটা দিন থাকা দরকার বিছানায় গড়াগড়ি খাবার জন্যে। সেই বিশেষ দিনগুলিতে কেউ বিছানা ছেড়ে নামবে না। বাচ্চারা বিছানায় হুটোপুটি খাবে, বড়রা শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়বে কিংবা গল্পের বই পড়বে।

মিস রুমাল!

সোহরাব চাচা টিপট হাতে ঘরে ঢুকলেন। হাসি মুখে বললেন, তোমার মা কই?

আমি বললাম, জানি না চাচা। আমার এই মাত্র ঘুম ভেঙ্গেছে।

কাল রাতে ঝড় কেমন দেখলে?

খুব ভাল দেখলাম।

বিরাট ঝড় হয়েছে। গাছ পালা, কাচা বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে একাকার হয়েছে। সোমেশ্বরী নদীতে বান ডেকেছে।

বা! কী ইন্টারেস্টিং।

স্যার সোমেশ্বরী নদীর বান দেখতে যাবেন। তুমি যাবে কি-না জানতে চেয়েছেন।

অবশ্যই যাব।

তাহলে চা খেয়ে তৈরি হয়ে নাও।

নাশতা খাব না?

নাশতা নদীর পারে খাওয়া হবে।

সোহরাব চাচা চায়ের পট টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। আমি বললাম, আপনি নিজে সব সময় চা নিয়ে আসেন আমার খুবই লজ্জা লাগে চাচা।

লজ্জার কিছু নাই মা। হাত মুখ ধুয়ে চা খাও। খালি পেটে খেও না। টোস্ট বিসকিট আছে।

থ্যাংক য়্যু চাচা। থ্যাংক য়্যু ভেরি মাচ।

সোহরাব চাচা চলে গেছেন। আমি খাটে পা ঝুলিয়ে বসে চা খাচ্ছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে কী অসাধারণ একটা দিনই না আজ শুরু হতে যাচ্ছে। সোমেশ্বরী নদীতে বান ডেকেছে। আমি এবং তিনি নদীর বান দেখতে যাচ্ছি–

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান

খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরতে ইচ্ছা করছে। আমার কোন শাড়িই নেই। মা আমাকে শাড়ি কিনে দেন না। তার ধারণা, শাড়ি পরলেই আমাকে বড় বড় লাগবে। চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকবে। গুন্ডা ছেলেরা পেছনে লাগবে। সেইসব গুন্ডাদের কেউ খালি হাতে ঘুরবে না ওদের হাতে থাকবে বোতল ভর্তি এসিড। প্রেম করতে রাজি না হলেই বোতল ছুঁড়ে মারবে।

শাড়ি পরলে র শাড়ি পরতে হবে বিশ্রী জবরজং সব শাড়ি। কড়া রঙ। উদ্ভট ডিজাইনের ছাপ। মার সবচে প্রিয় শাড়ির একটায় বাঘ, ভালুক, সিংহের ছবি। শাড়ির নাম কাহিনী-কাতান। শাড়ির গায়ে বাচ্চাদের রূপকথা। কোন সুস্থ মাথার মহিলার এই শাড়ি পরার কথা না, মা পরবেন। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পরবেন। সম্ভবত এই শাড়ির সঙ্গে তার কিছু সুখ স্মৃতি আছে। হয়ত কোন একদিন বাবা বলেছিলেন, (নিশ্চয়ই ঠাট্টা করে বলা, কিংবা মাকে খুশি করার জন্যে বলা) আরে বাঘ-ভালুক মার্কা শাড়িতে তোমাকেতো দারুণ লাগছে।

মাকে ভজিয়ে ভাজিয়ে সিম্পল কোন শাড়ি বের করার জন্যে মার খোঁজে নীচে নেমে মন খারাপ হয়ে গেল। ইউনিটের সবাই সোমেশ্বরী নদীর বান দেখার জন্যে যাচ্ছে। আজ নাকি সবাই নদীর পারে বসে নাশতা করবে। আমি বললাম, মা আমার শরীর ভাল লাগছে না, আমি যাব না।

মা বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই যাবি না মানে? সবাই যাচ্ছে তুই যাবি না কেন?

আমার শরীর ভাল না, এই জন্যে আমি যাব না।

অবশ্যই তুই যাবি। তোকে একা এখানে রেখে যাব? তোর কি মাথাটা খারাপ হয়েছে! যা কাপড় বদলে আয়।

না কাপড় বদলাব না, যে কাপড়ে আছি সেই কাপড়ে যাব।

রাতের বাসি কাপড় পরে যাবি?

হুঁ।

এমন একটা চড় লাগাব না…!

লাগাও।

আমি মুখ গোঁজ করে বসে আছি। কিছুই আমার মনে ধরছে না। একা একা শুয়ে থাকতে পারলে ভালো লাগত। সবাই রেস্ট হাউস ছেড়ে চলে যাবে—— আমি একা থাকব এর আনন্দ আলাদা।

বকুলের কী হয়েছে? মুখ অন্ধকার কেন?

ডিরেক্টর সাহেব কখন এসে, আমার সামনে দাড়িয়েছেন বুঝতে পারি নি। আমি চট করে উঠে দাঁড়ালাম, বিনীত ভঙ্গিতে হাসলাম। আশ্চর্য কাণ্ড আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আমার পা কাঁপছে।

কাল রাতের ঝড় কেমন দেখলে?

ভাল।

কী প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ছিল শুনেছ? আমি ভয়ে অস্থির। এই বুঝি মাথায় পড়ল। বজ্রাঘাতে মৃত্যু খুব খারাপ।

খারাপ কেন?

লোক প্রবাদ হচ্ছে ভয়াবহ পাপীরা বজ্রাঘাতে মারা যায়। সিরাজদ্দৌলাকে যে খুন করেছিল—মিরণ, সে বজ্রাঘাতে মারা যায়।

এইসব আপনি বিশ্বাস করেন?

আরে দূর এইসব বিশ্বাস করব কেন। কত ছোট ছোট অবোধ শিশু বজ্রাঘাতে মারা পড়ে। এরা কী পাপ করবে? এদের সবচে বড় পাপ সম্ভবত কেড়ে ছোট ভাইয়ের লজেন্স নিয়ে নেয়া। সোমেশ্বরী নদীর বান দেখতে তুমি যাচ্ছ না?

যেতে ইচ্ছা করছে না।

সব সময় নিজের ইচ্ছাকে দাম দিও না। কালেক্টিভ ইচ্ছাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে, যদি গুরুত্ব না দাও তাহলে হঠাৎ দেখবে তুমি দল থেকে আলাদা

হয়ে পড়েছে। তখন ভয়াবহ সমস্যা হবে।

কী সমস্যা?

মানুষের ডিএনএ-এর ভেতর একটা ইনফরমেশন ঢুকিয়ে দেয়া আছে। ইনফরমেশনটা হচ্ছে— কখনো একা থেকো না। সব সময় দলে থাকবে। এবং দলের একজনকে মান্য করবে। মানুষ যখন এই পদ্ধতিতে কাজ করতে অস্বীকার করে তখনই তার মাথা আউলা হতে থাকে।

ও।

আচ্ছা দেখি তোমার কেমন বুদ্ধি, বলতো–কেন মানুষের ডিএনএ তে এই তথ্য ঢুকানো যে মানুষকে দলে থাকতে হবে একা থাকা যাবে না। দলের একজনকে মান্য করতে হবে?

জানি না।

খুব সহজ কারণ। প্রাচীন মানুষকে বনে জঙ্গলে থাকতে হত। হিংস্র জন্তু জানোয়ারের ভয়ে দলবদ্ধ ভাবে চলতে হত। সেই কারণে প্রকৃতি মানুষের মাথার ভেতর ইনফরমেশনটা দিয়ে দিয়েছে।

ও।

মানুষের সমস্যা হচ্ছে সে একই সঙ্গে দলে থাকতে চায় আবার একই সঙ্গে দল থেকে আলাদা হয়ে বাস করতে চায়।

প্রকৃতি ডিএনএতে ইনফরমেশন দিয়ে দিয়েছে বলেই কি দলপতি হিসেবে আমরা সবাই আপনাকে মান্য করছি?

হতে পারে। মানুষের স্বভাবই হচ্ছে নিজেদের মধ্যে একজন দলপতি ঠিক করে ফেলা। আমরা যে এত রাজা ভক্ত জাত তা কী জন্যে? একই কারণে। পশুদের মধ্যেও এই দলপতি ব্যাপারটা আছে। মানুষের সঙ্গে পশুদের তেমন কোন প্রভেদ নেই।

মা সেজেগুজে নেমে আসছেন। তাঁর মুখ ভর্তি হাসি। তিনি খুকিদের মত আহ্লাদী গলায় বললেন—বকু আমি কাহিনী-কাতানটা পরলাম। মা ডিরেক্টর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, মঈন ভাই আমাকে কেমন লাগছে? ডিরেক্টর সাহেব বললেন, আপনাকে সুন্দরবন সুন্দরবন লাগছে।

কেন?

বাঘ ভালুক আপনাকে ঘিরে রেখেছে এই জন্যে।

উফ মঈন ভাই আপনি যে কী রসিকতা করতে পারেন। এই শাড়িটা আমাকে বকুলের বাবা কিনে দিয়েছিল। এ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার থেকে যেদিন প্রমোশন পেয়ে সেলস ম্যানেজার হল সেদিন।

খুব সুন্দর শাড়ি। চলুন রওনা হওয়া যাক। পাহাড়ি ঢলের পানি নাকি বেশিক্ষণ থাকে না।

সোমেশ্বরী নদীর কাছে গিয়ে আমরা হতভম্ব। একী কান্ড! নদী ফুলে ফেঁপে একাকার। সমুদ্রের গর্জনের মত শোঁ শোঁ গর্জন আসছে। মাঝে মাঝে প্রবল স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকি হয়ে কড় কড় আওয়াজ হচ্ছে। বড় বড় গাছ নদীতে ভেসে আসছে। সেই সব গাছ ধরার জন্যে গ্রামের মানুষজন জড় হচ্ছে। যে গাছের ডালে প্রথম দড়ি পরিয়ে দিতে পারবে সেই হবে গাছটার মালিক। দড়ি পরানোর কর্মকান্ড মোটেই সহজ না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে নামতে হচ্ছে।

বকুল আম্মা!

তাকিয়ে দেখি মওলানা সাহেব আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ তিনি আচকান পরেছেন। চুল কেটেছেন বলে মনে হচ্ছে। তাঁকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। তাকে খুবই উৎসাহী বলে মনে হচ্ছে।

বুঝছেন আম্মা, একবার এক হাতী পানিতে ভেসে এসেছিল। হাতীর সঙ্গে হাতীর বাচ্চা। মা হাতীটা তার বাচ্চাটাকে শুড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছিল।

তারপর!

এই অঞ্চলের মানুষজন আম্মা খুব সাহসী, তারা দড়ি, চেইন, কাঠ দিয়ে হাতী আর তার বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে ফেলে।

বলেন কী?

দুটা হাতীই গুরুতর জখম হয়েছিল। বাচ্চাটা মারা যায়। মা হাতী বনে চলে যায়। তবে আম্মা অদ্ভুত ব্যাপার, প্রতি বৎসর ঠিক যেদিন বাচ্চাটা মারা গিয়েছিল সেদিন মা হাতীটা বন থেকে নেমে আসত। বাচ্চাটা যে জায়গায় মারা গিয়েছিল সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে থেকে কাঁদত।

বাচ্চাটা কবে মারা গিয়েছিল?

১৯শে চৈত্র।

আপনি নিজে দেখেছেন?

জ্বি আম্মা দেখেছি।

এখনো আসে?

গত তিন বৎসর ধরে আসতেছে না। সম্ভবত মারা গেছে, কিংবা অন্য সন্তানাদি হয়েছে।

মওলানা সাহেব খুব ব্যস্ত হয়ে ইউনিটের কাজে লেগে গেলেন। নাশতা তৈরি হয়েছে। সেই নাশতা হাতে হাতে পৌঁছে দেয়া। চায়ের কাপ তুলে দেয়া। তাঁর ব্যস্ততার সীমা নেই। নাশতা হচ্ছে পরোটা, ডালভাজি, একটা সিদ্ধ ডিম, একটা কলা। মা তার এবং আমার কলাটা বদলাবার জন্যে গিয়েছেন। দাগ ধরা কলা তিনি বদলে নেবেনই।

আমি খুব অবাক হয়ে ল্কখ্য করলাম ডিরেক্টর সাহেব একটু দূরে চায়ের একটা মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখে আশ্চর্য ধরনের বিষণ্ণতা। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নদীর দিকে। তিনি এক পলকের জন্যেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছেন না। এক পলকের জন্যে দৃষ্টি ফেরালেও তিনি দেখতে পেতেন আমি নদী দেখছি না, আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে।

নাশতা খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র সোহরাব চাচা বললেন, একটা অত্যন্ত জরুরি ঘোষণা। পাহাড়ি নদীর পারে একটা শট নেয়া হবে, আগে যেখানে শট নেয়া হয়েছিল সেখানে, কাশবনের কাছে। কাজেই ইউনিট চলে যাবে, দৃশ্যটায় আর্টিস্ট থাকবে শুধু একজন বকুল। বকুল তুমি যাও স্যারের কাছ থেকে দৃশ্যটা বুঝে নাও। মেকাপম্যান ইউনিটের সঙ্গে চলে যাবে। মেকাপ হবে অন লোকেশন।

আমি ডিরেক্টর সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, বকুল একটু কষ্ট করতে হবে। অনেক দূর হাঁটতে হবে। পারবে না?

জ্বি পারব।

নদীতে হঠাৎ যৌবন দেখে দৃশ্যটা আমার মাথায় এসেছে। দিলুতো আগেও এই নদীর কাছে এসেছে। তারপর হঠাৎ একদিন এসে দেখে নদীর এই অবস্থা। তার নির্জের জীবনের সঙ্গে দৃশ্যটি মিলে যাচ্ছে। সে অবাক হয়ে নদী দেখবে। নিজের অজান্তেই সে নদীর পারের খুব কাছাকাছি চলে যাবে। দৃশ্যটা এ ভাবে নেয়া হবে যেন মনে হয় এই বুঝি সে পড়ে গেল নদীতে।

আমার পোষাক কী হবে?

এখন যা পরে আছ তাতেই চলবে। শুধু গায়ে শাদা একটা চাদর জড়িয়ে নেবে।

মার খুব ইচ্ছা ছিল সঙ্গে যাবার। তিনি শেষ পর্যন্ত সাহস করলেন না। তবে মওলানা সাহেব আমাদের সঙ্গে রওনা হলেন আজ শুক্রবার। তার জুম্মার নামাজ আছে— সেটা নিয়ে তাকে তেমন চিন্তিত মনে হল না।

সকাল বেলা রোদ ছিল। আমরা রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। প্রকৃতি কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে। ডিরেক্টর সাহেব বারবার চিন্তিত এবং বিরক্ত মুখে মেঘের দিকে তাকাচ্ছেন। মেঘ হলে শট নেয়া সমস্যা হবে। ভাল শটের জন্যে সানলাইট চাই। তবে হাইস্পীড ফিল্ম ব্যবহার করলে এই সমস্যার সমাধান হবে। অল্প আলোয় কাজ করার জন্যে হাইস্পীড ফিল্ম নিশ্চয়ই আনা হয়েছে। আমি নিজের মনে হাঁটছি–অল্প কিছুদিন কাজ করেই অনেক ফিল্মের কথা শিখে ফেলেছি। কেমন যেন হাসি পাচ্ছে।

শট নেয়া হল।

কেমন হল আমি কিছুই জানি না। ভয়ে আমার আত্মা কেঁপে যাচ্ছিল। এমন একটা জায়গায় আমাকে দাঁড় করানো হল যার ঠিক নীচ দিয়ে সোঁ সোঁ করে স্রোত যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি পার ভেঙ্গে আমি নীচে পড়লাম। মওলানা সাহেব বললেন, আম্মা কোন ভয় নাই আমি আল্লাহপাকের পাক নাম ইয়া আহাদু পড়ে ফু দিয়ে দিয়েছি। তিনি আপনাকে রক্ষা করবেন।

আমার কাজ হল নদীর পানির দিকে বিস্ময়, ভয় এবং আনন্দ নিয়ে তাকিয়ে থাকা। আমি হাসিমুখে ডিরেক্টর সাহেবকে বললাম, বিস্ময় ভয় এবং আনন্দ এই তিন জিনিস একসঙ্গে কী ভাবে দেখাব? তিনি বললেন, খুব সহজ। ঐ জায়গাটায় যখন তুমি দাঁড়াবে তখনই একসঙ্গে বিস্ময় এবং ভয় চলে আসবে। আর তখন আনন্দময় কিছু ভাববে তাহলেই আনন্দও চোখে ছায়া ফেলবে।

এত সহজ?

হ্যাঁ এত সহজ।

আমি দাঁড়ালাম। শট নেয়া হল। ক্যামেরা পজিশন এমন যে একসঙ্গে আমাকে দেখা যাচ্ছে, নদীর জলের ঘূর্নি দেখা যাচ্ছে। ডিরেক্টর সাহেব বললেন, আরেকটা শট নেয়া হবে। তুমি কাশফুল হাতে নিয়ে দাঁড়াও। এক পর্যায়ে কাশফুল নদীতে ছুঁড়ে মারবে। তারপর ক্যামেরা চলে যাবে তোমার মুখ থেকে কাশফুলে। তারপর দেখা যাক কী হয়। আমি তাই করলাম এবং অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল, ফুলটা পড়ল ঠিক জলের ঘূর্নির মাঝখানে। জলের ঘূর্নির সঙ্গে ঘুরছে ডুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠে আবার ডুবে যাচ্ছে। ক্লোজ শটে ক্যামেরা ফুলকে ধরে আছে। ফুল নানান কান্ডকারখানা করছে আমরা সবাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি। মওলানা বললেন, মাশাল্লাহ বড়ই আচানক দৃশ্য।

এই দৃশ্য নিয়ে আমরা এতই অভিভূত, বৃষ্টি যে শুরু হয়েছে তাও বুঝতে পারি নি। যখন বোঝা গেল তখন প্রচন্ড ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। ক্যামেরা ভেজানো যাবে না। চল্লিশ লক্ষ টাকা দামের এরিফ্লেক্স ক্যামেরা। এক ফোঁটা পানিও পড়তে দেয়া যাবে না। বড় বড় ছাতা ক্যামেরার উপর ধরে দৌড়ে কোন একটা বাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে। আমরা সবাই ছুটছি। আশে পাশে কোন বাড়িঘর নেই তবু ছুটছি।

শেষ পর্যন্ত বাড়ি একটা পাওয়া গেল। মাটির বাড়ি উপরে খড়ের ছাউনি। ক্যামেরাম্যান হাঁফ ছেড়ে বললেন, আল্লা বাঁচিয়েছেন। মওলানা সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, মানুষের বিপদে আল্লাহ পাক সব সময় সঙ্গে সঙ্গে আছেন। আমি বললাম, তাই নাকি?

মওলানা সাহেব বললেন, জ্বি আম্মা। আল্লাহ পাক মানুষের বিপদের সময় পাশে থাকেন, মানুষের আনন্দের সময়ও পাশে থাকেন।

কখন তিনি পাশে থাকেন না? তাতো আম্মা বলতে পারি না। আমার জ্ঞান বুদ্ধি অল্প।

বৃষ্টি জোরেশোরে শুরু হয়েছে। দমকা বাতাসও দিচ্ছে। সন্ধ্যা এখনো হয় নি কিন্তু কেঁপে অন্ধকার নামছে। বৃষ্টি সহজে থামবে এ রকম মনে হচ্ছে না।

ডিরেক্টর সাহেব বললেন, ঝাল মুড়ি দিয়ে চা খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। তেলে ভাজা ঝাল মুড়ি, শুকনো মরিচ আর সিগারেট সহ আগুন গরম চা।

ইউনিটের একটা ছেলে ছাতা হাতে সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে গেল। আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যে মুড়ি এবং চায়ের ব্যবস্থা হবে। ডিরেক্টর সাহেব কোন কিছু চেয়েছেন আর তা তাকে দেয়া হয় নি এমন ঘটনা কখনো ঘটে নি।

ডিরেক্টর সাহেব বললেন, পাহাড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে। তোমরা এক কাজ কর বৃষ্টি কমার জন্যে অপেক্ষা কর। আমি ভিজতে ভিজতে রওনা হচ্ছি।

মওলানা সাহেব বললেন, ঠান্ডা লেগে জ্বরে পড়বেন।

বৃষ্টির পানিতে ঠান্ডা লাগে না, জ্বরও হয় না। চা খেয়ে শরীর গরম করে আমি নামব বৃষ্টিতে।

মওলানা বললেন, স্যারের সঙ্গে আমিও যেতাম কিন্তু আচকানটা ভিজে যাবে। আচকান ভিজলে নষ্ট হয়ে যাবে।

আচকান নষ্ট করা ঠিক হবে না। আপনি থাকুন ক্যামেরা ইউনিটকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসুন।

জি আচ্ছা।

চা চলে এল। চায়ের সঙ্গে মুড়ি ভাজা। শুকনো মরিচ ভাজা।

ডিরেক্টর সাহেব বৃষ্টিতে নামার প্রস্তুতি নিলেন। জুতা খুলে ফেললেন, প্যান্ট গুটিয়ে নিলেন। আমি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললাম, আমি আপনার সঙ্গে যাব।

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি যাবে? ভাল বৃষ্টি হচ্ছেতো।

হোক। আমি একা একা এখানে থাকব না।

একা কোথায় সবাইতো আছে।

আপনি চলে গেলে আমিও চলে যাব।

বেশতো চল। তোমার ঠান্ডার ধাত নেইতো? বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে পড়বে?

আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন যে বৃষ্টির পানিতে ঠান্ডা লাগে না।

আমার কথাই আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ?

হ্যাঁ।

চল বৃষ্টিতে নামা যাক। শোন একটা কাজ করা যাক। তুমি বরং হাতে একটা ছাতা নাও। আমি ভিজতে ভিজতে যাই তুমি ছাতা হাতে পেছনে পেছনে আস।

না আমি ছাতা নেব না।

আমরা বৃষ্টিতে নেমে পড়লাম। আমি ভেবেছিলাম সবাই খুব অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাবে। কেউ তাকাল না। যেন ঘটনাটা খুব সহজ ও স্বাভাবিক। ডিরেক্টর সাহেব নিশ্চয়ই এর আগেও অনেক বৃষ্টিতে ভিজেছেন। আমার মত আরো অনেকেই তাঁর সঙ্গী হয়েছে।

বৃষ্টির ফোঁটা অসম্ভব ঠান্ডা। আরেকটু ঠান্ডা হলেই বরফ হয়ে যেত এমন অবস্থা। ফোঁটাগুলিও সাইজে বড়। পাহাড়ি বৃষ্টির এই বুঝি ধরন।

বকুল বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগছে?

খুব ভাল লাগছে।

তুমি কি প্রায়ই বৃষ্টিতে ভেজ?

আমার খুব ইচ্ছা করে কিন্তু মা দেয় না। আমি আবার মার সব কথা শুনি। আমি খুব মাতৃভক্ত মেয়ে।

মাতৃভক্তি খুব ভাল, কিন্তু একটা কথা খেয়াল রাখবে–প্রকৃতি মানুষের জন্যে কিছু সহজ আনন্দের ব্যবস্থা করে রেখেছে মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি কোন ভক্তির কারণেই নিজেকে এই সব সহজ আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবে না।

আচ্ছা যান করব না।

বৃষ্টির ফোঁটাগুলি কেমন সুচের মত গায়ে বিঁধছে দেখছ?

জ্বি দেখছি।

বৃষ্টিতে নামলেই আমার কী করতে ইচ্ছা করে জান?

না জানি না।

সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে। সেটা সম্ভব না। ওয়াটার প্রক সিগারেট থাকলে ভাল হত, ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সিগারেট টানতে টানতে হাঁটতাম।

একটা কাজ করুন কোন একটা গাছের নীচে দাড়িয়ে সিগারেট শেষ করুন। তারপর আমরা হাঁটব।

থাক বাদ দাও। বৃষ্টি মনে হয় আরো জোরে আসছে।

হুঁ।

আমার বেলা সবসময় কী হয় জান–যখন দেখি জোর বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টি দেখে ভিজতে ইচ্ছে হল, যেই নামলাম–ওমি বৃষ্টি শেষ।

আজকেরটা শেষ হবে না। আজ সারা রাত বৃষ্টি হবে।

তোমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে নাতো?

না। মাটি পিছল হয়ে আছে সাবধানে হাঁট।

সাবধানেই হাঁটছি। কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে দেখছেন। কিছুক্ষণ পর আর চোখে কিছু দেখতে পাবেন না।

তাইতো মনে হচ্ছে।

পথ চিনে যেতে পারবেন?

তা পারব। জোড়া তালগাছ দেখতে পাচ্ছ?

হুঁ।

প্রথম যেতে হবে জোড়া তালগাছ পর্যন্ত। সেখানে দুটা রাস্তা। আমরা সেই রাস্তা নেব যেটা গেছে গারোদের শ্মশানের দিকে। বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগছে?

ভাল লাগছে।

ঝড় আসছে এটা কি বুঝতে পারছ?

না।

ঝড় আসছে। ভাল ঝড় আসছে। আমাদের প্রধান কাজ এখন হবে কোন একটা পাকা দালানে আশ্রয় নেয়া।

পাকা দালান পাবেন কোথায়?

তাইতো দেখছি। শ্মশান পর্যন্ত যেতে পারলে হত। শাশানে মরা রাখার একটা ঘর আছে।

আমি মরে গেলেও শ্মশানের ঐ ঘরে যাব না।

দেখতে দেখতে ঝড় শুরু হয়ে গেল। শোঁ শোঁ শব্দ হতে লাগল। ঝড় আসছে উল্টো দিক থেকে। পিঠে বাতাসের ঝাপ্টা লাগছে। আমাকে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। স্যান্ডেল পায়ে রওনা দিয়েছিলাম, স্যান্ডেল অনেক আগেই খুলে ফেলেছি। হাঁটছি খালি পায়ে। বাঁ পায়ে কাঁটা ফুটেছে। কাঁটা ফোঁটায় যন্ত্রণাও সুখের মত লাগছে।

ভয় লাগছে?

উহুঁ। শুধু চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

ধর আমার হাত ধর।

আমি কোন রকম দ্বিধা ছাড়া তাঁর হাত ধরলাম আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল এ জীবনে আমার আর কিছু পাওয়ার নেই, চাওয়ারও নেই। আমি এখন বাস করছি সব পেয়েছির ভুবনে। আমার চোখে পানি এসে গেল।

ঝড় বাড়ছে। বাড়ুক। পৃথিবীতে প্রলয় নেমে আসুক। কিচ্ছু যায় আসে না। আমি এখন ভাল মতই কাঁদতে শুরু করেছি। ভাগ্য ভাল আমার চোখের জল তিনি দেখবেন না। চোখের জলের কারণও কোনদিন জানবেন না।

বকুল!

জ্বি।

মনে হচ্ছে আমরা একটা বিপদে পড়েছি।

কেন?

তালগাছ দেখতে পাচ্ছি না।

মনে হয় ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে।

গাছ ভাঙ্গার মত জোরালো ঝড় হচ্ছে না।

আমার কথা শেষ হবার আগেই প্রচন্ড শব্দে কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বড় একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ল।

বকুল।

জ্বি।

গাছ চাপা পড়ে মারা যাব বলেতো মনে হচ্ছে। কী করা যায় বলতো?

চলুন ফাঁকা মাঠে চলে যাই।

ফাঁকা মাঠেতো মাথায় বাজ পড়ার সম্ভাবনা।

আমি হেসে ফেললাম। তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, হাসছ কেন?

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ভয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এই জন্যে হাসছি।

আমিতো চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

আমিও দেখতে পাচ্ছি না।

তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, হেল্প হেল্প বলে চিৎকার করলে কেমন হয়?

খুব ভাল হয়।

চিৎকার করলেই বা কে দেখবে। কোন মানুষজনওতো দেখছি না।

চলুন আমরা হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় না একসময় কাউকে পাব। কিংবা বাড়ি ঘর পাব।

 

মার্টির দেয়ালের লম্বাটে ধরনের একটা ঘর শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। বিরান মাঠের মাঝে ঘর। প্রাইমারী স্কুল বা মক্তব জাতীয় কিছু হবে। ঘরের দরজা জানালা সবই খোলা। ভেতরে কিছু বেঞ্চ আছে। চাটাই আছে। ঘরটার টিনের চালের একটা অংশ ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে। অন্য অংশটিও হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমরা দুজন রাত কাটাব এমন একটা জায়গায় যে জায়গাটা কেউ কোনদিন খুঁজে পাবে না। এমন অসাধারণ রাত আমি আর কখনোই ফিরে পাব না। কখনো না, কোনদিনও না।

তিনি ভেজা দেয়াশলাই জ্বালাবার চেষ্টা করছেন। যে ভাবে সব ভিজেছে দেয়াশলাই জ্বালার কোন কারণ নেই। তবু তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আহা বেচারার বোধ হয় খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা এখন একটা ভয়ংকর কাজ করলে কেমন হয়? তাকে তুমি তুমি করে বললে কেমন হয়? আমি যদি বলি, মঈন শোন, তুমি সিগারেট ধরাবে কীভাবে? ভিজে গেছে না? পাপিয়া ম্যাডাম যদি মাঝে-মধ্যে তুমি বলতে পারেন–আমি বললে অসুবিধা কী? না কোন অসুবিধা নেই। এই সুযোগ আমার জীবনে আর আসবে না। তিনি খুব চমকে উঠবেন। কিংবা কে জানে হয়ত চমকাবেন না। মানুষ একেক পরিবেশে একেক রকম আচরণ করে।

আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, কী ব্যাপার? আমি বললাম, আমার কেন জানি খুব ভয় ভয় লাগছে।

কিসের ভয়?

জানি না কিসের ভয়। আমি আপনার হাত ধরে বসে থাকব।

বেশতো বসে থাক। ঝড় কিন্তু কমে গেছে।

না কমে নি।

তুমি কাঁদছ কেন?

জানি না কেন যেন আমার খুব কান্না পাচ্ছে। আপনি কি আমাকে একটু আদর করে দেবেন? প্লীজ প্লীজ প্লীজ।

আর ঠিক তখনই মওলানা সাহেবের গলা শোনা গেল। চিন্তিত গলায় মওলানা ডাকছেন, স্যার কি আছেন? স্যার?

টর্চ লাইটের আলো পড়ছে স্কুলের বারান্দায়।

স্যার! স্যার।

তিনি বের হয়ে গেলেন। সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, কে মওলানা সাহেব?

জ্বি স্যার। গজব হয়ে গেছে। গাছপালা ভেঙ্গেছে বাড়িঘর কত যে গেছে কে জানে। আমি আপনার চিন্তায় অস্থির হয়েছি। আপনার খোজে নানান দিকে লোক গেছে।

আমি ভাল আছি।

বকুল আম্মা। উনি কোথায়?

সেও ভাল আছে। তার পায়ে কাঁটা ফুটেছে। হাঁটতে পারছে না। মওলানা সাহেব!

জ্বি।

কোনখান থেকে একটি সিগারেট এনে দিতে পারবেন। মনে হচ্ছে সিগারেট খেলে মরে যাব।

এনে দিচ্ছি স্যার। টর্চ লাইটটা আপনার কাছে রাখেন।

তিনি টর্চ লাইট হাতে স্কুল ঘরে ঢুকলেন। বসলেন আমার পাশে। আমার মনে হল— এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী কোন মেয়ে কোনদিন জন্মায় নি। কখনো জন্মাবেও না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *