রাত তিনটা।
ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। তরুদের বাসার সামনে আধমরা কাঁঠাল গাছের ডাল মড়াৎ করে ভাঙল। ভাঙা ভাল পড়ল ড্রাইভার, দারোয়ানদের একতলা টিনের চালে। তাদের হৈচৈ এবং বজ্রপাতের শব্দে খালেক জেগে উঠলেন। ইলেকট্রিসিটি নেই, চারদিক ঘন অন্ধকার। শুধু তরুর ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। খালেক মেয়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। ব্যাকুল গলায় বললেন, তরু কি হয়েছে রে মা? টেনশনের কারণে তিনি ভুলে গেলেন যে মেয়েকে ইদানীং তিনি পোশাকি নামে শামসুন নাহার ডাকছেন।
তরু দরজা খুলল। হাই তুলতে তুলতে বলল, তেমন কিছু হয় নি বাবা। ঝড়ে কাঁঠাল গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়েছে। এখন আর হৈচৈয়ের শব্দ আসছে না কাজেই সব ঠিক ঠিক। পশ্চিম রণাঙ্গন শান্ত।
খালেক বিস্মিত হয়ে বললেন, পশ্চিম রণাঙ্গন শান্ত মানে কি?
একটা উপন্যাসের নাম। লেখক জার্মান। তাঁর নাম এরিখ মেরিয়া রেমার্ক! তার আরও একটা বিখ্যাত বই আছে নাম থ্রি কমরেডস। এই বইটা পড়তে হলে বড় সাইজের টাওয়েল লাগে।
টাওয়েল লাগবে কেন?
বই পড়তে শুরু করলে খুব কাদতে হবে। এমনই কষ্টের বই। টাওয়েল লাগবে চোখের পানি মুছতে।
তুই রাত জেগে কি করছিস?
লিখছি।
কি লিখছিস?
একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস। এখন খুব ক্রিটিক্যাল জায়গায় আছি। এক স্বামী তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মারছেন। বেচারি ছটফট করছে আর তিনি বলছেন, সীমা! আর একটু কষ্ট করো। এক্ষুনি তোমার কষ্টের শেষ হবে। তুমি শান্তিতে ঘুমাবে। এই বলেই তিনি ঘুমপাড়ানি গান গাইতে শুরু করলেন—
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো
খাট নাই পালংক নাই পিঁড়ি পেতে বস।
খালেক বললেন, তোর তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যতই দিন যাচ্ছে তুই ততই তোর মার মতো হয়ে যাচ্ছিস।
মার মাথা খারাপ ছিল?
অবশ্যই ছিল।
কখনো তো বলো নি।
অসুখ-বিসুখের কথা কি বলে বেড়ানো ঠিক। তাছাড়া আমি নিজেও শুরুতে ধরতে পারি নি।
তরু বলল, বাবা আমার ঘরে এসে বসো। কিছুক্ষণ গল্প করি। চা খাবে? চা বানিয়ে আনি? চা খেতে খেতে বাপ-বেটিতে গল্প।
খালেক বললেন, শামসুন নাহার, তোমার আচার-আচরণ আমার কাছে মমাটেই ভালো মনে হচ্ছে না।
তরু বলল, বাবা আমাকে শামসুন নাহার ডাকার আর প্রয়োজন নেই। আমার বিয়ে ভেঙে গেছে। আনিস সাহেব বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন।
বলিস কি? গত পরশু না চায়নিজ খেতে গেলি। উলটপালট কি করেছিস?
তেমন কিছু করি নি। তবে উনার ধারণা আমি ডেনজারাস মেয়ে। আমাকে বিয়ে করলে পদে পদে বিপদে পড়তে হবে।
কেন এ রকম ধারণা হলো? কি সর্বনাশের কথা।
তরু বলল, এই প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না বাবা। তুমি মার কথা বলো।
খালেক বললেন, তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
তরু বলল, তাহলে পঙ্গু চাচার কথা বলো।
পঙ্গু চাচাটা কে?
ওসমান চাচা।
তাকে তুই পঙ্গু ডাকিস?
বাবা সরি। হঠাৎ হঠাৎ ডাকি।
খালেকের বিস্ময়ের সীমা রইল না। বিস্ময়ের প্রধান কারণ তরুর মা উনাকে হঠাৎ হঠাৎ ডাকত পঙ্গু ভাই। এই নিয়ে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে অনেক রাগারাগি করেছেন। সে হাসতে হাসতে বলেছে, আচ্ছা যাও এখন থেকে আর পঙ্গু ভাই ডাকব না। ডাকব গঙ্গু ভাই।
খালেক বললেন, গঙ্গু ভাইটা কি?
তরুর মা হেসে ভেঙে পড়তে পড়তে বললেন, গঙ্গু হচ্ছে পঙ্গুর কাজিন।
মহিলার কথাবার্তার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। তরু অবিকল তার মার মতো হয়েছে। তার কথাবার্তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। মা ছাড়া সংসারে বড় হয়েছে। কিছু সমস্যা তো হবেই। তাই বলে এতটা? তার বিয়ে ভেঙে গেছে বলে যা বলছে তাও মনে হয় ঠিক না। খালেক ঠিক করলেন সকালে নাশতা খেয়েই তিনি আনিসের কাছে যাবেন। গোলমাল কিছু হয়ে থাকলে ঠিক করবেন।
ঘরের মোমবাতি তলানিতে চলে এসেছে। তরু নতুন নোম আনতে গেছে। ফিরতে দেরি করছে। খালেক অস্থির বোধ করছেন।
বাবা নাও চা খাও। চা বানাতে গিয়ে দেরি করেছি।
মোমবাতি পাস নাই?
পেয়েছি। জ্বালাব না। অন্ধকারে তোমার সঙ্গে গল্প করব। বাবা তুমি জানো অন্ধকারে মিথ্যা কথা বলা যায় না।
জানি না তো। কে বলেছে?
সাইকিয়াট্রিস্টরা বলেন। পুলিশের যাবতীয় ইনটারোগেশন এই কারণেই রাতে হয়।
চা খেলে রাতের ঘুমের দফা রফা হবে তার পরেও খালেক চায়ে চুমুক দিলেন। মোম নিভে গেছে। হঠাৎ অন্ধকার হবার জন্যেই কি বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে?
তরু বলল, বাবা তোমার কাছে একটা ইনফরমেশন চাই। মামার বাড়ির কেউ কখনো এ বাড়িতে আসেন না কেন?
খালেক বললেন, সেটা তারা জানে কেন আসে না। তাদেরকে কোলে করে এ বাড়িতে আনার তো আমার দরকার নাই। আমি তাদের খাইও না, পরিও না। মোমবাতি জ্বালা। মোমবাতি ছাড়া অন্ধকারে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। নিজেকে চোর চোর লাগছে।
তরু মোমবাতি জ্বালাল আর তখনই বসার ঘরের দরজায় ডাকাত পড়ার মতো শব্দ হতে লাগল। দরজা ভেঙে ফেলার মতো অবস্থা।
খালেক উঠে গেলেন। মোমবাতি হাতে পেছনে পেছনে গেল তরু। দরজা খুলে দেখা গেল সনজু তার বোনকে নিয়ে এসেছে। বোন থরথর করে কাঁপছে। অপ্রকৃতস্থের মতো তাকাচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে।
খালেক বললেন, কি হয়েছে।
সনজু বলল, দুলাভাই মারা গেছেন।
কি সর্বনাশ, কখন মারা গেছে।
সন্জু বলল, কখন মারা গেছেন জানি না। এই মাত্র মোবাইলে খবর এসেছে। কে যেন তার পেটে ছুরি মেরেছে। লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেখানে মারা গেছেন।
খালেক হতভম্ব গলায় বললেন, ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো। চলো হাসপাতালে যাই। ধৈর্য ধরো। বিপদে ধৈর্যের মতো কিছু নাই।
ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। বৃষ্টি থামে নি। তরু বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছে। চারটার মতো বাজে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সকাল হবে। তরু ঠিক করেছে বারান্দায় বসেই আজ সকাল হওয়া দেখবে। একজন ঔপন্যাসিকের সকাল হওয়া দেখা খুব জরুরি। সে কখনো সকাল হাওয়া দেখে নি। তার ঘুম নটার আগে ভাঙে না। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠতেন। আয়োজন করে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির বারান্দায় বসে সূর্য ওঠা দেখতেন। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে বিখ্যাত সব কবিতা লিখতেন যেগুলি পাঠ্য হয়ে যেত।
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান
কবিতা ছাপিয়ে কাজের মেয়ের গলা পাওয়া গেল। আফা আপনে এইখানে, আমি সারাবাড়ি খুঁজতেছি। এত ঘটনা যে ঘটছে আমি কিছুই জানি না। ঝড়-তুফান যে হইছে হেই খবরও নাই। আফা মার্ডার নাকি হইছে?
হুঁ।
কেমন দেশে বাস করি দেখছেন আফা? পথেঘাটে মার্ডার। চা খাবেন আফা।
খেতে পারি।
গত কাইলই লোকটারে দেখছি চায়ের কাপে টোস্ট বিসকুট ড়ুবায়া চা খাইতেছে—আইজ মার্ডার। বারান্দায় বইসা আছেন কেন আফা, বৃষ্টির ছিট আসতাছে।
আসুক তুমি চা নিয়ে এসো।
সনজুদের বাসার দরজা খোলা। ভেতরে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। কেউ যেন সুইচ টিপে বাতি জ্বালাল। ঐ বাসায় কেউ নেই। সবাই হাসপাতালে। তাহলে বাতি কে জ্বালাবে? ঘরের ভেতর থেকে কুচকুচে কালো রঙের একটা বিড়াল এসে বারান্দায় আলোতে বসেছে। এই বিড়ালটাকে তরু আগে দেখেনি। মনে হচ্ছে ভৌতিক বেড়াল। বিড়ালটাই কি ঘরের ভেতরের বাতি জ্বালিয়ে বারান্দায় এসে আলোতে বসেছে? এডগার এ্যালেন পোর বিড়াল?
আফা! চা নেন। মোবাইলটা ধরেন। একটু পরে পরে বাজতাছে।
তরু চায়ের কাপ এবং মোবাইল হাতে নিল। কাজের মেয়ে বলল, কারেন্ট আসছে আফা। বারিন্দার বাতি জ্বালায়ে দিব?
তরু বলল, না।
সে চায়ের কাপে চুমুক দিল। বিড়ালটা তাকাচ্ছে তার দিকে। তরু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বেড়ালটাকে ঘিরে যে রহস্যময়তা তৈরি হয়েছিল তার অবসান হয়েছে। কারেন্ট এসেছে বলেই সনজুদের ঘরের বাতি জ্বলে উঠেছে। বেড়ালের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। তরুর মোবাইল টেলিফোন আবার বেজে উঠেছে।
সনজু হবার সম্ভাবনী। হত্যাকাণ্ড কিভাবে ঘটল তার বর্ণনা দেবার জন্যে সনজু নিশ্চয়ই ব্যস্ত হয়ে আছে। হত্যাকারী মৃতদেহের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করে। মুন্সিগঞ্জের হেমন্ত হয়তো হাসপাতালের সামনেই হাঁটাহাঁটি করছে। সনজু এক পর্যায়ে হেমন্ত বাবুকেও টেলিফোনে ধরিয়ে দিতে পারে।
তরু টেলিফোনের বোতাম টিপে বলল, হ্যালো কে?
ওপাশে ধরেছেন লেখক স্যার। তিনি থমথমে গলায় বললেন, তরু! তুমি এই কাজটা কেন করলে?
তরু বলল, কোন কাজটা স্যার?
কোন কাজটা তুমি জানো না? স্টুপিড মেয়ে।
গালাগালি করছেন কেন স্যার। লেখকের মুখে গালাগালি মানায় না। লেখকরা মিষ্টি করে কথা বলবেন। স্যার আপনি কল্পনা করুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কারো উপর রাগ করে বললেন—এই শালা। দূর হ! তখন কেমন লাগবে?
তরু! তুমি অতিরিক্ত চালাক সাজার চেষ্টা করছ। তোমাকে দোষ দিচ্ছি। এই সময়কার তরুণী মেয়েদের জেনারেল স্টাইল অতিরিক্ত চালাকি করা। তারা বন্ধুবান্ধবদের সামনে অবলীলায় বলবে—পাঁচটা মিনিট অপেক্ষা কর। আমি মুততে গেলাম। বলে বাথরুমে ঢুকবে এবং ভাববে অতি স্মার্ট একটা কাজ করা হলো।
ঠিক বলেছেন স্যার।
শোনো তরু! আমাকে উদ্ধার করো। আমার স্ত্রী যে কি সমস্যা তৈরি করেছে এবং ভবিষ্যতে কি ভয়ংকর কাজকর্ম করবে বা তোমার কল্পনাতেও নেই। আমার অনুরোধ তুমি আমাকে উদ্ধার করো।
কিভাবে উদ্ধার করব?
আমার স্ত্রীকে বলবে সবই তোমার সাজানো। তুমি একবার আমাকে প্রেম নিবেদন করেছিলে, আমি তখন খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম বলেই এইভাবে শোধ নিয়েছ।
বললেই বিশ্বাস করবেন?
অবশ্যই বিশ্বাস করবে। সে বিশ্বাস করার জন্যেই অপেক্ষা করছে। বিশ্বাস করা ছাড়া তার আর কোনো সেকেন্ড অপশন নেই।
স্যার আমি আজ দিনের মধ্যেই বলব।
থ্যাংক য়্যু। ফ্রম মাই হার্ট থ্যাংক য়্যু।
তরু বলল, স্যার আপনার সঙ্গে আমি যা করেছি তার জন্যে এখন লজ্জা লাগছে। আপনি চাইলে আমি কিছু নিরিবিলি সময় আপনার সঙ্গে কাটাব। এবার আর ম্যাডাম উদয় হবেন না। ঐ হোটেলেও যেতে পারি। আপনার নিশ্চয়ই বুকিং আছে। বুকিং আছে না স্যার?
হুঁ।
তরু গলা নামিয়ে বলল, ম্যাডাম স্বপ্নেও ভাববেন না যে ঘটনার পরদিনই আবার আপনি হোটেলে যাবেন এবং কাউকে ডেকে পাঠাবেন। স্যার আজ কি আসব?
তোমার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না।
স্যার বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। আপনি ইশারা করলেই আমি আসব।
আগে তুমি তোমার ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে তাকে ঠিক করে তারপর দেখা যাবে।
যদি কথা বলে ঠিক করতে পারি তাহলে কি আসব? কখন আসব বলুন?
বিকালের দিকে আসতে পারো If You really want that.
বিকাল মানে কখন? সময়টা বলুন।
হঠাৎ তুমি এত ব্যস্ত হলে কেন?
আপনার উপর যে অন্যায়টা আমি করেছি তার প্রতিকার করতে চাই। তাছাড়া স্যার, আমি আপনার চোখে তৃষ্ণা দেখেছি। লেখকের চোখের তৃষ্ণা খুব খারাপ জিনিস। চোখে তৃষ্ণা নিয়ে লেখক লিখতে পারেন না।
তুমি চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে চলে এসো।
থ্যাংক য়্যু স্যার।
তরু টেলিফোন নামিয়ে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে ভোরের আলো ফুটছে। তরু আগ্রহ নিয়ে ভোর হওয়া দেখছে।
খালেক বিকালের মধ্যে সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেললেন। ডাক্তারের রিপোর্ট, সুরতহাল, কবর দেয়ার জন্যে ওসি সাহেবের অনুমতি সব জোগাড় হয়ে গেল। আজিমপুর গোরস্থানে কবর দিয়ে তিনি বাসায় ফিরে মোটামুটি হাসিমুখে তরুকে বললেন, কড়া করে এক কাপ চা দে তো মা। চা খেয়ে গরম পানিতে হেভি গোসল দেব।
তরু বলল, বাবা! তোমাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে কেন?
খালেক বললেন, অস্বাভাবিক মৃত্যু কত ভয়াবহ এটা জানিস? নানান ফ্যাকড়া। পুলিশ থাকে টাকা খাওয়ার ধান্ধায়। তাদের সামাল দেয়া বিরাট ব্যাপার।
তরু বলল, তুমি An expert হেডমাস্টারের মতো সব ঝামেলা শেষ করে দিয়েছ? কনগ্রাচুলেশন।
খালেক সরু চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের তাকানোর ভঙ্গি, কথাবার্তার ভঙ্গি সবই কেমন অদ্ভুত লাগছে।
তরু বাবাকে চা এনে দিল। মগ ভর্তি চা। তরু বলল, আরাম করে চা খাও বাবা। গিজার কাজ করছে না। চুলায় গরম পানি হচ্ছে। দশ মিনিট পরেই গোসল করতে পারবে। এই দশ মিনিট আমার সঙ্গে গল্প করো।
কি গল্প করব?
পঙ্গু চাচা তোমার বাড়িতে কেন থাকেন? তার টাকা-পয়সা ভালোই আছে। তারপরেও এখানে কেন পড়ে আছেন। এই ব্যাপারটা বলো। খালেক বললেন, আজকের দিনে এইসব কথা কেন তুলছিস?
তরু বলল, প্রায়ই তুলতে চাই। ভোলা হয় না। অনেকগুলি খটকা নিয়ে বড় হয়েছি তো বাবা। খটকা ভালো লাগে না।
কি খটকা?
এই যেমন পঙ্গু চাচা এত জায়গা থাকতে তোমার বাড়ির ছাদে থাকেন কেন? এটা ছাড়াও খটকা আছে।
আর কি?
মার এবং খালা দুজনের মৃত্যুদিন তুমি ঘটা করে করো। মিলাদ হয়। কাঙালি ভোজ হয় এবং তোমার বিখ্যাত তওবা অনুষ্ঠান হয়। তওবার বিষয়টা আমি বুঝতে পারি না। তওবা কেন? তুমি কি বড় কোনো পাপ করেছ? ভালো কথা, পানি মনে হয় গরম হয়েছে। তুমি গোসল করতে যাও।
খালেক বাথরুমের দিকে রওনা হলেন। তিনি অপ্রকৃতস্থের মতো পা ফেলছেন। এক তলা থেকে শায়লার চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ আসছে। তার ঘরের দরজা-জানালা বন্ধু। তারপরেও আওয়াজ আসছে। বন্ধ দরজার সামনে সনজু মোড়ায় মাথা নিচু করে বসে আছে। মৃত মানুষের বাড়িতে আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেকে ভিড় করে থাকে। এই বাড়ি খালি। দুপুরে ভাড়া করা ট্যাক্সি করে দুই মহিলা এসেছিলেন। অল্প কিছুক্ষণ থেকে সেই ট্যাক্সিতেই বিদায় নিয়েছেন।
তরু বারান্দা থেকে সনজুকে ইশারায় ডাকল। সনজু আসছে। তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে নিতান্ত অনিচ্ছায় আসছে।
সনজু মাথা নিচু করে তরুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একবারও চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তরু বলল, মুন্সিগঞ্জের হেমন্ত বাবুর খবর কি? উনি ভালো আছেন?
সনজু জবাব দিল না।
তরু বলল, ঘটনা কি সেই ঘটিয়েছে?
সনজু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না।
তরু বলল, তোমার আপা একা কাঁদছেন। তুমি কাঁদছ না এটা কেমন কথা? কান্নাতেও সঙ্গী লাগে। আপার সঙ্গে কাঁদো। নকুল কান্না হলেও কাঁদো। তোমার আপা কিছুটা শান্তি পাবেন।
সনজু চলে যাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কাঁদবে। শরীর ফুলে ফুলে উঠছে।
তরু লেখকের স্ত্রীকে টেলিফোন করল। পাঁচ মিনিটের মাথায় ভদ্রমহিলা পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন যে লেখকের কোনো দোষ নেই। বাজে একটা মেয়ের পাল্লায় পড়ে এই সমস্যা হয়েছে। তিনি তরুকে ক্ষমা করে দিলেন। এবং বললেন, এ রকম কাজ সে আর যেন না করে। তরু কাঁদতে কাঁদতে বলল, আর কখনো করব না ম্যাডাম।
ম্যাডাম বললেন, তুমি একদিন বাসায় এসে আমার সঙ্গে এক কাপ চা খেয়ে যাবে।
তরু বলল, জি আচ্ছা ম্যাডাম।
আমি তোমাদের মতো মেয়েদের সমস্যাটা যে বুঝি না, তা-না। বুঝি। ওর লেখা পড়ে মাথা ঠিক থাকে না। না থাকাই স্বাভাবিক। ঠিক আছে কান্না বন্ধ করো। আমি পুরোপুরি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
তরু এরপর টেলিফোন করল আনিসকে। মিষ্টি করে বলল, আমি তরু।
আনিস বলল, নাম বলতে হবে না। টেলিফোনে তোমার নাম্বার উঠেছে। বলো কি ব্যাপার।
আপনি কি আমার ছোট্ট একটা কাজ করে দেবেন?
কি কাজ?
আমার স্বামী হিসেবে পাঁচ মিনিট অভিনয় করতে পারবেন?
আনিস বলল, রহস্য করবে না। কি বলতে চাও পরিষ্কার করে বলো।
ঐ দিন যে লেখক স্যারের কাছে গিয়েছিলাম তার কাছে আবার যাব। আপনাকে নিয়ে যাব। আপনাকে দেখিয়ে লেখক স্যারকে বলব যে উনি আমার হাসবেন্ড। আমরা দুজন আপনার দোয়া নিতে এসেছি। তারপর দুজন মিলে তাকে কদমবুসি করব।
আনিস কঠিন গলায় বলল, তোমার কোনো পাগলামির সঙ্গে আমি যুক্ত থাকতে চাচ্ছি না। তুমি দয়া করে আর কখনো আমাকে টেলিফোন করবে না।
জি আচ্ছা। আংটিটা ফেরত নিতে আসবেন না?
আংটি তুমি নর্দমায় ফেলে দাও।
তরু বলল, এরকম কঠিনভাবে কথা বলছেন কেন? সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেই যে কঠিন কঠিন কথা বলতে হয় তা তো না। আমরা বন্ধুর মতো থাকতে পারি। আপনার যে কোনো সমস্যায় আমি থাকব। আমার সমস্যায় আপনি থাকবেন।
আনিস বলল, তোমার কি ঐ লেখকের কাছে যেতেই হবে?
তরু বলল, হ্যাঁ।
আনিস বলল, কখন?
বিকাল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে।
আনিস বলল, ঠিক আছে আমি আসছি। স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করে আসব।
তরু বলল, সত্যিকার স্বামী হিসেবে গেলে কেমন হয়। প্রথমে আমরা দুজন কাজি অফিসে গেলাম, বিয়ে করলাম। সেখান থেকে গেলাম লেখক স্যারের কাছে। আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম উনি আমার হাসবেন্ড। এর বড় একটা সুবিধা আছে।
কি সুবিধা?
লেখক স্যারকে মিথ্যা কথা বলতে হলো না। লেখকদের কাছে মিথ্যা বললে পাপ হয়। আমি জানি আপনি রাজি না। কিন্তু একটা কথা বললেই আপনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাবেন।
আনিস অবাক হয়ে বলল, এমন কি কথা যে বললেই আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাব।
তরু বলল, কথাটা খুবই সাধারণ।
আনিস বলল, সাধারণ কথাটা শুনি?
তরু বলল, বলতে আমার লজ্জা লাগছে। তারপরেও বলি। আমি রাতে যখন ঘুমুতে যাই তখন আমার বালিশের পাশে একটা বালিশ রেখে দেই। এবং কল্পনা করি—সেখানে মাথা রেখে তুমি শুয়ে আছ।
তরু টেলিফোন ধরে আছে। ওপাশ থেকে কেউ কথা বলছে না। পৃথিবী হঠাৎ শব্দহীন হয়ে গেছে। তরু বলল, তুমি আছ না চলে গেছ?
আনিস বলল, তোমাদের বাড়ির পাশেই তো একটা কাজি অফিস আছে। আছে না?
তরু বলল, আছে। আমি কি শাড়ি পরে রেডি হব?
হ্যাঁ।
তরু কাঁদছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এই কান্না মিথ্যা কান্না না। তার কান্নার শব্দে খালেক ছুটে এসে বললেন, মা কি হয়েছে?
ভুরু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, বাবা আজ আমার বিয়ে। কাজি অফিসে বিয়ে হচ্ছে। তুমি তৈরি হও। তুমি এবং পঙ্গু চাচা বিয়ের সাক্ষী।
খালেক বললেন, কার সঙ্গে বিয়ে?
তরু চোখ মুছতে মুছতে বলল, জানি না।