নবম পরিচ্ছেদ
এতবড় বাড়িতে বসে পড়বার মতো একটু জায়গা খুঁজে পায় না অরুণ। এটা তার কাজেও সময়ে সময়ে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। কিন্তু তবু কথাটা–তার কাছে অন্তত- মর্মান্তিকভাবেই সত্য। শুধু যে এ বাড়িতে কেউ পড়ে না তাই নয়–আর কাউকে পড়বার সুযোগ দিতেও প্রস্তুত নয়। এখানে যেন দিনরাতই হাট বসে আছে। হঠাৎ দূর থেকে এদের বাড়ির দিকে এলে মনে হয় কী কারণে দারুণ একটা চেঁচামেচি হচ্ছে। এরা সাধারণ কথাও কয় চেঁচিয়ে। কর্তাদের যেমন গলাই শোনা যায় না–সকলেই আস্তে আস্তে কথা বলেন- ছেলেদের তেমনি ঠিক বিপরীত, তারা আস্তে কথা বলতেই পারে না; আর তাদের সঙ্গে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গিন্নীদেরও অভ্যাস হয়ে গেছে সর্বদা চিৎকার করে কথা বলা। তার ওপর এদের আড্ডা যা কিছু বেশির ভাগই বাড়িতে, ভায়ে ভায়ে। পাড়ার কোথাও এদের আড্ডা জমে না, তার কারণ এই বয়সী ছেলেদের মধ্যে এমন বেকার খুঁজে পাওয়া কঠিন। লেখাপড়া করুক না করুক–ইস্কুল কলেজে যাওয়ার একটা ঠাট বজায় রাখে অন্য ছেলেরা। এরা সেদিক থেকে সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ, তাই অবসরও এদের অখণ্ড।
এ ছাড়া আর এটা ব্যাপার আছে। পাড়ার অপর ছেলেরা কথাবার্তা কইলেও এদের একটু হীন চোখে দেখে। অন্তত অরুণের তাই অনুমান। সেটা এরাও খানিকটা বোঝে, সে কারণেও কতকটা আরও গৃহকেন্দ্রিক। আর সেই কারণেই অরুণের ওপরেও এদের একটা আক্রোশ। বোধ হয় মনে করে, শিক্ষানুরাগের এই একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ওদের নিরন্তর নিঃশব্দে ধিক্কার দিচ্ছে এবং অহরহ ঘরেবাইরে সকলের কাছে ছোট করে দিচ্ছে। অরুণ যে কখনও এ বাড়ির বাইরে কোথাও যায় না–এমন কি ইস্কুলে ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও বড় একটা কারুর সঙ্গে মেশে না–প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি মুহূর্তও বাইরে থাকে না–সেটাও ওদের কাছে প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার বলে বোধ হয়।
সেইজন্যেই অনেক খুঁজে খুঁজে যদি বা একটি নিভৃত কোণ বার করে অরুণ–সেটা বেশিক্ষণ নিভৃত থাকে না। এদের সজাগ সতর্ক দৃষ্টি সর্বদা ওকে অনুসরণ করে, একটু পরেই সেখানে গিয়ে হাজির হ’তেও দেরি হয় না। এক খুব ভোরে উঠে বাগানের কোথাও গিয়ে বসলে খানিকটা সময় পাওয়া যায়–কারণ এদের রাতও হয় যেমন অনেক দেরিতে, তেমনি ভোরও সহজে হ’তে চায় না। অনাবশ্যক বসে বসে রাত জাগে বলে এধারেও উঠতে দেরি হয়। অরুণও সকাল করে শুতে পারে না এদের অত্যাচারে। তবু ওকে ভোরে উঠতেই হয়। কারণ দিনেরাতে এই যা একটু অবসর, ওদের ঘুম ভাঙ্গবার আগে পর্যন্ত। সে ওদের ঘুমের সময়টায় সারারাত জেগেও পড়তে প্রস্তুত ছিল–যদি আলোর একটা ব্যবস্থা থাকত। এ বাড়ির মেজকর্তা অর্থাৎ তার মেসোমশাই এতখানি তেল খরচ বরদাস্ত করবেন না, তা সে জানে।
শুধু যদি চেঁচামেচি হট্টগোল হ’ত তাহলেও অতটা অসুবিধা হ’ত না। কারণ সাধারণ প্রতিকূল পরিবেশেও মন বসবার মতো পাঠে আসক্তি যথেষ্ট ছিল ওর। কিন্তু এদের আক্রমণটা যে শুধু পরোক্ষ নয়–অনেকখানি প্রত্যক্ষও। ওকে পড়তে বসতে দেখলেই এরা নানারকম অত্যাচার শুরু করে দেয়। ঠাট্টা বিদ্রূপ টিকি’রর ঝড় বইতে থাকে। ওর কানের কাছে এসে হয়ত চিৎকার করে বলে ওঠে একজন, ‘ওগো তোমরা কেউ এখানে কথা কয়ো নি গো কথা কয়ো নি, দুটি ঠোঁট ফাঁক করো নি। বেদব্যাসের ধ্যান ভেঙ্গে যাবে, খুব সাবধান।’
আর একজন হয়ত অমনি সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ো তোলে, ‘চেঁচাস কেন ছোঁড়া–তোর চিত্কারে বিদ্যের জাহাজ ফুটো হয়ে যাবে যে।’
সঙ্গে সঙ্গে হেসে গড়িয়ে প’ড়ে হয়ত একজন বললে, ‘দূর–চিত্কারে নাকি আবার জাহাজ ফুটো হয়।’ আগের লোক আরও চেঁচিয়ে হাত পা নেড়ে জবাব দিলে,–’একি তোর নোহার জাহাজ যে ফুটো করতে কামান বন্দুক চাই–এ বিদ্যের জাহাজ, চিত্কারেই ফুটো হয়ে যায়।’
কেউ হয়ত আবার ওর চোখ এবং খোলা বইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় জোড়হস্ত এগিয়ে দিয়ে–যাতে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সংশয় না থাকে–বলে, ‘ওগো বিদ্যাসাগর মশাই, তোমার বিদ্যে থেকে একটু ভাগ দেবে আমাকে? দাও না ভাই, একটা পেরেক- টেরেক মেরে মগজে ঢুক্যে–একটুখানি বিদ্যে।
সঙ্গে সঙ্গেই পেছন থেকে হয়ত প্রচণ্ড ধমক এসে পড়ে, ‘না না, তোমরা অমন করে ওর পিছনে লেগো নি। মেজকাকা জানতে পারলে দেক্যে দেবে মজা। ও বলে লেখাপড়া শিখে জজ ম্যাজেস্টার হবে–গোরুর গাড়ি বোঝাই করে ছালাছালা টাকা এনে দেবে মেজ কাকাকে!’ ইত্যাদি ইত্যাদি–চারিদিক থেকে চলবে এই সপ্তরথীর আক্রমণ।
প্রথম প্রথম একটু আধটু প্রতিকার বা প্রতিবাদের ক্ষীণ চেষ্টা করত অরুণ। যুক্তি দিয়ে, যথোপযুক্ত উত্তর দিয়ে,–কখনও বা অনুনয়-বিনয় করে ওদের প্রতিনিবৃত্ত করার চেষ্টা করত সে। কিন্তু একেবারেই সে সব চেষ্টা বৃথা দেখে ক্রমশ হাল ছেড়ে দিয়েছে। এ তার শক্তির বাইরে। জ্ঞান হবার পর থেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত একান্ত দুর্দশায় ও পরানুগ্রহে কাটাবার ফলে ওর মনের মেরুদণ্ডই গেছে ভেঙ্গে। কোথাও কোন কারণে সামান্যমাত্র অধিকার কায়েম করা–এমন কি দাবি করারও শক্তি নেই আর। ওদের এইসব টিকিরির যোগ্য উত্তর মনে এলেও মুখ ফুটে তা প্রকাশ করতে পারে না। বিনা কারণেই সকলের কাছে সর্বদা যেন ভয়ে ভয়ে থাকে। তাই এদের অর্থ অর্থহীন আক্রোশ এবং ইতর ব্যবহারের কোনরকম প্রতিরোধ করার কথা কল্পনামাত্র করতে পারে না, মাটির দিকে চেয়ে মাথা নামিয়ে বসে থাকা শুধু। খুব অসহ্য হ’লে একবার হয়ত চোখ তুলে অসহায়ভাবে করুণ মিনতির দৃষ্টিতে চায়–কিন্তু সে চাহনির অর্থ অপাত্রে প’ড়ে আরও নিষ্ঠুর কৌতুকেরই সৃষ্টি করে, ফল কিছু হয় না।
শুধু একটা দিকে কিছু শক্তি তার এখনও প্রকাশ পায়–সেটা আত্মদমনের ক্ষেত্রে। নিজের ক্ষুধা-তৃষ্ণার মতোই চোখের জলটাকেও সে শাসন করতে পারে এখনও। ক্ষোভে দুঃখে প্রতিকারহীন অবিচারে যখন তার বুক ভেঙ্গে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায় তখন–তার এই অবস্থার একমাত্র সান্ত্বনা যে অশ্রুকে সে প্রাণপণ চেষ্টায় ফিরিয়েই দেয়–বাইরে তার একটি বিন্দুও প্রকাশ পায় না। এদের অকরুণ বিদ্রূপ-দৃষ্টির সামনে সে জল যে এতটুকু সহানুভূতির উদ্রেক করতে পারবে না–বরং নবতর অত্যাচারেরই ইন্ধন যোগাবে তা সে জানে।
প্রতিকার যাঁরা করতে পারতেন–কর্তা বা গিন্নীরা–তাঁদের গোচরে এটা–অন্তত এতটা–কখনই হয় না। মুখ ফুটে এসব কথা তাদের কাছে গিয়ে বলা বা নালিশ করা অরুণের সাধ্যের বাইরে। তাই তাঁরা কেউ জানতেও পারেন না। এক কিছুটা জানে মহাশ্বেতা–তাও সবটা নয়। এতটা জানলে হয়ত সেও প্রতিবাদ করত। তার স্বভাবত স্নেহপ্রবণ মন এতখানি বরদাস্ত করতে পারত না। সবটা জানে না বলেই বরং মনে মনে সৈ একটু উৎফুল্ল হয়। কারণ ওরও একটা অব্যক্ত নালিশ আছে অরুণ সম্বন্ধে। ওর ছেলেদের যে আদৌ লেখাপড়া হ’ল না, সেজন্যে বিচিত্র মানসিক কারণে অরুণকেই দায়ী মনে হয় তার। তারও মনে হয়, অরুণের এই বিদ্যানুরাগটা অহরহ তার ছেলেদের মূর্খতাকে ধিক্কার দিচ্ছে আর সকলের কাছে ছোট ক’রে দিচ্ছে তাদের।
অরুণ যদি তার নিজের মাসীকেও এটা জানাতে পারত কি তার কাছে কোন প্রতিকার প্রার্থনা করত তাহলে কি ফল হ’ত তা বলা কঠিন। কিন্তু একেবারেই চুপ করে থাকার ফলে প্রতিকার কি প্রতিবিধানের কোন আশাই থাকে না। এক সময় তার এতদিনের এত-ঘা- খাওয়া মনও হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। মনে হয় সে বুঝি পৃথিবীতে আসার সময় ঈশ্বরের কাছ থেকে দু-হাত ভরে শুধু অন্ধকারের অভিশাপই চেয়ে এনেছে এ জন্মের পাথেয়–তার জীবনে তাই আলোকের আশীর্বাদ কখনই নামবে না।
তবু, ওর এই বর্তমান জীবনের আদি-অন্তহীন অন্ধকারে একটি স্বর্ণালোক-রেখা ছিল বৈকি। আলোক-রেখা না বলে হয়ত তাকে আলোকদূতী বলাই উচিত। অন্তত অরুণের তাই মনে হয় মাঝে মাঝে। নিঃসীম অন্ধকারে সে যেন আলোকশিখা বয়ে এনে হাজির হয়। আর আসে সে আপনা থেকেই, না ডাকতে।
সে হ’ল বুঁচি–মহাশ্বেতার মেয়ে স্বর্ণলতা।
সেই প্রথম দিনটি থেকেই সে ওর সহায়। ওর বন্ধু।
সে-ই মেজকাকীকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ওকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়েছে, সেই মেজকাকাকে দিয়ে ওর পড়ার বই আনিয়ে দিয়েছে। দিনকতক তাকেও লেখাপড়া শেখাবার চেষ্টা করেছিল অরুণ, বই খাতা সুদ্ধ টেনে বসাত রোজ–কিন্তু বেশিদিন সে চেষ্টা ওর ধাতে সয় নি। দিনকতক পরে হাঁপিয়ে উঠেছে, বলেছে, ‘না বাপু, রক্ষে করো এ আমার দ্বারা হবে না। মা সরস্বতী কি সকলের সয়? সয় না। পড়তে গেলেই মাথার মধ্যে সব যেন গুইলে যায়। তার চেয়ে আমার হাঁড়িবেড়িই ভাল। তুমি আর এ চেষ্টা করো নি। মিছিমিছি তোমার সময় অপ্চ। আমাদের বংশে লেখাপড়ার পাট নেই, তুমি চেষ্টা করলে কি হবে বলে! বলি, হ’লে তো আমার ভেয়েদেরই আগে হবার কথা গা? ওরা তো বেটেছেলে। তা ওদেরই কি হ’ল?’
সত্যি-সত্যিই, হাঁড়ি-বেড়ি নিয়েই থাকতে ভালবাসে সে। আর সে-ই হয়েছে অরুণের মুশকিল। রান্নাঘরের বাইরে কোথাও তার টিকি দেখা যায় না। কদাচিৎ এঘর-ওঘর আসা- যাওয়ার পথে হঠাৎ যদি নজরে পড়ে যায় তার ভাইদের কাণ্ড–তখনই ছুটে আসে সে। চোখমুখ গরম করে ভুরু কুঁচকে গুরুজনদের মতোই তিরস্কার করে, ‘আবার তোমরা ওর পেছনে লেগেছ? লজ্জা করে না তোমাদের! নিজেদের সবকটি ন্যাজই তো কেটে বসে আছে, এখন ওরটা না কাটতে পারলে মুখুর খাতায় নামটা না তুলতে পারলে–বুঝি মনটায় সোয়াস্তি হচ্ছে না। কেন, কী জন্যে এখানে এসেছ তোমরা–কি দরকার? সরে পড়ো, সরে পড়ো বলছি সব–সোজা ঐ পগারধারে গিয়ে বসে থাকো, তোমাদের সঙ্গে ইয়ার্কি করার মতো ভাম-ভোদড় বেস্তর মেলবে!’
রাগ হবারই কথা, হয়ও। যদি কাছাকাছি শ্রুতিসীমার মধ্যে মেজকাকা বা মেজকাকী না থাকে তো সাহস করে কেউ বলেও বসে, ‘দ্যাখ, মুখ সামলে কথা বলবি বলে দিচ্ছি। বেশ করেছি এখানে এয়েছি। আমাদের খুশি এখানে এয়েছি। আমাদের খুশি এখানে থাকব। কী হয়েছে কি তাতে? ইঃ–উনি লেখা-পড়া করবেন বলে আমরা সবাই দিনরাত মুখে গো দিয়ে থাকব–না? ভারী আমার এলে-বিয়ে পাসের পড়া পড়ছেন রে।’
‘বলি এলে-বিয়ে না হয় না’ই হল–ও যে টুকুন পড়ছে তাও তো তোমাদের কারুর সাধ্যিতে কুলোল না। লেখাপড়ার মহিমে তোমরা কি বুঝবে–গো-মুখুর দল!’
‘দ্যাখ বুঁচি–,’ কেউ হয়ত জোর করে একটু ধমকের সুর গলায় আনবার চেষ্টা করত কিন্তু সূচনাতেই তার সে প্রচেষ্টার অপমৃত্যু ঘটিয়ে হাত-পা নেড়ে চোখমুখের বিচিত্র ভঙ্গি করে বুঁচি উত্তর দিত, হ্যাঁ–দেখেছি দেখেছি, খুব দেখেছি। যাও না মেজকাকাকে গিয়ে বল না যে তোমাদের আমি গোমুখু বলেছি–জবাবটা সে ব্যক্তি কি দেয় শুনে এসো না। যাবে? দ্যাখো– যদি একা যেতে ভরসায় না কুলোয় তো না হয় আমার সঙ্গেই চলো, আমি নে যাচ্ছি।’
তারপরই আবার ভ্রু কুঁচকে দস্তুরমতো ভয় দেখাবার ভঙ্গিতে বলত, ‘কী তোমরা ভালয় ভালয় যাবে এখান থেকে–না আমিই গিয়ে মেজকাকাকে বলব?’
এর পর আর কারুরই সাহস হ’ত না সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। যেন কিছুই হয় নি, যেন তাদের ভয় পাবার কোন কারণই নেই, বুঁচির কথাটা তারা কানেও তোলে নি ভাল করে–মুখের ওপর প্রাণপণে ‘এমনি একটা নিরুদ্বিগ্ন উদাসীনতা ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করতে করতে একে একে তারা সবাই সরে পড়ত। তারা নিজেদের মর্জিমতোই যাচ্ছে যেন–অপর কারও হুকুমে নয়, এইটেই প্রতিপন্ন করতে চাইত তারা; কিন্তু পিছনে স্বর্ণের সবিদ্রূপ হাসি তাদের আত্মসম্মানের সেই আশ্রয়টুকুও রাখতে দিত না শেষ পর্যন্ত।
আর ওর ঐ আশ্চর্য শক্তি দেখে বিস্ময়ের সীমা থাকত না অরুণের।
ঐ অতোটুকু মেয়ে–বয়সের তুলনাতেও অনেক ছোট দেখায় ওকে–কিন্তু কী অনায়াসেই না এদের শাসন করে সে–এই অর্ধ বর্বর বড় বড় ভাইদের! কোথা থেকে এই শক্তি এই গাম্ভীর্য আসে ওর?
ওরা সবাই চলে গেলে বহুক্ষণ পর্যন্ত অবাক হয়ে সেই কথাই ভাবত সে বসে বসে।
অবশ্য ঠিক তখনই সময় মিলত না কোন কিছু ভাববার।
ওরা চলে গেলে অরুণকে নিয়ে পড়ত স্বৰ্ণ।
‘আচ্ছা, তুমি কী বলো তো? বিধাতা কী দিয়ে গড়েছেন? এতটুকু হায়াপিত্তি বলে কিছু থাকতে নেই তোমার? ঠায় বসে বসে এই বাঁদরামো সহ্যি করো কি করে? একটু বলতে পারো না ওদের, একটু চোখ রাঙাতে পারো না?’
ওকে দেখলেই–কে জানে কেন–অরুণ যেন সঞ্জীবিত হয়ে উঠত, তার চিরদিনের বোবামুখেও হাসি ফুটত। হয়ত হেসে বলত, ‘চোখ রাঙানো কি সব চোখে মানায়? ওর জন্যে ভগবান আলাদা রকমের চোখ দিয়ে পাঠান যে!’
কপট ক্রোধে চোখ মুখ রাঙা করে উত্তর দিত বুঁচি, ‘কেন বলো তো যখন-তখন আমার কটা চোখের খোঁটা দাও। বেশ বেশ! আমার চোখ কটা আছে আমারই আছে– তোমার তাতে কী?’
সঙ্গে সঙ্গে অপ্রতিভ হয়ে পড়ত অরুণ। সত্যিই বুঁচির যেমন মেমেদের মতো সাদা রঙ, তেমনি তাদের মতোই কটা চোখ। কিন্তু অত ভেবে কিছু বলে নি অরুণ, কটা চোখের কথা মনেও ছিল না তার। থাকলে কখনই বলত না। আসলে স্বর্ণর চেহারা নিয়ে কোন দিনই মাথা ঘামায় নি সে। ওর মুখচোখ কেমন তা বোধহয় খুঁটিয়ে দেখেও নি।
ঘাড় হেঁট ক’রে তাড়াতাড়ি জবাব দিত, ‘না-না–বিশ্বাস করো, সত্যিই আমি সে ভাবে কথাটা বলি নি। তুমি কিছু মনে করো না। আর কোন দিন বলব না তোমার চোখের কথা!
গম্ভীরভাবে বুঁচি বলত, ‘হ্যাঁ, মনে থাকে যেন। আর কোনদিন বলো নি।’
তারপরই–অরুণকে চমকিত ও চমৎকৃত ক’রে উচ্ছ্বসিত হাসিতে লুটিয়ে পড়ত সে, ‘ধন্যি, বাবা ধন্যি। ধন্যি ছেলে বটে তুমি যা হোক! বেটাছেলে মানুষ, একটুতে এমন আউতে পড় কেন? কটা চোখকে কটা বলে ঠাট্টা করলেই বা দোষ কি? সকলেই তো করে! বেশ করেছি বলেছি–এ বাক্যি কি তোমার মুখে বেরোয় না?’
সে হাসি সংক্রামক রোগের মতোই অরুণের মনেও সঞ্চারিত হয়। সেও হাসে। অল্প- অল্প, অপ্রতিভের হাসি। সুখের হাসিও। স্বর্ণের এ কথা তার মনে কোন বেদনাবোধ জাগায় না, কোন গ্লানি আনে না। বরং একটা আশ্চর্য রকমের সান্ত্বনার, একটা আশ্বাসের প্রলেপ বুলিয়ে দেয় যেন ওর মনের সুগভীর ক্ষতগুলোয়। মনে হয় কোন কঠিন রোগ-ভোগের পর যেন বলকারক পথ্য লাভ করেছে সে, সঞ্জীবনী সালসা সেবন করেছে।
অবশ্য কথা সে বলতে পারে না কিছু! এসব কথা জানাবার শক্তি বা সাহস তার কাছে কল্পনাতীত। সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শুধু। কিন্তু স্বর্ণেরই বা দাঁড়িয়ে তার কথা আদায় করার অবসর কই। সে যেমন ব্যস্ত-সমস্ত ভাবে আসে, তেমনি ব্যস্ত-সমস্ত ভাবেই চলে যায়।
আর সে যাবার পর অনেকক্ষণ ধরে ভাবে অরুণ, মেয়েটাকে যদি একটু লেখা-পড়া শেখানো যেত তো বেশ হ’ত। কত কী জানবার আছে পৃথিবীতে, কত কী শেখবার আছে– তার কোন খবরই রাখল না। শুধু হাঁড়ি-বেড়ি আর সংসারের কাজে কী যে রস পায় ও।
॥২॥
এত টাকার মুখ মহাশ্বেতা কখনও দেখেনি তার জীবনে। এক টাকায় দু আনা সুদ পাওয়া যায় তাও কখনও শোনে নি। তার মা টাকা ধার দেয় সে জানে-টাকায় এক পয়সা সুদ মেলে। তাও একশ কি পঞ্চাশ হ’লে শতকরা এক টাকার হিসেব। একেবারে শুধু হাতে দিলে সেইটেই বড় জোর দেড় টাকায় ওঠে। কিন্তু এক মাসে একশ টাকায় সাড়ে বারো টাকা সুদ–কখনও কখনও সুযোগ-মতো পনেরোও আদায় ক’রে দেয় অভয়পদ–’এ যে গল্প কথা একেবারে। বাবা, এ যে একরাশ টাকা। একটা বাবুর মাইনে বলতে গেলে …. হ্যাঁ গা, সত্যি টাকা তো এসব–নাকি মেকী? বলি জালটাল নয়?’
অভয়পদ গম্ভীরভাবে বলে, ‘বাজিয়ে দ্যাখো না, কাঁসার টাকা বলে কি মনে হচ্ছে?
‘কে জানে বাপু। সন্দ হয় যেন। মড়ারা এত টাকা পায় কোথা থেকে? এ তো কুবেরের ঐশ্বয্যি!’
সত্যিই তার বিশ্বাস হ’তে চায় না ব্যাপারটা। টাকা হাতে পেলেও না। মাঝে মাঝে অকারণেই নাড়া-চাড়া করে, বার করে গুণে দেখে। দুশো টাকা এনেছিল সে মার কাছ থেকে, পাঁচ-সাত মাসেই বেড়ে সেটা প্রায় ডবল হয়েছে। এ কী সহজ কথা!
তবে টাকাটা হাতে থাকে না বেশি দিন এটা সত্যি। মাসের শেষে ধার দেয়–দশ বারো দিন থাকতে–আবার মাসকাবারে ফেরৎ পায়। মাঝের কটা দিন মাত্র নাড়তে চাড়তে পায় সে। তা তার জন্যে দুঃখ নেই ওর, টাকা খাটাই তো লক্ষ্মী, বসে থাকলে আর তার দাম কি? বলি বাক্সে তুলে রাখলে ষোল বছরেও তো একটা পয়সা বাড়বে না! (এ কথা সবই অবশ্য অভয়পদর মুখে শোনা–তবে এ যে ‘লেহ্য’ কথা তা সেও বোঝে।)
সব মাস-কাবারে সব টাকা ফেরৎ পায় না। তা না পাক, পরের মাস-কাবারে ডবল সুদ পাবে তা সে জানে। সেদিকে মিসে খুব হুঁশিয়ার আছে–গলায় জোল দিয়ে আদায় করে। সুদটা ঠিকমতো পেলেই হ’ল। সুদের জন্যেই তো টাকা খাটানো। না-ই বা পেলে হাতে সব মাসে। সে তো বাড়ছে সেখানে।
আজকাল অনেক শিখেছে সে, এ বিষয়ে অনেক জ্ঞান হয়েছে। সুদ পড়ে থাকলে তারও সুদ পাওয়া যায়–এ সে জানত না। এটা বলেছে মেজগিন্নী। মেজগিন্নী অনেক জানে সত্যি। কে জানে হয়ত বা মেজগিন্নী নিজেও এ কারবার করে লুকিয়ে। হয়ত মেজকর্তাই খাঁটিয়ে দেয় টাকাটা, ওদের কাছে সাধু সেজে থাকে। ওদের টাকা সুদে খাটলে যদি বেড়ে যায় অনেক, ফুলে-ফেঁপে যদি বড়লোক হয়ে ওঠে মহাশ্বেতা–সে কি সহ্য হয়? সেই ভয়েই হয়ত দাদাকে অত সাধু-উপদেশ দিয়ে আটকাতে চেয়েছিল। সব পারে ওরা, কর্তাগিন্নীর অসাধ্য কিছু নেই। নিশ্চয়ই তাই। ভেতরে ভেতরে নিজেরাও ঐ কাজই করছে–মেজগিন্নীর বুকপোঁতা করছে শুধু। নইলে এত কথা জানল কী করে?
শুধু কী তাই। আবার নাকি কি কী চটায় আর কিস্তিতে টাকা ধার দেয় বাজারে, তাও জানে মেজবৌ। বলে, ‘ও দিদি, অমন ক’রে বটঠাকুরের হাততোলায় থাকার দরকার কি টাকা খাটাতে চাও তো বাজারে খাটাও না, মোটা লাভ।’
‘সে আবার কি লো? বাজারে খাটাব কি? সে আবার কী ক’রে খাটাতে হয়?’
সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বেশ উৎসুকভাবেই জিজ্ঞাসা করে মহাশ্বেতা।
‘সে তো খুব সোজা গো। ধরো যার কাছ থেকে মাছ কেনা হয়–তাকে দশ টাকা ধার দিলে, পরের দিন থেকে একশ’ দিন পর্যন্ত রোজ সে তোমাকে দশ পয়সা ক’রে আদায় দিয়ে যাবে। মোটা সুদও পেলে, আবার সুদ ছাড়া কোন্ না মাঝে মাঝে কিছু মাছও আদায় হবে মাগ্না!
‘অ। তা সে কত ক’রে পোষাল তাহলে?’
আরও উৎসুক, আরও সন্ধিগ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করে মহাশ্বেতা। প্রাণপণে হিসাবটা মাথায় আনবার চেষ্টা করে।
‘বাবা এত হিসেব বুঝছ আজকাল! বলে কত ক’রে পোষাল! দিদি আর সে মনিষ্যি নেই!
‘নে বাপু, তোর রঙ্গ রাখ। যা বলছিলি তাই বল।’
‘বলি এত কারবার করছ, এ সোজা হিসেবটা বুঝতে পারলে না? এক টাকায় তো চৌষট্টি পয়সা গো? চৌষট্টি পয়সা ধার দিয়ে সে জায়গায় পাচ্ছ একশ’ পয়সা। এক টাকা ন’ আনা। তাহলে একটাকায় ন আনা পেলে। অনেক লাভ।’
‘তেমনি তো একশ’ দিন ধরে চলবে লো! সে তো তিন মাসের বেশি হয়ে গেল তা’হলে। সে আর এমন কি?’
‘বাব্বা, তুমি তার চেয়েও বেশি চাও। তোমার খাই তো কম নয়। আরও বেশি পাও বুঝি? তা’হলে তুমি তো টাকার কুমির হয়ে পড়বে গো!’
‘হ্যাঁ, তা আর নয়! তা’হলে আর ভাবনা ছিল না। লাভ তো কত।… কী যে বলিস!’
অপ্রতিভ হয়ে তাড়াতাড়ি কথা চাপা দেবার চেষ্টা করে। আরও গোলমাল হয়ে যায়, আরও উলটো-পালটা বলে ফেলে। নিজেও বুঝতে পারে সে কথাটা। অনুতাপের সীমা থাকে না। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই মনে মনে নিজের কান মলে। কেনই যে এসব কথা তোলে সে, আর কেনই বা হাটিপাটি পেড়ে এ-সব সুদে খাটানোর কথা বলতে যায়! পেটে যে কেন কথা থাকে না তার–তা সে নিজেই বুঝতে পারে না।
এত ঠকে তবু তার লজ্জা নেই! ছি, ছি!
মনে মনে বার বার নিজেকে তিরস্কার করতে থাকে মহাশ্বেতা
যে কোন কথাই মাথায় ঢুকতে দেরি হয় মহাশ্বেতার, কিন্তু তেমনি একবার ঢুকলেও সহজে আর বেরোতে চায় না। টাকায় টাকা বাড়ে–এই কথাটা মাথায় ঢোকবার পর সে প্রাণপণে মূলধন বাড়ানোর কথাই চিন্তা করে আজকাল। মার কাছ থেকে আর এক খেপ টাকা এনেছে সে। কদিন পরে আরও একবার গিয়েছিল কিন্তু শ্যামা কিছু দেন নি। হাঁকিয়ে দিয়েছেন সোজাসুজি।
‘টাকা কি আমার কাছে বসে থাকে? এখন টাকা নেই, যা!’
‘তা তুমি যে আমার টাকা খাটাও তা তো বলো নি বাপু এতদিন!’ অপ্রসন্ন মুখে বলে মহাশ্বেতা।
ঠিক এই ভয়ই করেছিলেন শ্যামা। এর পর সুদের কথা উঠবে, হিসেব চেয়ে বসবে হয়ত। তিনি প্রস্তুতও ছিলেন সে জন্যে। বললেন, ‘সব সময় কি আর খাটাই। এক- আধবার তেমন লোক এসে পড়লে দিতে হয় বৈকি। আর তুমি তো কিছু বারণও ক’রে দাও নি তোমার টাকা খাটাতে। এমন হুট ক’রে চেয়ে বসতে পারো তাও বলো নি টাকা রাখবার সময়। তা’হলে আমি তোমার টাকা রাখতুমই না।
‘না, তা নয়।’ মহাশ্বেতা বেশ একটু দমে যায় মায়ের কণ্ঠস্বরে। তাড়াতাড়ি বলে, ‘তা নয়–তবে টাকা খাটালে আমার একটা সুদও পাওনা হয় তো।’
‘হয় বৈকি। হবেও পাওনা। আমি তো তোমার ভাগের সুদ দোব না এমন কথা কখনও বলি নি। যা দু’চার পয়সা পাওনা হয় তা নিশ্চয়ই পাবে। কিন্তু সে একটা হাতি-ঘোড়া কিছু হবে না। সে পিত্যেশ ক’রো না। কটাই বা টাকা, সব সময়ে তো খাটাইও না তোমার টাকা। তাহলে আর চাইবা-মাত্র দিলুম কী ক’রে? দৈবে-সৈবে তেমন কেউ এলে তবেই দিই। আর তুমি তো নিয়েও গেলে বার করে চারশ’ টাকা। আর কি নশ’ পাঁচশ; আছেই বা ‘
‘তবেই তো বললে ভাল। বেশ গাইলে। তুমি তো যা সুদ দেবে তা বুঝতেই পারছি, মাঝখান থেকে আমারই লোকসান। একশ’ টাকা আমার কাছে ছ মাস খাটলে দুশ’ টাকা হয়ে যেত।’
‘দ্যাখ–,’ শ্যামা বেশ একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই বলেন, ‘অত বাড়াবাড়ি কোন জিনিসেরই ভাল নয়। যা রয় সয় তা-ই ভাল। অত সুদ যে দেয় তার কখনও টাকা শোধ করবার মতলব নেই। সে একদিন সবসুদ্ধ ভরাডুবি করবে। তোর চেয়ে মাথা-ওলা লোক ঢের আছে সংসারে। এতই যদি সহজ হ’ত ব্যাপারটা তা হ’লে সবাই গিয়ে টাকা ঢেলে দিত। আর এত সুদ তা’হলে তারা দেবেই বা কেন? যা পিটে নিয়েছিস, নিয়েছিস–এইবার হাত গুটো। ঐ কটা টাকাই থাক, তাতেই ঢের।’
হ্যাঁ, তা আর নয়। সব সুদ্ধ এনে তোমাকে ধরে দিই, কবে কে দশ টাকা ধার নিয়ে এক পয়সা সুদ দেবে সেই পিত্যেশে। তোমাদের জামাই নিজে হাতে ক’রে নে যাচ্ছে। বলি সে মানুষটা তো আর বোকা নয়। যাকে দিচ্ছে বুঝে-সুঝেই দিচ্ছে। তেমন কোন সন্দ থাকলে এক পয়সা বার করত না সে। আর এত-সুদই বা কিসের? কী এমন দিচ্ছে শুনি। দারোয়ানদের কাছ থেকে নিত–তাদের সুদ কি কম? আরও ঢের বেশি। টাকায় তিন চার আনা আদায় করে তারা। ওরা কি আর আমাদের মতো, যে এক পয়সায় মরে-বাঁচে। ওরা হ’ল গে সায়েব বাচ্ছা–ওদের কাছে ও দু আনা এক আনার দাম কি?’
এই বলে–যেন খুব বুদ্ধিমতীর মতো কথা বলেছে, বলতে পেরেছে–এইভাবে চারিদিকে সগর্বে চেয়ে নেয় একবার। কিন্তু তার সে বিজয়গর্বের উত্তাপ বেশিক্ষণ ভোগ করা যায় না। শ্যামা ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেন একেবারে।
‘আছে বৈকি মা–খুবই দাম আছে। নইলে এত ছিষ্টি ক’রে তোদের মতো দীন-দুঃখীর কাছ থেকে হাত পেতে ধার নিত না–এই কটা সামান্য টাকা।’
শ্যামা বিরক্ত মুখে চুপ ক’রে যান। তাঁর আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয় না। এর সঙ্গে তর্ক ক’রেই বা লাভ কি?
মহাশ্বেতাও বেজার মুখে বসে থাকে চুপ করে। তার পছন্দ হয় না কথাটা– তা বলাই বাহুল্য। তার চেয়েও বড় কথা, স্বামীকে সে জাঁক্ ক’রে ব’লে এসেছে– দুশ’ টাকা আজই এনে দেবে, যেমন ক’রেই হোক। অথচ সে টাকার কোন ব্যবস্থাই হ’ল না, অন্য কোথাও অন্য কোনভাবে হবে–এমন আশাও নেই। এতগুলো টাকা কেউ তাকে উজ্জ্বল সম্ভাবনার ওপর কিম্বা মোটা সুদের প্রতিশ্রুতির ওপর ধার দেবে না–তা সে জানে।
কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে তেমনি অন্ধকারপানা মুখ ক’রেই উঠে গিয়েছিল, যাবার সময় একটা বিদায়সম্ভাষণ পর্যন্ত জানায় নি।
.
কিন্তু তাই বলে যে এমন বাড়াবাড়ি কাণ্ড করবে সে, তা শ্যামা একবারও ভাবে নি। বিশ্বাসই করতে চান নি কথাটা–যখন চট্টখণ্ডীদের গিন্নী এসে জানালেন যে মহাশ্বেতা গহনা বন্ধক রেখে তাঁর কাছ থেকে টাকা ধার করতে এসেছিল–তিনি দিতে পারেন নি বলে মল্লিকদের কাছে গেছে তাঁর ওখান থেকে; সেখানে কি হয়েছে না হয়েছে তা তিনি বলতে পারবেন না অবশ্য–তবে টাকার জন্যে যে সে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই–এবং বেশ মোটা টাকাই দরকার তার।
চট্টখণ্ডী-গিন্নী নিজে এসেই খবরটি দিয়ে গেলেন। বড়-একটা এঁদের বাড়ি আসেন না তিনি, দরকার পড়লে শ্যামা নিজেই যান। এতকাল পরে বাড়ি বয়ে এসে তিনি কিছু আর মিছে কথা বলে যাবেন না, সে রকম লোকই নন। তিনি এসেছেন নিছক কৌতূহলবশতঃই। মহাশ্বেতাদের অবস্থা ভাল তা এ অঞ্চলের সবাই জেনেছে এতদিনে, অন্তত ‘হন্যে হয়ে’ টাকা ধার ক’রে বেড়াবার মতো অবস্থা তাদের নয়। তবে সে কী উদ্দেশ্যে কোন্ প্রয়োজনে টাকা ধার করতে এসেছে–সেইটেই জানতে চান তিনি বিশেষত তার মাও যখন আজকাল বন্ধকী কারবার করেন তখন পরের কাছে যেতে হ’ল কেন? মাকে গোপন ক’রে সে কোথাও টাকা খাটাতে চায়, না মায়ের কাছ থেকে যা নেওয়া সম্ভব তা সব নেওয়া হয়ে গেছে বলেই বাইরে বেরোতে হয়েছে?
.
আসলে তাঁদের অজ্ঞাত বৃহত্তর কোন লাভের পথে এরা যাচ্ছে কিনা মায়ে-বেটিতে সেটা না-জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছেন না তিনি।
কিন্তু তাঁর কৌতূহল কিছুই মেটাতে পারেন না শ্যামা। কারণ সত্যিই এ খবরটা তাঁর কাছে একেবারে নূতন। অনেক জেরা ক’রেও তাঁর পেট থেকে কোন খবর বার করতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়েই চলে গেলেন চণ্ডী-গিন্নী। শ্যামা যে একেবারেই কোন খবর রাখেন না–এটা বিশ্বাস করা তাঁর পক্ষে কঠিন।
শ্যামা অবশ্য তাঁকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টাও করেন না বিশেষ। আসলে তখন কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না ওঁর। নানারকম সংশয় ও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে মনে। বহু রকমের দুর্ভাবনা। মেয়েটা ওঁর বড়ই বোকা। এতটুকু সাংসারিক জ্ঞান নেই। এধরনের মানুষ যখন আবার মাথা খেলিয়ে বুদ্ধিমানের মতো কোন কাজ করতে যায় তখনই বিপদের কথা হয় সকলের কাছে আরও হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠে, নয় তো নিজের সর্বনাশ নিজেই ক’রে বসে। কী করছে সে, গহনা বন্ধক রেখে টাকা ধার করছে সে কিসের জন্যে, কার জন্যে?
যদি ঐ টাকা দিয়ে বাড়ি-ঘর বিষয়-সম্পত্তি কেনে তো তাঁর কিছুমাত্র আপত্তি নেই। বিষয়ের দাম কমতে পারে–একেবারে মূলে হা-ভাত হয় না। কিন্তু সুদের নেশায় পাগল হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজে ধার করে অপরকে ধার দিচ্ছে না তো? তা’হলে তো সাংঘাতিক ব্যাপার। মেয়েটা না হয় চিরকালের পাগল, জামাইও কি পাগল হয়ে গেল ওর সঙ্গে সঙ্গে? নাকি ও তাকে লুকিয়েই এ কাজ করছে? কিছু বিশ্বাস নেই, সব পারে ও। বুদ্ধি যে পথে যায় সে পথের ফুটপাথ মাড়ায় নি কখনও।…
অথচ বোকা-সোকা পাগল যা-ই হোক–এই একটি মেয়েই তাঁর জীবনে যা কিছু আশ্বাস বহন করে। শুধু যে ওর স্বামীর কাছ থেকে প্রভূত সাহায্য পেয়েছেন শ্যামা তাই নয়–ও যে সুখী, ও যে নিশ্চিন্ত–এইটুকুই তাঁর যেন মস্ত একটা ভরসা,-এই দিক্-দিশাহীন অন্ধকার জীবনে একমাত্র আলোক-অবলম্বন। শেষে এই সামান্য আলোকশিখাটাও নিভিয়ে দেবে না তো হতভাগা মেয়েটা? নষ্ট করবে না তো তাঁর একমাত্র আশ্রয় ও আশ্বাস-কেন্দ্রটি?
কে জানে–আবার এক সময় এমনও মনে হয়–হয়ত তেমন কোন লোকসান হবে না শেষ অবধি, কিম্বা আদৌ কোন লোকসান হবে না। বরং টাকা আসবেই উল্টে অনেক টাকা, তাঁর পক্ষে কল্পনাতীত অঙ্ক। এটা ঠিক যে জামাই তাঁর কড়ি-কপালে। ওর মতো অসহায় অশিক্ষিত লোক যা করেছে তা ঢের। যারা ছোট-বেলায় দুঃখ পায় শেষ বয়সে অদৃষ্ট তাদর প্রতি অনেক বেশি প্রসন্ন হন নাকি। জামাইয়েরও হয়ত তাই হবে। আর যার কপাল ভাল, ভগবান যাকে দেবেন–তাকে তুচ্ছ একটা অবলম্বন ধরে, যে-কোন পথেই টাকা ঢেলে দেন। হয়ত বাধা দিলে ক্ষতিই করা হবে ওদের। তবু চুপ ক’রেই বা থাকতে পারেন কৈ? তাঁর এই দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা যে জীবন সম্বন্ধে অন্য শিক্ষাই দিয়েছে এতকাল।…
এই নানারকম বিপরীতমুখী চিন্তায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে সেদিন আর কোন কাজে মন দিতে পারলেন না শ্যামা। রাত্রেও ভাল ঘুম হ’ল না তাঁর। শেষ পর্যন্ত সকাল-বেলায় সেকরাদের একটা ছেলেকে ডেকে চারটে চালতা ও গোটাদুই কাঁচকলা ঘুষ দিয়ে মহাদের বাড়ি পাঠালেন। বিশেষ দরকার, দুপুরবেলা যেন অতি অবশ্য সে একবার আসে।
মহা অবশ্য দুপুরের খানিকটা আগেই এসে হাজির হ’ল। কৌতূহল প্রবল–কোথায় কী অঘটন ঘটল বা মজার খবর পাওয়া গেল, এ সম্বন্ধে তার ঔৎসুক্য শিশুর মতোই।
কী গো, বলি এত জরুরি তলব কিসের! যখন শুনলুম তুমি চাতে কাঁচকলা খাইয়ে তাকে পাঠিয়েছে–তখনই বুঝলুম কিছু একটা সমিস্যের ব্যাপার আছে। নইলে তুমি যা কিপ্পন মনিষ্যি–দরের জিনিস খরচ ক’রে সুখসোমন্দা লোক পাঠাবে–এ একটা কথাই নয়।… যেমন শোনা, আমি সব ফেলে-ঝেলে কোনমতে দুটো হাতে-ভাতে ক’রেই হুড়তে পুড়তে ছুটে এসেছি। ছোট বৌটাকে বলে এসেছি সব পড়ে রইল ভাই, তুই একটু দেখিস। ফিরে এসে আবার না মহারানীর কাছে চাট্টি কথা শুনতে হয়। আজকাল তো আবার কাজের পালা হয়েছে, ভাগ হয়েছে–যে যার পালা সে তার করবে। মোন্দা গেরস্তর কাজ ঠিক ঠিক ওঠা চাই, নইলেই এতটি কথা আর চিপ্টেন। তা ছোট বৌ দেখবে, তেমন নয় ও। মানুষের ঘরের মেয়ে যে হয় তার চালচলনই আলাদা। ও-ই বললে–তুমি যাও দিদি, মা যখন এমন ক’রে ডেকে পাঠিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই কোন জরুরি দরকার আছে।… তা ব্যাওরাটা কি বলো দিকি–এত জোর তলব একেবারে!’
শ্যামা কোন বৃথা ভূমিকার মধ্যে গেলেন না–একেবারে সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, ‘তুই নাকি গয়না বাঁধা রেখে টাকা ধার ক’রে বেড়াচ্ছিস? গয়না নিয়ে নাকি এ পাড়ায় এসেছিলি?’
ঠিক এ প্রশ্নটার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না মহাশ্বেতা। তার মুখখানা বেশ একটু বিবর্ণ হয়ে উঠল কিছুক্ষণের জন্য। খানিকটা চুপ ক’রে বসে থেকে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে যেন কোনমতে বলে ফেললে, ‘হ্যাঁ!’
‘কেন?’ কঠিন ও তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করেন শ্যামা।
এ কণ্ঠস্বর সে চেনে। চিরকাল একে ভয় করতেই অভ্যস্ত মহাশ্বেতা। ভয় আজও তার কম হ’ল না। সে-ভয় দমন ক’রে বেপরোয়া হ’তে গিয়ে হঠাৎ রূঢ় হয়ে উঠল সে।
‘কেন আবার কি? টাকার দরকার পড়েছে বলেই এইছি। আমি তো আর কচি খুকী নই–একটা কাজ যখন করেছি তখন তার অখ আছে বৈ কি।’
‘সেই অখটাই তো জানতে চাইছি বাছা। কথাটা বলতেই বা তোমার দোষ কী? আমি তো তোমাকে আটকাচ্ছি না, তোমারটা কেড়ে বিগড়েও নিচ্ছি না।’
‘দোষ আবার কি! দেখা হয় নি তারপর থেকে, তাই বলি নি।–আর এ এমনই বা কি কথা যে, এত ছিষ্টি ব্যাখ্যানা ক’রে বলতে হবে সবাইকে? ধার-দেনা মানুষ ক’রেই থাকে, কেউ আপদে-বিপদে করে, কেউ বা কারবার করতে নেয়। আমিও না হয় ধরো কারবার করতে নিয়েছি কিছু টাকা। তাতে এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?–আর দোষের কথা কে বলেছে? কেড়ে বিগড়ে নেবার কথাই বা উঠছে কেন? আমার গয়না আমি বন্ধক রাখব–তাতে এত কৈফিয়ৎ বা কিসের? আমার কি এটুকু এক্তার নেই?
ভেতরের ভয়টা বাইরের ‘মুখ-সাপোর্টে’ ঢাকতে গিয়ে মহাশ্বেতার কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যায়। শেষের দিকে গলাটা কেঁপেও যায় একটু।
কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামানো দরকার মনে করেন না শ্যামা। তুচ্ছ কথার অর্থ ধরে মান-অভিমান প্রকাশ করা তাঁর অভ্যাসও নয়। তিনি শুধু একটুখানি চুপ ক’রে থেকে বলেন, ‘অ। তুমি তা’হলে কারবার করতে টাকা ধার নিচ্ছ। বাঃ, এমন না হ’লে বুদ্ধি! –তাই তো বলি, আমার বুদ্ধিমতী মেয়ে কারও সঙ্গে সলা-পরামর্শ না করেই যখন এমন কাজ করেছেন, তখন একটা ভাল রকমই অখ আছে বৈকি!’
শ্যামা তাঁর কণ্ঠস্বরে কঠিন ব্যঙ্গটাকে যতদূর সম্ভব প্রচ্ছন্ন রাখতেই চেষ্টা করেন, তবু এর ভেতরের খোঁচাটা এতই স্থূল যে মহাশ্বেতারও বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। এবার সে বেশ একটু তেতে উঠেই জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, অত্থ আছেই তো। আমি কম সুদে টাকা ধার ক’রে যদি বেশি সুদে অপরকে ধার দিই তো অন্যায় অলেহ্যটা কি করা হ’ল, তা তো বুঝতে পারছি না। বলি, সব কারবারেই তো এই দস্তুর গা? কম দামে মাল কিনে বেশি দামে বেচা–না কি বলো? বৌদিও তো শুনছ–বলি বলো না আমি হক বলছি কি না বলছি! আর যদি বেহকই বলে থাকি–টাকা গেলে আমার যাবে, এলে আমার আসবে। তোমার তো কিছু লোকসান নেই তাতে? তবে তোমার এত জ্বালানি পোড়ানি কিসের?
রাগ করবারই কথা। অপমানে বিরক্তিতে শ্যামার একদা-গৌরবর্ণ মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠলও একবার–কিন্তু প্রাণপণ শক্তিতে সে উষ্মা দমনই করলেন তিনি। এ এমনই নির্বোধ, এমনই বুদ্ধিহীন যে এর উপর রাগ করা মানে নিজের শক্তিরই অপচয় করা। এর ওপর অভিমান করলে নিজেকেই অপমান করা হয়। তিনি তাই আরও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থেকে শুধু প্রশ্ন করলেন, ‘তা জামাই জানেন এ কথাটা?–তুই যে গহনা বন্ধক রেখে তাঁকে টাকা দিচ্ছিস?
‘ও মা, তা জানে না!’ সবেগে বলতে গিয়েও কেমন যেন থতমত খেয়ে থেমে যায় মহাশ্বেতা। বুঝি কথাটা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে পড়ে যায় যে কথাটা অভয়কে জানবার কোন কারণ ঘটে নি। সে টাকা চেয়েছে, মহাশ্বেতা বলেছে দেব। কোথায় পাবে সে–কিম্বা কোথা থেকে আনবে–সে প্রশ্ন অভয়ও করে নি, মহাশ্বেতাও বলে নি। হয়ত অভয়ের ধারণা যে তার স্ত্রীর কাছেই আরও টাকা আছে–জমিয়েছে সে। তবে সে সম্ভাবনার কথা মহার তখন মনে হয় নি, তা’হলে সে-ই ভুলটা ভেঙ্গে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠত। তখন শুধু এই কথাটাই মনে হয়েছিল যে, এইভাবে টাকাটা চাওয়া মাত্র যোগাড় ক’রে এনে দেবার মধ্যে তার একটা মস্ত বাহাদুরি প্রকাশ পাবে–স্বামীর কাছে তার ‘পোজিশান্’ বাড়বে (এ শব্দটা সে সম্প্রতি শিখেছে ছোট দেওরের কাছ থেকে–তার ভারী পছন্দ এ শব্দটা)। তাছাড়া ধার করার কথাটা জানানো বা অনুমতি নেওয়া যে দরকার তাও মনে হয় নি তার।
সামান্য দ্বিধায় কণ্ঠস্বর মুহূর্তকালের জন্য স্তিমিত হয়ে আসে, থতিয়ে থেমে যায় একটু, তার পরই আবার গলায় জোর দিয়ে বলে, ‘সে আবার না জানে কি? সব যে তার নখ-দর্পণে। বলে মানুষের মুখের দিকে চাইলে সে পেটের কথা টের পায়। তার কাছে কি কোন কিছু চাপা থাকে?’
কিন্তু সেই সামান্য দ্বিধাই শ্যামার কাছে যথেষ্ট। তিনি ওর আসল প্রশ্নটা চাপা দেবার চেষ্টাকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘হুঁ! তার মানে তুমি তাঁকে কিছু বলো নি, লুকিয়েই করেছ কাজটা।–সে আমি বুঝেছি মা, জামাই জানলে কখনও এ কাণ্ড করতে দিতেন না! তোমার ভাল লাগবে না, তুমি শুনবেও না তা জানি, তবু আমার কর্তব্য বলেই বলেছি– কাজটা ভাল কর নি–ভাল করছ না। অন্তত জামাইকে লুকিয়ে এ কাজ করা একেবারেই উচিত নয়। যা করেছ করেছ–আজই গিয়ে তাঁকে সব খুলে বলো আর এ টাকাটা ভালয় ভালয় ফিরে পেলে আগে দেনা শোধ ক’রে গহনা ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। ছিঃ–সোনা হ’ল লক্ষ্মী, সেই লক্ষ্মীকে বন্ধক রেখে টাকা ধার করে নিতান্ত যাদের হা-ভাতের দশা তারা। এ কাজ করতে নেই, ক’রো না।’
শ্যামার কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্যে ও আন্তরিকতায় কেমন যেন ভয় পেয়ে যায় মহাশ্বেতা, আস্তে আস্তে বলে, ‘তা না হয় সে ফিরলে আজ খুলে বলব কথাটা, তারপর সে যা বলে। তবে মনে তো হয় না, যে সে বারণ করবে। টাকা খোয়াবার পাত্তর সে নয়–টাকা আদায় করবেই যেমন ক’রে হোক। এটুকু জোর আমার মনে আছে। তবু দেখি বলে–। তবে তুমি আর ঐ সব ভাল করো নি, ভালো করো নি বাক্যিগুলো বলো নি বাপু–তোমার কথা বড্ড ফলে যায়। কাল-মুখের বাক্যি তোমার।
বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ায় সে! খেয়ে দেয়ে এতটা পথ এসেছে, ছুটেই এসেছে বলতে গেলে–এখনও ভাল ক’রে দম নিতে পারে নি। আরও খানিকটা বসে গল্প ক’রে সেই বিকেলের দিকে ফিরবে বলে প্রস্তুত হয়ে এসেছিল–কিন্তু এখন যেন আর বসতে ভরসা হচ্ছে না। মার কাছে ধরা পড়ে যাবার লজ্জা তো আছেই–তা-ছাড়া শ্যামার বলবার ধরনটাতে একটু ভয় ধরেও গেছে, এ অবস্থায় মার অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে বসে থাকা বড় অস্বস্তিকর। তার চেয়ে বরং ভট্চায-বাড়ি ঢুকে একটু বসে জিরিয়ে নেবে। এক ঘটি জলও খেয়ে নেবে সেখানে। বুক অবধি শুকিয়ে উঠেছে যেন। এখানেও খেয়ে নেওয়া চলত কিন্তু তাতে করে আরও পাঁচটা মিনিট অন্তত এইখানে বসতে হয়। সেটুকুও থাকতে ইচ্ছা করছে না।
কনক অবশ্য পীড়াপীড়ি করে, হাত ধরে বসাতেও যায় কিন্তু সে আর বসে না। ঘাড় নেড়ে বলে, ‘না ভাই আমি যাই। কথা তো হয়েই গেল–মিছিমিছি আর দেরি ক’রে লাভ কি? ছোট বৌটার প্রেহারী শুধু। সেও তো বালস্পোয়াতী–তার একার ঘাড়ে অতটা চাপানো ঠিক নয়। মহারানী যা আছেন, মানুষটা মরে গেলেও নিজের পালার বাইরে একটি কাজ করবেন না। তার চেয়ে পারি তো আমিই গিয়ে পড়ি, সে বসে থাকবে না, হয়ত এতক্ষণে কাজে লেগেই গেলে, তবু যতটা পারি। শেষের দিকে খানিকটা হাতাপিতি ক’রে সেরে নিতে পারলেও উগার হয় কিছু!’
সত্যিই সে আর দাঁড়ায় না, হন্ হন্ ক’রে হাঁটতে শুরু করে দেয়।
॥৩॥
কথাটা যতই আনন্দের এবং ওর পক্ষে সুখের হোক–জিজ্ঞাসা না করলে নিজে থেকে বলা যায় না। অথচ এতদিন যেটুকু সংশয় ছিল কনকের সেটুকুও আর থাকেহ না। ছেলেই হবে তার–মানে ছেলে কিম্বা মেয়ে। যে-সব লক্ষণগুলোর কথা জানা বা শোনা ছিল তার– সে সবগুলোই মিলে যাচ্ছে। অথচ অনেক আগেই যাঁদের চোখে পড়ার কথা তাঁরা নির্বিকার। শ্যামার সব দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কিন্তু তিনিও–হয়ত ওর দিকে ইদানীং ভাল ক’রে তাকিয়ে দেখেন নি ব’লেই অথবা এ সম্ভাবনার কথাটা তাঁর আদৌ মনে হয় নি ব’লেই– দেখতে পান নি কিছু। হেমেরও চোখে পড়ে না কারণ দিনের বেলা বৌয়ের দিকে তাকিয়ে দেখার অবসরই তার অল্প। এক রবিবারেই যা সকালের দিকে বাড়ি থাকে কিন্তু সে সময়টাও কাটে তার বাগানের তদ্বির করে বা মাছ ধরে। তাছাড়া কনকের দিকে ভাল ক’রে চেয়ে দেখার কোন কারণ আছে বলেও মনে হয় না তার।
অগত্যা অনেক ইতস্তত ক’রে কনক বাপের বাড়িতেই চিঠি লেখে। এসব কথা চিঠিতে লিখতেও লজ্জা করে–লিখতে বসে অনেকবারই ভাবতে হয়েছে, অনেক ইতস্তত করেছে সে কিন্তু উপায়ান্তর না পেয়েই শেষ পর্যন্ত ইশারা-ইঙ্গিতে কথাটা জানিয়েছে। আজকাল তার সুবিধাও হয়েছে একটু। কান্তি বাজারে-দোকানে যায় দরকার-মতো–তাকে পয়সা দিলে খাম পোস্টকার্ড সে-ই এনে দিতে পারে। দেয়ও। এর মধ্যে দু-একবার এনে দিয়েছে। পয়সা আজকাল দুটো একটা সে সাহস ক’রে হেমের কাছ থেকে চেয়ে নেয়। সামান্য দুটো-একটা পয়সা চাইলে কোন কারণ জিজ্ঞাসা করে না হেম, হাসিমুখেই দেয়। একবার শুধু একসঙ্গে দু আনা পয়সা চেয়ে ফেলেছিল কনক–সেই দিনই, চাইবার সঙ্গে সঙ্গেই গম্ভীর হয়ে উঠেছিল হেম, কী দরকার প্রশ্নও করেছিল। সেই থেকেই সতর্ক হয়ে গেছে কনক–আর কখনও দু পয়সার বেশি চায় না। অবশ্য সে দু আনা সে হেমেরই প্রয়োজনে চেয়েছিল–ওর হাড়ের বোতামগুলো সবই প্রায় ভেঙ্গে গেছে, কান্তিকে দিয়ে কিনে আনাবে ব’লে–তাই কথাটা বলতেও কোন দ্বিধা ছিল না, হেমের মুখের গাম্ভীর্যটাও কাটতে খুব দেরি হয় নি–তবু ভাল ঘোড়ার এক চাবুক, সেই একবারেই শিক্ষা হয়ে গেছে তার, আর ভুল করে না।
আর কীই বা দরকার তার! নিজের জন্যে কিছু কেনার উপায় নেই এ বাড়িতে; ইচ্ছা, প্রয়োজন এমন কি সঙ্গতি থাকলেও নয়। কোন কিছু দরকার হ’লে ভয়ে ভয়ে শাশুড়ীর গোচরে আনতে হয় কথাটা; যদি তিনি বলেন যে, ‘দেখি–এখন তো হাতে খুব টানাটানি– সামনের মাসে না হয় মরি-বাঁচি ক’রে যা হয় করব’ কিম্বা যদি বলেন যে, ‘হেমকে বলে দেখি একবার যদি এনে দেয়’–তো সেটা মহা সৌভাগ্য বুঝতে হবে। আর যদি সোজা ঝেড়ে জবাব দেন যে, ‘ও সব এখন হবে-টবে না বাছা অত পয়সা নেই’ কিম্বা বলেন, ‘আমার ঘরে ইচ্ছে করলেই কোন জিনিস পাওয়া যায় না মা, দরকার হ’লেও অনেক সময় চেপে রাখতে হয়।–তো ব্যস্–সেইখানেই সে প্রসঙ্গের ইতি। আবার সে কথা তুলবে এত সাহস অন্তত কনকের নেই।
আর তাঁকে না বলে কোন জিনিস কিনবে, কি কিনে আনাবে এমন বুকের পাটা কার? হেমেরও সে সাহস নেই। সে চেষ্টা যে দু-একবার ক’রে দেখে নি কনক তা নয়। ইদানীং হেম তার প্রতি খুবই সদয় হয়েছে–বেশ সস্নেহ ব্যবহার করে–তবু ফরমাশের নাম শুনেই শিউরে উঠেছে। জবাব দিয়েছে, ‘ও বাবা, আমি তোমাকে দুম ক’রে কোন জিনিস এনে দেব–সে আমার দ্বারা হবে না। মা টের পেলে রক্ষে থাকবে না। মিছিমিছি একটা অশান্তি। তার চেয়ে ও মাকেই ব’লো।’
অশান্তি যে তা কনকও বোঝে। দেখতেই পাচ্ছে। এমনিতেই শ্যামা যেন তার সম্বন্ধে কেমন বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়েছেন আজকাল। কেন তা অনেক ভেবেও সে বুঝতে পারে না। ছেলে যতদিন বৌ সম্বন্ধে উদাসীন ছিল ততদিন তিনি কনকের প্রতি যথাসম্ভব (তাঁর স্বভাবে যতটা সম্ভব) সহানুভূতিই দেখিয়েছেন, প্রকাশ্যেই ছেলের ব্যবহারে অনুযোগ করেছেন। কিন্তু ইদানীং ছেলের মতি-গতি পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে–এমন কী ভাল করে পাল্টাবার আগেই, শ্যামার মেজাজের পরিবর্তন ঘটে গেছে যেন। স্বামীর স্নেহ,–ভালবাসা বলে, আজও মনে করে না কনক, সে টের পাবার আগেই যেন শাশুড়ী টের পেয়েছেন। তা না হয় পেলেন–কিন্তু সেজন্যে তিনি কেন অসন্তুষ্ট হবেন সেইটেই ভেবে পায় না সে।
চিঠি লেখারও বিপদ কম নয়। শ্যামা নিজে যদিচ মোটামুটি খানিকটা লেখা-পড়া জানেন, তবু মেয়েদের বই নিয়ে বসে থাকা পছন্দ করেন না। ওটা সময়ের অপব্যয় বলেই মনে করেন। বলেন, ‘অমন আয়না মুখে ক’রে বসে থাকা বড়লোকদের শোভা পায়। আমাদের গেরস্ত ঘরে ও-সব সাজে না। আর দরকারই বা কি, দু’পাতা বই পড়ে কি স্বগে বাতি দেবে, না কোম্পানির দপ্তরে চাকরি করতে যাবে? ঐ সময়টা সংসারের বাড়তি কাজ করলে কিছু তবু সাশ্রয় হয়।’
পড়া যেমন পছন্দ করেন না, তেমনি লেখাও না। চিঠি লিখতে দেখলেই তাঁর দৃষ্টি এবং কণ্ঠ দুই-ই তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। বিপদ-আপদ না ঘটলে চিঠি লেখার কী সার্থকতা তা তিনি ভেবেই পান না।
‘যারা কাজ-কারবার করে তাদের না হয় ঝুড়ি ঝুড়ি চিঠি পাঠাতে হয়, সে চিঠিতে দু’পয়সা আসে তাদের–তার জন্যেই সাহেবদের আপিসে মাইনে-করা কেরানী রাখে- তোমাদের চিঠিতে তো আর এক পয়সা আয় হবে না, বরং ঐ পয়সাটাই অপচ্ হবে। ঐ যে সব বলেন, ভারী তো এক পয়সা খরচ একখানা পোস্টকার্ডের–ওটা কি আবার খরচা নাকি! আ-মর্–একটা পয়সাই বা আসে কোথা থেকে! বলে কড়া কড়া নাউটা, কড়াটা না ফেললে তো আর নাউটা নয়। এক পয়সার পোস্টকার্ড না কিনে নুন কিনলে গেরস্তর সাতদিন রান্না চলে। আর কী দরকারই বা? দুদিন আগেই হয়তো দেখা হয়েছে না হয় আর দুদিন পরে হবে। যা বলবার আছে তখনই বলবে পেটের থলি উজোড় করে সব কথা ব’লো–তাতে তো কোন ক্ষতি হবে না। এক পয়সা লোকসান নেই তাতে। অসুখ-বিসুখ করে কি কোন জরুরি দরকার থাকে–সে এক কথা, নইলে তো সেই বাঁধা গৎ, তুমি কেমন আছ–আমি ভাল আছি। সুখ-সোমন্দা পয়সা উড়িয়ে দেওয়া।’
সুতরাং খাম পোস্টকার্ড আনলেই শুধু হয় না–চিঠি লেখবার মতো অবসরটুকুর জন্যও সাধনা করতে হয়। সে অবসর সত্যিই দুর্লভ এ বাড়িতে। সদাজাগ্রত শাশুড়ী অহরহ কর্মব্যস্ত, কখন কোথায় এসে পড়বেন তার ঠিক নেই। দুপুরে তিনি নিজে ঘুমোন না, আর কেউ ঘুমোয় তাও পছন্দ করেন না। কনক দুপুরের দিকে একটু অবসর পায় ঠিকই–কিন্তু কখন তিনি ঘুরতে ঘুরতে এসে হাজির হবেন কিম্বা ওকে ডেকে কাছে বসাবেন তার কোন ঠিকই নেই। চিঠি লেখা তো অপরাধ বটেই–লুকিয়ে লেখা আরও কঠিন অপরাধ।
তবু ওরই মধ্যে সময় করে একখানা চিঠি লেখে সে। যেটা দশ মিনিটে লিখে ফেলবার কথা সেইটেই তিনদিন ধরে লিখতে হয়। রাত্রে লেখা যায় না–হেম জিজ্ঞাসা করবে হঠাৎ বাপের বাড়িতে চিঠি লেখার কী এমন দরকার পড়ল? বিশেষত ওর বাপের বাড়ির গ্রামের বহু ছেলে লিলুয়ায় কাজ করে–একই গাড়িতে যাতায়াত–কে কেমন আছে তার মোটামুটি একটা খবর পায়ই হেম। সে জিজ্ঞাসা না করলেও তারাই সেধে দেয় সে খবর। আগে বলত না, এখন হেম ওকে বলেও এসে সে খবর। কাজেই–আবার মিছিমিছি এক পয়সা খরচের কী এমন জরুরি প্রয়োজন পড়ল–এ প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক।
কিন্তু–চিঠি যখন লেখা হয় নি, তখন কী করে লিখব–এই প্রশ্নটাই ছিল প্রধান, চিঠি লিখে গোপনে কান্তিকে ফেলতে দিয়েই অনুতপ্ত হয়ে ওঠে কনক। কেনই বা একথা ওঁদের লিখতে গেল সে! তাঁরা আর কী করবেন? এক বাড়িতে থেকে সে যা জানাতে পারল না– তাঁরা অন্য গ্রাম থেকে এসে কেমন ক’রে জানাবেন? মিছিমিছি তাঁদেরও বিব্রত করা। এঁরা যে জানেন না সে কথাটা অবশ্য লজ্জায় লিখতে পারে নি সে। তবে তাঁরা অনুমান করতে পারবেন। কারণ জানলে এঁরাই জানাতেন সে কথাটা। তা-ই নিয়ম। দুম্ ক’রে এসে যদি কেউ কথাটা তোলে, তাহ’লে তার লাঞ্ছনার সীমা থাকবে না।
এক যদি তাঁরা কোন ছুতো ক’রে দু-একদিনের জন্য নিয়ে যান–তারপর সেখান থেকে লিখে জানান তো হয়। সেইটেই লিখে দেওয়া উচিত ছিল। তবে–সে মনে মনে প্রবোধ দেয় নিজেকে–সে বুদ্ধি কি আর বাবা-মার হবে না? তা না হ’লেও, এলে সে টের পাবেই, কাছাকাছি এলে না হয় একটু চোখ টিপে দেবে’খন শাশুড়ীর পিছন থেকে–যাতে চিঠির কথাটা না বলেন শাশুড়ীকে।
কিন্তু এ আশ্বাসও বেশিক্ষণ টেকে না–আশঙ্কাটাই প্রবল হয়ে ওঠে। আশ্চর্য, তার ভাগ্যটা যেন সৃষ্টিছাড়া একেবারে। নইলে এমন কথা কে কোথায় শুনেছে! এক বাড়িতে এক সংসারে বাস ক’রেও শাশুড়ী খবর রাখেন না–কেউ শুনলেও বিশ্বাস করবে না। বিশেষত বিধবা শাশুড়ী–ব্রাহ্মণের বিধবা। কিন্তু শ্যামাও যে একেবারে দলছাড়া গোত্রছাড়া। সাধারণ অন্য বিধবাদের মতো আচারবিচারের ধরাকাঠ তাঁর আদৌ নেই। তিনি বলেন, ‘অতশত মানতে গেলে আর কট্কেনা করতে গেলে আমার চলে না, আমার বলতে গেলে ভিখিরীর সংসার, দুঃখের পেছনে দড়ি দিয়ে চলতে হয় অষ্টপ্রহর। যে সময় ঐসব করব–সে সময় আমার দু পাঁচসের পাতা চাঁচ হয়ে যাবে।… আর ওসব মানিও না, উনি ঠিকই বলতেন–এটা ক’রো না, এটা করলে অমুক হবে শুনলেই উনি ছড়া কাটতেন, মোকড় মারলে ধোকড় হয় চালতা খেলে বাকড় হয়। সেই কথাটাই ঠিক।’ ভাত অবশ্য তিনি বধুর হাতে আজও খান নি, ওর দীক্ষা হয় নি–হাতের জল এখনও অশুদ্ধ বলে–চাঢ়া পাতার জ্বালে ভাত রাঁধা–তিনি ছাড়া কেউ অত ভাল পারেও না। ধৈর্য্যের অভাব, পাতাও অনেক বেশি খরচ ক’রে ফেলে। কিন্তু ভাত ছাড়া মোটামুটি রান্নাটা কনকই করে আজকাল, দৈবাৎ কোনদিন শ্যামার হাতে কাজ না থাকলে সে অন্য কথা। নইলে কোন নিয়ম-কানুনের ধার ধরেন না তিনি। কাজেই যে কারণে জানা যেতে পারত–সে কারণটা ওদের সংসারে নেই।
.
চিঠি পেয়ে ওর বাবা প্রথম শনিবারেই এসে হাজির হলেন–আর এমন সময়েই এলেন যে ওর সতর্কতার সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেল। এ সময়টা কনকের হিসেবে ধরা ছিল না। অর্থাৎ বেলা দুটোর সময়।
ও সেদিন ঘুমোয় নি। আর একটু পরেই হেম এসে পড়বে–হেম আজকাল তিনটের মধ্যেই এসে পড়ে–এসেই গরম জল চাইবে সাবান কাঁচবার জন্যে; তাছাড়া স্বামী খেটেখুটে এসে দেখবে স্ত্রী আরামে ঘুমোচ্ছে–সে বড় লজ্জার কথা; তাই সে রান্নাঘরের দাওয়াতেই আঁচলটা পেতে গড়াচ্ছিল একটু। আর কতটা পরে পাতার জ্বালে গরম জলের হাঁড়ি চাপাবে–সামনে কার্নিসে-পড়া রোদটা দেখে সেই-পাতার হিসেব করছিল মনে মনে।
অকস্মাৎ বাবার গলা কানে যেতেই ধড়মড় ক’রে উঠে কাপড়-চোপড় সামলে বাইরে এল কিন্তু তার আগেই অনিষ্ট যা হবার তা হয়ে গেছে। তখন আর কোন-রকম সাবধান করার উপায়ও ছিল না–তিনি ওর দিকেই পিছন ফিরে রকের ওপর জেঁকে বসেছেন। আগে কি কথা হয়েছিল তা জানা গেল না, কনক যখন এল তখন ওর বাবা হাসি-হাসি মুখে বলছেন, ‘সুখবরটা শুনেই ছুটে এলুম বেনঠাকরুন, বলি যাই, খাড়া খাড়া গিয়ে সন্দেশ খেয়ে আসি গে।… আজ আর সহজে ছাড়ছি না কিন্তু তা আগেই বলে রাখছি, একটি হাঁড়ি মিষ্টি চাই।’
শ্যামার সঙ্গে চোখাচোখি হ’ল না বটে কিন্তু তাঁর মুখটা দেখার কোন অসুবিধাই ছিল না কনকের। প্রথমটা একটা প্রচণ্ড বিস্ময়, একটা হতচকিত ভাবই মুখে চোখে ফুটে উঠেছিল– কিন্তু সে এক লহমার বেশি নয়। তারপরই তাঁর মুখ অরুণ বর্ণ ধারণ করল, ধারলো ছুরির ফলার মতোই শাণিত হয়ে উঠল তাঁর দৃষ্টি। কিন্তু সেও এক মুহূর্তের বেশি নয়, বোধ করি সে উষ্ণতা ও উগ্রতার একটা ছায়ামাত্র সরে গেল তাঁর মুখের ওপর দিয়ে– প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যথোচিত মিষ্ট সৌজন্যের হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন যেন। হেসেই জবাব দিলেন, ‘খাওয়া তো আমারও পাওনা হয় বেইমশাই, আমি তো পথ চেয়ে বসে আছি–আপনি হাঁড়ি হাতে করে ঢুকবেন। তা সে হবেই এখন– কিন্তু সুখবরটি আপনাকে এরই মধ্যে দিলে কে?’
সুখবরটা কি তা প্রশ্ন করার প্রয়োজন হল না। ঐ যা প্রথমেই কয়েক মুহূর্ত সময় লেগেছিল বেহাইয়ের কথাটা ঠিক কোন্ দিকে যাচ্ছে ধরতে। কিন্তু মনের ওপর ও মুখের ওপর যত দখলই থাক তাঁর– কণ্ঠস্বরটাকে পুরোপুরি আয়ত্তের মধ্যে আনতে পারেন নি– শেষের প্রশ্নটা করার সময় সতর্কতা সত্ত্বেও কণ্ঠ থেকে ঈষৎ তীক্ষ্ণ কঠিন সুরই বেরিয়ে এল। আর তাইতেই হুঁশিয়ার হয়ে উঠলেন পূর্ণ মুখুজ্জে-মশাই। তিনিও পল্লীগ্রামেই বাস করেন– এসব বাঁকা প্রশ্নের সরল পরিণতি তাঁর একেবারে অজানা নয়। প্রাথমিক উচ্ছ্বাসটা সামলাতে একটু সময় লাগল বটে– তবে সহজ সত্য কথার পথে আর গেলেন না তিনি। বার দুই ঢোক গিলে বললেন, ‘খবর? তা মানে– তা ঠিক বলতে পারব না। মানে ঐ মেয়েমহল থেকে শোনা, বুঝলেন কিনা– ঠিক কী করে খবরটা গেছে—’
অর্ধপথেই থেমে গেলেন পূর্ণবাবু।
শ্যামাও আর বেশি পীড়াপীড়ি করলেন না। অমায়িকভাবেই হেসে বললেন, ‘যাক– যে-ই দিক, খবরটা পৌঁছলেই হ’ল। আমারই দেওয়া উচিত ছিল, দোবও ভাবছিলুম কদিন থেকেই কিন্তু জানেন তো বহুদিন মা সরস্বতীর পাট নেই, দোয়াতকলম এখন যেন বাঘ মনে হয়!
এর পর কোন পক্ষেই সহজ সৌজন্যের অভাব হল না। বরং শ্যামার দিক থেকে একটু বাড়াবাড়িই হল বলা যায়। কান্তিকে দোকানে পাঠিয়ে সত্যি-সত্যিই দুটো রসগোল্লা আনালেন তিনি– তাও এক-পয়সানে ছোট রসগোল্লা নয়, দু-পয়সানে বড় রসগোল্লাই আনতে বলেছিলেন তিনি– ঘরে তৈরি খুদ ভাজার নাড়ুর সঙ্গে সে দুটোই সাজিয়ে দিলেন এবং পীড়াপীড়ি করে সবগুলো খাওয়ালেন। পূর্ণ মুখুজ্জেমশাইয়ের মনে যেটুকু উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল, এই প্রীতিপূর্ণ হৃদ্যতায় তার আর চিহ্নমাত্র রইল না; তিনি জলযোগ শেষ করে খুশি মনেই বিদায় নিলেন। মেয়ের সঙ্গে দেখা হল বটে–কিন্তু সে শ্যামার সামনেই– আড়লে দেখা করার কোন প্রয়োজন আছে তা তাঁরও মনে হল না, শ্যামাও সে সুযোগ দেওয়া আবশ্যক মনে করলেন না। সুতরাং মামুলী সাবধানে থাকার দু চারটে উপদেশ দিয়ে পূর্ণবাবু হাসিমুখে মেয়েকে আশীর্বাদ করে বেয়ানকে প্রণাম করে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেন। বহুদিন মেয়ের সন্তান-সম্ভাবনা না হওয়ায় মেয়ে-জামাইয়ের সম্পর্ক সম্বন্ধে যে কুটিল সংশয়টা দেখা দিয়েছিল, এ সুসংবাদে সেটাও নির্মূল হয়ে গেছে। ভদ্রলোক সত্যি-সত্যিই খুশি হয়েছেন।
বেয়াইকে কিছুদূর এগিয়ে দিয়ে, তাঁর চোখের আড়ালে চলে যাওয়া পর্যন্ত কানাইবাশীর ঝাড়টার কাছে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শ্যামা। সহজ, স্বাভাবিক মানুষ। যেতে যেতে হঠাৎ পেছন ফিরে তাকালেও পূর্ণবাবু কোন বৈলক্ষণ্য টের পেতেন না। কিন্তু তাঁর বগলের বিবর্ণ ছাতাটি ওঁদের বাঁশঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গেই শ্যামার মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল। বাইরের ঘরের রকে পাতার রাশ পড়ে, বঁটিটা সেইখানেই কাৎ করা কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না ক’রে সোজা বাড়ির মধ্যে এসেই ঢুকলেন।
হেম খানিকটা আগেই এসেছে কিন্তু শ্বশুরকে দেখেই বোধ হয়–তখনও পুকুরে নামে নি কাপড় কাঁচতে–রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে একটু বিশ্রাম করছিল। কনকও আছে সেখানে–সাবান-কাঁচার জল গরম হয়ে গেছে অনেকক্ষণই, ওদিকে কাজও পড়ে বিস্তর– তবু সেখান থেকে নড়তে পারে নি। সে বহুদিন এই ঘর করছে, শাশুড়ীকে সে বিলক্ষণ চেনে, তাঁর এই কিছু পূর্বের অমায়িক ব্যবহারে ভোলার মতো নির্বোধ নয় সে। সে তাই উনুনের ধারেই আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝড় যে একটা উঠবে সে বিষয়ে তার সন্দেহমাত্র ছিল না–শুধু কখন উঠবে এবং কী পরিমাণ প্রবল হবে সেইটেই ঠিক অনুমান করা যাচ্ছে না। আশঙ্কাটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকলে উদ্বেগ আরও বাড়ে–কনকেরও বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছিল আসন্ন আক্রমণের সম্ভাবনায়।
শ্যামা এসে দাওয়ার সামনেই দাঁড়ালেন। ছেলে কিংবা বৌ কে অপরাধী, অথবা দুজনেই–ঠিক করতে না পেরে দুজনের মুখের ওপরই একটা কঠোর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘বলি, আমাকে না জানিয়ে বেয়াইবাড়িতে চিঠিটা কে লিখলে জানতে পাই কি?’
উত্তর কারুর দেওয়ার কথা নয়, সেজন্য অপেক্ষাও করলেন না শ্যামা! শাণিতকণ্ঠ আর এক পর্দা চড়িয়ে পুনশ্চ বললেন, ‘এ ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়ার তাড়াটি পড়ে গেল কার? আমাকে না বলে সাত-তাড়াতাড়ি কুটুমবাড়িতে না জানালে চলছিল না বুঝি? মহা সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছিল একেবারে!… আমি কি কানা না কিছু জানি না? যখন দরকার বুঝতুম আমিই জানাতুম। আর যদি এত মাথাব্যথাই পড়েছিল তো এমন ক’রে কুটুমবাড়িতে আমাকে বে-ইজ্জত না ক’রে সোজাসুজি এই দাসীবাঁদিকে হুকুম করলেই তো হ’ত যে– খবরটা জানিয়ে দাও, নইলে আমাদের চলবে না, দিন কাটছে না। না কি, মা-মাগী যে এ বাড়ির কেউ নয়–নিতান্ত ঝি-চাকরাণী, সেই কথাটাই জানানো দরকার ছিল!’
হেম এই আকস্মিক–এবং তার কাছে অকারণ, আক্রমণে হকচকিয়ে গিয়েছিল। সে অবাক হয়ে বলল, ‘কী জানানো হয়েছে কি? আর কে-ই বা জানালে?’
‘কে জানিয়েছে সেইটেই তো আমি জানতে চাইছি বাছা! কার এতবড় সাহস–বুকের পাটা হ’ল যে কুটুমবাড়িতে মুখটা পোড়াতে গেল আমার!’
ছেলের প্রশ্ন করার ধরনেই শ্যামা বুঝে নিয়েছেন–সেই সঙ্গে কনকের অমন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও যে–কাজটা কার। সেই সঙ্গে তাঁর ভাষাও গেছে বদলে।
কনকের মাথাতে যেন কিছু ঢুকছে না। তার সবটাই যেন কাঠ হয়ে গেছে–ভেতরে বাইরে। বাইরে কোথায় একটা কাঠঠোকরা ঠকাস ঠকাস আওয়াজ করছে, দুটো কাঠবেড়ালীতে ঝগড়া বাধিয়েছে–সেই দিকেই যেন প্রাণপণে কান পেতে আছে সে। আজ যে রণরঙ্গিনী মূর্তি তার শাশুড়ীর–আজ নিশ্চিত মার খাওয়া অদৃষ্টে আছে তার, সেই চিন্তা থেকেই মনটাকে সরাতে চাইছে সে।
হেম কিন্তু এবার বিরক্ত হয়ে উঠল। এ সব কথার পাঁচ সে কোনদিনই সইতে পারে না। সেও বেশ গলা চড়িয়েই বলল, কী মুশকিল, অত ভনিতা না করে আসল কথাটা কি খুলে বললেই তো হয়! কী হয়েছে সেইটেই যে বুঝতে পারছি না!’
শ্যামাও সমান ঝাঁঝের সঙ্গে জবাব দিলেন, ‘কি হয়েছে জানো না? ন্যাকা?… তোমার ছিষ্টিধর বংশধর হবেন আমার স্বগে বাতি দিতে–বৌ পোয়াতী, সেই খবরটি রাতারাতি তোমার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে গেল কী ক’রে সেইটেই জানতে চাইছি।… খবর কি আমি জানতুম না–না কখন খবর দিতে হবে সেটা আমার জানা ছিল না? আমি কি ঘরসংসার করি নি কখনও? না কি বেদের টৌল ফেলেই দিন কেটেছে চিরকাল? যে তোমার বৌ বিবেচনা শেখাতে গেল?… কী সাহস ওর! এত সাহস ওর আসে কোথা থেকে?… তুমিই নিশ্চয় এ আস্পদ্দা যুগিয়েছ ওকে! সমঝে দিয়েছ যে মা দাসীবাদী, ওকে থোড়াই কেয়ার তুমি মহারাণী, তুমি যা ভাল বুঝবে তার ওপর আর কথা নেই!
সংবাদটা এতই অপ্রত্যাশিত আর পেলও এমন আকস্মিকভাবে যে কিছুক্ষণ যেন হেম শব্দগুলোর অর্থই ঠিকমতো বুঝতে পারল না–বিহ্বলভাবে মার দিকে চেয়ে বসে রইল শুধু।
বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল কনকও। কিন্তু সে অন্য কারণে। উনি সটান বলে দিলেন যে উনি জানতেন! এতবড় মিথ্যা কথাটা উনি বললেন কী করে?… এ সংসারে কেউই সুবিধের নয় তা সে জানে–তবু, এতখানি বয়স হল ওঁর–উনি মা, মা বলে ডাকে সেও–সন্তানের সামনে এই তুচ্ছ কারণে এতবড় নির্জলা মিথ্যা কথাটা বলে বসলেন!… কনকও মেয়েছেলে, তায় দিন-রাত এক বাড়িতে বাস করছে ওঁর সঙ্গে, উনি যে টের পান নি এতদিন–তা সে হলপ ক’রে বলতে পারে। শুধু শুধু–নিজের অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য ঢাকবার জন্যে;–তিনি যে সুগৃহিণী, চারিদিকে চোখ আছে তাঁর সেইটুকু জাহির করার জন্যে; আর সবচেয়ে বড় কথা, কনককে লাঞ্ছনা করবার সুযোগের জনেই জেনেশুনে এই মিথ্যা কথাটা বলছেন উনি! উনি অনেক কিছু পারেন–কত যে পারেন তা তো এসে অবধিই দেখছে সে–কিন্তু এতটা যে পারেন তা ওরও জানা ছিল না।… এই নূতন আবিষ্কারের অভাবনীয়তায় সে যেন নিজের আসন্ন বিপদের কথাও ভুলে গেল–বিস্ময়টাই বড় হয়ে উঠল আর সমস্ত কথা ছাপিয়ে।
কিন্তু কনকের জন্য ভগবান সেদিন আরও বিস্ময় জমিয়ে রেখেছিলেন, –অধিকতর বিহ্বলতার কারণ তোলা ছিল তার জন্যে।
মার কথাগুলোর সম্যক অর্থ মাথায় যাবার সঙ্গে সঙ্গে যেন সমস্ত শরীরটা রিন্ রিন্ ক’রে উঠল হেমের, মনের মধ্যে যেন একসঙ্গে অনেকগুলো তারের যন্ত্র উঠল ঝন্ ঝন্ করে। একটা অব্যক্ত, অজ্ঞাত, অনাস্বাদিত সুখে সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।
.
কিন্তু তার মধ্যেই কথাটা তার মাথায় গেছে যে, এ বিহ্বলতাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। এ অনির্বচনীয় অনুভূতি উপভোগ করার অবসর বা সময় এটা নয়। এ মুহূর্তে কোন অশান্তি বরদাস্ত করতে রাজি নয় সে। মার যে রকম রণরঙ্গিনী মূর্তি–তিনি সব কিছুই করতে পারেন, গায়ে হাত তোলাও বিচিত্র নয়।… একবার অপাঙ্গে অপরাধিনীর দিকে চেয়ে দেখল সে।– তার সেই আনত ম্লান শুষ্ক মুখ ও একান্ত দীন ভঙ্গী দেখে একটা অননুভূত মমতাতেও মনটা ভরে গেল তার। আহা বেচারী! এই কথাটাই মনে হ’ল তার সর্বাগ্রে।
সে মুখে যৎপরোনাস্তি একটা আহত ভাব টেনে বলল, ‘ওঃ, এই! আমি ভাবছি না জানি কী একটা গুরুতর কাণ্ড হয়ে গেছে।… কথাটা তো সেভাবে বলা হয় নি অতশত বুঝেও বলি নি। তুমি যে এই কথা নিয়ে তিল থেকে তাল করবে তাও জানতুম না… তাছাড়া ঠিক বলব বলে বলাও হয় নি। সেদিন বড়বাবু হঠাৎ ডেকে বললেন যে, তোমার বদলির অর্ডার এসেছে, জামালপুরে যেতে হবে।… কবে? না, এই পনেরো দিনের মধ্যে। তখনই আর কিছু ভেবে না পেয়ে বলে বসলুম, যে এখন দিনকতক মাপ করুন–আমার ঘরে এই ব্যাপার।… তা সে কথাটা যে এমনভাবে চাউর হবে, তাও জানি না। এখন মনে পড়ছে বটে যে সেখানে ওদের পাড়ার পুলে চক্রবর্তী দাঁড়িয়েছিল। সেই হয়ত গিয়ে রটিয়ে দিয়েছে কথাটা।’
কথাটা শ্যামার বিশ্বাস হ’ল না। বিশ্বাস হওয়ার কোন কারণ নেই। এ পৃথিবীটাকে তিনি দেখেছেন বহুদিন, এই ছেলেকেও দেখছেন আজন্ম। একথা ও বলে নি। সবটাই বানানো, এই মুহূর্তে যা মনে এসেছে বানিয়ে বলছে। তবু কিছু করার নেই। তাঁর এ বিশ্বাসের কোন প্রমাণ নেই তাঁর হাতে। ছেলে যখন দোষটা মাথা পেতে নিচ্ছে তখন ‘বলে নি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মনের মধ্যেকার ধূমায়িত রোষ তাই প্রচণ্ডতর বেগে জ্বলে উঠলেও আত্মসংযমই করতে হ’ল শেষ পর্যন্ত। তিনি বিস্মিতও হলেন। ছেলে যে বৌ সম্বন্ধে আর উদাসীন নেই–এইটুকু জানতেন, কিন্তু বৌ যে এতটা হাতের মুঠোয় পুরেছে ছেলেকে, কান ধরে ওঠাচ্ছে বসাচ্ছে–এ খবরটা জানা ছিল না তাঁর।
কিন্তু মনে যা-ই হোক, যত দাহই সঞ্চিত হয়ে উঠুক–সেটা প্রকাশ করার স্থান কাল এটা নয়। প্রাণপণে অর্ধোদাত বিষ দমন করলেন শ্যামা। নিরতিশয় শীতল কণ্ঠে শুধু বললেন, ‘অ। তাহলে তুমিই বলেছ! তা কৈ, বলো নি তো সে কথাটা এতদিন। ওটা যে জানতে তাও তো বলো নি!’
‘বা রে।’ হেম মাথা হেঁট ক’রে জবাব দেয়, ‘এ কী আমার বলবার কথা! আর কেনই বা বলব। তুমিও তো জানতে, তুমিও তো বলো নি কাউকে। আমাকেও তো বলো নি। তাছাড়া–’
একটু থেমে গলাটা বোধ করি বা লজ্জাতেই একটু নামিয়ে বললে, ‘তাছাড়া আমি ঠিক জানতুমও না। বলতে হয়–একটা কৈফিয়ৎ দিতে হয় তাই বলা। আন্দাজে ঢিল মারা কতকটা–। লেগে যাবে যে ঠিক ঠিক—’
‘হুঁ!’ অপরাধ স্বীকারের জাজ্বল্যমান প্রতিমূর্তি আনতবদনা বধূর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শ্যামা আরও শীতল কণ্ঠে বললেন, ‘সবই জানতে বাছা। বৌ যে লিখেছে তাও জানতে–তাই সাত-তাড়াতাড়ি আগু বেড়ে এসে দোষটা ঘাড় পেতে নিলে। তোমার যে এতটা উন্নতি হয়েছে সেইটেই শুধু আমি জানতুম না– তা জানলে কি আর একথা বলতে আসি?… তোমাদের গুষ্টির দ্বারা তো অনেক শিক্ষা, অনেক ফৈজৎ হয়েছে–এইটেই বাকি ছিল শুধু বোয়ের কাছে অপমান হওয়া।… যাক্–ঘাট হয়েছে আমার একথা বলতে আসা, তাতে যদি রাজরাণীর কাছে অপরাধ হয়ে থাকে তো মাপ করতে ব’লো; আর কী করব তা জানি না–বলো তো না হয় উঠোনে নাক-খই দিই সাত হাত মেপে!’
এর পর উত্তর-প্রত্যুত্তরের জন্য দাঁড়ানো যায় না। তাহ’লেই সত্য মিথ্যা সাক্ষী প্রমাণের কথা উঠবে। ছেলেই বা কী মূর্তি ধারণ করবে তার ঠিক কি! কথাটা শেষ ক’রেই শ্যামা হন্ হন্ ক’রে বাইরে চলে গেলেন।
প্রমাণ-প্রয়োগ না থাক্–মিথ্যাটা কেউ মুখের ওপর মিথ্যা বলে ছুঁড়ে মারলে কারুরই ভাল লাগে না। হেমেরও লাগল না। কিছু পূর্বেকার মনের মধ্যে রিন-রিনিয়ে ওঠা মিষ্টি সুরটা নষ্ট হয়ে গেল, কোথায় একটা বড় রকমের ছন্দপতন হ’ল যেন। মাধুর্যের বদলে মনের পাত্রে ফেনিয়ে উঠল একটা কটু-তিক্তস্বাদ। সে হন্হনিয়ে কাছে উঠে এসে চাপা গলায় বললে, তুমিই বা আমাকে না জানিয়ে–আমাদের না জানিয়ে চিঠি লিখতে গিছলে কেন? এ এমন একটা কি কথা যে পাড়ায় পাড়ায় ঢাক পিটিয়ে না বেড়ালে হয় না। এইসব কথা নিয়ে ঘোঁট আদিখ্যেতা যার ভাল লাগে লাগে–আমার ভাল লাগে না, এইটে মনে ক’রে রেখো!’
কনক এ কথার কোন উত্তর দিতে পারে না; অন্তরভরা কৃতজ্ঞতায় এবং উচ্ছ্বসিত প্রেমে তার চোখে যে জল এসে গিয়েছিল এই কয়েক মুহূর্ত আগে–সেইটেই বেদনার অশ্রুতে পরিণত হয় শুধু। বলতে পারে না যে, ওরা অন্ধ বলেই তাকে কথাটা অন্যত্র জানাতে হয়েছিল, বলতে পারে না যে, যে স্বামী উদাসীন তার কাছে এ কথাটা নিজে থেকে মুখ ফুটে কোন স্ত্রীই জানাতে পারে না–বলতে পারে না, তার জন্য হেমকে যে গুরুজনের কাছে মিথ্যা বলতে হয়েছে তাতে এমন কোন দোষ হয় নি, কারণ সেই গুরুজনও একটু আগে তাদের কাছে মিথ্যাই ব’লে গেছেন। কিছুই বলা হয় না। একটু আগে স্বামীর মুখে মধুর মিথ্যেটা শুনতে শুনতে অভাবনীয় সৌভাগ্যের মাধুর্যরসে মন ডুবে গিয়ে যে স্বপ্ন দেখছিল, কল্পনা করছিল কেমন ক’রে সে স্বামীর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে বলবে ‘তুমি আমাকে মাপ করো আমার জন্যে তোমাকে মিথ্যা বলতে হ’ল’–আর স্বামী কেমন করে মধুর প্রশ্রয়ে ওকে পা থেকে টেনে তুলে বলবেন, ‘দূর পাগল, তাতে কি হয়েছে!’–সে স্বপ্ন, সে কল্পনাও কোন্ বাস্তবের রূঢ় দিগন্তে মিলিয়ে গেল। এর পর আর কোন কথাই বলবার প্রবৃত্তি রইল না ওর। হেঁট হয়ে হাঁড়ির গরম জলটা কলসিতে ঢেলে দিতে দিতে শুধু প্রাণপণে চোখের জলটা হেমের কাছ থেকে গোপন রাখবার চেষ্টা করতে লাগল।