৯. খুন
বিকাল বেলা বাসা থেকে বের হচ্ছি, দেখি, সিঁড়িতে জয়নাল বসে আছে। জয়নাল হাসিখুশি মানুষ, কোন সময় মন খারাপ করে থাকে না। যখন তার হাসিখুশি হওয়ার কোন কারণ নেই তখনো সে হাসিখুশি! আজকে কিন্তু জয়নালকে দেখে মনে হল তার মন খারাপ। গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখেও কিছু বলল না। আমি কাছে গিয়ে বললাম, কি রে জয়নাল!
তবু সে উত্তর দিল না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কি রে জয়নাল? কি হয়েছে?
জয়নাল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার রশীদের কথা মনে আছে?
রশীদ? আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মনে করতে পারলাম না।
জে। রশীদ। মিনতির কাজ করত। একদিন নদীর ঘাটে নতুন কাপড় পরে। এসেছিল। তখন আমি —
হ্যাঁ হ্যাঁ, যে তোকে ফিরিশতার মত ডাক্তার নাওয়াজের খোঁজ দিয়েছে?
জয়নাল চমকে উঠে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, শ স্ স্ স্ আস্তে। কেউ শুনবে।
কে শুনবে? কেউ নাই এখানে। কি হয়েছে রশীদের?
মরে গেছে।
মরে গেছে? আমি চমকে উঠে বললাম, মরে গেছে?
জে।
কেমন করে মরে গেল?
পানিতে ডুবে।
পানিতে ডুবে? আমি অবাক হয়ে বললাম, সাঁতার জানত না?
জয়নাল একটু হাসার মত ভঙ্গি করে বলল, কি বলেন আপনি মুনীর ভাই! পানির পোকা ছিল একেবারে! মাছের মত সাঁতার দিত।
তাহলে ডুবে গেল কেন?
জয়নাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার কি মনে হয় জানেন?
কি?
কেউ একজন মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছে। লুঙ্গির খুট দিয়ে চোখ মুছে জয়নাল বলল, রশীদ পানিতে ডুবে মরার মানুষ না। শুক্রবারে দেখা হল ভাল মানুষ। তারপর দেখা নাই। এখন শুনি মরে গেছে! বিশ্বাস হয়?
জয়নাল!
জে?
তুই জানিস আমার কি মনে হয়?
কি?
নাওয়াজ খান মেরেছে।
জয়নাল এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি বললাম, নাওয়াজ খান অনেক ডেঞ্জারাস মানুষ!
আপনি কি বলেন মুনীর ভাই! ফিরিশতার মত মানুষ–
জয়নাল। নাওয়াজ খান ফিরিশতার মত মানুষ না—
আপনি কেমন করে জানেন?
আমি? আমি–মানে ইয়ে–আমি আমতা আমতা করে থেমে গেলাম, আমি আর সলীল যে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম সেটা বলতে পারলাম না। জয়নাল সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আমাদের ক্লাসের একজন চিনে। সে বলেছে।
জয়নাল আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। মাথা নেড়ে বলল, একজন ভাল মানুষের বদনাম করা ঠিক না।
তুই কেমন করে জানিস সে ভাল মানুষ?
আমি জানি। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের কেউ খোঁজখবর নেয় না। ডাক্তার। সাহেব আমাদের খোঁজখবর নেন। টাকা পয়সা দেন।
জয়নাল, তুই আমার কথা শোন। খবরদার, তুই আর কোনদিন গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকে যাবি না। খবরদার।
জয়নাল আমার কথার উত্তর দিল না। মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, রশীদ ছাড়া তোর পরিচিত আর কেউ মারা গেছে?
জয়নাল মাথা নাড়ল, না। কেউ মারা যায় নাই। খালি—
খালি কি?
তালেব আলী –জয়নাল অনিশ্চিতের মত থেমে গেল।
তালেব আলী কি?
তালেব আলীর খোঁজ নাই আজ কয়েক মাস।
তালেব আলীটা কে?
আরেকজন মিস্ত্রি।
তার খোঁজ নেই?
না। কিন্তু তালেব আলী পাগলা কিসিমের। মনে হয় নিজেই কোথাও চলে গেছে।
তালেব আলী কি তোর ফিরিশতা ডাক্তারের কাছে যেতো?
জয়নাল দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল।
আর কেউ কি মারা গেছে কিংবা হারিয়ে গেছে?
রইস।
রইসটা কে?
জুতা পালিশ করত। বাপের সাথে ঝগড়া করে চলে গেল।
কোথায় চলে গেল?
কেউ জানে না। রইসের অনেক মাথা গরম।
তুই কেমন করে জানিস মাথা গরম? নাওয়াজ খান হয়তো —
জয়নাল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, না মুনীর ভাই। গরিব মানুষের পোলাপান। এইভাবেই মানুষ হয়। এক জায়গায় কয়দিন থাকে, তারপর সেখান থেকে আরেক জায়গায়। তারপর আরেক জায়গায়।
কি বলিস তুই জয়নাল?
ঠিকই বলি।
তিন তিনজন ছেলে তোর ফিরিশতা ডাক্তারের কাছে যেতো। তিনজনই শেষ আর তুই বলছিস–
বড় মানুষেরা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে যেভাবে মাথা নাড়ে জয়নাল সেভাবে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, মুনীর ভাই, গরিবের পোলাপান মরে অনেক বেশি। সেইদিন একজন ট্রাকের নিচে পড়ে শেষ। এখন আপনি কি বলবেন সেইটাও ডাক্তার সাহেব মেরেছে?
তা আমি জানি না। কিন্তু তুই –খবরদার, আর কখনো গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকে যাবি না। ঠিক আছে?
জয়নাল কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
বল, তুই আর কোন দিন যাবি না। বল।
জয়নাল খুব অনিচ্ছার সাথে বলল, ঠিক আছে যাব না।
তার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম সে কথাটা বলেছে আমাকে ঠাণ্ডা করার জন্যে। যখন দরকার হবে তখন সে ঠিকই যাবে তার ফিরিশতার মত ডাক্তার নাওয়াজ খানের কাছে! আমার কথা সে একটুও বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আমি আর কি করতে পারি?
জয়নালের কাছে রশীদের খুন হয়ে যাবার খরব পেয়ে আমি গেলাম সলীলের সাথে দেখা করার জন্যে। সলীল বাসায় নেই, তার কোন মাসীর বাড়ি বেড়াতে গেছে। আমি কি করব বুঝতে না পেরে ফিরে আসছিলাম চৌরাস্তার মোড়ে হঠাৎ মীনা ফার্মেসীটা চোখে পড়ল। এটা মতি মিয়ার ফার্মেসী, বাবা এখানে ওষুধ বিক্রি করেন।
ফার্মেসীতে মতি মিয়া আর তার একজন কর্মচারী বসে ছিল। এই কর্মচারীটি নতুন এসেছে, কমবয়সী হাসিখুশি একজন মানুষ। মতি মিয়া আমাকে দেখে খামাখা একটু মাতব্বরীর ভান করে বলল, কি খবর?
আমি বললাম, ভাল।
পড়াশোনা কর, নাকি খালি ঘোরাঘুরি?
আমার একটু মেজাজ গরম হল, নিজে চোরাই ওষুধ বিক্রি করে কিন্তু আমার উপর খবরদারি। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, খালি ঘেরাঘুরি।
আমার কথা শুনে কমবয়সী হাসিখুশি কর্মচারীটি হঠাৎ হি হি করে হেসে উঠল, কিছুতেই আর হাসি থামাতে পারে না। মতি মিয়া চটে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি বললে?
না, কিছু না।
অন্য মানুষটি তখনো হেসে যাচ্ছে, মতি মিয়া তাকে জোরে একটা ধমক দিল, চুপ করবে তুমি?
মানুষটির হাসার রোগ আছে, অনেক কষ্ট করে নিজেকে থামাল। মতি মিয়া আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, মুরুব্বীদের সাথে এইভাবে কথা বলা ঠিক না। আদব-লেহাজ বলে একটা কথা আছে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না, দাঁড়িয়ে রইলাম। মতি মিয়া খানিকক্ষণ গজ গজ করে একসময় উঠে দাঁড়িয়ে তার কর্মচারীটিকে বলল, দোকানটা দেখ, আমি বাজারটা সেরে আসি।
জি আচ্ছা।
মতি মিয়ার পিছনে পিছনে আমিও উঠে যাচ্ছিলাম, কর্মচারীটি বলল, তোমার নাম কি?
আমি আমার নাম বললাম।
আজকে তুমি জব্বর দিয়েছ মতি মিয়াকে! জিজ্ঞেস করল, পড়াশোনা কর না কি খালি ঘোরাঘুরি। তুমি বললে ঘোরাঘুরি! হি হি হি হি —
লোকটা আবার হাসতে শুরু করে, কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না। ব্যাপারটা মোটেও এত হাসির নয়, মানুষটার নিশ্চয়ই হাসির রোগ আছে। হাসি যত অর্থহীন হোক, এটা সব সময় সংক্রামক, একটু পরে আমিও হাসতে শুরু করলাম।
লোকটা ফার্মেসীর একটা আলমারি খুলে কি একটা কৌটা বের করে সেখান থেকে দুইটা ট্যাবলেট বের করে একটা টপ করে মুখে দিয়ে আরেকটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি এটা?
খেয়ে দেখ। ভিটামিন সি। অনেক মজা খেতে।
আমি সাবধানে মুখে দিয়ে দেখি সত্যিই তাই। চুষে চুষে খেতে খেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সব ওষুধ চিনেন?
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলল, না চিনলে চলে?
আমি লাল রঙের একটা বোতল দেখিয়ে বললাম, ঐটা কি ওষুধ, বলেন দেখি।
লোকটা মাথা চুলকে বলল, হয় ব্লাড প্রেশার না হয় ডায়াবেটিস।
সত্যি মিথ্যা কে জানে। আমি আরো কয়েকটা জিজ্ঞেস করলাম, লোকটা কিছু না কিছু বলে দিল। কথা শুনে মনে হল বানিয়েই বলছে –আমি অবিশ্যি সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। হঠাৎ আলমারিটার উপরে এক জায়গায় দেখি, বাবার ভেজাল ওষুধগুলি সাজানো। আমি হাত দিয়ে দেখিয়ে বললাম, ঐটা কিসের ওষুধ?
ঐটা এন্টিবায়োটিক্স।
সেটা দিয়ে কি হয়?
ইনফেকশান হলে খেতে হয়।
কিসের ইনফেকশান?
কত রকম ইনফেকশান আছে! কিডনি, লিভার, ব্রেন। লোকটা খুব গম্ভীর ভাব করে হাত নেড়ে বলল, এন্টিবায়োটিক্স ছাড়া আজকাল একটা দিনও যায় না।
হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি চোখে মুখে একটু অবাক হবার ভান করে বললাম, আমাকে ওষুধটা দেখাবেন? একটু দেখি।
লোকটা মুখে তাচ্ছিল্যের ভান করে ওষুধের বাক্সটা নামিয়ে এনে খুলে শিশিটা বের করে আমাকে দেখাল, বলল ক্যাপসুল।
আমি চোখে মুখে বিস্ময়ের ভান করে বললাম, কি সুন্দর! আমাকে একটা ক্যাপসুল দেবেন?
লোকটা খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি ক্যাপসুল দিয়ে কি করবে?
সাজিয়ে রাখব।
লোকটা খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল আমি ঠাট্টা করছি কিনা। আমি চোখে মুখে যতটুকু সম্ভব একটা সরল ভাব ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম। লোকটা বলল, ওষুধ কি সাজিয়ে রাখার জিনিস?
কি হয় সাজিয়ে রাখলে? মানুষ সুন্দর জিনিস সাজিয়ে রাখে না?
লোকটা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না, অসম্ভব বোকার মত কোন প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেওয়া খুব মুশকিল। লোকটা খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার হি হি করে হাসতে শুরু করল, কিছুতেই আর হাসি থামাতে পারে না।
হাসতে হাসতে সে সত্যি সত্যি শিশিটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে একটা ক্যাপসুল বের করে আমার হাতে দিয়ে দিল। আমি যখন ক্যাপসুলটা নিয়ে বের হচ্ছি তখনো সে হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভারি মজার মানুষ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বাবার ভেজাল ওষুধের একটা প্রমাণ সে হাতে হাতে দিয়ে দিল, নিজে না জেনেই!