নবম পরিচ্ছেদ
কাজল মনসাপোতা পৌঁছিল সন্ধ্যাবেলা।
বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরিতে ঘুরিতে একটি ভ্রাম্যমাণ দলের সঙ্গে সে অজন্তায় গিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। গুহাভ্যন্তবে অনতিউজ্জ্বল আলোকে মায়ের কোলে শিশু বুদ্ধের চিত্র দেখিতে দেখিতে হঠাৎ তাহার হারানো মায়ের জন্য মন কেমন করিয়া উঠিল। জগতে মাতৃশক্তি একটা বড়ো শক্তি। যে মাকে সে কখনও দেখে নাই, অথচ দশমাস ধরিয়া যাহার গর্ভে বাস করিয়া, যাহার শরীর হইতে পুষ্টি সংগ্রহ করিয়া তাহার দেহ পুষ্ট হইয়াছে, তাহার কথা মনে পড়িবামাত্র কাজলের সমস্ত নাড়ীতে টান ধরিল। মায়ের সহিত দেখা কবিবার আর কোনো উপায় নাই, কিন্তু মায়ের পবিত্র স্মৃতিবিজড়িত মনসাপোতায় গিয়া হাজিব হইতে পারিলে যেন মাকে সে অনেকখানি ফিরিয়া পাইবে।
অপরাহের রৌদ্র বাঁকাভাবে আসিয়া গুহার দেওয়ালে পড়িয়াছে, চারিদিকে স্তব্ধতা এবং নিবিড় প্রশান্তি। কোথায় লুকাইয়া বসিয়া কী একটা পাখি ক্রমাগত ডাকিতেছে। পাখির ডাকে সমস্ত পবিবেশ যেন করুণ উদাস হইয়া উঠিল। মানুষ সকলেই সকলের আত্মীয়, তবু মায়ের সঙ্গে শিশুর যে গভীর আত্মীয়তা তাহার সমান্তরাল কোনো সম্পর্ক আর পৃথিবীতে নাই। শৈশব হইতেই একটা বঞ্চনার অনুভূতি হৃদয়ের গভীরতম তলদেশ হইতে উঠিয়া আসিয়া মাঝে মাঝে তাহাকে কষ্ট দেয়। কী একটা জিনিস যেন তাহার পাওয়া হইল না, কী এক অমৃত আস্বাদন করিতে বাকি রহিয়া গেল। বড়ো হইয়া উঠিবার পর হইতে সে অপর্ণার জন্য তাহার মন-খারাপের কথা হৈমন্তীকে কখনও বলে নাই— বলিলে মা ভাবিতে পারে এত ভালোবাসা সত্ত্বেও ছেলে আপন হয় নাই। কিন্তু মনের ভিতরে গোপন রাখা এক জিনিস, আর ভূলিয়া যাওয়া অপর জিনিস।
তাহার ভয় ছিল সে ঠিক ঠিক পথ চিনিয়া যাইতে পারিবে কিনা, সেই কোন ছোটবেলায় বাবার সহিত একবার আসিয়াছিল। স্টেশন হইতে সে একখানা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করিল বটে, কিন্তু গ্রামে ঢুকির মুখে সেখানা ছাড়িয়া দিল এই গ্রামে সে হাঁটিয়া ঢুকিবে। জেলে-পাড়া ছাড়াইয়া পথের বাকে একটা অশ্বথ গাছ। ছোটবেলায় গাছটাকে সে এইটুকু দেখিয়া গিয়াছে, গোড়ায় কতগুলি ইট সাজাইয়া বেদিমতো করা ছিল। মেয়েরা স্নান করিয়া এক ঘটি করিয়া জল ঢালিয়া দিয়া যাইত। এখন গাছটা দোতলা সমান বড়ো হইয়া উঠিয়াছে, গোড়াটা গোল করিয়া বাঁধানো। আর কিছুটা হাঁটিতেই দূর হইতে একটা ঝাকড়া গাছের মাথা নজরে আসিল, কাহাদের উঠানে যেন গাছটা বাড়িয়া উঠিয়াছে। তারপরেই তাহার বুকের মধ্যে রক্ত ঢেউ খেলিয়া উঠিল। তাহাদের বাড়ি! তাহার মায়ের হাতে পোঁতা স্বর্ণচাপার গাছটা!
স্বপ্নের মধ্য দিয়া হাঁটিবার মতো কাজল নিঃশব্দ পদসঞ্চারে বাড়ির উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে পতনোম্মুখ বাড়িটা বিস্মৃত ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের মতো দেখাইতেছে। চালে খড় প্রায় নাই, দাওয়ায় ছোট-বড়ো ইদুর অথবা সাপের গর্ত, সমস্ত উঠান জুড়িয়া আগাছার জঙ্গল। চাপাগাছে এখন ফুল নাই, এখন চাঁপাফুল ফুটিবার সময় নয়, কেবল সান্ধ্য-বাতাস বাধিয়া গাছের পাতায় ঝিরঝির শব্দ হইতেছে। গাছটা কী নিজের ভাষায় তাহাকে কিছু বলিতে চায়?
প্রথমেই একটা আলো প্রয়োজন। স্টেশন হইতে কয়েকটা মোমবাতি কিনিয়া আনা উচিত ছিল। আসলে সে জীবনে কখনও সাংসারিক বিষয়ে মাথা ঘামায় নাই, কোথাও গেলে সেখানে শয্যা, আলো, আহার এবং অন্যান্য গার্হস্থ্য সুবিধা অপেক্ষা করিয়া থাকিবে ইহাতেই সে অভ্যস্ত। আলোর ব্যবস্থা যে আবার নিজেকে সঙ্গে করিয়া আনিতে হইবে ইহা তাহার মাথায় আদৌ খেলে নাই। বস্তুত এখন মনে পড়িল, খাওয়ার ব্যবস্থাও সে কিছু করিয়া আসে নাই বটে। অবশ্য একরাত্রি না খাইলে তেমন কিছু অসুবিধা নাই, কিন্তু আলো নিতান্ত প্রয়োজন।
পাশে তেলিদের বাড়িতে সবে সন্ধ্যার প্রদীপ দেখানো হইতেছে। একজন বৃদ্ধা উঠানের তুলসীতলায় ছোট একটি পিতলের প্রদীপ জ্বালিয়া দিয়া উপুড় হইয়া প্রণাম করিতেছিল, প্রণামের শেষে সোজা হইয়া আধ-অন্ধকাবে কাজলকে দেখিয়া অবাক হইয়া বলিল–কে? কে ওখানে?
কাজল আন্দাজ করিল ইনিই কুণ্ডবাড়ির গৃহিণী, ছোটবেলায় যখন দেখিয়াছিল তখন আরও মোটাসোটা ছিলেন, বয়েস বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে চেহারা ভয়ানকভাবে ভাঙিয়া পড়িয়াছে। বয়স তো কম হইল না, তাহার বাবাকে ইনি ছোট দেখিছেন, সে বলিল—আমি-আমি কাজল–
-কাজল? কে কাজল?
-আমি—এই পাশের বাড়ির ছেলে। আমাকে ছোটবেলায় একবার আপনি দেখেছেন। আমার বাবার নাম অপূর্ব-অপু। মায়ের নাম অপর্ণা–
তেলি-গিন্নি অবাক হইয়া আগাইয়া আসিতে আসিতে বলিল—কে? বামুনঠাকরুনেব নাতি? অপুর ছেলে? তুমি হঠাৎ কোথা থেকে? এতদিন ছিলে কোথায়—এসো এসো, দাওয়ায় উঠে এসো
কাজল আধুনিক মনোবৃত্তির ছেলে, সে বৃদ্ধার পায়ে হাত দিয়া প্রণাম করিতে গেল। বৃদ্ধা পিছনে সরিয়া গিয়া বলিলেন–না না, ছিঃ! তোমরা ব্রাহ্মণ, আমাদের পুরোহিত বংশ। তোমার ঠাকুমা আমার চেয়ে বয়েসে ছোট ছিলেন, কিন্তু আমি তাকে চিরদিন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে এসেছি। আহা, তোমার মা-ঠাকুমা বড়োই অল্প বয়েসে–
তেলিগিন্নি তাহাকে যথেষ্ট আদর করিলেন, গ্রামে আর ভদ্রলোক নাই সে বিষয়ে বিস্তর দুঃখ করিলেন, কিছু ধানী জমি দান করিলে কাজল তাহার বর্তমান মাকে লইয়া আবার মনসাপোতায় আসিয়া বাস করিতে রাজি আছে কিনা সে কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। তাহার বাবা যখন ছোটবেলায় এই গ্রামে বাস করিত, সেই সময় ও বর্তমান সময়ে যে অনেক পার্থক্য তাহা বলিয়া সে এই সরল ও স্নেহময়ী বৃদ্ধার মনে আঘাত দিতে চাহিল না। বিশেষ করিয়া সে জানে একদিন তেলি-গিন্নির দয়ার দানের উপর নির্ভর করিয়াই তাহাদের সংসার চলিত, আজ একটু সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছিয়া তাহাকে অসম্মান করা যায় না। সে বলিলআমি মায়ের সঙ্গে কথা বলে দেখব, দেখি ওঁর কী মত—
–তুমি কী এখন কদিন এখানে থাকবে? বাড়িঘর যে সারানোনা দরকার তা তো দেখতেই পাচ্ছো! তোমার বাবাই মারা যাবার আগে মেরামতের জন্য আমাকে শেষ যা টাকা পাঠিয়েছিল— তারপর তোমরা তো আর এদিক মাড়ালেই নাও, তোমাকে বলতে ভুল হয়ে গিয়েছে, আজকাল তোমাদের বাড়ি দেখতে মাঝে মাঝে শহর থেকে লোক আসে, জানো? অপু নাকি বড়ো হয়ে কী সব বই লিখেছে, সেই বই পড়ে তারা আসে। আমাকে কত কথা জিজ্ঞেস করে। তা তোমার বাবা কী বই লিখত? ঠাকুর-দেবতার কথা?
কাজল হাসিয়া বলিল–না ঠাকুমা, এমনি গল্পের বই। লোক আসে বাড়ি দেখতে আজকাল?
—তবে আর বলছি কী? সেদিনকার ছেলে অপু, এই তো সেদিন বইদপ্তর বগলে করে ইস্কুলে পড়তে যেত, সে নাকি আবার বই লিখে নাম করেছে। প্রায় ছুটির দিনেই লোকজন আসে
কাজল একটা হ্যারিকেন চাহিয়া লইয়া বাড়িতে ফিরিল। তেলিদের বাড়িতে জেলেপাড়ার একটি মেয়ে কাজ করে, সে গৃহিণীব নির্দেশে এরই মধ্যে আসিয়া দাওয়া ও ঘরঝট দিয়া নড়বড়ে তক্তাপোশটায় চাদর-বালিশ পাতিয়া দিয়া গিয়াছে। কাজলকে তেলি-গিন্নি বলিয়া দিয়াছে, যে কয়দিন থাকিবে তাহাদের বাড়ি দুইবেলা খাইতে। কাজেই আপাতত করিবার কিছু নাই। কাজল সুটকেস হইতে একখানি বই বাহির করিযা হ্যারিকেনের আলোয় বালিশে ভর দিয়া পড়িতে লাগিল।
তাহার একান্ত আপন মানুষেরা এই ঘরখানায় বাস করিত। রৌদ্র উঠিবার পর ঘাসের আগায় শিশিরবিন্দুর মতো তাহারা মহাকালেব নির্মম নির্দেশে কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে। কিন্তু এই বাড়ির প্রত্যেকটি কোণে তাহাদের মমতার স্মৃতি মাখানো আছে। মায়ের কথাই বেশি করিয়া মনে আসে। ঠাকুমার সহিত নিশ্চিন্দিপুর ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কিন্তু কেন যেন মনসাপোতার সহিত কেবলমাত্র মায়ের স্মৃতি মাখামাখি হইয়া আছে। এই ঘরে মা থাকিত, দরিদ্র ঘরের জিনিসপত্র সযত্নে গুছাইয়া রাখিত, কুলুঙ্গিতে রাখা আয়নার সামনে সাজিত, সিঁথিতে সিঁদুর দিত, বাবা কবে কলিকাতা হইতে আসিবে সেজন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করিযা থাকিত। ঘরের চারদেয়ালে আরদ্ধ পরিবেশে যেন সময় আর অগ্রসর হয় নাই, তেইশ বৎসব পূর্বের সেই দিনগুলিতেই আটকাইয়া গিয়াছে।
আচ্ছা, যদি হঠাৎ ফিরিয়া আসে? হয়তো আসলে মা বাঁচিয়া আছে, বাংলা উপন্যাসের গল্পের মতো কোনো রহস্যময় কারণবশত আত্মগোপন করিয়া আছে মাত্র, একদিন হঠাৎ স্বেচ্ছানির্বাসন হইতে প্রত্যাবর্তন করিবে। কিছুদিন আগে সে ওয়েলসের টাইম মেশিন পড়িয়া মুগ্ধ হইয়াছিল। অমন একটি সময়-ভ্রমণের যন্ত্র পাইলে সে প্রথমেই তাহার মাকে দেখিতে যাইত।
কিন্তু তাহা যে হইবার নহে, প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে কে যাইতে পারে?
বই রাখিয়া কাজল দাওয়ায় আসিয়া দাঁড়াইল। শুক্লপক্ষের চতুর্থীর চাঁদ এর মধ্যেই পশ্চিমদিকে নারিকেল গাছগুলির মাথায় নামিয়া পড়িয়াছে। উঠানের আগাছার জঙ্গলে ঝি ঝি ডাকিতেছে যেমনটি আজ হইতে তেইশ বৎসর পূর্বেও ডাকিত।
বাড়িটা সারাইতে হইবে। নিশ্চিন্দিপুরের বাড়িটা নতুন করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। আর মৌপাহাড়ির বাড়িটাও ফেলিয়া রাখিলে চলিবে না। আজ তেলি-গিন্নির কথায় সে বুঝিতে পারিয়াছে বিশ্বসাহিত্যে তাহার বাবার নাম স্থায়ী হইয়া থাকিবে। আজ আরও কয়জন আসিতেছে, শীঘ্রই এমন দিন আসিবে যখন দর্শনার্থীর জন্য তাহার বাবার স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলিতে গ্রন্থাগার, অতিথিশালা এবং মিউজিয়ম প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। নিজের বাবার প্রতি স্বাভাবিক প্রীতি এবং ভক্তিবশত সে যে বাবার সাহিত্যকে অহেতুক গৌরবান্বিত করিতেছে এমন নহে, সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে এবং একনিষ্ঠ পাঠক হিসাবে সে নির্মোহ বিচার করিয়া বুঝিয়াছে অপূর্বকুমার রায়ের রচনা সততা, ঐকান্তিকতা ও মানবিকতার অনন্য প্রভায় উদ্ভাসিত। যুগে যুগে ইহার পাঠকের অভাব ঘটিবে না-এ সাহিত্য বাঁচিতে আসিয়াছে।
তিনদিন পর বাড়ি আসিবার সময় কাজল উঠানের চাপা গাছটা হইতে কয়েকটি পাতা সংগ্রহ করিয়া সুটকেসে ভরিয়া লইয়া আসিল।
কলেজ স্ট্রীটে একটি পত্রিকার স্টলে দাঁড়াইয়া কাজল মাসিকপত্রের পাতা উলটাইতেছিল। এই পত্রিকাতে সে কিছুদিন আগে একটি গল্প পাঠাইয়াছিল। এত বড়ো কাগজে তাহার গল্প ছাপিবে কিনা কে জানে! ডাকে পাঠানো গল্প তো সম্পাদকেরা বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলিয়া দিয়া থাকেন বলিয়া শোনা গিয়াছে। বিজ্ঞাপনের পাতাগুলির পর সূচিপত্রে আসিয়া হঠাৎ তাহার চোখ এক জায়গায় আটকাইয়া গেল। অমিতাভ রায় নামে একজন লেখকের একটা গল্প ছাপা হইয়াছে। বাঃ, তাহার নামে আরও সাহিত্য-যোথা লোক আছে তাহা হইলে! কিন্তু কিন্তু গল্পের নামও এক হয় কী করিয়া? কম্পিতহস্তে সে গল্পটা খুঁজিয়া বাহির করিল।
তাহারই গল্প। এই ডাল-ভাত-তরকারির সাধারণ পৃথিবীতে এমন ঘটনা সম্ভব হইল কী করিয়া? পকেটে কয়েকটা টাকা ছিল, তাহা দিয়া সে চার কপি পত্রিকা কিনিয়া লইল।
মানুষ মাঝে মাঝে এমন অনেক কাণ্ড করে যাহা সে আগের মুহূর্তেও ভাবে নাই, এবং পরেও যাহার কোনও সম্যক ব্যাখ্যা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। প্রথম শ্রেণির একটি পত্রিকায় তাহার গল্প বাহির হইয়াছে, এক্ষেত্রে প্রথমেই গল্পটা সে তাহার বন্ধুদের লইয়া দেখাইবে ইহাই সমীচীন। কিন্তু কিছুমাত্র না ভাবিয়া সে কলুটোলা পোস্ট অফিসে গিয়া বাহিরে যে পাবলিক রাইটার বসিয়া থাকে তাহার নিকট হইতে একটি কপি ভালো করিয়া র্যাপ করাইয়া লইল, পরে উপরে অপালার নাম লিখিয়া জিনিসটা পার্সেল করিয়া দিল।
গল্পটা লইয়া পাঠকমহলে বেশ আলোচনা হইল। একদল ভালো বলিল, একদল বলিলতেমন কিছু হয় নাই। কিন্তু পরিচিত এমন কিছু মানুষ, যাহাদের মতামতের উপর কাজল নির্ভর করে, তাহারা বলিল—রচনায় কিছু কিছু দুর্বলতা থাকিলেও গল্পের বিষয়বস্তু এবং ট্রিটমেন্ট একেবারে নতুন ধরনের। লেখক হিসাবে প্রশংসা পাইবার ব্যাপারটা কাজলের জীবনে নূতন, সে লক্ষ করিল খ্যাতির কেশ নেশা আছে।
দিন দশেক বাদে সে অপালার নিকট হইতে একটি চিঠি পাইল। অপালা লিখিয়াছে—আপনি পাঠাবার আগেই গল্পটা আমি পড়ে ফেলেছি, কারণ ওই পত্রিকার আমি গ্রাহক। তবুও আমাকে মনে করেছেন বুঝে খুব ভালো লাগল। বড়ো কাগজে নিজের প্রথম রচনা প্রকাশ হবার আনন্দ কেমন, তা আমি কোনদিন জানতে পারব না, কারণ আমি লিখি না—কিন্তু আনন্দের তীব্রতাটার সামান্য আন্দাজ করতে পারি। কলকাতায় এ আনন্দ ভাগ করে নেবার মতো বন্ধুর আপনার অভাব নেই, তা সত্ত্বেও এক কপি কাগজ আমাকে পাঠিয়েছেন।
নিজের সৃষ্টির জন্য প্রশংসা পাইবার একটা নেশা আছে, কাজল তাহা বেশ অনুভব করিল। দম্ভ ও অসন্তুষ্টি না আসিলে এই নেশাই প্রেরণার কাজ করে, পরবর্তী সার্থক সৃষ্টির পথে স্রষ্টাকে অগ্রসর করিয়া দেয়। কাজল আবার লিখিতে বসিয়া গেল।
বিখ্যাত মানুষের পুত্র হইয়া জন্মগ্রহণ করাটা অন্যের নিকট যতখানি সুখের বিষয় বলিয়া মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে ততটা নহে। বস্তুবাদী দর্শনের প্রভাবে আচ্ছন্ন বর্তমান যুগে অপূর্বকুমার রায়ের বিশ্বমুখী মানবিকতা এবং গভীর প্রকৃতিপ্রেম পাঠকসমাজকে মুগ্ধ করিয়াছিল। সময় কাটিবার সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা প্রকট হইতেছে। অপুর রচনার প্রয়োজনীয়তাও বাড়িতেছে। কাজল যেখানেই যায় সবাই তাহার বাবার নামোল্লখ করা মাত্র চিনিতে পারে, কাজলকে খাতির করিয়া দুই-একটা মিষ্টি কথা বলে। এ বড়ো কম গৌরবের কথা নহে। কিন্তু সব প্রদীপের নিচেই ছায়ান্ধকার থাকে। এক্ষেত্রেও তাহায় ব্যতিক্রম হয় নাই। গৌরবজনক পিতৃপরিচয়টা ভালো, কিন্তু জগতের তাবৎ মানুষের আকাঙ্ক্ষাপণের দায় যখন বিখ্যাত মানুষের পুত্রের ঘাড়ে আসিয়া পড়ে, তখন সে বেচারির নিজের জীবনটায় ক্রমাগত বো বড়ো গোযোগ বাধিতে থাকে। কাজলের জীবনে এইবার সেই পর্যায় শুরু হইল।
একদিন বিখ্যাত একটি বাংলা সংবাদপত্রের চিঠিপত্রের স্তম্ভে অপুর স্মৃতিরক্ষার প্রসঙ্গে একটি পত্র প্রকাশিত হইল। পত্ৰলেখক অপুর জনৈক ভক্ত। তিনি জানিতে চাহিয়াছেন আধুনিক বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক অল্প বয়েসে মারা গিয়াছেন বলিয়া কি সবাই তাহাকে ভুলিয়া গিয়াছে? তিনি সম্প্রতি নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম দেখিতে গিয়াছিলেন, সেখানে লেখকের আদি বাসভবন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। মৌপাহাড়িতে লেখকের মৃত্যু হয়—সেখানেও স্মৃতিরক্ষার কোনও ব্যবস্থা নাই। অপূর্ব রায়ের সাহিত্য চিরজীবী হইবে বলিয়া তিনি মনে করেন, অবিলম্বে সকলে কাজে না লাগিলে ভবিষ্যৎ যুগের মানুষের নিকট গালি খাইতে হইবে।
এই চিঠি বাহির হইবার পর একই পত্রিকায় আরও কয়েকটি পত্র প্রকাশিত হইল। তাহাদের লেখক আলাদা হইলেও মর্ম এক।
মনসাপোতায় ঘুরিয়া আসিয়া কাজলেরও মনে হইয়াছিল বাড়িটার মেরামত প্রয়োজন। যাহারা তাহার বাবাকে ভালোবাসে, তাহাদের এরুপ দাবি করিবার অধিকার আছে বটে। হৈমন্তীর সঙ্গে পরামর্শ করিয়া সে তেলি-গৃহিণী এবং রানুদিকে চিঠিসহ কিছু টাকা পাঠাইয়া দিল। ঠিক করিল, মৌপাহাড়িতে নিজে গিয়া বাড়িঘর সারাইয়া আসিবে।
রানুদিকে লিখিল বাবার কেনা সাম্প্রতিক বাড়িটাকে মেরামত করিতে। পুরানো ভিটা যেমন আছে এখন থাকুক।
পরীক্ষার একেবারে মুখে মুখে কাজল রানুদি এবং কুণ্ড-গৃহিণীর চিঠি পাইল। বাড়ির কাজ হইয়া গিয়াছে। কাজল যেন গিয়া দেখিয়া আসে।
রানুদিদি নিজেই তাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেল।
ভালো করিয়া কান পাতিলে যেন হারানো মানুষগুলির কণ্ঠস্বর শুনিতে পাওয়া যাইবে।
বিকাল হইয়া আসিয়াছে। অপরাহের বিদায়ী সুর লাগিয়াছে দিবসবীণার তন্ত্রীতে। কোথাও কোনো শব্দ নাই, কেবল একটা নাম-না-জানা পাখি কিচমিচ্ করিয়া পাতার আড়ালে লুকাইয়া ডাকিতেছে। অকস্মাৎ বিচিত্র এক অনুভূতিতে কাজলের শিহরিয়া উঠিল। সময় অদ্ভুত জিনিস। মানুষের যা কিছু একান্ত প্রিয়, একান্ত আপন, সবই মহাকালের স্রোতে কেমন অনিবার্যভাবে বিস্মৃতিব মোহনাব দিকে বহিয়া যায়। আজ যাহা নিতান্ত বাস্তব, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ হাসিকান্না লইয়া যে বৃহৎ সংসারটা—আগামীকাল তাহা তাৎপর্যহীন ইতিহাসে পরিণত হয়। যদি না তাহার বাবার মতো হে একটা দাগ কাটিয়া যায়, তাহা হইলে কেহ তাহাকে মনে রাখে না। এই যে আজ পৈতৃক ভিটায় দাঁড়াইয়া তাহার পবিত্র অনুভূতি, রানুদিদির ভালোবাসা-হাজার বৎসর পরে কে মনে রাখিবে? চলিয়া তো যাইতেই হইবে, তবু ইহসর্বস্ব মানুষ অর্থ খ্যাতি প্রতিপত্তির জন্য কত লালায়িত হয়। কাজলের মহাভারতের শ্লোক মনে পড়িল—অহনহনি ভূতানি…।
বেলা একেবারেই পড়িয়া আসিয়াছে। তাহারা দুইজন বাড়ির দিকে ফিরিল।
এইবার নিশ্চিন্দিপুর ভ্রমণে কাজলের এমন একটা অভিজ্ঞতা হইল, যাহা আগে কখনোই হয় নাই। বস্তুত অপ্রত্যাশিত স্থান হইতে আঘাত পাইয়া তাহার মন হঠাৎ খুব দমিয়া গেল। এখন সে অন্যত্র থাকে বটে, কিন্তু এই গ্রামের মাটির সহিত তাহার অন্তরের নিগুঢ় যোগাযোগ আছে, এখানকার মানুষকে সে নিতান্ত আপন বলিয়া মনে করে। এইবার চলিয়া আসিবার পূর্বে সতু তাহাকে ডাকিয়া বলিল—তুমি কি আজই চলে যাচ্ছো নাকি?
–হ্যাঁ সতুকাকা। সামনে আমার পরীক্ষা, পড়া আছে। নইলে আরও দু-একটা দিন থাকতে পারলে ভালো হত–
–হুঁ, তা আবার আসবে কবে?
—পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই একবার ঘুরে যাব। চাবি রানুপিসির কাছে রইল।
-চাবির কথা হচ্ছে না, তোমাকে একটা দরকারি কথা বলি শোনন, অপুর বইয়ের তো বাজারে খুব নাম, আজকাল তোমাদের ভিটে দেখতে বহু লোক আসে। কোনো একটা ছুটির দিন এলে দেখবে বাড়ির সামনে মেলা বসে গিয়েছে। আবার শুনছি মহকুমা শহরের ইস্কুলের ছেলেরা এক বছর তোমাদের ভিটেয় অপুর জন্মদিন পালন করবে। তা তোমার কর্তব্য এখন এখানে একটা পাকাপাকি রকমের কিছু ব্যবস্থা করা। চাবি তত দিয়ে যাচ্ছে, তার হ্যাপা সামলাবে কে? রোজ নিত্যিদিন লোক এসে যদি বাড়ি দেখতে চায়, আমি তো কাজকর্ম ফেলে দৌড়তে পারব না? তার কী ব্যবস্থা করে যাচ্ছো?
কথাগুলি শুনিতে কিঞ্চিৎ কটু হইলেও ন্যায়সঙ্গত বটে। কাজল গ্রামের মুখুজ্যেবাড়ি হইতে ঈশানীবালা নামে এক বৃদ্ধাকে খুঁজিয়া বাহির করিল। তাহার স্বামী পরেশনাথ কলিকাতায় চাকরি করিতেন, বছর দশেক হইল গত হইয়াছেন। জমিজমা বিষয়সম্পত্তি কিছুই নাই, চলাচলতির ভয়ানক কষ্ট। মাসিক ত্রিশ টাকার বিনিময়ে তিনি অপুর নবনির্মিত বাড়িতে থাকিয়া দেখাশুনা করিতে রাজি হইলেন। তাঁহার নিজের বাড়িও জীর্ণ প্রায়, বৃষ্টি হইলে ঘরের সর্বত্র হুহু করিয়া জল পড়ে। দেওয়ালেরও যা অবস্থা, বড়ো রকমের একটা ঝড় হইলেই ধসিয়া পড়িবে। এমতাবস্থায় ঈশানীবালার রাজি না হইবার কথা নহে। কাজল কিছুটা নিশ্চিন্ত হইল, পিতৃপুরুষের ভিটায় অন্তত সন্ধ্যাবাতি পড়িবে।
রওনা হইয়া আসিবার সময়ে কাজল ব্যাগ হাতে একবার তাহাদের বাড়িটা দেখিয়া আসিতে গেল। সঁড়িপথের বাঁক ফিরিবার পূর্বেই শুনিল উঠানে দাঁড়াইয়া কাহারা কথা বলিতেছে। পথের মোড় ঘুরিয়া দেখিল তাহাদের বাড়ির দাওয়ায় তিন-চারজন লোক বসিয়া রহিয়াছে। তাহাদের মধ্যে একজন গ্রামেরই মানুষ, কাজল চেনে, কিন্তু নাম জানে না। তাহাবা চলিয়া যাইবাব পবে নিশ্চিন্দিপুরে অনেক নতুন লোক আসিয়া বসবাস করিয়াছে, সকলের সঙ্গে তাহার পরিচয় হয় নাই।
গ্রামের মানুষটি অন্য তিনজন ভদ্রলোকের দিকে তাকাইয়া কাজলকে দেখাইয়া বলিলেন–এই ইনিই অপূর্বাবুব ছেলে—
আগন্তুক ভদ্রলোক তিনজন যেন একটু কৌতূহলের সহিত কাজলের দিকে তাকাইলেন। কাজল বলিল–নমস্কার।
প্ৰতিনমস্কাব করিয়া তাহাদের মধ্যে একজন বলিলেন—আপনিই অপূর্বকুমার রায়ের ছেলে? আসুন, উঠে এসে এইখানটায় বসুন।
কাজলের মনে মনে হাসি পাইল, কাহাব বাড়িতে কে আমন্ত্রণ জানাইতেছে! পরমুহূর্তেই যেন কাজলের অন্তরের কথার প্রতিধ্বনি করিয়া ভদ্রলোক বলিলেন—আমরা কিন্তু এখানে অতিথি নই। সেজন্যই আপনাকে ডেকে বসতে বললাম। অপূর্ববাবু শুধু আপনার বাবা নন, তিনি সমস্ত দেশের মানুষের সম্পত্তি। তা এখানে তার স্মৃতিরক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই?
কাজল সবিনয়ে জানাইল-চেষ্টা চলিতেছে, তবে কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয় নাই।
আগন্তুক বলিলেন—কিছু মনে করবেন না, এ বিষয়ে কিন্তু লেখকের ফ্যামিলি হিসেবে আপনাদের আর একটু উদ্যোগী হওয়া উচিত। মানুষ অনেক আশা নিয়ে এখানে আসে।
গ্রামের অচেনা ভদ্রলোক বলিলেন—আমিও তাই বলি। আপনার উচিত শহরের বাস ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে থাকা
কাজল অবাক হইয়া বলিল—তা কি সম্ভব? আমার পড়াশুনো আছে তো—
আগন্তুকদের একজন বলিলেন—আপনি কী পড়েন?
–আমি এইবার এম.এ. দেব।
–তাহলে তো প্রায় শেষ করে এসেছেন। তারপরে এখানে থাকতে বাধা কী?
কাজল বলিল—পড়া শেষ হলেই তো সবকিছু শেষ হয় না। বরং সেখান থেকেই জীবনের শুরু। গ্রামে থেকে আমার কাজকর্ম
—আপনার বাবার তো আটকায় নি। এ গ্রামের মানুষ হয়েও তিনি বড়ো লেখক হয়েছেন।
—আমার বাবার জীবনী বোধহয় আপনারা ঠিক জানেন না। খুব ছোটবেলায় তিনি এ গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর সারাজীবন কেটেছে কলকাতায়, কাশীতে, মধ্যপ্রদেশের গভীর জঙ্গলে—আরও কত জায়গায়। গ্রামে আর কোনদিনই ফিরে আসতে পারেন নি। ভ্রমণ না করে নিশ্চিন্দিপুরে থেকে গেলে তিনি কী লেখক হতে পারতেন?
গ্রামের মানুষটি ঈষৎ রাগতস্বরে বলিল—তাহলে এই গ্রামের প্রতি আপনার যে একটা কর্তব্য এবং দায়িত্ব আছে সেটা আপনি অস্বীকার করতে চান?
আরও প্রায় আধঘণ্টা কাজল তাহাদের চাবজনকে বোঝাইবার চেষ্টা করিল—সে পলায়নপর উদাসীন নহে। মধ্যবিত্ত সংসারেব বিভিন্ন গ্রাস হইতে বাঁচাইয়া এই বাড়িটা নতুন করিয়া বানানো হইয়াছে। এরপর মনসাপোতার এবং মৌপাহাড়ির বাড়িটাও ঠিক করিতে হইবে। সে একমাত্র ছেলে, কত দিকে একসঙ্গে তাহার পক্ষে দৌড়ানো সম্ভব?
লোকগুলি বিশেষ বুঝিল বলিযা মনে হইল না। তাহাবা কাজলের প্রতি কথাব উত্তবে নানান সম্ভব-অসম্ভব যুক্তি দেখাইতে লাগিল। গ্রামেব ভদ্রলোকটি তো মনে হইল কাজলের উপব কোনো অজ্ঞাত কাবণে ভয়ানক চটিয়া বহিছেন। এইটাই কাজলের মনে বেশি করিয়া লাগিল। তাহার নিজের গ্রামের মানুষ কিনা তাহাকে ভুল বুঝিয়া তিরষ্কার করিতেছে! তাহাদেব স্বপ্নের নিশ্চিন্দিপুরের মানুষ! তাহার বাবার স্মৃতিরক্ষার প্রসঙ্গে তাহার দায়িত্বেব কথা সে ভালো করিয়াই জানে, এবং সে তাহা অস্বীকারও করিতেছে না। কিন্তু তাহার নিজেরও তো একটা জীবন আছে। সে বাবার মতো লেখক হইতে চায়, পৃথিবীটা ঘুরিয়া দেখিতে চায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, নিজের মতো করিয়া বাঁচিতে চায়। অপূর্বকুমার রায় যেমন তাহার একাব বাবা নহে, সমস্ত দেশবাসীর গর্বের স্থল, তাহার স্মৃতিরক্ষার বিষয়েও তো দেশবাসীর মনোযোগী হওয়া উচিত।