তারপর দুটি রাত, মাঝখানে একটি দিন।
খোকা জানে না কিভাবে সময় কেটেছে। কোনো হিসেব নেই তার কাছে। কেবল এইটুকু মনে আছে, অনৈসর্গিক আচ্ছন্নতার ভিতর জুবড়ে থেকেও সে অনুমান করতে পারছিলো কি পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকা চলেছে শহরময়। জানালার ফাঁকে চোখ রাখলেই দেখা যায় চতুর্দিকে ছত্রাখান মৃতদেহ, ছিন্নভিন্ন, ঝাঝরা; শহর জুড়ে দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন, তপ্ত বাতাসের হলকায় দগ্ধ মাংস আর বারুদের কটু গন্ধ।
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিলো দেয়াল। জানালার সামনে একটা খাট খাড়া করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো রাজীব ভাই, গুলি লাগলো মুখে।
ঠিক কখন রাজীব ভাইয়ের মৃত্যু হয়, খোকার তা জানা নেই। অন্ধকার প্রেতপুরীতে তিনটি জড়বৎ প্রাণী রদ্ধশ্বাসে কেবল প্রহর গুনেছে। সবকিছু আয়ত্তে এলেই ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালাবে উন্মত্ত সৈন্যদল, একটি প্রাণীও বাঁচবে না, এই এখনও যেমন কুকুর বিড়াল সামনে যা পড়ছে তোপের মুখে উড়িয়ে দিচ্ছে এক ধারসে,–থেকে থেকে এইসব ভেবে শিউরে উঠছিলো খোকা।
সকালের আলোয় রাজীব ভাইয়ের মুখ দেখে তার রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিলো, মনে হয়েছিলো নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ, বিকৃত তিরস্কার। গুলিতে রাজীব ভাইয়ের মুখের একপাশের চোয়াল উড়ে গিয়েছিলো।
সন্ধ্যার আগেই শুরু হয়েছিলো মুখের দিকে পচানি ধরার। অনির্দিষ্টকালের জন্যে কারফিউ, কোনো প্রশ্নই উঠে নি সৎকারের। প্রতি মুহূর্তেই গোলাগুলির তুমুল শব্দ, মাঝে মাঝে দূরে কোথাও ঘটছে উচ্চণ্ড বিস্ফোরণ; বসে বসে নিজের মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া কারো কিছুই করণীয় ছিলো না।
এই প্রথম জীবনের চেয়েও বড় বলে মনে হয়েছিলো এক একটি রাত্রিকে; বিস্ফোরণের শব্দ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছিলো প্রতিটি পল অনুপলকে। জীবনের অর্থ তখন একটাই, প্রাণের ভার; নারকীয়তার এমন রুদ্রমূর্তি আর কখনো দেখে নি খোকা।
ক্রমাগত ফুলছিলো রাজীব ভাইয়ের লাশ। এক বিকট গহ্বর ঠেলে বেরিয়ে আসছিলো ক্ষত-বিক্ষত জিভ। যাবতীয় ধ্বংসস্তুপের ভিতর এই মানুষটিই সবচেয়ে বেশি অনাত্মীয় হয়ে উঠেছিলো তিনটি প্রাণীর কাছে; কেননা রাজীব ভাইয়ের লাশের গন্ধে সকলেরই নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।