নবম অধ্যায় – দাক্ষায়ণীর ব্রত
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–অনন্তর সতী, শৈশব অতিক্রম করিয়া শোভন যৌবনে পদার্পণ করিলেন। ১
তখন সেই সহজ-সৰ্বাঙ্গসুন্দরীর অঙ্গে রূপরাশি দ্বিগুণ উথলিয়া পড়িল। প্রজাপতি দক্ষ দুহিতাকে প্রারূঢ়-যৌবনা দেখিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, এই কন্যাকে মহাদেবের হস্তে সম্প্রদান করিব কিরূপে? ২
অনন্তর, সতী আপনিও, মহাদেবকে পাইবার আশয়ে, মাতৃ-আদেশে গৃহস্থিত চিত্ৰিত মহাদেবের আরাধনা করিতে লাগিলেন। ৩
আশ্বিন মাসের নন্দকানামী অষ্টমীতে গুড়ৌদন ও লবণদ্বারা মহাদেবের পূজা করিয়া বন্দনা করিতে লাগিলেন, এইরূপে সেইদিন অতিবাহিত করিলেন। ৪
কার্তিক মাসের চতুর্দশীতে বিবিধ পায়স পিষ্টক দ্বারা শিবের আরাধনা করিয়া সেই পরমেশ্বরকে স্মরণ করিতে লাগিলেন। ৫
অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে যবৌদন ও তিল দ্বারা দেবাদি দেবের আরাধনা করিয়া সেইদিন অতিবাহিত করিলেন। ৬
সেই সতী, পৌষমাসের কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীনিশাতে জাগরণাদি করিয়া প্রাতঃকালে কৃসরান্ন (তিল-মুগ-সিদ্ধ ওদন) দ্বারা মহাদেবের পূজা করিলেন। ৭
তিনি মাঘমাসের পূর্ণিমাতে রাত্রিজাগরণ করিয়া নদীতীরে অবসনে শিবপূজা করিলেন। ৮
আর সম্পূর্ণ মাঘমাসে তৎকাল সম্ভুত বিবিধ পুষ্প ফল দ্বারা শিবপূজা-নিরত হইয়া সংযতাহারে থাকিলেন। ৯
ফাল্গুনমাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে রাত্রি জাগরণ করিয়া বিল্বপত্র দ্বারা বিশেষরূপে শিবপূজা করিলেন। ১০
সতী চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের চতুর্দশীতে দিবসে ও রাত্রিতে পলাশ কুসুম দ্বারা শিবপূজা করিলেন এবং শিবকে স্মরণ করত সেই দিবারাত্রি অতিবাহিত করিলেন। ১১
তিনি বৈশাখমাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়াতে যবোদন দ্বারা শিবপূজা করিলেন, সম্পূর্ণ বৈশাখমাস ধৃত ভোজন করিয়া রহিলেন এবং মহাদেবকে স্মরণ করত নিরাহারে সেই দিন যাপন করিলেন। ১২
জ্যৈষ্ঠমাসের পূর্ণিমানিশাতে বসন ও বৃহতী পুষ্প দ্বারা মহাদেবের পূজা করিয়া নিরাহারে সেই রজনী অতিবাহিত করিলেন। ১৩
আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্দশীতে বৃহতীকুসুম দ্বারা মহাদেবের পূজা করিলেন। ১৪
শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী এবং চতুর্দশীতে যজ্ঞোপবীত, বস্ত্র এবং কুশ দ্বারা শিবপূজা করিলেন। ১৫
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীতে নানাবিধ পুষ্প ও ফল দ্বারা শিব পূজা করিয়া পরদিন চতুর্দশীতে জল পান করিয়া থাকিলেন। ১৬
যখন সতী এই ব্ৰতারম্ভ করেন, তখনই সাবিত্র’ সমভিব্যাহারে ব্রহ্মা, লক্ষ্মী সমভিব্যাহারে ভগবান বাসুদেব-যথায় গণপরিবৃত মহাদেব অবস্থিত ছিলেন, সেই হিমালয় প্রস্থে তদীয় সমীপে গমন করিয়াছিলেন। ১৭-১৮
মহেশ্বর, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে সস্ত্রীক সমাগত দেখিয়া যথোচিত সম্ভাষণপূর্বক তাহাদিগের আগমন প্রয়োজন জিজ্ঞাসা করিলেন। ১১
মহাদেব তাহাদিগকে দাম্পত্যপ্রেমে আবদ্ধ দেখিয়া দারপরিগ্রহ করিতে মনে মনে কিঞ্চিৎ অভিলাষ করিলেন। ২০
অনন্তর “তোমাদিগের আগমন প্রয়োজন যথার্থরূপে বল; তোমরা কিজন্য আসিয়াছ? এখানে তোমাদিগের কি প্রয়োজন আছে?” ২১
মহাদেব এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে সৰ্ব্বলোক-পিতামহ ব্রহ্মা বিষ্ণুকর্তৃক প্রণোদিত হইয়া মহাদেবকে বলিলেন;–হে ত্রিলোচন! আমরা যে জন্য আসিয়াছি তাহা শ্রবণ কর; হে বৃষধ্বজ! দেবতাদের জন্য, বিশেষতঃ সৃষ্টি রক্ষার জন্যই আমরা আসিয়াছি। ২২-২৩
শম্ভু! আমি প্রতিবারেই এই জগৎ সৃষ্টি করি, বিষ্ণ, পালন করেন, তুমি সংহার করিয়া থাক। ২৪।
তোমাদিগের উভয়ের সাহায্যে আমি আমার কর্তব্যকাৰ্য করিতে সমর্থ; বিষ্ণ, তোমার ও আমার সাহায্যে পালনকার্য্যে সমর্থ হন; তুমিও আমা দিগের উভয়ের সাহায্য ব্যতীত সংহার করিতে সমর্থ হও না। ২৫
অতএব হে বৃষধ্বজ! আমাদিগের পরস্পরের কাৰ্যে পরস্পরের সাহায্য করা উচিত; নতুবা জগৎ থাকে না। ২৬
কোন কোন অসুর আমার বধ্য হইবে; কোন কোন অসুর। নারায়ণের বধ্য হইবে; কোন কোন অসুর তোমারও বধ্য হইবে। ২৭
কতকগুলি সুরবৈরী তোমার পুত্রের বধ্য; কতকগুলি আমার আত্মজ দিগের বধ্য; কতকগুলি বা মায়ার বধ্য হইবে। ২৮
তুমি সর্বদা যোগরত, বাগদ্বেষাদি-শূন্য ও দয়া-মাত্ৰসার হইলে তোমার। বধ্য অসুরসকলের আর বধ হইবে না। ২৯
হে ঈশ! হে বৃষধ্বজ! অথচ তাহাদিগের বধ না হইলে বারে বারে উপযুক্তমত সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ই হইবে না। ৩০
হে হর! যদি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় না করা গেল, তাহা হইলে আমাদিগের মায়ার শরীর ভেদ হওয়ার আবশ্যকতা নাই। ৩১
আমরা সকলেই এক; কেবল কাৰ্য্যভেদে রূপভেদ হইয়াছে; সেই কাৰ্য্য ভেদই যদি সিদ্ধ না হইল, তাহা হইলে রূপভেদের প্রয়োজন কি? ৩২
আমরা একই; ত্রিবিধ হইয়া বিভিন্নস্বরূপ হইয়াছি। মহেশ্বর। এই সনাতনতত্ত্ব জানিও। ৩৩
মায়াও কাৰ্যভেদে বিভিন্ন রূপ ধারণ করাতে–কমলা, সরস্বতী, সাবিত্রী ও সন্ধ্যা হইয়াছেন। ৩৪
হে মহেশ্বর! নারীই প্রবৃত্তি ও অনুরাগের মূল। স্ত্রীপরিগ্রহের পর, কাম ক্কোধাদির উৎপত্তি হয়। ৩৫
কাম-ক্রোধাদির উৎপত্তি হেতু অনুরাগ উৎপন্ন হইলে, প্রাণিগণ যত্নপূর্বক বৈরাগ্য হেতুকে পরিত্যাগ করে। ৩৬
সঙ্গই, অনুরাগবৃক্ষের মহৎ ও প্রথম ফল। সঙ্গ হইতে কাম কাম হইতে ক্রোধের উৎপত্তি। ৩৭
বৈরাগ্য এবং নিবৃত্তি শোকবশতও হয়, স্বভাববলেও হয়; সংসারপরাধ ব্যক্তির কদাপি সঙ্গ হয় না। ৩৮
তাহা হইলেই, হে মহেশ্বর! তাহার দয়া ও শান্তি উপস্থিত হয়। তখন অহিংসা, ক্ষমা এবং জ্ঞানমার্গের অনুসরণে প্রবৃত্তি হয়। ৩৯
তুমি তপোনিষ্ঠ সঙ্গ-হীন এবং সতত দয়াযুক্ত হইলে তোমার অহিংসা ও সতত শাস্তি হইবে। ৪০
তাহা হইলে তোমার অসুর-বধে প্রযত্ন হইবে কিরূপে?–দারপরিগ্রহ না করিলে যে যে দোষ, তৎসমস্তই তোমাকে বলিলাম। ৪১
অতএব হে জগদীশ্বর! শুধু দেবগণের নহে,-জগতের হিতার্থে, তুমি এক সুশোভনা রমণীর পাণিগ্রহণ কর। ৪২
বিষ্ণর যেমন লক্ষ্মী, আমার যেমন সাবিত্রী সেইরূপ তোমার যিনি সহচরী হইবেন, হে শম্ভু! এখন তুমি তাহার পাণিগ্রহণ কর। ৪৩
মার্কণ্ডেয় বলিলেন;–মহাদেব, ব্ৰহ্মার এই কথা শ্রবণে মুখ তুলিয়া ঈষৎ হাস্য করত নারায়ণ সমীপে তাহাকে বলিতে লাগিলেন। ৪৪।
ঈশ্বর বলিলেন,–ব্ৰহ্মন! জগতের জন্য তুমি যাহা বলিলে তাহা ঠিক বটে, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে ব্ৰহ্মচিন্তাই আমার স্বার্থ। সেই স্বার্থব্যাঘাত-ভয়েই জগতের হিতকর কাৰ্যেও আমার প্রবৃত্তি হইতেছে না। ৪৫
তথাপি আমি যেরূপ জগতের হিতানুষ্ঠান করিতে পারি তাহা বলিতেছি। হে মহাভাগ। আমার উচিত কথা শ্রবণ কর। ৪৬।
যিনি ভাগে ভাগে আমার তেজ গ্রহণে সমর্থ হইবেন, আমার ভার্যা করিবার জন্য তাদৃশ কামরূপিণী যোগিনী রমণী নির্দেশ কর। ৪৭।
আমি যোগমুক্ত হইলে যোগযুক্ত হইবে; আমি কামাসক্ত হইলে মোহিনী হইবে;-হে ব্ৰহ্মন্! এইরূপ বরবণিনী রমণী কে বলিয়া দাও? ৪৮
আমি ভাৰ্য্যা করিতে প্রস্তুত আছি। বেদবিৎ পণ্ডিতগণ যাঁহাকে “অক্ষয়” (অবিনাশী) বলিয়া থাকেন, সেই সনাতন পরম জ্যোতিকে চিন্তা করিব। ৪৯
তদীয় চিন্তায় আসক্ত হইয়া গাঢ় সমাধিস্থ হইব; যে রমণী তাহাতে বিঘ্ন করিবে, সে-ই আমার ভাৰ্য্যা হইতে পারিবে। ৫০
তুমি, আমি বা বিষ্ণু–আমরা সকলেই পরম ব্রহ্মের অংশ; হে মহাভাগ! তাহার চিন্তা করা আমাদিগের উচিত। ৫১
হে কমলাসন! তদীয় চিন্তা ব্যতীত আমি ক্ষণকালও থাকিতে পারি না। অতএব বলিয়া দাও, কে সতত আমার কৰ্ম্মের অনুগামিনী রমণী;–আমি তাহাকে বিবাহ করিতে পারি। ৫২।
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–সৰ্ব্বজগৎপতি ব্রহ্মা মহাদেবের এই কথা শুনিয়া। স্মিতমুখে হৃষ্টচিত্তে এই কথা বলিলেন। ৫৩
ব্রহ্মা বলিলেন,–মহাদেব! তুমি যেরূপ চাহিতেছ, সেরূপ রমণী আছে। ৫৪
সতীনাম্নী শুভাননা দক্ষতনয়া তোমার প্রার্থনানুরূপ রমণী, সেই বুদ্ধি শালিনীই তোমার ভাৰ্য্যা হইবেন। ৫৫
তিনি তোমাকে পাইতে অভিলাষিণী হইয়া তোমার প্রীতি-সাধনোদ্দেশে তপস্থা করিতেছেন জানিও; হে দেবদেবেশ! তুমি সর্বান্তর্যামী-সকলই জানিতেছ। ৫৬
মার্কণ্ডেয় বলিলেন,–অনন্তর ব্রহ্মার বাক্য শেষ হইলে ভগবান মধুসূদন বলিলেন,–ব্ৰহ্মা যাহা বলিলেন, তাহা তুমি কর। ৫৭
শিব “করিব” বলিলে ব্ৰহ্মা-সাবিত্রী ও লক্ষ্মী-নারায়ণ হৃষ্টচিত্তে স্ব স্ব স্থানে গমন করিলেন। ৫৮
শিবের সেই কথা শ্রবণ করিয়া মদন, রতি এবং মদনের বন্ধুবৰ্গ বিশেষ হর্ষযুক্ত হইলেন। অনন্তর মদন, শিব-সমীপে গমনপূর্বক বসন্তকে সতত নিযুক্ত রাখিয়া প্রচ্ছন্নরূপে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ৫৯
নবম অধ্যায় সমাপ্ত ॥ ৯