নবম পরিচ্ছেদ –তৃতীয় পালসাম্রাজ্য
১. বরেন্দ্র-বিদ্রোহ
যে বিদ্রোহের ফলে দ্বিতীয় মহীপালরাজ্য ও প্রাণ হারাইলেন কৈবর্ত্তনায়ক দিব্যের সাহিত তাঁহার কোনো সম্বন্ধ ছিল কি না তাহা নির্ণয় করা কঠিন। রামচরিতের একটি শ্লোকে এরূপ ইঙ্গিত আছে যে দিব্য মহীপালের অধীনে উচ্চরাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। রামচরিতে ইহাও স্পষ্ট উল্লিখিত হইয়াছে যে দিব্য মহীপালকে হত্যা করিয়া বরেন্দ্রভূমি অধিকার করিয়াছিলেন। সুতরাং প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে যে দিব্যি এই বিদ্রোহের সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন ইহা অনুমান করা স্বাভাবিক। কিন্তু দিব্যের সহিত বিদ্রোহীদের কোনো প্রকার যোগাযোগ ছিল এরূপ কোনো কথা রামচরিতে নাই। সুতরাং অসম্ভব নহে যে দিব্য প্রথমে মহীপালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগদান করেন নাই কিন্তু বিদ্রোহীদের হস্তে পরাজয়ের পর মহীপালকে হত্যা করিয়া তিনি বরেন্দ্রী অধিকার করিয়াছিলেন। রামচরিতে দিব্যকে দস্যু ও ‘উপব্ৰিতী’ বলা হইয়াছে টীকাকার উপব্ৰিতীর অর্থ করিয়াছেন ‘ছদ্মব্ৰিতী’। কেহ কেহ ইহা হইতে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে দিব্য কর্তব্যবশে বিদ্রোহী সাজিয়া মহীপালকে হত্যা করিয়াছিলেন। কিন্তু এরূপ অর্থ সঙ্গত মনে হয় না। দস্যু ও উপব্ৰিতী হইতে বরং ইহাই মনে হয় যে রামচরিতকারের মতে দিব্য প্রকৃতই দস্যু ছিলেন, কিন্তু দেশহিতের ভান করিয়া রাজাকে হত্যা করিয়াছিলেন। বস্তুত রামচরিত কাব্যের অন্যত্রও দিব্যের আচরণ কুৎসিত ও নিন্দনীয় বলিয়া ব্যাখ্যাত হইয়াছে। কিছুদিন পর্য্যন্ত বাংলার একদল লোক বিশ্বাস করিতেন যে দিব্য অত্যাচারী মহীপালকে বধ করিয়া দেশরক্ষা করিয়াছিলেন এবং তাঁহার এই মহৎ কার্যের জন্য জনসাধারণ কর্ত্তৃক রাজা নিৰ্বাচিত হইয়াছিলেন। তাঁহারা দিব্যকে মহাপুরুষ সাজাইয়া উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে প্রতি বৎসর “দিব্য-স্মৃতি উৎসবের ব্যবস্থা করিতেন। কিন্তু রামচরিতে ইহার কোনো সমর্থনই পাওয়া যায় না। অবশ্য পালরাজগণের কর্ম্মচারী সন্ধ্যাকরনন্দী দিব্য সম্বন্ধে বিরুদ্ধ ভাব পোষণ করিবেন ইহা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু রামচরিত ব্যতীত দিব্য সম্বন্ধে জানিবার আর কোনো উপায় নাই। সুতরাং রামচরিতকার তাঁহার চরিত্রে যে কলঙ্ক লেপন করিয়াছেন তাহা পুরোপুরি সত্য বলিয়া গ্রহণ না করিলেও দিব্যকে দেশের ত্রাণকর্ত্তা মহাপুরুষ মনে করিবার কোনোই কারণ নাই।
দিব্য নিষ্কণ্টকে বরেন্দ্রের রাজ্য ভোগ করিতে পারেন নাই। পূর্ব্ববঙ্গের বৰ্ম্মবংশীয় রাজা জাতবর্ম্মা তাঁহাকে পরাজিত করিয়াছিলেন; কিন্তু এই বিরোধের হেতু বা বিশেষ কোনো বিবরণ জানা যায় না। রামপাল বরেন্দ্র উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু পারেন নাই-বরং দিব্য রামপালের রাজ্য আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়াছিলেন। যদিও রামচরিতে দিব্যের রাজ্যকালের কোনো ঘটনার উল্লেখ নাই, তথাপি যিনি জাতবর্ম্মা ও রামপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া বরেন্দ্রী রক্ষা করিতে পারিয়াছিলেন তিনি যে বেশ শক্তিশালী রাজা ছিলেন এবং বরেন্দ্রে তাঁহার প্রভুত্ব বেশ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা স্বীকার করিতেই হইবে। দিব্যের মৃত্যুর পর তাঁহার ভ্রাতা রুদোক এবং তৎপরে রুদোকের পুত্র ভীম বরেন্দ্রর সিংহাসনে আরোহণ করেন। রামচরিতে ভীমের প্রশংসাসূচক কয়েকটি শ্লোক আছে এবং তাঁহার রাজ্যের শক্তি ও সমৃদ্ধির বর্ণনা আছে। সুতরাং দিব্য স্বীয় প্রভু ও রাজাকে বধ করিয়া যে মহাপাতক করিয়াছিলেন বরেন্দ্রে একটি শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠাপূৰ্ব্বক তথায় সুখ-শান্তি ফিরাইয়া আনিয়া তাঁহার কতক প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছিলেন। দিনাজপুরের কৈবর্ত্তস্তম্ভ (চিত্র নং ১ক) আজিও রাজবংশের স্মৃতি বহন করিতেছে।
.
২. রামপাল
দ্বিতীয় মহীপাল যখন বিদ্রোহ দমন করিতে অগ্রসর হন তখন তাঁহার দুই কনিষ্ঠ ভ্রাতা শূরপাল ও রামপাল কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। মহীপালের পরাজয় ও মৃত্যুর পর তাঁহারা কিরূপে মুক্তি লাভ করিয়া বরেন্দ্র হইতে পলায়ন করেন রামচরিতে তাঁহার কোনো উল্লেখ নাই। পলায়ন করিবার পর পালরাজ্যের কোনো এক অংশে, সম্ভবত মগধে, শূরপাল রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার রাজ্যকালের কোনো বিবরণই জানা যায় নাই। সম্ভবত তিনি খুব অল্পকালই রাজত্ব করিয়াছিলেন এবং তারপর রামপাল রাজা হন।
রামপাল রাজা হইয়া বরেন্দ্র উদ্ধার করিবার প্রয়াস করিয়াছিলেন কিন্তু বিফল মনোরথ হইয়া বহুদিন নিশ্চেষ্ট ছিলেন। তারপর আবার এক গুরুতর বিপদ উপস্থিত হইলে পুত্র ও অমাত্যগণের সহিত পরামর্শ করিয়া বিপুল উদ্যমে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন। এই গুরুতর বিপদ কী, রামচরিতকার তাঁহার উল্লেখ করেন নাই। সম্ভবত দিব্য কর্ত্তৃক আক্রমণই এই বিপদ এবং রাজ্যের অবশিষ্ট অংশ হারাইবার ভয়েই বিচলিত হইয়া রামপাল পুনরায় দিব্যের প্রতিরোধ করিতে কৃতসংকল্প হইলেন।
দিব্যের বিরুদ্ধে সৈন্য সংগ্রহের জন্য রামপাল সামন্তরাজগণের দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে লাগিলেন। অর্থ ও সম্পত্তির প্রলোভনে অনেকেই তাঁহাকে সাহায্য করিতে স্বীকৃত হইল। এইরূপে বহুদিনের চেষ্টায় রামপাল অবশেষে বিপুল এক সৈন্যদল সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলেন।
রামপালের প্রধান সহায় ছিলেন তাঁহার মাতুল রাষ্ট্রকূটকুলতিলক মথন। ইনি মহন নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি দুই পুত্র মহামাগুলিক কাহুরদেব ও সুবর্ণদেব এবং ভ্রাতৃম্পুত্র মহাপ্রতীহার শিবরাজ প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া আসিলেন। অপর যে সমুদয় সামন্তরাজ রামপালকে সৈন্য দ্বারা সাহায্য করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকজনের নাম রামচরিতে পাওয়া যায়। রামচরিতের টীকায় ইহাদের রাজ্যের নামও দেওয়া আছে কিন্তু তাঁহার অনেকগুলির অবস্থান নির্ণয় করা যায় না।
১। ভীমযশ-ইনি মগধ ও পীঠীর অধিপতি ছিলেন এবং কান্যকুব্জরাজের সৈন্য পরাস্ত করিয়াছিলেন।
২। কোটাটবীর রাজা বীরগুণ।
৩। দণ্ডভুক্তির রাজা জয়সিংহ। দণ্ডভুক্তির মেদিনীপুর জিলায় অবস্থিত ছিল।
৪। দেবগ্রামের রাজা বিক্রমরাজ।
৫। অরণ্য প্রদেশস্থ সামন্তবর্গের চূড়ামণি অপরমারের (হুগলী জিলান্তৰ্গত) অধিপতি লক্ষ্মীশূর।
৬। কুজবটীর (সাঁওতাল পরগণা) রাজা শূরপাল।
৭। তৈলকম্পের (মানভূম) রাজা রুদ্রশিখর।
৮। উচ্ছলের রাজা ভাস্কর অথবা ময়গলসিংহ।
৯। ঢেক্করীরাজ প্রতাহসিংহ।
১০। (বর্ত্তমান রাজমহলের নিকটবর্ত্তী) কয়ঙ্গলমণ্ডলের অধিপতি নরসিংহাৰ্জ্জুন।
১১। সঙ্কট গ্রামের রাজা চণ্ডাৰ্জ্জুন।
১২। নিদ্রাবলীর রাজা বিজয়রাজ।
১৩। কৌশাম্বীর রাজা দ্বোরপবর্দ্ধন। কৌমাঘী সম্ভবত রাজসাহী অথবা বগুড়া জিলায় অবস্থিত ছিল।
১৪। পদুবহুবার রাজা সোম।
এই সমুদয় ব্যতীত আরও অনেক সামন্তরাজ রামপালের সহিত যোগ দিয়াছিলেন-রামচরিতে তাঁহাদের সাধারণভাবে উল্লেখ আছে, নাম দেওয়া নাই। ইহার মধ্যে যে সমুদয় সামন্তরাজ্যের অবস্থিতি মোটামুটি জানা যায় তাঁহার বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে যে প্রধানত মগধ ও রাঢ়দেশের সামন্তগণই রামপালের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছিলেন।
রামপাল সম্ভবত দক্ষিণবঙ্গ হইতে বরেন্দ্র আক্রমণ করেন। সমস্ত সামন্ত রাজগণের সৈন্য একত্রিত করিয়া তিনি প্রথমে মহাপ্রতীহার শিবরাজকে একদল সৈন্যসহ প্রেরণ করেন। এই সৈন্যদল গঙ্গা নদী পার হইয়া বরেন্দ্রভূমি বিধ্বস্ত করে। এইরূপে গঙ্গার অপর তীর সুরক্ষিত করিয়া রামপাল তাঁহার বিপুল সৈন্যদল লইয়া বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করেন। এইবার কৈবৰ্তরাজ ভীম সসৈন্যে রামপালকে বাধা দিলেন এবং দুই দলে ভীষণ যুদ্ধ হইল। রামচরিতে নয়টি শ্লোকে এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে। রামপাল ও ভীম উভয়ই বিশেষ বিক্রম প্রদর্শন করেন এবং পরস্পরের সম্মুখীন হইয়া যুদ্ধ করেন। কিন্তু হস্তীপৃষ্ঠে যুদ্ধ করিতে করিতে দৈববিড়ম্বনায় ভীম বন্দী হইলেন। ইহাতে তাঁহার সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল। যদিও হরি নামক তাঁহার এক সুহৃদ পুনরায় তাঁহার সৈন্যগণকে একত্র করিয়া যুদ্ধ করেন এবং প্রথমে কিছু সফলতাও লাভ করেন, তথাপি পরিশেষে রাজপালেরই জয় হইল। রামপাল ভীমের কঠোর দণ্ড বিধান করিলেন। ভীমকে বধ্যভূমিতে নিয়া প্রথমেই তাঁহার সম্মুখেই তাঁহার পরিজনবর্গকে হত্যা করা হইল। তারপর বহু শরাঘাতে ভীমকেও বধ করা হইল। এইরূপে কৈবৰ্ত্তনায়কের বিদ্রোহ ও ভীমের জীবন অবসান হইল।
বহুদিন পরে রামপাল আবার পিতৃভূমি বরেন্দ্রী ফিরিয়া পাইয়া প্রথমে ইহার শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরাইয়া আনিতে যত্নবান হইলেন। তিনি প্রজার করভার লাঘব এবং কৃষির উন্নতি বিধান করিলেন। তারপর রামাবতী নামক নতুন এক রাজধানী প্রতিষ্ঠা করিলেন। এই রামাবতী নগরী সম্ভবত মালদহের নিকটবর্ত্তী ছিল।
এইরূপে পিতৃভূমি বরেন্দ্ৰীতে স্বীয় শক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া রামপাল নিকটবর্ত্তী রাজ্যসমূহ জয় করিয়া পালসাম্রাজ্যের লুপ্ত গৌরব উদ্ধার করিতে যত্নবান হইলেন।
বিক্রমপুরের বৰ্ম্মরাজ সম্ভবত বিনা যুদ্ধেই রামপালের বশ্যতা স্বীকার করিলেন। রামচরিতে উক্ত হইয়াছে যে পূৰ্ব্বদেশীয় বৰ্ম্মরাজ নিজের পরিত্রাণের জন্য উৎকৃষ্ট হস্তী রথ উপঢৌকন দিয়া রামপালের আরাধনা করিলেন।
কামরূপ যুদ্ধে বিজিত হইয়া অধীনতা স্বীকার করিল। সম্ভবত রামপালের কোনো সামন্ত রাজা এই যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন। তিনি কামরূপ জয় করিয়া ফিরিয়া আসিলে রামপাল তাঁহাকে বহু সম্মানদানে আপ্যায়িত করিলেন।
এইরূপে পূৰ্ব্বদিকের সীমান্ত প্রদেশ জয় করিয়া দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইলেন। রাদেশের সামন্তগণ সকলেই রামপালের অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সাহায্যে রামপাল উড়িষ্যা অধিকার করিলেন। এই সময় উড়িষ্যার রাজনৈতিক অবস্থা বিশেষ শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। দক্ষিণ হইতে গঙ্গারাজগণ পুনঃপুন আক্রমণ করিয়া ইহাকে বিপর্যস্ত করিতেছিলেন। রামপালের সামন্তরাজ দণ্ডভুক্তির অধিপতি জয়সিংহ রামপালের বরেন্দ্র অভিযানে যোগ দিবার পূর্ব্বেই উৎকলরাজ কর্ণকেশরীকে পরাজিত করিয়াছিলেন। গঙ্গারাজগণ উৎকল অধিকার করিলে বাংলা দেশেরসমূহ বিপদ এই আশঙ্কায়ই সম্ভবত রামপাল নিজের মনোনীত একজনকে উৎকলের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। ঠিক অনুরূপ কারণেই অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গ রাজ্যচ্যুত উৎকলরাজকে আশ্রয় দিলেন। এইরূপে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার রক্ষকরূপে উৎকলের অধিকার লইয়া রামপাল ও অনন্তবর্ম্মার মধ্যে বহুদিনব্যাপী যুদ্ধ চালিয়াছিল। রামচরিত অনুসারে রামপাল উত্তাল জয় করিয়া কলিঙ্গদেশ পৰ্য্যন্ত স্বীয় প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। অনন্তবর্ম্মার লিপি হইতে জানা যায় যে ১১৩৫ অব্দের অনতিকাল পূর্ব্বে তিনি উড়িষ্যা জয় করিয়া স্বীয় রাজ্যভুক্ত করেন। সুতরাং রামপালের মৃত্যু পর্য্যন্ত উড়িষ্যায় তাঁহার আধিপত্য ছিল ইহা অনুমান করা যাইতে পারে।
রামচরিতের একটি শ্লোকে একপক্ষে সীতার সৌন্দর্য ও অপরপক্ষে বরেন্দ্রীর সহিত অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক সম্বন্ধ বর্ণিত হইয়াছে। টীকা না থাকায় এই শ্লোকের সমুদয় ইঙ্গিত স্পষ্ট বোঝা যায় না, কিন্তু কয়েকটি সিদ্ধান্ত বেশ যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হয়। প্রথমত রামপাল অঙ্গদেশ জয় করিয়াছিলেন (অবনমদঙ্গা) দ্বিতীয়ত তিনি কর্ণাটরাজগণের লোলুপ দৃষ্টি হইতে বঙ্গদেশকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন (অধরিতকর্ণাটেক্ষণলীলা)। তৃতীয়ত তিনি মধ্যদেশের রাজ্যবিস্তারে বাধা দিয়াছিলেন (ধৃতমধ্যদেশতনিমা)।
অঙ্গ ও মগধ যে রামপালের রাজ্যভুক্ত ছিল শিলালিপি হইতে তাঁহার প্রমাণ পাওয়া যায়। কর্ণাটদেশীয় চালুক্যরাজগণের বাংলা আক্রমণের কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। রামপালের রাজ্যকালে আৰ্য্যাবৰ্তে কৰ্ণাটগণের প্রভুত্ব আরও বিস্তার লাভ করে। কর্ণাটের দুইজন সেনানায়ক পালসাম্রাজ্যের সীমার মধ্যেই দুইটি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমটি রাঢ়দেশের সেনরাজ্য। রামপালের জীবিতকালে ইহা খুব শক্তিশালী ছিল না, এ বিষয়ে পরে আলোচিত হইবে। কিন্তু কর্ণাটবীর নান্যদেব একাদশ শতাব্দের শেষভাগে (আ ১০৯৭) মিথিলায় আর একটি প্রবল স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। মিথিলা প্রথম মহীপালের সময় পালরাজ্যভুক্ত ছিল। নান্যদেবের সহিত গৌড়াধিপের সংঘর্ষ হয়। এই গৌড়াধিপ সম্ভবত রামপাল, কারণ রামপালকে পরাজিত না করিয়া কোনো কর্ণাটবীর মিথিলায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন ইহা সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না। সুতরাং কর্ণাটের লোলুপ দৃষ্টি এ সময় বাংলার বিশেষ আশঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ হইয়াছিল। রামপালের জীবিতকালে নান্য বাংলা জয় করিতে পারেন নাই এবং সেনরাজগণও মাথা তুলিতে পারেন নাই-সম্ভবত রামচরিতকার ইহাই ইঙ্গিত করিয়াছেন। রামপালের মৃত্যুর অনতিকাল পরেই কর্ণাটদেশীয় সেনরাজগণ সমস্ত বাংলা দেশ জয় করেন। সুতরাং রামপাল যে কর্ণাটের লোলুপ দৃষ্টি হইতে বাংলা দেশ রক্ষা করিতে পারিয়াছিলেন ইহা কম কৃতিত্বের কথা নহে।
রামপালের রাজ্যকালে গাহড়বালবংশীয় চন্দ্রদেবের বর্ত্তমান যুক্তপ্রদেশে একটি শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কাশী ও কান্যকুব্জ এই রাজ্যের দুইটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। পালরাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত থাকায় পালরাজগণের সহিত ইহাদের সংঘর্ষ উপস্থিত হইল। গাহড়বালরাজগণের লিপি হইতে জানা যায় যে, ১১০৯ অব্দের পূৰ্ব্বে গাহড়বালরাজ মদনপালের পুত্র গোবিন্দচন্দ্রের সহিত গৌড়রাজের যুদ্ধ হইয়াছিল। এই যুদ্ধে যে গোবিন্দচন্দ্র জয়লাভ করিয়া গৌড়রাজ্যের কোনো অংশ অধিকার করিয়াছিলেন তাঁহার প্রশস্তিকারও এমন কথা বলেন নাই। সুতরাং রামপাল মধ্যদেশের রাজ্যবিস্তার প্রতিরোধ করিতে পারিয়াছিলেন রামচরিতের এই উক্তি বিশ্বাসযোগ্য বলিয়াই মনে হয়। এই প্রসঙ্গে ইহাই উল্লেখযোগ্য যে গোবিন্দচন্দ্রের রাণী কুমারদেবী রামপালের মাতুল মহণের দৌহিত্রী ছিলেন। অসম্ভব নহে যে মহণ এই বৈবাহিক সম্বন্ধ দ্বারা রামপালের সহিত গাহড়বালরাজের মিত্রতা স্থাপন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং কতক পরিমাণে কৃতকাৰ্যও হইয়াছিলেন। মহণ যে কেবল রামপালের মাতুল ছিলেন এবং তাঁহার ঘোর বিপদের দিনে পুত্র ও ভ্রাতুষ্পুত্রসহ তাঁহার সাহায্য করিয়াছিলেন তাহা নহে, উভয়ে অভিন্নহৃদয় সুহৃৎ ছিলেন। বৃদ্ধবয়সে রামপাল মহণের মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া এত শোকাকুল হইলেন যে নিজের প্রাণ বিসর্জন করিতে কৃতসংকল্প হইলেন। মুগগিরি (মুঙ্গের) নগরীতে গঙ্গাগর্ভে প্রবেশপূৰ্ব্বক তিনি এই নশ্বর দেহ ত্যাগ করিয়া স্বর্গে মাতুলের সহিত মিলিত হইলেন। বন্ধুর শোকে এইরূপ আত্মবিসর্জনের দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।
রামপাল ৪২ বৎসরেরও অধিককাল রাজ্য করেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহীপালের রাজ্যকালেই তিনি যৌবনে পদার্পণ করেন, অন্যথা তিনি সিংহাসনের জন্য ষড়যন্ত্র করিতেছেন এরূপ অপবাদ বিশ্বাসযোগ্য হইত না। সুতরাং মৃত্যুকালে তাঁহার অন্ত ত ৭০ বৎসর বয়স হইয়াছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। তিনি সম্ভব ১০৭৭ হইতে ১১২০ অব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন।
রামপালের জীবন ও মৃত্যু উভয়ই বিচিত্র। তাঁহার কাহিনী ইতিহাস অপেক্ষা উপন্যাসের অধিক উপযোগী জীবনের প্রারম্ভে জ্যেষ্ঠভ্রাতার অমূলক সন্দেহের ফলে যখন কারাগারে শৃঙ্খলিত অবস্থায় তিনি নিদারুণ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করিতেছিলেন, তখন অন্তর্বিপ্লবের ফলে বরেন্দ্রে পালরাজ্যের অবসান হইল। সেই ঘোর দুর্যোগের দিনে অসহায় বন্দী রামপাল কিরূপে জীবন রক্ষা করিয়াছিলেন ইতিহাস তাঁহার কোনো সন্ধান রাখে না। তারপর পিতৃরাজ্য হইতে বিতাড়িত হইয়া কোন নিভূত প্রদেশে তিনি দীর্ঘকাল দুঃসহ মনোব্যথায় জীবন যাপন করিয়াছিলেন তাহাও জানা যায় না। যখন বিপদ আরও ঘনীভূত হইয়া উঠিল এবং সম্ভবত তাঁহার শেষ আশ্রয়টুকুও হস্তচ্যুতে হইবার উপক্রম হইল, তখন ধর্ম্মপাল ও দেবপালের উত্তরাধিকারী এবং প্রথম মহীপালের বংশধর ভারতপ্রসিদ্ধ রাজবংশের এই শেষ মুকুটমণি লজ্জা ঘৃণা ভয় ত্যাগ করিয়া অধীনস্থ সামন্ত রাজগণের দ্বারে দ্বারে সাহায্য ভিক্ষা করিয়া ফিরিতে লাগিলেন। তাঁহার উদ্যম ও অধ্যবসায়ে রাজলক্ষ্মী তাঁহার প্রতি প্রসন্না হইলেন। বরেন্দ্র পুনরধিকৃত হইল, বাংলা দেশের সর্বত্র তিনি প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করিলেন এবং কামরূপ ও উৎকল জয় করিলেন। দক্ষিণ দিগ্বিজয় অনন্তবর্ম্মা চোড়গঙ্গ এবং পশ্চিমে চালুক্য ও গাহড়বাল এই তিনটি প্রবল রাজশক্তির বিরুদ্ধে তাঁহাকে সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল। তাঁহার বাহুবলে খণ্ড-বিখণ্ড বাংলা দেশে আবার একতা ও সুদৃঢ় রাজশক্তি ফিরিয়া আসিল, বাঙ্গালী আবার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিল। নিভিবার ঠিক আবেগ প্রদীপ যেমন উজ্জ্বল হইয়া উঠে রামপালের রাজ্যকালে পালরাজ্যের কীৰ্তিশিখাও তেমনি শেষবারের মতো জ্বলিয়া উঠিল। রামপালের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পালবংশের গৌরবরবি চিরদিনের তরে অস্তমিত হইল।