০৯. ছয় লিটার দুধ

আমাদের দেশে এখনও অল্প কিছু লোক অবশিষ্ট আছে যারা বিশ্বাস করে অন্ধ আতুর বোবা খঞ্জদের দান করলে অশেষ পুণ্য হয়। সেই রকম এক সজ্জন বোবাদের জন্য রোজ ছয় লিটার দুধ পাঠায়। মাত্র ছয় প্যাকেট দুধে এত বাচ্চার কী হবে? তাই দুধটা নষ্ট না করে কিছুটা মাদার নিয়ে গিয়ে দই বসায়। কিছুটা রেখে দেয় সারাদিনের অসংখ্য কাপ চায়ের জন্য। আর তারপরে যেটুকু থাকে জল মিশিয়ে এক দুটো রুগ্ন বাচ্চাকে দেওয়া হয়।

আমি চা দিয়ে চলে যাবার পর আমার বিষয়ে যতটুকু সেই দাসদা জানে সব গুছিয়ে বলে দেয়। আর তখন আবার তিনজনে আলোচনা চলে–”কী করিতে হইবে”।

সেই ১৯৭৭ সালে যখন বামফ্রন্ট প্রথমবার ক্ষমতায় আসে এই রুনু গুহ নিয়োগীর আত্মা ভর করা ওয়ার্ডেনের বয়স ছিল আঠারো কুড়ি বছর। তখন থেকেই সে দেখে আসছে তার দুই এল.সি.এম. দাদাদের এলাকা জোড়া দাপট। যাদের মাথার উপর বিরাজমান প্রবল প্রতাপ বড় সাহেবের অভয় ছত্র। শুধু এরাই নয়, অন্য সব পার্টি কর্মীদেরও–পার্টি যেভাবেই হোক একটা পর একটা ভোটে জিতেছে আর তাদের বেড়ে গেছে দর্প দম্ভ অহঙ্কার। এক সময় তাদের মনে হতে থাকে যে, আমাদের পার্টির টিকিটে গরু ঘোড়া গাধা যাকেই ভোটে দাঁড় করানো হোক–জিতিয়ে আনতে পারি। পয়সা আর পেশি শক্তির উপর নির্ভরতা যত বেড়ে যায় জনগণের উপর তাদের ততো কর্তৃত্ব করার দমিয়ে রাখার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। শেষে এক সময় এমন মনে হয় মানুষ যেন লকআপে বসে থাকা কোনো কৃপাভিক্ষু আর পার্টির ছোট বড় নেতা কর্মী-সব যেন থানার ছোট বড় দারোগা। এই রকম এক পরিবেশে ওয়ার্ডেন বড় হয়ে ওঠে। সে দেখে আমি যদি কাউকে মারি দাঁড়িয়ে মার খায়। কাউকে যদি ধমকাই মাথা নীচু করে কাঁদে। যদি কারও কাছে বিড়ি চাই সে চা সিগারেট খাওয়ায়। যদি রিক্সায় চাপি রিক্সাঅলা ভাড়া চায় না, চায় দয়া কৃপা করুণা।

মানুষের মধ্যে আলো আছে, অন্ধকার আছে, শয়তান আছে, ‘ভগবান’ আছে। সে কাকে আশ্রয় করে এগুবে সেটা নির্ভর করে তার মানসিক গঠন–শিক্ষা সংস্কৃতি, বংশগতি, সহবত, রক্তের গ্রুপ এবং আরও বহু বিষয়ের উপর। তাই চম্বল নদীতে চান করলেও বহু মানুষ ডাকাত হয়

আবার অনেক মানুষ পুরোহিত পরিবারে জন্মেও জহুদ হার্মাদ হয়ে যায়। সবটাই নির্ভর করে স্থান কাল পাত্রের উপর। ধরা যাক কুখ্যাত পুলিশ অফিসার রুনু গুহ নিয়োগী যদি ওই চাকরিটা না পেতেন, যদি সরকার তাকে খোলা ছুট না দিত যদি নিজের পাড়ায় একটা মুদিখানা খুলে পেট পালতে হতো–সে কী তার বিকৃত প্রবৃত্তি চরিতার্থতার এমন লাগামহীন প্রয়োগ করতে পারত? পারত না। সেই সুযোগ নাগালে এনে দিয়েছিল তার চাকরি আর অনুকূল সময়। সে ইচ্ছেমত সেটাকে ব্যবহার করেছে।

মানুষকে মারায়, মানুষকে অত্যাচার করায় একটা অদ্ভুত আনন্দ আছে। সে জানত নাদিরশাহ, তৈমুর লঙ, হিটলার, পুলিশ অফিসার গুহ নিয়োগী। আর জানে এই ওয়ার্ডেন। সে কারণে তার বন্ধুরা তাকে রুনু নামে ডাকে। এই নামকে সে নিজের নামের সাথে সেই গর্ব অহঙ্কারে বহন করে চলে–যেমন ভাবে সুভাষ বোস ‘নেতাজি’, মোহন দাস গান্ধি বাপুজি’, স্যার আশুতোেষ বাংলার বাঘ’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গুরুদেব’ বহন করে গেছেন। তবে সেই সত্তরের দশক থেকে নব্বই দশকের শেষপাদ পর্যন্ত মনের সুখে বিরোধী ঠেঙাবার সুযোগ থাকলেও এখন আর তা নেই। সময়টা যে বদলে গেছে। এখন চারধারে আর বিরুদ্ধতা করার লোক নেই। সব সিপিএম। মালিক শ্রমিক জোতদার বর্গাদার বাড়িঅলা ভাড়াটে ধনি-দরিদ্র শোষক শোষিত শাসক শাসিত সবাই তাদের চিরকালীন আন্তঃ সম্পর্ক ভুলে, সংঘর্ষ মুলতুবি রাখে, এক পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে এক সুরে গান গাইছে।

তাছাড়া ওয়ার্ডে চাকরিটাও পুলিশে পায়নি। বয়স পার হয়ে গিয়েছে। আর অফিসার হতে হলে যে ডিগ্রি দরকার তাও সময় মতে যোগাড় হয়নি। এখন চাকরি করতে হচ্ছে ওয়ার্ডেনের। বাধ্য হয়ে মনের ক্ষোভ মনে চেপে রাখেন। আর মাঝে মাঝে তেমন সুযোগ হাতে এলে স্কচের নেশা তাড়ি দিয়ে মেটান। পদ ওনার যাইহোক-নিজেকে উনি মনে করেন সব পদের ঊর্ধ্বে।

যদিও এই স্কুলের সবাই কোন না কোনভাবে সিপিএম পার্টির সাথে যুক্ত, কেউ সরাসরি পার্টি করে, কারও দাদা কাকা মামা পার্টির নেতা, কেউ এসেছে কোন পার্টির কর্মীর পরিচয় সুত্রে। যে কারণে লোকে বলে বড় সাহেব এই স্কুলটা বানিয়েছে নিজের লোকদের করে কম্মে খাবার জন্য। বোবার সেবা–ওটা তো একটা ছুতো।

***

সে যাই হোক এই স্কুলের যিনি টিচার ইনচার্জ তিনিও এসেছেন দক্ষিণবঙ্গের এক তাবড় নেতার সুপারিশে। পদ এবং নেতার কারণে তার ধারণা হয়েছিল আমিই একমাত্র সেই ব্যক্তি যার কাছে বাঘ বশ করানো হান্টার আছে। সে জানত না অমন হান্টার সবাই লুকিয়ে নিয়ে ঘুরছে। দরকার পড়লেই চালাবে।

উনি যে পদে বর্তমানে আসীন ওনার আগে আর একজন ছিল। তখনও স্কুলের স্থায়ী ভবন নির্মাণ হয়নি। অন্যত্র অস্থায়ী ভাবে চালানো হচ্ছিল বোবা স্কুল। তখন থেকে তিনি ছিলেন ওই দায়িত্বে। এরপর স্থায়ী ভবন হল। সেখান থেকে স্কুলকে সরিয়ে আনা হল এখানে। আর তার কিছুদিন পরে কী যে হল–কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ ইস্তফা দিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। শোনা যায় উনি সৎ, পরিশ্রমী, দরদী এক শিক্ষক ছিলেন। যে-কোনো ভাউচারে চেকে সই করার আগে খোঁজ নিতেন টাকাটা যথার্থ জায়গায় খরচ হচ্ছে কিনা। এর ফলে তার বিরুদ্ধে একটা চক্র গড়ে ওঠে। তারা ওনাকে অপমান, হেনস্থা করতে থাকেন। উনি একা, ওরা অনেক। তাই তাদের সঙ্গে পেরে না ওঠায় চাকরি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। শোনা যাচ্ছে বর্তমানে খুবই আর্থিক অনটনে আছেন। তবে আছে সেই সতোর সঙ্গেই। নিজের বিশ্বাসের প্রতি অমর্যাদা না করে।

আমি এখানে আসার কয়েক মাস পরে ঘটেছিল একটা ঘটনা। তখনও উনি ফোলানো বেলুনের উপর বসে আছেন। গ্রামবাংলার এক মফঃস্বল টাউন থেকে শহরে এসে মাথা ঘুরে গেছে ওনার। পুকুরের পোনা সমুদ্রে গিয়ে পড়লে যেমন হয়। আমি এই স্কুলের বড়দি-কত সম্মান আমার। অফিসে ঢুকছি, যে বসেছিল উঠে দাঁড়াচ্ছে, যে বিড়ি খাচ্ছিল বিড়ি লুকাচ্ছে। বেল বাজাচ্ছি–লোক ছুটে আসছে। ধমক দিচ্ছি সে কঁপছে। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। উনি তখন নিয়ম করে রোজ কাউকে না কাউকে ধমকান ‘শোকজ করে দেব।

তখন পর্যন্ত উনি লোককে চমকানি দেন। নিজে চমকানি খাননি। উনি লোককে কাদান, নিজে কাঁদেননি। সে কাঁদবেন পাঁচ সাত বছর পরে–যখন বড়সাহেব তার একজন স্নেহধন্যাকে এখানে এনে শিক্ষিকার চাকরিতে ঢোকাবেন। সে তার ডিগ্রির জোরে এক সময়, তাকে অপসারিত করে টিচার ইনচার্জ হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেবে। তখন এই বড়দি নিজের পোস্ট আঁকড়ে রাখার তাড়নায় এক ডিগ্রি প্রদান সংস্থায় গিয়ে ভর্তি হবে ছাত্রী হয়ে। আর পরীক্ষার সময় চোতা মারতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবেন। তখন সেই সংস্থা থেকে ফোন করে বড় সাহেবকে জানাবেন–আপনার স্কুলের মাস্টার, একে কী করব? বড় সাহেব বললেন–আপনারা কিছু করবেন না, যা করার আমি করব।

এরপর তিনি একদিন টিচার ইনচার্জকে তার ঘরে ডেকে একটা পবিত্র ঝাড় দেবেন। আর তিনি একঘর অধস্তন কর্মচারির সামনে ঝাড় খেয়ে কাঁদবেন। লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকবেন। সেই যে ধোনা শুরু হবে। এরপর নানাবিধ কারণে মাঝে মাঝে বড় সাহেব ধুনতেই থাকবেন।

***

সেটা ছিল এক পনেরোই আগস্ট। আগের দিন টিচার ইনচার্জ বলে গেলেন শিক্ষক অশিক্ষক সব কর্মচারিকে সকাল আটটার মধ্যে স্কুল প্রাঙ্গণে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। পতাকা তোলা এবং স্বাধীনতা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হবে। যে উপস্থিত না থাকবে শোকজ করে দেব।

ওয়ার্ডেন সাহেব নিজের কাজের ক্ষতি করে আটটাতে এসে গেলেন স্কুলে। অন্যদিন দশটায় আসেন। একটা বিল্ডিং নির্মাণ চলছে, মিস্ত্রিমজুর খাটছে। সেখানে থাকাটা স্বাধীনতা দিবসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসে বসে রইলেন। এদিকে বড়দি আর আসে না। কেমন করে যেন তার ট্রেন ফেল হয়ে গেছে তাতেই বিলম্ব। তিনি এলেন পাক্কা চল্লিশ মিনিট দেরিতে।

চল্লিশ মিনিট। অর্থাৎ এক মিনিটকে ষাট দিয়ে গুণ করলে যত সেকেন্ড তত সময়। প্রাঙ্গণের পাশেই বড় সাহেবের বড় ছেলের ভাড়া খাটানো গোটা কয়েক গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। এত সময় বরবাদ হয়ে যাওয়ার রাগে একটা গাড়ির মধ্যে বসে ফুঁসছিল ওয়ার্ডেন। এমন সময় এলেন টিচার ইনচার্জ। চারদিকে তাকালেন। অনেককে দেখতে পেলেন তিনি কিন্তু ওয়ার্ডেন নজরে এল না। তিনি তাই স্বভাবসুলভ গ্রাম্যতায় গর্জে উঠলেন, অমুককে দেখছি না। আসেনি নাকি? একটা দিন আসতে পারল না। এ আমি সহ্য করব না।

আরও কিছু তিনি বলতেন হয়তো, বলা হল না। গাড়ির দরজা খুলে নীচে নেমে এল ওয়ার্ডেন। বিয়ের রাতে বেড়াল মারো নীতি গল্পটা তার জানা। বুঝল এই হচ্ছে সঠিক সময়, এবার বেড়াল মারা দরকার। ছয় আট মাস হয়ে গেছে উনি এখানে এসেছেন, বড় পদ পেয়ে নিজেকে বৃন্দা কারাত ভাবছেন। এখন সেই বেলুনে পিন ফোঁটানো দরকার।

ওয়ার্ডেনও গর্জে উঠলেন, অন্যের বেলা আইন নিয়ম দেখাচ্ছেন–আপনার নিজের বেলা আইন নেই কেন? কটা বাজে এখন? কটায় আসবার কথা ছিল আপনার? এতগুলো লোকের এত সময় নষ্ট, এর পেনাল্টি কে দেবে?

অধস্তন এক কর্মীর এমন অভাবিত আক্রমণে কেমন যেন কুঁকড়ে গেলেন টিচার ইনচার্জ। ভেবে পেলেন না উধ্বর্তনকে কড়কানি দেবার শক্তির উৎস কোথায়? আমি তো জেলা কমিটির নেতার সাথে যুক্ত একী রাজ্য কমিটির? তা না হলে ওয়ার্ডেন হেড অব দি ইনস্টিটিউটকে কী করে এমন রুক্ষ ভাষায় আক্রমণ করতে পারে?

বলে টিচার ইনচার্জ, আমার ট্রেনটা ফেল হয়ে গেল বলে–

ওসব কোনো যুক্তি নয়। বিষয়টা বোঝা উচিত ছিল, কত বড় দায়িত্ব আপনার কাঁধে। এতগুলো লোক আপনার অপেক্ষায় থাকবে। একঘন্টা আগে কেন বাড়ি থেকে বের হলেন না? সবদিন লেটে আসেন, একটা দিন তো একটু আগে আসবেন। আপনি নিজেই যদি এই রকম হন, অন্যরা তো করবেই। আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও বলে একটা কথা আছে। আগে সেটা করুন, সবাই দেখে শিখবে।

বেড়াল মরে গেল, বেলুন চুপসে গেল। আর কোনদিন টিচার ইনচার্জ অন্যকে ধমকালেও ওয়ার্ডেনের উপর হম্বিতম্বি করার সাহস পাননি। নামের শেষে বাবু যোগ করে ডাকা শুরু করেন।

এখন পর্যন্ত ওয়ার্ডেন তেমন কোনো প্রবল প্রতিপক্ষের সামনে পড়েনি। ছোট্ট একটা সীমাঞ্চলে ঘোরাঘুরি। সে সবাইকে চেনে, সবাই চেনে তাকে। মানুষ বোঝে এই লোকটার পিছনে একটা সংগঠিত দল আছে। যে দল সরকার চালায়। যে সরকারের পুলিশ আছে। যে পার্টির প্রচুর ক্যাডার আছে। একে কিছু বললে বা করলে সেই সব শক্তি আমাকে পিষে মেরে দেবে। ফলে সর্বত্র ওয়ার্ডেন সহজে জয় পেয়ে যায়। এইভাবে বিনা প্রতিরোধে জয়ী হয়ে যাবার ফলে দম্ভ দর্প ঔদ্ধত্য আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেছে। তার এখন আর কাউকে অপমান করতে মুখে যা আসে বলতে বাধে না। পুরোপুরি দারোগা স্বভাব গ্রাস করে নিয়েছে তাকে।

জীবন আমাকে দিয়ে কত কিছু যে করিয়ে নিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। ছাগল গরু চরানো, চায়ের দোকান, হোটেলের থালা গেলাস বোয়া, মুটে-মজুরি, ট্রাকের খালাসি, রাত পাহারার পাহারাদার, শ্মশান ডোম, পায়খানা পরিষ্কার করা জমাদার, রান্নার রাঁধুনি, রিক্সাঅলা থেকে চাকু বোমা হাতে দৌড়ানো, জেলখাটা আসামি আরও কত কী। এইসব করতে করতে হাজার ধরনের লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয়। যা থেকে আহরণ করেছি হাজার রকম জ্ঞান, ধীরে ধীরে ভরে উঠেছে অভিজ্ঞতার ছেঁড়া ঝুলি-ঝোলা।

এখন দেখছি এমন একজনকে যা না দেখলে মানুষ দেখা আমার অসম্পূর্ণ রয়ে যেত। আমি জেলখানায় ছিলাম, বহু দাগি অপরাধী দেখেছি, তাদের সাথে মিশেছি। তাদের কাউকে কোনদিন অকারণে মানুষকে অত্যাচার করে আনন্দ পেতে দেখিনি। আজ দেখছি এমন একজনকে যে বামপন্থী। পরিবারের সন্তান। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের রচনাবলী থেকে উদ্ধৃতি দেয়। রামকৃষ্ণের কথামৃত পড়েছে আবার সেই লোকই মনে প্রাণে রুনু গুহ নিয়োগী হতে চায়। মানুষকে নিপীড়ন করে মজা পায়।

যাহ নাই ভান্ডে তাহা নাই ব্রহ্মান্ডে। আমি আমার কথা বলছি। আমি রাধুনি মানুষ। এক হাঁড়ি ভাতের একটা টিপে বুঝে যাই সব ভাতের হাল হকিকৎ} সেই জ্ঞানভাণ্ড নিয়ে এই লোকটাকে যতবার দেখছি নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করেছি, যে পার্টির পরিমণ্ডলে এমন বিষাক্ত প্রাণীর বিকাশ সে পার্টির অন্তঃসার কেমন। কিছুদিন পরে এই লোকটা সম্বন্ধে একটা গল্প শুনেছিলাম। সেটা আগে বলি, তারপর বলব আজকের কথা।

সেদিন বেলা দশটার হাজিরা দিতে স্কুলে আসছিলেন। উনি আসেন সাইকেলে। ওনাকে কে যেন বলেছেন, সাইকেল চালনা স্বাস্থ্যের পক্ষে একটা ভালো ব্যায়াম। তাই সব সময় সাইকেলেই চড়েন। বাড়ি থেকে স্কুলের দুরত্ব চার কিলোমিটার। দুবার আসা যাওয়ায় ভালোই ব্যায়াম হয়ে যায়। সেদিন এসে দেখেন বাইপাসে একটা মাল বোঝাই ভ্যান রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। আর ভ্যান চালক একে তাকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করছে–গোপালনগর কিধার হ্যায় থোরা বাতা দিজিয়ে।

বাইপাশ থেকে সোজা পূর্ব দিকে আকাশের যতদুরে চোখ যায় এই সবটা জুড়ে ছিল একটা হোগলা বন–বড় বড় মাছের ভেরি। যার মালিক ছিল বিহারি মণ্ডল খগেন নস্কর পরিবার। সেই জমি কেড়ে সিপিএম পার্টি কিছু মৎসজীবী কিছু ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলি বন্টন করে দেয়। এখন আবার ওই পার্টির লোক সেই জমি মৎস্যজীবী, ভূমিহীনদের কাছ থেকে নিয়ে ছোট ছোট প্লট করে বেচে দিচ্ছে।

যাদের উচ্চমূল্য দেবার ক্ষমতা আছে তারা সব উচ্চদামে ভাল প্লটগুলো কিনে নিয়েছে। যারা গরিব তারা চলে যাচ্ছে পথঘাট, জল বিদ্যুৎবিহীন গোপালনগর রানাভূতিয়া কাটিপোতা এইসব দিকে। গড়ে উঠছে গরিব মানুষের পাড়া। এখানে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান আছে। বাঙাল, বাঙালি, বিহারি, উড়িয়া আছে। তবে সবই সেই খেটে যাওয়া মানুষ। এদের মেয়ে বউরা বাবু বাড়ি বা কোনো ছোট কারখানায়, কেউ কোন নার্সিংহোমে আয়ার কাজ করে। পুরুষেরা কেউ মিস্ত্রি, কেউ মজুর, কেউ রিক্সা চালায়। ভাড়া ঘরের দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে এরা একটা যেমন তেমন দোচালা বানিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে তার মধ্যে মাথা গুঁজেছে। এই ভ্যান চালক তেমন কোনো পরিবারের ঘর গেরস্থালির মালপত্র কোন এক ভাড়া বাড়ি থেকে তুলে পৌঁছে দিতে চাইছে গোপালনগরে। সেই মালের মালিকের ঠিকানায়। সদ্য গড়ে তোলা গৃহে।

এখন সে ওয়ার্ডেনকে জিজ্ঞাসা করে গোপাল নগরে যাবার পথ। বলে, পাহেলে একদিন গ্যায়া থা। লেকিন আভি রাস্তা পহচান নেহি পা রহা।

ভ্যানে একটা চৌকি চেয়ার, বড় বড় কটা টিনের বাক্সো মুখ বাঁধা কটা বস্তা, খান কুড়ি ইট, এইসব। বোঝা যায় খুব ভারি হয়েছে ভ্যান। তার উপর গ্রীষ্মকালের গনগনে রোদ। লোকটা বহুদূর থেকে ভ্যান টেনে এসেছে, ঘামে ভিজে গেছে তার শরীর, হাঁফাচ্ছে জিভ বার করা কুকুরের মতো। এমন মানুষকে দেখলে যে-কোনো মানুষের মনে কিছু করুণা আসা স্বাভাবিক। সে তো মানুষের। কিন্তু যার মনে আছে এক হার্মাদি আত্মার অপচ্ছায়া, যে মানুষকে বিপদে ফেলে আনন্দ উপভোগ করে তার কেন ওসব মানবিক দুর্বলতা থাকবে।

এটা একটা চৌরাস্তার মোড়। দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলে গেছে গড়িয়া থেকে দমদম এয়ারপোর্টে যাবার রাস্তা। আর পশ্চিম থেকে পুবে চলে গেছে যাদবপুর থেকে এঁকে বেঁকে গোপাল নগর যাবার পথ। ভ্যানটা এসেছে উত্তর দিকে থেকে। বদবুদ্ধি চাগাড় দিল ওয়ার্ডেনের মাথায়, সে হাত উঁচু করে দক্ষিণ দিকটা দেখিয়ে দিল সোজা যাবে। দেখবে সামনে একটা মোড়। কাউকে জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই। বেঁকে যাবে বাঁদিকে। মাইল দুয়েক গেলে গোপালনগর। ভুল পথ দেখিয়ে মনে মনে একচোট হেসে নিল সে। ভ্যানঅলা এই গরমে হাঁসফ্টস করতে করতে ভ্যান টেনে যাবে। ফের ফিরে আসবে। তখন নিশ্চয় আধমরা হয়ে যাবে। কী মজা!

একে মা মনসা তার উপর ধুনোর গন্ধ। এমনিতে যে তোক স্বভাব নিপীড়ক তাকে আবার তাতিয়ে দিয়েছে দাসদা। ওয়ার্ডেনের যেমন তেতে ওঠা স্বভাব দাসদার স্বভাব লোককে তাঁতানো। ওই মহিলাকে মাদার কিলার তারই দেওয়া নাম। এতে মহিলা তেঁতে যায় খেপে ওঠে-গাল পাড়ে। এটাই নির্মল মজা।

দুপুর বেলা প্রথম যখন আমাকে দেখে ভালো লাগেনি ওয়ার্ডেনের। দণ্ডকারণ্য থেকে এসেছি, সেটা একটা গভীর বন। ফলত আমার চেহারাটা বুনো বুনো। ওয়ার্ডেনের বাড়িতে রান্নার লোক কাজের মাসি আছে। তারা যেমন বাবু শ্রেণির সামনে কুঁকড়ে থাকে, চোখ তুলে তাকাতে সাহস পায় না, আমার চোখের দৃষ্টি তেমন নয়। তবে ভালো না লাগলেও কী বা করার আছে। আমাকে বড় সাহেব এনেছে!

মানুষ দুজন লোকের প্রতি বিশেষ মনোযোগী থাকে—যাকে সে ভালোবাসে আর যার উপর বিরূপ। দাসদা, আমার উপর বিরূপ ছিল ফলে পথে ঘাটে আমাকে দেখলে আমার বিষয়ে কিছু জেনে বুঝে নেবার চেষ্টা করত। খুব একটা শান্ত নম্র ভদ্র লোক তো ছিলাম না। যাদবপুর রেল স্টেশনে ছিল আমার ঠেক। যেটা দাসদার দুবেলা যাওয়া আসার পথ। সে দেখেছে আমাকে মদ খেয়ে মাতলামো করতে মারপিট করতে, মার খেতে। পুলিশে ধরে নিয়ে যেতে। সে জেনেছে আমি এককালে নকশাল ছেলেদের সাথে মিশতাম। সিপিএম আমাকে ‘কেস ফাইল’ করে দেবে বলে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। রিক্সা ইউনিয়ন সংক্রান্ত কারণে সিটুর লোকেরা আমাকে ঝাড় দেয়। আমি পালিয়ে যাই যাদবপুর থেকে।

রাগ আমার উপর ছিল তার কিন্তু সে নিজে কিছু করবে অতটা সাহস শক্তি শরীর মনে নেই। আর সে সময় তার নিজের দলেও আঞ্চলিক বিশৃঙ্খলা চরমে উঠেছিল। কামারপাড়া, যার নেতা ছিল এক চৌধুরি, যে কামারপাড়া দক্ষিণবঙ্গের বিরোধী দমনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিল, যে কামারপাড়া প্রবল কংগ্রেস-পুলিশের আক্রমণের মুখেঝাণ্ডা বাধা লাল ডাণ্ডা তুলে রাখতে পেরেছিল, যেখানে পা রেখে পার্টি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুরাতন স্বভাব বদলে ফেলতে রাজি ছিল না। সেই আগের মতো বুনো মোষতুল্য চারদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। যাকে তাকে মার, তোলা আদায়, জমি জবর দখল এসব চালাচ্ছিল। ফলে জনগণ বিরূপ হচ্ছিল পার্টির উপর। এরা অন্য তো অন্য নিজের দলের দুর্বলকেও গিলে খাচ্ছিল। টিবি হাসপাতালে মহাজনি ব্যবসা কে চালাবে, কার টাকা সুদের খাটবে সেইনিয়ে বিবাদে এক সিপিএম মার্ডার করে দিয়েছিল আর এক সিপিএম-কে।

বড় সাহেব চাইতেন কামারপাড়া তার অনুগত বাধ্য বিনীত হয়ে থাকুক। তিনি যা বলবেন–সেই মত চলুক। কিন্তু কামারপাড়া যারা মার্কসবাদ লেনিনবাদ পড়েনি পার্টির গঠনতন্ত্র কর্মসূচি জানে না, জানে শুধু খুন জখম, জানে হাতে বন্দুক থাকলে পৃথিবী আমার পদানত, তারা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করতে রাজি ছিল না। ফলে কামারপাড়া এবং বড় সাহেবপন্থীদের মধ্যে ঠাণ্ডা গরম লড়াই চলছিল।

যতদিন চৌধুরিবাবু, খোকা দাস, সহ একগাদা নেতা কর্মীকে দল থেকে তাড়িয়ে না দেওয়া হয় ওই অবস্থা জারি ছিল। বিতাড়ন পর্ব সমাধা হলে সমগ্র যাদবপুর জুড়ে কায়েম হয়ে যায় বড় সাহেবের একচ্ছত্র আধিপত্য। মুকুটহীন সম্রাট হয়ে ওঠেন তিনি। এমন সম্রাট যে ইচ্ছা করলে যে কোনো লোককে কান ধরে ওঠবস করাতে পারেন।

এখন আমার বিষয়ে অনেক কিছু জেনে নেবার পর ওয়ার্ডেন মনস্থির করে ফেলেন, বিয়ের রাতে বেড়াল মারবেন। একটা গাছ মাটিতে পোর পরে যতদিন যায় একটু একটু করে সে তার শেকড় মাটির গভীরে বসিয়ে দেয়, আকাশে মাথা তোলে। তখন তাকে উপড়ে ফেলা কঠিন। এখনই তাকে নাড়িয়ে দিতে হবে। নাড়াতে থাকতে হবে, মাটিতে শেকড় বসাবার সুযোগ সময় না পায়।

***

যাদবপুর থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম চলতে চলতে আবার সেখানেই পৌঁছে গেছি। রান্নার কাজ থেকে শ্রমজীবনের শুরু। এখন আবার রান্নার কাজ পেয়েছি। এখন মনে হচ্ছে একটা বিশাল পরিক্রমার অন্তিম পর্বে পৌঁছে গেছি। এবার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটতে চলেছে।

আমি এক সময় গল্প লিখতাম। লেখার কাজটা আমার বড় প্রিয় ছিল। যখন কেউ আমাকে লেখক বলত ভীষণ ভালো লাগত। বাংলা ভাষার মূল ভূখণ্ড থেকে বহুদূরে থাকার জন্য বাংলা সাহিত্য জগতের সঙ্গে আর কোন গভীর সম্পর্ক রাখতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে জীবন আমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছে সেই ছিন্ন সূত্রকে সংযুক্ত করার জন্য।

ছত্তিশগড়ে থাকলেও মাঝে মাঝে বাংলার কোনো কোনো কাগজে একটা আধটা লেখা ছাপা হত। যে কারণে একজনাবিলবড়মানুয়ের চক্ষুশূল হয়ে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম জেনেছিলাম আপনজনও পর হয়ে যায়, ঈর্ষায় পোড়ে যদি সে এমন কিছু করে ফেলে যা বড়োর বড়ত্বকে ছাপিয়ে যায়।

লেখার জন্য প্রথম যাদের কোপে পড়িতারা একস্কুলের শিক্ষক এবং রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী। লেখার বিষয়বস্তু তাদের মনঃপূত ছিল না। এই প্রথম দেখলাম বামপন্থীরাও স্বপক্ষের সহকর্মীর শত্রু হতে পারে যদি সেই সহকর্মী সামাজিক মর্যাদায় তার সমকক্ষ হয়েও কোনো বিশেষ গুণে তাকে ছাড়িয়ে যায়।

আমি থাকতাম বস্তার জেলায়। সেখানেই সংগঠনের কাজকর্ম দেখাশোনা করতাম। মাসে এক দুবার দল্লী গিয়ে দেখা করে আসতাম নিয়োগীজির সাথে। একদিন সকাল বেলায় গেছি নিয়োগীজির বাসায়, উনি তখন গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরে বসে চা খাচ্ছেন আর পেপার পড়ছেন। আমাকে দেখে চোখ চক চক আর মুখে ফুটে উঠল সাদর হাসি। আসুন ব্যাপারীজি বসুন; আমি বসার পর বলেন তিনি, আপনার দূর্গ গল্পটা পড়লাম।

কেমন হয়েছে?

অসাধারণ।

শুধু এইটুকু বলে থেমে গেলে পারতেন। কিন্তু তিনি এখন আরও এমন অনেক কথা বললেন যা শুনলে যে কোনো নবীন লেখকের আনন্দে উড়তে ইচ্ছা করবে।

সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন এক গুণবান ডাক্তার, তিনি সত্যিই গুণবান। উনি এমন একজন চিকিৎসক যিনি কলকাতায় থাকলে কাঁড়িকাড়ি টাকা কামাতে পারতেন। তা না করে দরিদ্র আদিবাসী শ্রমিকদের সেবা করবেন বলে সর্বসুখ বর্জন করে এসে পড়ে আছেন এই দল্লীর শহিদ হাসপাতালে। মাইনে নেন মাত্র দুহাজার টাকা। নিজেই বলেন–আর টাকা কী হবে এতেই যখন চলে যায়।

একদিন রাত তখন প্রায় বারোটা, কনকনে পাহাড়ি শীতে উনি চান করছেন। শীতে আমার সর্বাঙ্গ জমে যাচ্ছে, আর উনি চান করছেন, ব্যাপার কী? পাগল হয়ে গেল নাকি।

বলেন তিনি একটা অপারেশন করতে হবে। প্রেসে গিয়েছিলাম। মিতান পত্রিকার ছাপার কাজ চলছে। বাইকে ফিরেছি, পথে কত ধুলো। চান না করলে ইনফেকশান হয়ে যাবে।

আমি আমার বুদ্ধি বিবেচনা অনুসারে বলি–অপারেশনটা কাল করলে কী হতো!

দেরি হয়ে যাবে। বলেই জল ঢাললেন মাথায়।

একজন হতদরিদ্র মজুর, তার হাইড্রোসিল অপারেশন। সেটা আজই করতে হবে। কাল করলে দেরি হয়ে যাবে। তাই এক ডাক্তার বরফ জমা শীতের দুপুর রাতে সাবান দিয়ে চান করে পরিচ্ছন্ন হচ্ছেন। কেউ সাক্ষী নেই, কেউ তার এই কাজের জন্য কোনো পুরস্কার দেবেন না। সব কিছু করছেন নিজের কর্তব্য বিবেচনাবোধ আর মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা থেকে। একমাত্র আমি তার সাক্ষী। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এল আমার সেদিন। যে রাজনৈতিক দর্শন মানুষকে এমন মানবিক করে তোলে সর্ব দর্শন তার কাছে খাটো পড়ে যায়।

আবার এই মানুষকেই কদিন পরে দেখি আর এক ভূমিকায়। কর্মকাণ্ডে যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না।

নিয়োগীজি সেদিন যখন আমার লেখার ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন চোখ পড়তে দেখলাম তার মুখ থমথমে হয়ে উঠেছে। যেন আষাঢ় মাসের আকাশে কালো মেঘ। নিয়োগীজির কথার ফাঁকে একবার তিনি বলে উঠলেন ডুলুংয়ের ওই সংখ্যায় আমারও একটা লেখা আছে। নিয়োগীজি সে কথায় কর্ণপাত করলেন না। এতে তিনি আরও ক্ষুব্ধ হলেন।

পত্রিকার এই সংখ্যায় আমি লিখেছি গল্প উনি লিখেছেন প্রবন্ধ। সত্যিইনর্মদা বাঁচাও আন্দোলন প্রসঙ্গে ওনার সেটা পরিশ্রমী লেখা। তবু সে লেখা বিষয়ে কোনো কথা না বলে, শুধু আমার লেখার প্রশংসা কেন করেছিলেন বিচক্ষণ নেতা শঙ্কর গুহনিয়োগী?

আমার ধারণায় উনি হয়তো ভেবেছিলেন একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত মানুষ সে তো ভালো লিখবেই। সেটাই তো স্বাভাবিক।কিন্তু যে লোকটা কোনোদিন কোনো স্কুলে যেতে পারেনি, জীবন কাটছে অনাহার, অর্ধাহারে, পাগলা কুকুরের মতো তাড়া খেয়ে খেয়ে, তাকে যদি একটু প্রশংসা করি, প্রেরণা যোগাই–সে একটা মানসিক জোর পাবে জীবন যুদ্ধে। কিন্তু সেই নর্মান বেথুনের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত ডাক্তার ভুল বুঝলেন।

ওই ডাক্তার কলকাতার জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের এক নেতা ছিল। কলকাতার যতো পত্র-পত্রিকা তাদের সাথে একটা গভীর নিবিড় সম্পর্ক ছিল তার। কলকাতার মানুষ দল্লীর এক বঙ্গ সন্তানের কর্মকাণ্ড নিয়ে বরাবর কৌতূহলী ছিল। ওই ডাক্তার দল্লীর শহিদ হাসপাতালের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এখানকার আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ে কলকাতার পত্র পত্রিকায় লিখতেন। এছাড়া ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার মুখপত্র ‘মিতান’-এর সম্পাদনা এবং বই পত্র প্রকাশনার দায়িত্ব ছিল ওনার। এই সব করতে করতে একটা একাধিকারবোধ মনের মধ্যে থানা গেড়ে বসে গিয়েছিল। ছত্তিশগড় থেকে বাংলা কাগজে লেখার মতো আর তো কেউ ছিল না।

আমি লিখি। এখন আমি ছত্তিশগড়ে চলে যাওয়ায়, ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সাথে যুক্ত হওয়ায় তার একাধিকার খর্ব হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। টলে যাচ্ছে আসীন আসন। এটাই তার মনোকষ্টের কারণ।

ক্রমে ক্রমে তার সাথে একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। বৈরী ভাবতে থাকে সে আমাকে। আগে বস্তার থেকে দল্লী এলে ডেকে কথা বলত এখন পাশ কাটিয়ে চলে যায়। দেখেও না-দেখার ভান করে। আমি গায়ে পড়ে আলাপ করতে চাই, সে আমল দেয় না।

একদিন দল্লীতে একটা মুখিয়া মিটিং চলছে। চেয়ারে বসে আছে সেই ডাক্তার। আমি গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বিকৃত হেসে সবাইকে বললেন, এ আদমি কভি দাদা লোগকে সাথ হুয়া করতা থা। দাদা লোক মানে নকশাল। তারপর আমাকে প্রশ্ন করলেন, কটা খুন করেছেন? আমার লেখা লেখক সত্তা নিয়ে কোনো কথা নয়, তার আগ্রহ সবার সামনে আমাকে একটা খুনি প্রতিপন্ন করা।

এরপর।

এরপর থেকে যখনই তার সাথে দেখা হয়, আমি যদি তার কাছে জানতে চাই-কী লিখছেন এখন! সে জিজ্ঞাসা করে আমি এখনও মদ খাই কিনা!

এইভাবে কেটে গেল কিছুদিন। ঘরের মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী। তখন কলকাতার একটা বিশিষ্ট পত্রিকা অনুষ্টুপ’নিয়োগীজির উপর একখানা পুস্তক প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়। যার নাম রাখে সংঘর্ষ ও নির্মাণ। যাদের সাথে নিয়োগীজিকাজ করেছেন, সংগঠনের সকল কর্মকর্তা, শ্রমিক কৃষক বহু মানুষের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ হতে থাকে, যারা লিখতে পারে লিখে দেয়, যারা পারে না, শুনে অন্য কেউ লিখে নেয়।

আমি বস্তারে বসে সে খবর পাই। কলকাতার এক বন্ধু চিঠি দিয়ে জানায়। এরপর আমি একটা লেখা তৈরি করি। লেখা তো মনের মধ্যে হয়ে বসেছিল, অপেক্ষা ছিল খাতার পাতায় নামানো। সেটা করতে যেটুকু সময়। উনিই ছিলেন এ অঞ্চলের লেখা সংগ্রহের দায়িত্বে। দিয়ে এলাম দল্লীতে গিয়ে ওনার কাছে লেখাটা।

কিছুদিন পরে, পুস্তক প্রকাশিত হবার পর দেখলাম প্রায় একশো লোকের লেখা ওই সংঘর্ষ ও নির্মাণ’বইয়ে আছে, শুধু আমার লেখাটা অনুপস্থিত। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল আমার।নিয়োগীজি আমার নেতা, আমি তার একজন সহকর্মী, এত লোকের এত লেখা! অনেক লোক তো জীবনে এই প্রথম লিখল–সবার সব লেখা রইল, শুধু আমারটাই বাদ! আমার প্রিয় নেতার জীবন ইতিহাসের আকরগ্রন্থে আমার কোনো নাম রইল না!

কেন এমন হয়েছে সেটুকু বুঝে নিতে আমার খুব বেশি মাথা ঘামাবার দরকার ছিল না। সত্যি বলতে কী, সেই প্রথম আমি বুঝতে শিখলাম যে, বামপন্থা হোক আর দক্ষিণপন্থা, কোনো পন্থাই মানুষকে তার ষড়রিপু থেকে বাইরে আনতে পারে না। হিংসা, দ্বেষ, ঈর্ষা, ক্লেদ, কলুষতা সব কিছু বহন করেই মানুষ সমাজে বিচরণ করে। যেমন গেরুয়া অঙ্গে ধারণ করলেই কোনো মানুষ সাধু হয়ে যায় না, যদি না তার অন্তঃকরণ শুদ্ধ-পূত পবিত্র হয়, তেমনই কেউ যদি কোনো বাম দলে যোগ দেয় সে খুব দরিদ্র দরদী হয়ে গেল, তেমনটা সচরাচর হতে দেখা যায় না।

আমরা অতি সাধারণ মানুষ। সাধারণত আমাদের অর্থের প্রতি আকর্ষণ অতিতীব্র।কারণ অর্থ দিয়ে জীবন ধারণের উপযোগী সম্পদ ক্রয় করা যায়। ক্রয় করা যায় অনেক সুখ। তাই যদি কারও অর্থের প্রতি তীব্রতম লালসা দেখি অবচেতনে তার উপর মনটা বিরূপ হয়ে ওঠে। যে অনেক অর্থ সম্পদের মালিক তাকে ভাবতে শিখি শত্রু বলে। ধরেই নিই যে লোকটা অসৎ। তার উপার্জন অন্যায় অবৈধ উপার্জন। অন্যকে ঠকিয়ে সে এসব কুক্ষিগত করেছে। অন্যকে শোষণ-দোহন বঞ্চনা করেই বাড় বাড়ন্ত। আমাদের সেই ক্রোধের তাওয়ায় বামদলগুলো তাদের স্বার্থের রুটি সেকে নেয়। তখন আমাদের মনে পড়ে না যে এইসব দলের নেতারাও এসেছে ধনবান পরিবার থেকে। সে ধন কোনো সৎ উপার্জনে জমা হয়নি। এসেছে সেই একই শোষণ দোহনের চোরাপথে। এরাও আমার শ্রেণি শত্রু।

আর আমাদের সেই আর্থ-সামাজিক বুভুক্ষা দৃষ্টি দিয়ে যখন কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে কিছু কিঞ্চিৎ অর্থের প্রতি অনীহা দেখি তিনি আমাদের চোখে মহান হয়ে যান। সন্ত বনে বসেন। সেই দুর্বল ফাঁক দিয়ে মানুষের মনের কন্দরে ঢুকে হাতিয়ে নিতে চান এমন কিছু যা অর্থের চেয়ে অনেক অনেক বড়।

ওই ডাক্তার সেটাই করতে চেয়েছিলেন। নিয়োগীজির মৃত্যুর পরে তার শূন্য আসনে উঠে বসতে চেয়েছিলেন। পুরো সংগঠনটাকে কবজা করে নিতে চেয়েছিলেন। সেটা অবশ্য পেরে ওঠেননি। দল্লী থেকে বিতাড়িত হয়ে যান। সেসব কিছুদিন পরে ঘটে। সে যাই হোক, তখন আমি আমার হৃদয় নিংড়ে বের করে আনা লেখাটার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাংলায় থাকি না, সে হলে একটা কিছু নিশ্চয় করা যেত। এখন একে কী করি! জীবন সুস্থির নয়, আজ এখানে কাল ওখানে। লেখাটা হয়তো হারিয়ে যাবে। শেষে কী ভেবে কে জানে ওটা মহাশ্বেতা দেবীর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। তখন উনি সেটা প্রতিক্ষণ পত্রিকায় দিয়ে দেন। ১৯৯১-এর ডিসেম্বর সংখ্যায় লেখাটা ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে যায়। আমার ধারণায় লেখাটা আমি ভালোই লিখেছিলাম। মহাশ্বেতা দেবীও বলেছিলেন, নিয়োগীকে নিয়ে এখন পর্যন্ত যত লেখা হয়েছে। তোমারটা সর্বোত্তম। কে জানে এই অপরাধেই ওই লেখাটা অনুষ্ঠুপের দপ্তরে গেল না হয়তো।

এরপর মহাশ্বেতা দেবী লেখাটার ইংরাজি অনুবাদ করে ফ্রন্টিয়ার পত্রিকাতে পাঠান এবং ১৯৯২,১ ফেব্রুয়ারি ওটি পুনঃপ্রকাশ হয়। ফের ওই লেখা হিন্দিতে অনুদিত হয়ে ওই বছরের সেপ্টেম্বর দিল্লির রাজকমল প্রকাশনার পুস্তক সংঘর্ষ আউর নির্মাণ-এ স্থান পায়। এই সব কারণে গুণধর ডাক্তার আমার উপর আরও খেপতে থাকে।

এর কিছুদিন পরে আমার এক বন্ধু আফিফ কলকাতা থেকে চিঠি লেখে ছত্তিশগড়ে আমার ঠিকানায়। জানায় ‘অভিমুখ’ নামে এক পত্রিকা নিয়োগীজির উপর একটা বিশেষ সংখ্যা করতে চাইছে। আমার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি চিঠি দিয়ে জানাই চলে এসো ছত্তিশগড়ে। এই কাজে আমার যথাসাধ্য সহযোগিতা থাকবে। কথা দিলাম।

কথামত নির্দিষ্ট দিনে আফিফ আর তার বন্ধু অভিমুখ পত্রিকা সম্পাদক–এসে গেল ছত্তিশগড়ে। সেই বন্ধুকে ওই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে দল্লীতে রেখে আফিফ গেল বস্তারে আমার ঠিকানায়। বহুদিন পরে দেখা, দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ হাসলাম, কিছুক্ষণ কাঁদলাম। আফিফ আগে রানার নামে একটা দেওয়াল পত্রিকা চালাত। পরে সেটা মুদ্রিত পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। এই পর্বে আমি সেই কাগজের লেখক ছিলাম। এরপর আফিফকে নিয়ে আমি চারদিন ধরে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ালাম। দেখা করলাম ভারত জন আন্দোলনের নেতা ড. ব্রহ্মদেও শর্মার সাথে, চেতনা মণ্ডলের সুরেশ মোড়ে, একতা পরিষদের রত্নেশ্বর নাথ, কাকেরের বাঙালি উকিল বিষ্ণুপ্রসাদ চক্রবর্তী, মুরলী মোহন উপ্ৰেতি আর নাজীব কুরেশির সাথে। এরা সবাই নিয়োগীজির আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। খুব কাছ থেকে দেখেছে তাকে। সবাই বলল লেখা দেবে। তারপর আফিফকে দল্লীতে পৌঁছে দিলাম। একদিন ওখানে থাকলাম। ওরা চলে গেল কলকাতা। আমি ঘুরে ঘুরে লেখাগুলো সংগ্রহকরলাম। হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে পাঠিয়ে দিলাম অভিমুখের ঠিকানায়। আজ আর সঠিকভাবে মনে নেই, খুব সম্ভব চারটে লেখা পাঠিয়েছিলাম বস্তার থেকে। যার মধ্যে একটা আমার নিজের লেখা, আর একটা নিয়োগীজির ‘শহিদ বীর নারায়ণ সিং’–এর বাংলা অনুবাদ।

কিছুদিন অপেক্ষার পর হাতে পেলাম অভিমুখ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা। পাঠিয়েছে আফিফ। পত্রিকা খুলে আমি হতভম্ব। কোথাও আমার কোনো নাম নেই। নিয়োগীজির লেখা–আমার অনুবাদ শহিদ বীরনারায়ণ সিং ছাপা হয়েছে বটে তাও আমার নামোল্লেখ ছাড়া। আফিফের নাম দেখলাম অতি ক্ষুদ্র অক্ষরে এক কোণে ম্রিয়মান হয়ে পড়ে আছে। সম্পাদকীয় পড়তে গিয়ে আমি আরও অবাক। সেখানে লেখা রয়েছে, যে লেখার উপরে নাম নেই তা অমুক ডাক্তারের লেখা বা অনুবাদ করা।

এর কারণ কী? একটা চিঠিতে সেটাও খোলসা করেছে আফিফ, সে যখন দল্লীতে তার বন্ধুকে রেখে বস্তারে আমার কাছে যায়, চারদিনের মধ্যে তাকে পটিয়ে ফেলে গুণধর ডাক্তার। প্রস্তাব দেয়, যদি মনোরঞ্জন ব্যাপারী পত্রিকায় যুক্ত না থাকে তবেই সে নিয়োগী বিষয়ক তথ্য-লেখা

অভিমুখকে দেবে। অন্যথায় নয়। আর যদি তা করা হয়, কলকাতায় তার বন্ধুমহলে একটা বিশাল সংখ্যার পত্রিকা বিক্রির ব্যবস্থা করে দেবে। দেবে আগাম কিছু আর্থিক সহযোগ মিতান তহবিল থেকে। বন্ধু সেই লোভনীয় টোপ গিলে নেয়।

ট্রেনে যেতে যেতে সে আফিফকে বলে এই প্রস্তাবের কথা। তা নিয়ে দুই বন্ধুতে তুমুল ঝগড়া হয়ে যায়। ট্রেন থেকে নেমে দুই বন্ধ হেঁটে যায় দুই পথে। ছিন্ন হয়ে যায় সব সম্পর্ক। একটা বিশেষ সংখ্যা করার জন্য যতটুকু যা দরকার, সব তো বন্ধু পেয়ে গিয়েছিল। সব গোছানো ছিল তার ব্যাগে। আর আফিফকে না হলেও চলবে। আমাকেও দরকার নেই। তবে আমার লেখাগুলো ডাক মারফত তার কাছে পৌঁছে যাবার পর ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিকে দৃষ্টি রেখে বীর নারায়ণ সিংকে বাদ দিতে পারে না। তাই ওই কৌশল–সব লেখা অমুকের।

পরে আফিফ একা একটা পত্রিকা করে দিবা রাত্রির কাব্য’। ভালোই চলছে সেটা। সেরা লিটল ম্যাগাজিনের সম্মানও পেয়েছে একবার।

২০১৫ সালের বইমেলায় সংঘর্ষ ও নির্মাণ বাংলা পুস্তকখানি অনুষ্টুপ থেকে নবপর্যায়ে পুনঃ প্রকাশ হয়েছে। দুজন সম্পাদকের একজন সেই গুণধর ডাক্তার। এবারও আমার সেই লেখাটি অভিমুখ থেকে নিয়ে এই পুস্তকে রাখা হয়েছে। তবে অন্য যে সব লেখা আছে তার কে লেখক, কে অনুবাদক নাম থাকলেও নাম নেই ‘আগামী প্রজন্ম ও শহীদ বীর নারায়ণ সিং’–এই লেখাটি যে হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিল। তবে এবার আর সব লেখা অমুকের’ এমন দাবিও করেন নি।

পরিশেষে যেটা বলার–একটু খারাপ তো লাগছে। তবে মানুষ লেখাটি পড়ছে, বীর নারায়ণ শঙ্কর গুহ নিয়োগী বিষয়ে জানছে এটা কম পাওনা নয়।

আর একটা কথা–যার গর্ভে জন্ম নিক, আর যাকেই বাপ ডাকুক তাতে কী! আমি তো জানি, আমিই ওর জন্মদাতা। আর জানে সেই অন্ধকার রাত, যে রাতে মেতেছিলাম–সৃষ্টি সুখের। উল্লাসে। সেই আনন্দ স্মৃতির ভাগ কে নেবে! সে একা আমার।

ওই ডাক্তার ওই আফিফের বন্ধু এরা একা বা বিচ্ছিন্ন নয়, এটা হল সমগ্র বাঙালি মধ্যবিত্ত বামপন্থীদের মানসিকতা। আমরা উচ্চ আমরা শ্রেষ্ঠ এটা স্বীকার করে নিয়েই আমাকে কমরেড ভাববে। এর বাইরে কী কেউ নেই? আছে, সে হচ্ছে ব্যতিক্রমী বিরলের মধ্যে বিরলতম। শঙ্কর গুহ নিয়োগী ছিলেন বিরলতমের একজন।

আমি আমার কর্মক্ষেত্রে অনেক গড়পড়তা মধ্যবিত্ত বামপন্থী পেয়ে গেছি, তারা রাজক্ষমতার অংশী বটে, তবে কেউ এতোটা আক্রামক নৃশংস নির্দয় নয়, যতটা ওয়ার্ডেন। এক অর্থে এ-ও বিরলের মধ্যে বিরলতম। দাসদার মুখে আমার কিছু পরিচয় জেনে ঠিক করে ফেলেছেন তিনি, আমাকে দুমড়ে দেবেন।

আমি কাজে যোগ দিয়েছিতখন মাত্র কয়েকদিন হয়েছে। উনি হাজিরা দিতে এসেছেন। এসেছেন সেই দশটায়। উনি এলে সারা স্কুলে একটা সোরগোল একটা ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে যায়। কাকে যে কী ভাষায় ধমকাবেন কেউ জানে না। ধমকানোর জন্য খুব বেশি কারণ দরকার পড়ে না। কারণ না পেলে কারণ খুঁজে নিতে কতক্ষণ লাগে! কথায় তো বলে ‘চালাক’ লোকের ছলের অভাব হয় না।

উনি স্কুলে ঢুকলেন। দেখলেন পায়খানা বাথরুমের লাইট জ্বলছে। ফেটে পড়লেন হুঙ্কারে। কে আছে দারোয়ান ডিউটিতে! হয়তো তখন বিহারির ডিউটি। কঁপায় তার উপর দেখছে না। লাইট জ্বলছে। ফালতু কারেন্ট পুড়ছে। পয়সাটা কী তোমাদের লালু দিয়ে যাবে!

মিন মিন করে বলে বিহারি–হামি আখুন লাইট নেভালো। তারপর গিলো পাম্প চালাতে। সেই সোমায় কাউ পায়খানা গিছে। সে যদি সুইজ না নেভায় হামি কী করব।

কোনো কথা শুনতেজাইনাদাজে রোজ এক গল্প। সব দারোয়ানগুলো ফঁকিবাজ। নেভাও, আলো নেভাও। আজ বলে দিলাম, নজর রাখবে। আর যেন কোনদিন দেখি না।

উনি স্কুলে আসা মাত্র নীচ থেকে কেউ না কেউ ছাদের দিকে মুখ করে চিৎকার দেয়, রঞ্জনদা, দাদা এসে গেছে। চাবসাও। উনুনে যা থাকতৎক্ষণাৎ সেটা নামিয়ে রেখে চা বসাতে হবে আমাকে। দশ মিনিট সময় তার মধ্যে চা বানিয়ে উনি কোথায় খুঁজে বের করে চা দিয়ে আসতে হবে। উনি তখন নীচের তলায় আছেন ভেবে, গিয়ে দেখব নেই। হয়ত দোতলায় ঘুরছেন, হয়তো কোনো ঘরে গিয়ে দাবা ক্যারাম খেলছেন। চা দিয়ে ফিরে আসব হুকুম দিলেন, চিনি কম আছে, নিয়ে আসুন। চিনি দেবার পর আর এক হুকুম, যান, সামনের মুদি দোকান থেকে একটা ফ্লেক নিয়ে আসুন। ফ্লেক এনে দেবার পর আবার আর এক হুকুম, দেশলাই নিয়ে আসুন।

এই যে একজন মানুষ গলদঘর্ম হয়ে বারবার সিঁড়ি ভাঙছে, তার হুকুমে কুকুরের মতো ছুটছে, এতেই তার মানসিক শান্তি আসছে, নিজের পদ এবং ক্ষমতার প্রতি সম্ভ্রম জাগছে। পারি, আমিও পারি। বড় সাহেব স্কুলে এলে সবাই যেমন কুঁকড়ে যায়, লেজ নাড়ায়, আমার জন্যও সেটা করে।

আমি এখানে আসার দ্বিতীয় কী তৃতীয় দিন এই রকম একটা হুঙ্কার গর্জন চিৎকার শুনেছিলাম ছাদে দাঁড়িয়ে, চা বসান। দাদা এসেছে। উনুনে তখন ডাল ফুটছে। ভেবেছিলাম ডালটা নামিয়ে চা বসাব। তাই একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। সেটাকেই সে ভেবে নিল অমনোযোগ, যা পরে অস্বীকার তারপর অবাধ্যতা হতে পারে। সেই বীজ অঙ্কুরেই বিনাশ করা বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ।

এমনিতেই সে সব সময় সরোষে কর্তৃত্ব বাচক শব্দাবলির ব্যাপক প্রয়োগ করে থাকে। যার মধ্যে জনৈক বড় নেতার আমি বলছি, আমি করছি অলঙ্কৃত মুদ্রাদোষ বহুল পরিমাণে ঝকৃত হয়। সেদিন সে তারই প্রদর্শন করে। কী হল! চা পেলাম না কেন?

বলি, রান্নার দেরি হয়ে যাবে, বাচ্চাদের স্কুল আছে। ডালটা…।

হ্যাং ইয়োর ডাল। গজরায় সে-হ্যাং ইয়োর বাচ্চা! আমি বলছি, আগে চা। ডাল নামান। কেউ যদি কিছু বলে, আমার নাম বলবেন।

অগত্যা ডাল নামিয়ে রেখে চা বানাই। তার অহম তৃপ্ত হয়।

আজ বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে দাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে চান করে দুটো খেয়ে বাড়িতে একটা চিঠি লেখার কথা ভাবছি। এমনিতে কেনারাম ফিরে গিয়ে আমার স্ত্রী অনুর কাছে সবকিছু বলেছে। তবু আমার একটা চিঠি দিয়ে সব কিছু বিস্তারিত জানানো দরকার।

অনু এখন পিত্তেপুরিয়া বলে একটা আদিবাসী গ্রামের আই.সি.ডি.এস. প্রকল্পের অন্তর্গত এক স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায়। দুশো পঁচিশ টাকা বেতনে ঢুকেছিল। এখন বেতন বেড়ে চারশো পঁচাত্তর হয়ে গেছে। তবে এই বেতনে একটা ছেলে একটা মেয়ে নিয়ে সেকি খেয়ে পরে বাঁচতে পারে? একটা ভরসা, আদিবাসী মানুষেরা ওকে খুব ভালোবাসে। আদিবাসীরা এমনিতে সভ্য জগতের মানুষকে বিশ্বাস করে না। ভালোবাসে না। দূরত্ব বজায় রেখে চলে।কিন্তু যাকে একবার ভালোবেসে ফেলে তার জন্য জান কোরবান।

শঙ্কর গুহ নিয়োগী আমাদের শিখিয়েছিলেন মানুষকে ভালোবাসতে। ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা পাওয়া যায়। তবে ওই–বুঝে নিতে হবে লোকটা মানুষ তো। আদিবাসীরা মানুষ। যদিও একটা দুটো অমানুষ হয়ে গেছে সে ওই সভ্য জগতের সহবতের কুফল।

আমি দীর্ঘদিন আদিবাসী অঞ্চলে ছিলাম। আমি সেই ভাগ্যবানদের একজন যে তাদের উজার করে দেওয়া ভালোবাসায় আকন্ঠ অবগাহন করে কৃতার্থ হয়ছি। আমার স্ত্রী অনুও সেই ভালোবাসা পাচ্ছে। তাদের যার ক্ষেতে যে নতুন ফসল ওঠে “মাদাম’ কে না দিয়ে খাবে না। মুরগি ডিম দিলে একটা দুটো তার জন্য রাখা থাকে। লাউ ধরেছে গাছে, একটা অনুর। জ্বালানি কাঠ নেই মাদামের বাসায় একজন সাইকেল করে ফেলে দিয়ে চলে যায়। ওদের ভরসায় কিছুদিন যদি অনু চালিয়ে নিতে পারে, আমি একদান ভাগ্যের সাথে জুয়া খেলে দেখতে পারি। যদি জিতে যাই আবার ওরা ফিরে আসবে এখানে। যদি হেরে যাই আমি চলে যাব ওখানে। তারপর যা হয় হবে।

চান করা খাওয়া আর হল না। রুনুর ছোট সংস্করণ এসে দাঁড়াল আমার সামনে। দুটো চোখের তারায় ধক ধক্ করছে চেপে রাখা জিঘাংসা। বলে সে সব কাজ হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, এবার চান করব।

চান পরে। নীচে চলুন।

কেন?

গেলেই দেখতে পাবেন।

নীচে যাবার পর দেখি একটা শাবল একটা দাঁ, হাতুড়ি কিছু পেরেক রাখা আছে। বলে সে তুলুন এগুলো। আমি তুলে নিই। সে আগে আগে হাঁটে আসুন। পিছন পিছন গিয়ে দাঁড়াই একটা ফাঁকা জায়গায়। সেখানে কিছু বাঁশ পড়ে আছে। বাঁশগুলো ফেড়ে মাঠের চারদিকে খুঁটি পুতে বেড়া দিয়ে দিন।আদেশ দেয় সে। এখানে সবজি চাষ করা হবে। যেন বেড়া মজবুত হয়, না হলে গরু ঢুকে পড়বে।

দুজন বাগানি আছে। একজন সকাল ছটায় আসে একই জায়গায় বসে এক বান্ডিল বিড়ি ফুকে বাড়ি চলে যায়। তা না করে আর কী বা করবে। বেচারার বয়স বছর চল্লিশ, ওজন কিলো তিরিশ, উচ্চতা তিনফুট, তার উপর হাঁপানি। তবে অন্যজন তাগড়া। লম্বা ছয় ফুট, ওজন আটাত্তর কিলো, বয়স বাহাত্তরে ছিল বাইশ। তার খুবই সাহস। আগে তার সাহসকে কংগ্রেস কাজে লাগাত এখন বড় সাহেব কাজে লাগায়। মাঝে মাঝে তার ডাক পড়ে সাহস দেখাবার জন্য। সেটাই তার আসল কাজ। মালি তো মাইনে পাবার জন্য। সে আসে যেদিন তার ইচ্ছে হয়। থাকে যতক্ষণ থাকতে চায়।

রুনুবাবুকে বলি–আমাকে তো রান্নার কাজের কথা বলা হয়েছিল। তাহলে এসব কেন?

বড় সাহেব বলেছে, এখানে সবাইকে সব কাজ করতে হবে। আর কোনো টাইম ফাইম চলবে না। আমার মাথার উপর দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে বলে সে।

সেটা কী শুধু একা আমার জন্য বলেছে! তাতো নয়। সবাই কী এখানে সব কাজ করে?

আপনি কী বলতে চাইছেন। তার মানে কী বড়দি গিয়ে আপনার সাথে রান্না করবে।

আমি কী তা বলেছি।

তাহলে কী বলছেন?

ছেড়ে দিন।

না, না বলুন কী বলতে চান। যদি বলেন বেড়া দেবেন না সেটা বড় সাহেবকে জানাই। তারপর আপনি জানেন।

বড় সাহেব! সেই কবে কত বছর আগে গব্বর সিং বলেছিল তার নাম শুনলে ভয়ে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে। আর এখন দক্ষিণবঙ্গের অনেক বিরোধী গ্রাম বড় সাহেব আসছে শুনলে ঘুম ভেঙে চমকে সেই যে জেগে ওঠে সারারাত আর দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। মানুষ নয়, যেন এক মূর্তিমান ত্রাসের প্রতিমূর্তি।

আমিও এখন কেঁপে গেলাম ভয়ে।নড়বড়ে হয়ে গেল সাহসের সব শেকড়। মনে পড়ে গেল। এক বন্ধুর উপদেশ। কী একটা ব্যাপারে যেন বলেছিলাম, আমি ভাঙতে রাজি আছি। মচকাতে রাজি নই। এই আমার জীবনদর্শন।

তখন বলেছিল সে-এটা কোনো বুদ্ধিমানের কথা নয়। গোঁয়ার নির্বোধরাই এমন করে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে গোয়ার্তুমি ভালো নয়। যে গাছের ডাল ভেঙে যায় কী হয়? জ্বালানি হয়ে যায়। যে ডাল একটু নমনীয়–সে নুয়ে যায়। অনুকূল সময় পেলে আবার সোজা হয়। এককালে তো বইপত্র পড়তিস। পড়িস নি–ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাক। কে বলেছে, লেনিন। সে কী বোকা ছিল? এক পা এগিয়ে দুপা পেছালে তার মানে তো হার! না হার নয়। দেখবি ঢু মারার আগে ষাঁড় কিছুটা পিছনে সরে আসে। ঘুসি মারার জন্য মানুষ হাত টেনে নেয় পেছন দিকে। এটাই পদ্ধতি।

এখন নিজের মনের কাছে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। প্রথমত, মানুষের সাথে মানুষ ভালো ব্যবহার কেন করে? করে, কারণ সেও চায় অন্যেরাও তাহলে তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে সহযোগ সহমর্মিতা দেবে। যার সে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে, যে নিজের শক্তিমত্তার উপর অত্যাধিক আস্থাবান হয়ে গেছে তার অন্যের সাথে সুসম্পর্ক সদব্যবহার করার দরকার পড়ে না। ভালো ব্যবহার করা ভালো মানুষ হয়ে ওঠা–এটা একটা দীর্ঘ অনুশীলন। সেটা যেমন একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে, বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায় ধীরে ধীরে। এর পিছনে ব্যক্তি মানুষের ভূমিকা খুবই গৌণ–এইসব কিছুর নিয়ন্ত্রক সময়-সমকালীন গোটা একটা ব্যবস্থা।

এই লোকটা শুধু এক ব্যক্তি নয় সে একটা মতাদর্শের প্রতিনিধি, একটা শাসন ক্ষমতার অংশ। তারই প্রতিফলন ঘটছে তার ব্যবহারিক জীবনে। যতক্ষণ এই ব্যবস্থার লয় বা শক্তিহ্রাস না ঘটবে তার যাপন প্রণালির কোনো পরিবর্তন হবার নয়। রামকৃষ্ণদেব বলেছেন যে সয় সে রয় যে না সয় নাশ হয়। মনকে বোঝাই, সহ্য কর। কত নামকরা ঐতিহ্যশালী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নবাগতের উপর অত্যাচার চলে। যার ইংরাজি নাম র‍্যাগিং। তোর উপর তাই চলছে। সয়ে যা। সয়ে যা আর অপেক্ষা কর। আমার বাবা বলতেন, যার না ধরি হাতে তার ধরি পায়ে–দেহি যদি দুঃসময়টা যায়। আমার বাবা ছিলেন অতি দুর্বল দরিদ্র নির্বিরোধী মানুষ। তাই তার বলা বাক্যে বিষ দ্বেষ থাকত না। এই কথা অন্য একজন বলত অন্যভাবে। অভদ্র বর্ষাকাল হরিণে চাটে বাঘের গাল, শোন রে হরিণ তোরে কই, সময় বুঝে সবই সই।

আর কথা বলি না, মুখ বুজে নেমে পড়ি ময়দানে। প্রায় তিন চার বিঘে জায়গা। আগে ভোবা ছিল, মেট্রো রেলের মাটি এনে ডোবা ভরা হয়েছে। এখানে সবজি চাষ হবে।

দুপুরের গনগনে রোদ, মাথার উপর যেন আগুন ঢালছে সূর্য, কুল কুল ঘামে শরীর ভিজে যাচ্ছে আমার। পেট কামড়াচ্ছে খিদেয় সেই অবস্থায় আমি খুঁটি পুতে বাঁশ চিরে পেরেক ঠুকে বেড়া দিতে থাকি। একদিনে কাজ শেষ হবে না। দিন চার-পাঁচ লাগবে। রোজ দুপুরের রান্না খাওয়ার পরে ভিড়ে যেতে হবে এই র‍্যাগিংয়ে।

এক সময় একটা শব্দ পেয়ে চোখ তুলে দেখি, দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর আমার রোদে পোড়া, ঘামে ভেজা কষ্ট দৃশ্য নয়ন ভরে অবলোকন করছে ছোট রুনু। তার চোখ হাসছে মুখ হাসছে, শরীর হাসছে কী এক আনন্দে।

***

আচ্ছা এটা কি সত্যি সম্ভব যে একজন উত্তর প্রদেশের লোক গেল মধ্যপ্রদেশে। দেখা হল একজনের সাথে, আলাপ পরিচয় বন্ধুত্ব হল। তারপর উত্তরপ্রদেশের লোকটি ফিরে গেল উত্তর প্রদেশে। এরপর বছর দশেক বাদে মধ্য প্রদেশের লোকটি এল পশ্চিম বাংলায়, আর সেখানেই দেখা হয়ে গেল উত্তর প্রদেশের লোকটির সাথে। এমন হওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার। যদি অসম্ভবটা সম্ভব হয় তবে বুঝতে হবে এর পিছনে অদৃশ্য কোন শক্তি আছে। গভীর কোন রহস্য আছে। আর বিশেষ কোন উদ্দেশ্য আছে।

আমার সঙ্গে দশবছর আগে দল্লীতে দেখা হয়েছিল দিল্লির যোগেনদার। এবার তার সাথে। আবার কলকাতায় দেখা হয়ে গেল। কারণ দিল্লির বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে যোগেনদা তার মাকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে বাস করবে বলে কলকাতার সোদপুরে একটি বাড়ি কিনে চলে এসেছেন।–যোগেন।ইনি দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের বাসিন্দা। এনার বাবা ছিলেন ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী। মা কোন এক হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডেন্ড।

এইরকম পরিবারের একমাত্র পুত্র যোগেন উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন দিল্লির নামি দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বন্ধু-বান্ধবও জুটেছে সব সম্পন্ন স্বচ্ছল ঘরের ছেলে মেয়ে। তবে এদের একটা বিশেষ বিশেষত্ব ছিল যে এরা শুধু নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য কেরিয়ার এসব নিয়ে ভাবিত ছিল না। দেশের আপামর জনসাধারণের দারিদ্র্য বঞ্চনা নিয়েও ভাবনা চিন্তা করতো। এরা চাইতো দেশ থেকে অসাম্য দূর হোক। সব মানুষ পাক খাদ্য বস্তু শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা এবং কর্ম সংস্থানের সম অধিকার। বলা বাহুল্য এরা মানসিক দিক থেকে কিছুটা নকশালপন্থীদের কাছাকাছি ছিল।

যোগেনের বাবা চাইতেন ছেলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক। হাসিল করুক সর্বোচ্চ ডিগ্রি। বিদেশে যাক, নিজের কেরিয়ার গড়ুক। সেই ছেলে নকশাল পন্থী’হয়ে যাওয়ায়, পড়াশোনা মুলতুবী রেখে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত হওয়ায়, ক্রোধে দিশেহারা হয়ে যোগেনকে ত্যাজ্য পুত্র করে দেন। বঞ্চিত করেন তাকে তার সম্পদ-সম্পত্তি থেকে। এতে অবশ্য যোগেনের জীবনে কোন পরিবর্তন ঘটে না। সে তার পূর্বের ভূমিকায় রয়ে যায়।

এরপর এক সময় উত্তাল সত্তর দশকের সমাপ্তি ঘটে। দিকে দিকে জেগে ওঠা বিপ্লবী সম্ভাবনা পিছু হটে। হতাশ যোগেনের বন্ধুরা আর কিছু হবে না’ ভেবে দেশে বিদেশে বড় বড় চাকরি নিয়ে বিয়ে থা করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তবে দেশের দরিদ্র মানুষের প্রতি তাদের যে দরদ তা তখনো সবটা মরে যায়নি। তখন সেই সব লোকেরা একত্র হয়ে ঠিক করে যে তারা তাদের বেতনের একটা অংশ দেশের কাজে ব্যয় করবে। এ জন্য সবাই মিলে একটা ফান্ড গঠন করে। এর সব ভার ন্যস্ত হয় যোগেনের উপর। সে চাকরি বাকরি বিয়ে ঘর সংসার কিছুই না করে সন্ন্যাসীতুল্য জীবন কাটাচ্ছে। দেশের প্রায় সব গণসংগঠন গণ-আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছে। এই ফান্ডের অর্থ কোথায় কিভাবে খরচ করা উচিত সেই সিদ্ধান্ত নেবে যোগেন। এ ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

তারা উপযুক্ত লোককে বাছাই করে উপযুক্ত দায়িত্ব দিয়েছে এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। যে দায়িত্ব যোগেন বহু বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছে। ভূপাল গ্যাস দুঘর্টনা। সবার আগে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে যে ট্রাক শোনে পৌঁছায় সে ট্রাকে সওয়ার থাকে যোগেন। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, মমাংগরা বাঁধে মৎসজীবীদের আন্দোলন, যেখানেই আন্দোলন যথাসাধ্য সাহায্য নিয়ে পৌঁছে যায় যোগেন এবং নিঃশব্দে নিজের কাজ সেরে ফিরে আসে। মঞ্চে ওঠে না পত্রিকার ইন্টারভিউ দেয় না টিভিতে মুখ দেখায় না। সব কিছু থেকে দূরে সরে মানুষের কাজ করে যায়।

দিল্লি থেকে এবার দল্লী এসেছে কিছু ওষুধ পত্র নিয়ে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা দ্বারা স্থাপিত শহীদ হাসপাতালকে দেবে বলে। এ সময়ে নির্বাচনী মহাযজ্ঞ চলছে। সেই প্রচার জিপে বসে দল্লী থেকে চলে এসেছে আদিবাসী জেলা বস্তারে। জল জঙ্গল জমিন নিয়ে গড়ে ওঠা এখানকার আদিবাসী আন্দোলন–যা চালাচ্ছে চেতনা মণ্ডল নামে এক সংগঠন সুযোগ পেলে কাছে গিয়ে সে আন্দোলনও একটু দেখবে।

এই বস্তার জেলার পারাল কোটে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসন পাওয়া এক গ্রামে যোগেনদার সাথে আমার পরিচয়। এরপর মাঝে মাঝেই উনি দল্লী থেকে আমার কাছে। চলে যেতেন। ঘরে খুঁদ কুড়ো যা রান্না হতে ভাগ করে খেয়ে ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে পড়তেন আমার পাশে।

এর কিছুদিন পরে যোগেনদা দল্লী ছেড়ে দিল্লিতে ফিরে যান। আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ থাকে না। কালে ভদ্রে উনি আমাকে এক আধখানা চিঠি লেখেন তাতেই বুঝতে পারি উনি আমাকে ভুলে যেতে পারেননি।

যোগেনদার বাবা মারা যাবার পর মা তার একমাত্র পুত্রকে ক্ষমাঘেন্না করে আবার কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তিনি এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছেন তাই পুত্রের কাছে নিজের শেষ ইচ্ছার প্রকাশ করেছেন, দূরদেশ দিল্লিতে নয়, শেষ নিঃশ্বাস ফেলবেন তিনি প্রিয় স্বদেশ সোনার বাংলায়। ভাগ্যিস মা ওই রকম একটা মনোবাসনা প্রকাশ করেছিলেন, তাই যোগেনদাকে আসতে হয়েছে বাংলায়। তাই আবার দেখা হয়ে গেল আমার সঙ্গে। না হলে আর দেখা হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না।

এটাও একটা অদ্ভুত যোগাযোগ। যা আমার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পক্ষে একটা সহায়তা সুত্র হিসেব চিহ্নিত হয়ে আছে। তাকে আর কোনভাবে যদি ব্যাখ্যা না করা যায় তবে অবশ্যই বলতে হবে ভাগ্য। ভাগ্যে ছিল বলেই এমনটা ঘটেছিল। না হলে যে আমি কোনদিন কলকাতায় আসব না, যে যোগেনদা কোনদিন আর বস্তারে যাবেন না-সেই দুজনার কলকাতায় দেখা হবে কেন!

উৎস মানুষ একটি বিশিষ্ট পত্রিকার নাম। আমি যখন বস্তারে ছিলাম পত্রিকা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত আমার ঠিকানায় একখানা করে পত্রিকা পাঠাতেন। যেটা যোগেনদার মারফতে হয়েছিল। একদিন খবর পেলাম ক্যানিংয়ে উৎস মানুষ পত্রিকার কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। বহুদিন যোগেনদার সঙ্গে কোন দেখা সাক্ষাৎ নেই। ভাবলাম ওখানে গেলে তার কোন খবর পাওয়া গেলেও যেতে পারে। সেজন্য অনুষ্ঠানে গেলাম এবং পত্রিকা সম্পাদকের কাছে যোগেনদার কথা জানতে চাইলাম। তিনিই বললেন যে যোগেনদা এখন স্থায়ীভাবে কলকাতায় আছেন। মা অসুস্থ তাই তার কোথাও যাবার কোন উপায় নেই। এবার আমি তার কাছ থেকে ঠিকানা পেয়ে চলে গেলাম সোদপুর। দেখা পেলাম যোগেনদার। এর পর থেকে মাঝে মাঝে দেখা আর কথা হতেই থাকল।

একদিন যোগেনদা আমাকে নিয়ে গেলেন লর্ডসিনহা রোডে। এখানে একজন সারস্বত সাধক থাকেন, যার নাম অশোক সাক্সোরিয়া। ইনি ভারতীয় ভাষা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত সীতারাম সাক্সোরিয়ার পুত্র। মাড়োয়ারি সম্প্রদায় সম্বন্ধে প্রায়শই একটা অভিযোগ ওঠে যে এই সমাজের মানুষ টাকা গোনা, টাকার কথা বলা, টাকার স্বপ্ন দেখা, টাকার গন্ধ শোকা এছাড়া পৃথিবীর আর অন্যকোন বিষয়ে আগ্রহী নয়। সেই প্রচলিত ধারণা ভেঙে এই শহরে যে কয়জন মানুষ এগিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম এই অশোকজি। যদিও নিজে উনি খুবই কম লিখে থাকেন তবে মানুষকে দিয়ে লেখাবার প্রয়াশ তার খুব বেশি। এই শহরে এমন একজনও নেই যিনি হিন্দিতে লেখেন অথচ অশোকজির কাছ থেকে প্রেরণা পরামর্শ নেননি। অশোকজির অনুপ্রেরণায় মাড়োয়ারি তনয়া অলকা সারাওগী অনুপ্রবেশ করেছিলেন সাহিত্য অঙ্গনে।যিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘কলিকথা ভায়া বাইপাশ’ লেখার জন্য সম্মানিত হয়েছেন সাহিত্য এ্যাকাডেমি পুরস্কারে।

যোগেনদার সাথে অশোকজির বাড়ি গিয়ে আমি ভীষণ অবাক। মনেই হল না যে এ বাড়িতে আমি আগে কখনও আসিনি। যেন ওই অকৃতদার বৃদ্ধ ঋষি, সাহিত্য রসিক আমার বহু বছরের চেনা।

কলকাতা শহরের মাড়োয়ারি সমাজের মধ্যমণি বিশাল বিত্তবান সীতারাম সাক্সেরিয়ার পুত্র অশোকজির ধনদৌলতের প্রতি কোন উৎসুকতা নেই। উনি ভালোবাসেন পুস্তক পরিবৃত হয়ে থাকতে, পুস্তক প্রেমী মানুষ দ্বারা ঘর ভরিয়ে রাখতে। যে কারণে বিশাল বিশাল সব ব্যবসাপাতি থেকে নিজেকে সরিয়ে লর্ড সিনহা রোডের প্রাসাদোপম বাড়ির এক নিরিবিলি কক্ষে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন তিনি। যেমন ভাবে যোগী ঋষিরা আশ্রয় নেয় কোন নিভৃত পাহাড় গুহায়। পারিবারিক সম্পত্তি থেকে উনি মাসে তিরিশ হাজার টাকা মাত্র নিয়ে থাকেন নিজের খরচ খরচার জন্যে।

সেদিন অশোকজি সশরীরে আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন।

তো আপ হি হ্যায় মনোরঞ্জন ব্যাপারী? অশোকজির চোখে মুখে সকালবেলার রোদ্দুর।

জি হ্যাঁ, আমিই মনোরঞ্জন।

যে কখনও ক্লান্ত হয় না? হেরে যেতে জানে না!

কে বলেছে!

আমি বলছি।

ভুল। বিলকুল গলদ। হারতে হারতেই আমি আজ এইখানে পৌঁছেছি। পরাজয় ছাড়া আমার জীবনে আর কিছু নেই।

আপনা আপনা নজরিয়া, বলেন তিনি। প্রত্যেকটা মানুষের দেখবার একটা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ আছে। একটা গেলাসে আধ গেলাস জল। কেউ বলবে অর্ধেক খালি, কেউ বলবে অর্ধেক ভরা। আপনি যে জীবন যাপন করছেন, অবশ্যই বলতে পারেন, হেরে গেছেন। তবে আমি বলব একটা জীবনের সময় সীমার মধ্যে দশটা জীবন যে যাপন করেছে সে সবচেয়ে বড় বিজয় প্রাপ্ত করেছে। হার কিসে হয় জানেন? যে নিজের মনের কাছে হেরে যায়। যে মনের কাছে হারে না সে পৃথিবীর কোন শক্তির কাছে হার মানে না। আমি তো বলব আপনার জীবন হার না মানা জীবন। এটা একটা উপন্যাসের জীবন। এই জীবন নিয়ে বই লেখা দরকার।

আমরা চলে আসার পর তিনি তার মানসকন্যা অলকা সারাওগীকে বলেন–আমার জীবন বৃত্তান্ত, এই জীবন উপন্যাসের জীবন। তুমি জীবন লেখ। হার না মানা জীবন।

ওই দিনই যোগেনদার মাধ্যমে পরিচয় হল সি.এস.সিতে কর্মরত কয়েকজন মানুষের সাথে। এই লোক কয়জন কোন ভালো কবি ভালো লেখক ভালো নেতা ভালো বক্তা কিছুই নয়। স্রেফ ভালো মানুষ। যা বর্তমান সময়ে এই দেশে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। কৃত্রিমতা বর্জিত খোলা মনের এমন দরদি উপকারী মানুষদের টানে যখনই আমার মন খারাপ লাগত দুপুর বেলায় ধর্মতলার সি.এস.সি. অফিসে ছুটে চলে যেতাম। কাজল দা, অমর দা, দেবাশীষদার সাহচর্যে খারাপ মন ভালো হয়ে যেত।

কাজলদার এক ভাইয়ের নাম শেখর। শেখরদা একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির নাম পদক্ষেপ। কলকাতায় আসবার পর আমার দ্বিতীয় দফায় সাহিত্য যাত্রা শুরু হল পদক্ষেপের মাধ্যমে। জেল জীবনের ছোট একটি ঘটনা নিয়ে লিখেছিলাম একটি গল্প ‘খাঁচার পাখিরাও গান গায়।

সেই গল্পের কিছুটা তুলে দিচ্ছি এখানে। কারণ ওটা গল্প হলেও আমার জীবনেরও একটা সময় জড়িয়ে আছে এই কাহিনির সঙ্গে।

‘এক বছর পর চালান হলাম প্রেসিডেন্সি জেলে। কত নাম শুনেছি এই জেলের। ইতিহাস বিজড়িত জেল আলিপুর প্রেসিডেন্সি–কত মহান মহান শহিদ জীবনের শেষ দিন এখানকারই কন্ডেম সেলে কাটিয়ে গেছেন। ঋষি অরবিন্দ এই জেলেরই এক সেলে বসে নাকি ভগবান দর্শন লাভ করে ছিলেন। শত শহিদের তীর্থভূমির ধূলি গায়ে মাখতে পেরে জীবনটা মনে হল যেন ধন্য হয়ে গেল।

মাত্র কয়েক মাস আগে বাহান্ন বা পঞ্চান্ন জন নকশাল বন্দী জেল ভেঙে পালিয়ে গেছে। জেলে তাই এ সময় খুব কড়াকড়ি।

কে যেন বলেছিল, জেলই হচ্ছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়। আমি সেই কথাটা মানি। জেল আমার জীবনে অভিশাপ নয়। পড়ে পাওয়া অমূল্য রতন। এই যে আজ দু কথা নিবেদন করতে পারছি আর গুণীজন তাতে চোখ বোলাচ্ছেন, একি কর্ম পাওয়া।

প্রেসিডেন্সি জেলে মনে হয় মাস তিনেক থাকবার পর দেখা হল আমার এক পুরাতন জেল খাটা বন্ধু রামুর সঙ্গে। স্পেশাল জেলে অনেক দিন একসাথে ছিলাম তো তাই বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ়। আমাকে দড়ি-হাজতের খাবার লাইনে থালা হাতে দেখে বড় অবাক হল সে–এ তোর চেহারা কি হয়েছে।

বলে সে–কাল থেকে তোর টি. বি. হয়ে যাক।

স্পেশাল জেলে দুতিন জন টি.বি. রুগী দেখেছিলাম দিন কয়েকের জন্য, পরে তাদের অন্যত্র চালান করে দেওয়া হয়। সবাই বলে স্পেশাল জেল ‘কচড়া’ জেল। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো মেলে না। সেই না মেলা খাওয়া টি.বি. রোগীদের যতটুকু মেলে দেখলে হিংসা হয়। সকালে আধ লিটার দুধ, দশ গ্রাম মাখন, দশ গ্রাম চিনি, দুটো ডিম, চা পাতা আর খান কয়েক বিস্কুট। একটু বেলা বাড়লে কলা-কমলা-আপেল। ভাত ডাল তরকারিও সব স্পেশাল। মাছ মাংসের দিনে শুধু গন্ধই নয় ঝোলের মধ্যে পরিমাণে বেশ অনেকটাই আমিষ পদার্থ থাকে।

পিটারের হাঁফানির টান ছিল। ও বড়ো আক্ষেপ করে ইশামসি বলেছিল রোগটা বদলে টি.বি. করে দিতে।

টি.বি. রোগ যদি হয় তাহলে খুব একটা মন্দ হয় না। প্রেসিডেন্সির সব ব্যবস্থাই উত্তম। কিন্তু তত ভাগ্য কি আমার আছে। টি.বি. না খাওয়া আর বেশি খায় লোকের রোগ। আমাদের মত মাঝারিদের জন্য এ ‘রাজরোগ’ নয়।

আমার মনোদশা বুঝতে পেরে রামু বলে–সত্যি সত্যি হতে হবে তার কি মানে আছে। ‘ঢবের’ হোক। ব্যাপারটা খোলতাই করে বাতলে দেয় রামরতন ওরফে রামু। আমি হচ্ছি দুনাম্বার টি.বি. ওয়ার্ডের ফালতু’। ওয়ার্ডে বিশ পঁচিশ জন পেসেন্ট আছে। তাদের জন্য একজন রান্নার ফালতু’ দরকার। ডাক্তারের সাথে আমি কথা বলে রাখবো। তুই কাল দড়ি হাজতের মেটকে বলবি–তোর টি.বি. আছে। ট্রিটমেন্টের জন্য ডাক্তারের কাছে যাবি। ও তোকে নিয়ে যাবে। ব্যাস আমি ক্যাচ করে নেব। মজায় থাকবি।

ছক নির্ভুল ছিল। কাজেই টি.বি. ওয়ার্ডে এসে যেতে আমার কোনো অসুবিধা হল না। রামু রান্না-বান্নার আইটমগুলো বুঝিয়ে দিল। ইচ্ছা থাকলেও তা এখানে বলা যাবে না। খুন খারাপি। বেড়ে যেতে পারে। শহর কলকাতার ফুটপাত, বস্তি, রেলস্টেশনে রোজই বিনা চিকিৎসায় বহু রুগী মারা যাচ্ছে। যাক্, সেটা তো আর খুন নয়। আমার লেখা পড়ে খাদ্য খাদক চিকিৎসার লোভে কোনো টি.বি. রুগী কারো পেটে কানিয়া ঠেসে দিয়ে অন্দর যাবার কামনা যদি করে বসে কে তার দায়িত্ব নেবে? তাই মুখে কুলুপ।

হাসপাতালের বাউন্ডারির পূর্ব দিকে রান্না ঘর। যার ওপরে ফিমেল ওয়ার্ড। উঁচু দেওয়ালের কারণে তাদের সাথে আমাদের চোখাচুখি হবার কোনো উপায় নেই। তবে কান সজাগ রাখলে কিচির মিচির শোনা যাবে। সন্ধের পরে সেটা বেশ স্পষ্ট হয়। তখন গুন গুন গানের দু-চার কলিও ভেসে আসে। আর হ্যাঁ, ঝগড়াও। মাঝে মাঝেই কাঁচা খিস্তির বন্যা বয়ে যায়।

রান্না ঘরে পর পর চারটে উনুন। প্রতি ওয়ার্ডের রান্না আলাদা, রাধুনি আলাদা। মুরগী, পাঁঠা, তেল, মাখন যে গুদাম থেকে পাওয়া যায়, উনুন জ্বালাবার কাঁচা কয়লাও সেখান থেকে মেলে। এ কয়লার আগুন আর ধোঁয়া প্রায় সমান সমান।

উনুন জ্বেলে দেবার পর ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায় বলে আমরা সবাই ঘর থেকে বাইরে এসে ধোঁয়া কম হবার জন্য অপেক্ষা করি। তা না করে তো উপায়ও নেই। চোখে তো কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু ব্যতিক্রম কেবল দু নাম্বার চৌকার নাগেশ্বরের বেলায় ঘটে। ও বাইরে আসে না। ধোঁয়ায় অন্ধকার ঘরে বসে কি যে করে কিছু বোঝাও যায় না। রান্না-বান্নার পরে হলে আন্দাজ করা যেত যে মাংস টাংস কিছু একটা সানটিং দিচ্ছে। কিন্তু উনুন জ্বলে সকালে, সব রান্নার আগে।

চার নাম্বার চৌকার মেহবুব মোল্লাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম–কি ব্যাপার চাচা? বিরক্তিতে ঘড় ঘড় করে বাজে সে “ছোড় দে উসকো বাত। বহুত সামঝায়া। মানতাহি নেহী। কভী কৌঈ সেপাই দেখ লেগা, গাড়মে দো লাথ পড়েগা তব সামঝেগা।”

এর বেশি সে তখন আর বিশেষ কিছু বলতে চাইল না। কিন্তু কৌতূহল আমাকে বাধ্য করলো নাগেশ্বরের উপর নজর রাখতে। কি এমন অপরাধ করে চলেছে ও যা সেপাইয়ের লাথি খাবার যোগ্য। দেখলাম পরের দিন সকালে একটা অব্যবহৃত কাঠের উঁচু টেবিল টেনে এনে দাঁড় করিয়েছে। উনুনের পাশে আর তার উপরে দাঁড়িয়ে নাগেশ্বর ধোঁয়া বের হবার ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে নির্ণিমেশ তাকিয়ে আছে ফিমেল ওয়ার্ডের দিকে। হা জেল কোডে এটা লাথ খাবার উপযুক্তই বটে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে, কামাতুর পুরুষের কদর্য দৃষ্টি থেকে, ধর্মীয় বিধিনিষেধ বেড়া জাল থেকে বেশ কিছুটা দুরে, দেওয়াল ঘেরা হাজার বারোশো মেয়ে মহিলার যে নিজস্ব জগৎ, স্বাভাবিক কারণেই তা অনেক নির্ভয় স্বাধীন এবং খোলা মেলা। শালা মনে হয় উঁকি দিয়ে সেই সব দেখছে।

এই জেলে আমি নতুন এসেছি। দু চারজনকে যতক্ষণ না পেটাতে পারছি ধাক্ জমবে না। সুযোগ যখন পাওয়াই গেছে আর ছাড়া কেন! আর তাই টেবিল থেকে নামিয়ে লোকজনে দেখতে পায় এমন জায়গায় এনে নাগেশ্বরের বুক বরাবর মাঝারি মাপের একটা পাঞ্চ করে দিলুম, সাথে ডায়ালগ–“সালে তেরা একেলেকে লিয়ে ক্যা পুরা জেলকো পিটবায়ে গা।”

হ্যাঁ জেলের এই নিয়ম। তবে সব সময় নয়। কখনো কখনো। ধরা যাক কেউ এক জন জেল থেকে পালিয়ে গেছে। সেই অপরাধে যারা পালায়নি সবাই মার খাবে। না-পালানো লোকদেরও উচিত ছিল পালানো আর না হয় পলাতককে পালাতে না দেওয়া। দুটোর কোনোটাই যখন সুচারু রূপে করতে পারেনি তখন কিছু শাস্তি তো পেতেই হবে।

নাগেশ্বর আমার যুক্তিটা মেনে নিল। বুঝলো যে আমার হাতে অদূর ভবিষ্যতে আরো দু একজন ঘুশি টুসী খাবে। চাই কি আমিও কোনো দিন কারো ধাক্ জমানোর শিকার হয়ে যেতে পারি। তখনকার মত চুপ করে গেল সে।

ঠেলা চুরির কেস ছিল। বিনা বিচারে প্রায় দেড় বছর জেলে হয়ে গিয়েছিল ওর, সেই কারণে ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল নাগেশ্বর। এবার কোর্টে গেলে আর বোধহয় জেলে ফেরত আসা যাবে না। কেস খালাস হয়ে ছাড়া পেয়ে যাবে। আগে দু’দুবার বেশি তবিয়ত খারাপ’ বলে যেতে হয়নি। এবার কোন অজুহাত দেখিয়ে কোর্টে যাবার হাত থেকে রেহাই পাবে! যত ওর কোর্টে যাবার দিন এগিয়ে আসছে প্রিয় বিচ্ছেদের গভীর যন্ত্রণা চোখে মুখে ফুটে উঠছে।

শেষে একদিন মরিয়া হয়ে আমার কাছে ছল ছল চোখে বললো “ভাইয়া মেরা একঠো কহা মানো। আমার এই লুঙ্গিটা এখনো নতুন আছে, কোর্টে যাবার দিন দিয়ে যাবো। শুধু একবার উঁকি মারতে দাও।

–”কেন রে! ওপারে কি?”

–”আমার একজন থাকে ফিমেল ওয়ার্ডে।”

–”কে থাকে তোর! কি কেস?”

–”মার্ডার।”

কয়েক দিন আগে হাসপাতালে রক্ত দিয়েছিল নাগেশ্বর। সেই টাকায় বিড়ি সিগারেট কিনেছিল। একটা সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। জেলে এর চেয়ে অমূল্য আর কিছু নেই। রক্ত বেচা পয়সার সিগারেট খেয়ে ওর প্রতি মনটা নরম হয়ে যায় আমার। আপন আপন স্বরে আলাপ চালাই আমি। আর তখনই এক ঘৃণ্য চোরের মনের তলদেশ থেকে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় এক অমলিন নিষ্পাপ আর্ত আত্মা। যে কিছুই পেতে চায় না। দিয়ে নিঃশেষ হতে চায়।

সারা দেশে দক্ষতা যোগ্যতা বিদ্যাবুদ্ধি সংখ্যায় মেধায় সব দিক দিয়ে মেয়েরা প্রায় পুরুষের সমান সমান। শুধু একটা মাত্র দিকে তাদের তেমন অগ্রগতি ঘটেনি, তা হল জেল যাত্রা। এদিক থেকে মেয়েরা পুরুষের অনেক পিছনে, অনেক নীচে। সে কারণে জেলে নারী অপরাধীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।

প্রেসিডেন্সী থেকে এই কারণে কোর্টে যখন চল্লিশ কি ষাট জন পুরুষ আবাসিককে হাজিরা দেওয়াতে নিয়ে যেতে হয়, মেয়ে বা মহিলা যায় দুই তিন বা পাঁচ। পাঁচ জনের জন্য আলাদা গাড়ি আলাদা ড্রাইভার আলাদা সেন্ট্রী দেওয়া খুবই ঝামেলার কাজ। তাই জেল কর্তৃপক্ষ ওই ষাট জনের মধ্যে এই পাঁচজনকেও গুঁজে দেয়। এটা তাদের অভিজ্ঞতায় বলে যে কাক কাকের মাংস খেতে চায় না। সবাই তো চোর ডাকাত খুনী, সব এক কাকের জাত।

এইরকম এক কোর্টে যাবার পথে নাগেশ্বরের চোখে পড়েছিল এক ‘বিল্লী আঁখ’ তরুণীর ভয় কাতর কোমল মুখের দিকে। তরুণীরও ভালো লেগেছিল বোধ হয় নাগেশ্বর ভুরুর উপরকার অগভীর কাটা দাগটাকে। তাই দুজন দুজনকে সুযোগ পেলেই এক ঝলক দেখে নিচ্ছিল। কথা বলা এখানে অপরাধ তাই মুখ ছিল মৌন। কিন্তু মন কিছু কিছু নিশ্চয় বলেছিল। সেই না বলা কথা দুজন দুজনার চোখের ভাষায় পড়ে নিতে পেরেছিল। এইরকম বার কয়েক আসা যাওয়ায় ওই অব্যক্ত ভাষা পেয়ে গিয়েছিল এক গভীর বিশ্বাসের অটুট বনিয়াদ।

সবটা জানে না নাগেশ্বর। তবে এইটুকু জানে যে মেয়েটা মার্ডার কেসে জেলে এসেছে। আর মাত্র দুমাস আগে তার লাইফার’ হয়ে গেছে। আর হয়তো এ জীবনে দেখা হবে না।

বলেছিলাম আমি কেন দেখা হবে না! তুই বের হয়ে গেলে ওকে ইন্টারভিউ করবি।

হতাশা ঝরে পড়ে নাগেশ্বরের গলায়–”ওর নাম, বাবার নাম, ঠিকানা কিছুই তো জানি না।” আর তারপর আমার হাত দুটো চেপে ধরেছিল–“আজ শেষ বারের মতো ওকে একটু দেখে নিতে দাও। ও নিশ্চয়ই এই ঘুলঘুলির দিকে তাকিয়ে বসে আছে।”

নাগেশ্বর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে চলে যাবার বেশ কয়েক দিন পরে ঘরের এক ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকারে উনুনের কাছে টেবিলটা টেনে এনেছিলাম আমি। তারপর সেই ঘুলঘুলি দিয়ে চোখ ছুঁড়ে ছিলাম দূরে! সামনে ছোট্ট একটা সবুজ মাঠ, মাঠের মাঝখানে দুজন মহিলা সেপাই। তার ওপাশে কল বল করে মটর সেদ্ধ খাওয়া এক দল নানা বয়সের মেয়ে। আর মটরের বাটি থেকে একটা একটা করে মটর ধীরে ধীরে পাখিদের সামনে ছুঁড়তে থাকা সেই বিড়াল চোখ মেয়ে। চোখে কিছু দেখতে চাওয়ার তীব্র তৃষ্ণা। বারবার সে দৃষ্টি এসে আছড়ে পড়ছে ধোঁয়া বের হওয়া ছোট্ট ঘুলঘুলিটার উপর।

আমার দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন তার দুচোখে একটা আলোর ঝিলিক খেলে গেল। তারপর নেমে এল চরম বিস্ময়। সেই দুটো বড় বড় চোখ কি যেন খুঁজতে চাইলো আমার ভুরুর উপর। কাটা দাগ কিনা বলতে পারবো না। নেই। যার ভুরুর উপর কাটা দাগ, সে নেই।

জেলখানায় আমার দিনগুলো খুব দ্রুত কেটে যায়। কাটতে চায় না তাদের যারা কষ্টে দুঃখে থাকে। আমি কষ্টে থাকি না। দুঃখ বলে কি পদার্থ আমার তা জানা নেই। ফলে সুখে থাকি। সুখের দিন দ্রুত ফুরায়–প্রবাদ বচন।

প্রায় আট-নয় মাস কোথা দিয়ে কিভাবে যে কেটে গেল টেরই পাইনি। মাঝে মাঝে ওই কোর্টে যেতে হয় নতুবা দিন চর্চায় কোনো নতুনত্ব নেই। সকালের গুনতি দিয়ে দিনের শুভারম্ভ, রাতে মাংসের ঝোল খেয়ে শুয়ে পড়া, স্বপ্নের ঘোরে তলিয়ে যাওয়া। একদিন, আজ না হয় কাল–জেলের মেট হবো আমি। আমার কোমরেও সাদা প্যান্টের উপর কালো চওড়া পিতলের চাকতিঅলা বেল্ট থাকবে। বেল্ট, ক্ষমতা আর সিনিয়রিটির প্রতীক। মেটেরা আমাদের চোখ টাটাবে বলে মালার মত বেল্টটা গলায় ঝুলিয়ে রাখে। হবে হবে। ভাগ্যে থাকলে আমারও একদিন হবে।

দুটো বাচ্চা ঝগড়া করছিল। একজন বলছিল অপরজনকে–তোর ঠাকুরমা মারা গেলে শ্রাদ্ধে আমাকে নিমন্ত্রণ করিসনি। মনে রাখিস, আমার ঠাকুরমারও জ্বর হয়েছে। এদের দোলানো বেল্টের অহংকার দেখে বলতে ইচ্ছা করে–জ্বর আমার গায়েও আছে।

রোজই জেলে নতুন নতুন মানুষ আসে। একদিন তারাও পুরানো হয়। পুরাতনরা ছুটি পেয়ে স্বাভাবিক নিয়মেই একদিন জেল থেকে বের হয়ে যায়। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার নতুন করে ফিরে আসে নতুন করে জেল বাসের জন্য।

একদিন সকালে আমদানিফাইলের সামনে নতুন আসা আসামীর ভিড়ে ফাইলে বসা নাগেশ্বরকে দেখে চোখ আটকে গেল কাটা ভুরুর উপর। আমাকে দেখতে পেয়ে ফাইল থেকে উঠে এসে হাউ হাউ করে যা বলল সে, তার মর্মার্থ হচ্ছে সত্যিকারের জেল সাজা ও এই ছয় আট মাস জেলের বাইরে থেকে ভোগ করেছে। মুক্ত দুনিয়ায় অনেক কিছুই আছে সত্যি। কিন্তু যে জগতে, জীবনে কটা চোখের কটাক্ষ নেই, সে জগত, জীবন আর যার কাছেই হোক নাগেশ্বরের কাছে কিছুতেই মনোরম নয়। তাই আবার ঠেলা চুরি করেছে ও। তবে এবার আর তাকে খুঁজে ধরতে হয়নি, খুঁজে ধরা দিয়েছে। শরীরের কাটা ফাটা দাগের সংখ্যা সে কারণে দু একটা বাড়তি।

আমার কাছে ওর মাত্র একটাই কাতর আবেদন, যে ভাবে পারি হাসপাতাল চৌকায় যেন একটা কাজে লাগিয়ে দেবার ব্যবস্থা করি। যদি তা করি তবে যে দিন ‘ব্লাড ব্যাঙ্ক বসবে’ সেই দিনই সে আমাকে পাঁচ প্যাকেট চারমিনার দেবে।

অনেক বছর কেটে গেছে। চোখ বুজলে আজো সেই আকুল আর্তিমাখা দুটো ছলোছলো চোখ আমাকে কাতর করে তোলে। শেষ পর্যন্ত ওদের কি হয়েছিল তা আমার জানা নেই। জানা নেই এই ইন্দ্রিয়াতীত প্রেমকে কোন নামে ডাকবো।

আমি জানি আজ কাল পরশু কোনো একদিন আবার যদি প্রেসিডেন্সি জেলে যাবার সুযোগ ঘটে, কোন এক চুম্বকীয় আকর্ষণ আমাকে টেনে নিয়ে যাবে ঘুলঘুলির সামনে। আমার চোখও সেই ঘুলঘুলি দিয়ে দুটো সজল কটা চোখকে খুঁজবে। যদি আজো তেমনি সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে কাউকে তাকিয়ে থাকতে দেখি নিঃসন্দেহে আমার চোখ জলে ডুবে যাবে। অন্তর মন প্লাবিত হয়ে যাবে লবণাক্ত বেদনায়।

এরই কদিন পরে দেবাশীষদার একবন্ধু যার নামও দেবাশীষ তারই পত্রিকা “আনোয়ান-এ” প্রকাশিত হয় আমার দ্বিতীয় গল্প ‘বধ্যভূমি থেকে ফিরে’।

যোগেনদার মাধ্যমে পরিচয় হয় সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজন গল্পকার-গবেষক-প্রবন্ধকার–পুস্তক সমালোচকের সঙ্গে। সন্দীপদা আমাকে দিয়ে রবিশষ্য পত্রিকার জন্য লিখিয়ে নেন আমার বাল্যকালের স্মৃতি কথা। অভিশপ্ত অতীত-অন্ধকার ভবিষ্যৎ-শিরোনামাঙ্কিত সে লেখাটি পরে অনেক কটি পত্রিকায় পুনঃ প্রকাশ পায়। সে লেখার একটি বক্তব্য বহু বিদগ্ধ মানুষ প্রশংসা করে উদ্ধৃতি হিসাবে তাঁদের রচনার সঙ্গে সংযোজন করেন। যা আমি লিখেছিলাম হিন্দু ও মুসলমান, উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের আন্তঃসম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে। লিখেছিলাম যে মানুষ আর একজন মানুষের কাছে কুকুরের চেয়েও ঘৃণ্যজীব বলে বিবেচিত হয়। সে তাকে ভালোবাসবে সম্মান করবে এ হয় না। হতে পারে না।

সে যাইহোক, একদিনি সি.ই.এস.সি. অফিসে গিয়ে অমরদার মুখে খবর পেলাম যে অলকা সারাওগী নাকি শেষ কাদম্বরী নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। দিল্লির রাজকমল প্রকাশন দ্বারা প্রকাশিত সেই পুস্তকে এমন একটি চরিত্র আছে যার নাম মনোরঞ্জন ব্যাপারী। শুনে আমার তো বিস্ময়ের আর সীমা পরিসীমা রইল না। অশোকৃজির বাড়ি আমি যাই, অলকাজিও আসেন। কিন্তু আমাদের দুজনার তো মুখোমুখি এখনও দেখাই হয়নি। তবে? কোথা থেকে পেলেন উনি এই নাম? পেয়েছেন অশোকজির কাজ থেকে।

যতদিন যোগেনদা দল্লীতে ছিলেন মাঝে মাঝে বস্তারে আমার ঠিকানায় চলে যেতেন। আর আমরা দুজনে সাইকেলে চেপে চলে যেতাম দূরের কোন আদিবাসী গ্রামে সংগঠনের কাজে। চার-পাঁচ-ছয় ঘন্টার সেই দীর্ঘ যাত্রায় আমি আমার বিগত জীবনের কথা বলতাম ওনাকে। উনি ওনার কথা বলতেন আমাকে। বলতেন উনি কমই, শুনতেন বেশি। মাস দুয়েক পরে দেখলাম আমার আর বলার মত কিছু অবশিষ্ট নেই। যতটুকু বলা যায় সব বলা হয়ে গেছে। যা পড়ে আছে বলা যায় না। লেখাও যায় না। লিখলে সেই আমার কথা আমার সামনে ফনা তুলে দাঁড়াতে পারে। আর বললে বিশেষ করে যোগেনদার মত মানুষের সামনে তা থেকে অহংকার আত্মপ্রচারের দুর্গন্ধ বের হতে পারে।

আমার এখনও সেই দিনটার কথা মনে আছে। যেদিনের কথা কিছুতেই ভোলা যাবে না। মনে আছে হয়ত যোগেনদারও। তখনও আমি কাপসীতে আসিনি, পি.ভি.৫৬ নাম্বারেই থাকি। সেদিন আমার বাসায় যোগেনদা পৌঁছেছেন রাত আট কি নটায়। শহর কলকাতার আটটানটানয়, জঙ্গলের আটটা নটা। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার সেই রাত আমাদের চারপাশে নেমেছে আরও কালো–ভয়াবহ হয়ে। সারাটা গ্রাম সে সময় নিঃঝুম হয়ে গেছে। কাপসী পাখানজুর বান্দে এই কটি টাউন এলাকা ছাড়া সারা অঞ্চলের এই নিয়ম। সন্ধ্যে হলেই রাতের খাওয়া খেয়ে শুয়ে পড়া। আর সূর্য ওঠার আগে শয্যা ছাড়া।

সেদিন আমাদের ঘরে কোন চাল ছিল না। যা সামান্য চাল তা দুপুরে রান্না হয়েছিল। যার কিছুটা খেয়ে বাকিটায় জল ঢেলে রেখেছিল অনু। সেটুকু বাচ্চা দুটোকে খাইয়ে রাতে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে স্বামী স্ত্রী আমরা উপোস করেছিলাম। সেই ভয়ানক দুর্গত সময়ে যোগেনদার আগমন। দল্লী থেকে বের হয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে এখন এখানে পৌঁছেছেন। তিনিও ক্ষুধার্ত। অনাহারে আমরা মাঝে মাঝেই থাকি। সেটা কাক পক্ষিতেও টের পায় না। সে বড় অপমান আর লজ্জার। না খাওয়ার কষ্ট সহ্য করা যায় না তার উপর আবার পাড়া প্রতিবেশির বিদ্রূপ-হিতলোদেশ সহানুভূতির নাটক। তাই পেটে কিল মেরে চুপচাপ শুয়ে থাকি। সেদিনও শুয়েছিলাম। এমন সময় দরজায় অতিথি। আমার বাবা বলতেন–অতিথিনারায়ণ।যেদিন আমাদের বাসায় কিছু ভালোমন্দ রান্না হতো বাবা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন–যদি কেউ আসে। খাবার সময় দুঃখ করতেন–ব্যাডা আইজ এ্যাট্টা অতিথি আইলে না! সেই বাপের ছেলের দরজায় দাঁড়ানো অতিথি নারায়ণকে দেখে এখন বিস্মিত বিব্রত লজ্জিত এবং দুঃখিত। কী এখন করে সে?

কী আর করবে। দরজা খুলে অতিথিকে ঘরে বসিয়ে একটা গামছা নিয়ে বের হয় গ্রাম পরিক্রমায়। এই রকম এক বিপন্ন দিনে পিছন দরজা দিয়ে ঘটি হাতে একদিন বের হয়ে গিয়েছিলেন বিপিন ব্যাপারী। ঘটিটা বন্ধক দিয়ে চাল এনে মান রক্ষা করে ছিলেন। আমি এখন কি বন্ধক দেব! আমার যে–বন্ধক দেবার মত কিছুই নেই।

তখন গ্রামের সব মানুষের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষ দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে। বাকিরা শোবার তোড়াজোর করছে। গ্রামের একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত যত ঘরের দরজা খোলা পেলাম সব ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম–কিছুটা চাল ধার দাও ভাই। ঘরে হঠাৎ অতিথি এসে গেল তো, তাই। ভেবেছিলাম কালকে হাটে গিয়ে কিনব। কে জানে যে এমন অসময়ে অতিথি এসে যাবে!

নেই। আমাদের দেবার মত চাল কারও ঘরেই নেই। কী করে থাকবে আর কেন থাকবে? যারা যারা ধার দিতে সক্ষম ইতিপূর্বে তাদের প্রায় সবার কাছ থেকে এক কিলো দুকিলো করে যে নেওয়া হয়ে গেছে। সে ধার কবে শোধ হবে তা কে জানে। তার উপর আবার নতুন ধার? না বাবা মাফ করো। যখন হতাশ আর নিরাশ হয়ে ফিরে আসছি তখন গ্রামের একমাত্র মুদি দোকানের মালিক জগদীশ আমাকে ডাকল। জানতে চায় সে, কী ব্যাপার! এত রাতে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটে বেড়াচ্ছে? তখন তাকে বলি আমার ছুটে বেড়াবার কারণ। জগদীশের কাছে আমার আগেরই দুশো টাকার মত বাকি পড়ে আছে, তা সত্ত্বেও এখন দু-কিলো চাল আড়াই শো ডাল আধ কিলো আলু দিল। এই কিন্তু শেষ, বাকি শোধ না দিলে আমি কিন্তু আর দেব না। বলে দিল সে। সেই চালে ভাত রান্না হলে যোগেনদা খেলেন খেলাম আমরাও। খাওয়া দাওয়ার পর বলেন তিনি–বড় ভালো খেলাম। গত এক দেড় মাসে কোন তরকারি খেতে পাইনি। আলুর তরকারিটা অনু বেধেছেও দারুণ।

যোগেন দা! যার দুই কাঁধে দুটো সাইড ব্যাগ। একটা ব্যাগে আছে তার এক সেট জামা কাপড়, চশমা পেন ডায়েরি, কটা বই। অন্য ব্যাগে এখন কমপক্ষে পনের কুড়ি হাজার টাকা। সে টাকা তিনি খরচ করতে পারেন স্বাধীনভাবে। কেউ তার কাছে কোন হিসাব চাইবে না। সে সামান্য চারটাকা কিলোদরের আলু কিনে খেতে পারল না গত এক দেড় মাসে? কেন সে শুধু ডাল আর ভাত যা রান্না হয় দল্লীর মেসে তাই খেয়ে রয়েছে। রয়েছে, কারণ, ব্যাগের ওই টাকা তার বন্ধুরা তাকে দিয়েছে দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য। সে টাকা যোগীনদা কেমন ভাবে নিজের জন্য খরচ করে?

এইসব দিনে যোগেনদা আর আমি দুজনে যেমন দুজনের জীবন কথা জেনেছিলাম, পেয়েছিলাম দেশ আর দেশের মানুষের বিষয়ে নিজস্ব ভাবনা চিন্তার কথাও। এরপর তিনি যখন ছত্তিশগড় বাস সমাপ্ত করে ফিরে আসেন, দিল্লি চলে যাবার আগে কিছুদিন কলকাতায় থেকে গিয়েছিলেন। তখন কলকাতায় তার যত বন্ধু সবাইকে বলেছিলেন আমার কথা। ফলে কলকাতার সেই সব মানুষ যারা শংকর গুহ নিয়োগীর আন্দোলন বিষয়ে খোঁজ খবর রাখেন তারা আমার কথাও জানতেন। কুশল দেবনাথ নামে এক জন ছত্তিশগড় ঘুরে এসে আনন্দবাজার পত্রিকায় যে প্রতিবেদন লেখেন তাতে শেষ চার ছয় লাইনে আমার কথাও থাকে। এই সব কারণে কলকাতায় না এলেও আমি অশোকজি এবং অন্যান্যদের কাছে অপরিচিত ছিলাম না।

অশোকজির কাছ থেকে অলকাজি যখন আমার কথা শোনেন তখন তিনি তার দ্বিতীয় উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিয়েছেন। তখন তার মনে হয় এই উপন্যাসের একটা চরিত্রের নাম মনোরঞ্জন ব্যাপারী রাখবেন। আর তাই আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে একটি চরিত্রের সৃজন করেন আমারই নামে।

আমার এই নামটি–আমার বড় প্রিয়। এ নাম আর কারও নয়–আমার। একা আমার। টেলিফোন ডাইরেক্টরি, ভোটার লিস্ট, রেশন দোকানের খাতা, পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপনের পাতা, বইমেলায় প্রকাশিত গিল্ডের পুস্তক তালিকা সম্বলিত ইয়া মোটা বই, সব আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। মনোরঞ্জন নামে অনেক আছে, কিন্তু মনোরঞ্জন ব্যাপারী নামে একজনও নেই। এই মহাবিশ্বে আমি এক এবং একক। এটা আমার গর্ব এটাই আমার অহংকার। আমার ভালো আমার কালো আমার আলো সবটা মিলিয়ে এক অখন্ড আমি। আমার কোন্ দুসরা নেই, বিকল্প নেই, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিরূপ নেই। অলকা দিদি কলমের এক আঁচড়ে আমারই প্রতিচ্ছায়াকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আমারই প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে।

অলকা দিদির সাথে দেখা করে একখানা শেষ কাদম্বরী’ চেয়ে নিয়ে পাঠ করার পর এমনই মনে হয়েছিল আমার। বড় অদ্ভুত মানুষ এই অলকা সারাওগী। বিশাল বিত্তবান পরিবারের কন্যা এবং বঁধু কিন্তু তার মনে অর্থের কোন উত্তাপ–খ্যাতির কোন অহমিকার প্রকাশ ছিল না। নিজের হাতে চা বানিয়ে আমাকে দিতেন। আমি এক ‘অচ্ছুত অস্পৃশ্য’ জেনেও আমার এঁটো কাপ তুলে নিয়ে যেতে দ্বিধা করতেন না। যখনই সময় পেতাম তার সঙ্গে দেখা করে আসতাম। তখন একদিন বলেছিলাম তাকে দিদি, এ আপনি কোন মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে নির্মাণ করলেন। মনোরঞ্জন ব্যাপারী যার নাম হয়, সে এত নরম এত নিভুনিভু কী করে হতে পারে। সে তো হবে কঠিন কঠোর রূঢ় রুক্ষ নির্মম।

আমার অন্য কী কী দোষ আছে তা আমার অজানা। তবে একটা দোষ আছে, আমি মহা বাঁচাল। একবার কথা শুরু করলে কোথায় গিয়ে থামতে হবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। অলকা দিদির কাছে যেতে যেতে বকবক করতে করতে একদিন টের পেলাম আসল মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সব কথা পেট থেকে বের হয়ে গেছে। আর অলকা দিদি তার তৃতীয় উপন্যাস ‘কোঈ বাত নেহি’তে একটি চরিত্র মনোরঞ্জন দত্ত ওরফে জীবন চন্ডাল-এর নির্মাণ করে সে সব কথা লিখে দিয়েছেন। যে সব কথা আমি এই কাহিনীতে লিখিনি, লিখতে সাহস পাইনি। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মনোরঞ্জন, মদন দত্তের দত্ত এই দুই অংশ জুড়ে ওই নাম। আর জীবন চন্ডাল আমার সেই সময় ‘বহুজন নায়ক’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকা উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রের নাম।

***

এক একটা মানুষ আছে যার মুখটা দেখলেই মনটা অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে আসে। ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। এ আপনার আমার সবারই করে। আবার এমন এক একটা মানুষ আছে যাকে দেখলে মনটা বিরূপ হয়ে ওঠে। মুখে ঘুসি মারতে সাধ যায়। কোন অপরাধ করেনি। তবুও।

কে জানে ওয়ার্ডেন লোকটার কাছে আমি হয়তো ওই শেষ দলেরই একজন। সে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে আমাকে চূর্ণ করে ফেলার। আজ সে হাজিরা দিতে আসার সময় ভ্যানে করে নিয়ে এসেছে দুটো বড় বড় ড্রাম। তাদের প্রমোটারি ব্যবসা আছে। এটা এই সময়ে সব সিপিএম নেতাদের প্রিয় ব্যবসা। ধমকে চমকে মালিকের কাছ থেকে জমিটা কেড়ে নিয়ে যা কিছু একটু দাম দিয়ে সেই জমিতে গড়ে তোলে বহুতল বিল্ডিং। তারপর বহুমুল্যে বিক্রয়। দশলাখ পুঁজি লাগিয়ে পঞ্চাশ লাখ মুনাফা।

সেই রকম কোনো বিল্ডিং নির্মাণে ড্রাম দুটোকে ব্যবহার করা হয়েছিল। একটার বাইরে ভিতরে শক্ত হয়ে জমে আছে সিমেন্টের চাদর আর একটায় চুনের প্রলেপ মোটা করে লেপটানো।

গেটের সামনে সে দুটোকে নামিয়ে ছাদের দিকে মুখ করে আমার নাম ধরে চিৎকার করে, শিগগির নীচে আসুন। যদি যম ডাকে তাকে যদি বা বলা চলে। একটু পরে যাব, সে হয়তো মানবে, ওয়ার্ডেন মানবে না। ভাত গলে যাবে। গলে যাক। ডাল উথলে উঠবে উঠুক। তবু তার হুকুম না মেনে উপায় নেই। এরই নাম ক্ষমতা। দৌড়ে নীচে নামলাম। ড্রাম দুটো দেখিয়ে বলে সে–এগুলো ছাদে নিয়ে যান।

এ দিয়ে কী হবে?

আগে নিয়ে যান। গিয়ে চা বসান, পরে বলছি।

কিছুক্ষণ পরে সে এক বোতল অ্যাসিড, সাবানগুড়ো, নারকেল ছোবড়া নিয়ে ছাদে আসে। বলে–ড্রাম দুটোকে এইসব দিয়ে ঘসে একেবারে চকচকে করতে হবে। এতে বাচ্চাদের খাবার জল ধরে রাখতে হবে।

ছাদে পাইপ লাইন আছে। কর্পোরেশনের জল আসে। সেই জলে রান্না করতাম। দিন দুয়েক আগে আদেশ দিয়ে গেছে–চলবে না, রান্নার জল টিউবওয়েল থেকে বালতি ভরে নীচে থেকে নিয়ে আসতে হবে। আমি আসার আগে গুঁড়ো মশলায় রান্না হতো। এক আদেশে সেটাও বন্ধ হয়েছে। ওতে ভেজাল থাকে বাচ্চাদের শরীর খারাপ হবে। শিল নোড়া এনে দিয়েছে। এখন আমি বাটা মশলায় স্বাদুতরকারি রাঁধি। বাচ্চা গোনা ছাড়াও আর একটা দায়িত্ব উনি পালন করেন–দুবেলা ভাত ডাল তরকারি চাখা। যদি কোনো খুঁত পান আমাকে ধুনে দেন। একদিন ভাতে কাকর পেয়ে গজরালেন—সারা দুপুর কী করেন। শুয়ে শুয়ে তো ফুলে যাবেন। একটু নড়ুন চড়ুন। চালটা দুপুরে একটু বেছে নিন। বাচ্চাদের দাঁত ভেঙে গেলে তখন কী হবে?

এত করছেন তবুও আত্মা শান্ত হচ্ছে না। কিছুতেই তৃপ্ত হচ্ছে না। কী করে যে হবে বুঝেও উঠতে পারছেন না। আজ অনেক খুঁজে ড্রাম দুটো পেয়ে গেছেন। বাচ্চাদের জল খাবার জন্য বাড়ি থেকে বয়ে দুদুটো ড্রাম এনে দিয়েছেন। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকবে। আর আমাকেও একটু ঝরানো গেল। এই তার প্ল্যান।

সে কী ময়লা ড্রাম। সহজে কী পরিস্কার হয়। আগে তাকে অ্যাসিড দিয়ে ঘষি তারপর সাবান বালি দিয়ে রগড়াই। রোজ দুপুরের দুঘন্টা যায় এর পিছনে। পাঁচ ছয় দিন পরে বলে ড্রাম–ওরে এবার আমাকে রেহাই দে রে। আর পারি না। এক পরত ছাল যে উঠে গেল। তবে তাকে আমি ছাড়ি, আমাকে ছাড়ে ওয়ার্ডেন।

***

আজ মাদার কিলারের সাথে আমার এক চোট তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল। সেই প্রথম যেদিন এখানে আসি সেদিনের সেই নোংরা কাপে চা খেতে দেবার স্মৃতি মনে বড় দগদগে হয়ে রয়ে গিয়েছিল। যা কিছুতেই ভুলতে পারি না। মনে পড়ে যায় আমার জাত নিয়ে করা একটা কটু মন্তব্য। সেই যে লিখেছিলাম যে মানুষ আর একজন মানুষের কাছে কুকুরের চেয়েও ঘৃণ্য জীব বলে বিবেচিত হয়, সে তাকে ভালোবাসবে সম্মান করবে-এ হয় না। হতে পারে না। সেই লেখার প্রেরণার কেন্দ্রে তো এরাই রয়েছে। তাই এদের আমি সম্মান করতে ভালোবাসতে পারি না।

একজন দয়ালু লোক বোবা বাচ্চাদের জন্য ছয় লিটার দুধ পাঠায় প্রত্যেক দিন। কিছু গরিব বাচ্চা আছে অপুষ্টি আক্রান্ত। তাদের দুধে ভাগ বসায় মাদার…..। যতটা তার ইচ্ছা ঢেলে নিয়ে গিয়ে দুই পাতে, পায়েস রাঁধে। সেই সব পদার্থ কিছুটা নিজে খায় কিছুটা ওয়ার্ডেন, সুপার, স্পোর্টস টিচারকে খেতে দেয়। কিছুটা বিলি বন্টন করে তার পছন্দের দু একজনকে।

মানুষের সব কিছুর একটা সীমা আছে, সীমা নেই শুধু লোভের লালসার। যতদিন যেতে থাকে একটু একটু করে দুধ নেবার পরিমাণ বেড়ে চলে তার। কারণ, তার কিছু প্রিয়পাত্রের সংখ্যা বেড়ে গেছে। শেষে দুধ আর দুধ থাকে না–জল হয়ে যায় জল ঢালতে ঢালতে। এক কাপ করে দিতে হলে চল্লিশটা বাচ্চার কত দুধ লাগে। সেই পাতলা দুধের কারণে বাচ্চাগুলোর আমার উপর ক্ষোভ জমতে থাকে। তারা তো দেখে না দুধ যাচ্ছে কোথায়!

এক অচ্ছুত রান্না করে। সেই ভাত বাটিতে তুলে খানিকটা জলে ঢেলে ফুটিয়ে জলটা ঝেড়ে নেন। ভাত শুদ্ধ হয়ে যায়। তরকারি ফোঁটান তবে জল ঝাড়েন না। তরকারিতে বিশেষ দোষ হয় না। রামকৃষ্ণ গিরিশ ঘোষের বাড়িতে ভাত খাননি জাত মরার ভয়ে, লুচিমন্ডা খেয়েছিলেন।

ওনার এইসব কর্ম চলে সকালের পর্বে বেলা নটা নাগাদ। তখনই দুধটা নিয়ে যান। বাচ্চারা আসে তারপরে। তাই দেখতে পায় না।

আজ যখন ইচ্ছেমত নিজের পাত্রে দুধ ঢালছে দেখে হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে উঠল আমার। অপরাধ যে করে আর অপরাধ যে সহে দুজনে সমান অপরাধী। আজ সেই অন্যায়কারি হাতটা চেপে ধরলাম আমি। কোথা থেকে যে মনের জোর এল তা জানিনা।

বলি–এত দুধ নেবেন না। এটা ঠিক নয়।

এটা তার রাখী-বাঁধা ভাইয়ের স্কুল। গলায় তখন তার সেই অধিকারবোধ। কোনটা ঠিক কোন্টা বেঠিক তা কি আমার তোমার কাছে শিখতে হবে!

আমার যে তখন মাথা গরম। সমান ঝঝে জবাব দিই, কার কাছে শিখবেন তাহলে! এত বছরে কেউ তো শেখায়নি। ভালো কিছু তো সে শেখাতে পারে যে নিজে তা জানো তেমন লোকের সঙ্গে তো মেশেননি কোনদিন।

মহিলা অসম্ভব জেদি। হার মানতে জানে না। দুধটা তার পাত্র থেকে ঢেলে রেখেছিলাম। সে আবার সেখান থেকে নিজের পাত্রে তুলতে যায়। এই দুধে বড় সাহেবের চা-ও হয়। সে থাকলে সাথে বিশ পঁচিশ জন লোক থাকে। তাদের চা-ও হয়। সেটাই মহিলার যুক্তি আর শক্তির উৎস। বলে–তোমার কোন কথা শুনব না। সুপার আর ওয়ার্ডেনের নাম ধরে বলে–ওরা বলুক, নেবেন না। নেব না।

ওরা কেন বলবে! ওরা তো ভাগে আছে যাদের জন্য দুধ সেই বাচ্চারা বলুক। তখন নিয়ে যাবেন সবটা। আমার কোন আপত্তি নেই। দুধ খাবেন আপনারা, বাচ্চাদের রাগ জমবে আমার উপর, সেটা চলবে না। যেটুকু দুধ পাত্রে তুলেছিল যথাস্থানে ঢেলে দিয়ে সে চিৎকার করে গালাগালি দিতে দিতে নীচে নেমে যায়। বুঝতে বাকি থাকে না আমার, একটা ঝড় উঠবে। এই অপমান সে নীরবে মেনে নেবে–এমন মায়ের মেয়ে সে নয়, কেন মেনে নেবে তার পিছনে যে শক্ত খুঁটি আছে।

আমি বিপ্লবী অনন্ত সিংয়ের জীবনী ‘কেউ বলে বিপ্লবী কেউ বলে ডাকাত’ পড়েছি। ওনাকে আমি জীবনে একবারই মাত্র দেখেছি। প্রেসিডেন্সি জেলের বড় গেট থেকে ফিরে যাচ্ছিলেন ওয়ার্ডে। হুইলচেয়ারে বসা ছিলেন তিনি। একজন ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। আর

ওনাকে দেখে বুকটায় মোচড় মেরেছিল আমার মনে হচ্ছিল যেন প্রাচীন এক ঐতিহ্যশালী মহাবৃক্ষের ধ্বংসাবশেষ। এই সেই মানুষ যার নামে সূর্য অস্ত না যাওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসকদের বুক কেঁপে যেত। সময় মহাশক্তিমান, আবার সময় কী অবিবেচকও। এক লৌহ পুরুষকে পরিণত করে দিয়েছে লোহালক্করে। আর ঠুসে দিয়েছে সেই দেশের সেই জেলে যে দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন। দেশ তো স্বাধীন হয়ে গেছে পরাধীন হয়ে গেছে, দেশের মানুষ দেশের মানুষেরই কাছে।

তবে এখনও আমার পড়ে ওঠা হয়নি রুনু গুহ নিয়োগীর ‘সাদা আমি কালো আমি’। সেটা পড়েছি অনেক পরে।

প্রত্যেকটা মানুষের তার জীবন-কার্যকলাপ সম্বন্ধে নিজস্ব কিছু ব্যাখ্যা আছে।কী সেই ব্যাখ্যা, যদি গান্ধীজির হত্যাকারি নাথুরাম গডসের ভাই গোপাল গডসের বই ‘গান্ধী বধ কিউ’ না পড়তাম কিছুতে জানতে পারতাম না। যারা এই সহস্রাব্দের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার বুক লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল–কী তাদের রাগের উৎস-লেখা আছে সেই বইয়ে। তাদের যুক্তি আমি মানতে নাও পারি। তাতে তাদের বিশ্বাসের কিছু-হানি বৃদ্ধি হবে না।

আমার ধারণায় মানুষ যতই তুচ্ছ নগণ্য, হীন, জঘন্য হোক, প্রত্যেকের জীবন থেকে কিছু না কিছু শেখা যায়। যা পরবর্তীকালে কোনো না কোনো কাজে আসে। আমাদের ওয়ার্ডেন লোকটাও এর বাইরে নয়। শেখার মতো তার কাছেও অনেক কিছু আছে। যারা ডাস্টবিন ঘাঁটে তারা জানে, ওই আবর্জনার মধ্যেও মন্ডা মেঠাই মিলে যায়।

চাকুরিজীবি লোকেরা জানে কাজ কম করলাম কী বেশি সেটা কোনো কথা নয়–আসল কথা তোমার উপর বস সন্তুষ্ট হচ্ছে কিনা। কোথায় কোথায় যেন শুনি বইপত্রেও পড়ি-কেউ কেউ তো বসের নেক নজরে থাকার জন্য, পদোন্নতির জন্য নিজের বউকেও বসের মনোরঞ্জনের নিমিত্তে পাঠিয়ে দেয়।

আমি জানিনা কী কৌশলে ওয়ার্ডেন তার উপরঅলাকে পটিয়ে রেখেছে। এর উপরে এর বস খুবই সন্তুষ্ট তাই কোনো কাজ না করে এমনকী কর্মস্থলে না থেকেও দিব্যি চাকরি করে যাচ্ছে। কিন্তু আমার বস ওই ওয়ার্ডেন আমার উপর মোটেই সন্তুষ্ট নয়। আমাকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। আর তাই আজকাল আমাকে প্রতিক্ষণ বিরক্ত আর অপমান করার ব্রত নিয়েছে।

আমি খেতে বসেছি, কাছে এসে চোখ বড় বড় করে থালাটা দেখল। তারপর এমন একটা মন্তব্য করে দিল যে খাবার আর গলা দিয়ে নামানো দায় হয়ে উঠল।কী?না, আমার মাছের পিসটা বড়। ওটা বাচ্চাদের দিয়ে সবচেয়ে ছোটটা রাখা উচিত ছিল।

কাজের পরে দুপুর বেলায় আমি নিজস্ব দরকারে স্কুলের বাইরে যাবার সময় গেটে দ্বারোয়ান দিয়ে মাঝে মাঝে আমার ব্যাগ তল্লাশি করায়, কিছু নিয়ে যাচ্ছি কিনা। একবার সেনিজেইকরেছিল। তবে সে নিজে বা দ্বারোয়ান এমনভাবে তল্লাশি করে যেন ইয়ার্কি করছে। দেখান তো দাদা ব্যাগটা, মনে হচ্ছে কোনো লুকানো মাল আছে। হাসে আর বলে।

এই কাজে যার সবচেয়ে বেশি উৎসাহ সে হচ্ছে বাংলাদেশী সাহা। জানিনা, এই লোকটা বা কোনমন্ত্রে বড় সাহেবকে বশ করে ফেলেছে। রাত দশটায় আসে বিছানা করে শুয়ে পড়ে। সকালে চলে যায়। এক রাতে চোর এসে বড় সাহেবের সদ্য কেনা দুখানা গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভিতরে রাখা টেপ রেকর্ডারসহ আরও কিছু দামি মাল নিয়ে পালিয়ে যায়। তবু তার রাতে ডিউটিতে ঘুম কামাই নেই।

সাহা লেখাপড়া জানে না। তেমন কোনো ভালো সঙ্গ পায়নি। মাথা মোটা নির্বোধ লোক। বড় সাহেবের প্রশ্রয় পেয়ে সে ধরাকে সরাজ্ঞান করে। এক এক সময় এমন কথা বলে–কী তার অর্থ নিজেও জানে না। এমন কাজ করে তার পরিণাম নিয়ে ভাবে না। সে যে আমার ব্যাগ সার্চ করে এটা যে আমাকে অপমান সেটা সে বোঝে না।

আমার ধারণা অবশ্যই এর পিছনে ওয়ার্ডেনের উস্কানি আছে। সাহাদা, এখন তোমার ডিউটি। যদি কোনো দামি মাল পাচার হয়ে যায় তুমি দায়ী। জানো ব্যাগে কী আছে? দেখাটা তোমার ডিউটির মধ্যে পড়ে।

এই কারণে ওয়ার্ডেন লোকটাকে দেখলে আমার শরীর জ্বলে। কিন্তু সেই জ্বলে যাওয়া শরীর নিয়ে আমি কী বা করতে পারি। যদি উড়ে যাওয়া কাক কারও মাথায় মলত্যাগ করে সে কী করতে পারে! নকশাল নেতা আজিজুল হক জেলখানায় ছিল। কত বড় নেতা! সেই তাকেই এক সেপাই লাঠি পেটা করত। আমি তো সেই রকম এক কয়েদখানায় এসে পড়েছি। সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কী করতে পারি।

রুনু গুহ নিয়োগীর আত্মজীবনীতে একটা মজার ঘটনার কথা লেখা আছে। রুনুর বন্ধু এক পুলিশ অফিসার যথেষ্ট দক্ষ অফিসার বলে ডিপার্টমেন্টে পরিচিত ছিল। অনেক কটা বড় বড় কেস সে ফয়সালা করেছিল। তবু তার বস কিছুতেই অফিসারটির প্রতি ভালো ব্যবহার করত না। অনবরত কাজে খুঁত খুঁজত। খুঁত পেলেই হেনস্থা করত! বন্ধুর এহেন দশায় রুনু খুব কষ্ট পেত। শেষে সে একদিন তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে আবিষ্কার করল এর কার্যকারণের সুগভীর রহস্য।

জানতে পারল বন্ধু তার বসের সাথে টেবিল টেনিস খেলে মাঝে মাঝে। দক্ষ খেলোয়াড় বন্ধুটি বার বার তার বসকে সেই খেলায় হারিয়ে দেয়। এটাই তার একমাত্র অপরাধ।

তখন বন্ধুকে পরামর্শ দেয় রুনু আর বসকে হারিও না। এবার তুমি হারতে থাকো। যদি খেলায় আর বসকে না হারাও অন্যত্র জয়ী হবে। চাকরি জীবন সুখময় হবে। এই যে তোমার কাছে বস হারে সেই মনোকষ্টে তার রাগ হয়ে যায়। আর ঊধ্বর্তন হবার সুবাদে ওইভাবে রাগ মিটিয়ে নেয়।

আমি কৌশলি নই। জীবনে কখনও কোথাও কৌশল করিনি। যারা কৌশল করে বাঁচে তেমন কাউকে গুরুপদে বরণ করিনি। পাহাড়চূড়া থেকে গড়িয়ে নামা নুড়ির মতো গড়িয়ে গেছে জীবন। যদি কৌশল করতে শিখতাম, জীবনের বহু দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেয়ে যেতাম। এইখানে আমি সেই সাহার চেয়েও অজ্ঞ মূর্খ।

তার উপর আবার ওই বাকসর্বস্ব দর্পী দম্ভী অহঙ্কারি অত্যাচারি ওয়ার্ডেন লোকটাকে মোটেই সহ্য করতে পারি না। যারা সত্যিকারের শ্রমিক কৃষক গরিব মানুষদের ভালোবাসত এবং তাদের হিত কামনায় সিপিএম পার্টিতে যোগ দিয়ে বহু দুঃখ কষ্ট বরণ করেছে, তাদের সেই আত্মত্যাগের ফসল এরা চেটেপুটে খেয়ে হয়ে উঠেছে মানুষেরই সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই এইসব ধান্ধাবাজ আমার দুচোখের বিষ। প্রাণ চায় এদের বিনাশ দেখতে–বিলুপ্তি দেখতে।

.

এক রবিবার রান্নাবান্না শেষ করে বসে আছি, বাচ্চারা চান করে খেতে আসছে না। কেন আসছে না? খোঁজ নিতে হোস্টেল রুমে গিয়ে দেখি গোটা আটেক দাবার বোর্ড নিয়ে জোড়া জোড়া বসে রয়েছে। কোথায় যেন দাবা প্রতিযোগিতা হবে মূক বধিরদের। তারই প্রস্তুতি চলছে। ওয়ার্ডেনও সেখানে রয়েছে। সেও দাবা খেলছে।

তার সাথে কেউ খেলতে চাইছে না হেরে যাবার ভয়ে। সে ডেকে ডেকে এক এক জনকে বসাচ্ছে আর হারাচ্ছে। হারিয়েই এমন চিৎকার করছে যেন দিব্যেন্দু বড়ুয়াকে হারিয়ে দিল। জিতে গেল পলাশীর যুদ্ধে। দখল করে নিল হোয়াইট হাউস।

আমি দাবা খেলাটা শিখেছিলাম জেলখানায় বসে। আমার মাস্টারমশাই বলেছিলেন, খুব ভালো খেলা। রোজ এক ঘন্টা খেললে মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়, কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আমার জীবন যে রকম, মস্তিষ্কের কার্য ক্ষমতা বাড়াবার সময় মেলে না।

ওয়ার্ডেন আর একজন প্রতিপক্ষকে নিয়ে খেলতে বসেছে। দুর্বল প্রতিপক্ষ বলে হেলাফেলা করে চাল দিচ্ছে। নিজের রক্ষণভাগের দিকে খুব একটা লক্ষ্য না রেখে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এক সময় আমি দেখতে পেলাম একটা নৌকাকে মার খাইয়ে দিলে ঘোড়া আর মন্ত্রী যে পজিশনে এসে যাবে পরের চালে ওয়ার্ডেনের মাৎ অনিবার্য। আমি ছেলেটার হয়ে নৌকা ঠেলে দিলাম এই চালটা থাকুক।

কী বোকার মতো চাল দিচ্ছেন। ফালতু নৌকাটা চলে যাবে। এটা ষোলঘুটি খেলা নয়–দাবা।

হেসে বলি–জানি তো দাবা। পারলে নৌকা মারুন।

মারলাম বলেই সে তার মন্ত্রী সরিয়ে নিল। ফাঁদে পা দিল আমার। আর হার কে বাঁচায়।

বলে সে–দাবা খেলতে জানেন?

তেমন কিছু না, একটু আধটু।

হেরে ওয়ার্ডেন রেগে গেছে। এবার সে আমাকে হারিয়ে প্রতিশোধ নেবে হারের। বলে, তবে এক হাত হয়ে যাক।

বলি–বাচ্চাদের খেতে দেব।

বেশি সময় লাগবে না। বসুন–।

বসে পড়ি দাবার বোর্ডের সামনে কালো ঘুটি নিয়ে। দাবার বোর্ড নয়–এটা যেন তখন আমার কাছে কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গন। আমার সামনে দাম্ভিক সেনাপতি দুর্যোধন। গদা হাতে সে আমার মস্তক চূর্ণ করার জন্য এগিয়ে আসছে। আমি দেখছি তার দর্প ভরা যুগল ঊরু। একটা সামান্য সুযোগ পেলেই শুইয়ে ফেলে দেব।

আমার রুনু পড়া ছিল না। পড়লেও প্রভাবিত হতাম কিনা তা বলতে পারি না। ধর্ম পুস্তক তো পড়েছি তবু আমার এই জীবনের জন্য গত জন্মের কর্মফল মানতে পারলাম কই! যা হয়েছে–ভালো হয়েছে, যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে, যা হবে ভালো হবে। এমন কথায় আস্থা আসে কোথায়? সব বোগাস বলে মনে হয়।

সেই যে মরিচ ঝাপির অসংখ্য আমার মা বোন মেয়ে নির্মম ধর্ষণের শিকার। সেই যে অসংখ্য বাঘ কুমিরের পেটে চলে যাওয়া আমারই বাবা ভাই সন্তান কী করে ভাববো তাদের সাথে যা হয়েছে–ভালো হয়েছে। ভালো হয়েছে–সে আমার সঙ্গে যুদ্ধরত এই দুর্যোধন দুঃশাসনদের দলের। এরাই তাদের ব্যবহার করেছে দাবার বোড়ের মতো। যেদিন বুঝেছে আর দরকার নেই, বোড়ের মতো মারিয়ে দিয়েছে।

আমি একটা বোড়ে মার খাইয়ে দিই। আমার কালো গজের চলার পথ খুলে রাখার জন্য। যদি সুযোগ করতে পারি গজের জোরে মন্ত্রী রাজার সামনে গিয়ে বসবে। এদিক ওদিকে চাল দিয়ে ওয়ার্ডেনকে অন্যমনস্ক করে রাখি আর সুযোগ খুঁজি।

সে আমার একটা ঘোড়া একটা হাতি চারটে বোড়ে একটা গজ মেরে দিয়েছে। আমি মেরেছি একটা ঘোড়া একটা গজ দুটো বোড়ে। পয়েন্টের হিসাবে সে এগিয়ে আছে।

এবার আমি একটা ‘অন্যমনস্ক’ভাবে চাল দিয়ে আর একটা ঘোড়াকে এমন জায়গায় বসালাম যে প্রতিপক্ষের তাকে মারতেই হবে। না মারলে চেক দিয়ে একটা নৌকা পেয়ে যাব। সেই চালটা সে দেখেছিল, পরের চালটা দেখেনি। তাই ঘোড়া মারল, আর আমার পথ খুলে গেল। মন্ত্রী গিয়ে বসে গেল রাজার সামনে কালো গজের জোরে, খেলা মাৎ!

হারিয়ে দিলাম লোকটাকে। যেন বদলা নিলাম এতদিনের অত্যাচারের। হেরে সে আবার ঘুটি সাজালো। মাথা গরম হয়ে গেছে তার। চালে ভুল করল, আবার হারল। পরপর চার গেম হেরে তার সারা মুখে যেন মেঘ জমে উঠল।

বলল–আর একদিন খেলব। সেদিন আপনাকে হারাব।

বললাম–হারি যদি লড়েই হারব।

***

একজন লোক এসেছে। এখন থেকে সে এখানে থাকবে। কারণ তার কোনো থাকার জায়গা নেই। এতকাল সে বউয়ের বাপের বাড়িতে থাকত।বউ আর মেয়ে দুজনে মিলে তাকে সেই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সে সেটা কাউকে বলে না। যেটা বলে তা হল, কেষ্ট আমার বাল্যবন্ধু। কেষ্ট বড় সাহেবের বাল্যবেলার ডাকনাম। কেস্টোকইল তুই গিয়া হোস্টেলে থাক। আর ইসকুলডারে দেইখ্যা শুইন্যা রাখ, তাই আইলাম। নইলে আমার কীসের ঠ্যাকা। বন্ধুর কথা তো ফ্যালাইতে পারি না।

বড় সাহেবের বাল্যবন্ধু এই লোকটা আগে একটা ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করত। এর বংশ ইতিহাস যা জেনেছি, তাতে লোকটা সত্যিই একটা বড় বংশের সন্তান। যে বংশের লোক সাহিত্য এবং রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে অনেক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সেই বংশে এই লোটার মতো এমন একটা কুলাঙ্গার কুমড়ো-পটাশ কেমন করে জন্ম নিল সেটা একটা বিস্ময়।

হয়তো এটাই হয়ে থাকে। যে কারণে শিব্রাম চক্কোরবর্তী বলে গেছেন–বাঁশের গা থেকে যা জন্মায় তা বাঁশ হয় না, কঞ্চি হয়।

আমার দুর্ভাগ্য এক মহান বংশের সদস্যকে নিয়ে আমি একটাও ভালো কথা লিখতে পারব না। এক অর্থে এই লেখার সবটাই শুধু কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কালো বাখান। আমি কী করব! যদি আমি এসব না লিখে রেখে যাই মানুষ কী করে জানবে কী যম-যন্ত্রণা ভোগ করতে করতে আমি– ‘আমি’ হয়ে উঠেছি। কী বিরূপ সময় কী নির্দয় নিষ্ঠুর মানুষ আমাকে অনবরত ছিঁড়েছে। একটা সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত আবাসিক স্কুল–যার সঞ্চালন করে একদল কথিত বামপন্থী। তারা যে কী ভীষণ জীব সে কথা না বললে আমি নিজের কাছে সত্য গোপন করা পাপে পাপী হয়ে যাব।

পৃথিবীতে একদল মানুষ আছে যারা বাঁচার জন্য খায়। আর একদল মানুষ আছে যারা খাবার জন্যই বাঁচে। শুধু খাওয়া আর কিছু নয়। সর্বক্ষণ এদের পেটের মধ্যে রাবণের চিতা জ্বলে। দিনরাত এক চিন্তা এক ধান্ধা–কী খাব, কোথায় পাবো। সেই যে একটা গল্পে আছে একজন লোক তীর্থ করে ফিরেছে, সবাই তার কাছে গিয়ে বসল কিছু ভ্রমণ বৃত্তান্ত শোনবার জন্য, তীর্থস্থান মাহাত্ম্য শোনবার আশায়। কিন্তু সে সবের কোথায় কী। সে সারাক্ষণ শুধু বলে গেল কোথায় কোন খাদ্য মেলে কী তার স্বাদ। ভাইরে অমরনাথ যদি যাও দেখবে মাড়োয়ারিরা পথের পাশে ভাণ্ডারা খুলে রেখেছে। আহঃ, খাঁটি ঘিয়ে ভাজা লুচি-হালুয়া কী তার স্বাদ….। বাল্যবন্ধুর যে কোন গল্প সে যেখান থেকেই শুরু হোক, শেষ হবে পাবদা মাছ, গলদা চিংড়ি, ইলিশ পাতুরি, তেল কই এইসবে গিয়ে।

বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রথম কিছুদিন সে এক হোটেলে গিয়েছিল। ভেবেছিল দু দশদিন পরে রাগ কমে গেলে বউ মেয়ে গিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। ফিরিয়ে আনেনি। এদিকে পকেটের পয়সা সব শেষ। তখন সে শেষ আশা ভরসার কেন্দ্র বাল্যবন্ধু বড় সাহেবকে ফোন করে। তুই ক’ কেষ্টা অখন আমি কী করি! গলায় দড়ি না দিয়া আর কোন উপায় দেখি না। তখন বড় সাহেব একে এখানে নিয়ে আসেন। গোটা চল্লিশ বোবা আছে, তাদের খাবার থেকে আরও পাঁচ দশ জনকে পালন পোষণ তো করাই যায়।

দুটো বিশাল বিশাল ব্যাগে জমা কাপড় আরও অনেক কিছু নিয়ে সে এল। এসেই জানিয়ে দিল, আমি বড় সাহেবের ছোটবেলার বন্ধু। বড় সাহেব আমারে স্কুলের দেখাশোনা করবার জইন্য আনছে। কইছে, যে তোর কথা না শুনবো সম্মান না দিবো–আমারে কবি। লাথি মাইরা তারে বাইর কইরা দিমু। একা আমাকে নয়, স্কুলের ছোট বড় সবাইকে সে এই কথা বার বার শোনালো। আমি তো আমি–টিচার ইনচার্জ পর্যন্ত কেঁপে গেল তার আগমনে।

শোনা গেল, সেই শোনালো–মহারাষ্ট্রের কোনো এক শহরে তার গাড়ি আর এক লরিতে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। বাল্যবন্ধুর গাড়ি গড়িয়ে পাহাড় থেকে নীচে পড়ে যায়। সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে পাঠানো হয় কোন এক হাসপাতালে। যেই সে খবর বড়সাহেব পেলেন এক কাপড়ে প্লেন ধরে উড়ে চলে গেলেন মহারাষ্ট্রে, বন্ধুর প্রতি এমন টানা বন্ধু নয়, যেন এক প্রাণ এক দেহ। এমন লোককে ভয় পাবে না তেমন বুকের পাটা কার?

দিন দশ পনের হল উনি এখানে এসেছেন। আর সারা স্কুলে যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কী এক দোষে যেন দারোয়ান সাহাকে গালে কষিয়ে দিয়েছেন শাঁসালো এক চড়। সে কেঁদে কেঁদে নালিশ করল হোস্টেল সুপারের কাছে। সাহার অনেক ক্ষমতা কিন্তু সে অন্যের জন্য। একদিন বাল্যবন্ধু এক টিচারের বুকেও দুমদাম ঘুষি মেরে দিলেন। টিচারের অপরাধ সে একটা বোবা বাচ্চাকে মেরেছে। র-আদ্যাক্ষর বিশিষ্ট এই টিচার আদ্যন্ত এক র’মাল। এর কথা পরে বলব।

এই বাল্যবন্ধুর বয়স অনেক। সে, বড়সাহেব, আর দারোয়ান দাস এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়ত। এত বয়সের লোক–তবুতার মধ্যে সব সময় একটা বালখিল্য ছ্যাবলামো, একটা অপরিণত মাস্তানি ঝোঁক, জোর করে সমীহ আদায় করার প্রবণতা দৃষ্টিকটু ভাবে সক্রিয়। আর একটা প্রবণতা–খাই খাই।

আমি এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। চারপাশেও বহু অভাবি অনাহারি মানুষ দেখেছি কিন্তু এমন কদর্য ক্ষুধার প্রতিমূর্তি আগে আর দেখিনি। যেমন কয়েকজনকে এখানে দেখছি। এইসব বক রাক্ষসেরা বোঝে না, বোবা বাচ্চাদের বঞ্চিত করে তারা দুধ ডিম মাছ মাংস খাচ্ছে না, সেই সাথে সে নিজের মান-সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসাও খেয়ে নিচ্ছে। যারা দেখছে আড়ালে নিন্দা করছে।

বোবা বাচ্চারা সকালে হালকা টিফিন খায়, দশটায় ভাত ডাল ভাজি মাছ বা ডিমের ঝোল। সেদিন সকালে বাচ্চাদের মুড়ি চানাচুর দিয়েছি। তারা টিফিন নিয়ে চলে যাবার পর বাল্যবন্ধু এলেন। একটা বাটিতে এক বাটি মুড়ি তাকেও দিলাম। সে ছাদে দাঁড়িয়ে মুড়ি চিবুতে লাগল। চারিদিকের দৃশ্যপট বড় মনোরম। দূরে একটা বড় পুকুর সেখানে মেয়েরা চান করছে কাপড়

কাঁচছে। ছাদ থেকে দেখা যায়।

সেদিন দুপুরের খাদ্য তালিকায় ডিম ছিল। ডিম সেদ্ধ করে নামিয়ে রাখার পর মনে হল পেটটা কামড়াচ্ছে। একটু পায়খানায় যেতে হবে। তখন বলি বাল্যবন্ধুকে, দাদা, আপনি বসে মুড়ি খান–এসে আপনাকে চা দেব। আমি একটু নীচে যাচ্ছি। পায়খানা। দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।

নীচে নেমে এসে মনে পড়ল, আরে খইনির ডিব্বাটা তত আনা হয়নি। মুখে খইনি না দিলে মল নির্গত হবার নয়। পুরানো অভ্যাস। তাই দৌড়ে আবার উপরে উঠে এলাম।

আমি গেছি পায়খানায়। ফিরে আসতে যত কম হোক দশ বারো মিনিট তো লাগবারই কথা। বাল্যবন্ধু বেশ নিশ্চিত মনে দুখানা ডিম তুলে নিয়ে খোসা টোসা ছাড়িয়ে মুড়ির বাটিতে নিয়েছেন, ধীরেসুস্থে খাবেন। মন ছিল মুড়ির বাটির দিকে কান আর চোখ ছিল সিঁড়ির দিকে। আমি না হই অন্য কেউ তো এসে পড়তে পারে। যেই দেখেছেন অন্য কেউ নয় আমি হাওয়াই চটি ফটাস ফটাস করে দ্রুত উপরে উঠে আসছি পাছে চুরিটা ধরা পড়ে যায়, খপাখপ দুটো ডিমই মুখে পুরে দেন। ডিমের উপরের সাদা অংশটা তখন কিছুটা ঠাণ্ডা হলেও ভেতরটা আগুন। তাড়াহুড়ো করে গিলতে গিয়ে সেই ডিমের গরম কুসুম আটকে গেল গলায়। আর উনি শ্বাস নিতে পারছেন না। দুটো চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। ডুবন্ত মানুষের মতো হাত দিয়ে শুন্যে কী যেন একটা ধরার চেষ্টা করছেন। ধরতে পারছেন না। শেষে শুয়ে পড়লেন ছাদে। হাত পা ছুঁড়তে লাগলেন কাটা ছাগলের মতো।

প্রথমে এমন দৃশ্য দেখে আমি ভেবেছিলাম বুঝি হার্ট এট্যাক হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে হাঁ মুখের মধ্যে সিদ্ধ ডিম দেখে বুঝতে পারলাম হার্টে নয়, এ্যাটাক হয়েছে শ্বাসনালিতে। তখন গলায় জল ঢেলে অতিকষ্টে ডিমকে ঠেলে দেওয়া গেল পাকস্থলির দিকে। তার যাত্রা শুভ হল।

এতবড় একটা ব্যাপার চাপা থাকার কথা নয়। সে ভেবেছিল তার বয়স এবং মর্যাদার কথা স্মরণে রেখে আমি এমন লজ্জার কথা পাঁচকান করব না। পাঁচ কান করিনি, তার সম্মানের কথা ভেবে দশ কান করেছিলাম। আমার পক্ষে চেপে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এর আগে বেশ কয়েকবার ডিম মাছ চুরি গেছে! উনি করেছেন বলছিনা, বোবারাও করতে পারে। আমাকে প্রস্রব পায়খানায় যেতে হলে যেতে হবে একতলায়, যার ইংরাজি নাম গ্রাউন্ডফ্লোর। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তিনতলা থেকে দেখতে পায়। তখনই ছুটে এসে যে যা পায় নিয়ে পালায়। রোজকার বাজার রোজ হয়, মাছ ডিম আসে গুনে গুনে। যদি কেউ ডবল নেয় একজন পায় না। তখন দোষ পড়ে আমার ঘাড়ে। অনেক কটা সন্দেহঘন তর্জনি বেয়নেটের মতো আমাকে বিদ্ধ করে।

আমি নিজেকে নিজে সম্মান করি। সেই সম্মানের গায়ে কোনো কালির ছিটে লাগুক তেমন কাজ করি না। তবু অপমানিত হই। যারা সেটা করে তারা নিজেরা নিজেদের সম্মান করে না। ফলে অন্যরাও তাকে সম্মানীয় ভাবে না। হ্যাঁ ভয় করে ডাকাতের মতো বা তার চেয়েও বেশি। ওই লোকগুলো সেটাকে ভক্তি শ্রদ্ধা সম্মান বলে মনে করে। মনে করে এটা পাবার অধিকার তার জন্মগত। অন্য কারও সেই অধিকার বা যোগ্যতা নেই। সব অতি হীন দীন তুচ্ছ। তাই অন্যকে অসম্মান অপমান করতে তাদের বাধে না।

আমি বাল্যবন্ধুকে অপমান করতে চাইনি। সে তো নিজেকে নিয়ে গেছে সেই জায়গায়। আমি শুধু সত্যকে সামনে নিয়ে এসেছিলাম। তাতেই ক্রুদ্ধ হলেন তিনি।

***

একবার স্কুলে সাইন ল্যাংগোয়েজের কুড়িদিনের একটা কোর্স শুরু হল। যারা বোবা বাচ্চাদের শিক্ষক তাদের শেখানো হল হাতের আঙুলে বিভিন্ন মুদ্রা ফুটিয়ে কীভাবে বিভিন্ন বিষয় বিশদভাবে বোবাদের বুঝিয়ে দেওয়া যায়। এর ব্যবস্থাপনায় ছিল এই মূক বধির বিদ্যালয় এবং সহযোগিতায় ছিল নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশন, সারা দেশের পঁয়ত্রিশ জন ওই ভাষায় দক্ষ শিক্ষক এসেছিলেন এখানকার শিক্ষকদের শিক্ষা দিতে। আগে তারা নিজেরা শিখে পরে বোবাদের শিক্ষা দেবে।

বহিরাগত শিক্ষকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল এই স্কুলে। আগে বোবা বাচ্চাদের রান্না করে তাদের স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে তারপর স্পেশাল লোকজনদের জন্য স্পেশাল মেনু রান্না করি। দুপুরে একবার রাতে আর একবার। তবে অঢেল নয়, সবকিছু মাপা-পরিমিত।

সেদিন সুপার অতিথিদের জন্য বাজার থেকে কাতলা মাছ এনেছেন, মাছের পিসগুলো সত্যিই তাকিয়ে দেখার মতো। জিভে জল এসে যাবে। তবে জিভের জল গিলে নিতে হবে কারণ সে মাছ শুধু অতিথিদের জন্য। অন্য কারও পাতে পড়বে না। হোস্টেল সুপার হোস্টেলে থাকে, খায়, থাকে খায় আরও অনেকে। তাদেরও জিভে জুটবে না। কারণ সব মাথা পিছু গোনা। পঁয়ত্রিশ পিস।

সেদিন আমি অতিথিদের জন্য রান্না করেছি সরু চালের ভাত, ঝুরি ঝুরি করে আলু ভাজা, মাছের মাথা দিয়ে সোনা মুগের ডাল, কাতলা মাছের কালিয়া, পেঁপের চাটনি।

তখন বেলা প্রায় একটা দেড়টা হবে। অতিথিদের খেতে তখনও ঘন্টা খানেক দেরি আছে। ভাবলাম এই ফাঁকে চানটা সেরে ফেলি। বাচ্চারা সব ক্লাসে আটকে আছে, ছাদে কোনো বেড়াল কুকুরও আসে না। খাদ্যদ্রব্য সুরক্ষিত থাকবে। সব টাকাটুকি দিয়ে তাই চান করতে গেলাম।

আমি চান করি পুকুরে। সেটা খানিকটা দূরে। তেল মশলার ছিটে গায়ে লেগে যায় তাই চানে আমার সাবান লাগে। না হলে গা চটচট করে। একটু বেশি সময়ও লাগে।

আমার উপর শুধু রান্না করার ভার–অতিথিদের খাদ্য পরিবেশন করে অন্য লোকে। অতিথিরা তো বোবাদের মতো সিঁড়িতে বা খোলা ছাদে বসে খেতে পারে না। তারা নীচে চেয়ার টেবিলে বসে খায়। যারা খাদ্য পরিবেশক খাবার দাবার নীচে নামিয়ে নিয়ে যায়। সেদিন যখন তারা পরিবেশন আরম্ভ করল, দেখে, সাতখানা মাছ কম। গোনা মাছের সাতখানা বেমালুম উধাও।

এমনিতে মাদার আর বাল্যবন্ধু দুজনার কোনো সদ্ভাব নেই! এক সঙ্গে দুটো ষাঁড় থাকলে যা হয়–সব সময় গুঁতোগুঁতি। দুজনেই যে হেভিওয়েট। এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায়। একজন পুরুষ একজন মহিলা, একজন বাঙাল একজন ঘটি, একজন উচ্চ শিক্ষিত আর একজন সাক্ষর, কোনো মিল থাকার কথা নয়। তবে দুজনার ক্ষেত্রে একটা মিল আছে, রামকৃষ্ণ মানেন। সেই যে তিনি বলেছেন-লজ্জা ঘৃণা ভয় তিন থাকতে নয়-সেটা জানেন। খাবার ব্যাপারে দুজনেই সমান লোভী। সুযোগ পেয়েছে কী এটা সেটা হাতিয়ে নিয়ে পালায়। এমনিতে মাদার বিধবা কিন্তু খাদ্যের ব্যাপারে বামনি হননি। আমিষ নিরামিষ কাউকে নিরাশ করেন না। দুজনকেই সমান আদর দেন। রবিবার হোস্টেলে মাংস হয়। এর পুরো মেটুলিটা ওনার একার। সেটা পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে তরিজুত করে রেধে একটু সুপার একটু ওয়ার্ডেন একটু স্পোর্টস টিচারকে দেন। বাকিটা নিজে সাঁটেন।

এরা দুজনেই চেয়ে যতটা সম্ভব নেবে বাকিটা নেবে চুরি করে। দুজনেই আগে বার কয়েক ধরা পড়েছে। একদিন মাদার একটা মাছের মাথা চেয়ে একখানা পেটি নিজের ভাগের একখানা গাদা লুকিয়ে বাটির উপর থালা ঢাকা দিয়ে নিয়ে পালাচ্ছিল। আমি ধরে ফেলি। তবে তার বয়সের কথা বিবেচনা করে চোরের সাজাটা দিইনি। যা বাচ্চাদের দিয়ে থাকি।

তবে সে সব খাবার একটু কমবেশি হলে এদিক সেদিক করে সামলে নেওয়া যায়। এখন সামলাব কী করে! পাত পেতে অতিথিরা যে বসে আছে। বাঙাল’ এসেছে হরেক কিসিমের মছলি চেখে যাবে, তার কী হবে? ঠিক জানি ওই দুজন ছাড়া কারও কম্ম নয় কিন্তু কোনো প্রমাণ যে নেই।

মাছ গিয়াছে চুরি। খবর পেয়ে সুপার ছুটে এল। ছাদে উঠতে হাঁফিয়ে গেছে সে। চোখ রাগে লাল শরীরে ঘাম। বুকে ব্রাস। বড় সাহেবের অতিথি। সে যদি শোনে কী হবে? যদি কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। যদি তাড়িয়ে দেয় চাকরি থেকে।

আমাকে সামনে পেয়ে ফেটে পড়ে সে, মাছ কী হল? সাতখানা মাছের কী হল? আমি বাজার থেকে গুনে এনেছি।

বলি–আমি তো জানিনা। যা এনেছেন রান্না করে রেখে চান করতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে শুনি মাছ কম।

আপনি চান করতে গিছিলেন, না হাওয়া খেতে আমাদের দেখার দরকার নেই। মাছ কোথায় রেখেছেন বের করুন। এনারা যদি খেতে না পায় বড় সাহেবকে জানাবে। আমি কিন্তু আপনার কথাই বলব। মুশকিলে পড়ে যাবেন এই আমি বলে দিলাম।

বিনা দোষে চোরের দায়ে ধরা পড়ে গেছি। সবাই আমাকে দোষারোপ করছে, কী যে করি!

তখন মনে পড়ে, আমি যখন চান করতে যাচ্ছিলাম তখন বাল্যবন্ধু আর রাজু নামের একটা কথাবলা ছেলে ছাদে আসছিল খাবার জন্য। রাজুর মা বাবা কেউ নেই। এক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, কোন এক নেতার সুপারিশে বড়সাহেব এখানে এনে রেখেছেন। তবে সদ্য সদ্য এসেছে বলে এখনও ধূর্ত হয়ে ওঠেনি। সে হবে অল্প কিছুদিন পরে। সে দায়িত্ব নিয়েছে বাল্যবন্ধু যে ওকে সাথে সাথে নিয়ে ঘোরে। শরীর সুস্থ রাখার জন্য ম্যাসাজ অতি উপকারি। কখনও রাজুকে দিয়ে বাল্যবন্ধু ম্যাসাজ করিয়ে নেন কখনও ম্যাসাজ করে দেন।

কেন জানিনা আমার মনে হল মাছ অন্তর্ধান রহস্যের কিছু সুত্র রাজুর কাছে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। ছাদে ডেকে এনে তাকে খুব হালকা ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম–কী রে ভাত খেয়েছিস?

হ্যাঁ, বলল সে।

কোন গামলা থেকে মাছ নিয়েছিস? যেটা এইখানে ছিল সেটা থেকে না ওইখানে যেটা ছিল?

হাত দিয়ে সে সেই স্পেশাল মাছের ঝোলের গামলা দেখায়।

কটা মাছ নিয়েছিস! সাতখানা?

না না, বলে সে, আমি দুটো খেয়েছি। কাকু বলল দুটো করে।

আর পাঁচটা?

দুটো কাকু খেয়েছে, তিনটে রেখে দিয়েছি।

কোথায় রাখা আছে?

কাকুর চৌকির নীচে। কাকু বলল রেখে আয় রাতে খাব।

বাল্যবন্ধুর চৌকির নীচ থেকে সেই মাছ রান্না ঘরে ফিরে এল এরপর। আমি রক্ষা পেয়ে গেলাম একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে। বেঁচে গেলাম চোর অপবাদ থেকে।

বেঁচে গেলাম কী? কোনো বলবান লোকের বিষ নজরে পড়ে কোনো দুর্বল অসহায় কী বাঁচতে পেরেছে? রাজুকে জেরা করে সব সত্য উগলে নেবার অপরাধে লোক সমাজে উপহাসের পাত্র হয়ে যাওয়া বাল্যবন্ধু আমার উপর রাগে ফুঁসছিল বিষধর সাপের মতো। সুযোগ খুঁজছিল ছোবল দেবার। একটা সুযোগ–একটা ছোবল, আমি ভ্যানিশ।

***

কথায় বলে বাপকা বেটা সিপাইকা ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোরা থোরা। বাপ জ্যাঠা যেমন হবে ছেলে সেই রকম হতে বাধ্য। সবটা না হলেও কিছুটা তো হবেই। সুপারের বাপ প্রাক্তন এম.এল.এ. এক জোতদার। জোতদাররা মানুষ হিসাবে কেমন হয়? যেমন শহরের নব ধনাঢ্য। অর্থগৃধ। ন্যায় অন্যায় নীতি নৈতিকতা কোনো কিছুর ধার ধারে না। মদ জুয়া বেশ্যাগমন তাদের ঠাটবাটের অঙ্গ।

জোঁক আর জোতদার দুই প্রাণীর মধ্যে একটাই সমানতা–রক্ত চুষে মোটা হয়। এদের ঠিকঠাক চিনেছিল নকশালরা। এরাও নকশালদের ঠিকঠাক চিনেছিল। যেমন সাপ আর নেউল। যে যাকে বাগে পাবে-মারবে।

সেই যখন সত্তর দশকে গ্রাম বাংলা উত্তাল হয়ে উঠেছিল, ভেবেছিল প্রাক্তন এম.এল.এ. আর বোধ হয় সাধের সাম্রাজ্য ধরে রাখা যাবে না। জমি জায়গা তো যাবেই প্রাণও বুঝি থাকে না। শোষণ জর্জর না-খাওয়া মানুষের মনে যে বারুদ জমে আছে এক প্রবল বিস্ফোরণে যেদিন ধেয়ে আসবে, লাভা স্রোতের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তাই সে আগেভাগে নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়া উচিত বলে মনে করে। তেমন জায়গা শহর কলকাতা ছাড়া আর কোথায়! এখানে কেউ কারও নাম জানে না, খোঁজ রাখে না, অনুসন্ধিৎসা দেখায় না। ফলে এই যাদবপুরে একটা দোতলা বাড়ি কিনে চলে আসে সেই বাড়িতে। সেখানে থাকে আর মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে জমি জায়গার দেখভাল করে আসে।

যেহেতু নকশালদের প্রতি প্রাক্তন এম.এল.এ.-র একটা বিদ্বেষ ছিল, সেটা সংক্রামিত হয়েছে তার ছেলের মধ্যে। কংগ্রেস খুব ভালো, সিপিএম খুব একটা মন্দ নয় কিন্তু ওরা মহা খারাপ। ধরলেই গলা কেটে দেয়। একী কোন পার্টি! দেশে আইন আছে বিচার আছে। যদি কিছু বলার থাকে থানায় যা কোর্টে যা। সেখানে ফয়সালা হোক। শঙ্কর গুহ নিয়োগীর নামে একটা প্রচার আছে সে নকশাল। আমি তার লোক। সে কথা গোপনও করি না। আমার সাথে যারা মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে মুখে দাড়ি, কাঁধে ঝোলা, ঝোলায় বইপত্র দেখে বোঝা যায় ওরাও নকশাল। তাই আমার উপরে রাগ।

সুপার শহরে এসেছে প্রায় তিরিশ বছর। তবু এখনও গ্রাম্যতা বর্জন করে পুরোপুরি শহুরে আদব কায়দা রপ্ত করে উঠতে পারেনি। তবে একটু বাবু বাবু ভাব উদয় হয়েছে বইকি। যদিও বড় সাহেবের ক্লাস ফ্রেন্ড দ্বারোয়ান দাসদা তাকে বাবুর সম্মান দিতে নারাজ। সে তাকে পেঁচো বলে ডাকে। ছাদের দিকে মুখ করে চেঁচায়–এই পেঁচো তোরে এ্যাক গার্জেন তালাস করতাছে।

সুপার এখন হোস্টেলেই থাকে খায়, কিছুদিন পরে বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করবে। ওয়ার্ডেন থাকে না, তবে খায়। সে মাঝে মাঝে। অন্যদিন শুধু চাখে। খায় থাকে স্পোর্টস টিচার, বাল্যবন্ধু আরও দশ বারোজন। সেই দশ বারো জন আর বোবা বাচ্চারা খেয়ে নিজের থালা নিজে ধোয়। অন্যরা ফেলে রেখে যায়।

এক দুপুরে এই কয়জন মাদারের নিজের হাতে বানানো কাঁটা চচ্চড়ি আর আমার যা রান্না সে দিয়ে দুটো সেবা করে থালা রেখে উঠে যাচ্ছিল। আমি বলি–থালা দেবার লোক নেই। যে যার থালা ধুয়ে তুলে রেখে যান।

আমার কথা শুনে তারা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। এ কী শুনছি! যা শুনছি তা ঠিক শুনছি তো?

এদের হয়ে কথা বলতে এগিয়ে এল মাদার। এ তুমি কী বলছ?

কী বলছি!

সুপার ওয়ার্ডেন মাস্টার, এরা এঁটো থালা মাজবে?

কেন মাজলে কী হবে? নিজের খাওয়া থালা তো।

এদের কোন সম্মান নেই, থালা মাজবে।

মাজুক না, তাতে মান সম্মান কী চলে যাবে?

এরা কোনদিন মাজবে না।

তাহলে পড়েই থাকবে।

তুমি মাজবে না?

আমি রান্নার লোক। রান্নার কাজ জানি। থালা মাজাটা ঠিকমতো জানি না। যে কাজ জানিনা কী করে করব?

একটু থেমে আবার বলি–আপনি তো মেয়েছেলে–রান্না, বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা, ঘরমোছা এসব তো জানেন, আপনি থালাগুলো ধুয়ে মেজে রেখে যান না।

যারা খেয়ে থালা রেখেছে সবাই বিব্রত। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। মাদার অগ্নিশর্মা– আমাকে বাসন মাজতে বলছে, তোমার সাহস তো কম না।

হ্যাঁ, সাহস আমার একটু আছে। আমি এই রকমই। এতে দোষ হলে আমার কিছু করার নেই। আমি দল্লীতে যেতাম। তখন দেখেছি শঙ্কর গুহ নিয়োগী, ডাক্তার শৈবাল জানা, ডাক্তার পুণ্যব্রত গুণ সবাই খেয়ে নিজের থালা নিজে ধুয়ে রাখেন। তারা যা পারেন এরা তাদের পায়ের নখের যুগ্যি না হয়েও কেন পারবে না। আমি রোজ বড় বড় হাঁড়ি কড়াই মাজি। এই কটা পুঁচকে থালা বোয়া আমার কাছে কোনো বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু যদি তাদের নিজের এঁটো ধুতে আত্মসম্মানে বাঁধে পরের এঁটো ধুতে আমার কেন বাঁধবে না। আমার রাজনৈতিক শিক্ষা ওটাকে চিহ্নিত করেছে একটা পুঁজিবাদী ঝোঁক হিসাবে, অপরের উপর প্রভূত্বকারি চিন্তাধারা হিসাবে। একমাত্র পুঁজিবাদী ভাবনার লোকই নিজের কাজ অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেয়। নিজে আরাম খায়।

এখন যুদ্ধপর্ব চলছে, আমি রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি। শাসকের সাথে শাসিতের, শোষকের সাথে শোষিতের, বর্ণপ্রভুদের সাথে দলিতের, পুঁজিবাদের সাথে সাম্যবাদের। এই যুদ্ধে আমিও একটা পক্ষ। একজন পদাতিক। শত্রু পক্ষের সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে লাভ হবে না। প্রতি আক্রমণে যেতে হবে। আমি নগণ্য মানুষ আর কী পারি। পারি আমি আমার ক্রোধকে ব্যক্তিগত স্তর থেকে সর্বজনীন মঞ্চে নিয়ে যেতে। সজোরে অন্যায়কে অন্যায় বলে ঘোষণা করতে।

সেদিন আমি ওদের এঁটো থালা ধুইনা, এটা ছিল প্রভুত্ববাদের বিরুদ্ধে আমার প্রতীকি প্রতিবাদ। তবে ওরাও জেদ বজায় রেখেছিল, থালা ধোয়নি। সে থালা ধুইয়েছিল অন্য একজন মহিলা কর্মীকে দিয়ে। যার পরিচিতি আদুরি গোঁসাই নামে।

আদুরি সেই লোক যে এই সেদিন বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে পশ্চিমবাংলায় এসেছে। এরা সত্যিই ভাগ্যবান। পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ বেকার। সিপিএম পার্টির বহুলোক, যারা একদিন এই পাটির জন্য বিপক্ষ দলের হাতে মার খেয়েছে, পাড়া ছেড়ে পালিয়ে থেকেছে, জেল খেটেছে–তারা আজও চাকরি পায়নি। এরা পেয়ে গেছে। সেই যে আসিলাম, দেখিলাম, জয় করিলাম, তাই। এদের ভোটার লিস্টে নাম, রেশন কার্ড, সিডিউল কাস্ট সার্টিফিকেট মোদ্দা কথা যা যা থাকলে নিজেকে ভারতীয় নাগরিক প্রমাণ করতে বেগ পেতে হবে না, সব কাগজ পত্র আছে। সব দায়িত্ব নিয়ে বানিয়ে দিয়েছে কোনো নেতা। এখন আবার পঞ্চাশ বছর বয়সে এক স্কুল সার্টিফিকেটে তিরিশ বছর বয়স লিখিয়ে একটা সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলে চতুর্থশ্রেণির কর্মী হিসাবে চাকরিও পেয়ে গেছে। এগারোটায় ডিউটিতে আসে একটা চল্লিশে একবার টিচারদের জন্য চা বানিয়ে দিয়ে টিভির ঘরে ঢুকে টিভি দেখে, না হলে পড়ে ঘুমায়–এই তার কাজ। চারটেয় বাড়ি চলে যায়।

কেন এদের প্রতি এতে বদান্যতা? বুঝ লোক যে জানো সন্ধান।

সে যাই হোক এই ঘটনায় হোস্টেল সুপার এতটা ক্ষুব্ধ হলেন যে হোস্টেলে খাওয়াই ছেড়ে দিলেন। আজ থালা আদুরি ধুয়েছে কাল কে ধোবে? স্কুলের তো ক্লাস যতদিন ছুটি প্রায় ততদিন। যেদিন স্কুল ছুটি আদুরি বুড়িরও ছুটি। তাই সুপার আত্মসম্মান রক্ষা করতে বাড়ি থেকে খেয়েই ডিউটিতে আসতে লাগলেন। ওয়ার্ডেন, স্পোর্টস টিচার ও অন্যরা যে যার থালা ধুয়ে রাখতে লাগল।

***

বলা হয়েছিল আমাকে রান্নায় সহযোগিতা করার জন্য একজন লোক দেওয়া হবে। সে এল। লোক নয় মহিলা। এল চাকরি করতে স্বামীকে সাথে নিয়ে।

আমাকে বলে দেয় সাহাবড় সাহেবের লোক। তার মুখে শুনলাম মহিলা নাকি বড় সাহেবের বাড়িতে প্রায় তিরিশ বছর কাজ করেছে। এক জবরদখল কলোনির দরমার বেড়া দেওয়া বাড়ির এক গরিব সিপিএম কর্মী থেকে এক সম্পন্ন উপনগরীর রাজপ্রাসাদতুল্য ভবনের বাসিন্দা, সিপিএম পার্টির নেতা হয়ে ওঠা, সবটা ঘটেছে তারই চোখের সামনে। এমনিতে সে তো ওই বাড়ির রাঁধুনি ছিল, তবে যখন বড় সাহেবের মায়ের অসুখ হয় যে অসুখে তিনি মারা যান, সে সময় এই মহিলা রাতদিন এক করে তার খুব সেবা শুশ্রূষা করেছিল। তিনি তাই যখন মারা যান প্রিয় পুত্রকে ডেকে বলেছিলেন “বেচারা সারা জীবন আমাদের সেবাযত্ন করেছে, দেখিস, ও যেন বুড়ো বয়সে ভাতের কষ্ট না পায়, যদি পারিস ওকে একটা ভালো কাজ দিস।”

বড় সাহেবের বাড়িতে খুব কাজ। এক সময় মহিলা বয়সের ভারে আর অত খাটুনি পেরে উঠছিল না। তাই কাজ ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে এসে বসেছিল। তবে মাঝে মাঝে ও বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসত। চেয়েচিন্তে নিয়ে আসত বাতিল-পুরানো কাপড় চোপড়, দুপাঁচ দশটা টাকা, বাড়তি খাবার দাবার। সেদিন যখন ওই বাড়ি গিয়েছিল বড় সাহেবের মনে পড়ে যায় সেই মাতৃ আদেশ তাই তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন এখানে, যাও মাসি বোবাদের স্কুলে। লোক একজন আছে সে রান্না করবে, তুমি একটু সাথে থেকো।

বেচারা আর ভালোভাবে হাঁটতেও পারে না। ওজন বেড়ে গেছে। এখন হাঁটতে গেলে দেহকাণ্ডখানি টায়ার পাংচার গাড়ির মতো একদিকে বেঁকে বেঁকে যায়। বসলে উঠতে পারে না উঠলে বসতে পারে না। তবে মুখের ধার এখনও আছে। যে দাপটে সে এতকাল পাড়ার প্রতিবেশী, বাড়ির বউদের শাসন করে এসেছে, সেই–আমি বড় সায়েবের বাড়ি কাজ কম যদি তার কাছে গে নালিশ করি দেখবে কী হয়–মনের জোর এখনও অটুট।

সে কাউকে তেমন একটা ভয় ডর পায় না। তার একমাত্র ভয় নিজের স্বামীকে দিয়ে। সে যদি একবার রেগে যায় যা মুখে আসে তা বলে গাল পাড়ে। সে সব সহ্য করা যায় না। কথা যদি বা সহ্য হয় সহ্য হয় না লোকের বক্রভাবে তাকানো, মুখ টিপে হাসা। পাড়ার এক দুটো ফাজিল বউ বলে আর হাসে-ঠাকুর্দা যেখন বলতেছে, হোক না হোক এটু কিছু সত্যি নিচ্চয় আছে। নালি শুধু মুধু নিজির বউয়ের নামে এসব বলবে ক্যান। হারে ঠাগমা মোনের ভুলি কিছুমিছু করে বসিসনি তো।

এই কথার জবাবে মহিলা গাল পাড়ে। সে যত গাল দেয় বউ ঝিরা ততো হাসে আর বলে চোরের মার বড় গলা। শাক দে মাছ ঢাকা যাবেন। \ প্রত্যেকটা মানুষের মনের মধ্যে একটা ঘনঘোর অন্ধকার মহাদেশ আছে যেখানে কোনো সুর্যের এককণা আলোক শত চেষ্টাতেও পৌঁছাতে পারে না। সব যুক্তি, তর্ক, অনুনয়, বিনয়, সব আদেশ, নির্দেশ, হুমকি, ব্যর্থ ফিরে যায় ওই বন্ধ কক্ষের দোর গোড়া থেকে। এই মহিলা–যার বড় নাতি মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যার ওজন আশি কিলোর আশেপাশে; যার মুখশ্রী, গায়ের রঙ জনি লিভারের মায়ের মতো, সে কবে কত যুগ আগে কী যে করেছিল তা কে জানে। কিন্তু সেই যে সন্দেহ তার স্বামীর মনে ঢুকে গিয়েছিল তা আজও দূর হয়নি। সর্বদা ভয় এই বুঝি কেউ তার বউকে নিয়ে পালায়। তাই বিগত তিরিশ চল্লিশ বছর তার একটাই কাজ–সব কাজ বর্জন করে বউ পাহারা দেওয়া।বউ কাজে যায় সে তার পিছন পিছন গিয়ে কাজের জায়গায় বসে থাকে। তার হাঁটা চলা, কথা বলা, হাসা সব কিছুর প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখে। সে যখন বড় সাহেবের বাড়ি কাজ করত, তখনও তার স্বামী তাকে একা ছাড়ত না। পাহারা দিত।

কথায় বলে চুন খেয়ে যার গাল পোড়ে দই খেতে ভয় পায়। এখন সে স্বামী বেচারার ভয় আরো বেড়ে গেছে আমার জন্য। আমি এখানে একা থাকি, বউ থাকে দূরে। রান্নার জায়গা ছাদে, সন্ধের পর এখানে অন্ধকার নামে, লোকজনও কেউ থাকে না। যদি একা পেয়ে, ফাঁকা পেয়ে বউটাকে আমি কিছু করে দেই, যদি বউটাই আমাকে কিছু করতে দেয়, তখন কী হবে? এই সন্দেহবাতিক আধপাগলা লোকটাকে খুব কৌশলে দারোয়ান সাহা আমার উপর বিরূপ করে তোলে। ফলে সে বউয়ের পিছু পিছু সোজা রান্নার জায়গায় এসে একটা কোণ বেছে নিয়ে বসে পড়ে। যেখান থেকে গভীরভাবে লক্ষ্য রাখে, আমি তার বউয়ের দিকে তাকাচ্ছি কী না, হাসছি বা কথা বলছি কি না!

একী বিড়ম্বনা! এক সাথে কাজ করি, কথা না বলে কী পারা যায়। একবারও তাকাব না সে কী করে সম্ভব! এই নিয়ে একবার তার সাথে আমার বিশাল ঝগড়া। মারপিট হবার দশা। ব্যাপারটা খুব একটা ভালোর দিকে যাচ্ছেনা দেখে অবশেষে টিচার ইনচার্জ নির্দেশ দিলেন, কাজের জায়গায় এভাবে স্বামীকে সাথে করে আনা যাবে না।

আমি ভাবলাম এবার একটু শান্তি পাব। ওমা, কোথায় শান্তি! সে লোকটা স্কুলে তো ঢোকে না, মেন গেটের সামনে একটা বড় গাছ আছে, যেখান থেকে ছাদটা দেখা যায় সেখানে এসে বসে। কখনো কখনো স্কুলের পাঁচিলের চারপাশ ঘিরে ঘোরে আর কান পেতে শোনবার চেষ্টা করে, চোখ কুঁচকে দেখবার চেষ্টা করে, ছাদে কোনো হাসি কথা গল্প হচ্ছে কী না। একটা তিন ব্যাটারি টর্চ কিনেছে। সন্ধের পরে ঘন ঘন আলো ফেলে চেষ্টা করে এমন কোনো দৃশ্য সংকেত দেখা যায় কী না যা অবৈধ আইন বহির্ভূত।

মহিলা বলে তার নাকি মাত্র সাত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে যুবতী, যুবতী থেকে বৃদ্ধা হয়েছে স্বামীর অধীনে। এই দীর্ঘ জীবন যাত্রার কোন পর্বে কী ঘটেছিল তা কে জানে। তখন স্বামীর মনে যে সন্দেহ জন্মেছিল সারা জনমে তা আর গেল না। বরং দিনকে দিন তা বেড়েই চলেছে।

মানুষের মনোজগতে একঅতি জটিল দুর্বোধ্য দুর্ভেদ্য রহস্যময়তার মোড়কে ভরা। বিশ্লেষণের অতীত এক বিস্ময়। কে একজন যেন বলেছেন-যখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়, আমরা আলো জ্বালাই। কিন্তু অন্ধকার তাতে সমাপ্ত হয়ে যায় না। একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে সরে যায় মাত্র। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে প্রকৃতিতে, যে ঘনঘোর অন্ধকার সৃষ্টি হয়ে আছে সেই অন্ধকারে কত কী যে গুপ্ত–তা এক জীবন তো তুচ্ছ হাজার জীবনের জ্ঞান বিজ্ঞান দিয়ে জানা অসম্ভব। আমাদের জানা বোঝার ক্ষমতা তো তোটুকু যতটুকু আমার আলোর নাগালে আসে। কিন্তু যা আসে না সেই মহাবিশ্ব সম্বন্ধে আমরা কি করে অভিমত দিতে পারি!

মহিলার বাহাত্তর বছরের স্বামীর মনের সেই অন্ধকার মহাদেশে–বাষট্টি বছরের স্ত্রীর প্রতি যে অবিশ্বাস তার অনুসন্ধান পাওয়া কঠিন। তা আছে এবং আমৃত্যু থাকবে।

.

আমার একখানা এইট পাশ স্কুল সার্টিফিকেট চাই। কেউ বাড়ি চায়। কেউ গাড়ি চায়, কেউ নারী চায়, কেউ চাকরি চায়। চায় তো সকলে কিন্তু পায় কজন! আমি চাইছি একটা চাকরি। সেটা পেতে হলে সর্ব প্রথম পেতে হবে ওই সার্টিফিকেট।

আছে, এই বাম জমানায় তেমন লোক আছে যে টাকা পেলে জীবিত লোকের ডেথ সার্টিফিকেট বানিয়ে এনে দিতে পারে। তবে আমি তার ঠিকানা জানিনা। আমার এমন কিছু লোকের সাথে আলাপ পরিচয় আছে, যারা শিক্ষিত–কেউ কেউ শিক্ষকও। এদের সবচেয়ে বড় দোষ, কেউ কোনো অন্যায় কাজ করে না। অন্যায় করে না আবার কেউ অন্যায় করলে কলমকে কষে ধরে তার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কী করে তাদের বলি যে আমাকে একখানা এইট পাশ সার্টিফিকেট বানিয়ে দাও। সবাই যে জানে আমি কোনদিন কোনো স্কুলের চৌকাঠ মাড়াইনি।

কবীরের দোহা আছে, নিদ না মানে মুর্দাকা খাট, পিয়াস না মানে ধোবি কা ঘাট, প্রেম না মানে জাত পাত, ভুখ না মানে ঝুঠা ভাত। আমি ক্ষুধার্ত, এখন আমি নীতি নৈতিকতা খেয়ে কী খিদের আগুন নেভাতে পারব?

আমার গুরু আমাকে বলেছেন–মানুষের সবচেয়ে বড় অন্যায় নিজেকে অনাহারে রাখা। আত্মার মধ্যে বাস করে পরমাত্মা। যে মানুষ অনাহারে থাকে তার আত্মা কষ্ট পায়। আত্মা কষ্ট পেলে পরমাত্মা কষ্ট পায়। যে পরমাত্মাকে কষ্ট দেয় মহা পাপ করে। সেই পাপে জিয়ন্তে নরকবাস ঘটে।

অনেকে পারে, আমি খিদে সহ্য করতে পারি না। খিদে লাগলে আমার হাত পা শিথিল হয়ে যায়–শরীর কাঁপে। মনের সব ভালো ভাবনা কর্পূর হয়ে উড়ে পালায়–খিদে সহ্য করতে পারিনা বলে নেতা হওয়া হল না। এই উপমহাদেশে একজন লোক স্রেফ অনশন করে সূর্য অস্ত না যাওয়া ব্রিটিশ সম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। বাঙালিরা চিরকালই আর্যাবর্ত বিরোধী বলে পুরুষোত্তম রামচন্দ্রকে সম্মান জানায়নি। পাঠার আগে রাম জুড়ে রাম পাঠা অর্থাৎ রামের মতো পাঠা বলে তাকে ব্যাঙ্গ করেছে। তাহলে রামভক্ত গান্ধীজিকে কেন মান দেবে! আমি বাঙালি তাই গান্ধীজির মতো অনশন শিখে আগ্রহী হইনি নেতা হবার।

অনাহারকে বড় ভয় পাই। তাই এখন আমার একখানা সার্টিফিকেট চাই। গায়ে অসুরের মতো জোর, গাধার মতো খাটতে পারি, গরমে শরীর সেকতে পারি রুটির মতো ওসব কোনো গুণ নয়। ওতে চাকরি মিলবে না। চাই একখানা শিক্ষিতের প্রমাণ পত্র। কী যে করি! কোথায় যে খুঁজে পাই তারে!

একটু অন্যায় হবে। হোক। বেআইনি কাজ হবে। সে হোক। সত্তর দশক যখন পার হয়ে এসেছি, সহজে মরছি না। বেঁচে থাকলে এই অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করার অনেক সুযোগ পাব। সেই যে এক অধ্যাপক পি.এইচ.ডি. বলে চাকরি করে বেতন নিয়ে পরে পি.এইচ.ডি. হলে না? আমিও

হয় একটা সত্যি পরীক্ষা দিয়ে দেব। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে গুঁতোয় পড়ে অশ্বত্থামা হতঃ ইতি গজঃ বলতে হয়েছিল।

আমার সমস্যার কথাটা আমি যোগেনদাকে জানিয়ে বলি, আপনার তো অনেক চেনা। কোথাও, থেকে এনে দিন না একখানা সার্টিফিকেট।

যেন কোনো নিষ্ঠাবান বামুনকে বলেছি এক টুকরো শুয়োরের মাংস খান, এমন মুখ করে তাকালেন আমার দিকে। বললেন–এটা আমি পারব না। তুমি অন্য কাউকে ধরো।

কাকে ধরি! কে আছে এমন যাকে যুধিষ্ঠিরের কুকুরে কামড়ায় না। একটু কম নীতি সিদ্ধান্ত মেনে চলে। বাস্তবটা বোঝে।

একজন বলে–বড় সাহেবের কাছে যাও। উনি সব পারেন।

গেলাম একদিন বড় সাহেবের কাছে। আমার সমস্যা শুনে আমাকে ধমকে উঠলেন–চাকরি আমি দেব। আবার সার্টিফিকেট সেও আমায় এনে দিতে হবে? যা তোর চাকরি করতে হবে না। চলে যা যেখান থেকে এসেছিস। একটা সামান্য কাগজ জোগাড় করার ক্ষমতা যখন নেই, চলে যা।

কাঁদো কাদো মন ছলো ছলো চোখ নিয়ে যখন ফিরে আসছি পথেই দেখা হয়ে গেল আদুরি গোঁসাইয়ের সাথে। সে স্কুলে হাজিরা দিয়ে চলে গিয়েছিল রেশন তুলতে। রেশন নিয়ে ফিরছে। সব শুনে সে একচোট খুব হেসে নেয়। তারপর বলে–তোমার মতো রাম পাঁঠা আর দেহি নাই। রাজবাড়ি গেছে বাসি রুটি চাইতে। আরে অতো ছোড কাম নিয়া কেউ বড়ো সাহেবের ধারে যায়? যদি গলায় ফাঁসি লাইগ্যা যাইতো, কী দুই চাইরখান খুন কইরা দিতা তাইলে একখান কতা হইত। কী না, বাবু আমারে একখান ছার্টিফিকেট দ্যান, এইডা কী তার যোগ্য কত?

বলি, তার কাছে ছোট হতে পারে আমার কাছে তো পাহাড় সমান। কার কাছে যে যাব বুঝতে পারছি না।

হাসে আর বলে সে–আমার কাছে যাও।

কী!

কই কী আমারে টাকা দিও। আমি বানাইয়া আইন্যা দিমু তোমার ছার্টিফিকেট। পাঁচশো হ্যাঁরে দেওন লাগবো। দুইশো আমার আওন যাওনের খরচ।

মানুষ! হায় রে মানুষ! মানুষ চেনা বড় সহজ কথা নয়। এই জন্য রামকৃষ্ণদেব বলেছেন কোন্ নুড়িতে নারায়ণ আছে তা কি কিছু বলা যায় রে। কে জানত কালকে বাংলাদেশ থেকে আসা আদুরি গোঁসাই এত শক্তিমান। কত লোকের কাছে গেছি। দেখিতে গিয়াছি পাহাড় নদী দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু। শুধু আমার চোখের সামনে আদুরির কাছে যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের পরে একটি শিশির বিন্দু। কে জানত যে, আমারই ঘরের উঠোনে অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে। এই জন্য মানুষ বলে গেছে গরু দুয়ারের ঘাস খায় না।

আদুরি গোঁসাইয়ের মতো এমন সাহসী সফল মহিলা পৃথিবীতে খুব কমই দেখা মেলে। দুটো ছেলে দুটো মেয়ে নিয়ে শুধু সাহসের জোরে দূর বিদেশ ইন্ডিয়ায় চলে এসেছিল ভাগ্য সন্ধানীর মতো। মানুষ নিরক্ষর হলেই মুখ হয় না। সে তার স্বাভাবিক বুদ্ধিতে জেনে গিয়েছিল মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানোর পথ শুরু হয় পাকস্থলি থেকে। তাই সে একটা বড় টিফিন বক্স কিনে নিয়েছিল, যার চারটে বাটি। সেই বাটিতে অতি যত্নে উপাদেয় রান্না খাবার ভরে পৌঁছে যেতে লাগল এক নাথবতী অনাথবৎ মহিলা নেত্রীর বাড়ি। যে আদুরির সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে বলেন–বল তুমি কী বর চাও?

মুই বড় গরিব। একখান ভালো কাম দ্যান মোরে।

দিলাম। আর কিছু?

না আর কিছু না। লাগলে পরে কমু।

তুই আমাকে কী দিবি?

আপনে কন।

যেদিন তুই আমার বাড়ির কাজ ছেড়ে দিবি, তোর কাজ তোকে ছেড়ে দেবে।

আপনে ভাইবেন না। আমার দুইখানা মাইয়া আছে। এ্যাকজোন কেউ না কেউ ঠিক আমু। আদুরি এখন সেই টিফিন বক্স নিয়ে স্কুলের ডিউটিতে আসে। একটা বড়দির জন্য বাঁধা। বাকি তিন কৌটো এক একদিন এক একজনার জন্য বরাদ্দ। অবশ্য যদি সে আদুরির উপকারি হয়। সে এখন বড় সুখে আছে, ভারত যাত্রা তার সার্থক।

এই আদুরি গোঁসাই আমাকে এনে দেয় দক্ষিণবঙ্গের এক স্কুল থেকে এইট পাশ সার্টিফিকেট। জানতে পারি আদুরির কারণে এই স্কুলে আমার জনকয়েক ক্লাস ফ্রেন্ড আছে। জনৈক সিপিএম নেতা কুঁজো ডাক্তার এমন সার্টিফিকেট স্বল্পমূল্যে শত শত বিলি করেছেন, জনকল্যাণ জনিত হৃদয় দুর্বলতায়।

সেই সার্টিফিকেট স্কুলে জমা করে দিয়ে বসে থাকি কবে আমার চাকরি হবে সেই আশায়। কবে বেতন পাব সেইদুরাশায়। দিনের পর দিন যায়। খাওয়াটা তো মিলে যায়, তবে শুধু খাওয়াতে তো চলে না, কিছু হাত খরচাও লাগে। একটু লিখি টিখি তার জন্য কাগজ কলম কিনতে হয়। এখানে সেখানে যেতে গাড়ি ভাড়াও দরকার। তেল সাবানও চাই। তেল কিনতে না পেরে রান্নার জন্য বরাদ্দ সরষের তেল ক’দিন মাথায় দিচ্ছিলাম। একদিন হোস্টেল সুপার দেখে ফেলে ধমকে দেয়-এ তেল মাখবেন না। এটা বাচ্চাদের রান্নার জন্য। এরা আমাকে সকাল বিকালের টিফিনও দেয় না। ওটা খাওয়া বারণ। শুধু দুবেলা যা রান্না হবে সেটাই আমার পাওনা। এখন বাচ্চা বেড়ে প্রায় ষাট। আরও ভর্তি চলছে। সবাই টিফিন পায়। একা আমি বাদ–কারণ আমি বাচ্চা নই, বড়। ছাত্র নই, কর্মচারি। আমার খাই খাই করা ভালো লক্ষণ নয়।

কোথায় যেন একবার লিখেছি–নিজে অভুক্ত থেকে অপরকে খাওয়ানো এর নাম সংস্কৃতি। খিদে পেলে খাওয়া এর নাম প্রকৃতি। খিদে না পেলেও খাওয়া এর নাম বিকৃতি। আর যে অপরের ক্ষুধার অন্ন ছিনিয়ে নেয় সে দুষ্কৃতি।

বোবা বাচ্চাদের খাবার খেয়ে নিলে সেটা তো অপরাধই। ওরা আমাকে সেই অপরাধ থেকে দুবেলা দুরে রাখছে।

এইসব কথা লিখতে ভালো লাগছে না। মানুষ যে যার নিজের চশমা দিয়ে জগতটাকে দেখে। তারা বিশ্বাস করতে চাইবে না, কেউ এত হীননীচ মনোবৃত্তির হয়। হয়, কারণ এরা সেই মানুষ যাদের কিছু বছর পরে হার্মাদ নামে এক ডাকে সবাই চিনবে। এরা যে কত নীচে নামতে পারে সে জানে মরিচঝাঁপির মাটি, গাছপালা, নদীর জল। কত জঘন্য হতে পারে কিছুদিন পরে টের পাবে লালগড়। যখন এরা কুয়োর জল পান অযোগ্য করে দেবার জন্য সেই জলে হেগেমুতে দেবে। পরিচয় পাবে সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামও। তার একটু দেরি আছে।

.

একটা প্রচণ্ড কলরব। ছাদ থেকে নীচে তাকালাম কী ব্যাপার এত শব্দ কেন শব্দহীন সমাজে। কেউ যদি বাক্য হারা হয় সে বধির নাও হতে পারে। তবে বধির হয়ে জন্মালে যোবা অবশ্যই হবে। আর যে মানুষ কথা বলতে পারে সে বলে শুধু মুখ দিয়ে। যে তা পারে না, কথা বলে হাত পা চোখ মুখ সর্বঅঙ্গ দিয়ে দেখি, এক সাথে অনেক বোবা কিছু বলার চেষ্টা করছে। তাই এত হৈ চৈ।

আর একটু লক্ষ্য করতে দেখি পাঞ্জা ধরা হচ্ছে। পাঞ্জায় হার জিত হচ্ছে। আজও স্কুল ছুটি। সব ছুটির দিনের মতো আজও ওরা খেতে দেরি করবে। সাবান ঘষা, কাপড় কাঁচা, চান আর পাঞ্জা একসাথে চলছে, দেখি সেই বাচ্চাদের ভিড়ে শিং ভেঙে ওয়ার্ডেনও ঢুকে পরেছে। সেও পাঞ্জা ধরছে।

স্কুলে দুজন তাগড়া জোয়ান ছেলে আছে। একজনের নাম মিঠুন আর একজন সোমনাথ। টকালো লম্বা সুস্বাস্থ্যের অধিকারি। সেই দুজনে পাঞ্জা ধরেছে। কে হারে কে জেতে–দুজনার সমর্থকদের সেই নিয়ে শোরগোল। বলে ওয়ার্ডেন, যে জিতবে তার সাথে আমার পাঞ্জা হবে। সবাই জানত মিঠুন জিতবে। তাই হল সেই জিতল। এবার সে আর ওয়ার্ডেন দুজনে পাঞ্জা ধরল–জিতে গেল ওয়ার্ডেন। জিতেই তার নাবালক উল্লাস–এটা হাত নয়, পিলার রে। একে কাত করতে হলে বুলডোজার লাগবে।

আমি হাসছি। হঠাৎকটা বোবা ছেলের চোখ গেল ছাদের দিকে। আমার দিকে। তারা সমস্বরে হাত মুখ মাথা নেড়ে আমাকে ডাকতে লাগল পাঞ্জা ধরার জন্য। আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মুখে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে ওয়ার্ডেন ডাক কাকে ডাকবি। সব পেড়ে ফেলে দেবো। এ হাত নেহি ফাঁসিকা ফান্দা হ্যায়। তারপর সরাসরি আমার দিকে হুঙ্কার–কাম অন।

ওয়ার্ডেন বয়সে আমার চেয়ে কম পক্ষে দশ বারো বছরের ছোট। শক্ত সামর্থ পেটানো চেহারা। উচ্চতায় আমার চেয়ে একটু বেশি। সে যেমন জানে, পাঞ্জা ধরলে অবধারিত ভাবে আমি হারব, আমিও জানি জেতা কঠিন। যে কোনো খেলায় কেউ হারাব জানলে খেলতে নামে না। আমি তাই নীচে নামি না। ছাদেই দাঁড়িয়ে থাকি, আর মাথা নাড়ি। না না।

আমার না-য়ে ওয়ার্ডেনের মনের জোর আরও বেড়ে যায়। যে হারার আগে হেরে বসে থাকে, তাকে হারানো সবচেয়ে সহজ। সেই দাবা খেলার হারের স্মৃতি সে আজও ভোলেনি। বুদ্ধির খেলায় হেরেছে এখন শক্তির খেলায় জিতে তার বদলা নিতে চায়। একটা বড় জয়ের আনন্দের চেয়ে একটা ছোট হারের অপমান তাদের কাছে অনেক বড় যারা জীবনে কোথাও কোনদিন হারেনি। আজও মনে দগদগে হয়ে আছে সেই হার।

সে দুতিনটা বোবা ছেলেকে ইশারা করে–যা ধরে নিয়ে আয়। ছেলেগুলো ছাদে রান্না ঘরে ছুটে এসে আমার হাত ধরে। জোর খাটায় চলল। পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। অগত্যা নেমে এলাম নীচে। গোটা পনের বাচ্চা ঘিরে ধরল আমাদের যেন এখন পালোয়ান দারা সিংয়ের সাথে অভিনেতা মুকরির একটা লড়াই হবে। যাতে লড়াই কম কমেডি বেশি। কে হারবে কে জিতবে সেটা সবার জানা। সবাই শুধু হাসির খোরাক চায়।

অগত্যা হাত বাড়াই আমি। হারাব জেনেই হাত বাড়াই। তবে ওই মরার আগে মরব না। হতে পারো তুমি আলেকজান্ডার কিন্তু আমিও পুরুর বাচ্চা।

পাঞ্জা ধরার যা নিয়ম–প্রথম তিরিশ সেকেন্ড প্রতিপক্ষের শক্তির একটা আন্দাজ নেওয়া। পরের তিরিশ সেকেন্ড তাকে শক্তি প্রয়োগ করতে দেওয়া। যদি বোঝা যায় আমার চেয়ে বলবান, নিজের হাতকে খুঁটির মতো যতক্ষণ পারা যায় গেড়ে বসে থেকে হার এড়ানো। যদি বোঝা যায়। আমার চেয়ে একটু কম, শরীরের সবশক্তি হাতে কেন্দ্রিভূত করে প্রতিপক্ষকে চেপে ধরা–চাপ বাড়িয়ে হারিয়ে দেওয়া।

জীবনে অনেক কিছুর মতো এক সময় পাঞ্জাও খুব ধরেছি। কিছু কৌশল জানা আছে। এখন সেটার সফল প্রয়োগ ঘটাই। আর আমার চেয়ে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ক্ষমতায় অনেক এগিয়ে থাকা এক হামবড়াই করা হার্মাদকে হারিয়ে দিই। জানি না কেন উল্লাসে ফেটে পড়ে যোবা বাচ্চারা। যেমন ভাবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমকে বাংলাদেশ হারিয়ে দিলে ভারতীয় দর্শক নেচে উঠেছিল। দুঃখী ওয়ার্ডেন। হেরে গেলাম যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কেন যে হারল? কেন তাকে হারাতে পারলাম? আমার মনে হয় সেই সময় আমার ডানহাত দীর্ঘ বাম অপশাসনের সৃষ্টি হওয়া এই সব উৎপীড়ক অহঙ্কারী লোকেদের দ্বারা অপমানিত মানবাত্মারা ভর করেছিল। তারা আমাকে বল জোগাচ্ছিল, হারিস না। তোর হার মানে শ্রমজীবনের পরাজয়। বিজয় এক দর্পিত দানবের। তোকে জিততেই হবে।

আমার কোনো উপায় ছিল না, না হারিয়ে। তাই হারিয়েছি। এই হার রুনু গুহ নিয়োগীর বর্বরতার। বিজয়, সমস্ত শ্রমজীবী জনতার। কারণ, আমি যে তাদেরই প্রতিনিধি।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *