জহুরের বিছানা আজ বারান্দায় পাতা হয়েছে। টুনী মশারি খাটাতে এসে নরম গলায় বলল, বৃষ্টি হলে কিন্তু ভিজে যাবে মামা। বৃষ্টি হবে আজ রাতে। জহুরের মনে হল টুনীর চোখ ভেজাভেজা।
জহুর নিচু গলায় বলল, তুই তো ভালো গান শিখেছিস।
টুনী চুপ করে রইল। মশারি খাটাতে তার বেশ ঝামেলা হচ্ছে। দড়ি-বাঁধবার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। জহুর বলল, মশারি পরে খাটাবি, বস তুই। তোর সঙ্গে তো আমার কথাই হয় না।
রান্না হয় নাই, মামা।
রান্নাবান্না সব সময় তুই করিস নাকি?
মাঝে মাঝে অজু করে। অঞ্জুর রান্না বাবা খেতে পারে না।
তোদের ছোটমা করে না?
ছোটমার শরীর ভালো না। আগুনের কাছে যেতে পারে না।
ঘরের ভেতর থেকে ঠকাঠক শব্দ হতে লাগল। টুনী বলল, এই যে আবার লেগে গেছে।
মারামারি করছে?
হুঁ। এরা নিঃশব্দে মারামারি করে। আমি সামলাই গিয়ে।
টুনী উঠে চলে গেল।
জহুর পরপর দুটি সিগারেট শেষ করল। এ-দুটিই তার সর্বশেষ সিগারেট। দুলাভাইয়ের কাছ থেকে টাকা না চাইলে আর সিগারেট কেনা যাবে না। চাওয়াটা একটা ঝামেলার ব্যাপার। টাকাপয়সা আগে বড়োআপা দিত। দেবার সময় রাগীরাগী একটা ভাব করে বলত, ইশ, আর কত কাল জ্বালাবি? বড়োআপার কথা মনে হওয়ায় জহুরের সামান্য মন খারাপ হল। খুবই সামান্য। এটা লজ্জার ব্যাপার। আরো অনেক বেশি মন খারাপ হওয়া উচিত। চোখ দিয়ে পানি-টানি পড়া উচিত। কিন্তু সেরকম কিছুই হচ্ছে না। খুব লজ্জা এবং দুঃখের ব্যাপার। বড়োআপার মতো
একটা ভালো মেয়ে এই দেশে তৈরী হয় নি।
মামা, তোমার চা!
অঞ্জু চায়ের কাপ বেঞ্চির ওপর নামিয়ে রাখল।
চা তো চাই নি।
খাও একটু। রান্নার দেরি আছে।
অঞ্জু বসল বেধির এক পাশে।
পড়া নেই আজকে?
আছে। তোমার চায়ে চিনি ঠিক হয়েছে মামা?
ঠিক আছে।
অঞ্জু বসে রইল চুপচাপ।
তুই কি কিছু বলবি নাকি?
অঞ্জু ইতস্তত করে বলল, টুনী আপা তোমাকে একটা কথা বলতে বলেছে। মামা।
জহুর অবাক হয়ে বলল, সে বললেই তো হয়। উকিল ধরেছে কেন?
তার লজ্জা লাগছে।
কী ব্যাপার?
ঐ ছেলেটিকে আপার পছন্দ হয় নি। আমারও হয় নি।
জহুর অবাক হয়ে বলল, আমাকে বলছিস কেন? দুলাভাইকে বল।
বাবাকে বলে লাভ হবে না।
জহুর চুপ করে গেল। অঞ্জু মৃদু স্বরে বলল, বাবা কারো কথা শোনে না।
জহুর বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, দুলাভাইয়ের অনেক পয়সা হয়েছে, না?
হুঁ।
ছেলেটাকে পছন্দ হয় নি কেন?
জানি না। জিজ্ঞেস করি নি।
তোর নিজেরও তত পছন্দ হয় নি। সেটা কী জন্যে?
লোকটার চেহারা দেখলেই মনে হয় কোন একটা মতলব পাকাচ্ছে।
চেহারা দেখে কিছু বোঝা যায় না।
অঞ্জু উত্তর দিল না। জহুর ঘোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জেলখানায় অনেক লোক দেখেছি ফেরেশতার মতো চেহারা, কিন্তু ভয়ংকর সব অপরাধ করে এসেছে। এক জনের নাম ছিল আব্দুল লতিফ, কলেজের প্রফেসর কী চমৎকার চেহারা, কী ভদ্র ব্যবহার। কিন্তু…
কী করেছিল ঐ লোক?
ঐ সব শুনে কাজ নেই।
কত দিনের জেল হয়েছিল ওর।
ফাঁসির হুকুম হয়েছিল।
অঞ্জু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
ঘরের ভেতরে আবার হুটোপুটি শুরু হল। লেগে গেছে দু ভাই। নিঃশব্দ যুদ্ধ চলছে। অঞ্জু ভাইদের সামলাতে চলে গেল।
দবির মিয়া ফিরল রাত এগারটায়।
তার মুখ থমথমে। বলল, ভাত খাব না, খিদে নাই।
ব্যপার কি দুলাভাই?
ব্যাপার কিছু না। তোমরা না খেয়ে বসে আছ কেন এত রাত পর্যন্ত?
আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
অপেক্ষা করার দরকার নেই। খিদে লাগলে খাবে, ব্যস।
দবির মিয়া বালতি হাতে কলতলায় গা ধুতে গেল।
গায়ে মাখার সাবান নেই কথাটা সকালে বলা হয় নি কেন? এই নিয়ে গৰ্জাতে গর্জাতে প্রচণ্ড একটা চড় বসাল অজুকে।
সকালে আপনাকে এক বার বলেছিলাম বাবা।
আবার মিথ্যা কথা। বললে আমি শুনলাম না কেন? কান তত এখনন নষ্ট হয় নি। যা, যেখান থেকে পারিস সাবান নিয়ে আয়।
জহুর মোড়াটা উঠোনে নামিয়ে বসেছিল। সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। পরিষ্কার জ্যোত্স। বেশ লাগছে বসে থাকতে।
মামা, একটা গায়ে-মাখা সাবান এনে দেবে?
জহুর দেখল, অজু কথা বলছে বেশ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। যেন কিছুই হয় নি।
এনে দিচ্ছি। আমার কাছে কোনো টাকা নেই রে অঞ্জু। টাকা দিতে পারবি?
অঞ্জু একটা দশ টাকার নোট এনে দিল।
সাবান ছাড়াও জহুর এক প্যাকেট সিগারেট কিনল। কিন্তু দোকানদার দাম নিতে চাইল না।
জহুর ভাই, দাম দিতে হবে না।
দাম দিতে হবে না কেন?
জহুর ভাই, আপনি আমারে চিনতে পারছেন না?
দোকানদার লোকটির সমস্ত মুখভর্তি চাপ দাড়ি। মাথায় ফুলতোলা কিস্তি টুপি একটা।
জহুর ভাই, আমি আজমল।
ও, দাড়ি রাখলে কবে?
বেশি দিন না। আপনি আসছেন খবর পাইছি। কিন্তু লজ্জাতেই দেখা করতে যাই নাই।
লজ্জা কিসের?
আপনের বিপদে কোন সাহায্য করতে পারি নাই। অবশ্য সাহায্য করার মতো অবস্থা আমার ছিল না। আমারে জালিয়াতি কেইসের আসামী করছিল। শুনছেন সেটা? বলব আপনেরে। অনেক কথা আছে, জহুর ভাই।
সাবান নিয়ে এসে জহুর দেখল দবির মিয়া গোসলটোসল সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে শুধু অজু এবং টুনী। অঞ্জু নাকি ভাত খাবে না, তার খিদে নেই। জহুর বলল, রাগ-টাগ করি না। ভাত খা।
রাগ না মামা, সত্যি খিদে নেই। আমি রাগ-টাগ করি না।
খাওয়ার মাঝখানে টুনী বলল, বাবার দোকানের যে নাইটগার্ডকে ওরা চোর মনে করে ধরেছিল, মনসুর নাম। ওকে থানায় পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
জহুর হাত গুটিয়ে সোজা হয়ে বসল, কী বলছিস এসব!
হুঁ, সে জন্যেই বাবার এ রকম মেজাজ। মামা, আরেকটু ডাল দেব?
জহুর কোনো জবাব দিল না।