নবম পরিচ্ছেদ
চৈতন্যদাস বাবাজী
মসীকৃষ্ণবর্ণ, খর্ব্বাকার, লম্বোদর, মুণ্ডিতশীর্ষ, একজন বৈরাগী সরস্বতী ও গঙ্গা সঙ্গমের নিকটে, সেই তিন্তিড়ি বৃক্ষের নিম্নে বসিয়া ঘনঘন নস্য লইতেছিল। তাহার পার্শ্বে কৃশকায়, কৃষ্ণবর্ণ একটি দীর্ঘাকার যুবক দাঁড়াইয়াছিল। ঘাটে যে কয়থানি নৌকা আসিল, বৈরাগী তাহাদের প্রত্যেক খানির মাঝি মাল্লাদিগকে হুগলী যাইতে অনুরোধ করিল; কিন্তু কেহই সম্মত হইল না। ঘাটে যে কয়খানি নৌকা ছিল তাহাদিগের মাঝিরা কহিল, “বাবাজী, আমরাত পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আজ সপ্তগ্রামের কোন নৌকা হুগলীর দিকে যাইতে সাহস করিবে না।” বৈরাগী কাতর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন বাপু? আমার যে হুগলীতে বিশেষ প্রয়োজন আছে।” একজন বৃদ্ধ ধীবর কহিল, “বাবাজী, আট আনা পয়সার জন্য কে মরিতে যাইবে? কাল রাত্রিতে সাতগাঁয়ে ফিরিঙ্গির সহিত ফৌজদারী সিপাহীর ভীষণ হাঙ্গামা হইয়া গিয়াছে, ফিরিঙ্গিরা হটিয়া পলাইয়া গিয়াছে, তাহাতে তাহাদের রাগ আরও বাড়িয়া গিয়াছে, এখন সাতগাঁয়ের লোক পাইলে তাহারা শূলে দিবে।” তাহার কথা শুনিয়া বৈরাগী আর কোন উত্তর খুঁজিয়া পাইল না, শম্বুকের পটহ হইতে ঘন ঘন নস্য লইতে লাগিল। ক্ষণকাল পরে জনৈক দীর্ঘাকার শ্যামবর্ণ ব্রাহ্মণ তিন্তিড়িতলে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে ইতস্ততঃ চাহিতে দেখিয়া বৈরাগীর মনে ভরসা হইল, সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুর মহাশয়, প্রণাম হই, আপনি কি কোন স্থানে যাইবেন?” ব্রাহ্মণ বিরক্ত হইয়া বৈরাগীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল এবং ক্ষণকাল পরে কহিল, “বাপু হে, কোথায় যাইব তাহা স্থির করিতে পারিতেছি না। তুমিও কি কোথাও যাইবে না কি?” “আজ্ঞা, সে প্রভুর ইচ্ছা, হুগলী যাইবার মানস ছিল, কিন্তু নৌকা পাওয়া যায় না। রাধে কৃষ্ণ, রাধে কৃষ্ণ, ঠাকুর মহাশয় কি সাতগাঁয়ে নূতন আসিয়াছেন?” “কেন বল দেখি?” “এই চাল চলন দেখিয়া বলিতেছি। সহরের লোকের চাল চলন আলাহিদা রকমের, আমিও পল্লীগ্রামের লোক।” “বটে, তোমার নিবাস কোথায়?” “কাটোয়ার নিকটে উদ্ধারণপুরে, ঠাকুর মহাশয়।” “আপনার?” “মুখ্সুসাবাদের নিকটে ভীমেশ্বরে।”
বৈরাগী বড় নির্ল্লজ্জ; ব্রাহ্মণ কোথায় যাইবে তাহা জানিবার ইচ্ছা সে কোন মতেই দমন করিতে পারিতেছিল না। বৈরাগী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “বলি ঠাকুর মহাশয় কি সাতগাঁয়ে যাইবেন?”
সেই সময়ে পথ দিয়া একজন মাতাল টলিতে টলিতে যাইতেছিল, সে বৈরাগীর কথা শুনিয়া বলিয়া উঠিল, “বাবাজী, এমন কাজ করিও না, তোমার মত নধর পাঁঠা পাইলে ফিরিঙ্গিরা লোভ সম্বরণ করিতে পারিবে না, গির্জ্জায় লইয়া গিয়া বলি দিবে।” বৈরাগী বলির কথা শুনিয়া নিষ্ঠীবন ত্যাগ করিয়া কহিল, “রাধে গোবিন্দ, রাধে গোবিন্দ। ঠাকুর মহাশয়, বেটা বড়ই বেল্লিক।” মাতাল সেইখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া টলিতে লাগিল এবং কহিল, “মিথ্যা নহে বাবাজী, তোমার ভুঁড়ীটিতে অনেক মাংস আছে, সুন্দর শিখ কাবাব্ বনিবে।” বৈরাগী আবার নিষ্ঠীবন ত্যাগ করিল, ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হইয়া রোধকষায়িত নেত্রে মদ্যপের দিকে চাহিল। সে লজ্জিত না হইয়া কহিল, “ঠাকুর চটেন কেন? কাবাব্ অতি সুন্দর দ্রব্য।” ব্রাহ্মণ কহিলেন, “সুন্দর দ্রব্য হয় তুমি গিয়া খাও।” “ঠাকুর, এমন পাঁঠাটি ছাড়িয়া যাইব?” “তুমি বড় জ্বালাতন আরম্ভ করিলে, শীঘ্র এ স্থান পরিত্যাগ কর।” বৈরাগী বলিল, “ঠাকুর, চলুন সরিয়া যাই, সাত গাঁ অতি কুস্থান, বেটা হয় ত এখনই বমন করিয়া দিবে।”
বৈরাগীর কথা শুনিয়া মদ্যপ ক্রোধে অধীর হইয়া বৈরাগীর দীর্ঘ শিখ ধারণ করিয়া কহিল, “তবে রে বেটা নেড়া, তুই আমাকে বেটা বলিস্? তোর এত বড় স্পর্দ্ধা হইয়াছে? চল্ আমি তোকে সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরে লইয়া গিয়া বলি দিব।” বৈরাগী যাতনায় অস্থির হইয়া চীৎকার করিতে লাগিল; কিন্তু তথাপি সিদ্ধেশ্বরী ও বলি শুনিয়া নিষ্ঠীবন পরিত্যাগ করিতে ভুলিল না। বৈষ্ণবের শিখা ছিঁড়িয়া যায় দেখিয়া সকলে মিলিয়া তাহাকে মদ্যপের হাত হইতে বাঁচাইল। মাতাল, টলিতে টলিতে চলিয়া গেল। তখন বৈরাগী মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুর মহাশয়, সত্য না কি?” ব্রাহ্মণ কহিলেন “কি?” “ঐ বেটা যাহা বলিল?” “আবার গালি দিতেছ? এখনই ত মরিতে বসিয়াছিলে?” “এখন ত আর শুনিতে পাইবে না?” “না পাউক, বৃথা গালি দিয়া ফল কি?” “ভাল, দিব না ঠাকুর মহাশয়, কথাটি কি সত্য?” “কি কথা?” “ঐ যা বলিল?” “সেত অনেক কথাই বলিল, তুমি কোন্ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ?” “ঐ যে, গির্জ্জায় গিয়া—” “গির্জ্জায় গিয়া কি?”, “ঠাকুর, সে কথা কি মুখে আনিতে আছে? থুঃ।” “তবে আমি বুঝিব কেমন করিয়া?” “ঐ যে গির্জ্জায় গিয়া, আপনাদের সেই কাল মাগীর সম্মুখে যাহা করেন তাহাই?” “ও, বলির কথা বলিতেছ?”
বৈরাগী পুনরায় নিষ্ঠীবন ত্যাগ করিল। ব্রাহ্মণ এইবার বড়ই চটিল এবং কহিল, “পাষণ্ড, তুই মহামায়ার নামে নিষ্ঠীবন ত্যাগ করিতেছিস্? তোর নরকেও স্থান হইবে না।”
বৈরাগী বড়ই বিপদে পড়িল, সপ্তগ্রামে গমন তাহার নিতান্ত আবশ্যক, অথচ গির্জ্জায় নরবলির কথা শুনিয়া সে বড়ই ভীত হইয়াছিল; তাহার আর একাকী সপ্তগ্রামে যাইবার ভরসা হইতেছিল না। ব্রাহ্মণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছে দৈখিয়া বৈরাগী করযোড়ে কহিল, “ঠাকুর মহাশয়, অপরাধ লইবেন না।” ব্রাহ্মণ মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল; তখন বৈরাগী পুনরায় কহিল, “ঠাকুর মহাশয়, আমি কি করিব? গুরুর আদেশ।” “তোমার গুরু কি তোমাকে মহামায়ার নামে থুতু ফেলিতে বলিয়াছে?” “না, না। লোকাচার।” “এমন লোকাচার সকলে সহিবে কেন?” “ঠাকুর মহাশয়, অপরাধ হইয়াছে।”
ব্রাহ্মণের ক্রোধ অধিকক্ষণ থাকে না। ব্রাহ্মণ প্রসন্ন হইয়া কহিলেন, “বাবাজী, তুমি কি পাগল হইয়াছ, খ্রীষ্টানে কখন নরবলি দেয়?” বলি শুনিয়া বৈরাগী থুতু ফেলিতে যাইতেছিল, বহু কষ্টে আত্মসম্বরণ করিল। এই সময়ে সাত আটজন লাঠিয়াল আসিয়া ব্রাহ্মণকে প্রণাম করিল। তাহাদিগের মধ্যে একজন বৃদ্ধ কহিল, “ঠাকুর মহাশয়, কোন সংবাদই পাইলাম না। সারা সহর তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াছি, যত লোক মরিয়াছে অথবা জখম হইয়াছে তাহাদিগের সকলকেই দেখিয়া আসিয়াছি। মহারাজকে ত কোথাও দেখিলাম না।” ব্রাহ্মণ সংবাদ শ্রবণে চিন্তিত হইয়া কহিলেন, “তাই ত ভুবন, আমি ভারিয়াছিলাম এইবার সন্ধান পাইব। নৌকা কোথায় আছে?” “নিকটেই বাদশাহী পুলের নীচে।” “তোমাদের আহার হইয়াছে?”
তখন দিবা দ্বিতীয় প্রহর অতীত হইয়াছে, ব্রাহ্মণের তখনও স্নানাহার হয় নাই। ভুবন তাঁহার মুখ দেখিয়া তাহা বুঝিতে পারিল এবং কহিল, “খাইব কি ঠাকুর মহাশয়? সকাল হইতে ত ঘুরিয়াই বেড়াইতেছি। চলুন নৌকায় ফিরিয়া যাই।”
বৈরাগী নৌকার কথা শুনিয়া সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুর মহাশয়ের কি নৌকা আছে? তাহা হইলে ত হুগলীতে যাইতে পারা যায়?” ব্রাহ্মণ হাসিয়া কহিলেন, “যায় বই কি, বাবাজী, তুমি আমাদিগের সহিত আইস, আমরা অপরাহ্নে হুগলী যাইব।” বাবাজী সানন্দে কহিল, “গৌরহরি, গৌরহরি; ঠাকুর মহাশয়, হুগলীতে আমার শিষ্যবাড়ী পায়ের ধূলা দিতে হইবে।” ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার শিষ্য কি জাতি?” “আজ্ঞা, তন্ত্রবায়।” “বাবাজী, তোমার মঙ্গল হউক, আমি শূদ্রের গৃহে অন্ন গ্রহণ করিব কি প্রকারে?” “ফলাহার করিবেন; উত্তম চিড়া, ঘন ক্ষীর, বাথানের দধি, মর্ত্তমান রম্ভা এবং গোল্লা।”
বৈরাগীর সৃক্কণী বহিয়া লালা গড়াইয়া পড়িল; ব্রাহ্মণ তাহা দেখিয়া আর হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না, তিনি মন খুলিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বৈরাগীর শিষ্য পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছিল, সে ঘন ঘন সৃক্কণী লেহন করিতেছে দেখিয়া, ব্রাহ্মণ কহিলেন, “আমরা শূদ্রগৃহে ফলাহারও করি না। বাবাজী, তোমাদিগের বোধ হয় আহার হয় নাই?” “আজ্ঞা না।” “ভাল, অদ্য তোমরা আমার অতিথি।” “ঠাকুর মহাশয়ের অন্ন প্রসাদ পাইব না ফলাহার করিব?” “এবেলা অন্ন প্রসাদ পাইবে ওবেলায় ফলাহার করিও। ভুবন, মহারাজ হয় ত ফিরিঙ্গির হাতে বন্দী হইয়াছেন, আমরা আহারান্তে নৌকা লইয়া হুগলী যাইব, তুমি নৌকায় পাকের উদ্যোগ কর।” “যে আজ্ঞা।”
সকলে ভুবনের নৌকায় আরোহণ করিলেন।