দেখি ঢালু পথটা হঠাৎ ডান দিকে বেঁকে শেষ হয়ে গেছে। সামনে একটা দরজা, ঠেলা দিতেই সেটা গেল খুলে। ভেতরে ঢুকে হাতড়ে হাতড়ে প্রকাণ্ড হুড়কোটাকে লাগিয়ে দিলাম। ব্যস্।
কোথা থেকে যেন অল্প একটু আলোও আসছে, মনে হল হাতের কাছে প্রকাণ্ড এক বাক্সের ওপর দেশলাই আর মোমবাতি।
দেখলাম আলাদিনের সেই গুহায় এসে পড়েছি। ছাদ থেকে ঝুলছে বিশাল বিশাল গালচে। দেওয়ালের সামনে সারি দিয়ে রয়েছে পেতল-কাঁসার বাসন আর ফুলদানির পাহাড়। ঘরের মাঝখানটা কাঠ-খোদাইয়ের টেবিল, হারমোনিয়াম আর বাক্স-প্যাটরা দিয়ে বোঝাই করা।
দুটো-একটা বাক্সের ঢাকনা খুলে আমি তো থ। কোনোটা-বা রেশমি শাড়িতে ভরতি, কোনোটাতে হাতঘড়ি, রুপোর বাসন, ফাউন্টেন-পেনের গাদা। আর একটাতে, বিশ্বাস করবে না হয়তো, সোনার গয়নায় ঠাসা।
কী যে করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শ্যামাদাসকাকা সামান্য একটা মুক্তোর মালা পেয়েই আহ্লাদে আটখানা হচ্ছিল, আর আমার দেখো কত জিনিস। তা ছাড়া একটা মুক্তোর মালা।
মালাটাকে পকেট থেকে বের করে বড়ো বাক্সটার ওপর রাখলাম।
এখন মুশকিল হচ্ছে এই এতগুলো জিনিস যে পেলাম, এগুলোকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় কী করে?
একটা হারমোনিয়াম একটু বাজিয়ে দেখলাম, দিব্যি প্যাঁ-প্যাঁ করে উঠল। বন্ধ ঘরে দারুণ জোরে বাজছে মনে হল। ভাবছিলাম সেবার বিরিঞ্চিদার হারমোনিয়ামে একটু সামান্য জল ফেলেছিলাম বলে আমাকে কী না বলেছিল। এখন আমার নিজেরই চারটে আস্ত আর একটা ভাঙা হারমোনিয়াম।
কিন্তু কতক্ষণ আর এইসব ভেবে আনন্দ করা যায়? খিদেয় পেট তো এদিকে ঢাক।
দেওয়ালে সব চমৎকার ছবি ঝুলোনো। একটাতে দেখলাম একজন বুড়ি মেম মাছভাজা খাবে, তাই হাত জোড় করে কাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে, আর একটা বেড়ালও মাছভাজা খাবার জন্য আঁকুপাঁকু করছে।
আরেকটাতে দেখলাম হয়তো ওই বেড়ালটাই হবে, মুখে করে একটা বিরাট চিংড়ি মাছ নিয়ে যাচ্ছে। মুখের এক দিকে চিংড়ি মাছের মুণ্ডু আর অন্য দিক দিয়ে ল্যাজ বেরিয়ে রয়েছে। আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি এ ভাবা যায় না।
আর টিকতে না পেরে, দড়াম করে দরজাটাকে খুলেই দিলাম।
কাষ্ঠ হেসে দাড়িওয়ালা বুড়োটা ভেতরে ঢুকল। কোমরে হাত দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখতে লাগল। আমার গা শিরশির করে উঠল। বললাম, আর দেরি করছ কেন? সাহস থাকে তো আমাকে মেরে ফেলো-না। আমার গলা কেটে ফেলো, গুলি করো, বুকে ছোরা বসাও, ফাঁসি দাও। আমি আর কিছুকে ভয় করি না। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।
বুড়ো বলল, সেকথা বললেই হয়।
বলে সামনের একটা বাক্স থেকে কতকগুলো কাপড়-চোপড় বের করে ফেলে, তলা থেকে এক টিন বিস্কুট, এক টিন সার্ডিন মাছ, এক বোতল কমলালেবুর রস আর এক টিন-খোলার যন্ত্র বের করল।
তারপর মুক্তোর মালাটাকে দেখে ভারি খুশি হয়ে, সেটাকে ওই বাক্সে পুরে, ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে আবার বন্ধ করে দিয়ে, আমার কাছে ফিরে এল।
তারপর বাক্সের ওপর চেপে বসে মহা ভোজ হল।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে, পকেট থেকে বেজায় একটা ময়লা রুমাল বের করে, মুখ মুছে, বুড়ো সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমার ওসব কিছুরই দরকার করে না। আমি সর্বদা হয় প্যান্টে নয় মাথায় হাত মুছি।
তখন বুড়ো বলল, দেখতে তুমি এত খুদে অথচ চালাক তো কম নও। আমাদের দলে যোগ দেবে? পরে হয়তো দলপতিও হতে পারো।
আমি বললাম, এখন দলপতি কে?
সে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললে, ইয়ে, আপাতত আমিই।
আমি বললাম, তুমি তো বুড়ো। ক-দিনই বা দলপতি থাকবে। তাহলে আরেকটু কমলালেবুর রস খাই?
বেশ ভালোই লাগছিল।
এমন সময় কে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। আমরা দুজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। মোমবাতিটাও ঠিক সেই সময় ছোটো থেকে ছোটো হয়ে গিয়ে শেষ অবধি নিবেই গেল।
নিঃশব্দে আমরা টিন, বোতল, টিন-কাটা সব বাক্সের পিছনে লুকিয়ে ফেলে, চুপচাপ বসে রইলাম।
বুড়োর কানে কানে বললাম, যদি দরজা ভেঙে ঢোকে?
বুড়ো বলল, ইস্, দরজা ভেঙে ঢুকবে। তা হলেই হয়েছিল। এরা নিজেদের পোষা গোরুকে নিজেরা ভয় পায়, তা জান?
আবার কানে কানে বললাম, কিন্তু যদি সঙ্গে পুলিশরা এসে থাকে?
সে বলল, তাই তো দোর খুলছি না।
বাইরে থেকে ওরা মহা ধাক্কাধাক্কি করল, কত কী বলে শাসাল, আগুন লাগিয়ে দেব। বাইরে থেকে তালা দেব। ভূতের ভয় দেখাব। এই সব।
সত্যি বলছি আমার একটু একটু ভয় ভয় করছিল। বুড়ো কিন্তু পা ছড়িয়ে বসে, একটু একটু হাসতে আর দাড়িতে হাত বুলুতে লাগল।
হঠাৎ বুড়ির গলা শোনা গেল।
ভালো চাও তো বেরিয়ে এসো। নইলে এই আমি হাটের মাঝে হাঁড়ি ভাঙলাম। গত বছরের আগের বছরের সেই ছাগলদের কথা জানাজানি হয়ে গেলে তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পাবে না বলে রাখলাম।
তাই শুনে বুড়ো ভারি ব্যস্ত হয়ে, ঘরময় পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। আমাকে বলল, মেয়েদের কখনো বিশ্বাস করতে হয় না। ঠগ, জোচ্চোর, ধাপ্পাবাজ।
বুড়ি বলে যেতে লাগল, সেই যে মাঘ মাসের শেষের দিকে, ভোরে উঠে?
বুড়ো চিৎকার করে বলল, এই চোপ খবরদার।
বলে দরজা খুলে একেবারে বাইরে এসে দাঁড়াল। আমিও কী করি, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে, ওর পেছনে যতটা পারি গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।
বুড়োর বগলের তলা দিয়ে উঁকি মেরে, আশ্চর্য হয়ে দেখলাম পুলিশ-টুলিশ কেউ কোথাও নেই, শুধু বুড়ি এক হাতে একটা খুদে লণ্ঠন, অন্য হাতে একটা খুন্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বুড়ির চালাকি দেখে বুড়ো রেগে কাঁই! পুলিশরা কই?
বুড়ি বললে, সে আমি কি জানি? আমি কি তাদের বটিগাট? তাদের কত কাজ। এখন তারা খানাতল্লাশি করতে করতে, তোমার ঘর অবধি পৌচেছে। দেখে এলাম তোমার বাক্স খুলে তোমার বিড়ি খাচ্ছে আর তোমার খাটে বুটপরা ঠ্যাং তুলে, তোমার ডাইরি পড়ছে। কীসব লিখেছ বানান ভুল।
বুড়ো তো দারুণ রেগে গেল।
–বেশ করেছি বানান ভুল করেছি। তোমার দাদা হই না আমি? তুমি এখানে কেন?
–আহা, আমি তোমার ডাইরি পড়া শুনি, আর তুমি এদিকে আমাদের সকলের চোখে ধুলো দিয়ে, জিনিসপত্রগুলো নিয়ে ভেগে পড় আর কী! উনি আর খোকা আর আমি পথে দাঁড়াই, তোমার তো তাই ইচ্ছে।
তারপর আমার ঠ্যাং দেখতে পেয়ে বললে, বাঃ! এরই মধ্যে সাকরেদও পাকড়ে ফেলেছ দেখছি।
বুড়ো কী যেন বলতে যাচ্ছিল, এমনি সময় শোনা গেল মেলা লোকের জুতোপরা পায়ের মচমচ শব্দ।
অমনি এদের দু-জনারই মুখ একেবারে পাংশুপানা! নিঃশব্দে ঘরের ভেতর আমাকে সুষ্ঠু টেনে নিয়ে, দরজা বন্ধ করে আগল দিয়ে দিল।
কারো মুখে কথাটি নেই, বুক ঢিপঢিপ! বাইরে এবার সত্যি সত্যি মেলা লোকের পায়ের শব্দ শোনা গেল।