দ্বিতীয় রামেসিস ও মারনেপতাহ
ইতিপূর্বে পি. মতেঁ মাসপেরো কর্তৃক বর্ণিত আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রচলিত কাহিনীর উপর পুনরায় নতুন করে পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা চালিয়েছেন। সন্দেহাতীত যে, টলেমির সেই স্বর্ণযুগে অতীত ইতিহাসের বহু কিছু আলেকজান্দ্রিয়াতে সংরক্ষিত ছিল। রোমান-বিজয়কালে সেসব ধ্বংস হয়। এ কত বড় ক্ষতি –অধুনা তা গভীরভাবে হৃদয়াঙ্গম করা যাচ্ছে।
পরবর্তী পর্যায়ে, ইসলামী জাহানে প্রচলিত কাহিনীতে যেমন তেমনি খ্রিস্টান জগতের প্রাচীন লোককাহিনীতেও দুই ফেরাউনের কাহিনী পাওয়া যায়। ২০ শতকের গোড়ার দিকে প্রকাশিত ‘হোলি হিস্টরিজ’ এবং ধর্মীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্দেশ্যে এ্যাবে এইচ, লেসেত্রে রচিত ইতিহাসেও ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনা ফেরাউন মারনেপতার আমলে সংঘটিত হয়েছিল বলে উল্লেখ রয়েছে। যাহোক, পি. মতেঁ তাঁর ‘ইজিপ্ট অ্যান্ড দি বাইবেল’ পুস্তকে (১৯৫৯) যে থিওরি দিয়েছেন এবং তার সমর্থনে যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন, তা বাস্তবে কোরআনের বর্ণনায় বিদ্যমান। যদিও, এই খ্যাতনামা প্রত্নতত্ত্ববিদ তাঁর রচনায় কোরআনের কোনো বরাত উল্লেখ করেননি। তবে, কোরআনের সেসব বর্ণনার আলোচনার আগে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে বাইবেলের বর্ণনার আলোচনায়।
বাইবেলের যাত্রাপুস্তকে রামেসিস (রামিষেষ) শব্দটার উল্লেখ রয়েছে বটে কিন্তু ফেরাউনের প্রকৃত কোনো নামের উল্লেখ নেই। এই রামেসিস হচ্ছে সেই অন্যতম নগরী যা জবরদস্তিমূলকভাবে ইহুদীদের দ্বারা নির্মাণ করানো হয়েছিল। এখন জানা যায় যে, বাইবেলে উল্লিখিত এই নগরী নীল-অববাহিকার পূর্বাঞ্চলে তানিস-কানতির এলাকায় অবস্থিত ছিল। এই এলাকাতেই দ্বিতীয় রামেসিস তাঁর উত্তরাঞ্চলীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন এই নগরীতে আরো সৌধমালা ছিল। তবে, দ্বিতীয় রামেসিসই এই নগরীকে গুরুত্বপূর্ণ বর্ণাঢ্য নগরীতে পরিণত করেন। গত কয়েকদশক ধরে এই এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এর বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই নগরী নির্মাণেই ‘রামেসিস’ কৃতদাসে পরিণত ইহুদীদের কাজে লাগিয়েছিলেন।
এখন যখন কোনো পাঠক বাইবেলে ‘রামেসিস’ শব্দটি দেখতে পান তখন তার মনে কোনোও ভাবান্তর জাগে না। কেননা, প্রায় ১৫০ বছর আগে সাংকেতিক চিত্রলিখন পদ্ধতির পাঠোদ্ধার আবিষ্কারকালে চ্যাপোলিয়ন এই বিশেষ শব্দটির উপর বিশদভাবে আলোকপাত করেছিলেন। ফলে, সেই থেকে শব্দটি একান্ত পরিচিত হয়ে পড়েছে। এখন এই শব্দটি আমরা আর সব শব্দের মতই পড়ছি, উচ্চারণ করছি এবং আমরা ধরেই রেখেছি, এই শব্দটি দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের কথা স্মরণ করুন। চিত্রাক্ষর লিখনের পাঠোদ্ধার পদ্ধতি তখন হারিয়ে গেছে; আর এই রামেসিস” শব্দটারও বলতে গেলে ঘটে গেছে অবলুপ্তি। তখন শুধু বাইবেলের পৃষ্ঠাতেই এই শব্দটি অবিকৃতভাবে রয়ে গিয়েছিল; যদিও কিছুসংখ্যক গ্রীক ও ল্যাটিন পুস্তকে এই শব্দটি প্রায় অথবা সম্পূর্ণ বিকৃত করা হয়েছিল। এ কারণেই ট্যাসিটাস তার। ‘এ্যনালস’ পুস্তকে শব্দটিকে রাহমসিস’ বলে উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু, বাইবেলে এই নামটি নির্ভুলভাবে সংরক্ষিত ছিল এবং এই শব্দটি বাইবেলের পেন্টাটেক বা তাওরাত অধ্যায়ে চার-চারটি জায়গায় উল্লিখিত রয়েছে। (আদিপুস্তক ৪৭, ১১, যাত্রাপুস্তক ১, ১১ ও ১২, ৩৭ এবং গণনাপুস্তক ৩৩, ৩ ও ৩৩, ৫)
হিব্রু ভাষার বাইবেলে ‘রামেসিস’ শব্দটি দু’ভাবে লিখিত হয়েছিল। যথা ‘রা (ই) মস’ এবং রাইআমস [হিব্রু ‘ই’-শব্দটি (আরবী) ‘আইন’-এর মত]। বাইবেলের গ্রীক অনুবাদ যা ‘সেপ্টোজিন্ট’ নামে খ্যাত, সেখানে শব্দটি লেখা হয়েছিল ‘রামেসে’ বলে। বাইবেলের ল্যাটিন সংস্করণে (ভালগেট) শব্দটিকে করা হয় রামেসে। ফরাসী ভাষায় অনূদিত ক্লেমেন্টাইন বাইবেলেও (১ম সংস্করণ, ১৬২১) রাখা হয় একই উচ্চারণ ‘রামেসিস’। চ্যাম্পোলিয়ন যখন চিত্রাক্ষর সাংকেতিক ভাষা নিয়ে গবেষণা করছিলেন তখন এই ফরাসী বাইবেলটি সর্বত্র প্রচলিত ছিল। চ্যাম্পোলিয়ন তার ‘সামারি হাইয়ারোগ্লিফিক অব দি এনসিয়েন্ট ইজিপশিয়ানস’ (২য় সংস্করণ, ১৮২৮, পৃষ্ঠা ২৭৬)-এ বাইবেলে উল্লিখিত এই শব্দটির বানান সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন।
এইভাবে বাইবেলের হিব্রু, গ্রীক ও ল্যাটিন সংস্করণে ‘রামেসিস’ নামটি সংরক্ষিত থেকে গিয়েছিল। মজার কথা, বাইবেলের পুরাতন সংস্করণগুলোতে দেখা যায়, ভাষ্যকারবৃন্দ এই শব্দটির অর্থ আদৌও অনুধাবন করতে পারেননি। উদাহরণস্বরূপ, ক্লেমেন্টাইন বাইবেলের ফরাসী সংস্করণে (১৬২১) এই ‘রামেসিস’ শব্দটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে একদম গাঁজাখুরিভাবেই বলা হয়েছে : ‘থাডার অব দি ভারমিন’ অর্থাৎ কিনা এক ধরনের স্তন্যপায়ী হিংস্র জন্তুর গর্জন। (কিনা আশ্চর্য!)
যাহোক, পরবর্তিতে লিখিত বিষয়গুলো সাব্যস্ত করার জন্য উপরের আলোচনাই যথেষ্ট :
(ক) (মিসরের দ্বিতীয় অধিপতি) রামেসিসের সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে ইহুদীদের মিসরত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না।
(খ) হযরত মুসা এমন এক ফেরাউনের আমলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন–যিনি রামেসিস ও পিথম নগরী নির্মাণ করেন। তিনিই হচ্ছেন দ্বিতীয় রামেসিস।
(গ) হযরত মুসার মাদিয়ানে অবস্থানকালে ক্ষমতাসীন ফেরাউনের অর্থাৎ দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যু ঘটে এবং হযরত মুসার জীবনের পরবর্তী ঘটনাবলী সংঘটিত হয় দ্বিতীয় রামেসিসের উত্তরাধিকারী মারনেপতাহহর রাজত্বকালে।
এছাড়াও, বাইবেলে আরো গুরুত্বপূর্ণ এমনকিছু তথ্য রয়েছে, যেসব তথ্যের আলোকে ইহুদীদের মিসরত্যাগের সময় মিসরে ক্ষমতাসীন ফেরাউনের সহজেই সনাক্ত করা সম্ভব। বাইবেলে বলা হয়েছে, হযরত মুসার বয়স যখন ৮০ বছর, তখন তিনি আল্লাহর নির্দেশক্রমে ফেরাউনের কবল থেকে ইহুদীদের মুক্তির প্রচেষ্টা চালান : “ফেরাউনের সহিত আলাপ করার সময় মোশির আশি ও হারুনের তিরাশি বৎসর বয়স হইয়াছিল” (যাত্রাপুস্তক ৭, ৭)। বাইবেলের অন্যত্র (যাত্রাপুস্তক ২, ২৩) বলা হয়েছে, হযরত মুসার জন্মকালে যে ফেরাউন মিসরে রাজত্ব করতেন, হযরত মুসা মাদিয়ানে থাকাকালে সেই ফেরাউনের মৃত্যু হয়। অবশ্য, এরপরেও বাইবেলের বর্ণনার ধারা অব্যাহত থেকেছে এবং মিসর অধিপতি পরিবর্তনের কোনো কথা সেখানে উল্লেখ নেই। এভাবে, হযরত মুসার মিসরে বসবাসের সময় এই দুই ফেরাউনের রাজত্বকাল যে কমপক্ষে আশি বছর হবেই, বাইবেলের বর্ণনা থেকে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
জানা যায়, দ্বিতীয় রামেসিস ৬৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন। (ড্রাইটন ও ভ্যান্ডিয়ারের নোলজি অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০১–১২৩৫; এবং রাওটনের অভিমত অনুসারে খ্রিস্টপূর্ব ১২৯০-১২২৪। তার উত্তরাধিকারী মারপেতাহ কতদিন রাজত্ব করেছিলেন এতুদবিষয়ে মিসরতত্ত্ববিদগণ নির্দিষ্ট কোনো হিসেব দিতে পারছেন না। তবে, তাঁর রাজত্ব যে কমপক্ষে দশ বছরকাল স্থায়ী হয়েছিল। তা নিশ্চিত বলা চলে। কেননা, ফাদার ডি ভক্স তাঁর গবেষণায় যে দলিলের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, সেখানে তাঁর রাজত্বের দশম বছরের কথা উল্লেখ রয়েছে। মারনেপতাহর রাজত্বকাল সম্পর্কে ড্রাইটন ও ভ্যান্ডিয়ার দুটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন : হয় তাঁর রাজত্বকাল ছিল দশ বছর (খ্রিস্টপূর্ব ১২৩৪–১২২৪) নতুবা বিশ বছর (খ্রিস্টপূর্ব ১২২৪–১২০৪)। মারনেপতাহ কিভাবে মারা যান, সে বিষয়েও মিসরতত্ত্ববিদগণ সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই বলছেন না। তারা শুধু জানাচ্ছেন, তাঁর মৃত্যুর পর গোটা মিসরে অভ্যন্তরীণ তীব্র গোলযোগ দেখা দেয় এবং তা প্রায় ২৫ বছরকাল স্থায়ী হয়।
প্রকৃতপক্ষে, মারনেপতাহর রাজত্বকাল সম্পর্কে দিনপঞ্জির ওই হিসেব কতটা সঠিক, বলা মুশকিল। তবে বাইবেলের বর্ণনামতে প্রাপ্ত এই সময়টাতে অর্থাৎ উক্ত আশি বছরের মুদ্দতে দ্বিতীয় রামেসিস ও মারনেপতাহ ছাড়া তৃতীয় নতুন কোনো রাজার সন্ধান পাওয়া যায় না। এই হিসেব মোতাবেক ইহুদীদের মিসরত্যাগের সময় হযরত মুসার বয়স কত ছিল, তা জানতে হলে সবার আগে জানা দরকার দ্বিতীয় রামেসিস ও মারনেপতাহ মোট কত বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন। এক্ষেত্রে প্রথম সেথোস ও দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্বকাল একুনে আশি বছর গণনা করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কেননা, সেখোসের রাজত্বকাল ছিল স্বল্পস্থায়ী। হযরত মুসার মাদিয়ানে গমন, যৌবনপ্রাপ্তি এবং সেখানে তাঁর আশি বছর অবস্থানের সাথে সেই স্বল্পমেয়াদের কোনো মিল নেই। পক্ষান্তরে, হযরত মুসার সময়কালে মাত্র দু’জন ফেরাউনকেই পাচ্ছি। মূলত, এখানে যে থিওরি তুলে ধরা হল, তার সাথে হুবহু মিল রয়েছে কোরআনের বর্ণনার। বাইবেলের একটিমাত্র বর্ণনার সাথে এই থিওরির বিরোধ পরিলক্ষিত হয়–আর তা হল রাজাবলি–১-এর ৬, ১ অধ্যায়ের বর্ণনা উল্লেখ্য যে, এই পুস্তকটি বাইবেলের পুরাতন নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হলেও তাওরাত খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত নয়। এই পুস্তকখানি নিয়ে বিতর্ক কম নয়; এবং ফাদার ডি ভক্স বাইবেলের পুরাতন নিয়মের এই অধ্যায়ে উল্লিখিত সময়ের হিসেবে একদম নাকচ করে দিতে দ্বিধা করেননি। উল্লেখ্য, এই অধ্যায়ে হায়কলে সোলায়মানী নির্মাণের সাথে সময়ের হিসেব গণনা করে ইহুদীদের মিসরত্যাগের সময়কাল বলে দেয়া হয়েছে। অথচ, এই হিসেব মোটেও সঠিক নয়। সুতরাং, ভুল এই বর্ণনার সন্দেহযুক্ত এই হিসেবের বরাত টেনে ড. মরিস বুকাইলি যে থিওরি তুলে ধরেছেন, তা নাকচ করা অসম্ভব বলেই তার ধারণা।