জাহানারাকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর বয়স কমে গেছে। চোখ-মুখ উজ্জ্বল। মুখের চামড়ায় খসখসে ভাব নেই। চোখের নিচে কালি পড়ে থাকত। সেই কালি দূর হয়েছে। পিঙ্গল চুলে কালচে ভাব এসেছে। শুভ্র চশমার ভেতর দিয়ে খুব আগ্ৰহ নিয়ে মার দিকে তাকিয়ে আছে। জাহানারা বললেন, এই তুই কী দেখছিস?
শুভ্ৰ চোখ থেকে চশমা নামিয়ে নিয়ে চশমার কাচ পরিষ্কার করতে করতে বলল, তোমাকে দেখছি।
আমাকে দেখার কী আছে?
অনেক কিছুই আছে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার বয়স কমে গেছে।
বয়স আবার কমবে কী? তুই সব সময় পাগলের মত কথা বলিস।
শুভ্র চশমা চোখে দিয়ে পরীক্ষকের চোখে মার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাসিমুখে বলল, সত্যি তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার বয়স কমেছে এবং তুমি আনন্দে আছে।
জাহানারা রাগী গলায় বললেন, আনন্দে থাকব কেন? আনন্দে থাকার মত কিছু হয়েছে?
অবশ্যই হয়েছে। মানুষের জন্মই হয়েছে আনন্দে থাকার জন্যে। কাজেই আনন্দে থাকাটা অপরাধ না। নিরানন্দে থাকাটাই অপরাধ।
তাহলে তুই নিরানন্দে থাকিস কেন? তোকে দেখেই মনে হয় তোর জন্ম হয়েছে নিরানন্দে থাকার জন্যে। সারাক্ষণ মুখ ভোতা করে বসে থাকিস। আর শোন, এই বিশ্ৰী অভ্যাসটা করেছিস কবে থেকে? দেখলেই রাগ লাগে।
কোন অভ্যাসটার কথা বলছ?
এই যে একটু পরপর চোখ থেকে চশমা হছিল। চশমার কাচ ঘষাঘষি করছিস।
শুভ্র আগ্রহী গলায় বলল, তুমি সারাক্ষণই আমার দিকে তাকিয়ে থাক। তাই না মা? আমি কী করছি না করছি কিছুই তোমার চোখ এড়ায় না। ঠিক বলছি?
জাহানারা কিছু বললেন না; শুভ্রর খাটে এসে বসলেন। এখন বাজছে বিকেল তিনটা। এই সময়টা রোজই তিনি ঘুমুতেন। কিছুদিন হল দুপুরের ঘুম না হয়ে ভালই হচ্ছে। গল্প গুজব করার সময় পাওয়া যাচ্ছে। শুভ্রর সঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে তার কথা বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বলা হয় না। কেন জানি ছেলেকে তিনি আজকাল সামান্য ভয়ও পান। তারপরেও এই কদিনে গুটুর গুটুর করে অনেক গল্প করে ফেলেছেন। ছোটবেলায় সিলেটে থাকতেন। একবার চা বাগানে বেড়াতে গিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন। তাঁকে খুজে পাওয়া গেল রাত দশটায়। সন্ধ্যার দিকে তাঁর খুবই ভয় লাগছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত কারণে ভয় কমতে লাগল। এইসব হাবিজাবি গল্প। শুভ্ৰ গল্পগুলি শুনেছেও খুব আগ্রহ নিয়ে। আজও মনে হয় সে রকম হবে। শুভ্র খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। আজ কি গল্প করা যায়?
শুভ্র।
বল।
তোকে কদিন ধরেই খুব জরুরি একটা কথা বলব বলে ভাবছি।
বলে ফেল।
তুই আবার রাগই করিস কি-না সেটাই আমার ভয়।
শুধু শুধু রাগ করব কেন?
বিরক্তও হতে পারিস।
যা বলতে চাচ্ছ চট করে বলে ফেল।
জাহানারা এতক্ষণ পা বুলিয়ে খাটে বসেছিলেন, এখন পা তুলে বসলেন। শুভ্র হাসি হাসি মুখে মার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখের ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে সে জানে মা কোন প্রসঙ্গে কথা বলবেন।
বিনুর বিয়ে ঠিক হয়েছে জানিস না-কি?
না জানি না।
আমিও জানতাম না। অথচ বিয়ে সব ঠিক ঠাক। শ্রাবণ মাসে বিয়ে। ছেলে স্কুল টিচার। ছেলের গ্রামের বাড়িতেই স্কুল। ছেলের জমিজমা আছে। মনে হয় বেশ অবস্থা সম্পন্ন।
ভালতো।
জাহানারা শুভ্রর দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, সব ঘটেছে আমার নাকের ডগার সামনে। অথচ আমি কিছুই জানতে পারি নি।
তোমার এত বুদ্ধি কোনো কাজে এল না?
আমার এত বুদ্ধি মানে? ঠাট্টা করছিস?
মোটেই ঠাট্টা করছি না। আমার ধারণা তোমার অনেক বুদ্ধি। যে নিজেকে যত বেশি আড়াল করে রাখতে পারে তার তত বেশি বুদ্ধি। তুমি শুধু যে নিজেকে আড়াল করে রাখ। তাই না, আমাকেও আড়াল করে রাখ। কাজেই তোমার ডাবল বুদ্ধি।
তুই তোর জ্ঞানের কথাগুলি বন্ধ করা।
বন্ধ করলাম।
শুভ্ৰ আবার চোখ থেকে চশমা খুলেছে; জাহানারা বিরক্ত মুখে ছেলের কাণ্ড দেখছেন। বিনুর ব্যাপার নিয়ে ছেলের সঙ্গে মজা করে কিছু কথা বলবেন ভেবেছিলেন, মনে হচ্ছে শুভ্রর তেমন উৎসাহ নেই। গল্প ঠিকমত শুরু হলে ছেলের উৎসাহ তৈরি হতে পারে। জাহানারা আবারো গল্প শুরু করলেন–
বুঝলি শুভ্ৰ, আমিতো বিনু মেয়েটাকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। যে ছেলেটার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা ফাইনাল হয়েছে সেই ছেলে এই বাসায় এসেছে মেয়ে দেখার জন্যে। বিনু তাকে চা বানিয়ে দিয়েছে। বোম্বাই টেস্ট বানিয়ে দিয়েছে। অথচ আমি কিছুই জানি না। মেয়ে আমাকে কিছুই বলে নি।
তুমি জানলে কীভাবে?
মেয়ের বাবার চিঠিতে সব জানলাম। ইন্টারেস্টিং চিঠি। পড়বি?
শুভ্র কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে বলল, দাও চিঠি পড়ে জাহানারা বললেন, চিঠি কি আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি? আমার ড্রয়ারে আছে। ড্রয়ার থেকে আনতে হবে।
শুভ্র বলল, চিঠি তোমার সঙ্গেই আছে মা। আমাকে চিঠিটা পড়বার জন্যেই তুমি এখন এসেছি। চিঠি তোমার আঁচলে বাধা।
শুভ্ৰ মিটিমিটি হাসছে। জাহানারা খুবই বিব্রত বোধ করছেন। ছেলের হাতে ধরা পড়া লজার ব্যাপার। এই লজার হাত থেকে বাঁচার উপায় দ্রুত খুঁজে বের করতে হবে। মাথায় কিছু আসছে না। জাহানারা হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ঠিকইতো। চিঠিটা পড়ে যে আঁচলে বেঁধে ছিলাম ভুলেই গেছি! নে পড়ে দেখ।
জাহানারা তীব্র দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখছেন। চিঠি পড়তে পড়তে ছেলের মুখের ভাবে কিছু পরিবর্তন হবে বলে তিনি আশা করছেন। এই পরিবর্তনগুলি তিনি দেখতে চান।
অতি সম্মানীয়া
ভাবি সাহেবা,
আসসালাম। পর সমাচার আশা করি সর্বাঙ্গীন কুশল। আপনাকে একটি আনন্দ সংবাদ দিবার জন্যে আমি অধম হাতে কলম নিয়াছি। যদিও উচিত ছিল নিজে আসিয়া আপনাকে কদম বুসির মাধ্যমে সংবাদ দেয়া। বাত ব্যাধির প্রবল সংক্রমণের কারণে তাহা না পারিয়া বড়ই মনঃকষ্টে কালান্তিপাত করিতেছি।
এক্ষণে আনন্দ সংবাদটি বলি– আমার বড় কন্যা বিনুর বিবাহ ইনশাল্লাহ ঠিক হইয়াছে। পাত্র স্কুল শিক্ষক, সদবংশ জাত। পিতামাতার এক সন্তান। আল্লাহপাকের অনুগ্রহে তাহার বিষয় সম্পত্তি ভাল। স্কুল শিক্ষকতা না করিলেও তাহার দুই বেলা শাকান্ন খাইবার সামর্থ্য আছে। ছেলে দেখতেও মাশাল্লাহ খারাপ না।
জনাব মোতাহার হোসেন ভাই সাহেবকে আনন্দ সংবাদটি দিতে পারিলাম না ইহা আমার জন্য অতিব বেদনাদায়ক। কারণ উনি একবার আমাকে খবর দিয়া অফিসে নিয়া গিয়াছিলেন। সেই সময় আমি কন্যার বিবাহ নিয়া খুব পেরেসানির মধ্যে ছিলাম। ভাই সাহেব চা পান দিয়া আমাকে বিশেষ রকম যত্ন করিবার পর বলিলেন- বিনুর বিবাহ নিয়া তুমি চিন্তা করিও না। তোমার কন্যার বিবাহের দায়িত্ব আমার। আমি তার অতি ভাল বিবাহ দিব। ছেলে তোমার এবং তোমার কন্যার পছন্দ হবে।
আজ বড়ই আফসোস উনি জীবিত নাই। সবই আল্লাহপাকের বিধান এবং উনার হিসাব যাহা আমরা অতি ক্ষুদ্র মানুষ বুঝিতে পারি না। কারণ উনার বিধান এবং হিসাব বোঝা অতি জটিল।
যাহা হউক ভাবি সাহেবা, আপনি আমার মেয়েটিকে একটু খাস দিলে দোয়া করিবেন। বিনু সর্বদাই আপনার কথা বলে। সে আপনার কথা যত বলে নিজ মাতার কথাও তত বলে কি-না। এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
বাবা শুভ্ৰকে আমার আন্তরিক দোয়া এবং স্নেহশীষ দিবেন। শেষবার যখন তাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে তখন তাহার মধুর ব্যবহারে বড়ই শান্তি লাভ করিয়াছিলাম। অল্প বয়সে পিতৃহীন হইয়া সে বড়ই মনস্তাপে পতিত হইয়াছে। ইহাও অতিব আফসোসের বিষয়। আল্লাহপাকের সমস্ত কাজের পিছনে মঙ্গল থাকে। ইহা ভাবিয়াই শান্তি পাইতে হইবে।
ভাবি সাহেবা, পত্রের ভুলত্রুটি মার্জনীয়। বাবা শুভ্ৰকে আমার আন্তরিক স্নেহশীষ দিবেন। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
আপনার স্নেহধন্য নাদান
হাবীবুর রহমান
শুভ্ৰ চিঠি শেষ করে মার দিকে তাকাল। জাহানারা বললেন, কিছু বলবি?
শুভ্ৰ বলল, না, কী বলব? বিনু চা বানিয়ে দিয়েছে, বোম্বাই টেষ্ট বানিয়েছে—এসব কথাতো চিঠিতে কিছু পেলাম না।
এই খবর আমি অন্য সোর্সে পেয়েছি। এখন তুই বল চিঠিটা পড়ে তোর কাছে খটকা লাগে নি?
উঁহু। খটকা লাগার মত কিছু কী আছে?
অবশ্যই আছে। আমারতো ধারণা পুরো চিঠিতে বানিয়ে বানিয়ে অনেক মিথ্যা কথা বলা। বাপটা মেয়ের মতই মিথ্যাবাদী।
আমার সে রকম মনে হচ্ছে না মা।
জাহানারা শীতল গলায় বললেন, চিঠিতে লেখা শেষবার যখন তোর সঙ্গে দেখা তখন তুই অনেক যত্ন টত্ব করেছিস। মধুর ব্যবহার করেছিস। মধুর ব্যবহার করা তোর ধাতে নেই। মনে করে দেখতো তুই কী করেছিলি? পিঠ চুলকে দিয়েছিস না মাথা মালিশ করেছিস?
শুভ্ৰ মাথার চুল টানতে টানতে বলল, কী করেছি মনে পড়ছে না। হয়ত হাসি মুখে তাকিয়েছি। হয়ত বলেছি- আপনি কেমন আছেন। এতেই বেচারা মহাখুশি হয়েছে। কিছু মানুষ আছে খুব অল্পতে খুশি হয়।
তোর বাবা তাকে খাতির করে অফিসে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গেল। বিতং করে বলল, মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে। এটা আরেকটা মিথ্যা না? লোকটা মারা গেছে এখন তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তা বলা যায়। সত্য মিথ্যা যাচাই করার উপায় নেই। তোর বাপিতো আর কবর থেকে উঠে এসে বলবে না— ইহা মিথ্যা।
মৃত একজন মানুষকে নিয়ে উনি শুধু শুধু মিথ্যা কথা কেনই বা বলবেন?
যার মিথ্যা বলার অভ্যাস সে মৃত মানুষ নিয়েও বলবে, জীবিত মানুষ নিয়েও বলবে।
শুভ্র বলল, আমার নিজের ধারণা ভদ্রলোক সত্যি কথাই বলছেন। বাবা নিশ্চয়ই চাচ্ছিলেন বিনু মেয়েটার ভাল একটা বিয়ে দিতে।
কার সাথে বিয়ে দেবে? তোর বাবা কি কোলে পাত্র নিয়ে বসে ছিল?
শুভ্ৰ হাসি মুখে বলল, একটা পাত্র বাবার হাতে অবশ্যই ছিল। আমি ছিলাম। আমি মোটামুটি নিশ্চিত বাবা বিনু মেয়েটাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন।
জাহানারা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শুভ্ৰ এত সহজে এমন ভয়ঙ্কর একটা কথা বলে ফেলতে পারে এটা তার ধারণার মধ্যেই নেই। তার মনে হল তিনি ভালমত নিঃশ্বাসও নিতে পারছেন না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, শুভ্র তুই এমন উদ্ভট একটা কথা কী করে বললি?
শুভ্র বলল, মা আমি যথেষ্ট পরিমাণে উদ্ভট একটা ছেলে। যে কথাটা তোমার কাছে খুব উদ্ভট মনে হয়েছে তার চেয়ে অনেক উদ্ভট কথা আমি মাথায় নিয়ে ঘুরি। অন্য কেউ তাতে খুব কষ্ট পেত, আমি তেমন কষ্টও পাই না।
জাহানারা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তুই কী কথা মাথায় নিয়ে ঘুরিস? আরেক দিন বলব মা। আজ থাক।
না। আজই বল। এখনি বল।
উঁহু, আজ বলব না। আজ তুমি খুবই রেগে গেছ। তোমার রাগ আজ আর বাড়ব না। কফি খেতে ইচ্ছা করছে। কফি খাবার ব্যবস্থা করতো মা।
জাহানারা যেমন বসে ছিলেন তেমনই বসে রইলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন- এক পলকের জন্যেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন না। শুভ্র বলল, মা শোন আমি যা বলি খুব চিন্তা ভাবনা করে বলি। একটা কিছু আমার মনে এল আর আমি হুট করে বলে ফেললাম তা কিন্তু কখনো হয় না। আমার ধারণা আমি আমার এই অভ্যাস পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। বাবাও খুব চিন্তা ভাবনা করতেন। তাঁকে দেখে তা মনে হত না। তিনি যে বিনুর সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তার সলিড গ্রাউন্ড ছিল। সে সম্পর্কে জানতে চাও?
জাহানারা বললেন, না, জানতে চাই না। এক সংসারে এতগুলি জ্ঞানী হবার দরকার নেই। তুই জ্ঞানী হয়েছিস, মহাজ্ঞানী অতীশ দীপঙ্কর হয়েছিস— এই যথেষ্ট।
শুভ্র বলল, বাবা কী কারণে ভদ্রলোককে তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন এটা তুমি শুনলে তোমার রাগ একটু কমবে।
আমার রাগ কমানোর জন্যে তোকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি এমন কেউ না। আমার রাগে করে কোনো ক্ষতি হবে না।
শুভ্র মাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিজের মনের কথা বলে যেতে লাগল। জাহানার খুব চেষ্টা করলেন ছেলে কী বলছে না বলছে সেদিকে নজর না দিতে। তা পারলেন না। তাঁকে ছেলের কথা খুব মন দিয়ে শুনতে হল।
শুভ্র বলছে— বুঝলে মা, বাবা ছিলেন দারুণ চিন্তাশীল মানুষ। যে-কোনো সমস্যা তিনি নানা দিক দিয়ে ভেবে একটা সমাধানে আসতেন। এ ধরনের গুণ খুব কম মানুষের থাকে। পৃথিবীতে বড় বড় বিজ্ঞানী যারা ছিলেন তাঁদের সবারই এই গুণ ছিল। সমস্যাকে তারা জটিল অঙ্ক মনে করতেন। তারপর শুরু হত অঙ্কের সমাধান। অঙ্কের একটাই কিন্তু সমাধান। সেই সমাধানে নানানভাবে পৌঁছানো যায়। বিজ্ঞানীয়া প্রতিটি সমাধান পরীক্ষা করে দেখেন। বাবাও ছিলেন ঠিক তাদের মত। বাবা দেখলেন, তার ছেলে শুভ্রর এমন একটি মেয়ে দরকার যে শুভ্ৰর ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাবে না। শুভ্রর বাবা কী ছিলেন তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তগ্রস্ত হবে না। পৈত্রিক সূত্রে শুভ্র কী পেল তা নিয়ে চিন্তিত হবে না। মেয়েটির সমগ্ৰ চেতনায় শুধু মানুষ শুভ্ৰ থাকবে। আর কিছু থাকবে না। সে হবে শুভ্রর ছায়া, শুভ্রর সঙ্গে থাকতে পারায় আনন্দেই সে আনন্দিত হবে। বাবা আমার ব্যাপারে কোনো রিসক নিতে রাজি হন নি। বিনু হচ্ছে এমন একটি মেয়ে যাকে নিয়ে কোনো রিসক নেই।
জাহানারা বললেন, তুই তোর বাবাকে পুরোপুরি বুঝে ফেলেছিস?
শুভ্র বলল, না। উনি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত জটিল। এত সহজে তাকে বোঝা যাবে না। তবে আমি চেষ্টা করছি। মা তুমি শুনে হয়ত খুশি হবে। আমি আগামী সপ্তাহ থেকে বাবার অফিসে নিয়মিত বসব বলে ঠিক করেছি।
জাহানারা ছেলেকে দেখছেন। এইতো মোটা কাচের চশমা পরা ছেলে। মাথাভর্তি চুল। সেই চুল হাওয়ায় উড়ছে। অনেক দূরে বসেও তিনি ছেলের গায়ের গন্ধ পাচ্ছেন। অথচ ছেলেকে চিনতে পারছেন না। নিজের ছেলে তাঁর কাছে অচেনা হয়ে গেছে।
কতদিন পর বাবার অফিসে এসেছে তা শুভ্ৰ মনে করতে পারছে না। শুধু মনে হচ্ছে অনেক দিন পর এসেছে। ছোটবেলায় প্রায়ই আসত। খুব বুড়ো এক ভদ্রলোক তাকে রিকশা করে স্কুল থেকে অফিসে নিয়ে আসতেন। তিনি কড়া গন্ধওয়ালা জর্দা খেতেন। জর্দার গন্ধে শুভ্ৰর মাথা ধরে ফ্ৰেত। আবার গন্ধটা ভালও লগত। অতিরিক্ত জর্দা এবং অতিরিক্ত পান খাওয়ার জন্যে ভদ্রলোকের জিহ্বা মোটা হয়ে গিয়েছিল। তিনি শুভ্ৰ বলতে পারতেন না। শুভ্ৰকে বলতে—শুবরু।
রিকশায় আসার সারা পথ তিনি শুবরুর সঙ্গে গল্প করতেন। হাত টাত নেড়ে গল্প। যেন শ্রোতা শুধু শুভ্ৰ একা না, আরো অনেকে। অধিকাংশ গল্পই ধর্ম বিষয়ক।
বুঝলা শুবরু, দুই ফিরিস্তা ছিল নাম হারুত আর মারুত। দুইজনেই ছিল বড় পবিত্র।
পবিত্র কী?
পবিত্র বুঝলা না? যেটা নোংরা ময়লা সেটা অপবিত্র, যেটা পরিষ্কার সেটা পবিত্র। এই যে তুমি সুন্দর জামা কাপড় পরে রিকশায় বসে আছা তুমি পবিত্র? তুমি যদি রিকশায় না বসে নর্দমার দূষিত পানিতে বসে থাকতা তুমি হইতা অপবিত্র।
দূষিত পানি কী?
দূষিত পানি হইল অপবিত্র পানি। পবিত্ৰ পানি হইল টলটলা পানি।
টলটলা পানি কী?
টলটলা পানি হইল…
বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ধৈর্য ছিল সীমাহীন। তিনি ব্যাখ্যা করতে করতে গল্প নিয়ে এগুতেন। শুভ্ৰ তাকে কখনোই বিরক্ত হতে দেখে নি। ধৈর্যহারা হতে দেখে নি। ভদ্রলোক তাকে অফিসে এনে চেয়ারে বসাতেন। রিকশা থেকে নামিয়ে চেয়ারে বসানো কাজটা করতে তার কষ্ট হত। কারণ শুভ্ৰকে তিনি কোল থেকে নামাতেন না। শুভ্ৰ যতই বলত আমি হেঁটে যেতে পারব তিনি বলতেন, অবশ্যই পারব্বা, কেন পারব না? তুমি যেমন হেঁটে যেতে পারব আমিও তেমন কোলে করে নিতে পারব।
শৈশবে শুভ্ৰকে প্রায়ই সন্ধ্যা পর্যন্ত বাবার অফিসে থাকতে হত। জাহানারা বেশির ভাগ সময় খুবই অসুস্থ থাকতেন। কোনো একটা অপারেশন হয়েছে যে কারণে হাসপাতালে, কিংবা অপারেশন ছাড়াই হাসপাতালে। মোতাহার সাহেবের হাসপাতাল ভীতি ছিল। তিনি কিছুতেই ছেলেকে হাসপাতালে পাঠাতেন না। হাসপাতাল কাউকে একবার ছয়ে দিলে তাকে বারবার হাসপাতালে যেতে হয়। মোতাহার সাহেব এই তথ্য মনেপ্ৰাণে বিশ্বাস করতেন।
অফিস ঘিরে বসে থাকতে শুভ্রর খুব খারাপ লাগত না। বৃদ্ধ ভদ্রলোক নানানভাবে শুভ্ৰকে ব্যস্ত রাখতেন। বেশির ভাগই গল্প বলে—
বুঝলা শুবরু সাইন্ধ্যাকালে আসমানে যে তারা দেখা যায়। তার নাম জান?
ইভিনিং স্টার?
হয়েছে। বাংলায় বলে শুকতারা। আরবিতে বলে- আয জোহরা। আসলে এটা তারা না।
এটা কী?
আয জোহরা হল এক আরব রমণী। সে মস্ত বড় একটা পাপ করেছিল বলে তাকে তারা বানায়ে আকাশে ঝুলায়ে দেয়া হয়েছে। তার জন্যে শাস্তি।
কে ঝুলায়েছে?
কে আবার? আল্লাহপাক ঝুলায়েছেন। রোজ হাশর পর্যন্ত তাকে এইভাবে ঝুলে থাকতে হবে।
রোজ হাশর কী?
রোজ হাশর হল মহাবিচারের দিন।
মহাবিচার কী?
মহাবিচার হল আল্লাহপাকের বিচার…. উনার বিচারকে ভয় পাবার কিছু নাই। উনি দয়ালু বিচারক। অপরাধ করলেও উনি ক্ষমা দিয়ে দেন। সবাই তাঁর কাছে মাফ পায়। নামেই তিনি বিচারক, আসলে তিনি ক্ষমারক।
ক্ষমারক কী? যিনি ক্ষমা করেন। তিনিই ক্ষমারক।
বৃদ্ধ শুভ্রর সকল প্রশ্নের জবাবই হয়ত দিতেন, কিন্তু তিনি এক বর্ষাকালে অসুখে পড়ে গেলেন। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল সর্দি জ্বর। বৃষ্টি পানি বৃদ্ধদের সহ্য করে না। বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা লেগেছে। পরে দেখা গেল ব্যাপার তারচেয়েও জটিল। এক সময় ডাক্তাররা সন্দেহ করলেন ক্যানসার। বৃদ্ধ মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে শয্যা গ্রহণ করলেন। এবং তিনটি জিনিশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন—
মৃত্যু
জর্দা ভর্তি পান
এবং
শুভ্র
জর্দা দিয়ে পান তাঁর জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন শেষ সময়ে দয়াপরবশ হয়ে কেউ হয়ত মুঠো ভর্তি জর্দা দিয়ে এক খিলি পান বানিয়ে তাকে দেবে। শুভ্ৰকে তার কাছে আসতে দেয়া হবে না, এটা কখনো ভাবেন নি। দিনের পর দিন তিনি খবর পাঠাতেন— পাঁচ মিনিটের জন্যে কি শুভ্ৰকে তার কাছে পাঠানো যায়। মাত্ৰ পাঁচ মিনিট। তিনি ছেলেটার সঙ্গে দুটা কথা বলবেন। এর বেশি কিছু না।
জাহানারা ক্যানসার রোগীর কাছে ছেলেকে পাঠানোর চিন্তা এক সেকেন্ডের জন্যেও মনে স্থান দিলেন না। অবোধ শিশু মৃত্যুর ভয়াবহ রূপ দেখে ভয় পাবে। কী দরকার? শৈশবের ভয় চিরস্থায়ী হয়ে যায়। মানুষের মনে নানান ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে। জটিলতার ভেতর দিয়ে যাবার কোনো দরকার নেই।
শুভ্ৰ জানতেও পারল না। মৃত্যুপথযাত্রী এক বৃদ্ধ কী গভীর মমতা নিয়েই না তার জন্যে দিনের পর দিন প্ৰতীক্ষা করেছে।
শুভ্ৰ আজ অফিসে আসবে এই খবরটা অফিসের সবাই জানে। ঝাড়ুদার সকালবেলা একবার অফিসে ঝাড়ু দিয়েছিল। এগারেটার দিকে আবার অফিস ঝাড়ু দিয়ে ফেলল। মোতাহার সাহেবের খাস কামরা শুধু যে ঝাঁট দেয়া হয়েছে তাই নয়, পুরো এক কোটা এয়ার ফ্রেশনার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জানালা এবং দরজায় নতুন পর্দা লাগানো হয়েছে। বড় বড় ফুল তোলা রঙিন পর্দাঁ। অফিসের কর্মচারীরাও আজ একটু ফিটফাট হয়ে এসেছে। আজ একটা বিশেষ দিন। অফিসের মালিকানা বদল হচ্ছে। ছোট সাহেব অফিসে বসবেন। কে জানে আগের চেয়ে সব কিছু হয়ত অনেক ভালভাবে চলবে। অন্তত আশা করতে তো দোষের কিছু নেই।
মোতাহার সাহেবের ঘরে শুভ্ৰ বসেছে। এসি ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এসিতে গ্যাস নেই বলে শো শো শব্দই হচ্ছে, ঘর ঠাণ্ড হচ্ছে না। শুভ্রর সামনে খালি একটা গ্লাস। গ্রাসের পাশে মিনারেল ওয়াটারের বোতল। বোতলটা ফ্রিজ থেকে বের করা হয়েছে। বোতলের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমছে। দেখতে ভাল লাগছে। শুভ্র এমনভাবে বোতলের দিকে তাকিয়ে আছে যেন বোতলের গায়ে পানি জমার অপূর্ব দৃশ্য সে অনেকদিন দেখে নি।
শুভ্রর সামনে ম্যানেজার ছালেহ উদ্দিন বসেছেন। তাঁর চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। শুভ্ৰ কদিন থেকেই ম্যানেজারের দুশ্চিন্তা লক্ষ্য করছে। কিছু জিজ্ঞেস করে নি। ছালেহ উদ্দিন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ছোট বাবু চা বা কফি খবো?
শুভ্ৰ পানির বোতল থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বলল, না।
অফিসের সবাইকে ডাকি। সবার সঙ্গে কথা বল।
কথা বলার দরকার কী?
দরকার আছে। সবাই অপেক্ষা করে আছে তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে।
আপনাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন?
চিন্তার অনেক কারণ আছে।
কারণগুলি বলুন শুনি।
অনেক টাকা বাইরে। আদায় বন্ধ।
কেন?
বড় সাহেব মারা গেছেন, সবাই ভাবছে ব্যবসা শেষ।
বাবার কী কী ব্যবসা ছিল?
ইটের ভাটা আছে, আর ট্রান্সপোটের ব্যবসা কিছুদিন করেছেন। এখন বন্ধ। চারটা ট্রাক ছিল, তিনটা স্যার থাকতেই বিক্রি হয়ে গেছে। কনস্ট্রাকশানের ব্যবসা মাঝে করেছেন। স্যারের ব্যবসাবুদ্ধি ভাল ছিল না। স্যারের একটা ব্যাপার ছিল লোকজন পছন্দ করতেন। তিনি থাকতেন নিজের মত কিন্তু চাইতেন। অনেক পুনু আশেপাশে থাকবে। রোজ নটার আগে অফিসে আসতেন থাকতেন।
এতক্ষণ কী করতেন? আমি যে চেয়ারে বসে আছি সেই চেয়ারে বসে থাকতেন?
চেয়ারে বসে থাকতেন। বিছানায় শুয়ে থাকতেন। তিনি ঝামেলা পছন্দ করতেন না।
শুভ্ৰ পানির বোতল খুলে গ্লাসে পানি ঢালিল। তার পানির তৃষ্ণা হয় নি। কিন্তু ভরা পানির বোতল দেখে এক চুমুক পানি খেতে ইচ্ছা করছে।
ম্যানেজার সাহেব!
বল, কী বলবা।
ছোটবেলায় আমি প্ৰায় এই অফিসে আসতাম।
জানি।
বুড়ো এক ভদ্রলোক আমাকে স্কুল থেকে অফিসে নিয়ে আসতেন। ভদ্রলোক খুব জর্দা খেতেন। আপনি কি ঐ বুড়ো ভদ্রলোক সম্পর্কে কিছু জানেন?
না।
বাবার অফিসেই চাকরি করতেন। অফিসের পুরনো কর্মচারীরা হয়ত জানবে। কিংবা অফিসে রেকর্ডপত্রও থাকতে পারে। একটু খোঁজ করে দেখবেন? আজই দেখবেন।
কারণটা কী?
কোনো কারণ নেই এমনি খোঁজ করা।
ও আচ্ছা।
বাবার অফিসে অনেক দিনের পুরনো কর্মচারী কারা আছেন?
কেউ নেই। স্যারের একটা স্বভাব হল বেশিদিন কাউকে চাকরিতে রাখতেন না। স্যার বেঁচে থাকলে আমার চাকরিও থাকত না।
বাবার মৃত্যু তাহলে আপনার জন্যে ভালই হয়েছে।
ছিঃ ছিঃ এইসব কী বল?
আমি ঠাট্টা করছি। আপনি এখন ঘর থেকে যান। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকব। দুপুরে আমি অফিসেই খাব।
ব্যাংকের হিসাবপত্র দেখবে বলেছিলে ক্যাশিয়ারকে আসতে বলব?
না। দুপুরের পর।
আচ্ছা। দুপুরে কী খাবে?
বাবা কী খেতেন?
স্যারতো দুপুরে কিছু খেতেন না। কয়েক টুকরা পেপে, একটা টেষ্ট বিসকিট এক কাপ চা।
আমিও তাই খাব। বাবার জীবন ধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখব।
আচ্ছা।
শুভ্ৰ চেয়ার ছেড়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ম্যানেজার সাহেব আমি আরেকটা ব্যাপার আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি— বাবা কি কোনো নেশা করতেন?
না।
শুভ্র বলল, আমার ধারণা করতেন। মদের নেশার কথা বলছি না, তারচেয়েও খারাপ কোনো নেশা। যেমন ধরুন আফিং। তিনি কি মাঝে মধ্যে আফিং খেতেন?
ম্যানেজার নিচু গলায় বলল, আমি জানি না।
অফিসের সবাইকে নিয়ে বিকেলের দিকে বসব। চা খাব। সব মিলিয়ে আপনারা কত জন?
পনেরো বিশজন হবে।
সবাইকে ডাকবেন। কেউ যেন বাদ না পড়ে।
আচ্ছা। ওসি সাহেবকে আসতে বলে দিয়েছি উনি দুপুরের দিকে আসবেন।
ওসি সাহেবকে কেন?
থানাওয়ালা ছাড়া আমাদের গতি নাই। উনাদের সাথে আমাদের মাসিক বন্দোবস্ত আছে।
তাদের কী পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়?
ভালই দেয়া হয়।
টাকা পয়সার লেনদেন কে করে? ক্যাশিয়ার সাহেব না আপনি।
আমি। পুলিশের আরো বড় অফিসার যারা আছে তাদের সাথে বড় সাহেব লেনদেন করতেন। এখন তুমি করবা। তুমি করতে না চাইলে আমিতো আছিই।
বড় অফিসাররাও এর মধ্যে আছে?
আছে। আমাদের যোগাযোগ কনষ্টেবল থেকে শুরু করে এক্কেবারে মাথা পর্যন্ত।
ভালো তো। লেজ থেকে মাথা।
নারকোটিসওয়ালদের টাকা খাওয়াতে হয়। বলতে গেলে টাকার খেলা।
ভাল।
পলিটিক্যাল পার্টিকে টাকা দেই। মাস্তান আছে কিছু। এরা অবশ্যি আমাদের নিজেদের।
আমাদের নিজেদের মানে?
আমাদের ব্যবসার যা ধাত এতে মাস্তান পুষতে হয়।
কতজন আছে?
আছে কিছু।
সংখ্যাটা কত।
আট নয় জন হবে। কমও হতে পারে।
সঠিক সংখ্যা বলতে পারবেন না?
না। লিডারের উপর নির্ভর। আমরা লিডার রেখে দেই। সে তার দল চালায়। দলে কতজন থাকবে না থাকবে এটা তার ব্যাপার।
আমাদের যে লিডার তার নাম কী?
চায়না ভাই।
কী ভাই?
চায়না ভাই। ডাবল মার্ডারের আসামি। থানায় তার নামে এগারোটা মামলা আছে। খুনের মামলা তিনটা।
আমাদের দলের লিডার হল খুনের মামলার পলাতক আসামি।
হুঁ।
পুলিশ তাকে ধরছে না?
ধরবে কী ভাবে? পুলিশও তো আমাদের। চায়না ভাই এর বাড়িতে মাঝে মধ্যে পুলিশ রেড হয়। পুলিশ আগে ভাগে আমাদের খবর দিয়ে রাখে। কোনো অসুবিধা হয় না।
ভয়ঙ্কর একজন ফেরারি আসামিকে দলের লিডার বানাতে হল?
যে রকম দল সে রকম লিডার। তবলিগ জামাতের লিডার দিয়েতো আর মাস্তানদের দল চালানো যায় না? নৌকা যেমন মাঝিও লাগে সে রকম। পানশি নৌকার একরকম মাঝি। দৌড়ের নৌকার আরেক রকম মাঝি। চায়না ভাই অফিসে এসেছে। তুমি কথা বলবে?
হ্যাঁ কথা বলব।
এখন কথা বলবো? না পরে পাঠাব?
এখনই বলব।
তোমাকে আরেকটা কথা বলা হয় নাই। আমরা নতুন একটা মেয়ে খরিদ করেছি; পাঁচিশ হাজার টাকায় খরিদ করেছি।
তার মানে?
আমাদের যে ব্যবসা তাতে সব সময় নতুন মুখ লাগে। মেয়েটা খুবই সুন্দরী। বয়স পনেরো ষোল। ফরিদপুরের মেয়ে।
এখন তাহলে আমাদের মেয়ের সংখ্যা তিপান্ন?
জ্বি।
চায়না ভাই ঘরে ঢুকে শুভ্রর পায়ের উপর উপুড় হয়ে গেল। শুভ্র কিছু বোঝার আগেই সে শুভ্রর দুপায়ের পাতায় চুমু খেয়ে ফেলল। শুভ্ৰ পা সরিয়ে নিল না।
যদিও আঁৎকে উঠে পা সরিয়ে নেয়াই ছিল স্বাভাবিক রিফ্লেক্স একশান।
শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, কেমন আছ চায়না?
চায়না মাথা নিচু করে বলল, ছোট সাহেবের দোয়া।
শুভ্ৰ বলল, মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলবে না। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বল। আমি চোখের উপর চোখ না রাখলে কথা বলতে পারি না।
চায়না তাকাল। স্বাভাবিক মানুষের চোখ। কোনো বিশেষত্ব নেই, কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। চেহারাও সাধারণ। রোগা, লম্বা। শুধু গলাটা অস্বাভাবিক লম্বা। গায়ের রঙ ফর্সা। রোদে পুড়ে রঙ জ্বলে গেছে। গায়ে খয়েরি রঙের গেঞ্জি। পরনে ঢোলা প্যান্ট। পায়ে কাপড়ের জুতা। জুতা জোড়া মনে হচ্ছে আজই কেনা হয়েছে। ঝকঝক করছে।
চায়না তোমার বয়স কত?
হিসাব নাই। চল্লিশ হতে পারে। আবার বেশিও হইতে পারে।
বিয়ে করছ?
জ্বি।
ছেলেমেয়ে আছে?
একটা মেয়ে।
মেয়ের নাম কী?
জরিনা বেগম।
জরিনা বেগমের বয়স কত?
হিসাব নাই। এগারো বার বছর হইব।
তোমার ভাল নামটা কী?
ভাল নাম ফজলু। এই নামে কেউ চিনে না। সবাই আমারে চায়না ভাই নামে জানে।
নামের পেছনে ভাই কেন?
আমারে খাতির কইরা ভাই ভাই ডাকত। এই ভাই ভাই ডাক থাইক্যা। আমি হইলাম চায়না ভাই।
চায়না নামটা কী চীন থেকে এসেছে?
জ্বে না। বাপ মা চায়না, এই থাইক্যা চায়না।
সবাই এখন চায়না ভাই ডাকে?
জ্বি।
জরিনীও কি তোমাকে চায়না ভাই ডাকে?
জরিনা কে?
জরিনা হচ্ছে তোমার মেয়ে। জরিনা বেগম। যার বয়স দশ এগারো।
চায়না কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎ সব দাঁত বের করে হেসে ফেলল। ছোট সাহেবের সামনে বেয়াদবি হচ্ছে। সে হাসি সামলাবার চেষ্টা করুল। পারল না; হাসির মধ্যেই বলল— ছোট সাহেব এক্কেবারে আসল জায়গায় হাত দিছেন। জরিনাও আমারে চায়না ভাই ডাকে। একদিন দিলাম ধমক। বললাম, বাপারে ভাই ডাকিছ? এমন আছাড় দিব। মেয়ে খলবলাইয়া হাসে। এই একজনরে দেখলাম আমারে ভয় পায় না।
আর সবাই ভয় পায়?
জ্বি পায়।
আমার বাবা কি ভয় পেতেন?
বললে বেয়াদবি হবে। কিন্তু সত্য কথা হইল। উনি ভয় পাইতেন।
আমি? আমি কি তোমাকে ভয় পাচ্ছি?
জ্বি না।
কেন ভয় পাচ্ছি না সেটা বলতে পারবে?
যে নিজেরে ভয় পায় সে অন্যেরে ভয় পায়। যে নিজেরে ভয় পায় না, সে কারোরেই ভয় পায় না।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও। চায়না শোন আমার পায়ের পাতায় আর কখনো চুমু খাবে না। আমার ভাল লাগে না।
কদমবুসি করি?
কর।
চায়না ভাই শুভ্ৰকে কদমবুসি করে বের হয়ে গেল। তাকে উৎফুল্ল এবং আনন্দিত মনে হল। নতুন মালিক তার পছন্দ হয়েছে। বেশ পছন্দ হয়েছে।
শুভ্ৰ সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিসের কাগজপত্র দেখল। পুরনো ফাইল ঘটিল। ক্যাশিয়ারের সঙ্গে কয়েক দফা বসল। এর মধ্যে লালবাগ থানার ওসি সাহেব এসেছিলেন খালি হাতে আসেন নি, ফুলের তোড়া নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প করল। টেলিফোনে কথা হল ওয়ার্ড কমিশনার সাহেবের সঙ্গে হাজি সুরত আলী]। ওয়ার্ড কমিশনার আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন- আপনি কোনো রকম দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার পিতা অতি বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। আমাদের আপনার মানুষ। আপনিও আমাদের নিজের লোক। সুখে শাস্তিতে বাস করতে হলে মিল মুহকবতটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ইনশাল্লাহ মিল মুহকবতের সঙ্গে আমরা কাজ করব। আপনি আমারে দেখবেন। আমি দেখােব আপনারে। এবং আমাদের দুইজনরে দেখবেন আল্লাহপাক। যিনি দিন দুনিয়ার মালিক। ভদ্রলোক টেলিফোন কাঁপিয়ে হাসলেন। শুভ্রও তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হাসল।
সন্ধ্যার পর শুভ্র ম্যানেজারকে ডেকে পাঠাল। ছালেহ ঘরে ঢুকে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কোন সকালে এসেছ, সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখন বাসায় যাও!
শুভ্র বলল, যাচ্ছি। যাবার আগে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলে যাই। আপনি বসুন।
মাগরেবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। যা বলার তাড়াতাড়ি বল।
কথা অল্পই বলব আপনার নামাজের ওয়াক্ত থাকবে। দাঁড়িয়ে থাকবেন না। বসুন।
ছালেহ বসল। শুভ্ৰ শান্ত গলায় বলল, আপনাকে আমি বলেছিলাম। ময়না পাখির খাঁচাটা আসমানীকে ফেরত দিতে। আপনি ফেরত দেন নাই।
কোনো প্রয়োজন নাই।
প্রয়োজন আছে কি-না সেটা বড় কথা না। বড় কথা হল আপনাকে যা কাজটা করতে বলা হয়েছে সেই কাজটা আপনি করেন নি।
কিছু কাজ কর্ম আছে নিজের বিবেচনায় করতে হয়।
এই অফিসে কাজ করত একজন বুড়ো লোকের খোঁজ বের করতে বলেছিলাম। সেটি করেছেন?
আজইতো বললা। এত তাড়াহুড়ার কী আছে?
যাই হোক আমি ভদ্রলোকের ঠিকানা খুঁজে বের করেছি। আপনি অফিসে সারাদিন বসেই ছিলেন এর মধ্যে কাজটা করে ফেলা যেত।
আমার কাজকর্ম কি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?
আপনি বাবার পুরনো কর্মচারী এবং অত্যন্ত বিশ্বাসী। ব্যবসা খুব ভাল বুঝেন। কিন্তু আপনার কাজকর্ম আমার পছন্দ না। আপনাকে আমি অফিসে রাখব না। অনেকগুলি কারণে রাখব না, তার মধ্যে একটা তুচ্ছ কারণও আছে। তুচ্ছ কারণটা হল আপনি ছোটবেলা থেকে আমাকে দেখেছেন। তখন তুমি তুমি করে বলতেন। এখনো বলেন। কোনো কর্মচারী মালিককে তুমি করে বললে অন্যদের উপর তার প্রভাব পড়ে। পড়ে না?
পড়ে।
আপনাকে বরখাস্ত করার আরেকটা কারণ বলি। এই কারণটা তুচ্ছ না, বড় কারণ। কারণটা মন দিয়ে শুনুন- আপনি অফিসের খুবই ক্ষমতাবান একজন মানুষ। এই অফিসে আমাকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে ক্ষমতাধর একজনকে তাৎক্ষণিকভাবে সরাতে হবে। তবেই বাকি সবাই ধাক্কার মত খাবে; আমার কথাগুলি কি বুঝতে পারছেন?
পারতেছি।
না পারার কোনোই কারণ নেই। অংকটা জটিল না। সহজ অংক। শুধুই যোগ বিয়োগ। আপনার মত বুদ্ধিমান একজন মানুষ সহজ যোগ বিয়োগ জানবেন না তা হয় না। আচ্ছা যান। আপনার নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।
আমার তাহলে চাকরি নাই?
না।
এই মাসটাতো আমি থাকব?
না থাকবেন না; মাগরেবের নামাজ পর্যন্ত আপনার চাকরি। নামাজের পর চাকরি নেই।
ছোট বাবু তুমি খুব ভুল করতেছ।
হয়ত করছি। শুদ্ধ করে করে কিছু শেখা যায় না। আমাকে শিখতে হবে ভুল করতে করতে। যত বড় ভুল করব তত বেশি শিখব। আচ্ছা আপনি এখন যান।
তুমি কি আছ কিছুক্ষণ, না বাসায় চলে যাবে?
বাসায় এখন যাব না। আমার এক জায়গায় নিমন্ত্রণ আছে। আর্কিটেক্ট আখলাক সাহেব আমাকে দাওয়াত করেছেন। সেখানে যাব। সেখান থেকে বাসায় ফিরব।
বন্ধুর বাসায় কখন যাবে?
এখনই যাব।
একটু দেরি করে যাও। তোমাকে খুবই জরুরি কিছু কথা বলা দরকার। আমাদের যে ব্যবসা সেখানে নানান রকম গ্রুপিং আছে। এগুলি জানা না থাকলে খুব সমস্যা। আমি এমন অনেক কিছু জানি যা বড় সাহেবও জানতেন না।
একটা বিষয় কর্মচারী জানবে অথচ মালিক জানবে না এটাতো ঠিক না।
তোমার বাবা ছিলেন এক রকম মানুষ, তুমি অন্য রকম। তোমার বিষয়ে ভিন্ন ব্যবস্থা হবে। তোমার এডমিনস্ট্রেশনে কর্মচারী যা জানবে মালিকও তাই জানবে।
না। আমার এডমিনস্ট্রেশনে তার মালিক কর্মচারীদের চেয়েও অনেক বেশি জানবে। আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যান। মাগরেবের ওয়াক্ত খুব অল্প সময়ের জন্যে থাকে। আপনার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ছালেহ দাঁড়িয়ে আছেন। যাচ্ছেন না। শুভ্র বলল, কিছু বলবেন?
ছালেহ শান্ত গলায় বললেন, তুমি তোমার বাবার ব্যবসা ভালই চালাবে।
শুভ্র বলল, থ্যাংক য়্যু।