আগ্নেয় পর্বতের অত কাছে বাস করা আলভারেজ উচিত বিবেচনা করলে না। ওলডোনিও লেঙ্গাই পাহাড়ের ধূমায়িত শিখরদেশের সান্নিধ্য পরিত্যাগ করে, তারা আরও পশ্চিম ঘেঁষে চলতে লাগল। সেদিকের গহন অরণ্যে আগুনের আঁচটিও লাগেনি, বর্ষার জলে সে অরণ্য আরও নিবিড় হয়ে উঠেছে, ছোট ছোট গাছপালা ও লতাঝোপের সমাবেশে। ছোট বড় কত ঝরনাধারা ও পার্বত্য নদী বয়ে চলেছে— তাদের মধ্যে একটাও আলভারেজের পূর্ব পরিচিত নয়।
এইবার এক জায়গায় ওরা এসে উপস্থিত হল, যেখানে চারিদিকেই চুনাপাথর ও গ্রানাইটের ছোট বড় পাহাড় ও প্রত্যেক পাহাড়ের গায়েই নানা আকারের গুহা। স্থানটার প্রাকৃতিক দৃশ্যও রিখটারসভেল্ডের সাধারণ দৃশ্য থেকে একটু অন্য রকম। এখানে বন তত ঘন নয়, কিন্তু খুব বড় বড় গাছ চারিদিকে, আর যেখানে সেখানে পাহাড় ও গুহা।
একটা উঁচু ঢিবির মতো গ্রানাইটের পাহাড়ের উপর ওরা তাঁবু ফেলে রইল। এখানে এসে পর্যন্ত শঙ্করের মনে হয়েছে জায়গাটা ভালো নয়। কি একটা অস্বস্তি, মনের মধ্যে কি একটা আসন্ন বিপদের আশঙ্কা, তা সে না পারে ভালো করে নিজে বুঝতে, না পারে আলভারেজকে বোঝাতে।
একদিন আলভারেজ বললে— সব মিথ্যে শঙ্কর, আমরা এখনো বনের মধ্যে ঘুরছি। আজ সেই গাছটা আবার দেখেছি, সেই D. A. লেখা। অথচ তোমার মনে আছে, আমরা যতদূর সম্ভব পশ্চিম দিক ঘেঁষেই চলেছি আজ পনেরো দিন। কি করে আমরা আবার সেই গাছের কাছে আসতে পারি?
শঙ্কর বললে— তবে এখন কি উপায়?
– উপায় আছে। আজ রাত্রে একটা বড় গাছের মাথায় উঠে নক্ষত্র দেখে দিক নির্ণয় করতে হবে। তুমি তাঁবুতে থেকো।
শঙ্কর একটা কথা বুঝতে পারছিল না। তারা যদি চক্রাকারে ঘুরছে, তবে অনুচ্চ শৈলমালা ও গুহার দেশে কি করে এল? এ অঞ্চলে তো কখনো আসেনি বলেই মনে হয়। আলভারেজ এর উত্তরে বললে, গাছটাতে নাম খোদাই দেখে সে আর কখনো তার পূর্বদিকে আসবার চেষ্টা করেনি। পূর্ব দিকে মাইল দুই এলেই এই স্থানটিতে ওরা পৌঁছুতো।
সে রাত্রে শঙ্কর একা তাঁবুতে বসে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজসিংহ’ পড়ছিল। এই একখানা বাংলা বই সে দেশ থেকে আসবার সময় সঙ্গে করে আনে, এবং বহুবার পড়লেও সময় পেলেই আবার পড়ে।
কতদূরে ভারতবর্ষ, তার মধ্যে চিতোর, মেওয়ার, মোগল-রাজপুতের বিবাদ! এই অজানা মহাদেশের অজানা মহা অরণ্যানীর মধ্যে বসে সে-সব যেন অবাস্তব বলে মনে হয়।
তাঁবুর বাইরে হঠাৎ যেন পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। শঙ্কর প্রথমটা ভাবলে, আলভারেজ গাছ থেকে নেমে ফিরে আসছে বোধ হয়। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, এ মানুষের স্বাভাবিক পায়ের শব্দ নয়, কেউ দু-পায়ে থলে জড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাটিতে পা ঘষে ঘষে টেনে টেনে চললে যেন এমন ধরনের শব্দ হওয়া সম্ভব। আলভারেজের উইনচেস্টার রিপিটারটা হাতের কাছেই ছিল, ও সেটা তাঁবুর দরজার দিকে বাগিয়ে বসল। বাইরে পদশব্দটা একবার থেমে গেল— পরেই আবার তাঁবুর দক্ষিণ পাশ থেকে বাঁ দিকে এল। একটা কোনো বড় প্রাণীর ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ যেন পাওয়া গেল— ঠিক যেমন পাহাড় পার হবার সময় এক রাত্রে ঘটেছিল, ঠিক সেই রকমই।
শঙ্কর একটু ভয় পেয়ে সংযম হারিয়ে ফেলে রাইফেল ছুঁড়ে বসল। একবার… দু’বার…
সঙ্গে সঙ্গে মিনিট দুই পরে গাছের মাথা থেকে প্রত্যুত্তরে দু’বার রিভলবারের আওয়াজ পাওয়া গেল। আলভারেজ মনে হয় ভেবেছে, শঙ্করের কোনো বিপদ উপস্থিত, নতুবা রাত্রে খামোখা বন্দুক ছুঁড়বে কেন? বোধ হয় সে তাড়াতাড়ি নেমেই আসছে।
এদিকে চারদিক থেকে বন্দুকের আওয়াজে জানোয়ারটা বোধ হয় পালিয়েছে, আর তার সাড়াশব্দ নেই। শঙ্কর টর্চ জ্বেলে তাঁবুর বাইরে এসে ভাবলে, আলভারেজকে সংকেতে গাছ থেকে নামতে বারণ করবে, এমন সময় কিছুদূরে বনের মধ্যে হঠাৎ আবার দু’বার পিস্তলের আওয়াজ এবং সেই সঙ্গে একটা অস্পষ্ট চিত্কার শুনতে পাওয়া গেল।
শঙ্কর পিস্তলের আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুটে গেল। কিছুদূরে গিয়েই দেখলে বনের মধ্যে একটা বড় গাছের তলায় আলভারেজ শুয়ে। টর্চের আলোয় তাকে দেখে ভয়ে বিস্ময়ে শঙ্কর শিউরে উঠল— তার সর্বশরীর রক্তমাখা, মাথাটা বাকি শরীরের সঙ্গে একটা অস্বাভাবিক কোণের সৃষ্টি করেছে। গায়ের কোটটা ছিন্নভিন্ন।
শঙ্কর তাড়াতাড়ি ওর পাশে গিয়ে বসে ওর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলে। ডাকলে— আলভারেজ! আলভারেজ!
আলভারেজের সাড়া নেই। তার ঠোঁট দুটো একবার যেন নড়ে উঠল, কি যেন বলতে গেল। সে শঙ্করের দিকে চেয়েই আছে, অথচ সে চোখে যেন দৃষ্টি নেই; অথবা কেমন যেন নিস্পৃহ, উদাস দৃষ্টি।
শঙ্কর ওকে বহন করে তাঁবুতে নিয়ে এল। মুখে জল দিল, তারপর গায়ের কোটটা খুলতে গিয়ে দেখে গলার নিচে কাঁধের দিকের খানিকটা জায়গার মাংস কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে! সারা পিঠটারও সেই অবস্থা। কোনো এক অসাধারণ বলশালী জন্তু, তীক্ষ্ণধার নখে বা দাঁতে পিঠখানা চিরে ফালা ফালা করেছে।
পাশেই নরম মাটিতে কোনো এক জন্তুর পায়ের দাগ— তিনটে মাত্র আঙুল সে পায়ে।
সারারাত্রি সেই ভাবেই কাটল, আলভারেজের সাড়া নেই, সংজ্ঞা নেই। সকাল হবার সঙ্গে হঠাৎ যেন তার চেতনা ফিরে এল। শঙ্করের দিকে বিস্ময় ও অচেনার দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলে, যেন এর আগে সে কখনো শঙ্করকে দেখেনি। তারপর আবার চোখ বুজল। দুপুরের পর খুব সম্ভবতঃ নিজের মাতৃভাষায় কী সব বকতে শুরু করল, শঙ্কর এক বর্ণও বুঝতে পারলে না। বিকেলের দিকে সে হঠাৎ শঙ্করের দিকে চাইলে। চাইবার সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করের মনে হল, সে ওকে চিনতে পেরেছে। এইবার ইংরেজীতে বললে— শঙ্কর! এখনো বসে আছ? তাঁবু ওঠাও, চল যাই— তারপর অপ্রকৃতিস্থের মতো নির্দেশহীন ভঙ্গীতে হাত তুলে বললে— রাজার ঐশ্বর্য লুকোনো রয়েছে ঐ পাহাড়ের গুহার মধ্যে— তুমি দেখতে পাচ্ছ না— আমি দেখতে পাচ্ছি। চল আমরা যাই— তাঁবু ওঠাও— দেরি কোরো না…
এই আলভারেজের শেষ কথা।
তারপর কতক্ষণ শঙ্কর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সন্ধ্যা হল, একটু একটু করে সমগ্র বনানী ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল।
শঙ্করের তখন চমক ভাঙল। সে তাড়াতাড়ি উঠে আগে আগুন জ্বাললে, তারপর দুটো রাইফেলে টোটা ভরে তাঁবুর দোরের দিকে বন্দুকের নল বাগিয়ে, আলভারেজের মৃতদেহের পাশে একখানা শতরঞ্জির ওপর বসে রইল।
তারপর সে রাত্রে আবার নামল তেমনি ভীষণ বর্ষা। তাঁবুর কাপড় ফুঁড়ে জল পড়ে জিনিসপত্র ভিজে গেল। শঙ্কর তখন কিন্তু এমন হয়ে গিয়েছে যে, তার কোনোদিকে দৃষ্টি নেই। এই ক’মাসে সে আলভারেজকে সত্যিই ভালোবেসে ছিল, তার নির্ভীকতা, তার সংকল্পে অটলতা, তার পরিশ্রম করবার অসাধারণ শক্তি, তার বীরত্ব— শঙ্করকে মুগ্ধ করেছিল। সে আলভারেজকে নিজের পিতার মতো ভালোবাসতো। আলভারেজও তাকে তেমনি স্নেহের চোখেই দেখতো।
কিন্তু এসবের চেয়েও শঙ্করের বেশি মনে হচ্ছে যে, আলভারেজ শেষকালে মারা গেল সেই অজ্ঞাত জানোয়ারটারই হাতে। ঠিক জিম কার্টারের মতোই।
রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে তার মন ভয়ে আকুল হয়ে উঠল। সম্মুখে ভীষণ অজানা মৃত্যুদূত— ঘোর রহস্যময় তার অস্তিত্ব। কখন সে আসবে, কখন বা যাবে, কেউ তার সন্ধান দিতে পারবে না। ঘুমে ঢুলে না পড়ে শঙ্কর মনের বলে জেগে বসে রইল সারা রাত।
ওঃ, সে কি ভীষণ রাত্রি! যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন ও রাত্রির কথা সে ভুলবে না। গাছে গাছে, ডালে ডালে, হাজার ধারায় বৃষ্টি পতনের শব্দ ও একটানা ঝড়ের শব্দ, অরণ্যানীর অন্য সকল নৈশ শব্দ আজ ডুবিয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের উপর বড় গাছ মড় মড় করে ভেঙে পড়ছে। এই ভয়ঙ্কর রাত্রিতে সে একা এই ভীষণ অরণ্যানীর মধ্যে! কালো গাছের গুঁড়িগুলো যেন প্রেতের মতো দেখাচ্ছে, অত বড় ঝড় বৃষ্টিতেও জোনাকির ঝাঁক জ্বলছে। সম্মুখে বন্ধুর মৃতদেহ। ভয় পেলে চলবে না! সাহস আনতেই হবে, নতুবা ভয়েই সে মরে যাবে। সাহস আনবার প্রাণপণ চেষ্টায় সে রাইফেল দুটির দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করলে। একটা উইনচেস্টার, অপরটি ম্যানলিকার— দুটোরই ম্যাগাজিনে টোটা ভর্তি। এমন কোনো শরীরধারী জীব নেই, যে এই দুই শক্তিশালী অতি ভয়ানক মারণাস্ত্রকে উপেক্ষা করে, আজ রাত্রে অক্ষত দেহে তাঁবুতে ঢুকতে পারে।
ভয় ও বিপদ মানুষকে সাহসী করে। শঙ্কর সারারাত সজাগ পাহারা দিল। পরদিন সকালে আলভারেজের মৃতদেহ সে একটা বড় গাছের তলায় সমাধিস্থ করলে এবং দু’খানা গাছের ডাল ক্রুশের আকারে শক্ত লতা দিয়ে বেঁধে সমাধির উপর পুঁতে দিলে।
আলভারেজের কাগজপত্রের মধ্যে ওপর্টো খনি বিদ্যালয়ের একটি ডিপ্লোমা ছিল ওর নামে। তাদের শেষ পরীক্ষায় আলভারেজ সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। ওর কথাবার্তায় অনেক সময়েই শঙ্করের সন্দেহ হত যে, সে নিতান্তই মূর্খ ভাগ্যান্বেষী ভবঘুরে নয়।
লোকালয় থেকে বহুদূরে এই জনহীন গহন অরণ্যে, ক্লান্ত আলভারেজের রত্নানুসন্ধান শেষ হল। তার মতো লোকেরা রত্নের কাঙাল নয়, বিপদের নেশায় পথে পথে ঘুরে বেড়ানোই তাদের জীবনের পরম আনন্দ, কুবেরের ভান্ডারও তাকে এক জায়গায় চিরকাল আটকে রাখতে পারতো না।
দুঃসাহসিক ভবঘুরের উপযুক্ত সমাধি বটে। অরণ্যের বনস্পতিদল ছায়া দেবে সমাধির উপর। সিংহ, গরিলা, হায়েনা সজাগ রাত্রি যাপন করবে, আর সবার উপরে, সবাইকে ছাপিয়ে বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্বতমালা অদূরে দাঁড়িয়ে মেঘলোকে মাথা তুলে খাড়া পাহারা রাখবে চিরযুগ।