৯. পরমাণুবাদীগণ
পরমাণুবাদের প্রতিষ্ঠাতা দুজন : লুসিপ্পাস ও ডেমোক্রিটাস। তাদেরকে পরস্পর থেকে আলাদা করা কঠিন, কারণে দর্শনের ইতিহাসে সাধারণভাবে তাদেরকে একইসঙ্গে উল্লেখ করা হয় এবং দৃশ্যত লুসিপ্লাসের অনেক কাজ পরবর্তীকালে ডেমোক্রিটাসের কাজ বলে পরিচিতি লাভ করেছে।
মিলেটাসের বাসিন্দা ছিলেন লুসিপ্পাস এবং ওই নগরীর বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী দর্শনের ধারার অনুসারী ছিলেন। সম্ভবত তার জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৪০ সালে। তার ওপর পারমিনাইডিসের ও জেনোর বেশ প্রভাব ছিল। তার সম্পর্কে তথ্য এত কম যে, এপিকুরাস (ডেমোক্রিটাসের একজন উত্তরকালীন অনুসারী) তার অস্তিত্ব পুরোপুরিই অস্বীকার করেছেন, আধুনিককালে কেউ কেউ এপিকুরাসের এই মত পুনরুত্থাপন করেছেন। তবে অ্যারিস্টটলের রচনায় লুসিপ্পাস সম্বন্ধে কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় (পাঠের উদ্ধৃতিসহ)। লুসিপ্পাস যদি নিছক একজন পৌরাণিক ব্যক্তি হতেন তাহলে অ্যারিস্টলের রচনায় তার উদ্ধৃতিসহ তার সম্পর্কে উল্লেখ থাকা সম্ভব ছিল না।
ডেমোক্রিটাসের ব্যাপারটা অবশ্য সে রকম নয়। এ নামে একজন ব্যক্তির অস্তিত্ব যে ছিল তা মোটামুটি নিশ্চিত। তিনি প্রেস-এর অ্যাবডেরা নগরীর লোক ছিলেন। তার জীবনকাল সম্পর্কে বলতে গেলে উল্লেখ করতে হয় যে, তিনি নিজেই বলেছিলেন, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৩২ সালে তিনি যখন যুবক ছিলেন, অ্যানাক্সাগোরাস তখন বৃদ্ধ। জ্ঞানের সন্ধানে তিনি দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ভ্রমণ করেছিলেন। সম্ভবত মিসরে তিনি উল্লেখযোগ্য সময় অতিবাহিত করেন এবং নিশ্চিতভাবে পারস্যও ভ্রমণ করেছিলেন। তার পর তিনি অ্যাবডেরায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। জেলার বলেছেন তার পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক সব দার্শনিকের মধ্যে সেরা।
ডেমোক্রিটাস ছিলেন সক্রেটিস ও সফিস্টদের সমসাময়িক, তবে শুধু কালক্রমের ভিত্তিতে তাকে আরো পরের দিকে দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, তাকে লুসিপ্পাস থেকে আলাদা করা খুবই কঠিন। এ কারণেই আমি তাকে সক্রেটিস ও সফিস্টদের পূর্ববর্তীকালে ফেলতে চাই, যদিও তার দর্শনের কিছু অংশ ছিল তার সমসাময়িক ও একই নগরীর বাসিন্দা এবং সফিস্টদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সফিস্ট প্রোটাগোরাসের মতামতগুলোর জবাব। প্রোটাগোরাস যখন এথেন্স যান। তখন তিনি সোৎসাহ অভ্যর্থনা লাভ করেন। অন্যদিকে ডেমোক্রিটাসকে বলতে শুনি, আমি এথেন্স গিয়ে দেখলাম সেখানকার কেউই আমাকে চেনে না। দীর্ঘকাল ধরে এথেন্সে তার দর্শন অবহেলিত ছিল। বার্নেট বলেন, প্লেটো ডেমোক্রিটাস সম্বন্ধে কিছু জানতেন কি না তা পরিষ্কার নয়…অন্যদিকে অ্যারিস্টটল ডেমোক্রিটাসকে ভালোভাবেই জানতেন, কারণ তিনিও ছিলেন উত্তরাঞ্চলের আয়োনিয়ার লোক। প্লেটো তার কোন সংলাপে কখনো ডেমোক্রিটাসের কথা উল্লেখ করেননি। বরং, ডায়োজিনিস লিরাটিয়াস বলেন যে, প্লেটো ডেমোক্রিটাসকে এতটাই অপছন্দ করতেন যে তিনি চেয়েছিলেন তার সব বই পুড়িয়ে ফেলা হোক। হিথ তাকে একজন গণিতজ্ঞ হিসেবে উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন।
ডেমোক্রিটাস, না হলে লুসিপ্পাস পারমিনাইডিসের উপস্থাপিত একত্ববাদ ও এম্পিডক্লিসের উপস্থাপিত বহুতুবাদের মধ্যে মধ্যস্থতা সাধনের প্রয়াস চালাতে গিয়ে পরমাণুবাদে উপনীত হন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো লক্ষণীয়ভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের মতো ছিল। গ্রিক চিন্তাজগতে যে ধরনের ত্রুটির প্রবণতা ছিল তারা সেগুলো অধিকাংশই এড়াতে পেরেছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেক বস্তু পরমাণু দ্বারা গঠিত, পরমাণু গাঠনিকভাবে অবিভাজ্য, জ্যামিতিকভাবে নয়; এবং তারা মনে করতেন যে, পরমাণুগুলোর মাঝে মাঝে শূন্য জায়গা থাকে, পরমাণু ধ্বংসযোগ্য নয়, পরমাণু সর্বদা গতিশীল ছিল, গতিশীল আছে এবং গতিশীল থাকবে। পরমাণুর সংখ্যা অসীম, প্রকারভেদও অসীম এবং তাদের মধ্যকার পার্থক্যগুলো হয় তাদের গাঠনিক রূপ ও আকার অনুসারে। অ্যারিস্টটল বলেন, পরমাণুবাদীদের মত অনুসারে তাপভেদেও পরমাণুগুলো পরস্পর থেকে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে, বর্তুলাকার পরমাণুতে আগুন থাকে এবং তা হয় সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত। ওজনভেদেও পরমাণুর মধ্যে বিভিন্নতা থাকে। তিনি ডেমোক্রিটাসকে উদ্ধৃত করেছেন, পরমাণুর অবিভাজ্যতা যত বাড়ে তার ওজনও তত বাড়ে। কিন্তু পরমাণুবাদীগণের তত্ত্বে পরমাণুর আসলেই ওজন আছে কি না তা একটি বিতর্কিত বিষয়। পরমাণু সর্বদা গতিশীল, কিন্তু ভাষ্যকারদের মধ্যে পরমাণুর আদি গতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বিশেষত জেলার বলেন, মনে করা হতো যে, পরমাণু সর্বদাই পতনশীল এবং সবচেয়ে ভারী পরমাণুগুলো সবচেয়ে দ্রুত গতিতে পতিত হয়, এভাবে পতনশীল অবস্থায় তারা হালকা পরমাণুগুলোকে ধরে ফেলে, তার ফলে অভিঘাত সৃষ্টি হয় এবং পরমাণুগুলো বিলিয়ার্ড বলের মতো পার্শ্বমুখে বিচ্যুত হয়। এটা ছিল নিশ্চিতভাবে এপিকুরাসের মত, যিনি অ্যারিস্টটলের সমালোচনা মোকাবিলা করতে গিয়ে অসচেতনভাবে নিজের তত্ত্বকে দাঁড় করিয়েছেন ডেমোক্রিটাসের তত্ত্বের ভিত্তির ওপর। কিন্তু এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে। যে, লুসিপ্লাসের ও ডেমোক্রিটাসের তত্ত্বে ওজন পরমাণুর কোনো মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল না। বরং এটাই আরো সম্ভবপর মনে হয় যে, তাদের মতে, আদিতে পরমাণুগুলো। এলোমেলোভাবে সঞ্চরণশীল ছিল, যেমনটি দেখা যায় গ্যাসের গতিবিদ্যা সম্পর্কিত আধুনিক তত্ত্বে। ডেমোক্রিটাস বলেন অসীম শূন্যতার মধ্যে উপর বা নিচ বলে কিছু নেই; তিনি আত্মার পরমাণুর গতিকে বায়ুহীন পরিবেশে সূর্যরশ্মির কণিকার গতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। এটা এপিকুরাসের দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমার মনে হয় আমরা এটিকে লুসিপ্পাস ও ডেমোক্রিটাসের অভিমত বলে ধরে নিতে পারি।
পরমাণুগুলোর সংঘর্ষের ফলে ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি হয়। এই আলোচনার বাকিটা অ্যানাক্সাগোরাসের আলোচনার অনুরূপ। তবে অ্যানাক্সাগোরাস বলেন, পরমাণুর ঘূর্ণাবর্ত মনের ক্রিয়ার ফল কিন্তু এই আলোচনা তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে ঘূর্ণাবর্তকে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করে।
পরমাণুবাদীদের প্রাচীনকালে সাধারণভাবে নিন্দা করা হতো এই বলে যে, তারা আকস্মিকতাকে সবকিছুর পেছনের কারণ মনে করেন। কিন্তু আসলে তারা ছিলেন ঠিক তার উলটো প্রকৃতির, কঠোর নিমিত্তবাদী। তারা মনে করতেন সবকিছুই ঘটে কতকগুলো প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে। কোনো কিছু আকস্মিকভাবে ঘটে এ কথা ডেমোক্রিটাস পরিষ্কারভাবে অস্বীকার করেছেন। ব্যক্তি লুসিপ্লাসের অস্তিত্ব নিয়ে যদিও প্রশ্ন আছে, তবু জানা যায় যে তিনি বলেছিলেন, কোনো কিছুই অকারণে ঘটে না; প্রত্যেক ঘটনারই ভিত্তি থাকে, একটি অনিবার্য কারণ থাকে। তবে এ কথা সত্য যে, বিশ্বজগৎ আদিতে যেমন ছিল তা কেন তেমনটি হয়েছে এর কোনো কারণ তিনি বলেননি; সম্ভবত তিনি এর পেছনে আকস্মিকতাকে দায়ী করেছেন। কিন্তু বিশ্বজগৎ একবার যখন অস্তিত্ব লাভ করেছে তখন তার পরবর্তী বিকাশ অপরিবর্তনীয়রূপে নির্ধারিত হয়েছে কতগুলো যান্ত্রিক নিয়ম দ্বারা। পরমাণুর আদি গতির কারণ ব্যাখ্যা না করার জন্য অ্যারিস্টটলসহ অনেকেই তার ডেমোক্রিটাসের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরমাণুবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাদের সমালোচকদের চেয়ে অধিকতর বিজ্ঞানভিত্তিক। কারণের সূত্রপাত অবশ্যই কিছু-একটা থেকে, আর যখন তা শুরু হয় তখন তার সূচনার পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে না। হয়তো বিশ্বজগৎ একজন স্রষ্টার সৃষ্টি, কিন্তু তা হলেও স্রষ্টা তার জন্য দায়ী নন। বস্তুত, পরমাণুবাদীদের তত্ত্ব প্রাচীনকালের অন্যান্য তত্ত্বাদির তুলনায় আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বের অনেক কাছাকাছি।
সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল যা করেননি, পরমাণুবাদীরা তা-ই করেছেন-তারা উদ্দেশ্য বা চূড়ান্ত কারণের উপস্থাপনা ছাড়াই জগৎকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। একটি ঘটনার চূড়ান্ত কারণ হচ্ছে ভবিষ্যতের একটি ঘটনা, যার স্বার্থে ওই আগের ঘটনাটি ঘটে। মানবিক ক্ষেত্রে এই ধারণাটি প্রযোজ্য। রুটিওয়ালা রুটি বানায় কেন? কারণ লোকজনের খিদে পাবে, তারা খাবে। রেলপথ নির্মাণ করা হয় কেন? কারণ লোকজনের ভ্রমণের ইচ্ছা জাগবে। এসব ক্ষেত্রে অভীষ্ট লক্ষ্য দ্বারা বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা হয়। কোনো একটি ঘটনার ব্যাপারে আমরা যখন প্রশ্ন করি কেন? তখন আমরা দুটো কথার মধ্যে যেকোনো একটি বলতে চাই : এই ঘটনার উদ্দেশ্য কী ছিল? বা, আগে কী ঘটেছিল যার ফলে এটা ঘটল? প্রথম প্রশ্নের উত্তর একটি উদ্দেশ্যদবাদী ব্যাখ্যা বা চূড়ান্ত কারণের দ্বারা ব্যাখ্যা। পরের প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে একটি যান্ত্রিক ব্যাখ্যা। আমি জানি না, এই প্রশ্ন দুটোর মধ্যে কোনটা বিজ্ঞানের তরফ থেকে আগেভাগেই তোলা উচিত ছিল, বা দুটো প্রশ্নই ভোলা উচিত ছিল কি না। তবে অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, যান্ত্রিক প্রশ্নটি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের দিকে অগ্রসর হয়েছে, উদ্দেশ্যবাদী প্রশ্নটি তা হয়নি। পরমাণুবাদীরা যান্ত্রিক প্রশ্ন তুলেছেন এবং তার যান্ত্রিক উত্তর দিয়েছেন। তাদের উত্তরসূরিরা, রেনেসাঁ পর্যন্ত, উদ্দেশ্যবাদী প্রশ্নের প্রতি অধিকতর আগ্রহী ছিলেন এবং সেভাবে বিজ্ঞানকে একটি কানাগলিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। উভয় প্রশ্নের ব্যাপারেই একই রকমের সীমাবদ্ধতা আছে। সাধারণ চিন্তা এবং দর্শন উভয় ক্ষেত্রেই এই সীমাবদ্ধতাকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। পুরো বাস্তবতা (ঈশ্বরসহ) সম্পর্কে এই দুটি প্রশ্নের কোনোটিই বোধগম্যরূপে উপস্থাপন করা যায় না, বাস্তবতার কিছু অংশ সম্পর্কে করা যায় মাত্র। উদ্দেশ্যবাদী ব্যাখ্যাটি সম্পর্কে বলা যায় যে, শেষ পর্যন্ত সেটা গিয়ে পৌঁছে এক স্রষ্টায় বা একজন নকশাকারীতে, যার উদ্দেশ্যগুলো সাধিত হয় প্রকৃতির নিয়মে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি একগুয়ে উদ্দেশ্যবাদী হন এবং প্রশ্ন করতে করতে এই জিজ্ঞাসায় উপনীত হন যে, স্রষ্টা কী উদ্দেশ্য সাধন করেন, তাহলে তার প্রশ্ন স্পষ্টতই পাপ বলে গণ্য হবে। তা ছাড়া এর কোনো অর্থও দাঁড়াবে না, কারণ একে অর্থবহ করতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে স্রষ্টাকে সৃষ্টি করেছেন আরো এক মহাস্রষ্টা, যার উদ্দেশ্য তিনি সাধন করেছেন। তাই, উদ্দেশ্যের ধারণাটি বাস্তবতার মধ্যে প্রয়োগযোগ্য, সামগ্রিকভাবে বাস্তবতার উপরে প্রয়োগযোগ্য নয়।
যান্ত্রিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের একটি যুক্তি প্রযোজ্য। বলা যায়, একটি ঘটনার কারণ অন্য একটি ঘটনা, অন্য একটি ঘটনার কারণ আবার তৃতীয় একটি ঘটনা, ইত্যাদি। কিন্তু আমরা যদি সমগ্রের কারণ জানতে চাই তাহলে আমরা আবারও সেই স্রষ্টার কাছে গিয়ে পৌঁছুব, যিনি নিজে অবশ্যই কারণ-বহির্ভূত। সুতরাং সব কারণগত ব্যাখ্যার সূচনা অবশ্যম্ভাবীরূপে স্বনিয়ন্ত্রিত। এ কারণেই বলা যায়, পরমাণুবাদীরা যে পরমাণুর আদি গতির কারণ ব্যাখ্যা করেননি সেটা তাদের কোনো ত্রুটি নয়। কোনোভাবেই ধরে নেওয়া যাবে না যে তাদের তত্ত্বগুলোর পেছনে তারা যেসব কারণ দেখিয়েছেন সেগুলো সম্পূর্ণরূপে অভিজ্ঞতাবাদী বা প্রায়োগিক ছিল। রসায়নশাস্ত্রের সত্য ব্যাখ্যা করার জন্য আধুনিককালে পরমাণু তত্ত্বের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে, কিন্তু গ্রিকদের কাছে এসব সত্য জানা ছিল না। প্রাচীনকালে প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণ ও যৌক্তিক বিচারের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য ছিল না। সত্য যে, পারমিনাইডিস পর্যবেক্ষণলব্ধ সত্যকে অপছন্দ করতেন, কিন্তু এম্পিডক্লিস ও অ্যানাক্সাগোরাস জলঘড়ি ও ঘূর্ণমান বালতির ক্ষেত্রে তাদের অধিবিদ্যা ও প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণকে মিলিতভাবে প্রয়োগ করেছেন। সফিস্টদের আগে পর্যন্ত দার্শনিকদের কারোর মধ্যেই এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ দেখা যায়নি যে, প্রচুর যুক্তি ও কিছু পর্যবেক্ষণের মিশ্রণের দ্বারা একটি পরিপূর্ণ অধিবিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সৌভাগ্যক্রমে, পরমাণুবাদীরা এমন এক অনুমানে পৌঁছেন যার পক্ষে কিছু প্রমাণ। মিলেছে দুই সহস্রাধিক বছর পরে, কিন্তু তাদের যুগে তাদের ওই বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি ছিল না।
লুসিপ্পাস তার যুগের অন্যান্য দার্শনিকদের মতো গতি ও পরিবর্তনের দৃশ্যমান সত্যের সঙ্গে পারমিনাইডিসের যুক্তিকে মেলাবার একটি উপায় উদ্ভাবনে সচেষ্ট ছিলেন। অ্যারিস্টটল বলেন, যদিও মনে হয় এই মতগুলো (পারমিনাইডিসের) যৌক্তিকভাবে একটি দ্বন্দ্বমূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে আসে, তথাপি ঘটনা বিচার করে এসব মতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা হবে পাগলামির কাছাকাছি। কারণ কোনো অপ্রকৃতিস্থ লোক নিশ্চয়ই এতটা হুশ-জ্ঞান হারাতে পারে না যে সে মনে করবে আগুন আর পানি অভিন্ন বা এক। কী সঠিক আর কী অভ্যাসবশত সঠিক বলে মনে হয় তার মধ্যে পার্থক্য ধরতে না-পারার মতো যথেষ্ট পাগল লোকও এ সংসারে কিছু আছে।
লুসিপ্পাস মনে করতেন, তার তত্ত্বটি ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং তা আসন্ন ও চলমানকে, বা গতিকে ও বস্তুর বহুত্বকে নাকচ করে না। প্রত্যক্ষণলব্ধ সত্যের ক্ষেত্রে তিনি এই আপস করেছেন। অন্যদিকে, তিনি অদ্বৈতবাদীদের এই মতের সঙ্গে একমত যে, শূন্যস্থান ছাড়া গতি সম্ভব নয়। এর ফলে একটি তত্ত্ব বেরিয়ে আসে যা তিনি বিবৃত করেন এভাবে : শূন্য হচ্ছে একটি অসত্তা বা অনস্তিত্ব। আর যার অস্তিত্ব আছে তার কোনো অংশই একটি অসত্তা হতে পারে না। কারণ যার অস্তিত্ব আছে তা একটি পরম পূর্ণতা। তবে এই পূর্ণতা এক নয়, বরং উলটো তা বহু, যা সংখ্যায় অসীম এবং তার বিভিন্ন অংশের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মতার কারণে অদৃশ্য। শূন্যতার মধ্যে বিচরণ করে বহু (কারণ শূন্যতা বলে একটি ব্যাপার আছে) এবং একত্রে মিলিত হয়ে তারা অস্তিত্বের আসন্নতা সৃষ্টি করে, আর পৃথক হওয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করে অস্তিত্বের বিলয়। তা ছাড়া, যখন তারা পরস্পরের সংস্পর্শে আসে (কারণ সেখানে তাদের সংখ্যা এক নয়) তখন তারা ক্রিয়া করে ও ক্রিয়ার শিকার হয়। একত্রে মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা সৃষ্টি লাভ করে আর পরস্পরের সঙ্গে মিলিতভাবে বাঁধা পড়ে। অন্যদিকে, বিশুদ্ধ এক থেকে কখনো কোনো বহুর সৃষ্টি হতে পারে না আর বিশুদ্ধ বহু থেকে এক-এর সৃষ্টি হতে পারে না; সেটা অসম্ভব।
দেখা যাবে, একটি বিষয়ে প্রত্যেকেই একমত হয়েছিলেন। সেটা হচ্ছে এই মত যে, পূর্ণতার মধ্যে কোনো গতি থাকতে পারে না। কিন্তু এই বিষয়টিতে সবার মতই ছিল সমান রকম ভ্রান্ত। কারণ পূর্ণতার মধ্যে একটি বৃত্তাকার গতি থাকতে পারে, যদি সেই পূর্ণতা সদা বিরাজমান হয়। ধারণাটি ছিল এ রকম যে, একটি বস্তু কেবল একটি শূন্য স্থানের দিকেই গতি লাভ করতে পারে, আর পূর্ণতার মধ্যে তো কোনো শূন্য স্থান থাকতে পারে না। তাহলে এটা মনে করা যেতে পারে-এবং তা মনে করা হয়তো সঠিকই হবে যে, একটি পূর্ণ স্থানের মধ্যে কখনোই একটি গতির সূচনা ঘটতে পারে না, কিন্তু এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, সেখানে গতি কখনোই সম্ভব নয়। তবে গ্রিকদের ব্যাপারে এটা মনে হয় যে, তারা মনে করতেন হয় পারমিনাইডিসের অপরিবর্তনীয় জগতের ধারণাটিকে মেনে নিতে হবে, নয় শূন্যতাকে স্বীকার করতে হবে।
এখন অনস্তিত্বের বিরুদ্ধে পারমিনাইডিসের অবস্থানকে যৌক্তিকভাবে অকাট্য বলে মনে হয় এবং তার যুক্তিগুলোর পক্ষে আরো সমর্থন পাওয়া যায় এই আবিষ্কার থেকে যে, যেখানে কিছুই থাকে না সেখানে বাতাস থাকে (সেকালে যুক্তি আর পর্যবেক্ষণের মধ্যে এই রকম বিভ্রান্তিকর মিশ্রণ একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল)। আমরা পারমিনাইডিসের অবস্থানটিকে এভাবে প্রকাশ করতে পারি : আপনি বলছেন শূন্যতা আছে; আর শূন্যতা মানে কিছু নয়; অতএব সেটি শূন্যতা নয়। বলা যাবে না যে, পরমাণুবাদীরা এই যুক্তির পালটা জবাব দিয়েছিলেন। তারা শুধু দাবি করেছিলেন যে, তারা তা অগ্রাহ্য করতে চান। এই যুক্তির ভিত্তিতে অগ্রাহ্য করতে চান যে, গতি হচ্ছে। অভিজ্ঞতার একটি তথ্য আর সে কারণেই একটি শূন্যতা অবশ্যই আছে, তা সেই শূন্যতাকে কল্পনা করা যতই কঠিন কাজ বলে মনে হোক না কেন।
এখনই এই সমস্যার পরবর্তীকালীন ইতিহাস বিবেচনা করা যাক। এ ব্যাপারে যুক্তির জটিলতা এড়ানোর প্রথম ও সবচেয়ে সোজা পথ হচ্ছে বস্তু ও স্থান-এর মধ্যকার পার্থক্য নির্দেশ করা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, স্থান কিছু নয়, বরং স্থানের প্রকৃতি একটি আধার বা পাত্রের মতো, যার কোনো অংশ কোনো বস্তু দ্বারা পূর্ণ থাকতে পারে আবার না-ও থাকতে পারে। অ্যারিস্টটল বলছেন (Physics, 208 b) : শূন্যতার অস্তিত্ব আছে-এই তত্ত্ব স্থানের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত, কেননা লোকে শূন্যতাকে এমন একটি স্থান বলে সংজ্ঞায়িত করে যেখানে কোনো বস্তু থাকে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন নিউটন, যিনি পরম স্থানের অস্তিত্ব আছে বলে দাবি করেছেন এবং একইভাবে আপেক্ষিক গতি থেকে পরম গতিকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছেন। কোপার্নিকান বিতর্কের উভয় পক্ষই (যত অল্পই তারা বিষয়টি বুঝে থাকুন না কেন) এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে ছিলেন, কারণ তারা মনে করতেন যে, আকাশমণ্ডলী পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে আবর্তিত হয় আর পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘোরে-এই দুই কথার মধ্যে পার্থক্য আছে। যদি সব গতিই আপেক্ষিক হয় তাহলে এই দুই বাক্য আসলে একই বক্তব্যের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। যেমন জন জেমসের পিতা আর জেমস জনের পুত্র। কিন্তু সব গতি যদি আপেক্ষিক হয় আর স্থান কোনো বস্তু দ্বারা পূর্ণ না হয়, তাহলে আমাদের হাতে শূন্যতার বিরুদ্ধে পারমিনাইডিসের যুক্তিগুলো ছাড়া আর কিছু থাকে না।
ডেমোক্রিটাসের যুক্তিগুলো ছিল আদি গ্রিক দার্শনিকদের যুক্তিগুলোর মতোই। তিনি বলেন যে, বিস্তার বা প্রসারণ হচ্ছে বস্তুর সারসত্তা এবং সে কারণেই বস্তু সর্বত্র বিরাজমান। তার কাছে প্রসারণ বিশেষণ, বিশেষ্য নয়। বস্তুর বিশেষ্য হচ্ছে বন্ধুত্ব এবং বস্তুত্ব ছাড়া বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। তিনি মনে করেন, সুখী লোকের সুখের অনুভূতি ছাড়া যেমন সুখ-এর কথা চিন্তা করা যায় না, তেমনই শূন্য স্থানও একটি উদ্ভট বা অর্থহীন ধারণা। কিছুটা ভিন্ন ভিত্তি থেকে লাইবনিজও পূর্ণতায় বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন যে, স্থান হচ্ছে একটি সম্পর্ক-ব্যবস্থা (state of relations)। এই বিষয়ে লাইবনিজ ও নিউটনের মধ্যে সাড়া-জাগানো এক বির্তক ছিল, যে-বিতর্কে নিউটনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ক্লার্ক। আইনস্টাইনের সময় পর্যন্ত ওই বিতর্ক অমীমাংসিত ছিল। আইনস্টাইনের তত্ত্ব লাইবনিজকে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী ঘোষণা করেছে।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানী যদিও বিশ্বাস করেন যে, বস্তু এক অর্থে পারমাণবিক, কিন্তু তিনি মনে করেন না যে, শূন্য স্থান বলে কিছু আছে। যেখানে কোনো বস্তু নেই সেখানেও একটা কিছু থাকে, যেমন আলোকতরঙ্গ থাকে। পারমিনাইডিসের যুক্তিগুলোর কল্যাণে দর্শনশাস্ত্রে বস্তু এককালে যে উচ্চমর্যাদা অর্জন করেছিল তা পরবর্তীকালে আর বজায় থাকেনি। বস্তু অপরিবর্তনীয় দ্রব্য নয়, বরং তা ঘটনাগুলোর গোষ্ঠীভেদের একটি উপায় মাত্র। কিছু কিছু ঘটনা এমন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত যে গোষ্ঠীকে বস্তুগত বলে মনে করা যেতে পারে। অন্যগুলো, যেমন আলোকতরঙ্গ, ওই গোষ্ঠীতে পড়ে না। ঘটনাবলিই বিশ্বজগতের উপকরণ বা মালমসলা এবং সেগুলোর স্থায়িত্ব খুবই সংক্ষিপ্ত। এই অর্থে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান হেরাক্লিটাসের পক্ষে আর পারমিনাইডিসের বিপক্ষে। কিন্তু আইনস্টাইনের তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের আগে পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞান ছিল পারমিনাইডিসের পক্ষে।
স্থানের ব্যাপারে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই যে, স্থান কোনো বস্তুসত্তা নয়, যেমনটি নিউটন মনে করতেন এবং লুসিপ্পাস আর ডেমোক্রিটাসও যে কথাই বলতেন। আবার, ডেমোক্রিটাসের ভাবনার মতো স্থান বস্তুগুলোর বিশেষণও নয়, বরং স্থান হচ্ছে সম্পর্কগুলোর একটি ব্যবস্থা, যেমনটি মনে করতেন লাইবনিজ। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি শূন্যতার অস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না তা কোনোভাবেই পরিষ্কার নয়। হয়তো বিমূর্ত লজিকের একটি বিষয় হিসেবে তাকে শূন্যতার সঙ্গে মেলানো যেতে পারে। আমরা বলতে পারি যে কোনো দুইটি জিনিসের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব থাকে, তা বেশি বা কম হতে পারে এবং সেই দূরত্বের মধ্যে কোনো বস্তু থাকে না। এ ধরনের মতকে অবশ্য আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে প্রয়োগ করা অসম্ভব। আইনস্টাইনের পর থেকে মনে করা হয় যে, দূরত্ব ব্যাপারটি ঘটনাগুলোর মধ্যকার ব্যাপার, বস্তুগুলোর মধ্যকার নয়, আর দূরত্বের সঙ্গে সময় এবং স্থানের সম্পর্ক আছে। এটা অবশ্যই একটি কারণগত ধারণা, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে একটি দূরত্বের মধ্যে কোনো ক্রিয়া ঘটে না। এই সবকিছুরই ভিত্তি অবশ্য প্রায়োগিক, যৌক্তিক নয়। তা ছাড়া আধুনিক মত ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ ছাড়া প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং তা করা হলে প্রাচীনকালের দার্শনিকদের কাছে তা বোধগম্য হতো না।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পরমাণুবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিক বিকাশই নিউটনের পরম স্থানের তত্ত্ব, যে তত্ত্ব অসত্তাকে বাস্তব প্রমাণ করার সমস্যার মুখোমুখি। এই তত্ত্বের ব্যাপারে কোনো যৌক্তিক আপত্তি নেই। প্রধান আপত্তি হচ্ছে এই যে, পরম স্থানকে কোনোভাবেই জানা যায় না এবং সে কারণেই তা একটি প্রায়োগিক বিজ্ঞানের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমান নয়। আরো বাস্তবিক আপত্তি হচ্ছে এই যে, পদার্থবিজ্ঞান পরম স্থানের ধারণা ছাড়াই চলতে পারে। কিন্তু পরমাণুবাদীদের কল্পিত জগৎ যৌক্তিকভাবে সম্ভব এবং বাস্তব জগতের সঙ্গে তার সাদৃশ্য প্রাচীনকালের অন্যান্য ধারার দার্শনিকদের কল্পিত জগতের চেয়ে অনেক বেশি।
ডেমোক্রিটাস তার তত্ত্বগুলোর বেশ বিশদ রূপরেখা তৈরি করেছিলেন এবং তার সেই রূপরেখার কিছু অংশ আগ্রহব্যঞ্জক। তিনি বলেন, প্রতিটি পরমাণু অভেদ্য এবং অবিভাজ্য কারণ তার মধ্যে কোনো শূন্য স্থান নেই। ছুরি দিয়ে যখন আপেল কাটা হয়, তখন আপেলের মধ্যে এমন কিছু শূন্য স্থান থাকা প্রয়োজন যার মধ্যে ছুরিটি ঢুকে যেতে পারে। আপেলটির মধ্যে যদি কোনো শূন্য স্থান না থাকত তা হলে তা হতো সীমাহীনভাবে কঠিন এবং সেই কারণে দৈহিকভাবে অবিভাজ্য। প্রতিটি পরমাণু অন্ত গতভাবে অপরিবর্তনীয়, বস্তুত, তা পারমিনাইডীয় এক। পরমাণুগুলো শুধু সঞ্চরণ করে, পরস্পরকে আঘাত করে এবং কখনো কখনো পাশাপাশি সজ্জিত হয়ে এমন আকার ধারণ করে যেগুলো আবার পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগতে পারে। নানা বিচিত্র আকারে পরমাণুগুলো সজ্জিত হতে পারে; আগুন গঠিত হয় ছোট ছোট চাকতির আকারের পরমাণুগুলোর সমন্বয়ে, আত্মাও তাই। পরমাণুগুলোর সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণাবর্তের, যা থেকে বিভিন্ন ধরনের বস্তু উৎপন্ন হয় এবং যা থেকেই শেষ পর্যন্ত সৃষ্টি হয় বিশ্ব। বিশ্বের সংখ্যা অনেক, সেগুলোর কতিপয় সৃষ্টি লাভ করছে, কতিপয় বিলীয়মান। কতক বিশ্বের সূর্য নেই, চাঁদও নেই। আবার কতকগুলোর অনেকগুলো করে সূর্য ও চাঁদ আছে। প্রত্যেকটি বিশ্বের শুরু ও শেষ আছে। একটি বিশ্ব কোনো বৃহত্তর বিশ্বের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এই সৃষ্টিতত্ত্বটির সারকথা ব্যক্ত করা যেতে পারে কবি পি. বি. শেলির ভাষায় :
বিশ্বের পর বিশ্ব ঘূর্ণমান অনাদিকাল
সৃষ্টি হতে বিলয় অবধি,
নদীবক্ষে বুদবুদের মতো
ঝলকায়, ফেটে যায়, বয়ে চলে যায়।
প্রাণের উৎপত্তি ঘটেছে আদিমতম কাদা থেকে। প্রত্যেকটি জীবন্ত দেহে কিছু পরিমাণ আগুন থাকে, বেশিরভাগই মস্তিষ্কে আর বক্ষদেশে (এ বিষয়ে বিজ্ঞ মহলে মতভেদ আছে)। চিন্তা একধরনের গতি এবং সে কারণেই তা অন্যত্র গতি সঞ্চার করতে সক্ষম। প্রত্যক্ষণ ও চিন্তন ভৌত বা শারীরিক প্রক্রিয়া। প্রত্যক্ষণ দুই প্রকারের : ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষণ আর বুদ্ধির দ্বারা প্রত্যক্ষণ। বুদ্ধির দ্বারা প্রত্যক্ষণ নির্ভর করে শুধু প্রত্যক্ষণের বস্তুর ওপর। আর ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষণ আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর ওপরও নির্ভর করে এবং সেই কারণে বিভ্রান্তিকর হতে পারে। লকের মতো ডেমোক্রিটাসও মনে করতেন যে, উষ্ণতা, স্বাদ, রং-এই ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো আসলে প্রত্যক্ষণের বস্তুর মধ্যে থাকে না, ওগুলো আমাদের ইন্দ্রিয়সঞ্জাত। কিন্তু ওজন, ঘনত্ব এবং দৃঢ়তা-এই ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো বস্তুর মধ্যেই থাকে।
ডেমোক্রিটাস ছিলেন একজন আগাগোড়া বস্তুবাদী। আমরা দেখেছি, তার বিবেচনায় আত্মা পরমাণু দ্বারা গঠিত, আর চিন্তা একটি ভৌত বা শারীরিক প্রক্রিয়া। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো লক্ষ্য নেই; আছে শুধু যান্ত্রিক নিয়মে পরিচালিত পরমাণুগুলো। জনসমাজে প্রচলিত ধর্মের প্রতি ডেমোক্রিটাসের কোনো বিশ্বাস ছিল না। তিনি অ্যানাক্সাগোরাসের মন-এর ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছিলেন। নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে, তিনি মনে করতেন জীবনের লক্ষ্য আনন্দ-উচ্ছলতা; আর তা অর্জন করার সর্বোত্তম উপায় মিতাচার ও সংস্কৃতিমান হওয়া। যা-কিছু প্রচণ্ড, যা-কিছু প্রবল আবেগপূর্ণ, তার সবই তিনি অপছন্দ করতেন। যৌনতার প্রতি তার সমর্থন ছিল না, কারণ তিনি বলতেন, যৌনতায় ইন্দ্রিয়সুখ দ্বারা চেতনা আচ্ছন্ন হয়। তিনি বন্ধুত্বকে মূল্য দিতেন, তিনি নারীদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করতেন এবং সন্তান-সন্ততির আকাক্ষা করতেন না, কারণ তাদের পড়াশোনা শেখানোর কাজে দর্শন বাধাগ্রস্ত হয়। এই সবকিছুর বিচারে তিনি ছিলেন অনেকটাই জেরেমি বেনথামের মতো। গ্রিকরা যাকে গণতন্ত্র বলত সেই ব্যবস্থার প্রতিও তার অনুরূপ ভালোবাসা ছিল।
যে একটি ভ্রান্তি পরবর্তী-প্রাচীন যুগের ও মধ্যযুগের সব চিন্তাকে দূষিত করেছিল, ডেমোক্রিটাস ছিলেন, অন্ততপক্ষে আমার মতে, ওই ভ্রান্তি থেকে মুক্ত গ্রিক দার্শনিকদের সর্বশেষ জন। এ পর্যন্ত আমরা যেসব দার্শনিক সম্পর্কে আলোচনা করেছি তারা সবাই বিশ্বজগৎকে বোঝার এক নিরাসক্ত প্রয়াসে লিপ্ত ছিলেন। বিশ্বজগৎকে বোঝা যতটা সহজ বলে তারা মনে করতেন, তত সহজ তা নয়; কিন্তু এই আশাবাদ ছাড়া তাদের পক্ষে জগৎকে বোঝার প্রয়াস শুরু করার সাহস অর্জন করাই সম্ভব ছিল না। প্রধানত, যেসব বিষয়ে তাদের প্রবণতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের যুগের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও সংস্কারগুলো ক্রিয়াশীল ছিল না সেসব বিষয়ে তাদের ঝোঁক ছিল নির্ভেজাল বৈজ্ঞানিক। কিন্তু তাদের প্রবণতা শুধুই বৈজ্ঞানিক ছিল না, তারা একই সঙ্গে ছিলেন কল্পনাপ্রবণ, প্রাণপ্রাচুর্যময় এবং দুঃসাহসিক অভিযানের আনন্দে ভরপুর। উল্কা, সূর্য/চন্দ্রগ্রহণ, মৎস্যকুল, ঘূর্ণিবাত্যা, ধর্ম, নৈতিকতা ইত্যাদি সমস্ত কিছুর প্রতিই ছিল তাদের আগ্রহ ও আকর্ষণ। সর্বভেদী মননের সঙ্গে তাদের মধ্যে মিশ্রণ ঘটেছিল শিশুসুলভ উৎসাহের।
এই পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতুলনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে, কিন্তু এই সময়ের পর থেকেই অবক্ষয়ের বীজ রোপিত হয় এবং অতঃপর ক্রমে অবনতি ঘটতে থাকে। ডেমোক্রিটাসের পর থেকে এমনকি সর্বোত্তম দর্শনের মধ্যেও একটি বিপথগামিতা দেখা দেয়, আর তা হচ্ছে বিশ্বজগতের চেয়ে মানুষের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ। প্রথমে আসে সংশয়বাদ, যা নিয়ে আসেন সফিস্টরা। এর ফলে নতুন নতুন জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টার চেয়ে কীভাবে আমরা জ্ঞান পেতে পারি-এই জিজ্ঞাসাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তারপর, সক্রেটিসের মাধ্যমে নীতিশাস্ত্র হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ; তারপর প্লেটো এসে ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষণের জগৎকে খারিজ করে স্বনির্মিত শুদ্ধচিন্তার জগতের পক্ষ নেন। তারপর অ্যারিস্টটল এসে বলেন, বিজ্ঞানে মৌলিক ধারণা হচ্ছে উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বাস। প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের মৌলিক প্রতিভা সত্ত্বেও তাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এমন অনেক দোষ ছিল যা পরবর্তীকালে ভীষণ ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। তাদের যুগের পর থেকেই গ্রিক মনীষায় প্রাণশক্তির ক্ষয় এবং জনসমাজে ক্রিয়াশীল নানা কুসংস্কারের পুনঃপ্রকোপ খেয়াল করা যায়। আংশিকভাবে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটে ক্যাথলিক ধর্মের বিজয়ের ফলে; কিন্তু রেনেসাঁর আগে পর্যন্ত দর্শনে আগের সেই প্রাণশক্তি ও স্বনির্ভরতা ফিরে আসেনি, যা ছিল সক্রেটিসের পূর্বসূরিদের বৈশিষ্ট্য।