1 of 2

০৯. দীপের ঘুম ভাঙল

দীপের ঘুম ভাঙল কানের কাছে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ কথাটা শুনে। তার বিছানা ঘেঁষেই জানালা এবং জানালার পাশেই রাস্তা। এখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। একেই শীতকাল, তার ওপর বাইরে কিছু কুয়াশা থাকতে পারে। শীতকালে ঘরের জানালা বন্ধ থাকে, মাথার জানালাটা কিছু তফাতে বলে ভোলা। কিন্তু কোনওটা দিয়েই আলো বা হাওয়া আসে না তেমন। অতিশয় ঘিঞ্জি গলির মধ্যে এই ঘর। এখান থেকে সব সময়ে মনে হয়, বাইরে মেঘ করে আছে কিংবা সন্ধে হয়ে এল।

ঘুম ভাঙলেই রোজ আঁশটে, কটু একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে। জানালার ধারেই পাড়ার রাজ্যের তরকারির খোসা, মাছের আঁশ, এঁটোকাটা জমা হয়ে থাকে। করপোরেশনের টিনের ঠেলাগাড়ি একটু বেলায় এসে নিয়ে যায়। ততক্ষণ গন্ধটা বেশ তীব্র। তারপরও গন্ধ একটা থাকেই। একতলার ঘর বলে এইসব অস্বস্তি। তবে এখন আর অতটা টের পায় না দীপ। সয়ে গেছে। শুধু এই সকাল বেলায় ঘুম ভাঙলে এখন কয়েকটা শ্বাসে গন্ধ পায়।

দীপনাথ বেশ ভোরেই বিছানা ছাড়ে। আজও গা থেকে কম্বলটা একটু আলসেমিভরে সরিয়ে উঠে পড়ল। কাজ আছে। সাতসকালে রাস্তায় কে কাকে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলল সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু কথাটা শুনে ঘুম ভাঙল বলে দীপনাথের মন থেকে সহজে গেল না সেটা।

কম্বলটা ভাঁজ করে রাখতে গিয়ে দীপনাথের একটু কষ্ট হল মনে। দাদা মল্লিনাথ তাকে এই বিলিতি কম্বলটা দিয়েছিল। ওয়াড় কবে ছিড়ে গেছে, উদ্যোগহীন মল্লিনাথ আর ওয়াড় করায়নি। অযত্নের ব্যবহারে গায়ের ঘষটানিতে রোয়া উঠে ভিতরের বুনোট বেরিয়ে পড়েছে কয়েক জায়গায়, তেলচিটে ময়লা ধরায় সবুজ আর হলুদ চৌখুপিগুলোও আবছা হয়ে এসেছে। আর একটা বা দুটো শীতের পরই ভিখিরি-কম্বল হয়ে যাবে।

কেন কোনও জিনিসেই তার যত্ন নেই? এ কথা ভাবতে ভাবতে দীপনাথ নিজের ওপর বিরক্ত হয়। শিয়ালদার মোড় থেকে কিনে আনা তেতো ও রসাল নিমকাঠি দিয়ে দাঁতন করতে করতে কলঘরে যাওয়ার আগে সে দু’জন চিত ও কাত হয়ে পড়ে থাকা রুমমেটকে দেখে নেয়। একটি নিতান্তই বাচ্চা ছেলে, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। অন্যজন ফুড ডিপার্টমেন্টের মধ্যবয়সি ইন্সপেক্টর। দীপনাথের সঙ্গে কারওরই খুব একটা ভাব নেই। লেপের তলায় দু’জনেই এখন নিথর। ছাত্রটি উঠবে সাতটা নাগাদ, ইন্সপেক্টর আরও পরে। এখন বাজে পৌনে ছ’টা মাত্র।

ভিতরে একটু দরদালান মতো। দরদালানের শেষে একটু চৌখুপি কাটা একধাপ নিচু করে বাঁধানো চৌবাচ্চার চাতাল। জলের চাপ কম বলে সকলেই আজকাল গ্রাউন্ড-লেভেলের নীচে ঢৌবাচ্চা বানায়।

চৌবাচ্চার ধারে অবশ্য যেতে পারল না দীপ। সেখানে ম্যানেজারের বউ তার ছোট ছেলেকে বড়-বাইরে করাতে বসেছে। দীপ সুতরাং দরজায় দাঁড়িয়ে দাতন চিবোতে থাকে। ম্যানেজারের বউয়ের মুখখানা কোনওদিনই দেখেনি দীপ। বউটি লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকে। কিন্তু আন্দাজ করা যায় বউটি তরুণী এবং দেখতে ভালই। গায়ের রং বেশ ফর্সা। তবে এর মতো নিষ্ঠুর প্রকৃতির মহিলাও হয় না। দু’ঘরের মাত্র ছ’জনকে নিয়ে এই ছোট্ট বোর্ডিং-এর লোকদের ম্যানেজার এমনিতেই যাচ্ছেতাই খাবার দেয়, তার ওপর এই বউটি ইচ্ছে করেই এত খারাপ রাধে যে মুখে দেওয়া যায় না। ফলে কেউই পুরোপেট খেতে পারে না। প্রতিদিনই থাকে রসুন দেওয়া শাক, কলাইয়ের ডাল আর তেলাপিয়া মাছের একটি গাদার টুকরো। দীপনাথ খাওয়ার সময় প্রতিদিনই বমি-বমি ভাব টের পায়। এ দিয়েও হয়তো খাওয়া যেত কিন্তু এই বউটি তা হতে দেয় না। কলাইয়ের ডাল ফোড়ন ছাড়া বেঁধে দেয়, যা খাওয়া সম্ভবই নয়। সর্ষেবাটা আর গুঁড়োমশলা দিয়ে রাঁধা মাছটিও গলা দিয়ে নামানো শক্ত। দীপনাথ প্রায়দিনই বাইরে খেয়ে নেয়। বউটির ঘোমটার আবরু আছে বটে কিন্তু মানবিক লজ্জাবোধটুকু নেই।

দীপনাথ দাঁতন করতে করতে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কঠোর দৃষ্টিতে বউটিকে দেখছিল। সে যে অপেক্ষা করছে তা টের পেয়েছে। একবার মুখ ঘুরিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে চকিতে দেখে নিল তাকে, তারপর ন্যাংটো এবং ভেজা ছেলেটাকে দুহাতে আলগা করে শূন্যে তুলে হরিণের পায়ে। পালাল।

প্রাতঃকৃত্যের পর, রুমমেটরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই দীপনাথ তার ব্যায়াম সেরে নেয়। নিজেকে ফিট রাখতে হলে এটুকু অবশ্যই দরকার। গোটা ষাটেক বৈঠক আর ত্রিশটা বুকডন, কয়েকটা যোগাসন এবং বুলওয়ার্কার নিয়ে একটু পেশি খেলানো। চল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা যায়। তা যাক। দীপনাথ জানে, শরীরকে সক্ষম রাখতে গেলে ব্যায়াম ছাড়া পথ নেই। বসিয়ে রাখলেই শরীরে ঘুণ ধরে, আজ গ্যাস অম্বল, কাল রক্তচাপ, হার্টের ব্যামো দেখা দেবেই। শরীরের যত্ন নিতে দীপনাথ ঠেকে শিখেছে। এর আগে মেস বোর্ডিং-এ বার দুয়েক সে শক্ত টাইফয়েড আর হাইপার-অ্যাসিডিটিতে ভুগে বিছানা নিয়েছিল। ফলে শৌখিন শরীর হলে তার চলবে না। দুর্ভাগ্যবশত তার আপনজন বলতে কেউই নেই। দাদা, ভাই বা বোন আছে বটে কিন্তু তাদের সঙ্গে একসাথে বেড়ে ওঠেনি বলে সম্পর্ক তেমন গাঢ় হয়নি। ফলে অসুখ বা বিপদ ঘটলে ভাই-বোনদের কাছে ধরনা দিতে তার লজ্জা করে। নিজের দায়িত্ব তার একেবারেই নিজের। অসুখ হয়ে পড়ে থাকা তার পোষায় না।

ব্যায়ামের পর কাচের গেলাসে ভেজানো কাবলি ছোলা খেয়ে স্টেটসম্যানটা খুলে বসে দীপ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে এবং আড়চোখে ঘড়ি দেখে। অফিস টাইমের আগেই বোসের ফাইবার গ্লাসের সুটকেসটা সারাতে চাদনি চক যেতে হবে। সুটকেস সারিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাবে। অফিসে তার বাঁধাধরা কাজ নেই। গেলেই হয়। আসলে সে বোস সাহেবের চব্বিশ ঘণ্টার চাকর।

পৃথিবীর খবর খুব ভাল নয়। খবরের কাগজওলারা সেই নিরানন্দ ছবিই তুলে ধরে বারবার। এনার্জি ক্রাইসিস, ইনফ্লেশন, পৃথিবী জুড়ে উগ্রপন্থীদের উৎপাত, দুর্ঘটনা। খবরের কাগজ ভাজ করে রেখে দীপ উঠে পোশাক পরে নেয়। চৌকির তলা থেকে সুটকেসটা বের করে টেনে। ওজনে হালকা হলেও বেশ বড়সড় জিনিস। বাসে-ট্রামে নেওয়া কষ্টকর। বোস এটার জন্য ট্যাক্সির ভাড়া দেয়নি।

কৌতূহলবশে সুটকেসটা খুলল দীপ। ভিতরটা ভেলভেটের মতো নরম কাপড় দিয়ে ঢাকা, গভীর বেগুনি তার রং, অনেকগুলো পকেট রয়েছে নানা মাপের। দীপনাথ লোভী নয়, চোর নয়। তবু তার আঙুল প্রতিটি পকেটের ভিতর খুঁজতে লাগল। কী খুঁজছে তা সে জানে না। একেবারে সামনের দিকে লম্বা পকেটটাতে তার আঙুল একটুকরো কাগজ চিমটি দিয়ে তুলে আনল।

একটু অবাক হয়ে দীপনাথ দেখে মিসেস বোসের সই করা একটা বেয়ারার চেক। টাকার অঙ্ক লেখা আছে আড়াই হাজার। কে একজন স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির নামে লেখা হয়েছে। চেকটা অবশ্য ব্যাংক থেকে ফেরত দিয়েছে। লাল কালি দিয়ে আগাগোড়া চেকটাকে আক্রোশভরে কেটে দিয়েছে কেউ। দীপনাথ চেকটা পকেটে রেখে দিল।

সকালের দিকে বোস সাহেবকে তার বাড়িতে রোজ একটা ফোন করার নিয়ম আছে। কোনও কাজ থাকলে বোস সাহেব তা ফোনেই বলে দেন।

আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিস থেকে দীপ ফোন করতেই মিসেস বোসের গলা পাওয়া গেল। গলাটি মিষ্টি বটে, কিন্তু বেশ ঝাঁঝালো।

দীপনাথ সবিনয়ে বলে, আমি দীপ।

বুঝেছি। মিস্টার বোস এইমাত্র বাথরুমে গেলেন।

দীপনাথ আড়চোখে ঘড়ি দেখে। এ সময়ে বোস সাহেবের বাথরুমে যাওয়ার কথা নয়। ঘড়ির কাঁটায় চলা মানুষ। বাথরুমে থাকেন আটটা থেকে সওয়া আটটা। এখন সাড়ে আটটা বাজছে প্রায়।

দীপ মৃদু স্বরে বলে, আজ যেন একটু ইররেগুলার হলেন মিস্টার বোস।

ওপাশে মিসেস বোস থমথমে গলায় বললেন, হ্যাঁ। কয়েকজন ভিজিটর এসে পড়েছিল বলে দেরি। আপনি কি একটু ধরবেন?

দীপনাথ সংকোচের সঙ্গে বলে, আমি ডাকঘর থেকে ফোন করছি। এখানে তো বেশিক্ষণ লাইন আটকে রাখতে দেবে না।

উঃ, আপনার যে কত প্রবলেম দীপনাথবাবু! ঠিক আছে, আপনি না হয় পরে ফোন করবেন।

শুনুন মিসেস বোস, আপনাদের সুটকেসটার মধ্যে একটা জিনিস ছিল।

কী জিনিস? দামি কিছু?

না। স্ক্র্যাপ একটা চেক। স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির নামে দেওয়া আপনার সই করা চেক।

হঠাৎ খুব কঠিন হয়ে গেল মিসেস বোসের কণ্ঠস্বর। বললেন, আপনি সুটকেসটা খুলেছিলেন কেন?

দীপনাথ একটু হাসল আপনমনে। বলল, সারাতে হলে মিস্ত্রিরাও তো খুলবে। তাই আমি আগেভাগে দেখে নিচ্ছিলাম, ভিতরে কিছু রয়ে গেছে কি না।

ও। ঠিক আছে।

চেকটা কী করব?

স্ক্র্যাপ চেক যখন, ফেলে দিন।

বলেই পরমুহূর্তেই মিসেস বোস হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, না, না। শুনুন, চেকটা আপনি নিজে নিয়ে এসে আমাকে দেবেন। প্লিজ, হারিয়ে ফেলবেন না।

আচ্ছা।

ফোন রেখে রাস্তার মোড়ের কাছে স্টার সেলুনে দাড়ি কামিয়ে নিতে বসে নিমীলিত চোখে আয়নায় নিজের সাবানের ফেনায় অর্ধেক ঢাকা মুখের দিকে চেয়ে দীপ ভাবে, মিসেস বোস খুব সাবধানি মেয়ে। চেকটা দীপ নষ্ট করে নাও ফেলতে পারে এবং সেটা দিয়ে কোনওদিন মিসেস বোসকে ব্ল্যাকমেল করতেও পারে, এই ভয়েই না ফেরত চাইল! আজকাল মানুষ মানুষকে একদম বিশ্বাস করে না।

দীপ স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জির একটা কাল্পনিক চেহারা ভাবতে চেষ্টা করল। নামটাই এমন মোলায়েম এবং দেবত্বে ভরা যে, যতবার চোখ বুজল ততবার শিবনে এক জটাধারী পুরুষকে দেখতে পেল। নিশ্চয়ই ওরকম নয় আসল স্নিগ্ধদেব। সম্ভবত পায়জামা পাঞ্জাবি পরা দাড়িওলা, রোগা ও রগচটা এবং ভীষণ পড়াশুনো জানা কোনও উগ্রপন্থী যুবাই হবে। মিসেস বোসের একটা পলিটিক্যাল লাইন আছে, সে জানে। কিন্তু কিছুতেই স্নিগ্ধদেবকে মিসেস বোসের গোপন প্রেমিক বা জার বলে মনে হয় না। কারণ, মিসেস বোস ওরকম নয়। গোপনতার ধারও ধারে না। যা চায় তা মুখ ফুটে চাইতে জানে। দরকার মতো স্বামীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো যথেষ্ট হিম্মত আছে। না, মিসেস বোসের চরিত্রের সঙ্গে গুপ্তপ্রেম ব্যাপারটা একদম খাটে না। তবু কোথাও একটা গোপনীয়তা আছেও। নইলে শেষ মুহূর্তে চেকটা অত আকুলভাবে ফেরত চাইত না।

দীপ যখন চাঁদনি চওকে পৌঁছোল তখন বেলা সাড়ে ন’টা। নানু মিয়ার দোকানে সুটকেসটা জমা করে বেরোল আবার ফোন করতে। মিস্টার বোস এতক্ষণে অফিসে এসে গেছেন।

ফোন ধরেই মিস্টার বোস বলেন, আজ শনিবার খেয়াল আছে তো?

হ্যাঁ।

আপনি বেলা একটার মধ্যে রেসের মাঠে পৌঁছে যাবেন। আজ অফিসে আসার দরকার নেই। আর শুনুন মিসেস বোস নিউ মার্কেটে গেছেন। যদি অসুবিধে না হয় তা হলে গো দেয়ার অ্যান্ড ট্রাই টু বি সাম হেলপ টু হার।

আচ্ছা।–বলতে গিয়ে দীপ অনুভব করে একটা অদ্ভুত আনন্দে তার গলাটা হঠাৎ কাঁপছে।

বোস ফোনেই একটু শ্লেষের হাসি হেসে বলেন, বেটার ট্রাই টু রেসট্রেন হার ফ্রম বায়িং থিংস। ও কে?

ও কে।

বোস ফোন রেখে দেন।

চাঁদনি চক থেকে নিউ মার্কেটে লম্বা পায়ে এক লহমায় পৌঁছে যায় দীপ। কিন্তু ভারী হতাশ হয়ে দেখে, নিউ মার্কেটে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। লোডশেডিং-এর মধ্যে টিমটিমে মোম জ্বলছে মাত্র। এই আলোয় কাউকে চিনে বের করা খুবই মুশকিল।

দীপ পরিস্থিতিটা একটু ধীর স্থিরভাবে বুঝে নিল। নিউ মার্কেটের গোলকধাঁধায় কীভাবে, কোন প্ল্যানমাফিক এগোলে মিসেস বোসকে খুঁজে বের করা অসম্ভব হবে না সেই স্ট্র্যাটেজিটা ঠিক করে শিকারি বেড়ালের মতো লঘু সতর্ক পায়ে এগোতে লাগল।

দীপের ভিতরে যে আর-একটা দুর্মুখ, দুর্বাসা টাইপের দীপ বাস করে সে ঠিক এই সময়ে প্রশ্ন করল, মিসেস বোসকে খুঁজে বের করার পিছনে তোমার আসল স্বার্থটা কী বলো তো বাপ! নিছক ডিউটি না অন্য কিছু?

দীপ ধমক দিয়ে বলে, চোপ শালা! ওসব বললে মুখ ভেঙে দেব। জানো না, আমি চব্বিশ ঘণ্টার চাকর! ডিউটি করছি।

ডিউটি? না কি রথ দেখা আর কলা বেচা। ভাঁড়িয়ে না বাপ, সব বুঝি। এই ঘুটঘুটে লোডশেডিং-এ খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার যে জোস দেখছি তোমার, তার পিছনে কেবল ডিউটি আছে বললে ঘোড়ায় পর্যন্ত হাসবে।

দূর গাড়ল। মিসেস বোসকে নিয়ে ভেবে ফালতু লাভ কী? একে বড়লোকের বউ, তার ওপর চাবুকের মতো তেজি মেয়ে। আমার মতো ম্যান্তামারাকে পাত্তা দেবে নাকি? স্বপ্নের পোলাও আমি খাই না হে।

রাখো রাখো! মেয়েছেলে ইজ মেয়েছেলে। সে যেমনই হোক, আর যারই বউ হোক। পুরুষের আবার অত কাণ্ডজ্ঞান থাকে নাকি? যার থাকে তার থাকে, কিন্তু তোমার অন্তত নেই।

আমার মন অত নরম নয়। এই তো দেখলে সেদিন দশ-বারো বছরের পুরনো সিগারেটের নেশা, কেমন ছেড়ে দিলাম। ভিতরের ইস্পাতে একটুও মরচে পড়েনি।

যত যা-ই বলল, আমার খুব ভাল ঠেকছে না। মেয়েছেলেটাও ইদানীং তোমাকে একটু একটু নজর করছে। চাকরির কথা ভেবে সাবধান থেকো। গ্যাড়াকলে পড়ে গেলে বোস তোমাকে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে।

আরে না না। বলতে বলতে দীপ আবছায়ায় একটা মুঠো গয়নার দোকানের সামনে মিসেস বোসের মতো একজনকে দেখতে পেয়ে খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রায় ঘাড়ে শ্বাস ফেলে বলল, মিসেস বোস?

মহিলা মুখ ফেরালেন।

দীপ বলল, সরি।

গলির পর গলি খুঁজে যাচ্ছে দীপা পাচ্ছে না।

তার ভিতরকার দুর্বাসাটা অক্রূর-সংবাদ দিল, লোডশেডিং বলে কেটে পড়েনি তো? খামোখা নাকাল হোচ্ছ খুঁজে খুঁজে।

উহু! দীপ মাথা নেড়ে ভাবে, অন্ধকারে ভয় খাওয়ার মেয়ে নয়।

মার্কেটের মাঝমধ্যিখানে গোল চত্বরটায় দাঁড়িয়ে দীপ চারদিকে গলির মুখের দিকে চিন্তিত চোখে ঢায়। স্ট্র্যাটেজি ভাবে।

ভিতরকার দীপ খুব হাসে, মিসেস বোসকে খোঁজার জন্য যে পরিমাণে হামলে পড়েছ তাতে মনে হচ্ছে না পেলে হার্টফেল করবে। তবে আমি তোমাকে বরং একটা টিপস দিই বুন্ধুরাম। বাইরে গিয়ে কার-পার্কটা খোঁজো। যদি বোসের অফিসের গাড়িটা দেখতে পাও তবে সেখানে একদম স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের নাড়িটা বরং দেখো।

দীপ লম্বা পায়ে দক্ষিণের ফটকের দিকে এগোল। তড়িঘড়িতে কোনওদিকে নজর করছিল না। কিন্তু ভাগ্য সহায়। আচমকাই একটা হ্যাজাকের আলোয় সামনের দোকান থেকে হাতে মস্ত বেতের বাস্কেট ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন মিসেস বোস। পরনে জিনস আর কামিজ।

দীপের বুকের মধ্যে একটা ব্যাং হঠাৎ তার স্থবিরতা ঝেড়ে ফেলে মস্ত এক লাফ মারল।

মিসেস বোস!–দীপের গলা কাঁপছে।

আরে! আপনি এখানে?

আপনার খোঁজেই।

মিসেস বোসের হাত থেকে বাস্কেটটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় দীপ। উনি বাস্কেটটা সরিয়ে নিয়ে বলেন, আই নিড নো হেলপ। আমার খোঁজে আপনাকে কে পাঠাল? মিস্টার বোস নাকি?

আর কে!–দীপ যতদূর সম্ভব অধস্তনের মতো বিনয়ী হেসে বলে।

অন্ধকারটা দীপের চোখে সয়ে গেছে। হ্যাজাকের আলোটাও বেশি চোখ ধাঁধাচ্ছে না। কাজেই আলো-অন্ধকারের সমস্যায় দীপ আর পীড়িত নয়। মিসেস বোসের ভ্রু-র ভাঁজ স্পষ্টই দেখতে পেল সে। এবং ভয় পেল।

তবে ভ্রু কুঁচকেও মিসেস বোস হেসে ফেললেন। বললেন, এটা স্পাইং নয় তো! ফিনানসিয়াল অফেনস ধরার জন্য মিস্টার বোস হয়তো আপনাকে লাগিয়েছেন।

না, না। আমি জাস্ট হেলপ করতে এসেছি।

মিসেস বোস মাথা নেড়ে বলেন, আমার হেলপ দরকার নেই। আমি ওয়ার্কিং উয়োম্যান। নিজেকে আমি শ্রমিক বলে মনে করি।

দীপ বলল, তা হলে মিস্টার বোসকে সেই কথাই বলব তো? আপনি আমার সাহায্য নেননি।

যা খুশি বলবেন। সেটা আপনার ভাববার কথা।

মিসেস বোস চোখে পরকলাটা পরেননি। পরলে ভাল হত। বাগডোগরার পর থেকে মিসেস বোস সম্পর্কে খুব সচেতন হয়ে পড়েছে দীপ। এতকাল তেমন লক্ষ করেনি, কারণ মিসেস বোসও লক্ষ করেননি তাকে। এখন দীপ টের পায়, মিসেস বোসের চোখে একটা অত্যন্ত শানিত এবং সৌজন্যহীন কঠিন দৃষ্টি রয়েছে। ইচ্ছে করলে উনি খুবই অভদ্র হতে পারেন।

দীপ একটু নিভে যায় মনে মনে। ম্লান মুখে বলে, শ্রমিক তো আমিও।

মিসেস বোস হাতের বাস্কেটটা দোলাতে দোলাতে দক্ষিণের ফটকের দিকে হাঁটছিলেন। পিছনে পিছনে বশংবদের মতো দীপ। মিসেস বোস মাথা ঝাঁকিয়ে বব চুলের ঝাপটা মেরে বললেন, কক্ষনও আপনি শ্রমিক নন। খাঁটি শ্রমিক হলে আপনাকে শ্রদ্ধা করতাম। আপনি হলেন মিস্টার বোসের কোর্ট জেস্টার, যাকে পারিষদ বলে।

রাগ অভিমান ইত্যাদি বহুকাল হল দীপের নেই। তার আদ্যন্ত চিন্তা হল টিকে থাকার। নানা ঘষটানিতে তার অনেক ফালতু জিনিস ভোতা হয়ে গেছে। কাজেই এ কথায় সে অপমান বোধ করল না! বলল, কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার পজিশনে না থাকলে আমার প্রবলেমটাও বোঝ যাবে না মিসেস বোস।

মিসেস বোস ঘাড় ফিরিয়ে দীপের দিকে তীক্ষ নজরে এক ঝলক তাকালেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, যদি আমাকে নিতান্তই সম্বােধন করতে হয় তবে দয়া করে আমার নাম ধরে ডাকবেন। আমার নাম মণিদীপা। নিজেকে আমি মিসেস বোস বলে ভাবতে ভালবাসি না। আমাকে যারা চেনে তারা সবাই মণিদীপা বলে ডাকে। মিসেস বোস বলে নয়।

দীপ একটু থমকায়। তারপর আস্তে করে বলে, আমার পক্ষে সেটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কি? মিস্টার বোসই বা কী ভাববেন?

মণিদীপা কঠিন স্বরেই বলেন, আপনি শ্রমিক নন, স্লেভ। বন্ডেড লেবারার। শ্রমিকদের আত্মমর্যাদা আপনার চেয়ে হাজার গুণ বেশি। তবু আপনাকে বলে দিচ্ছি, যদি মণিদীপা বলে ডাকতে পারেন তবেই ডাকবেন। নইলে সম্বােধন করার দরকার নেই।

অন্ধকার থেকে বাইরের উজ্জ্বল রোদে এলে মণিদীপার চেহারাটা যেন আরও ক্ষুরধার হয়ে ওঠে। পরনে রং-চটা নীল জিনস, গায়ে একটা হলদেটে খাটো টি-শার্ট, বাঁ হাতে গালা দিয়ে তৈরি মোটা একটা বালা, ডান হাতে ঘড়ি। কিন্তু এই নির্মোকের ভিতরে মণিদীপাকে সুন্দর না কুৎসিত দেখাচ্ছে সে বিচার এখন দীপের কাছে বাহুল্য মাত্র। পোশাকের চেয়ে এখন বহুগুণ বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির ব্যক্তিত্ব।

দীপ তার অসফল জীবনের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটির চোখে চোখ রাখারই সাহস পাচ্ছিল না। আড়চোখে দেখে, শ্যামল দিঘল চেহারা ও কমনীয় সুশ্রী মুখের মেয়েটি যেন তার যাবতীয় বাঙালিয়ানা আর মেয়েলিপনা ঝেড়ে ফেলে বেপরোয়া দাঁড়িয়ে আছে। এত নির্ভয় হাবভাব দীপ কোনও মেয়ের মধ্যে দেখেনি।

মার্কেটের চাতালে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে চারদিকে চাইলেন মণিদীপা। কার পার্কে বোস সাহেবের পুরনো মরিস গাড়িটা ধূলিধূসর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপেক রাষ্ট্ররা তেলের দাম বাড়ানোর পর থেকে বোস নিজের গাড়ি আর গ্যারাজ থেকে পারতপক্ষে বের করেন না। অফিসের গাড়িই ব্যবহার করেন। মণিদীপা রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে গাড়ির লক করা দরজা খুললেন।

ভদ্রতাবশে দীপ কাছে গেল। দাঁড়িয়েও রইল। কিন্তু কিছু বলার ছিল না বলে কথা বলল না।

মণিদীপা একরকম কঠিন মুখ করে সামনের দিকে চেয়ে থেকে গাড়ি ছাড়লেন।

আস্তে আস্তে হেঁটে দীপনাথ চাদনির দিকে ফিরে আসে। হঠাৎ খেয়াল হয়, মিসেস বোসকে চেকটা দেওয়া হল না। উনিও চাইলেন না।

ভারী অন্যমনস্ক বোধ করে দীপ। রাস্তাঘাট কিছুই খেয়াল করে না। এক রিমোট কন্ট্রোলে চালিত হয়ে সে বিপজ্জনক রাস্তাঘাট পেরোয় এবং নানু মিয়ার দোকানে এসে কাঠের টুলে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। সুটকেসটা সারাই করতে আরও একটু সময় লাগবে।

দীপ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বুঝতে পারে, মিস্টার বোস তাকে হয়তো খামোখা শুধুমাত্র তার বউকে হেলপ করার জন্য নিউ মার্কেটে পাঠাননি। তাকে দেখে মণিদীপাও খামোখা রেগে যায়নি। এই দুইয়ের মধ্যে তার বোধের অগম্য কোনও যোগসূত্র থাকতে পারে।

ঢাউস সুটকেসটা নিয়ে প্রায় দমসম হয়ে রেসের মাঠে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই দীপ লম্বা দৈত্যের মতো বোস সাহেবের মুখের বিরক্তিটা লক্ষ করে। গেটের কাছেই ধৈর্যহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। দীপের দিকে একবার অবহেলায় চেয়ে দেখে বললেন, ফার্স্ট রেস এখুনি শুরু হবে।

দীপ দুঃখিত মুখে বলে, সারাই করতে অনেক সময় লাগল। বাসেও ভিড় ছিল।

ট্যাক্সি নিলেই তো পারতেন।

খুঁজেছি। পেলাম না।

কথাটা ডাহা মিথ্যে। ট্যাক্সি খুঁজলে হয়তো সত্যিই পাওয়া যেত না। কিন্তু দীপ ট্যাক্সির চেষ্টাই করেনি। কারণ, ট্যাক্সি ভাড়া কে দেবে সেটা স্পষ্ট নয়। এমনকী গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে ঢোকার টিকিটের দামটা নিয়েও সে দুশ্চিন্তা করছে।

বোস হিপ পকেট থেকে আনকোরা নতুন এক বান্ডিল দশ টাকার নোট আর একটা প্যাডের কাগজ বের করে দীপের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, খুব তাড়াতাড়ি করুন। বেটিং কাগজে লেখা আছে, একটু দেখে কাটবেন।

দীপ এ কাজে নতুন নয়। মাথা নাড়ল এবং সুটকেসটা নিয়েই কাউন্টারের দিকে দৌড়োল। লাইনে দাঁড়িয়ে কাগজটা আড়চোখে দেখে নেয় সে। সব কটা রেসেই আলাদা করে উইন আর প্লেস খেলছেন বোস সাহেব। ট্রেবল-টোট আর জ্যাকপটের বাছাই রয়েছে পাঁচটা করে। টাকা থাকলে কী দেদার ওড়ানো যায়!

সরু চ্যানেলে সুটকেসটা নিয়ে ভারী অসুবিধে হচ্ছিল। সামনের ও পিছনের লোকেরা তাকাচ্ছে। বিরক্তও হচ্ছে। কিন্তু দীপের কিছু করার নেই। সে পরিষ্কার বুঝে গেছে, লোকলজ্জা জিনিসটার কোনও মানেই হয় না। তার যা কাজ তা তাকে কারও পরোয়া না রেখেই করে যেতে হবে।

দীপ বোস সাহেবের কাগজ দেখে টিকিট কাটল। তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে নিজের জন্যও একটা উইন কাটল। দু’নম্বর ঘোড়ার নাম মালকা। নামটা পছন্দ হল দীপের। নইলে ঘোড়ার সে কিছুই বোঝে না।

বোস সাহেবের সঙ্গে এখন আর দেখা করার দরকার নেই। একদম রেসের পর দেখা হলেই হবে। তাকে শুধু কাগজ দেখে টিকিট কেটে যেতে হবে।

রেস দেখার জন্য স্ট্যান্ডে গেল না দীপা মজবুত সুটকেসটা এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে তার ওপর বসে একটু দম নিল। এই শীতের দুপুর আর তেমন শীতল নয়। তার বেশ ঘাম হচ্ছে। নিজামে ঢুকে রোল খেয়েছিল সস্তায়, এখন সেই রোলের উদগার উঠল একটা। কিন্তু বস্তুত তার পেটে এখনও যথেষ্ট খিদে আছে। দুপুরে ভাত না খেলে সে কোনওদিনই স্বস্তি বোধ করে না।

প্রথম রেসের ঘোড়াগুলিকে দেখতে পেল না দীপ। ভিড়ের মাথা টপকে জকিদের টুপিগুলিকে ছুটে যেতে দেখল শুধু। প্রচণ্ড চেঁচানিতে কান ঝালাপালা। নিস্তেজ হয়ে বসেই রইল দীপ। শুনতে পেল, কিং আরথার বাজি মেরেছে। সে জেতেনি, বোস সাহেবও নন।

দ্বিতীয় রেসের টিকিট কাটতে গিয়ে নিজের জন্য আবার দু’নম্বরই কাটে দীপ। ঘোড়ার নাম স্পার। স্পার কথাটার মানেই জানে না সে। তবু সেই অচেনা নামের ঘোড়ায় সে তার মহার্ঘ টাকা বাজি রেখে মনে মনে বলল, কোনও ঘোড়াই তো চিরকাল হেরে যায় না। একদিন না একদিন একবার হলেও জেতে।

কিন্তু স্পর জিতল না। তবে বোস সাহেবের উইন লেগে গেল এবার।

তৃতীয় রেসেও দু’নম্বর ঘোড়ায় নিজের বাজি ফেলল দীপ। যা থাকে কপালে, আজ লাগাতার দু’নম্বরেই খেলে যাবে। এবার দুনম্বরের বামটাও সুন্দর। ফ্লোরা। লাইনে তার সামনের লোকটাও বোধহয় ফ্লোরাই কাটবে। কারণ সেই লোকটার সামনে আর-একজন মুখ ফিরিয়ে বলল, ফ্লোরার ওপর ধরছিস! ওর কি আগের দিন আর আছে! ফ্লোরার টাকা অনেক খেয়েছি, কিন্তু আর ও টাকা দেবে না।

কিন্তু তাতে দীপের কিছু যায় আসে না। সেই ফ্লোরাতেই বাজি ধরল। এবং জিতল না। বোস সাহেবের ঘোড়াও আর সে মেলায় না। রেসের পর টাকা নেওয়ার সময়েই দেখবে।

চতুর্থ বাজিতে টিকিট কাটতে গিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ল দীপ। দু’নম্বরের নাম লাকি ডিপ। কিন্তু পাঁচ নম্বরের নাম মণিদীপ। আশ্চর্য! কিন্তু পাঁচ নম্বর না কেটে দীপ করেই বা কী! মণিদীপারা যে ভারী তেজি হয়।

দীপ সুটকেস সামলে চ্যানেল থেকে বেরিয়ে এল। এবং খানিকটা অবাক হয়ে দেখল, একটা চেনা মুখের লোক হাঁ করে তাকে দেখছে। কে লোকটা?

পরমুহূর্তেই ভারী লজ্জা পায় দীপ। এ যে মেজদা শ্রীনাথ। কতকাল দেখা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *