০৯. টুকু বুঝতেই পারল না

টুকু অনেকক্ষণ পর্যন্ত বুঝতেই পারল না সে কোথায় আছে। অন্ধকার এবং অপরিচিত একটা ঘর। সে শুয়ে আছে মেঝেতে। তার গায়ে দুৰ্গন্ধ মোটা একটা কাঁথা। সে শুনল ইনিয়ে-বিনিয়ে অল্প বয়েসী। একটা বাচ্চা কাঁদছে। কান্নাব শব্দ শুনতে শুনতে টুকু চোখ বন্ধ করল। এই মুহূর্তে সে কিছু ভাবতে চায় না! ঘুমুতে চায়। আরামে তার শরীর অল্প অল্প কাঁপছে। ঘুম এত আরামের হয় সে আগে কখনো ভাবেনি। এখানে সে কী ভাবে এল? নিজে নিজে নিশ্চয়ই আসেনি। কেউ এসে দিয়ে গেছে। কতদিন আগে দিয়ে গেছে? এক’দিন দু’দিন না। সাত দিন? বাড়ি থেকে যেদিন সে বের হল সেদিন কী বার ছিল? সোমবার না মঙ্গলবার? এটা কোন কাল? শীত না গ্রীষ্ম? কিছুই মনে পড়ছে না।

গায়ের উপর রাখা মোটা কথা থেকে দুৰ্গন্ধ আসছে। ঘুমের মধ্যেও সেই দুৰ্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আরো যেন বেশি পাওয়া যাচ্ছে। পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠছে। বমি বমি লাগছে।

টুকু দ্বিতীয়বার চোখ মেলল। সঙ্গে সঙ্গে মোটা একটা গলা শোনা গেল নাম কী তোর? এই নাম কী রে?

টুকু জবাব দিল না; জবাব দেবার আগে লোকটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু লোকটা বসেছে এমনভাবে যে তাকে দেখতে হলে মাথা ঘুরিয়ে তাকাতে হয়। মাথা ঘুরাতে ইচ্ছা করছে না।

এই পোলা, এই! কিছু খাবি? খাবি? কথা কস না ক্যান? বোলা নাহি। এই এই।

টুকু কথা না বলাই ভাল বিবেচনা করল। কথা বলতে শুরু করলেই এরা অসংখ্য প্রশ্ন করবে। বাড়ি কোথায়? বাবার নাম কী? থাক কোথায়? পড়াশোনা করি? কী হয়েছে তোমার?

এরচে এই যে চুপচাপ পড়ে আছে এটা কী ভাল না? টুকু আগ্রহ করে আশপাশের জীবনযাত্রা দেখছে। যে লোকটি তার সঙ্গে কথা বলছে তার চেহারা সে এখনো দেখেনি। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে বুড়ো কেউ হবে। কথার সঙ্গে সঙ্গে সে খুব কাশছে।

এই পোলা, ভুখ লাগছে? কিছু খাবি? ও মতির মা, এই পুলারে খাওন দেও!

মতির মা ঘরে ঢুকল। হাতে এলুমিনিয়ামের বাটি এবং চামচ। বাটিতে তরল সবুজ রঙের কি একটা জিনিস। মতির মার পরনে গাঢ় সবুজ রঙের একটা শাড়ি। বয়স ও খুব কম। একে দেখে মনে হয় না মতি বলে তার কোনো ছেলে আছে।

মাতিব মা, এই পুলাব জবান বন্ধ। তার মুখে তুইলা চাইরােডা খাওয়াইয়া দাও।

মতির মা চামচে করে সবুজ রঙের ঐ জিনিস টুকুর মুখের কাছে ধরল। মতির মার মুখ ভাবলেশহীন। এই ছেলে কিছু খাক না খাক তাতে তার কিছু যায় আসে না। টুকু আগ্রহ করে খেল। জিনিসটা খেতে ভাল। টকটক এবং প্রচণ্ড ঝাল। মাতিব মা যতবার চামচটা মুখের কাছে ধরছে। ততবারই তার হাতেব চুড়ি টুনটুন কবে বাজছে। মেয়েটির হাত ভর্তি গাঢ় লাল রঙের চুড়ি। সবুজ শাড়ি পরা একটি মেয়ের সাদি হাত ভর্তি লাল চুড়ি থাকে তাহলে দেখতে অনা রকম লাগে।

বুড়ো কাশতে কাশতে ডাকল, ও মতির মা।

কী?

এই পুলার তো জবান বন্ধ। তারে ঘবে আইন্যা তে! দেহি আরেক বিপদে পড়লাম।

ফালাইয়া দিয়া আহ।

পুলার গাযে জ্বর আছে কি-না দেহ দেহি।

মতির মা টুকুর গায়ে হাত না দিয়েই বলল, জ্বর নাই।

আর একটা দিন দেখি তারপরে যেখান থাইক্যা আনছি হেইখানে ফালাইয়া থুইয়া আসমু।

যা ইচ্ছা কর।

টুকু আগ্রহ করে চারদিকে লক্ষ্য করছে। এটা নিশ্চয়ই বস্তির কোনো-একটা ঘর। চৌকিটৌকির কোনো ব্যবহার নেই। ঘরের এ-মাথা ও-মাথা পর্যন্ত চাটাই বিছানো। যখন যার ইচ্ছা! এসে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে যাচ্ছে। রান্না এবং খাওয়াব ব্যবস্থা বারান্দাষ। বিরাট একটা হাড়িতে কি যেন রান্না হয়েছে। বাড়ির লোকজন নিজের নিজের ইচ্ছামত খেয়ে চলে যাচ্ছে। এই পরিবারের লোক কজন টুকু ধরতে চেষ্টা করল। পারল না। মনে হচ্ছে অনেকগুলি মানুষ। এতগুলি মানুষের মেঝেতে ঘুমুবার জায়গা হয় কী করে জানে? এর মধ্যে একটি মেয়ের মনে হয় নতুন বিয়ে হয়েছে। সবাই তাকে নয়া বৌ নয়া বৌ বলছে। মেয়েটা বেশ সেজোগুজে আছে।

বিকেলের দিকে টুকু উঠে বসল। ঘোর বর্ষ। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। এই ঘরে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ছে না।–এই আনন্দেই বাড়ির মানুষগুলি উল্লসিত; আধরুড়ো একটা লোক বারবার বলছে . পলিথিনেধ কাগজ দিয়ে কেমুন মেরামত করালাম দেখছ? পঁচিশ টাকা খরচ হইছে কিন্তু আরাম হইছে কত টেকার? পঁচিশ হাজার টেকার আরাম।

নয়া বৌ এই কথায় খিলখিল করে হাসল। বুড়ো টুকুর দিকে তাকিয়ে বলল, শইলডা এখন কেমন লাগে?

টুকু কিছু বলল না। ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে রইল।

পেশাব-পায়খানা করবি নাকি? এই পুলা?

টুকু তাকিয়ে রইল। চোখের পলক ফেলল না।

বুড়ো দুঃখিত মুখে বলল, আহা জবানডা বন্ধ। ঐ পুলা থাক শুইয়া থাক।

টুকু সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। কে তাকে এখানে এনেছে তা জানতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না। কেউ তাকে কিছু বলছেও না। জবান বন্ধ অবস্থায় থাকার খুব মজা আছে।

নয়া বৌ-এর স্বামী শ্যামলী সিনেমা হলের গেট ম্যান। সে বাড়ি ফিরল রাত বারটায়। টুকুকে দেখে বলল, হারামজাদা এখনো আছে?

বুড়ো বলল, গাইলমন্দ করিস না। এই পুলার জবান বন্ধ। গুংগা পুলা। লোকটি বাড়ি ঢুকেই শাড়ি টানিয়ে ঘরের কোণায় পর্দা ঘেরা একটা জায়গা তৈরি করে ফেলল। এই ঘরের ছোট কটা বাচ্চা ছাড়া সবাই প্রায় জেগে আছে। সে এই সব অগ্রাহ্য করে পর্দা ঘেরা জায়গায় চলে গেল।

পর্দার ভেতরে একটা কুপি জ্বলছে বলে এদের দুজনের কালো ছবি পর্দায় পড়ছে। এরা কি করছে না করছে সব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। বাড়ির অন্যান্যদের সঙ্গে টুকুও খুব আগ্রহ নিয়ে পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। সমস্ত ব্যাপারটা তার এত অদ্ভুত লাগছে।

পুরো ব্যাপারটা অবশ্যি দেখা গেল না। বুড়ো বিরক্ত গলায় বলল, ঐ হারামজাদা পুলা। বাতি নিভা। তাড়াতাড়ি বাতি নিভা।

বাতি নিভে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। অপূর্ব ছায়াছবির শেষটা দেখা গেল না বলে টুকুর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সারা রাত বৃষ্টি হল। তুমুল বৃষ্টি। ঘরের দরজা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। তাতে কারো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। টুকুর ঘুম আসছে না। তার চমৎকার লাগছে। মজার মজার সব চিন্তা মাথায আসছে। সেই সব চিন্তার একটা হচ্ছে এটা যেন বস্তিব কোনো ঘর না। এটা হচ্ছে সমুদ্রগামী জাহাজ। ঝড়ে এই জাহাজের কলকব্জা নষ্ট হয়ে গেছে, জাহাজ ভেসে যাচ্ছে নিরুদ্দেশেব পথে। জাহাজের যাত্রীরা সবাই মরণাপন্ন; কারণ জাহাজে খাদ্য নেই, পানি নেই; জাহাজের তলানীতে একটা ফুটো হয়েছে। সেই ফুটো দিয়ে কলকল করে পানি আসছে; ফুটো বন্ধ করার চেষ্টা করে ও লাভ হয়নি। এখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। দুলতে দুলতে জাহাজ এগুচ্ছে।

টুকু সত্যি সত্যি এক ধরনের দুলুনি অনুভব করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। আকাশ খানিকটা আলো হয়েছে। মেঘ নেই। বৃষ্টি ভেজা টাটকা একটা দিন। টুকু সাবধানে ঘুমন্ত মানুষদের ডিঙিয়ে ঘর থেকে বেকল। হাঁটা শুরু করল। একবার ও পেছনে ফিরে তাকাল না।

একটা সময় আছে যখন আমাদের পেছন ফিরতে ইচ্ছা করে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *