নবম পরিচ্ছেদ
চট করে ভালো লাগানোর পথ
নিউইয়র্কের এইটথ অ্যাভিনিউর থারর্টি-থার্ড স্ট্রিটের এক ডাকঘরে একখানা চিঠি রেজিষ্ট্রি করার জন্য আমি লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম রেজিষ্ট্রির কেরানি ওর কাজে বেশ একঘেঁয়েমী বোধ করে চলেছে–সেই একঘেঁয়ে খাম ওজন করা, ডাকটিকিট দেয়া, খুচরো দেয়ানেয়া করা, রসিদ লেখা-সারা বছর ধরে সেই একঘেঁয়ে যাতা পিষে চলা। আমি তাই নিজেকে বললাম আমি লোকটিকে আমায় পছন্দ করাবো। স্বভাবতই আমাকে পছন্দ করার জন্য আমায় ভালো কিছু বলতে হবে। আমার সম্পর্কে অবশ্য নয়, ওর সম্পর্কেই। অতএব আবার নিজেকে প্রশ্ন করলাম : ‘ওর মধ্যে কি আছে যেটার সত্যিকার প্রশংসা করতে পারি?’ এরকম প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অনেক সময়েই কঠিন। বিশেষ করে : অচেনা মানুষ সম্পর্কে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা সহজেই হবে। আমি ঠিক তখনই এমন কিছু দেখলাম যাতে আমার প্রশংসা বাধ মানল না।
তাই সে যখন আমার খামখানা ওজন করছিল তখন বেশ সাগ্রহে মন্তব্য করলাম : ‘আহা, আপনার মতো আমার যদি চুল থাকতো।‘
লোকটি হাসিমুখে বেশ একটু চমকেই মুখ তুলল। নাঃ, আগের মতো তো এখন আর নেই–সলজ্জ ভঙ্গীতে সে জানালো। আমি জবাবে বললাম, ‘তা হলেও আগেকার জৌলুস হারিয়ে এখনও চমৎকার আছে।’ লোকটি অসম্ভব খুশি হলো। সে আমার সঙ্গে বাকি সময় বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললো। শেষ যে কথাটা সে আমায় বললো তা হলো : ‘বহু লোকেই আমার চুলের প্রশংসা করেছে।’
আমি বাজি রাখতে পারি লোকটি প্রায় হাওয়ায় ভাসতে ভাসতেই সেদিন মধ্যাহ্ন ভোজ সারতে যায়। আরও বাজি ধরতে পারি সে সেদিন রাতে বাড়ি গিয়ে ওর স্ত্রীকে ব্যাপারটা বলেছে। তারপর নিশ্চয়ই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে : সত্যিই আমার চুল বড় সুন্দর।
এই গল্পটা একবার আমি অনেকের সামনেই বলেছিলাম, আর একজন আমায় পরে প্রশ্ন করেছিল; আপনি ওর কাছ থেকে কি চাইছিলেন?
আমি ওর কাছে কি চাইছিলাম। ভাবুন একবার!
আমরা এরকম স্বার্থপর হয়ে উঠেছি যে সামান্য খুশির ভাব ছড়িয়ে কাউকে কিছু নিঃস্বার্থ প্রশংসাও করতে পারবো না? সব সময়েই আমাদের একাজে উদ্দেশ্য হবে কারও কাছ থেকে পরিবর্তে কিছু পাওয়ার আকাঙক্ষা? আমাদের মন যদি এই রকম নীচতা আর ক্ষুদ্রতা ভরা হয় তাহলে আমাদের সব কাজে ব্যর্থতাই শুধু প্রাপ্য।
হ্যাঁ, লোকটির কাছ থেকে আমি কিছু আদায় করতে চাইছিলাম। দাম দেওয়া যায় না এমন কিছুই আমি চাইছিলাম, আর তা পেয়েও ছিলাম। আমার এটাই লাভ হয়েছিল যে আমি আমার জন্য কিছু না চেয়েও একটা চমৎকার মানসিক আনন্দ লাভ করি। এরকম মানসিক অনুভূতি উজ্জ্বল আনন্দময় হয়ে মানুষের স্মৃতিতে ঘটনার পরেও জ্বলজ্বল করে।
মানুষের ব্যবহারের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আইন আছে। আমরা সেই আইন মেনে চললে, আমরা বলতে গেলে জীবনে কোনদিনই ঝামেলায় পড়বো না। আসলে এই আইন মেনে চললে তার বদলে পেয়ে যাবো অসংখ্য বন্ধু আর অনাবিল সুখ। কিন্তু যে মুহূর্তে আমরা এ আইন ভঙ্গ করবো তখনই আমরা সীমাহীন ঝামেলায় পড়ে যাব। আইনটা হলো এই রকম : ‘সব সময়েই অপর ব্যক্তিটিকে শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করতে সুযোগ দিন।‘ আগেই বলেছি প্রফেসর জন ডিউই বলেছেন যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ভাবা মানুষের একটা চিরন্তন আকাঙক্ষা। প্রফেসর উইলিয়া জেমস বলেন : ‘মানব চরিত্রের গভীরতম নীতি হলে প্রশংসিত হওয়ার আশা।’ আগেই যেমন বলেছি এই আকাঙক্ষাই আমাদের অন্যান্য সব প্রাণীদের সঙ্গে তফাৎ বুঝিয়ে দেয়। এই আকাঙক্ষাই আসলে সভ্যতা সৃষ্টির মূল।
দার্শনিকরা হাজার হাজার বছর ধরেই মানবিক সম্পর্ক নিয়ে নানা চিন্তা ভাবনা করে আসছেন। আর ওই সব চিন্তা ভাবনার মধ্য থেকে যে ফসল মিলেছে তা হলো একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটা নতুন কিছু নয়–এ ইতিহাসের মতই পুরনো। জরথুষ্ট্র তিন হাজার বছর আগে তাঁর সব অগ্নি-উপাসক অনুগামীকে শিক্ষা দেন। কনফুসিয়াস চীনদেশে এটা শিখিয়েছেন ২৪০০ বছর আগে। লাওৎসে, তাও ধর্মের উদগাতা যিনি, সেটা শিখিয়েছিরেন হান উপত্যকায় তাঁর শিষ্যদের। বুদ্ধদেব এটা শিখিয়েছিলেন খ্রষ্টের জন্মের পাঁচশ বছর আগে পবিত্র গঙ্গার তীরে বসে। হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি তারও হাজার বছর আগে এটা শিখিয়েছিল। যীশু একটা মাত্র বাক্যেই এটা প্রকাশ করেছিলেন আর এটাই হয়তো সারা বিশ্বে সবচেয়ে দামী কোন নীতি : ‘অন্যের প্রতি সেই ব্যবহারই কর অন্যের কাছ থেকে যা আশা কর।’
আপনি যাদের সংস্পর্শে আসেন তাদের সমর্থন আশা করেন। আপনি চান, আপনার প্রকৃত মূল্যায়ন। আপনি চান, আপনার ছোট্ট দুনিয়ায় নিজের গুরুত্ব। আপনি কখনই সস্তাদরের ফাঁপা তোষামোদ চান না, বরং চান সত্যিকার প্রশংসা আপনি আশা করেন, আপনার বন্ধুবান্ধবী আর সহকর্মীরা চার্লস্ শোয়াব যেমন বলে গেছেন সেই রকম হবে। তিনি যা বলেছেন : তারা দেবে হৃদয়ের স্বীকৃতি আর কমবে সত্যিকার প্রশংসা। আমরা সবাই তাই চাই।
.
অতএব আসুন আমরা সোনার অক্ষরে লেখা নীতিটাই বরং মেনে চলি। আর অন্যদের সেই জিনিসই দিই যা তাদের কাছ থেকে আমরা আশা করি।
কিন্তু কেমন করে? কখন আর কোথায়? এর উত্তর হলো সব সময়েই আর সব জায়গাতেই।
যেমন উদাহরণ হিসেবে রেডিও সিটির খবর সরবরাহকারী কেরানীর কাছে আমি একবার হেনরি শুভেইন অফিসের নম্বরটা চেয়েছিলাম। পরিচ্ছন্ন আর চমৎকার পোশাক পরিহিত লোকটি যেভাবে জবাব দিল তাতে মনে হলো সে খবরটা জানিয়ে বেশ গর্ব বোধ করছিল। বেশ পরিষ্কারভাবে সে জানাল : ‘হেনরি শুভেইন। (বিরতি) উনিশতল, ঘরের নম্বর ১৮১৬।
আমি এলিভেটরের দিকে ছুটে গিয়েই থমকে দাঁড়ালাম, তারপর আবার ফিরে এসে বললাম, ‘আপনি যেভাবে সব জানালেন তার জন্য আপনাকে অভিনন্দন জানাতে চাই। আপনি বেশ সুন্দর, পরিষ্কার করে উত্তর দিয়েছেন। আপনি ঠিক কোন শিল্পীর মতই কাজ করেছেন। ভারি চমৎকার।’
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে কেরানীটি জানালো কেন কথার ফাঁকে ফাঁকে সে একটু বিরতি দিয়েছে। কেরানীটি আমার প্রশংসায় সত্যিই খুব গর্বিত বোধ করতে শুরু করেছিল। উনিশতলায় যাওয়ার অবসরে আমার এই ভেবেই বেশ আনন্দ হল যে, অন্ততঃ ওইদিন বিকেলে একজনের মনে মানুষের আকাঙিক্ষত সুখের পরশ জাগাতে পেরেছি।
প্রশংসা করার দর্শন সম্বন্ধে আলোক লাভ করার জন্য আপনাকে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত বা কোনো চেয়ারম্যান হয়ে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি প্রতিদিনই এই ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে পারে না।
যেমন ধরুন, আপনি খাবারের আদেশ দিলেন পরিবেশনকারিণীকে। সে ভুল কিছু আনলে যদি বলেন, তোমায় কষ্ট দিচ্ছি বলে দুঃখিত, আমি আসলে চেয়েছি অন্য জিনিস। সে এটা ভয়ে নিশ্চিয়ই বলবে, না, না, কষ্ট কি। আসলে সে আনন্দের সঙ্গে কাজটা সংশোধন করে নেবে যেহেতু আপনি তাকে সম্মান দিয়েছেন।
‘আমি আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি বলে দুঃখিত’, ‘দয়া করে কি’—’ধন্যবাদ, যদি-’ এই ধরনের ছোটখাটো কথাতে প্রতিদিনের একঘেঁয়েমি জড়ানো জীবন অনেকটা সহ্য করার অবস্থায় এনে তাকে মোলায়েম করে তোলে। তাছাড়াও এই রকম সম্মান দেখানো কথাতেই ফুটে ওঠে বংশ মর্যাদা আর প্রকৃতি শিক্ষার ভাব। আর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আপনি কি ‘হল কেইনের লেখা উপন্যাস কখনও পড়ে দেখেছেন? যেমন ধরুন, ‘দি ক্রিশ্চিয়ান’, ‘দি ডিমষ্টার’, ‘দি ম্যাক্সিমাম’? একলক্ষ মানুষ তার উপন্যাস পাঠ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন কর্মকারের সন্তান। সারা জীবনে তিনি আট বছরের বেশি স্কুলে শিক্ষা নিতে পারেন নি, তাসত্ত্বেও তিনি যখন মারা গেলেন তখন তিনি ছিলেন পৃথিবীতে যত অর্থবান সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে প্রথম সারির।
তার কাহিনীটা হলো এই রকম : হল কেইন সনেট আর বীরগাথা ভালো বাসতেন। আর তাই তিনি দান্তে, গ্যাব্রিয়েল, রসেটির সব কবিতা একেবারে গোগ্রাসেই গিলে ফেলেন। এ ছাড়াও তিনি রসেটির শিল্পমণ্ডিত রচনার অকুণ্ঠ প্রশংসা করে একটা বক্তৃতা বানিয়ে ফেলেন–আর স্বয়ং রসেটিকেই একটা কপি পাঠিয়ে দেন। রসেটি সেটা পেয়ে দারুণ খুশি হন। রসেটি হয়তো স্বগতোক্তি করেছিলেন : ‘যে তরুণ আমার রচনা সম্পর্কে এ রকম উঁচু ধারণা পোষণ করে সে নিঃসন্দেহে দারুণ কিছু। তাই রসেটি ওই কামারের ছেলেকে লণ্ডনে এসে তার সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানালেন। এটাই হল কেইনের জীবনের মোড় ঘোরার প্রথম অংশ। এই ভাবেই তিনি সে কালের শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীদের সংস্পর্শে এলেন। তাঁদের পরামর্শ আর উৎসাহে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি এমন এক জীবনে প্রবেশ করলেন যে জীবনকে তিনি আলোক উদ্ভাসিত করে তুললেন–সারা আকাশে বাতাসে তা ছড়িয়ে গেল। তাঁর বাড়ি আইল অব ম্যানের গ্রীবা ক্যাসল সারা বিশ্বের ভ্রমণ বিলাসীদের কাছে হয়ে উঠেছিল একেবারে মক্কার মতো। এছাড় তিনি রেখে গেলেন কয়েক কোটিরও বেশি টাকার সম্পত্তি। তা সত্ত্বেও-কে বলতে পারে–তিনি হয়তো গরীবের মতই মারা যেতেন অনামা হয়ে, শুধু যদি না তিনি একজন খ্যাতনামা মানুষকে প্রশংসা করে একটা প্রবন্ধ না লিখতেন।
হৃদয় থেকে করা আন্তরিক প্রশংসার শক্তিই এই অফুরন্ত সে শক্তি।
রসেটি নিজেকে বড় মানুষ বলেই ভাবতেন। তাতে অবাক হবার কিছু নেই। প্রায় সব মানুষই নিজেকে খুব বড় বলে ভেবে থাকে।
আর ঠিক সেই রকমই ভাবে প্রতিটি জাতিই।
.
আপনি কি ভাবেন জাপানিদের চেয়ে আপনি শ্রেষ্ঠ? আসল সত্য হলো জাপানীরা আবার আপনাদের চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে ভাবে। কোন রক্ষণশীল জাপানি কোন সাদা চামড়ার মানুষকে জাপানি মহিলার সঙ্গে নাচতে দেখলে ক্ষেপে আগুন হয়ে যায়।
আপনারা কি নিজেদের ভারতের হিন্দুদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন? অথচ হিন্দুরা নিজেদের আপনার চেয়ে ঢের বেশি শ্রেষ্ঠ বলেই ভাবে। আপনি কি নিজেদের এক্সিমোর চেয়ে সেরা বলে ভাবেন? এটা অবশ্যই, আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা ছাড়া আর কিছু না। তবে এক্সিমোরা আপনাদের সম্পর্কে কি রকম ভাবে একটু জানতে চান? এক্সিমোর মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা ভারি অলস, তারা কাজকর্ম করতেই চায় না। এক্সিমোরা তাদের বলে সাদা চামড়ার মানুষ’-এর কারণ হলো এটাই তাদের ঘৃণার চরম প্রকাশ।
যে কোন জাতিই অন্য জাতির চেয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে ভাবে। আর এর থেকেই জন্ম নেয় দেশপ্রেম–আর যুদ্ধ।
খোলাখুলি সত্য কথাটা হলো, যে কোন মানুষের সঙ্গেই আপনার দেখা হোক না কেন সে নিজেকে আপনার চেয়ে যে কোন দিক থেকেই তোক শ্রেষ্ঠ বলে ভাবে। তার হৃদয়ে প্রবেশাধিকার করার নিশ্চিত উপায় হলো, যে কোন রকমেই তাকে জানিয়ে দেওয়া এই ছোট্ট পৃথিবীতে তার গুরুত্ব সম্বন্ধে আপনি ওয়াকিবহাল, আর এ কাজটা করবেন আন্তরিক ভাবেই।
এমার্সন কি বলেছেন একটু স্মরণ রাখবেন : যে কোন মানুষের সঙ্গেই আমার দেখা হোক, আমি জানি কোন না কোন বিষয়ে সে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
আর এর ভিতরে সবচেয়ে দুঃখজনক অবস্থা হলো যাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের কণামাত্র সত্যিই নেই তারা নিজেদের অসামার্থ ঢাকতে গলাবাজী করে লোক ঠকাতে চেষ্টা করে। ব্যাপারটা সত্যি সত্যিই কদর্যতায় ভরা।
শেক্সপিয়ার এ সম্পর্কে বলেছিলেন : ‘মানুষ! গর্বিত মানুষ! সামান্য অধিকারের সাজে সজ্জিত হয়ে সে এমন সব অদ্ভুত কাজ করে যাতে স্বর্গের দেবদূতরাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।‘
.
আমি এবার জানাতে চাই আমার নিজের পাঠক্রমের ছাত্র কিছু ব্যবসায়ী মানুষ এই নীতিগুলো কাজে লাগিয়ে কি অভুতপূর্ব ফল লাভ করেছেন। প্রথমেই ধরা যাক কানেকটিকাটের সেই অ্যাটনীর কথাটাই। তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজনের জন্যেই নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
আমার পাঠক্রমে যোগ দেবার ঠিক পরে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ভদ্রলোক, (যাকে আমরা মিঃ ‘আর’ বলে ডাকবো) কিছু আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে লং আইল্যাণ্ড যাত্রা করেন। তাঁর স্ত্রী এরপর গেলেন তার এক বৃদ্ধা পিসীর সঙ্গে কথা বলতে, তারপর সেখান থেকে অন্যান্য ছোট বয়সের আত্মীয়দের দেখতে। মিঃ আর’কে যেহেতু প্রশংসা করার ব্যাপারটা কাজে লাগিয়ে দেখতে হবে সেই জন্যেই তিনি ঠিক করলেন ওই বৃদ্ধাকে দিয়েই শুরু করবেন। সেই জন্য বাড়ির চারদিকে তিনি তাকিয়ে দেখার চেষ্টা
করতে লাগলেন কি দিয়ে প্রশংসা শুরু করা যায়।
তিনি জানতে চাইলেন, ‘এ বাড়িটা ১৮৯০ সালে বানানো হয়েছিল, তাই না?’
‘হ্যাঁ’, বৃদ্ধা জবাব দিলেন ‘ঠিক ওই বছরেই তৈরি হয়।‘
‘এটা দেখেই যে বাড়িতে আমার জন্ম হয় তার কথা মনে পড়ছে’, মিঃ আর বললেন, ‘ভারি চমৎকার বাড়িটা। কি সুন্দর করে বানানো। কত ঘর। জানেন তো, আজকাল আর কেউ এরকম করে বানাতে চায় না।’
তুমি ঠিক বলেছো, বৃদ্ধা বললেন, ‘আজকালকার ছেলেবয়সীরা আর সুন্দর করে বাড়ি বানাতে চায় না। তারা চায় শুধু ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্ট, ইলেকট্রিক বরফের বাক্স, তারপর কেবল তাদের মোটর গাড়ি চড়ে হাওয়া খেয়ে বেড়াতে।’
একটু থামলেন বৃদ্ধা।
‘এ বাড়িটা স্বপ্নের বাড়ি, তারপর আবার বলে চললেন আগের স্মৃতি আর সুখস্বপ্ন রোমন্থন করতে করতে। এ বাড়ি তৈরি হয়েছিল ভালোবাসা দিয়ে। আমার স্বামী আর আমি এটা তৈরি করার অনেক আগে থেকেই স্বপ্ন দেখেছি। আমাদের কোন সম্পত্তি ছিল না। সব পরিকল্পনাই আমরা নিজেরা করি।’
বৃদ্ধা এরপর তাকে সারা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। বৃদ্ধ সারাজীবন ধরে নানা দেশ বেড়িয়ে যেসব জিনসপত্র এনে সাজিয়েছেন, সব কিছুরই মি, আর অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে লাগলেন। চমৎকার কাজ করা শাল, পুরনো আমলের চায়ের সরঞ্জাম, চীনামটির পাত্র ফ্রেঞ্চ বিছানা আর চেয়ার, ইতালীয় তেলরঙা ছবি, আর রেশমী পর্দা, যেটা কোনকালে ফরাসি দুর্গে শোভা পেত।
আমাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখানোর পর মি. আর বলেছিলেন, বৃদ্ধা আমায় নিয়ে গেলেন একটা গ্যারেজে। সেখানে যত্ন করে রাখা ছিল একটা প্যাকার্ড গাড়ি প্রায় নতুন।
‘আমার স্বামী মারা যাওয়ার অল্পদিন আগেই গাড়িটা কিনেছিলেন’, নরম গলায় বললেন বৃদ্ধা। তাঁর মৃত্যুর পর আমি আর গাড়িটায় চড়িনি … তুমি ভালো জিনিসের কদর বোঝ, তাই তোমাকেই আমি গাড়িটা উপহার দেব।’
‘সেকি পিসীমা’, মিঃ আর বললেন, একি বলছেন। আপনার এ সদাশয়তা সত্যিই চমৎকার। কিন্তু আমি তো তা নিতে পারবো না। আমি তো আপনার কোন আত্মীয়ই নই, তাছাড়া আমার একটা গাড়ি আছে। আপনার কত আত্মীয় আছে তারা গাড়িটা পেলে খুশি হবে।
‘আত্মীয়। বৃদ্ধা বলে উঠলেন। হ্যাঁ, আমার অনেক আত্মীয় আছে, তারা চাইছে আমি মরলে তারা গাড়িটা পাবে। কিন্তু না, তারা গাড়িটা পাচ্ছে না।
কাউকে যদি গাড়িটা না দিতে চান তাহলে যারা পুরনো গাড়ি কেনাবেচা করে তাদের কাছে বিক্রি করতে পারেন,’ মিঃ আর বললেন।
বিক্রি করব! বৃদ্ধা চেঁচিয়ে উঠলেন, তুমি কী করে ভাবলে এ গাড়ি আমি বিক্রি করবো? তুমি কি ভাবছ যে গাড়ি আমার স্বামী আমার জন্য কিনেছিলেন তাতে অচেনা মানুষরা চড়বে সেটা আমি সহ্য করবো? আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না এ গাড়ি বিক্রি করব। আমি এটা তোমাকেই দেব। কারণ তুমি ভালো জিনিসের প্রশংসা কর!
মিঃ আর নানাভাবে উপহারটা না নেবার চেষ্টা করলেন কিন্তু বৃদ্ধার মনে আঘাত লাগবে বলেই তা পারলেন না।
এই বৃদ্ধা বিরাট একটা বাড়িতে তার দামী জিনিসপত্র সেই শাল, ফরাসী ছবি, চায়ের সরঞ্জাম সব কিছু নিয়ে শুধু একটু মর্যাদা আর মমত্ববোধই চেয়েছিলেন। একদিন অতি সুন্দরী আর সবার প্রিয় এক যুবতীই তিনি ছিলেন। একদিন ভালোবাসা দিয়ে একটা বাড়ি তৈরি করে সারা ইউরোপ ঘুরে জিনিস এনে তা সাজিয়েও ছিলেন সুন্দর করে তোলার জন্যেই। আর আজ বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গতায় তিনি কেবল চাইছিলেন একটু মানব হৃদয়ের উষ্ণতা আর সামান্য প্রশংসা–কিন্তু তা কেউ তাকে দেয়নি। তাই সেটা যখন পেলেন তা হয়ে উঠলো মরুভূমির বুকে ঝরণার মতো–তার কৃতজ্ঞতা তাই ওই প্যাকার্ড গাড়িখানা উপহার দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না।
আর একটা উদাহরণ দিই। কাহিনীটি বলেছেন নিউইয়র্কের লুইস অ্যাণ্ড ভালেন্টাইনের প্রাকৃতিক দৃশ্যের শিল্পী ডোনাল্ড এম. ম্যাকমোহন।
তাঁর কথাতেই এবার শোনা যায় : ‘বন্ধুত্বলাভ ও প্রভাব বিস্তার’ সম্পর্কে বেতার কথিকাটি শোনার ঠিক পরেই আমি একজন বিখ্যাত অ্যাটনীর এস্টেটের ল্যাণ্ডস্কেপ আঁকছিলাম। বাড়ির মালিক এক সময় এসে আমায় একটু উপদেশ দিলেন–কোথায় একগুচ্ছ রডোড্রেনডন ফুলগাছ লাগাবেন।
আমি বললাম, ‘জজ সাহেব, আপনার ভারি চমৎকার শখ আছে তো। আপনাদের সুন্দর ওই কুকুরগুলো চমৎকার। আমার ধারণা ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে কুকুর প্রদর্শনীতে আপনি প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন।’
‘হ্যাঁ,’ জজসাহেব বললেন, ‘কুকুরদের নিয়ে আমার খুব আনন্দ। আমার কুকুরের ঘর দেখবেন?’
এরপর তিনি এক ঘন্টা ধরে তার কুকুর আর সব পুরস্কারগুলো আমায় দেখালেন। তাছাড়া কুকুরের বংশপরিচয়ও আমাকে দিলেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘আপনার কোন ছোট ছেলে আছে?’
হ্যাঁ’, আছে,’ আমি জবাব দিলাম।
জজসাহেব এবার জানতে চাইলেন। ‘একটা কুকুরছানা তার ভালো লাগবে না?’
‘ওহ্ হ্যাঁ, সে প্রায় আনন্দে লাল হয়ে যাবে।‘
‘ঠিক আছে, তাকে একটা কুকুরছানা উপহার দিচ্ছি,’ জজসাহেব বললেন।
এরপর তিনি আমায় বুঝিয়ে দিলেন কেমন করে কুকুরছানাটাকে খাওয়াতে হয়। তারপর নিজেই একটু থেমে জানালেন, মুখে বললে আমি ভুলে যাবো তাই কাগজে তিনি সব লিখে দেবেন। জজ সাহেব তখন ঘরে গিয়ে কুকুরছানার বিষয়ে সমস্ত কিছু লিখে দিলেন, এমনি কি তার বংশ পরিচয় পর্যন্ত। তিনি তাঁর একঘন্টা পনেরো মিনিট মূল্যবান সময় নষ্ট করে প্রায় একশ ডলার দামের কুকুরছানাটাও সঙ্গে দিলেন। এর কারণ আর কিছুই না, আমি শুধু তার শখ সম্বন্ধে আমার আন্তরিক প্রশংসা জানিয়ে ছিলাম বলেই।
.
কোডাকের বিখ্যাত জর্জ ইস্টম্যান যিনি ফিল্ম আবিষ্কার করেন আর যার ফলে চলচ্চিত্র তৈরিও সম্ভবপর হয়। জীবনে প্রায় একশ কোটি ডলার আয় করেছিলেন আর পৃথিবীর একজন খ্যাতনামা ব্যবসায়ী বলেও নাম কেনেন। অথচ এই ধরনের দারুণ নাম করা সত্ত্বেও তিনি আমার বা আপনার মতো সামান্য একটু প্রশংসার কাঙাল ছিলেন।
বেশ কয়েকবছর আগে ইস্টম্যান তাঁর মায়ের স্মৃতিরক্ষার জন্য রেচেষ্টারে স্কুল অব মিউজিক আর কিলবোর্ন হল নামে একটি নাট্যমঞ্চ তৈরী করেছিলেন। ওই সময় নিউইয়র্কের সুপিরিয়র সীটিং কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট জেমস অ্যাডামসন ওই বাড়িগুলোর জন্য থিয়েটারের চেয়ার সরবরাহ করার অর্ডারটা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। ইস্টম্যানের স্থপতিকে ফোন করে তিনি মিঃ ইস্টম্যানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলেন।
অ্যাডামসন শুধু এইটুকুই চাইছিলেন।
তাকে যখন ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো তিনি দেখলেন মিঃ ইস্টম্যান তাঁর ডেক্সের সামনে কিছু কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে দেখছেন। একটু পরেই মুখ তুললেন মিঃ ইস্টম্যান তারপর চশমা খুলে স্থপতি আর মিঃ অ্যাডমসনের দিকে এগিয়ে এলেন।
সুপ্রভাত, ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের জন্য কি করতে পারি? তিনি বললেন।
স্থপতি তার পরিচয় দিতেই মি. অ্যাডামসন বললেন : ‘আপনার জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে আপনার চমৎকার অফিসের তারিফ করছিলাম। সুযোগ পেলে এরকম একটা ঘরে কাজ করতে পারলে খুব ভালো লাগতো। আপনি বোধ হয় শুনে থাকবেন আমি বাড়ি সাজানোর কাজ করি। জীবনে এতো সুন্দর সাজানো অফিস আমি কখনও দেখিনি।’
জর্জ ইস্টম্যান জবাবে বললেন : আপনি এমন কিছু মনে করিয়ে দিলেন যে কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। এটা সুন্দর বলেছেন, তাই না? এটা যখন প্রথম বানানো হয় তখন সত্যিই এটা উপভোগ করতাম। কিন্তু আজকাল এত রকম কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় যে কয়েক সপ্তাহ ধরেই হয়তো ঘরটার দিকে তাকানোই হয়ে ওঠে না।
অ্যাডামসন এগিয়ে গিয়ে একটা প্যানেলে হাত রাখলেন। এটা ইংলিশ ওক কাঠে বানানো তাই না? ইতালীয় ওকের চেয়ে এর খাজগুলো আলাদা।
‘হ্যাঁ, ইস্টম্যান জবাব দিলেন। এটা ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা ওক। কাঠের বিষয়ে অভিজ্ঞ আমার একজন বন্ধুই এটা বেছে দিয়ে ছিলেন।
এরপর ইস্টম্যান অ্যাডামসনকে ঘরে ঘুরতে ঘুরতে নানা জিনিসপত্র, রঙ, হাতের কাজ ইত্যাদি দেখাতে লাগলেন যেগুলো তাঁরই ইচ্ছেমত বানানো হয়।
ঘরটায় ঘুরতে ঘুরতে তারা একটা জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন। জর্জ ইস্টম্যান এবার খুব আস্তে আস্তে তার স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে তাঁর কিছু জনদরদী কাজের নমুনা দিচ্ছিলেন। এসবের মধ্যে ছিল রচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়, জেনারেল হাসপাতাল, ফ্রেণ্ডলি হোম, শিশু হাসপাতাল ইত্যাদি। মিঃ অ্যাডামসন তাঁকে আন্তরিকভাবেই তাঁর মানবদরদী কাজে অর্থব্যয় করার জন্যে অভিনন্দন জানালেন। একটু পরেই জর্জ ইস্টম্যান একটা কাঁচের বাক্স খুলে একটা ক্যামেরা বের করলেন, একজন ইংরেজের কাছ থেকে কেনা এই ক্যামেরাটি তিনি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন।
.
অ্যাডামসন এরপর জর্জ ইস্টম্যানকে তাঁর ছেলে বেলার কথা, কি করে তিনি ব্যবসা আরম্ভ করেন সব জিজ্ঞাসা করতেই মি. ইস্টম্যান আন্তরিকভাবে তাঁর ছেলেবেলার দারিদ্র্যময় জীবনের কাহিনী শোনালেন। তিনি জানালেন কিভাবে তার বিধবা মা একটা বোর্ডিং হাউস চালাতেন আর তিনি রোজ মাত্র পঞ্চাশ সেন্ট মাইনেয় একটা বীমা কোম্পানির কেরানির কাজ করতেন। দারিদ্রের ভয়ঙ্কর দিনরাত তাড়া করে চলত, তাই তিনি শপথ করেছিলেন জীবনে অনেক টাকা করবেন যাতে মাকে কখনও বোর্ডিং হাউসের কাজ করে মৃত্যুর দিকে যেতে না হয়। মি. অ্যাডাম আরও প্রশ্ন করে অনেক কিছু আগ্রহ নিয়ে শুনে গেলেন-মিঃ ইস্টম্যান আরও বললেন শুকনো ফটোগ্রাফির প্লেট নিয়ে তিনি কিভাবে কাজ করেছেন। তিনি শোনালেন কিভাবে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে যান; কখনও সারারাত ধরে। কাজের ফাঁকে কখনও বা একটু ঘুমিয়ে নিতেন। একই পোশাক একটু ঘুমিয়ে কখনও বা টানা বাহাত্তর ঘন্টাও কাজ করেছিলেন তিনি।
জেমস অ্যাডামসন জর্জ ইস্টম্যানের ঘরে ঢোকেন দশটা পনেরোয়, তাঁকে জানানো হয়েছিল মাত্র ৫ মিনিটের বেশি সময় পাওয়া যাবে না। কিন্তু এক ঘন্টা কেটে গেল, দুঘন্টাও গেল তারা তখনও কথা বলে যাচ্ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত জর্জ ইস্টম্যান অ্যাডামসনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শেষবার যখন জাপানে যাই কয়েকটা চেয়ার কিনে বাড়ি নিয়ে আসি। সেগুলো বারান্দায় রেখেছি। কিন্তু রোদ্দুরে লেগে রঙ চটে যাওয়ায় আমি রঙ কিনে নিজেই এগুলো রঙ করেছি। আমি কেমন চেয়ার রঙ করতে পারি একবার দেখবেন নাকি? ঠিক আছে, চলুন বাড়ি গিয়ে আমার সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজ সারবেন তারপর আপনাকে দেখাবো।’
মধ্যাহ্ন ভোজের পর মি. ইস্টম্যান অ্যাডামসনকে তার জাপান থেকে আনা চেয়ার দেখালেন। চেয়ারগুলোর দাম দেড় ডলারের বেশি নয়। কিন্তু জর্জ ইস্টম্যান যিনি ব্যবসাতে একশ কোটি টাকা করেছেন, চেয়ারগুলো নিজেই রঙ করেছেন বলে গর্ববোধ করতেন।
চেয়ারগুলোর জন্য যে অর্ডার দেবার কথা তার মোট দাম প্রায় ৯০,০০০ ডলার ছিল। অর্ডারটা কে পেয়েছিল বলে আপনার ধারণা-জেমস অ্যাডামসন না তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান?
এরপর থেকে মি, ইস্টম্যানের মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর জেমস অ্যাডমসন ঘনিষ্ট বন্ধু হয়েই ছিলেন।
এবার বলুন দেখি আপনি বা আমি এই প্রশংসা করার ইন্দ্রজাল স্পর্শ কোথা থেকে শুরু করবো? নিজের বাড়িতেই শুরু করুন না কেন? অন্ততঃ আর কোন জায়গার কথা আমার জানা নেই যেখানে এর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি বা যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি অবহেলা করা হয়। আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই কিছু ভালো গুণ আছে–অন্ততঃ সেটা নিশ্চয়ই ভাবতেন, না হলে তাকে বিয়ে করতেন না। কিন্তু কতদিন আগে তার আকর্ষণ সম্পর্কে তারিফ জানিয়েছেন আপনি? কতদিন আগে মনে আছে? বলুন কতদিন হলো?
কয়েক বছর আগে নিউ ব্রানসউইকের মিরামিচির কোন জলাশয়ে মাছ ধরছিলাম। আমি এজন্য কানাডীয় অরণ্য এলাকায় একটা নির্জন তাবুতেই থেকে যাই। পড়বার মতো পেতাম কেবল গ্রামের কোন খবরের কাগজ। কাগজের সবই আমি পড়ে ফেলতাম মায় বিজ্ঞাপন পর্যন্ত আর ডরোথি ডিক্সের একটা প্রবন্ধও। তাঁর প্রবন্ধটা এতই সুন্দর ছিল যে সেটা কেটে রেখে দিই। তার কথা হলো কনেকে দেয়া বক্তৃতা শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর উপদেশ হলো বরকে একপাশে টেনে নিয়ে তাকে এই উপদেশটা কারও দেওয়া উচিত :
‘প্রেয়সীকে চুমু দেবার আগে কখনও বিয়ে করবেন না। বিয়ের আগে কোন মেয়েকে প্রশংসা করা তো স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু বিয়ের পরে সেটা করা হলো বিশেষ প্রয়োজন-আর আপনার পক্ষে নিরাপত্তারও কারণ বটে। বিয়েতে স্পষ্ট কথার স্থান নেই। এটা হলো কূটনীতির জায়গা।‘
আপনি যদি প্রতিদিনের বিবাহিত জীবন সুখে শান্তিতে কাটাতে চান তাহলে কোন ভাবেই আপনার স্ত্রীর ঘরকন্নার কাজে মাথা গলাবেন না বা তার কাজের সঙ্গে আপনার মায়ের কাজের তুলনা করবেন না। বরং অন্যদিকে, বারবার তার ঘরকন্নার কাজের প্রশংসা করবেন আর খোলাখুলি বার বার তার মতো একজনকে বিয়ে করেছেন বলে নিজেকে ধন্যবাদ দেবেন। বলবেন তার মধ্যে পেয়েছেন ভেনাস আর মিনার্ভার রূপ। মাংস যদি শক্ত হয়ে যায় বা রুটি যদি পুড়ে যায় একদম অভিযোগ করবেন না। বরং বলবেন আজকের রান্নাটা তার রোজের মতো হয়নি। আর তাতেই আপনার স্ত্রী আবার সযতে সব কিছু করার ব্যবস্থা করবেন।
এমন ব্যবহার কিন্তু আচমকা করতে চাইবেন না–তাহলে তার সন্দেহ হতে পারে। যেমন ধরুন আজ বা আগামী কাল রাত্তিরে আপনার স্ত্রীর জন্য একগুচ্ছ ফুল বা কিছু মিষ্টি নিয়ে এলেন। তবে শুধু বলবেন না ‘হ্যাঁ এটা আমার আগেই করা উচিত ছিল। বরং মুখে কিছু হাসি ছড়িয়েই ঘরে ঢুকবেন। সঙ্গে বলবেন প্রেমময় দুটো চারটে কথাও। আরও বেশি সংখ্যায় যদি স্বামী স্ত্রী একাজ করতো তাহলে বোধ হয় আমাদের দেশে ছটা বিয়ের মধ্যে একটা বিবাহ বিচ্ছেদও আর হতো না।
.
কোন মেয়েকে আপনার প্রেমে পড়ানোর জন্যে কি করতে হবে শুনবেন? বেশ তবে সেই গোপন রহস্যটা বলে দিই শুনুন। এটায় কাজ হবেই, তবে কৌশলটা আমার নয়। আমি এটা ধার করেছি ডরোথি ডিক্সের কাছ থেকে। তিনি একবার বিয়ে পাগলা একজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। লোকটা অন্ততঃ তেইশ বার সুন্দরীদের হৃদয় আর তাদের ব্যাঙ্ক তহবিল জয় করেছিল (তবে একটা কথা আড়ালে জানাই লোকটার সঙ্গে ডরোথি ডিক্সের দেখা হয় জেলখানায়)। ডরোথি ডিক্স তার কাছে ঐ প্রেমে পড়ার কৌশলের কথা জানতে চেয়েছিলেন। সে জবাব দেয় এতে রহস্য কিছুই নেই : আপনাকে যা করতে হবে তা হলো মেয়েটির সম্বন্ধে অনর্গল শুধু কথা বলে যান, ব্যস তাতেই কাজ হবে।
পুরুষদের সম্পর্কেও একই কৌশল খাটে। ডিসরেলী একবার বলেন : যে কোন পুরুষের সঙ্গে তার নিজের বিষয়েই বলুন, দেখতে পাবেন সে ঘন্টার পর ঘন্টা শুনে যাবে। ডিসরেলী ছিলেন অতি ধুরন্ধর মানুষ। তার মতো কেউ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চালাতে পারেনি।
অতএব মানুষ আপনাকে পছন্দ করুক তাই যদি চান তাহলে এই নিয়মটা মেনে চলুন : অপর ব্যক্তিকে শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করার সুযোগ দিন–আন্তরিকভাবে সেটা করবেন।
এ বইটা আপনারা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই তো পড়ে চলেছেন। বইটা এবার বন্ধ রেখে পাইপের তামাক ঝেড়ে ফেলে কাছাকাছি মানুষটির উপর ওই তত্ত্বটা একটু কাজে লাগান দেখি–সঙ্গে সঙ্গে এর যাদুকরী ক্ষমতাটাও লক্ষ করতে ভুলবেন যেন।
অল্প কথায় নিজেকে অপরের কাছে পছন্দসই করে তোলার উপায় :
১নং নিয়ম : অপরের সম্পর্কে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হয়ে উঠুন।
২নং নিয়ম : হাসুন।
৩নং নিয়ম : মনে রাখবেন কোন মানুষের কাছে তার নিজের নামটি যে কোন ভাষাতেই সবচেয়ে মিষ্টি।
৪নং নিয়ম : ভালো শ্রোতা হোন। অপরকে তার নিজের বিষয়ে বলতে উৎসাহ দিন।
৫নং নিয়ম : অন্যের আগ্রহের ব্যাপার নিয়ে কথা বলুন।
৬নং নিয়ম : অপর ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববার সুযোগ দিন–আন্তরিকভাবেই তা করুন।