অধ্যায় ৯ — তারুণ্যপূর্ণ সিনিসিজম
পশ্চিম দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটু ঘোরাফেরা করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, আজকের বুদ্ধিমান তরুণেরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সিনিক। রাশিয়া, ভারত, চিন কিংবা জাপানের ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। আমি বিশ্বাস করি চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া এবং পোল্যান্ডেও এমনটা দেখা যাবে না, এবং কোনোক্রমেই জার্মানিতে এটা সার্বজনীন ব্যাপার হতে পারে না। কিন্তু এটা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের বুদ্ধিমান তরুণদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। পশ্চিমের তরুণেরা কেন সিনিক তা বোঝার জন্য আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে প্রাচ্যের তরুণরা কেন সিনিক নয়।
রুশদেশের তরুণরা সিনিক নয়, কারণ তারা সামগ্রিকভাবে কম্যুনিস্ট দর্শন গ্রহণ করে, এবং দেশটি বিরাট ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, বুদ্ধি দ্বারা ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়ে আছে। সুতরাং তরুণরা অনুভব করে তাদের জন্য অর্থপূর্ণ ভবিষ্যৎ অপেক্ষমাণ। ইউটোপিয়া সৃষ্টি করতে গিয়ে আপনি যখন পাইপলাইন বসাচ্ছেন, গড়ছেন রেলপথ কিংবা কৃষককে শিক্ষা দিচ্ছেন একযোগে চার মাইল ক্ষেত্রে ফোর্ডের ট্রাক্টর চালনা তখন আপনাকে জীবনের লক্ষ্যে নিয়ে ভাববার দরকার করবে না। ফলে রুশ যুবকরা সতেজ এবং আন্তরিক বিশ্বাসে আপ্লুত।
ভারতের অকপট যুবকদের মৌলিক বিশ্বাস এই যে, ইংরেজরা দুষ্ট প্রকৃতির এই উদাহরণ থেকে, যেমন দেকার্তরে অস্তিত্ব বিষয়ক দর্শন থেকে, একটা সমগ্র দর্শন দাঁড় করা যায়। ইংরেজরা যেহেতু খ্রিষ্টান, এই তথ্য থেকে ধরে নেয়া হয় যে হিন্দুধর্ম কিংবা ইসলামধর্ম (যখন যেমন) একমাত্র সত্য ধর্ম। ইংল্যান্ড যেহেতু পুঁজিবাদী এবং শিল্পপ্রধান, অতএব সংশ্লিষ্ট তার্কিকের মেজাজ অনুসারে প্রত্যেকে চকরা ঘুরাবে কিংবা দেশীয় শিল্প ও পুঁজিবাদ বিকাশের জন্য সংরক্ষণমূলক কর আরোপ করতে হবে এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিবাদে এসবই হবে প্রধান হাতিয়ার। আর যেহেতু ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখলে রেখেছে সামরিক শক্তির জোরে, অতএব নৈতিক বল একমাত্র শ্রদ্ধেয় ব্যাপার। তাছাড়া ভারতের জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ড নিগ্রহ তাদেরকে বীরের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তাদের অসার বা তুচ্ছ মনে করার জন্য যথেষ্ট নয়। এইভাবে ঈঙ্গ-ভারতীয়রা তাদের বুদ্ধিদীপ্ত যুবকদের সিনিসিজমের অনিষ্টকর প্রভাব থেকে রক্ষা করেন।
চিন দেশে ইংরেজদের প্রতি ঘৃণাও একটা ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু এই ঘৃণার পরিমাণ ভারতের চেয়ে কম, কারণ ইংরেজরা ঐ দেশ কোনো দিন জয় করেনি। চৈনিক যুবকরা দেশপ্রেমের সঙ্গে প্রতীচ্যবাদের প্রতি আন্তরিক আগ্রহ যুক্ত করেন। পঞ্চাশ বছর আগে জাপান এই কাজটিই করেছিল। চৈনিক যুবকরা চান চিনের জনগণ আলোকপ্রাপ্ত হোন, স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী হোন এবং এর ফল লাভের জন্য তাদের কাজকে নির্দিষ্ট রূপ দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে তাদের এই আদর্শ উনিশ শতকের, কিন্তু চিনের জন্য এটা বিগত (প্রাচীন) কালের হয়ে যায়নি। চিনে সিনিসিজম জড়িত ছিল রাজকীয় শাসনযন্ত্রের কর্মচারীদের সঙ্গে, যুদ্ধবাজ সমরনায়কদের মধ্যে এ মনোভাবটা ছিল, যারা ১৯১১ সাল থেকে দেশটিকে বিপথগামী করে। কিন্তু আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের মানসিকতায় সিনিসিজমের স্থান নেই। জাপানের তরুণ বুদ্ধিজীবীদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা ১৮১৫ সাল থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত ইউরোপীয় কন্টিনেন্টের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন্ন নয়। উদারতন্ত্রের নীতিবাক্য এখনও প্রবল: সংসদীয় সরকার, প্রজার স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও বাক-স্বাধীনতা এই সব নিয়ে তোলপাড় চলে। ঐতিহাসিক সামন্তপ্রথা এবং স্বেচ্ছাচারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তরুণদের ব্যস্ত ও উদ্দীপনার ভেতর রাখার জন্য যথেষ্ট।
পশ্চিমের স্বাভাবিক সারল্যচ্যুত যুবকদের কাছে উষ্ণ আবেগ জিনিসটা গ্রাম্য ব্যাপার বলে অনুভূত হয়। তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস এই যে সবকিছু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করে তারা সব কিছু দেখতে পেরেছে এবং লক্ষ্য করেছে যে ভ্রাম্যমাণ চাঁদের নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। অবশ্য পুরাকালীন শিক্ষায় এর পক্ষে বিপুল যুক্তি রয়েছে। আমি মনে করি না যে, এই যুক্তিগুলো সমস্যার গোড়ায় পৌঁছতে পারে। কারণ অন্যান্য পরিস্থিতিতে যুবকরা পুরাকালীন শিক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং নিজেরাই আলাদা সুসমাচার (Gospel) তৈরি করে নেয়। আজকের প্রতীচীর তরুণরা যদি শুধু সিনিসিজম দ্বারা প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে সেই পরিস্থিতির জন্য অবশ্যই বিশেষ কারণ থাকবে। তরুণরা শুধু তাদেরকে যা বলা হয় তাই বিশ্বাস করতে অসমর্থ নয়। তারা সব কিছু বিশ্বাস করতে অসমর্থ। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এর কারণ খোঁজার জন্য তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা প্রথমে কতকগুলো পুরাতন আদর্শ একটা একটা করে আলোচনা করে দেখি তারা কেন পুরাতন আনুগত্যসমূহে প্রেরণা পায় না। ধর্ম, দেশ, প্রগতি, সৌন্দর্য, সত্য, আদর্শ হিসেবে এইগুলোর নাম আমরা করতে পারি। তরুণদের চোখে এগুলোর মধ্যে ভ্রান্তি কোথায়?
ধর্ম-এখানে অসুবিধাটা অংশত পাণ্ডিত্য সংক্রান্ত, অংশত সামাজিক। পাণ্ডিত্য সংক্রান্ত কারণে খুব কম শিক্ষিত লোকেরই এখন ধর্মীয় বিশ্বাসে তীব্রতা আছে, যা সম্ভব ছিল, ধরুন, সেন্ট টমাস অ্যাকুনাসের সময়। অধিকাংশ আধুনিক মানুষের কাছে ঈশ্বর কিছুটা অস্পষ্ট, জীবন শক্তির নামান্তর কিংবা এমন কোনো শক্তি নয় যা আমাদের জন্য ন্যায়ের পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও পরজগতের চেয়ে ধর্মের ইহজাগতিক ফলাফল নিয়ে অধিক ভাবেন। তারা খুব একটা নিশ্চিত নন যে এই জগত ঈশ্বরের গৌরব প্রকাশের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। তারা বরং ঈশ্বরকে ব্যবহারিক প্রকল্প মনে করেন যার কাজ হলো বর্তমান জগতের উন্নতিসাধন। ঈশ্বরকে পার্থিব জগতের প্রয়োজনের অধীনস্ত করা তারা প্রকারান্তরে নিজেদের বিশ্বাসের আন্তরিকতায় সংশয় লেপন করেন। তারা হয়তো ভাবেন, সাবাথেরমতো ঈশ্বরকেও মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়েছিল। গির্জাসমূহকে আধুনিক আদর্শের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ না করার সমাজতাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। গির্জাগুলো উপহার হিসেবে প্রাপ্ত প্রভূত সম্পত্তির জন্য ঐ সম্পত্তি রক্ষার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। উপরন্তু এসব গির্জা নিষ্পেষণমূলক নীতির সঙ্গে জড়িত, এই নীতমালা জীবনের অনেক সুখকে নিন্দনীয় বলে রায় দিয়ে বসে আছে, আর তরুণরা এসব সুখের মধ্যে ক্ষতিকর কিছু দেখতে পান না। গির্জাগুলো নানা প্রকার অত্যাচারও করে থাকে। আর সন্দেহবাদীদের কাছে তা অপ্রয়োজনীয়ভাবে নির্দয় বলে মনে হয়। আমি বেশ কিছু উৎসুক তরুণকে জানি যারা খ্রিষ্টের শিক্ষাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন পরে তারা দেখতে পান যে তাদের গির্জাচালিত খ্রিষ্টধর্মের বিরোধী এবং সমাজচ্যুত গণ্য করা হয়। তাদের অত্যাচারও সইতে হয়েছে, যেন তারা যুধ্যমান নাস্তিক্যবাদী।
দেশ-অনেক যুগে এবং স্থানে দেশপ্রেম ছিল প্রগাঢ় বিশ্বাসের ব্যাপার। এই বিশ্বাসের প্রতি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ সম্মতি দিতে পারতেন। শেক্সপিয়রের সময়ে ইংল্যাণ্ডে, ফিশতের সময়ে জার্মানিতে, ম্যাসিনির সময়ে ইতালিতে এই বিশ্বাসটা ছিল। পোল্যাণ্ড, চিন এবং বহির্মঙ্গোলিয়ায় এই বিশ্বাসটা এখনও বিদ্যমান। পশ্চিমের জাতিসমূহের মধ্যে দেশপ্রেম এখনও অত্যন্ত শক্তিশালী। সেখানকার রাজনীতি, সরকারি ব্যয়, সামরিক প্রস্তুতি এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয় দেশপ্রেম নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বুদ্ধিমান তরুণরা দেশপ্রেমকে পর্যাপ্ত আদর্শ হিসেবে গ্রহণে অপারগ; তারা মনে করে নিপীড়িত জাতির জন্য দেশপ্রেম খুবই দরকার, কিন্তু নিপীড়িত জাতি স্বাধীনতা অর্জন করার পরই যে জাতীয়তাবাদ এক সময় বীরত্বব্যঞ্জক ছিল তা নিপীড়নমূলক হয়ে পড়ে। পোল্যাণ্ডবাসীরা মারিয়া তেরেসা অশ্রু বিসর্জন দেবার পর থেকে আদর্শবাদীর সহানুভূতি ভোগ করেছেন, আবার তারাই নিজেদের স্বাধীনতা সংগঠিত করেছেন ইউক্রেনীয়দের নিষ্পেষণের জন্য। আইরিশ জনগণ, যাদের উপর ব্রিটিশ জাতি আট শ বছরের জন্য সভ্যতা আরোপ করেছিল, নিজেদের স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে আইন প্রণয়ন করে উৎকৃষ্টমানের বই প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে দেয়। পোলরা ইউক্রেনীয়দের খুন করছে আর আইরিশরা খুন করছে সাহিত্য, এই দৃশ্যগুলো একটি ক্ষুদ্র জাতির জন্যও জাতীয়তাবাদ যে আদর্শ হিসেবে অপর্যাপ্ত তা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু শক্তিধর জাতির বেলা যুক্তিটা বাড়তি শক্তি লাভ করে। ভার্সাই সন্ধি তাদের কাছে খুব একটা প্রেরণাদায়ক ব্যাপার ছিল না যাদের আদর্শ রক্ষা করতে গিয়ে ভাগ্যবলে আত্মাহুতি দিতে হয়নি। অথচ এই আদর্শগুলোর প্রতি তাদের শাসকরা বিশ্বাসঘাতকতা করে। যুদ্ধ চলাকালে যারা এই নীতিবাক্য প্রচার করতেন যে তারা সমরবাদের বিরুদ্ধে যুধ্যমান, যুদ্ধের শেষে তারাই নিজ-নিজ দেশে সমরবাদীতে পরিণত হন। এই ধরনের ঘটনা বুদ্ধিমান তরুণদের কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে তুলেছে যে দেশপ্রেম বর্তমান যুগের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এবং এই সমরবাদী নীতি যদি নমনীয় না করা যায় তাহলে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।
প্রগতি-মার্জিত তরুণদের কাছে এই উনিশ শতকী আদর্শে খুব বেশি ব্যাবিট জাতীয় মানবতা রয়েছে। পরিমাপযোগ্য প্রগতি ঘটে মোটর গাড়ি তৈরির সংখ্যা কিংবা কী পরিমাণ বাদাম ভক্ষণ করা হলো, এই জাতীয় গুরুত্বহীন ব্যাপারে। প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বস্তু পরিমাপযোগ্য নয়। ফলে এটা মান উন্নয়ন কিংবা সংখ্যা বাড়ানোয় আগ্রহী ব্যক্তির পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত বিষয় নয়। উপরন্তু বহু আধুনিক উদ্ভাবন মানুষকে করেছে অসহায়। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে রেডিও, সিনেমা এবং বিষাক্ত গ্যাসের নামোল্লেখ করতে পারি। শেক্সপিয়র একটি যুগের উত্তৰ্ষ পরিমাপ করেছেন ঐ যুগের কাব্যশৈলী দ্বারা (৩২তম সনেট দেখুন)। কিন্তু পরিমাপের উক্ত রীতি এখন সেকেলে হয়ে গেছে।
সৌন্দর্য-সৌন্দর্য জিনিসটায় এমন কিছু আছে যার জন্য একে সেকেলে মনে হয়। কিন্তু কেন যে সেকেলে মনে হয় সেটা বলা দুষ্কর। যদি আধুনিক কোনো চিত্রকর সম্পর্কে অভিযোগ তুলে বলা হয় যে তিনি সৌন্দর্য-সন্ধানী তাহলে তিনি তো ক্ষেপেই যাবেন। আজকাল দেখা যায় অধিকাংশ শিল্পী জগতের বিরুদ্ধে ক্রোধ-দ্বারাই উদ্বুদ্ধ বোধ করেন, সুতরাং তারা নির্মল সন্তোষের চেয়ে তাৎপর্যময় ব্যথার চিত্র আঁকায় সমধিক উৎসাহী। তদুপরি অনেক ধরনের সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি দেয়ার জন্য একজনকে কিছুটা ভাবগম্ভীর হতে হয়, যা বুদ্ধিমান আধুনিকের পক্ষে সম্ভব নয়। এথেন্স কিংবা ফ্লোরেন্সের মতো ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের একজন ক্ষমতাবান নাগরিক অনায়াসে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে গণ্য করতে পারতেন। তখন ধুলার ধরণী ছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত, সৃষ্টির লক্ষ্যই ছিল মানুষ, তার শহর মানুষকে সর্বোকৃষ্ট করে তুলেছে, তিনি নিজেও নিজ শহরের সর্বোকৃষ্ট ব্যক্তিদের অন্যতম। অনুরূপ পরিস্থিতিতে ঈস্কিলাস কিংবা দান্তে স্বীয় আনন্দ ও বেদনা গুরুত্ব দিয়ে নিতে পারতেন। তিনি অনুভব করতে পারতেন ব্যক্তি-আবেগের মূল্য রয়েছে, আরো অনুভব করতেন বিয়োগান্তক ঘটনা অমর কবিতায় ধরে রাখা প্রয়োজন। কিন্তু আধুনিক মানুষ, যখন দুর্ভাগ্যপীড়িত হয়, নিজেকে পরিসাংখ্যিক সমগ্রতার পূর্ণসংখ্যা হিসেবে দেখতে পায় তাদের চোখের সামনে অতীত ও বর্তমান ভেসে ওঠে তুচ্ছ পরাজয়ের নিরানন্দ মিছিল হিসেবে। মানুষকেই তাদের মনে হয় হাস্যকর দাম্ভিক জীবন হিসেবে। এই মানুষ অসীম নিস্তব্ধতার ভেতর সংক্ষিপ্ত বিরতির সময় কেবলি চিৎকার আর হইচই করে। unaccomodated man is no more but such a poor, bare, forked animal.১৮ বলেন রাজা লিয়র এবং এই ধারণা তাকে উন্মাদ করে দেয়, কারণ এই ধারণাটি তার কাছে পরিচিত নয়। কিন্তু এই ধারণা আধুনিক মানুষের কাছে খুবই পরিচিত। ফলে উক্ত ধারণা মানুষ যে তুচ্ছ শুধু এই বিশ্বাসে তাদের পৌঁছায়।
সত্য-পুরাকালে সত্য ছিল সন্দেহাতীত, শাশ্বত এবং অতি-মানবিক। তরুণ বয়সে আমি নিজে এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করি এবং সত্য-সন্ধানে নিজেকে নিবেদন করে তারুণ্যের অপব্যয় করি। আজ কিন্তু একদল শত্রুর অভ্যুদয় ঘটেছে যারা সত্য নিধনে প্রস্তুত: প্রয়োগবাদ, ব্যবহারবাদ, মনস্তত্ত্ববাদ, আপেক্ষিকতা পদার্থশাস্ত্র এই শক্রদলের অন্যতম। গ্যালিলিও এবং ইনকুইজিশন এ ব্যাপারে এক হতে পারেনি যে পৃথিবী সূর্যের চারদিক প্রদক্ষিণ করে নাকি সূর্যই পৃথিবীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে। তবে তারা একমত ছিলেন যে এ প্রসঙ্গে তাদের মতামতের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। তবে যে একটি ব্যাপারে তারা অভিন্ন মত পোষণ করতেন তা ছিল একেবারে ভুল। মতটি হলো, এ ব্যাপারে তারা যা বলছেন তা শুধু শব্দগত প্রভেদের ব্যাপার। প্রাচীনকালে সত্যের পূজা সম্ভব ছিল; বাস্তবিক পক্ষে মানব বলি দেয়ার যে প্রথা ছিল তা থেকেই পূজার প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ মেলে। কিন্তু সরল মানবিক এবং আপেক্ষিক সত্যের পূজা করা কঠিন বৈকি। এডিংটনের মতে মধ্যাকর্ষণ সূত্র পরিমাপের সুবিধাজনক নিয়ম মাত্র। এই সূত্র অন্যান্য সূত্রের চেয়ে অধিকতর সত্য নয়, যেমন পরিমাপের মেট্রিক পদ্ধতি ফুট ও গজ থেকে অধিক সত্য নয়।
প্রকৃতি ও প্রকৃতির সূত্র অন্ধকারে ছিল: ঈশ্বর বললেন, নিউটন হও, আর পরিমাপে সুবিধা হয়ে গেল।
এই মনোভাবে মহত্ত্বের অভাব আছে বলেই মনে হয়। স্পিনোজা যখন কিছুতে বিশ্বাস করতেন, তিনি মনে করতেন ঈশ্বরের আলোকিত ভালোবাসা উপভোগ করছেন। কিন্তু আধুনিক মানুষ মার্ক্সের সঙ্গে সহমত পোষণ করে মনে করে যে অর্থনৈতিক অভীষ্টই তাকে পরিচালিত করে কিংবা ফ্রয়েডের প্রভাবে মনে করে নির্দিষ্ট যৌন তাড়নার জন্যই সে কোনো তত্ত্বে আস্থা রাখছে কিংবা যৌন-তাড়নার জন্যই লোহিত সাগরে প্রাণীকুলের প্রকারভেদে বিশ্বাস করে। তবে কোনো ক্ষেত্রেই সে স্পিনোজার মতো পুলক অনুভব করতে পারে না।
এতদূর আমরা বুদ্ধিবাদী ভঙ্গিতে সিনিসিজমের বিচার করেছি, মনে করেছি সিনিসিজমের বুদ্ধিগত কারণ রয়েছে। যাহোক, আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদরা বলতে কখনো ক্লান্তি বোধ করেন না যে, বিশ্বাস কদাচিৎ ন্যায়সঙ্গত অভিলাষ দ্বারা নির্ধারিত হয়, অবিশ্বাস সম্পর্কে একই কথা খাটে, যদিও সংশয়বাদীরা এ ব্যাপারটা প্রায়শই উপেক্ষা করে চলেন। ব্যাপক সংশয়বাদীতার কারণ সম্ভবত সমাজতাত্ত্বিক, বুদ্ধিগত নয়। প্রধান কারণ ক্ষমতাহীন স্বাচ্ছন্দ্য। ক্ষমতার অধিকারীরা সিনিক হন না, কারণ তারা তাদের ধ্যান-ধারণা অপরের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন। নিপীড়িত জনগণও সিনিক হন না, যেহেতু তাদের মন ঘৃণায় পূর্ণ, আর ঘৃণা, অন্য যে কোনো সবল ভাবাবেগের মতো, প্রচণ্ড বিশ্বাস বয়ে আনে। শিক্ষা, গণতন্ত্র এবং ব্যাপক উৎপাদন অভ্যুদয়ের আগ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ বুদ্ধিজীবীরা প্রভাবিত করেছেন, তাদের গলা-কাটা গেলেও এই প্রভাব কোনো সময় খর্ব হয়নি। আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন। আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা যদি নির্বোধ ধনীদের প্রচারক কিংবা রাজবিদূষক হিসেবে কাজ করতে রাজি থাকে তবে তাদের বড় চাকরি লাভ এবং মোটা টাকা উপার্জনে কোনো মতেই অসুবিধা হয় না। ব্যাপক উৎপাদন এবং প্রাথমিক শিক্ষার ফল দাঁড়িয়েছে যে, নির্বুদ্ধিতা এখন অনেক গভীরে প্রোথিত। সভ্যতা উন্মেষের পর থেকে নির্বুদ্ধিতা এত বেশি গভীরে প্রোথিত হয়নি। জার সরকার লেনিনের ভ্রাতাকে হত্যা করলে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ লেনিন কিন্তু সিনিকে পরিণত হয়ে যাননি, তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছে ঘৃণা, এবং আজীবন এই ঘৃণার অনুপ্রেরণায় কাজ করে শেষ পর্যন্ত সফল হন। কিন্তু সমধিক দৃঢ় পশ্চিমা দেশগুলোতে ঘৃণাবোধ করার সুযুক্তি কদাচিৎ মেলে। এত ব্যাপক জিঘাংসা সাধনের সুযোগ ঘটে না। বুদ্ধিজীবীদের কাজের আদেশ দেয় এবং অর্থ যোগায় সরকার কিংবা ধনীরা, যাদের উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের জন্য ক্ষতিকর না হলেও হাস্যকর বলেই মনে হয়। কিন্তু সিনিসিজমের একটু ছোঁয়া থাকার দরুন তারা পরিস্থিতির সঙ্গে বিবেকের সাযুজ্য ঘটাতে সমর্থ হয়। তবে এটা সত্য যে ক্ষমতাসীনরা আশা করে কোনো কোনো কর্মকাণ্ডে সম্পূর্ণ প্রশংসনীয় কাজ হোক, এইসব কাজের মধ্যে প্রধান হলো বিজ্ঞান; পরবর্তী হলো আমেরিকায় গণস্থাপত্যশিল্প। কিন্তু একজন মানুষের শিক্ষা যদি কেবল সাহিত্যগত হয়, যা এখনও প্রায় দেখা যায়, তাহলে বাইশ বছর বয়সে সে দেখতে পায়, সকল দক্ষতা নিয়ে যা-কিছু তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তার জন্য সে কিছুই করতে পারছে না। এমনকি পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও বিজ্ঞান-সাধকরা সিনিসিজমে ভোগেন না; কারণ সমাজের অনুমতিক্রমেই তাদের বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারেন। তবে আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এরা ব্যতিক্রম এবং ভাগ্যবান।
যদি এই নিদান সঠিক হয় তাহলে আধুনিক সিনিসিজম কেবলমাত্র প্রচার দ্বারা কিংবা তরুণদের সামনে উন্নততর কোনো আদর্শ উপস্থাপন করে দূর করা যাবে না। ধর্মযাজক এবং জরাজীর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্ম থেকে নির্গত আদর্শ থেকে উন্নততর বলেও প্রমাণিত হবে না। এই রোগের প্রতিবিধান তখনই মিলবে যখন বুদ্ধিজীবীরা এমন কাজ পাবে যা তাদের সৃষ্টিশীল ঝোঁক বাস্তবায়নের সহায়ক হবে কিংবা বাস্তবায়ন করতে পারবে। ডিসরেলি যে ব্যবস্থাপত্রের পক্ষে বলে গেছেন তা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা আমি দেখতে পাচ্ছি না; আগে তোমাদের প্রধান শিক্ষকদের শিক্ষিত করো। এই শিক্ষা হবে আরো বাস্তব শিক্ষা, সাধারণভাবে সর্বহারা শ্রেণিকে কিংবা ধনিক শ্রেণিকে যে শিক্ষা দেয়া হয় তার থেকে আলাদা হতে হবে। এই শিক্ষা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিবেচনায় রাখবে। উপযোগীবাদী এষণা থেকে শুধু সামগ্রীর পাহাড় গড়বে না, যা কারো সময়ে কুলাবে না উপভোগের। মানব দেহ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান না থাকলে কাউকে ডাক্তারী পেশায় নিয়োজিত হতে দেয়া হয় না অথচ একজন অর্থলগ্নিকারী যদি তার কাজের বিচিত্র দিক সম্পর্কে অজ্ঞ হন তবু তাকে নির্বোধে কারবার চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়, কেবল ব্যতিক্রম করা হয় যদি তার ব্যাংকের খাতায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জগণ্ডা কী সুখকরই না হতো যদি অর্থশাস্ত্র এবং গ্রিক কবিতা বিষয়ে পরীক্ষায় যিনি পাস করেননি তাকে স্টক এক্সচেঞ্জে কাজ করার অনুমতি প্রদান করা না-হতো, কিংবা রাজনীতিকরা ইতিহাস এবং আধুনিক উপন্যাসের জ্ঞান রাখতে বাধ্য হতেন। কল্পনা করুন একজন বড় শিল্পপতি এই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন: আপনি যদি প্রচুর পরিমাণে গম মজুদ করেন, তার প্রতিক্রিয়া জার্মান কবিতায় কী হবে? আধুনিক বিশ্বে হেতুবাদ যে কোনো সময়ের চেয়ে সমধিক জটিল এবং এর শাখা-প্রশাখা সুদূর বিস্তৃত, বৃহৎ সংগঠনের সংখ্যা বৃদ্ধিই এর কারণ; কিন্তু এই সংগঠনগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা মূর্খ, তারা তাদের কাজের ফলাফল এক শতাংশও বোঝে না। রাবলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হারানোর ভয়ে তার বই নিজের নাম গোপন করে ছাপতেন। আধুনিকরা বলে ঐ ধরনের বই লিখতেই যাবেন না। কারণ আজকের দিনের প্রচারণার নিখুঁত পদ্ধতি লেখকের নাম ঠিকই খুঁজে বের করবে। জগতের শাসককুল সর্বকালেই নির্বোধ ছিল। কিন্তু বর্তমান কালের শাসকদের মতো তাদের এত ক্ষমতা ছিল না। এই শাসকদের কীভাবে বুদ্ধিমান করে তোেলা যায় তার উপায় খুঁজে বের করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যার সমাধান কি সম্ভব নয়? অসম্ভব আমি মনে করি না, তবে কাজটা যে সহজ তাও আমার মনে হয় না।