ঘুরতে ঘুরতে যখন আবার হোটেলে ফিরে এলাম, তখন রাত অনেক। আমার জন্যে অপেক্ষা করে করে ইংরিজি ক্যালেন্ডারের পুরনো তারিখটাও শেষ পর্যন্ত বিদায় নিয়েছে। কেন জানি না, জনহীন কলকাতার রাজপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, এতদিনে আমি সাবালক হয়ে উঠছি। এতদিন অনভিজ্ঞ বালকের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখেছি আমি; পরিপূর্ণ হইনি আমি। আজ রাত্রে আমি পরম পূর্ণতা লাভ করেছি। জ্ঞানবৃক্ষের ফল আস্বাদন করে এতদিনে যেন নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করছি আমি।
হোটেলে ঢোকার পথে দেখলাম, সত্যসুন্দরদা তখনও রিসেপশন কাউন্টার আলো করে বসে আছেন। শাজাহানের কাউন্টারে এখন কোনো লোক নেই। পৃথিবীর সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে, সত্যসুন্দরদা একা জেগে রয়েছেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যসুন্দরদা যেন কিসের ইঙ্গিত পেলেন। চোখ দুটো বোধহয় একটু লাল হয়েছিল। হাত দুটো চেপে ধরে সত্যসুন্দরদা বললেন, শরীর খারাপ হয়েছে নাকি? কোথায় গিয়েছিলে? রাত্রে কিছুই খাওনি। জুনো সায়েবকে জিজ্ঞেস করলাম, সে বললে তোমাকে খেতে দেখেনি। শেষে বুড়োর কাছ থেকে গোটা কয়েক স্যান্ডউইচ আদায় করে, এই ড্রয়ারের মধ্যে রেখে দিয়েছি। এখন শাজাহানে কেউ আসবে না। সুতরাং নিয়ম মানবার দরকার নেই। এইখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইস্কুলের ছেলেদের মতো খেয়ে নাও। . সত্যসুন্দরদা যেন বুঝতে পারছেন আমার মধ্যে আকস্মিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। আমার মনের সুবোধ সুশীল ইস্কুলবয়টাকে তাড়িয়ে দিয়ে, একটা অপরিচিত ভয়াবহ পুরুষ সেখানে আসর জাঁকিয়ে বসেছে। কোনোরকমে বললাম, সত্যসুন্দরদা, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
সেইজন্যেই তো স্যান্ডউইচ আনিয়ে রেখেছি! খিদে থাকলে আধডজন স্যান্ডউইচে কিছু হত না। তাছাড়া তোমাকে আজ খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। চমৎকার অ্যানাউন্স করেছ, কনিও খুব খুশি। কনি তো বিশ্বাসই করলে না জীবনে কোনোদিন তুমি ক্যাবারে আর্টিস্টদের প্রেজেন্ট করোনি।
আমার চোখ দিয়ে তখন ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আমার আপত্তি অমান্য করে চোখে জল কেন যে আমাকে অপদস্থ করবার চেষ্টা করছে, বুঝতে পারলাম না।
মানুষের মনের কথা বোসদা যেন অতি সহজেই বুঝে ফেলেন। আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, বেশ বুঝতে পারছি, একদিন এই হোটেলে তোমার জুড়ি থাকবে না। কাউন্টারে, বারে, ক্যাবারেতে তোমাকে না-হলে এক মুহূর্তও চলবে না।
বোসদা এবার দেখতে পেলেন। আমি কাঁদছি। কী হল? ছিঃ, কাঁদছ কেন? পরমুহূর্তেই বোসদা আমাকে পরমস্নেহে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মুখটা নিজের বুকের কাছে টেনে নিলেন। শাজাহানের আগুনে এতদিন পুড়ে পুড়েও বোসদা যে ছাই হয়ে যাননি, তা আবিষ্কার করলাম। জড়িত কণ্ঠে বোসদা বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি। তুই যে কাদছিস, এতে আমার আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু দেখে যা। দেখার এমন সুযোগ জীবনে আর কখনও হয়তো পাবি না। কিন্তু চিরকাল এমন থাকিস। চিরকাল যেন এমন লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে পারিস।
তুমি থেকে বোসদা তুই-তে নেমে গিয়েছিলেন, এবার তুমি-তে ফিরে এলেন। বললেন, সাপারে বসে কনি তোমাকে খুঁজছিল। ভারি মিশুক মেয়েটা। চমৎকার কথাবার্তা বলে। অনেক মজার মজার গল্প বলছিল। সারা জীবনটাই তো যাযাবরের মতো কাটিয়ে দিল। পৃথিবীর এক হোটেল থেকে আর এক হোটেলে নাচতে নাচতেই ওর বসন্ত শেষ হয়ে যাবে। কনিই বলছিল, খেলোয়াড়, অভিনেত্রী এবং নর্তকীর জীবনে মাত্র একটি ঋতুই আছে। তার নাম বসন্ত ঋতু। এরা সকলেই কেবলমাত্র যৌবনে ধন্য। ভদ্রমহিলা আরও গল্প করতেন। কিন্তু ল্যামব্রেটাকে নিয়েই বিপদ হল। বামনটা বার-এ যেতেই কয়েকজন মহিলা ভয়ে চিৎকার করে ওঠেন। তাতে অপমানিত হয়ে ল্যামব্রেটা একজনের টেবিলের উপর বসে পড়ে। ভদ্রমহিলা মেটারনিটি জ্যাকেট পরে স্বামীর সঙ্গে বার-এ বসেছিলেন। ল্যামব্রেটা তাকে বলে, আমার দিকে ওইভাবে তাকিও না। তোমার যে ছেলে হবে, আমার থেকেও সাইজে ছোট হবে!
ভদ্রমহিলা সেই শুনে ফেন্ট হয়ে যাবার দাখিল। খবর পেয়ে আমরা আবার বার-এ গিয়ে ওঁদের সামলাই। কনিও জোর করে ল্যামব্রেটাকে ঘরে নিয়ে গেল। আড্ডাটা জমল না।
বোসদা বললেন, যাও, শুয়ে পড়গে। আমিও চেয়ারে বসে একটু চুলে নিই। রাত চারটের সময় কয়েকজন গেস্ট চলে যাবেন, তাদের জাগিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
ছাদের উপরে উঠে আস্তে আস্তে দরজাটা টেনে খুললাম। এই সময় কাউকেই জেগে থাকতে দেখার আশা করি না। গুড়বেড়িয়াও নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু পা দিয়েই দেখলাম একটা চ্যাপ্টা মদের বোতল নিয়ে ল্যামব্রেটা ছাদের ধুলোর উপর বসে আছে। কোট-প্যান্ট-টাই সে কিছুই ছাড়েনি। মাঝে মাঝে বোতলের মুখটা খুলে সে দু এক ঢোক গিলে নিচ্ছে। আমাকে দেখেই ল্যামব্রেটা উঠে দাঁড়াল। বললে, কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখছ?
আমার তখন চাঁদ দেখবার মতো মানসিক অবস্থা নেই। বললাম, ঘুমোবেন না?
মদের বোতলটা হাতে করে ল্যামব্রেটা এবার সোজা আমার সঙ্গে চলে এল। অনুমতি না-নিয়েই ঘর খোলামাত্রই সে আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ল্যামব্রেটার চোখ দুটো দেখলে ভয় লাগে। যে আমুদে ক্লাউন কিছুক্ষণ আগেও কলকাতার সাড়ে তিনশো লোককে হাসিয়ে এসেছে, সে যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।
ল্যামব্রেটা বললে, আমি শুনলাম, তুমি এখানেই ঘুমোও। তোমার জন্যেই আমি অপেক্ষা করছিলাম। তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি, কাল থেকে ক্যাবারেতে অন্য কাউকে তুমি কনির কোলে বসতে ডাকবে না। তাহলে বিপদ হবে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। লোকটা কি মদে চুর হয়ে আছে? আমার উত্তরের অপেক্ষা না-করে, ল্যামব্রেটা বললে, কলকাতার লোকরা তোমরা জানোয়ার। তোমাদের বাবা, মা, ঠাকুমা, দিদিমা কেউ মানুষ ছিলেন না। সব জানোয়ার। বলেই ল্যামব্রেটা তার বিশিষ্ট ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করল। সঙ্গে গান। সে গানের অর্থ—আমাদের এই দুনিয়ায় সবাই জানোয়ার। যদি বিশ্বাস না-হয়, আমার সঙ্গে রাত্রে খারাপ পাড়ায় চলো, না-হয় অন্তত হোটেলে এসো।
আমার চোখে ঘুম নেমে এসেছে। এই সময় কোন পাগলের হাতে পড়লাম! বললাম, মিস্টার ল্যামব্রেটা, রাত অনেক হয়েছে। ল্যামব্রেটা এবার কুৎসিত গালাগালি শুরু করল। রাত হয়েছে তো কী হয়েছে? কী তোমার সতী-সাবিত্রী হোটেল। এখানে রাত নটা বাজলেই সব ব্যাটাছেলে যেন ঘুমিয়ে পড়েন!
বললাম, মিস্টার ল্যামব্রেটা, সারাদিন কাজ করে ক্লান্তি অনুভব করছি। বিছানার উপর উঠে নাচতে নাচতে ল্যামব্রেটা বললে, কনির কোলে বসে পড়বার সময় তো সে-কথা মনে থাকে না? বললাম, আমাকে এসব বলে লাভ কী? আমি তো কনির কোলে বসিনি।
না, তোমরা বসবে কেন? তোমরা রোমের পোপ, তোমরা ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ, তোমরা লর্ড বুড়ার ডাইরেক্ট ডিসেনডেন্ট! কনির যে একটা কোল আছে, তাই তোমরা ক্যালকাটা সিটিজেনরা জানো না।
ল্যামব্রেটার হাবভাব দেখে মনে হল, মদের ঘোরে সে এবার আমার ঘরের জিনিসপত্তর ভাঙতে আরম্ভ করবে।
নিরুপায় হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে গুড়বেড়িয়ার খবর করলাম। গুড়বেড়িয়া ঘুমোচ্ছিল। ধড়মড় করে উঠে পড়ে বললে, কী হয়েছে? দেবতা কিছু গণ্ডগোল করছে নাকি?
দেবতাই বটে! বামন সায়েবকে দেখে গুড়বেড়িয়ার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে, ইনি সাক্ষাৎ শ্রীভগবানের অবতার। গুড়বেড়িয়াকে বললাম, তোমার ভগবান-টগবান রাখো। এখন মাতাল সায়েবকে কী করে ঘর থেকে বের করা যায় বলো?
গুড়বেড়িয়ে আমার তোয়াক্কা রাখে না। আমার খুশি-অখুশিতে তার চাকরি নির্ভর করে না। তাছাড়া, ক্ষতি যা হবার তা প্রায় হয়েই গিয়েছে। পরবাসীয়া মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছে।
ভেবে দেখলাম, কোনো উপায় নেই। কনিকে ডেকে পাঠানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই। গুড়বেড়িয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম, কনি মেমসায়েব কোথায়?
গুড়বেড়িয়া বললে, নীচের তলায়। বাধ্য হয়েই ফোন করলাম। টেলিফোনটা বেজে উঠতেই কনি ফোনটা ধরলে; এত রাত্রে কেউ যে তাকে ফোনে ডাকতে পারে, সে বোধহয় ভাবতেও পারেনি। বললে, কে? কী ব্যাপার?
যথাসম্ভব কম কথা খরচ করে আমার সমস্যার কথা কনির কাছে নিবেদন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করলাম, এত রাত্রে আপনার ঘুমের ব্যাঘাত করা আমার উচিত নয়; কিন্তু ল্যামব্রেটার মাতলামো আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে।
কনি বেশ ভয় পেয়ে গেল। সে যে চমকে গিয়েছে, তা তার গলার স্বর থেকেই বুঝলাম। কনি বললে, আমি এখনই ছাদে যাচ্ছি।
কনি ছাদে আসছে শুনে গুড়বেড়িয়া তড়াং করে উঠে দাঁড়াল। এত রাত্রে ল্যাংটা মেমসায়েবদের আবার ছাদে আসবার দরকার কী?
ছাদের দরজাটা এবার মুহূর্তের জন্যে খুলে গেল। সেখানে স্লিপিংগাউনে দেহ আবৃত করে, মাথায় সিল্কের বনেট জড়িয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েক ঘন্টা আগে সে কলকাতার গণ্যমান্যদের মনোরঞ্জন করছিল। তার ভঙ্গিতে তখন লাস্য ছিল, যৌবনের দেহ ছিল। কিন্তু রাত্রের এই অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে যেন অন্য কেউ। সে আর যাই হোক—কনি দি উয়োম্যান নয়। এ কনিতে একটুও আগুন নেই। নিতান্ত একঘেয়ে হলেও, সেই পুরনো উপমাই মনে পড়ছে—তার মুখে আকাশের চঁাদের স্নিগ্ধতা।
কনি বললে, কোথায় সে? আপনাকে অ্যাটাক করেছিল নাকি?
বললাম, আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে আক্রমণ করেনি, কিন্তু আমার ঘর অধিকার করে বসে আছে। ওখানে বসে বসে মদ খেতে খেতে অনেকটা হুইস্কি আমার বিছানার তোশকের উপর ফেলে দিয়েছে।
আমার কথা শুনে কনি লজ্জায় মাটিতে মিশে গেল। আস্তে আস্তে বললে, আই অ্যাম সো স্যরি, বাবু। কনি সোজা আমার ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। ঢুকেই অস্ফুট স্বরে বললে, হ্যারি!
ল্যামব্রেটার যে আর কোনো নাম থাকতে পারে তা আমার মাথায় আসেনি। হ্যারি নাম শুনেই ল্যামব্রেটা চমকে উঠে দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। কনিকে দেখেই, প্রথমে সে হুইস্কির বোতলটা প্রাণপণে জড়িয়ে ধরলে। যেন ওইটা কেড়ে নেবার জন্যেই কনি ঘরের মধ্যে ঢুকেছে। ল্যামব্রেটা বোধহয় সব বুঝতে পারলে। কিন্তু পরমুহুর্তেই প্রতিবাদের সাহস জোগাড় করে বললে, আমি যাব না। কিছুতেই যাব না। জানোয়ারের বাচ্চাদের আমি ছারপোকার মতো টিপে মেরে ফেলব। তাতে তোমারই বা কী? আই এই গালফুলো বেলুনমুখো ছোকরারই কী?
কনি দাঁতে দাঁত চেপে বললে, হ্যারি, রাত্রি অনেক হয়েছে। তুমি এই নিরীহ ভদ্রলোকের বিছানা নষ্ট করে দিয়েছ।
তার জন্যে আমি স্যরি। আমি ইচ্ছে করে করিনি। ছারপোকা মারতে গিয়ে বোতলটা পড়ে গিয়েছিল। তাতে ওঁর কী ক্ষতি হয়েছে? আমারই তো লোকসান হল।
হ্যারি! কনি এবার আরও চাপা, অথচ আরও তীব্র স্বরে বললে। ল্যামব্রেটাও এবার দপ করে জ্বলে উঠল। বেশ করব। আমার যা খুশি তাই করব। তাতে তোমার কী? এক মগ বিয়ার নিয়ে এসে আমি এই ছোঁড়ার মাথার বালিশ ভিজিয়ে দেব; দু বোতল রাম দিয়ে আমি নিজের কোট কাচব; হোয়াটস্ দ্যাট টু ইউ?
এমন অবস্থার জন্যে কনি বোধহয় প্রস্তুত ছিল না। ল্যামব্রেটা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। লজ্জায় অপমানে কনির মুখ যে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, তা আমি বুঝতে পারলাম। কনি নিজের দেহের সব রাগ চেপে রেখে, আরও কাছে এগিয়ে গিয়ে কিছু করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ যেন তার মনে পড়ে গেল ঘরের মধ্যে আমিও দাঁড়িয়ে রয়েছি। মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে কনি আমাকে বলল, প্লিজ, তুমি যদি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।
কোনো কথা না বলে, আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু সে বোধহয় এক মিনিটেরও কম সময়ের জন্যে। তারই মধ্যে যেন মন্ত্রের মতো কাজ হয়ে গেল। কোনো এক আশ্চর্য উপায় ল্যামব্রেটা তার সংবিৎ ফিরে পেয়েছে! কনি আমাকে ঘরের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে বললে, কাম ইন।
ভিতরে ঢুকে দেখলাম, ল্যামব্রেটা একেবারে জল হয়ে গিয়েছে। বলছে, প্লিজ। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি রিয়েলি স্যরি।কনি বললে, আর নয়। আমি অনেক সহ্য করেছি।
ল্যামব্রেটা এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, আমি এখনই নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি।
যাও। এখনি নিজের ঘরে চলে যাও। কনি বললে।
নিজের ঘরে যাবার জন্যে উঠে পড়ে ল্যামব্রেটা হঠাৎ আমাকে দেখতে পে। অভিমানে ছোট ছেলের মতো মুখ ফুলিয়ে কনিকে বললে, তুমি শুধু আমার দোষ দেখো। আর ওরা যে আমাকে শিম্পাঞ্জি বললে, তখন? তখন তো কিছু বললে, না? ছোটো ছেলের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে ল্যামব্রেটা নিজের ঘরে চলে গেল। কনি কিছু বলার জন্যে তার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু কোনো কথা না শুনে ল্যামব্রেটা নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে দড়াম করে দরজা ভেজিয়ে দিল।
আমি দেখলাম, দরজার সামনে কনি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়বার জন্যে আমিও তৈরি ছিলাম না। কনি এবার আস্তে আস্তে ছাদের এক কোণে এসে দাঁড়াল। আমি দেখলাম, কনি কাঁদছে। কনি দি উয়োম্যান স্লিপিং গাউনের হাতা দিয়ে চোখের জল মুছছে। আস্তে আস্তে সে এবার আমাকে বললে, বুটস্। পৃথিবীর এই লোকরা ব্রুটস্। হ্যারির সামনে শাজাহানের বার থেকে উঠে এসে একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করলে তোমার এই ক্লাউনটা শিক্ষিত শিম্পাজি না মানুষ?
ও যদি নিজের ঘরে বসে মাতলামো করত কিছু বলতাম না। আমি দেখতেও যেতাম না। ওই তো আমাকে বাধ্য করলে। আমার কী দোষ?—কনি যে সত্যিই কঁদছে তা আমার বুঝতে বাকি রইল না। সে বললে, তুমি কিছু মনে করো না। সারাদিন খেটে খুটে তুমি যখন ঘুমোতে এলে, তখন হ্যারি তোমার মুডটা নষ্ট করে দিয়ে গেল।
আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, তাতে কী হয়েছে। উনি তো আর জেনে শুনে কিছু করেননি। নেশার ঘোরে কেউ কিছু করলে, তার জন্য তাকে দোষী . করা চলে না।
কনি বললে, যাই, ওকে আর একবার দেখে আসিগে যাই। কনি এবার ল্যামব্রেটার ঘরে পা টিপে টিপে ঢুকে গেল। আজ আমার ঘুম আসবে না। গুড়বেড়িয়াকে এক গ্লাস জল আনতে বলে, আমি আমার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিন্তু কনির কী হল। ল্যামব্রেটার ঘরে সেই যে সে ঢুকেছে, আর বেরোবার নাম নেই। ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে কিনা তাও বুঝতে পারছি না। ঘরের দরজাটা কনি একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। ওরা দুজনে কি কোনো কথা বলছে? না তো। ফিসফিস করে কথা বললেও কাঠের পার্টিশন ভেদ করে কিছু গুঞ্জন এই স্তব্ধ রাত্রে আমার কানে এসে হাজির হত।
গুড়বেড়িয়া আমার হাতে জলের গেলাসটা দিয়ে দিল। জলটা এক নিঃশ্বাসে পান করে ফেললাম। বুকের ভিতরটা যেন একেবারে শুকনো মরুভূমি হয়ে ছিল। গুড়বেড়িয়া এতক্ষণে কোনো গণ্ডগোলের আভাস পাচ্ছে। এই রাত্রে ছাদের ঘরগুলোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার। সেখানে কোনো অঘটন ঘটলে তার চাকরিটাই আগে যাবে। গুড়বেড়িয়া ফিসফিস করে প্রশ্ন করলে, ল্যাংটা মেমসায়েব নীচে চলে গিয়েছেন তো?
আমি ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলাম, মেমসায়েব এখনও যাননি।
অ্যাঁ! যাননি? তাহলে কোথায় তিনি?
ইশারায় গুড়বেড়িয়াকে দেখিয়ে দিলাম। গুড়বেড়িয়া বললে, হুজুর, যতদূর মনে হচ্ছে ঘরের আলো নেভানো। তাই না?
বললাম, আমার তো তাই মনে হচ্ছে। সন্দেহ নিরসনের জন্যে গুড়বেড়িয়া এবার সোজা ল্যামব্রেটার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ঘরের কাছাকাছি গিয়ে, কাঠের ফাঁক দিয়ে সে উঁকি মেরে নিঃসন্দেহ হতে চাইল, ঘরের আলো নিভে গিয়েছে কিনা। আমি তখনও বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। গুড়বেড়িয়া ফিরে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোতে লাগল। বললে সব্বোনাশ হয়েছে, হুজুর। বুলু আলো জ্বলছে।
তাতে তোর কী? আমি তাকে সাহস দিয়ে বললাম।
কী বলছেন, সায়েব! ঘর একেবারে অন্ধকার থাকলে আমি এতটা ভয় পেতাম না। পরবাসীয়া আমাকে প্রথম দিন বলে দিয়েছিল, আলো থাকলে ভয় নেই, আলো না থাকলেও তেমন ভয় নেই, কিন্তু দুশমন হচ্ছে ওই বুলু আলো। গুড়বেড়িয়ার এবার কেঁদে ফেলবার অবস্থা। চোখ মুছতে মুছতে বললে, আমাকে শনিতে ধরেছে। আমার আর চাকরি থাকবে না।
কাঁদতে কাঁদতে সে নিবেদন করলে, ল্যাংটা মেমসায়েবদের উপর কড়া নজর রাখবার হুকুম আছে। তাদের বার-এ ঢুকতে দেওয়া বারণ; তাদের ঘরে কোনো পুরুষমানুষদের ঢুকতে দেওয়া বারণ; কোনো পুরুষমানুষের ঘরেও তাদের প্রবেশ নিষেধ। যদি কারুর ঘরে সে ঢুকেও পড়ে, দরজা হাট করে খুলে রাখতে হবে। আমার চাকরিটা আজ গেল হুজুর!
আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, অত ভয় পাচ্ছ কেন? এই রাত্রে কে তোমার ছাদে আসছে?
আপনি জানেন না। মার্কোসায়েব রবারের জুতো পরে কখন যে এসে পড়বেন, কিছুই ঠিক নেই। সায়েব কোনো কথা শুনবেন না। সঙ্গে সঙ্গে হোটেল থেকে দূর করে দেবেন। করিমকে সেবার যেমন সায়েব ঘাড় ধরে বের করে দিলেন। তখনকার ল্যাংটা মেমসায়েব একজন সায়েবকে রাত্রে ছেড়ে দিতে বলেছিল। ছেড়েও দিয়েছিল করিম। পাঁচটা টাকার জন্যে করিমের সব গেল।
গুড়বেড়িয়া এবার দরজায় ধাক্কা দেবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছিল। চাকরি যাবার ভয়ে বামনাবতার তার মাথায় উঠেছে। আমি বাধা দিলাম। বললাম, গুড়বেড়িয়া, সারাদিন কাজ করে বহু পরিশ্রান্ত লোক এখন ঘুমোচ্ছে। এখন তাদের ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করো না। গুড়বেড়িয়া আমার কথার মধ্যে কিসের। ইঙ্গিত খুঁজে পেল কে জানে। মনে হল সে সন্দেহ করছে, মেম সায়েবের ওই ঘরে ঢুকে পড়ে নীল আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার পিছনে আমারও কোনো। হাত আছে। গুড়বেড়িয়া এবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাব আর ভাষায় প্রকাশ করতে সাহস করলে না।
আজ রাত্রের আকাশকে আমার বড় বিষণ্ণ মনে হচ্ছে। যেন সৃষ্টির ভান্ডারের যত আনন্দ ছিল, পৃথিবীর বেহিসেবি মানুষরা সব উড়িয়ে দিয়েছে। যা পড়ে আছে সে কেবল দুঃখ। কারুর জন্য কোথাও এক ফোঁটা প্রশান্তি। অবশিষ্ট নেই।
ল্যামব্রেটার ঘরের দরজা এবার খুলে গেল মনে হল। ঘরের নীল আলোটা এখন আর জ্বলছে না। সেখানে নির্ভেজাল অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মধ্য থেকেই শ্বেতদ্বীপবাসিনী কনি লঘু পদক্ষেপে বেরিয়ে এল। ধীরে ধীরে সে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির দিকে আসতে আসতে সে আমাকে দেখতে পেল। আমাকে সে যে দেখতে পাবে তা বোধহয় তার হিসাবের মধ্যেই ছিল না। কিন্তু আমাকে অবজ্ঞা করেই সে নিজের ঘরে চলে গেল।