পদ, যতি ও যতিলোপ
এবারে আমরা পদ-প্রসঙ্গে ঢুকব। পদ করে কয়? পিয়ার নিয়ে আলোচনার সময়ে তার কিছুটা আভাস দিয়েছিলুম। এবারে আর-একটু বিস্তারিতভাবে তার সুলুকসন্ধান নেওয়া দরকার।
সনেট তো চোদ্দো পঙক্তির কবিতা। বাংলায় তাকে আমরা চতুৰ্দশপদী কবিতা বলি। সেই বিচারে ‘পদ কথাটার অর্থ দাঁড়ায় পঙক্তি। শব্দকোশেও অন্যান্য অর্থের সঙ্গে, এই অর্থটা দেওয়া আছে বটে। কিন্তু এখানে আমরা ‘পদ” বলতে যা বোঝাতে চাইছি, তাতে এই অর্থটা পরিত্যাজ্য। কেন-না, একটু বাদেই আমরা দেখব যে, কবিতার পঙক্তিতে অনেকসময়ে একাধিক পদ থাকে। সেক্ষেত্রে, ‘পদ” বলতে যদি আমরা ‘পঙক্তি’ বুঝি, তাহলে ‘দ্বিপদী পঙক্তি’ কথাটার অর্থ দাঁড়াবে ‘দ্বি-পঙক্তিক পঙক্তি’, এবং ব্যাপারটা তখন খুবই ধোঁয়াটে হয়ে দাঁড়াবে।
তার চেয়ে বরং ‘পদ” বলতে ‘পদক্ষেপ” বোঝাই ভালো। বস্তৃত, প্রতি পদক্ষেপে যেখানে বিপদের আশঙ্কা কিংবা আনন্দের আশ্বাস রয়েছে, সেখানে তো আমরা ‘পদে-পদে বিপদ’ কিংবা ‘পদে-পদে আনন্দ”-এর কথাই বলে থাকি। (উদাহরণ : “নিবিড় ব্যথার সাথে পদে-পদে পরম সুন্দর”— রবীন্দ্রনাথ।)
এখন ব্যাপার হচ্ছে এই যে, কবিতার পঙক্তিগুলিকে তো আমরা একটানা পড়ে। যাই না, একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাব, আমরা যখন কবিতা পড়ি, তখন সেই কবিতার এক-একটি পঙক্তি একাধিক অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এটা হয় ছন্দের চালের জন্য। তা যেমন অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, তেমনই পয়ার-বন্ধের আলোচনার সময়ে আমরা দু-রকম চালের কথা জেনেছিলুম। ছোটো-মাপের চাল আর বড়ো-মাপের চাল। চাল না-বলে একে চলন কিংবা পদক্ষেপও বলতে পারি। সত্যি, এ যেন দু-রকমের পদক্ষেপ। ছোটো-মাপের ও বড়ো-মাপের। এই দুই-মাপের পদক্ষেপ, আসলে, কবিতার পঙক্তির ভিতরকার দুই-মাপের দুটি অংশকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। আমরা যখন ছোটো পদক্ষেপে চলি, তখন ছোটো-মাপের অংশটাকে ধরতে পারি। আর বড়ো-পদক্ষেপে চললে সন্ধান পাই বড়ো-মাপের অংশের। ছোটো-মাপের অংশকে আমরা বলি। ‘পৰ্ব’’। বড়ো-মাপের অংশকে বলি “পদ”।
পদক্ষেপ-এর কথাটা যখন বলেইছি, তখন আর-একটু বিশদ করে বলা যাক। পদক্ষেপ করতে-করতে এগোনো মানে বারবার পা-ফেলা ও পা-তোলা। এই পাফেলা ও পা-তোলার মধ্যে একটু বিরতি ঘটে। এ যেন চলার মধ্যেই একটু থেমে থাকার ব্যাপার। আমরা যখন কবিতা পড়ি, তখন একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর, প্রায় আমাদের অগোচরে, এই থেমে-থাকার ব্যাপারটা ঘটতে থাকে। আমরা একটু চলি, একটু থামি, একটু চলি, একটু থামি— এই রকমের ব্যাপার। আর কী। কবিতায় এই থেমে-থাকার ব্যাপারটাকেই বলি ‘যতি’।
‘যতি’ আছে তিন রকমের। ছোটো যতি, মাঝারি যতি আর বড়ো যতি। ছান্দসিক এর নাম দিয়েছেন লঘুযাতি, অর্ধর্যাতি আর পূর্ণযতি। কবিতার পঙক্তির মধ্যে পর্ব যেহেতু সবচেয়ে ছোটো অংশ, তাই তার পরে আসে লঘুযতি; আর পদের মাপ যেহেতু পর্বের চেয়ে বড়ো, তাই তার পরে আসে অর্ধযতি।। পঙক্তির মাপ আরও বড়ো। তাই পূৰ্ণযতি আসে পঙক্তির শেষে।
একটা দৃষ্টান্ত দিই।
নতমুখে বলেছিলে, চিত্তে রেখো আশা
আঁধারেও দীপ্তি যেন পায় ভালোবাসা।
এই যে অক্ষরবৃত্ত-ছন্দ-লেখা দুটি পঙক্তি, ছোটো-পদক্ষেপে চললে— ছন্দের চাল অনুযায়ী— এরা পর্বে-পর্বে এইভাবে ভাগ হয়ে যাবে :
নতমুখে/বলেছিলে/চিত্তে রেখো/আশা,
আঁধারেও/দীপ্তি যেন/পায় ভালো/বাসা।
সেক্ষেত্রে প্রতি পর্বের শেষে আমরা একটুক্ষণের জন্য থেমে দাঁড়াব, এবং এই যে একটুক্ষণের জন্য থেমে দাঁড়ানো, এটাই হচ্ছে লঘুযতি।।
বড়ো-পদক্ষেপে চললে কিন্তু পর্বে-পর্বে বিভক্ত না-হয়ে এই পঙক্তি দুটি আর একটু বড়ো-মাপে অর্থাৎ পদে-পদে ভাগ হয়ে যাবে। তখন ভাগটা হবে এইরকম :
নতমুখে বলেছিলে,/চিত্তে রেখো আশা,
আঁধারেও দীপ্তি যেন/পায় ভালোবাসা।
তখন দেখতে পাব যে, দুটি পঙক্তির প্রতিটির মধ্যেই রয়েছে দুটি করে পদ; অর্থাৎ এই পঙক্তি দুটি হচ্ছে দ্বিপদী পঙক্তি। (প্রথম পদ আর্ট-মাত্রার; দ্বিতীয় পদ ছ-মাত্রার) সেইসঙ্গে আর-একটা জিনিসও দেখা যাবে। সেটা এই যে, ছোটো-পদক্ষেপে চললে পর্বশেষে আমরা যেটুকু সময়ের জন্যে থেমে দাঁড়াচ্ছিলুম, বড়ো-পদক্ষেপে চলার ফলে পদশেষে তার চাইতে আর-একটু বেশি সময়ের জন্যে আমাদের থামতে হচ্ছে। আর দ্বিতীয় পদের সঙ্গে-সঙ্গে এক্ষেত্রে যেহেতু পঙক্তির সীমানাও শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাই সেখানে থামতে হচ্ছে আরও-একটু বেশি সময়ের জন্যে। পদশেষে আর পঙক্তি শেষে এই যে থেমে দাঁড়ানো, যথাক্রমে এরাই হচ্ছে অর্ধযাতি আর পূর্ণযতি।
অক্ষরবৃত্তের বদলে এবারে দ্বিপদী এই পঙক্তি দুটিকে আমরা মাত্রাবৃত্তে ঢালাই করব। যদি ৬-মাত্রার মাত্রাবৃত্তে ঢালাই করি, তাহলে এদের চেহারা দাঁড়াবে এইরকম :
নতমুখে তুমি বলেছিলে যেন চিত্তে খানিক আশা
জেগে থাকে। আর আঁধারেও যেন জ্বলে ওঠে ভালোবাসা।
এ-দুটিও দ্বিপদী পঙক্তি। পদে-পদে ভাগ করলে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়াবে :
নতমুখে তুমি বলেছিলে যেন / চিত্তে খানিক আশা
জেগে থাকে। আর আঁধারেও যেন / জ্বলে ওঠে ভালোবাসা।
পঙক্তি দুটিকে আমরা স্বরবৃত্তেও ঢালাই করতে পারি। লিখতে পারি :
শান্ত গলায় বলেছিলে, চিত্তে রাখো আশা
অন্ধকারের বুকে জ্বালাও গভীর ভালোবাসা।
এ-ও দ্বিপদী পঙক্তি। এর পদবিভক্তি হবে এইরকম :
শান্ত গলায় বলেছিলে / চিত্তে রাখো আশা,
অন্ধকারের বুকে জ্বালাও / গভীর ভালোবাসা।
এবারে ত্রিপদী পঙক্তির দৃষ্টান্ত দিই :
অবশ্যই তার চেয়ে আছে আরও ভাল মেয়ে, কিন্তু হে ঘটক,
আগে তারই কথা কও, অন্যথা বিদায় হও, সম্মুখে ফটক।
এর পদ-বিভাজন হবে এই রকম :
অবশ্যই তার চেয়ে / আছে আরও ভালো মেয়ে/কিন্তু হে ঘটক,
আগে তারই কথা কও,/অন্যথা বিদায় হও,/ সম্মুখে ফটক।
শব্দগুলিকে, ছন্দের চাল অনুযায়ী, এখানে দুই পঙক্তিতে সাজানো হয়েছে। আগেকার দিন হলে অবশ্য অন্য-বিন্যাসে এদের সাজানো হত। বিন্যাসটা হত এই-রকম :
অবশ্যই তার চেয়ে আছে আরও ভালো মেয়ে
কিন্তু হে ঘটক,
আগে তারই কথা কও, অন্যথা বিদায় হও,
সম্মুখে ফটক।
বলা বাহুল্য, ঘটক-মহাশয়ের প্রতি নিবেদিত এই শব্দাবলিকে এখানে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে ধরা হয়েছে। সেক্ষেত্রে, মাত্রাবৃত্ত কিংবা স্বরবৃত্তেও একে বিন্যস্ত করা যেত। কিন্তু আমরা তো এখানে ছন্দের পার্থক্য বুঝতে বসিনি, পদ-পরিচয়টাই শুধু পেতে চাইছি। আশা করি, সেই পরিচয় ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে।
এবারে একটু যতির কথায় ফিরব। যতির পরিচয় আমরা আগেই পেয়েছি। কিন্তু একটা জরুরি কথা তখন জানা হয়নি। সেটা এই যে, লঘুযতি ও অর্ধার্যতি মাঝে-মাঝে লোপ পেয়ে যায়। অর্থাৎ পর্ব কিংবা পদের শেষে তখন আর থেমে দাঁড়াবার উপায়। থাকে না। পুরোনো সেই উদাহরণটির উপরে আর-এক বার চোখ রাখা যাক :
নতমুখে বলেছিলেন, চিত্তে রেখো আশা,
আঁধারেও দীপ্তি যেন পায় ভালোবাসা।
পর্বের হিসেব করলে দেখা যাবে যে, অক্ষরবৃত্তে-লেখা এই পঙক্তি দুটির প্রতিটিতে আছে তিনটি করে পর্ব ও একটি করে ভাঙা-পর্ব। আবার, পদের হিসেব নিলে দেখতে পাব যে, এই পঙক্তি দুটির প্রতিটিতে আছে দুটি করে পদ। এখন কথা হচ্ছে, পর্ব ও পদের সীমানা এখানে এতই স্পষ্ট যে, পর্বশেষের লঘুযাতি ও পদশেষের অর্ধযতির ব্যাপারটাকে বুঝে নিতে এক্ষেত্রে আমাদের কিছু অসুবিধে হয়নি। কিন্তু আমরা যখন কবিতা লিখি, তখন পর্ব ও পদের সীমানা কি সর্বত্র এমন স্পষ্টভাবে টেনে দেওয়া যায়? যায় না। (পর্বের সীমানা তো মাঝে-মাঝেই অস্পষ্ট থেকে যায়।) কেন? কারণটা আর-কিছুই নয়, পর্ব অথবা পদের সঙ্গে শব্দের বিরোধ। পর্ব অথবা পদের সীমানা শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যখন শব্দের সীমানা শেষ হয় না, তখন অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে, (শব্দটাকে না ভেঙে) গোটা শব্দটাকে একসঙ্গে উচ্চারণ করবার প্রয়োজনে আমরা পর্ব অথবা পদের শেষে থেমে দাঁড়াতে পারছি না। আর তখনই আমরা বুঝতে পারি যে, লঘুযতি ও অর্ধর্যাতি এক্ষেত্রে লোপ পেয়ে গেল।
আগের উদাহরণের সামান্য-কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে এবারে নতুন করে সাজিয়ে নেওয়া যাক। লেখা যাক :
অস্ফুট বলেছ, যেন চিত্তে থাকে আশা,
আঁধারে অম্লান যেন জ্বলে ভালোবাসা।
বলা বাহুল্য, এইভাবে লিখলেও পঙক্তি দুটির ছন্দ একই থাকবে, কিন্তু দুটি পঙক্তির কোনওটিরই প্রথম পর্বের সীমানাকে এক্ষেত্রে আর স্পষ্ট করে দেখানো যাবে না। ফলে প্রথম পর্বের শেষে আর আমরা থেমে দাঁড়াতেও পারব না। পঙক্তি দুটির পর্ব বিভাজন এক্ষেত্রে এইরকম হবে 🙂
অস্ফুট ব : লেছ, যেন / চিত্তে থাকে / আশা,
আঁধারে অ : ম্লান যেন / জ্বলে ভালো / বাসা।
পর্বশেষের লঘুযতি কীভাবে লোপ পায় আমরা তা দেখলুম। এতে ছন্দের কোনও হানি হয় না, বরং তার বিন্যাসে বেশ-একটা বৈচিত্র্যের ছোঁয়া লাগে।
পর্বান্তিক লঘুযতির মতো পদান্তিক অর্ধযতিও অনেকক্ষেত্রে লোপ পায়। কীভাবে পায়, আগের ওই উদারণটিকেই আরও-একটু ঘুরিয়ে সাজালে সেটা বোঝা যাবে। যেমন, ধরা যাক, আমরা যদি লিখি :
নতমুখে বলেছিলেন, হৃদয়ে রেখো আশা,
অন্ধকারে অন্নান জ্বলুক ভালোবাসা।
তাহলে এই পঙক্তি দুটির প্রথম পদ ও দ্বিতীয় পদের মধ্যবর্তী সীমারেখা স্পষ্ট হয়ে ফুটবে কি? ফুটবে না। পদ-বিভাজন সে-ক্ষেত্রে এই রকম হবে :
নতমুখে বলেছ, হু : দয়ে রাখো আশা,
অন্ধকারে অম্লান জ্ব : লুক ভালবাসা।
অর্থাৎ প্রথম পঙক্তির হৃদয়ে ও দ্বিতীয় পঙক্তির ‘জ্বলুক’ শব্দকে না ভেঙে আমরা একটানা উচ্চারণ করতে চাইব (কেন-না, সেটাই স্বাভাবিক উচ্চারণ), এবং তারই ফলে, প্রথম ও দ্বিতীয় পঙক্তির প্রথম পদের শেষে আমরা থেমে দাঁড়াতে পারব না। তখন আমরা বুঝে নেব যে পদান্তিক অর্ধর্ষতি এক্ষেত্রে লোপ পেয়ে গেল।
কিন্তু লঘুযতির বিলোপ যদিও পঙক্তি-বিন্যাসের কোনও ক্ষতি করে না, অর্ধার্যতির বিলোপ তাকে বেশ-খানিকটা ধাক্কা দেয়। কবিতার বিন্যাসে যারা আদ্যন্ত মসৃণতার পক্ষপাতী, তাদের পক্ষে তাই অর্ধার্যতিকে যথাসম্ভব বঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা করাই ভালো।
প্রসঙ্গত, একটা কথা বলি। লঘুযতি ও অর্ধার্যতি কীভাবে লোপ পায়, সেটা বোঝাবার জন্য আমরা এখানে যেসব উদাহরণের সাহায্য নিয়েছি, সেগুলি অক্ষরবৃত্তে লেখা। সেক্ষেত্রে মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তে লেখা পঙক্তির সাহায্যেও যতিলোপের ব্যাপারটা অবশ্যই বুঝিয়ে বলা যেত। কিন্তু তার আর কোনও দরকার আছে কি? নেই নিশ্চয়?
কবিতার ক্লাসে তাহলে এখানেই আমি ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দিলুম। এবারে পড়ুয়াদের মধ্যে উপাধিপত্র বিতরণের পালা। এই উপলক্ষে আমি পদ্যে একটি ভাষণ দিতে চাই।