টানেলের স্ল্যাভ বসানো হচ্ছে।
বিশাল ক্রেন এসেছে। লোহার শিকলে বাঁধা দৈত্যাকৃতি স্ল্যাভ নামানো হচ্ছে। চারদিকে সীমাহীন ব্যস্ততা। লোকজনের হৈ চৈ, ডাকাডাকি। ক্রেনের শব্দের সঙ্গে মিশেছে জেনারেটরের শব্দ। দুটা বড় জেনারেটরই একসঙ্গে চলছে। একটির শব্দেই কানে তালা ধরে যায়, সেখানে দুটা পাওয়ারফুল ইনজিন। লীনা মুগ্ধচোখে দেখছে। এখানে তার কোনো কাজ নেই। তার দায়িত্ব বেতনের স্টেটমেন্ট তৈরি করা। সেসব ফেলে সকাল থেকেই এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচে আনন্দময় কাজটা ক্রেনের চালক করছে। কত উঁচুতে আকাশের কাছাকাছি মানুষটা বসে আছে। সুইচ টিপছে, অমনি সে উপরে উঠছে, নিচে নামছে। বিশাল সব স্লাভ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
কে যেন লীনার কাধে হাত রাখল। লীনা চমকে উঠে পেছনে তাকাল। হাসিমুখে ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে। সে কী যেন বলল, কিছুই বোঝা গেল না। মনে হচ্ছে ফিরোজ শুধু ঠোঁট নাড়ছে।
লীনা বলল, তুমি কখন এসেছ?
ফিরোজ হাতের ইশারায় বুঝল সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।
লীনার মনে হল— বাহ্, বেশ মজা তো! কথা হচ্ছে, কেউ কথা বুঝতে পারছে না। এরকম অবস্থায় যা ইচ্ছা বলা যায়।
লীনা বলল, কাজের সময় তুমি এসেছ কেন? তোমাকে দেখে আমার মোটেই ভালো লাগছে না। আমার খুব বিরক্তি লাগছে।
ফিরোজ আবারও ইশারা করল সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। ফিরোজ বলল, চলে দূরে যাই। বলেই ইশারায় তবু দেখাল।
লীনার এক পা যেতে ইচ্ছা করছে না। এখানে বিরাট কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। সব ফেলে দিয়ে সে তাঁবুতে চলে যাবে? গুটুর গুটুর করে গল্প করবে? গল্প করার সময় তো শেষ হয়ে যায়নি। সারাজীবনে অনেক গল্প করা যাবে। এখন কাজ দেখা যাক। এই কাজ সারাজীবন থাকবে না। কাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপরেও লীনা রওনা হল।
তাঁবুর কাছ থেকেও জেনারেটারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তবে এখানে কথা বললে শোনা যায়। লীনা উৎসাহের সঙ্গে বলল, জান আমাদের সূর্যঘর কমপ্লিট হয়েছে। আমরা অবিকল মরুভূমির মতো তৈরি করে ফেলেছি। ঘরগুলি যে কী সুন্দর হয়েছে। দেখলে ধড়াম করে শব্দ হবে।
ধড়াম করে শব্দ হবে কেন?
ঘরগুলি এতই অদ্ভুত যে দেখে তুমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাবে, তখন ধড়াম করে শব্দ।
ফিরোজ হেসে ফেলল।
লীনা বলল, হাসবে না। আমি সিরিয়াস। দেখে তুমি যদি অজ্ঞান না হও, আমি ভ্যানগগের মতো কান কেটে তোমাকে দিয়ে দেব।
তোমাদের প্রজেক্ট কি কমপ্লিট নাকি?
আরে না। অনেক বাকি। আমরা টার্গেট থেকে সামান্য পিছিয়েও পড়েছি। রাতদিন কাজ হচ্ছে। আমাদের কারোরই নিশ্বাস ফেলার সময় নেই।
আমি এসে মনে হয় তোমাদের কাজের ক্ষতি করলাম।
তা তো করেছই।
সরি বেশিক্ষণ থাকব না, বিকেল পাঁচটার গাড়িতে চলে যাব।
তুমি বলেছিলে পূর্ণিমা দেখতে আসবে। আসনি কেন?
ফিরোজ বলল, ঢাকা শহরে থেকে কবে পূর্ণিমা, কবে অমাবস্যা এইসব বোঝা যায়। কোন ফাঁকে পূর্ণিমা এসেছে, কোন ফাঁকে চলে গেছে বুঝতেই পারিনি। লীনা তোমাকে একটা বিশেষ খবর দেবার জন্যে এসেছি।
দাও।
এখানে না। চলো কোনো নিরিবিলি জায়গাতে যাই। সেখানে বলি। চলো তোমাদের সূর্যঘরে যাই।
সূর্যঘরে তো এখন যাওয়া যাবে না। কোনো এপ্রোচ রোড নেই। যেতে হবে টানেলের ভিতর দিয়ে। টানেল এখানো তৈরি হয়নি।
তাহলে চলো তাঁবুর ভেতর যাই। তাঁবুর ভেতরটা নিশ্চয়ই নিরিবিলি।
চলো যাই।
নাশতা জাতীয় কিছু কি পাওয়া যাবে? খুব ভোরে রওনা হয়েছি নাশতা খাওয়া হয় নি। খিদেয় পেটের নাড়িভুড়ি তো হজম হয়েছেই, এখন পেটের চামড়া হজম হওয়া শুরু হয়েছে।
তুমি তাঁবুর ভেতর গিয়ে বোস, আমি নাশতা নিয়ে আসছি।
তোমার স্যার কোথায়? তাঁকে তো দেখছি না।
স্যার ডায়নোসর-পার্কে আছেন। ডায়নোসরের গায়ে বনটাইল করা হচ্ছে। স্যার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন।
বনটাইল কী জিনিস?
রঙ করার একধরনের পদ্ধতি। উঁচু উঁচু দানার মতো হয়ে গায়ে রঙ লাগে। দেখতে চাইলে তোমাকে দেখাব।
অবশ্যই দেখতে চাই, তবে নাশতাটা খেয়ে নেই। খিদে-পেটে ডায়নোসর দেখলে কী হবে জানো? ডায়নোসরগুলিকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা হবে। তোমার স্যার নিশ্চয়ই সেটা পছন্দ করবেন না।
তোমাকে খুব খুশি খুশি লাগছে। কারণটা কী বল তো?
কারণ আমার বিয়ে। সামনের মাসের ২১ তারিখ। শুক্রবার বাদ জুম্মা।
লীনা তাকিয়ে আছে। ফিরোজ বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছ। তুমি কি চাও না আমার বিয়ে হোক?
লীনা জবাব দিল না।
হাসান বলল, তুমি না চাইলে বিয়ে করব না। এইভাবে তাকিয়ে থেকো না, খাবার নিয়ে এসো। ভালো কথা, তোমার মা তোমার জন্যে কৈ মাছ বেঁধে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। দুপুরে এই কৈ মাছ খেতে হবে। আমার দায়িত্ব হচ্ছে দুপুরে এই কৈ মাছ তাঁর কন্যার সামনে বসিয়ে খাওয়াতে হবে। কন্যা মাছ খেয়ে কেমন তৃপ্তি পেয়েছে সেটা আমাকে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। হোসেন আলি ভালো নাশতার আয়োজন করেছে। পরোটা, মাংস, বুটের ডাল, ডিমের ওমলেট। এর সঙ্গে আছে টোস্ট, মাখন, এক কাপ দুধ, একটা কলা।
ফিরোজ বলল, কী সর্বনাশ! তোমার স্যারের ব্রেকফাস্ট ভুল করে আমাকে দিয়ে দিয়েছে।
লীনা বলল, স্যার সকালে এক কাপ চা আর একটা টোস্ট খান। ভালো ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আমাদের এখানে গেস্টদের জন্যে থাকে।
ফিরোজ বলল, মুখটা এমন কঠিন করে ফেলেছ কেন লীনা? আমি তো তোমার স্যারের প্রসঙ্গে এখনো খারাপ কিছু বলিনি।
বলতে ইচ্ছা করলে বলো। কোনো সমস্যা নেই।
তুমি একটু সহজ হও তো। তোমার সঙ্গে দেখি হালকা ঠাট্টা-তামাশাও করা যায় না। এখন বলো সামনের মাসের একুশ তারিখে তোমার কি কোনো প্রগ্রাম আছে? বিয়েতে কনে উপস্থিত না থাকলে তো সমস্যা। অবশ্যি মোবাইল টেলিফোন আছে। কবুল কবুল মোবাইল টেলিফোনেও বলতে পারবে।
লীনা বলল, এই প্রজেক্ট শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যেতে পারব না।
প্রজেক্ট শেষ হবে কবে?
জুন মাসের আট তারিখে। জুন মাসের নয় তারিখে ওপেনিং।
জুন মাসের আট তারিখ পর্যন্ত তোমাকে এখানে খুঁটি গেড়ে বসে থাকতে হবে?
হ্যাঁ। আট না, নয় তারিখ পর্যন্ত। ওপেনিঙে আমি থাকব।
তোমার স্যার একদিনের জন্যেও ছুটি দেবেন না?
চাইলে দেবেন। কিন্তু আমি ছুটি নেব না।
কেন?
প্রজেক্ট চলাকালীন সময়ে আমি বিয়ের ঝামেলায় যাব না।
বিয়েটাকে তোমার এখন ঝামেলার মতো মনে হচ্ছে?
তোমার সঙ্গে আমি কূটতর্কে যেতে চাচ্ছি না। এখানে সবাই রাতদিন পরিশ্রম করছে আর আমি বিয়ে করে শাড়ি গয়না পরে বউ সেজে বসে থাকব, তা কেমন করে হয়?
হয় না তাই না?
না, হয় না।
ফিরোজ নাশতা শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে। তুমি যেমন কঠিনচোখে তাকিয়ে আছ, বলার সাহস পাচ্ছি না। চোখের দৃষ্টি একটু নরম কর— আমি নতুন একটা প্ল্যানের কথা বলি।
লীনা চুপ করে রইল। কেন জানি হঠাৎ তার প্রচণ্ড রাগ লাগছে। সামনে বসে-থাকা মানুষটাকে অসহ্য বোধ হচ্ছে। নিজের উপর রাগ লাগছে। সে সব কাজকর্ম ফেলে তাঁবুতে বসে মজা করে গল্প করছে। তার উচিত সাইটে চলে যাওয়া।
ফিরোজ বলল, আমার বুদ্ধিটা হচ্ছে–চলো আমরা দুজন একসঙ্গে তোমার স্যারের কাছে যাই। তাঁকে বলি— হে মহামান্য গুরুদেব। আপনি আমাদের দুজনের প্রতি সামান্য দয়া করুন। একটা কাজি খবর দিয়ে এখানে নিয়ে আসুন। আমরা বিয়ে করে ফেলি। এটা একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। প্রজেক্টের লোকজন এতই ব্যস্ত যে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটা তাদের সাইটে করতে হচ্ছে।
তোমার শস্তা ধরনের রসিকতার কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে। আমি এখন কাজে যাব।
আমি কী করব?
তুমি বিশ্রাম করতে চাইলে বিশ্রাম কর। ঘুরে দেখতে চাইলে ঘুরে দেখ।
তুমি কি সত্যি আমাকে রেখে চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ যাচ্ছি।
একুশ তারিখে আমি তাহলে বিয়েটা করতে পারছি না?
না।
তোমাকে একটা আংটি দিয়েছিলাম। আংটিটা দেখছি না। ফেলে দিয়েছ নাকি?
হীরার আংটি ফেলে দেব কেন? কী বলছ তুমি! আংটি পরে কাজ করতে অসুবিধা হয়। এইজন্যে খুলে রেখেছি।
তোমাদের এখানে কি দুপুরের দিকে কোনো গাড়ি যায়?
না।
দুপুরে গাড়ি গেলে দুপুরে চলে যেতাম।
দুপুরে কোনো গাড়ি যায় না।
শেষ গাড়িটা ঢাকায় কখন যায়?
রাত দশটায়।
তাহলে একটা কাজ করি, রাত দশটার গাড়িতেই যাই। এই সময়ে তোমার যদি মন বদলায় সেটাও দেখে যাই! এমনও তো হতে পারে রাত দশটার সময় তুমি ঠিক করলে আমার সঙ্গে চলে যাবে। তখন তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম।
লীনা বলল, আমি যাচ্ছি। কোনো কিছুর দরকার হলে হোসেনকে বলবে। ও ব্যবস্থা করবে।
ফিরোজ বলল, তোমাদের এখানে নাপিত আছে? সময়ের অভাবে সেলুনে গিয়ে চুল কাটাতে পারছি না। এখন যখন কিছু ফ্রি টাইম পাওয়া গেছে-~~ ফ্রি টাইমটা কাজে লাগাই। হেয়ার কাট পাস মাখা ম্যাসাজ। নাপিত আছে?
লীনা বলল, নাপিত নেই। তবে হোসেনকে বললে সে খবর দিয়ে নিয়ে আসবে।
ফিরোজ বলল, তুমি হোসেনকে বলে যাও আমার সঙ্গে যেন দেখা করে।
নাপিত খবর দিয়ে আনার জন্যে ফিরোজের হোসেনকে দরকার নেই। হোসেনকে দিয়ে সে স্যারের কাছে বীনার চিঠিটা পাঠাবে। তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল বীনার চিঠির প্রয়োজন পড়বে না।
কী লেখা বীনার চিঠিতে? জানতে ইচ্ছা করছে, আবার জানতে ইচ্ছাও করছে না। হোসেনের হাতে চিঠিটা পাঠানো কি ঠিক হবে? সবচে ভালো হত সে নিজে যদি চিঠিটা নিয়ে যেত। সেটাও সম্ভব না।
ফিরোজ পুরোদিন একা কাটাল। লীনা দুপুরে খেতে এল না। সে নাকি সাইটে খাবে। হোসেন আলি তাঁবুর ভেতর ফিরোজের খাবার দিয়ে গেল। ফিরোজ বলল, হোসেন–চিঠি দিয়েছিলে?
হোসেন বলল, জ্বি।
ফিরোজ বলল, স্যার কি চিঠিটা পড়েছেন?
জানিনা। আমি উনার হাতে চিঠি দিয়া চইল্যা আসছি।
লীনার জন্যে তার মা একবাটি তরকারি পাঠিয়েছিলেন। তরকারিটা গরম করে লীনাকে দিতে হবে।
জ্বি আচ্ছা।
দুপুরের খাওয়ার শেষে ফিরোজ ঘুমুতে গেল। চারদিকের হৈহল্লার মধ্যে ঘুমানো মুশকিল। তবে দীর্ঘ সময় শব্দের ভেতরে বাস করছে বলে শব্দ এখন আর কানে লাগছে না। সে কোথায় যেন পড়েছিল— পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতায় ঘুম ভালো হয় না।
ফিরোজ ঘুমাল মরার মতো। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা। তাঁবুর ভেতর অন্ধকার হয়ে আছে। হোসেন আলি টি-পটে করে চা নিয়ে এসেছে।
হোসেন বিনীত গলায় বলল, এর আগেও দুইবার আসছি। ঘুমে ছিলেন, ডাক দেই নাই।
ফিরোজ বলল, ভালো করেছ। লীনা সাইট থেকে এখনো ফিরে নি?
হোসেন বলল, জি ফিরছেন। স্যারের তাঁবুতে আছেন। চা খাইতেছেন।
আমার এখানে কি এসেছিল?
বলতে পারি না।
বিকেল পাঁচটার গাড়ি কি চলে গিয়েছে?
অনেক আগে গেছে। অখন বাজে ছয়টা।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফিরোজ হালকা গলায় বলল, আচ্ছা দেখি তো হোসেন মিয়া—তোমার কেমন বুদ্ধি—এই ধাঁধার উত্তর কি হবে বল।
সংসারে এমন জিনিস কিবা আছে বল
লইতে না চাহে তারে মানব সকল।
কিন্তু তাহা সবে পাবে অতি আশ্চর্য,
বল দেখি বুঝি তব বুদ্ধির তাৎপর্য!
হোসেন তাকিয়ে আছে। মনে হল তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ফিরোজ বলল, সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সংসারে একটা জিনিস আছে যা কেউ চায় না। পিতা চায় না, মাতা চায় না, পুত্র-কন্যা চায় না। না চাইলেও সবাইকে সেই জিনিস গ্রহণ করতে হয়। কেউ বাদ যায় না।
বলতে পারব না।
ফিরোজ হালকা গলায় বলল, আচ্ছা যাও। বলতে না পারলে কী আর করা।
ফিরোজ অন্ধকারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। তার মাথায় আরো ধাঁধা আসছে। লীনা যখন ছোট ছিল-সেভেন এইটে পড়ত, তখন ফিরোজ তাকে ধাঁধা জিজ্ঞেস করত। লীনা প্রাণপণ চেষ্টা করত ধাঁধার জবাব দিতে। যখন দিতে পারত না তখন কেঁদে ফেলত। নিঃশব্দ কান্না না, ভেউ ভেউ করে বাড়িঘর ঝাঁপিয়ে কান্না। লীনার বড়ভাই সাব্বির ফিরোজের উপর রাগ করত। বিরক্তগলায় বলত, তুই সবসময় ওকে কাঁদাস কেন? জানিস ধাঁধার জবাব দিতে না পারলে সে কাঁদে। জেনেশুনে কঠিন কঠিন ধাঁধা।
ফিরোজ বলত, ধাঁধার জবাব দিতে না পারলে কাঁদবে কেন?
লীনা অন্য সবার মতো না। নরম স্বভাবের মেয়ে। এটা মাথায় রাখবি। যেসব ধাঁধার জবাব সে জানে সেসব জিজ্ঞেস করবি। দেখবি জবাব দিয়ে সে কত খুশি হয়। মানুষকে খুশি করার মধ্যে কি কোনো দোষ আছে?
না, দোষ নেই।
কথা দে, তুই কখনো লীনাকে কঠিন কোনো ধাঁধা জিজ্ঞেস করবি না।
আচ্ছা যা কথা দিলাম।
মনে থাকে যেন।
মনে থাকবে।
ফিরোজের মনে আছে। লীনাকে সে কখনোই কোনো কঠিন ধাঁধা জিজ্ঞেস করেনি। সমস্যা হচ্ছে যে মেয়ে কঠিন ধাঁধা পছন্দ করে না, সে নিজে ঝাপ দিয়ে কঠিন এক ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। এই ধাঁধার জবাব ফিরোজ ইচ্ছা করলে দিয়ে দিতে পারে। দেয়া ঠিক হবে না। কিছু কিছু ধাঁধার জবাব নিজেকে খুঁজে বের করতে হয়। এমনও হয় যে, খুব সহজ ধাঁধা কিন্তু জবাব খুঁজতে এক জীবন চলে যায়।
লীনা হাসানের সামনে বসে আছে।
হাসান কাপে কফি ঢালছে। এই কাজটা করা উচিত লীনার, কিন্তু সে করতে পারছে না। স্যার কফির পট হাতে নিয়ে নিয়ে কফি ঢালা শুরু করেছেন। সে তো এখন কেড়ে স্যারের হাত থেকে কফিপট নিয়ে নিতে পারে না। লীনা খুব অস্বস্তি বোধ করছে।
লীনা কেমন আছ বলো।
লীনা নড়েচড়ে বসল। কী অদ্ভুত প্রশ্ন! আজ সারাদিন তো সে স্যারের সঙ্গেই ছিল। ডায়নোসরে কীভাবে রঙ করা হয় দেখছিল। তাঁবুতে সে স্যারের সঙ্গেই এসেছে। স্যার বললেন, আমার সঙ্গে এসো তো লীনা। কিছুক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলি।
তখন থেকেই লীনার বুক ধ্বক ধ্বক করছে। স্যার তার সাথে কি কথা বলবেন? সে ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না। এখন বললেন, লীনা কেমন আছ বলো। লীনা কি বলবে সে ভালো আছে? নাকি চুপ করে থাকবে।
কফি খেতে কেমন হয়েছে লীনা?
ভালো হয়েছে স্যার।
ফিরোজ সাহেব যে এসেছিলেন, উনি কি চলে গেছেন?
পাঁচটার সময় চলে যাবার কথা, হয়তো চলে গেছেন। আমি খোঁজ নিইনি।
হাসান বলল, উনি যাননি। আমি খোঁজ নিয়েছি।
লীনা বলল, তাহলে স্যার উনি রাত দশটায় যাবেন।
হাসান বলল, একটা কাজ কর। তুমি তার সঙ্গে চলে যাও।
লীনা হতভম্ব গলায় বলল, আমি কোথায় যাব?
তোমার মার কাছে যাবে। সামনের মাসে তোমার বিয়ে। জঙ্গলে পড়ে থাকলে তো হবে না। বিয়ের আগে আগে কত কাজকর্ম আছে।
এখানে এতকিছু হচ্ছে, সব ফেলে আমি বাসায় চলে যাব?
হ্যাঁ যাবে। যে কাজকর্ম এখানে হচ্ছে তাতে তুমি তেমন কোনো সাহায্য করতে পারছ না। তোমাকে বেতনের স্টেটমেন্ট তৈরি করতে বলেছিলাম, সেটা কি করেছ? আমি লক্ষ্য করছি এখানে তোমার প্রধান কাজ হচ্ছে সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো। গত পরশু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমি সূর্যঘরে বসেছিলে। তাই না?
জি স্যার।
কেন বসেছিলে?
লীনা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমরা এত সুন্দর সুন্দর জিনিস বানাচ্ছি, এসব দেখতে আমার ভালো লাগে।
হাসান কঠিন গলায় বলল, হোসেনের কাছে শুনেছি সপ্তাহখানিক আগে রাত একটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত তুমি আমার তাঁবুর সামনে রাখা বেঞ্চটায় বসেছিলে। এটা কি সত্যি?
জি স্যার।
কেন বসেছিলে?
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ শেষরাতে উঠে। চাঁদ দেখার জন্যে বসেছিলাম।
তোমার ভাবুর সামনে বসে চাঁদ দেখা যায় না?
যায় স্যার।
তাহলে আমার ভাবুর সামনে বসে ছিলে কেন?
লীনা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, স্যার আমি আর কোনোদিন বসব না।
হাসান বলল, লীনা কাঁদবে না। তরুণী এক মেয়ে বাচ্চাদের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদছে— দেখতে ভালো লাগে না। কান্না বন্ধ কর।
কান্না বন্ধ করতে প্রাণপণ চেষ্টা লীনা করছে। পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। স্যার তার উপর রাগ করেছেন— এরচে মরে যাওয়া ভালো ছিল। ক্রেন দিয়ে বড় বড় স্ল্যাভ যখন নামাচ্ছিল তখন সে কেন দৌড়ে কোনো একটা স্লাভের নিচে দাঁড়াল না!
লীনা শশানো, তুমি এখানে তেমন কোনো কাজ করতে পারছ না। দীর্ঘদিন তুমি এখানে আছ, এটা খুবই সত্যি। একদিনের জন্যেও ছুটি নিয়ে ঢাকায় যাওনি তাও সত্যি। আমার কোনো কাজকর্মও যে এখানে করছ না ঢাকায় যাওনি তাও সত্যি। আবার কোনো কাজকর্মও যে এখানে করছ না তাও সত্যি। তুমি কি বুঝতে পারছ?
পারছি স্যার।
কাজেই তুমি ঢাকায় চলে যাও। মার সঙ্গে থাকো। বিশ্রাম কর। বিয়ের সময় কনের উপর দিয়ে অনেক মানসিক চাপ যায়। কাজেই বিয়ের কনের বিশ্রাম দরকার।
বিয়ের পর আমি কি আবার এসে কাজ শুরু করব?
না। বিয়ের পর জঙ্গলে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। স্বামীর সঙ্গে থাকবে। আসল কথা বলতে ভুলে গেছি–তুমি কি ইয়াকুব সাহেবের চা-এর কোনো নাম দিয়েছিলে?
জ্বি।
কী নাম?
এখন মনে পড়ছে না স্যার।
ইয়াকুব সাহেব তোমার নামটাই পছন্দ করেছেন। তার জন্যে তুমি নিশ্চয়ই বেশ ভালো এমাউন্টের একটা চেক পাবে। নতুন সংসার শুরু করার সময় টাকাটা কাজে লাগবে। কনগ্রাজুলেশনস।
আমি কি এখন চলে যাব স্যার?
হ্যাঁ।
কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে না?
না।
কয়েক দিন পরে যাই স্যার? নতুন কেউ আসুক, তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তারপর যাই। এই কদিন আমি তাঁবুর ভেতর থাকব। তবু থেকে বের হব না।
দায়িত্ব বুঝানোর কিছু নেই। তোমাকে এমন কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়নি যে আরেকজনকে বুঝাতে হবে। তুমি আজই যাবে।
জি আচ্ছা যাব। আজই যাব।
যাবার আগে ফিরোজ সাহেবকে আমার কাছে পাঠাবে। তার হাতে আমি একটা চিঠি দিয়ে দেব।
জ্বি আচ্ছা।
লীনা উঠে দাঁড়াল। তাঁবুর দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
জিজ্ঞেস কর।
জিজ্ঞেস করতে ভয়-ভয় লাগছে স্যার। আমি আপনাকে প্রচণ্ড ভয় পাই।
ভয় পাবার কিছু নেই। জিজ্ঞেস কর।
অনেক দিন থেকে দেখছি আপনার খুবই মন খারাপ। কেন মন খারাপ স্যার?
হাসান ক্লান্ত গলায় বলল, আমার ছেলেটা অসুস্থ। বেশ অসুস্থ। তার মা একা তাকে নিয়ে ডাক্তারদের কাছে ছোটাছুটি করছে। তার প্রচণ্ড দুঃসময়ে আমি পাশে থাকছি না। এইজন্যেই সারাক্ষণ মনটা খারাপ হয়ে থাকে। লীনা এখন তুমি যাও। আমি কাজ করব। কয়েকটা জরুরি চিঠি লিখতে হবে।
স্যার আপনি একটু সহজভাবে আমার দিকে তাকান। আমি আপাকে খুবই ভয় পাই। আপনি যেভাবে তাকিয়ে আছেন আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছে?
লীনা, তুমি যাও তো। এখন তুমি আমাকে বিরক্ত করছ।
হাসানের প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মাথার ভেতর দপদপ শব্দ হচ্ছে। তার উচিত ব্যথা কমাবার কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা। তবে তারও আগে চিঠিটা লিখে ফেলা দরকার। হাসান কাগজ কলম নিয়ে বসল—
কল্যাণীয়াসু বীনা,
তোমার চিঠিটা পড়লাম। এত সুন্দর করে এত গুছিয়ে এর আগে আমাকে কেউ চিঠি লিখেছে বলে আমার মনে পড়ে না। তোমার কথামতো তোমার অতিপ্রিয় বোনকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলাম। কাজটি করার জন্যে আমাকে রূঢ় আচরণ করতে হয়েছে। আমি বিষণ্ণ বোধ করছি। মানুষের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে আমি অভ্যস্ত না। এই আচরণ লীনার প্রাপ্য ছিল না।
আমি তোমার বোন এবং ফিরোজ সাহেবকে বিয়ে উপলক্ষে একটা গিফট দিতে চাই। আমি চাই না এরা কেউ জানুক গিফটটা কে দিয়েছে। তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। এই ব্যবস্থাটা তুমি অবশ্যই করতে পারবে।
গিফটটা কী তা বলার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলে নেই। আমি যখন বিয়ে করি তখন আমার হাতে কোনো টাকাপয়সা ছিল না। তারপরেও সাহস করে দুজনের জন্যে ঢাকা–কাঠমুণ্ডুর দুটা রিটার্ন টিকেট কিনে ফেলি। যেন আমাদের দুজনের জীবনের শুরুটা হয় বিশাল হিমালয়ের পাশে। শেষপর্যন্ত আমাদের নেপাল যাওয়া হয়নি। টাকাপয়সার এমন ঝামেলায় পড়লাম যে বলার না। বাড়িওয়ালা তিন মাসের ভাড়া পায়। ভাড়া না দিলে উচ্ছেদ করে দেবে এই অবস্থা। টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে এলাম। এরপর জীবনে অনেক অর্থ উপার্জন করেছি। পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি। কিন্তু রাগ করে হাতের কাছেই কাঠমুণ্ডু সেখানে যাই নি। আমি লীনা এবং তার বরকে কাঠমুণ্ডুর দুটা টিকিট, সেখানের সবচে ভালো হোটেলে সাতদিন থাকার ব্যবস্থা করে দিতে চাই। তোমার চিঠি পড়ে মনে হল আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা ভালো না। হয়তো তোমার ধারণা ঠিক। আমি নিজে যে নিজেকে সবসময় বুঝি তা না। তারপরেও বলব মায়ানগর সম্পূর্ণ হলে একবার এসে দেখে যেও। আমার মন বলছে মায়াগর দেখার পরে তুমি বলবে—লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম এত খারাপ তো সে না।
বীনা শোনো, যার ভেতর অন্ধকার থাকে সে আলো নিয়ে খেলতে পারে না। আমি সারাজীবন আলো নিয়েই খেলেছি। তারপরেও আমার ভুল হতে পারে। হয়তো তারাই আলো নিয়ে খেলে যাদের হৃদয়ে গভীর অন্ধকার।
তুমি ভালো থেকো। তোমার চিঠি খুব ভালো হয়েছে। এটা আবারো না বলে পারছি না।
হাসানুল করিম