কখনো জীবনের খেরোখাতার হিসাব বাতাসে উড়ে যায়। মানুষ সব হিসাবের উর্ধ্বে উঠে গেলে যোগ-বিয়োগের ব্যাখ্যায় সে হিসাবের রশি টানা যায় না। একটি একটি গিট খুলে গেলে রশি লম্বায় বাড়াতে হয়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত টানা হয় সে রশির সীমানা।
আকমল হোসেন-আয়শা খাতুন এমন উপলব্ধিতে নিচুপ হয়ে গেছেন। মেরিনার সঙ্গেও ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না। বড় বেশি নির্মম সত্যের সাক্ষী হওয়া মানুষ হয়ে বোকার মতো তাকিয়ে থাকেন মেরিনার দিকে।
মেরিনা রেগে গিয়ে বলে, আপনারা এমন করে বাড়িটাকে ভুতুড়ে বানাচ্ছেন কেন? ভুলে যাচ্ছেন নাকি যে এটা গেরিলাযোদ্ধাদের আশ্রয়বাড়ি? ওরা এমন ভুতুড়ে বাড়ি দেখলে ভুলেও কেউ আর এখানে পা ফেলবে না।
মায়ের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে মেরিনা বলে, কী, কথা বলবেন না, আম্মা?
আমি তো তোর কথা শুনতে পাচ্ছি, মা। বল না, কী বলবি?
মেরিনা মায়ের কথা শুনে বাবার দিকে তাকায়।
আব্বা, আপনি কি আমার কথা শুনেছেন?
শুনেছি। তুই কিছু বলবি?
না। আমি আপনাদের ভূত তাড়াতে চেয়েছি। যাই নিজের ঘরে।
মেরিনা চলে যাওয়ার পরও দুজন চুপচাপ বসে থাকেন। দু-চারটি টেলিফোন আসে। কথা বলেন। কথা তেমনভাবে জমে না। কেমন আছ, ভালো আছি জাতীয় কথা। রাত বাড়লে ভাত খান। ঠিকমতো খেতেও পারেন না। আয়শা খাতুন একবার বলেন, আমার শরীর খারাপ লাগছে।
তাই বলেন, সে জন্য আপনি এমন গুটিয়ে বসে আছেন? আব্বা, আপনার কেমন লাগছে?
আমি জানি না, কেমন লাগছে। তবে তেমন খারাপ বোধ হয় নয়।
মেরিনা সপ্রতিভ কণ্ঠে বলে, যাক, বাঁচালেন।
খাওয়া শেষ হলে মেরিনা বাবা-মাকে শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বিছানা গুছিয়ে দিল। আয়শা খাতুন বিছানায় গেলেন। আকমল হোসেন পড়ার টেবিলে বসলেন।
রাতে দুজনের কারোরই ঠিকমতো ঘুম হলো না।
ভোর হলো। শেষ রাতের দিকে খানিকটা ঘুমিয়ে উঠে পড়লেন দুজনে। দিনের শুরু থেকে এরকম কাটল। দুপুরের পর থেকেই আয়শা খাতুন বলছেন, ভালো লাগছে না। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।
আকমল হোসেন আয়শার কপালে হাত রেখে বললেন, জ্বর আসেনি। গা ঠান্ডা দেখছি। আমি আশরাফকে ফোন করে দেখি ও কী ওষুধের কথা বলে।
মাথাব্যথার জন্য তোমার ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করার দরকার নেই। আশরাফ টিপ্পনী কাটবে।
মেরিনা হাসতে হাসতে বলে, ডাক্তার চাচা মজার মজার টিপ্পনী কাটে। শুনতে ভালোই লাগে।
আজ আমার শুনতে ভালো লাগবে না, মা। তোমরা আমাকে জ্বালিয়ে না। আমাকে একা থাকতে দাও। শরীর ঠিক হয়ে যাবে।
আব্বা, আপনি আম্মার কথা শুনবেন না।
ঠিকই বলেছ। আমি আশরাফকে দেখছি।
আকমল হোসেন ফোন ঘোরান। পাওয়া যায় আশরাফকে। মাথাব্যথার কথা শুনে ঝাড়ি দিয়ে বলে, মাথাব্যথা না ছাই। তোমার পিরিতের যন্ত্রণা। তোমার পিরিত কমাও, বন্ধু। আপাতত একটা পেইন কিলার খাওয়াও। আমি বিকেলে এসে দেখব।
আকমল হোসেন প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখার বাক্স থেকে একটা নোভালজিন ট্যাবলেট এনে আয়শাকে খাইয়ে দিয়ে বলেন, আপাতত চুপচাপ শুয়ে থাকো। নিশ্চয়ই কমে যাবে।
আমি বিছানায় গেলাম। দেখি, ঘুম আসে কি না।
মেরিনা মায়ের হাত ধরে শোবার ঘরে নিয়ে আসে। বলে, আপনার জ্বর আসবে, আম্মা। গা গরম হচ্ছে। জ্বর কত উঠবে আল্লাহই জানে। মাথায় জলপট্টি দেব।
আমি একা থাকতে চাই, মা। আমার কিছু ভালো লাগছে না। দিনের বেলা হলেও মশারিটা ঠিকমতো খুঁজে দে। মশার উৎপাত বেড়েছে।
মেরিনা মশারি খুঁজতে খুঁজতে বলে, মাহমুদার ঘটনা কী…
মেয়েটা আমার ভেতরটা তোলপাড় করে দিয়েছে। পাকিস্তানি আর্মির হাতে নির্যাতিত হয়েও ও ভেঙে পড়েনি। কত বড় সাহসী কাণ্ড ঘটাল। বাড়ির একটি লোকও বাঁচল না। এমন একটা বীর মেয়েকে আমার স্যালুট করা উচিত।
আম্মা, আম্মা…
মেরিনা বুঝতে পারে, ওর মা আচ্ছন্নের মতো কথা বলছেন। মাহমুদার ঘটনা ওর মাকে বিধ্বস্ত করে রেখেছে। ওর দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডের পর দিনরাত এক হয়ে গেছে আয়শা খাতুনের। মায়ের দিকে তাকিয়ে মেরিনা নিজেও বিষণ্ণ হয়ে যায়। মাহমুদা ওকেও যন্ত্রণাবিদ্ধ করে। ও আস্তে করে ডাকে, আম্মা আম্মা…
আয়শা খাতুন নিমীলিত চোখে তাকান। বলেন, বাতি বন্ধ করে দে।
তারপর চোখ বোজেন। মেরিনা বাতি বন্ধ করে চলে যায়। দরজা টেনে দেয়। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। মনে হচ্ছে, কোথাও একঝাক মৌমাছি গুনগুন করছে। আয়শা বিছানায় উঠে বসেন। আবার শুয়ে পড়েন। একসময় নেতিয়ে আসে শরীর। তার আর কিছু মনে থাকে না। স্মৃতিতে ভেসে থাকে হাজার হাজার মৌমাছির ওড়াউড়ি।
আকমল হোসেন সন্ধ্যায় ঘরে এসে মশারি উঠিয়ে আয়শার কপালে হাত রেখে চমকে ওঠেন। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কী করব, ভাবলেন। ডেকে তোলা ঠিক হবে। পুরোনো কাপড় ছিঁড়ে জলপট্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। মেরিনাকে ডাকলেন। অনেকক্ষণ জলপট্টি দেওয়ার পরে তাঁর মনে হলো জ্বর খানিকটা কমেছে। ভাবলেন, একটু দুধ বা হরলিকস খাওয়ালে বোধ হয় স্বস্তি পাবে।
মৃদুস্বরে ডাকলেন, আশা।
সাড়া নেই। ঘুমের মধ্যেও মুখমণ্ডলজুড়ে বিষণ্ণতা ম্লান করে রেখেছে চেহারা। আকমল হোসেন বিপন্ন বোধ করেন। আয়শাকে কখনো এত বিষণ্ণ দেখেননি। মাহমুদার ঘটনা কি তাকে এতই বিপর্যস্ত করেছে? সাহসী মেয়েটির সাহসকে কেন দেখবে না আয়শা? পরক্ষণে ভাবলেন, এভাবে ভাবলে আয়শার প্রতি অবিচার করা হবে। আয়শা নিজেও বলেছেন, মেয়েটি বোমা ফাটিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে বাড়িটাকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়েছে। এমন কথা বলার পরও মাহমুদার মৃত্যু আয়শাকে প্রবলভাবে ঘায়েল করেছে।
তিনি স্ত্রীর মুখের ওপর ঝুঁকে আবার ডাকলেন। সাড়া নেই।
ভাবলেন, তাঁর কাছে বসে থাকা উচিত। যদি নিজে নিজে ওঠেন। যদি কিছু চান। পানি কিংবা অন্যকিছু। কিংবা যদি তাকেই খোঁজেন? যদি বলেন, তুমি কি আমার কাছে একটু বসবে? দেখো তো আমার পালস ঠিক আছে কি না? তুমি আমার হাতটা ধরে রাখো।
আকমল হোসেন নিজের টেবিলে বসলেন। কাগজপত্র খুললেন। সকালের কাগজ আবার পড়বেন বলে উল্টালেন। সকালে পড়েছিলেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় বিষয় নোট করা হয়নি। এখন ডায়েরিতে লিখবেন বলে পাতা খুললেন—৭ আগস্ট, শনিবার গোলাম আযম কুষ্টিয়ার পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে শান্তি কমিটির সভায় বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিব ও বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে আঁতাত করে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে দেশের মানুষ আজ অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে। আমাদের ভাবী বংশধরেরা কোনো দিন এসব বেইমান ও বিশ্বাসঘাতককে ক্ষমা করবে না। দেশকে এদের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারলে আমাদেরও জবাবদিহি করতে হবে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন কুষ্টিয়ার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাদ আহমেদ। সভায় যোগ দেন পশ্চিম পাকিস্তানের দুজন জামায়াত নেতা। একজন পাঞ্জাব থেকে নির্বাচিত এমএনএ নাজির আহমদ। আরেকজন রাওয়ালপিন্ডির রাজা মোহাম্মদ বারাসাত।
আকমল হোসেন নোট করার পর দেখলেন, কলমের কালি শেষ। দোয়াত থেকে কালি ভরলেন কলমে। আয়শার দিকে তাকালেন। ও গুটিসুটি শুয়ে আছে, যেন নিজেকে একটি পুঁটলি বানিয়েছে—নাকি ফসফরাস বোমা কিংবা গ্রেনেড? আকমল হোসেন চেয়ারে মাথা হেলান দিলেন। কলমের কালি পরীক্ষা করেন। মনে করেন, যুদ্ধের সবটুকু ইতিহাস তাঁকে লিখতেই হবে। মাহমুদা তার বুকের ভেতরের সবটুকু ভিত নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ওর কথা ভেবে তিনি বিপন্ন বোধ করেন। চোখে পানি আসে। তিনি দুহাতে পানি মুছে আবার পত্রিকার পাতায় চোখ রাখেন।
নেত্রকোনায় শান্তি কমিটির সভা হয় বাংলা প্রাইমারি স্কুল প্রাঙ্গণে। কমিটির নেতা ফারুক আহমদ বলেন, পাকিস্তান টিকে না থাকলে মুসলমানদের ধর্ম, কৃষ্টি, তাহজিব-তমদুন, ইজ্জত—কিছুই রক্ষা হবে না। চব্বিশ বছর আগে এ দেশের মুসলমানরা যেমন অধিকারবঞ্চিত ও অবহেলিত ছিল, ঠিক তেমনি অধিকারহীন হয়ে হিন্দুদের গোলামে পরিণত হবে। আর এ জন্যই শেখ মুজিব ও তাঁর বাহিনী চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতে কোনো শক্তি পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না।
সভার সভাপতি বলেন, এই ডাকাতদল দেশকে মুক্ত করার নামে হিন্দুদের দাসত্বে আবদ্ধ করতে চায় জাতিকে। কাজেই এদেরকে মুক্তিবাহিনী বলা ন্যায়সংগত নয়। আকাশবাণীর জঘন্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রচারণা কোনো মুসলমানেরই শোনা উচিত নয়।
আকমল হোসেন দ্রুত চোখ বোলালেন অন্যান্য খবরের ওপর। দেশজুড়ে রাজাকাররা কত কী করছে তার একটা খতিয়ান করলেন ডায়েরির পাতায়। ভাবলেন, এখন কি ঘুমোতে যাবেন? নাকি এই চেয়ারে বসে রাত কাটিয়ে দেবেন? ভোরের অপেক্ষায় থাকবেন? আয়শার ঘুম ভাঙলে বলবেন, চলো, সূর্য ওঠা দেখি। গতকাল রাব্বানী বলেছে, তোমার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা বেশি। বাসাটা ছাড়বে কি না ভেবে দেখো। আর তা না করলে তুমি একা থাকো। আয়শা আর মেরিনাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দাও।
আকমল হোসেন রাব্বানীকে বলেন, সবাই মিলে এই বাড়িটাকে দুর্গবাড়ি বানিয়েছে। এই বাড়ি ছেড়ে আয়শা-মেরিনা অন্য বাড়িতে প্রাণ বাঁচাতে যাবে না। ওরা এই বাড়ির প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। রাব্বানী মিনমিন করে বলেছিল, সবই বুঝি, কিন্তু পরিস্থিতি সামলেও চলতে হবে।
তিনি ভাবলেন, গেরিলাযোদ্ধাদের আশ্রয়ের ঠিকানা ভেঙে ফেলা ঠিক নয়। বিভিন্ন অপারেশনে গেরিলাদের সহযোগিতা না দিলে চলবে কেন? রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সুইপার রাবেয়া আর পরদেশী নির্যাতিত মেয়েদের খবর নিয়ে কার কাছে যাবে? না, এ বাড়ি ছাড়া চলবে না। তবে আরেকটু সাবধান হতে হবে।
তিনি চেয়ারে মাথা হেলিয়ে ঘুমোতে চাইলেন। টেবিল-ল্যাম্প নেভালেন। ভাবলেন, ল্যাম্পের চারপাশে পিপড়েরা ভিড় করুক। ওরা আলোর কাছে জীবনের সমাপ্তি টানুক। মানুষেরও উচিত আলোর কাছে জীবনের সমাপ্তি টানা। স্বাধীনতাযুদ্ধ তো আলোর সময়। একজন মানুষের গৌরবের অর্জন সারা জীবনের সঞ্চয়। মাহমুদা আলোর সময়ে বীর নারী হয়েছে। এই নারীর স্মৃতি এই পরিবারের সবার জীবনের সঞ্চয়। মানুষ নিজে সঞ্চয় করে, অন্যের সঞ্চয়ও মানুষ নিজের মধ্যে রাখতে পারে। ওহ, এভাবেই ইতিহাসের পাতা ভরাবেন তিনি। যুদ্ধের ইতি ও নেতির সবটুকু তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আকমল হোসেন দেখলেন, টেবিল-ল্যাম্পের চারপাশে পিপড়েরা উড়ে আসতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে বাড়ছে। দু-একটা ডানা ঝাপটে পড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য, পিপীলিকার পাখা হয় মরিবার তরে—এমন একটি প্রাকৃতিক নিয়ম, হায় বিধাতা! তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, তোমাদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিলাম। মৃত্যু যে আলো, এই সত্য তোমাদের চেয়ে বেশি আর কে বোঝে! তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ান।
সাত দিনের মাথায় আয়শা খাতুন উঠে বসলেন। প্রতিদিন এসেছেন ডা. আশরাফ। সারাক্ষণই চিন্তিত থেকেছেন। আকমল হোসেনকে বলেছেন, বুঝতেই পারছি না ব্যাপারটা। সব ধরনের রক্ত পরীক্ষা করালাম। কিছুই পাওয়া গেল না। আমার মনে হয়, কোনো বড় ধরনের সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম থেকে এই অসুস্থতা হতে পারে। ভাবির অসুস্থতা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে।
আকমল হোসেন ধীরে ধীরে মাহমুদার কথা বলেন। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত মাহমুদা কীভাবে শান্তি কমিটির নেতার বাড়িতে বোমা ফাটিয়েছে, সে কথা বলেন।
ও যে আর ফিরে আসতে পারেনি, সেটাও কষ্ট হয় আশরাফের কাছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলেন, বুঝেছি। ভাবির অসুস্থতা নিয়ে আমাকে আর ভাবতে হবে না। তবে বিপদ কেটে গেছে। দুএক দিনের মধ্যে পুরো সুস্থ হয়ে যাবেন।
মেরিনা চা নিয়ে আসে।
আশরাফ জিজ্ঞেস করেন, তুমি কেমন আছ, মা?
ধাক্কাটা আমি সামলাতে পেরেছি। আম্মা পারেননি।
বুঝেছি। দুদিন ধরে ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের বাড়িতে একজন যোদ্ধাকে দেখতে হয়েছে। রেকি করতে গিয়ে বুকে গুলি লেগেছে।
কেমন আছে? সুস্থ হবে তো?
মেরিনার কণ্ঠে উদ্বেগ।
বিপদ কেটে গেছে। সুস্থ হতে এখন যে কয় দিন লাগে।
কয় দিন লাগতে পারে?
আমি মনে করছি, সাত-আট দিন লাগবে। তারপর ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে পুরো বিশ্রামের জন্য। ওর বাড়িতে পাঠানো যাবে না। অন্য কোথায় রাখব, তা খোঁজ করছি।
ওরা কেউই বিশ্রাম নেবে না, চাচা। ওই একটি শব্দ ওরা বাতিল করে দিয়েছে।
তুমি দাওনি, মা?
হ্যাঁ, আমিও দিয়েছি। যুদ্ধের ভেতরে কত হাজার রকম কাজ থাকে, সেগুলো তো করতে হয়।
আশরাফ মৃদু হাসেন। হাসিতে আনন্দ। সময় জয়ের গল্প এখন চারদিকে। কোনো কিছুই থেমে নেই। ছুটছে আপন নিয়মে। কখনো প্রবল তীব্রতায়, কখনো নিজস্ব নিয়মের স্বচ্ছতায়। ছুটতেই হবে।
আশরাফ কপালের ওপর পড়ে থাকা এলোমলো চুল হাত দিয়ে মাথার ওপরে ঠেলে দিয়ে বলেন, সজীবের বুকে গুলি লাগলে ওকে একটি লাল শার্ট পরিয়ে স্কুটারে করে ধানমন্ডিতে আনে শিপন। একজন রক্তাক্ত মুক্তিযোদ্ধার পাশে আরেকজন। প্রত্যেকেই দ্রুত বুঝে নেয় যে কী করতে হবে। ওরা এই শহরের আকাশে আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।
কথা শেষ হলে আকমল হোসেন বলেন, আমাদের সময়টা এমন। আশরাফ খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে বলেন, সময়টা এখন ঝুঁকির এবং মৃত্যুর।
না, চাচা, শুধু মৃত্যুর না, সাফল্যেরও। আমরা স্বাধীনতার পথে এগোচ্ছি। আমরা জয়ী হবই।
মা, তোমাকে দোয়া করি।
আশরাফ চায়ে চুমুক দিয়ে কাপ টেবিলের ওপর রাখলে ঠক করে শব্দ হয়। শব্দটা ঘরে টুনটুন করে বাজে। তিনজন মানুষ চারদিকে তাকায়। মনে হয়, একটি স্কুটার রক্তাক্ত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে এবং ফার্মগেটের ভাড়া করা বাড়িতে অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে যোদ্ধারা। টার্গেট পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর মোনায়েম খানের বাড়ি। বাষট্টি সালে গভর্নর হয়ে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের হুকুমের দাস হয়েছিল লোকটি। নিজে বাঙালি। তার জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্য আর সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের প্রতি তার কোনো অঙ্গীকার ছিল না। উল্টো অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় আইয়ুব খানের পতনের আগে তার বিদায় হয়। তারপর বেশ কিছুকাল লোকচক্ষুর আড়ালে গোপনে ছিল। এখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেয় তাকে খতম করার।
একজন বলে, আমি একাই পারব। দুই দিন তার বনানীর বাসা রেকি করেছি। দরজা খোলা রেখে সন্ধ্যায় চামচাঁদের নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসর জমায়। ওকে মারতে আমাদের দুই জন লাগবে না।
ঠিক তো?
একদম ঠিক। দরকার হলে আরও একদিন রেকি করব। রেকি করতে আমাকে সহযোগিতা করছে বাড়ির গরুর রাখাল। ওর সঙ্গেই আমি একদিন ভেতরে ঢুকেছিলাম। কোথায় থেকে কী করা যায়, সব দেখে এসেছি। যেদিন আক্রমণ করতে যাব, সেদিন পেছনের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকব। সামনের গেট দিয়ে ঢাকা রিস্কি হবে। লোকটা একটা নরকের কীট। ওকে ধ্বংস করতে চারজন মুক্তিযোদ্ধার শক্তি ব্যয়ের দরকার নেই।
আরেকজন বলে, একই দিনে আমরা আরও একটি ঘটনা ঘটাতে চাই।
কোথায়?
কোথায় ঘটাব সেটা বুঝতে হবে।
লালবাগের শান্তি কমিটির নেতা আমাদের তালিকায় আছে। আমি ঠিক করেছি, সকাল থেকে ওর বাড়ির সামনে থাকব। বের হলে পিছু নেব। তারপর সুযোগ বুঝে গুলি।
গুলি! আশরাফ চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে আবার রাখেন। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসে শব্দটি, গুলি! মাথা ঝাঁকিয়ে নেন। যুদ্ধের সময় গুলির ছোঁয়া দুপক্ষকেই নিতে হয়। তবে যোদ্ধারা নেয় বুকে, আর শত্রুপক্ষের কাপুরুষেরা নেয় পিঠে! আশরাফ মেরিনার ডাকে ঘুরে তাকান। মেরিনা বলে, আমি কি আপনার জন্য আরেক কাপ চা আনব, চাচা?
হ্যাঁ, মা। আমি আরেক কাপ চা চাই।
মেরিনা উঠে গেলে আকমল হোসেন বলেন, ফার্মগেট এলাকায় আমরা একটি চমৎকার দুর্গবাড়ি পেয়েছি। বেশ জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। নিরাপদও মনে হয়। ছেলেরা তাই বলে। আমি একটু পরে ওখানে যাব। মাসের ভাড়ার টাকা দিয়ে আসব। আর গেরিলাদের পরবর্তী পরিকল্পনার কথাও জানব।
আমি বুকে গুলি নেওয়া ছেলেটিকে দেখে বাড়ি যাব। ভেবে আনন্দ পাই যে ঘরকুনো বাঙালির ছেলেরা কত অনায়াসে গুলির সঙ্গে যোঝযুঝি করছে। আমাদের আর কেউ ভিতু বলতে পারবে না।
থাক, নিজেদের গুণ আর নিজেদের গাইতে হবে না।
ঠিক বলেছিস। এখন বিশ্ববাসী গাইবে। ওই চায়নিজরা এবং আমেরিকানরাও গাইবে। যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তাদেরকে এর মূল্য দিতেই হবে। এখন উঠছি।
আশরাফ মেরিনার দেওয়া চায়ের কাঁপে শেষ চুমুক দেয়। প্রাঙ্গণে রাখা নিজের গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার আগে আলতাফকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কেমন আছ, আলতাফ?
ভালো নেই। একদম ভালো নেই। শরীরের চেয়ে মন বেশি খারাপ।
কী হয়েছে?
গ্রামে আমার ভাইটি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। বাবাকে বলেছি ত্যাজ্যপুত্র করতে। বাবা করেছেন। শয়তানটা বলেছে, ত্যাজ্যপুত্র করলে কী হবে, আমি বাবাকে ত্যাজ্য-বাবা করলাম। আর আমার বড় ভাইকে করলাম ত্যাজ্য-ভাই। ওর মুখ দেখতে না পেলে আমার কিছু আসবে-যাবে না। ও এত বান্দর হলো কেন ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারি না।
দুঃখ পেয়ো না। নিজেদের একদল মানুষ তো এমনই করছে। দেখছ না চারদিকের অবস্থা। চেনা মানুষও খোলস বদলে ফেলে।
আলতাফ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, আমার একটাই ভয়, ডাক্তার চাচা।
আশরাফ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলে বলেন, দেশ স্বাধীন হলে ও কি বাঁচতে পারবে? মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ও মরবে। ওকে বাঁচাবে কে?
যদি কেউ এভাবে নিজের মৃত্যু চায়, তাহলে তা-ই হবে। স্বাধীনতার বিপক্ষে চিন্তা করাটাই তো সবচেয়ে বড় অপকর্ম। এই অপকর্মের জন্য কাউকে মাফ করে দেওয়ার সুযোগ নাই। কেউ মাফ করতে চাইলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। তারাও শাস্তি পাবে।
আশরাফ গাড়িতে স্টার্ট দেন। গাড়ি গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি আলতাফের দিকে তাকান। আলতাফই প্রথমে মাহমুদাকে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পায়। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি। ভয়ও পায়নি। পাকিস্তানি আর্মির হাতে নির্যাতিত মাহমুদাকে বাড়িতে আনার জন্য ছুটে এসেছিল আকমল হোসেনের কাছে। তার বিপরীতে চলে গেছে তার ভাই। সে ভাইকে নিয়ে ও এখন দুশ্চিন্তায় আছে। ও ধরে নিয়েছে, দেশ স্বাধীন হবে, শুধু সময়ের ব্যাপার। আমরা সবাই আমাদের সময়কে এভাবে দেখছি। আশরাফ মতিঝিল পার হয়ে ধানমন্ডির দিকে যাবেন।
গাড়ি নিয়ে রাস্তায় ওঠেন। কোনো ওষুধের দোকানে নেমে ওষুধ কিনতে হবে। জরুরি ওষুধ সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখতে হয়। কখন যে কোথায় দরকার। হবে, কে জানে! আশরাফের মাথায় মাহমুদার ঘটনা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
তখন আকমল হোসেন মৃদু হেসে আয়শার হাত ধরে বলেন, আজ আমার ধড়ে প্রাণ এসেছে। কয়দিন যা ভোগালে। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার জীবনে এভাবে কখনো ঘাবড়াইনি। তুমি তো দেখেছ।
ভেবেছিলে বাঁচব না?
অনেকটা সে রকমই। যমে-মানুষে টানাটানি বলে একটা কথা আছে না।
আমি মোটেই এতটা অসুস্থ হইনি। তুমি ভয় পেয়ে বেশি ভেবেছ।
তোমাকে হারানোর ভয় তো আমার আছে, আশা। আমি তোমার আগে মরতে চাই।
তোমার প্রাণটা উড়ে গিয়েছিল, এখন ফিরে এসেছে, তাতেই আমি খুশি। আজ রান্নাঘরে ঢুকব। কী খাবে, বলো?
আলতাফ বাজারে গেছে। ও কী আনে দেখি। তারপর বলব। রান্না নিয়ে আজ তোমাকে ঝামেলা পোহাতে হবে না। চলো, ড্রয়িংরুমে বসবে। তোমার উল-কাটা কই?
আমি নিচ্ছি। মেরিনা কোথায়?
ও নুসরাতের বাড়িতে গেছে। দুপুরের আগেই ফিরবে।
নুসরাতের বাড়িতে গেছে! দুপুরের আগেই ফিরবে! নুসরাতের বাড়িতে। আয়শা ভুরু কোঁচকান।
ওরা দুজনে মিলে বাংলাদেশের পতাকা বানাবে। সেসব পরিকল্পনা বোধ হয় করবে। আমাকে কিছু বলেনি। আমিও জোর দিয়ে জানতে চাইনি।
ঠিক আছে, থাক। ও এলে ওর কাছ থেকে শুনব। তুমি কি বের হবে?
হ্যাঁ, ফার্মগেটের বাড়িতে যাব। দেখা দরকার ওরা কী করছে। ওখানে ক্র্যাক প্লাটুনের ছেলেরা আসবে। দুপুরের আগেই ফিরে আসব।
ঠিক আছে, যাও।
তোমার মন খারাপ হবে না তো?
আয়শা মৃদু হেসে বলে, একটুতেই মন খারাপ করলে আমরা যুদ্ধ করব কীভাবে? তুমি ঘুরে এসো। আমি অপেক্ষা করব। একসঙ্গে ভাত খাব। অবশ্য ওখানে যদি বেশিক্ষণ থাকতে হয়, তাহলে ওদের কাছেই থাকবে। দুপুরের ভাত না হয় আমরা রাতেই খাব।
আকমল হোসেন মৃদু হেসে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর গাড়ি ছুটে যায় রাস্তায়। ভিড় আছে। গাড়ি-রিকশার ভিড়। মাঝেমধ্যে আর্মির গাড়ি দেখা যায়। আকমল হোসেন দেখলেন, রাস্তায় আর্মির মুভমেন্ট বেশি। কোথাও কিছু ঘটেছে কি? নাকি ওরা পঁচিশে মার্চের মতো কিছু একটা ঘটানোর পায়তারা করছে! ভেবেছে, শহরের গেরিলারা হয়তো কয় দিন পর শহরটা দখল করে নিতে পারে। তারপর এমন একটি রাস্তায় গাড়ি চালাতে তিনি ভীত হন না। বরং স্বস্তিই পান। ওদেরকে সন্ত্রস্ত-আতঙ্কিত দেখলে নিজের ওপর আস্থা বাড়ে। বোঝেন, যে শক্তি জাহির করার জন্য ছেলেরা রাস্তায় নেমেছে, সেখানে তারা সফল। আর এই সাফল্যে আকমল হোসেন নিরাপদে ফার্মগেটের বাড়িতে ঢুকে যান। গাড়ি রেখে আসেন বেশ খানিকটা দূরে। কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে যেতে নিরাপদ বোধ করেন না। বাড়ির দুর্গচরিত্র জানাজানি হয়ে গেলে বিপদের আশঙ্কা আছে। এমনিতেই এই বাড়ি থেকে অস্ত্রশস্ত্র নেওয়ার জন্য ছেলেদের প্রায়শই আসতে হয়। গাড়ি দূরে রেখে ফুটপাত ধরে হেঁটে এদিকওদিক তাকিয়ে আড়ালে ঢুকে পড়েন। তারপর গেরিলাদের হাইড।
ড্রাইভিং সিটে বসে থাকে আলতাফ।
গাছপালায় ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন বাড়িটি ভীষণ মন টানে। এখানে এলেই তার গাছের নিচে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ইট-কাঠের বাড়িতে এমন স্নিগ্ধতা বুঝি আর হয় না। আজও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস টানলেন। ছোট ছোট বুনো ঝোপে পা রাখলেন। পা দিয়ে ফুটে থাকা লজ্জাবতী ফুল বুজিয়ে দিলেন। পেছন থেকে স্বপন হাততালি দিয়ে দৌড়ে আসে।
আঙ্কেল, এটা মজার খেলা। আমিও আপনার সঙ্গে খেলব।
এসো। আমরা পাঁচ মিনিট খেলব। বেশি সময় না।
পাঁচ মিনিট আমার জন্য অনেক সময়, আঙ্কেল।
স্বপন লজ্জাবতী ঝোপের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে বেগুনি ফুল বুজিয়ে দেয়। তারপর ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চলেন, আঙ্কেল।
আকমল হোসেন ঘাসে পা মুছে স্যান্ডেলে পা ঢোকান। ভাবেন, এখানে আশরাফকে নিয়ে আসতে হবে। ও ঘাসের পরশে স্নিগ্ধ হয়ে বলবে, এই দেশটা এত সুন্দর কেন? চলো, দুজনে পায়ে হেঁটে দেশটা ঘুরে বেড়াই।
আকমল হোসেন গেরিলাদের সঙ্গে বসে ওদের পরিকল্পনার কথা জানতে চান। তখন একটি কাগজ দেখছিল সবাই মিলে। একটি টিপয়ের ওপরে রাখা কাগজের চারপাশে ওরা বসে আছে। কেউ হাটু মুড়ে, কেউ পা গুটিয়ে। ওদের মনোযোগ গভীর। আকমল হোসেন ওদের সঙ্গে বসে পড়েন। ওরা তার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দেয়।
হাবীব বলে, আমরা স্টেট ব্যাংকের এই ম্যাপটি করেছি, আঙ্কেল। আপনি দেখেন। আমাদের নেক্সট অপারেশন এখানে হবে।
স্টেট ব্যাংক তো খুব ইম্পর্ট্যান্ট ভবন। প্রতিটি গেটে কড়া পাহারা থাকে। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করতে হবে।
আমরা ঠিক করেছি পাঁচজন যাব। সিরাজ এর মধ্যে রেকি করে এসেছে। ঘটনার দিন দুলাল যাবে রেকি করতে।
এই কাগজটা দেখুন, চাচা। এই যে গেট। কতক্ষণ পরে পরে যে পাহারার বদল হয়, সেটা আমরা জানি। আমরা ঠিক করেছি, পাহারা বদলের সময়টা কাজে লাগাব। রদবদলের সময় ওরা কিছুটা অন্যমনস্ক থাকবে, ফুল অ্যাটেনশন দেবে না।
আকমল হোসেন চিন্তিত মুখে বলেন, ওদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। বিপজ্জনক অস্ত্র।
তা আমরা জানি। এটাও দেখে এসেছি যে ব্যাংকের একপাশের বাংকারে পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ পাহারায় থাকে। ব্যাংক ভবনের দেয়াল ঘেঁষে আছে ওই সব পুলিশের দুটো ক্যাম্প।
আকমল হোসেন মনোযোগ দিয়ে ওদের আঁকা ম্যাপটা দেখেন। দেখে খুশি হন। ওরা ভাললা পরিকল্পনা করেছে।
আমরা অপারেশন এই সময়ে করার জন্য একটি কারণ বেছে নিয়েছি।
আকমল হোসেন মৃদু হেসে বলেন, দুররানি আসবে এ জন্য?
ঠিক, চাচা, একদম ঠিক। একটা হাড় বদমাশ লোক। পিআইএতে বাঙালিদের দমন-পীড়নের একজন বড় হোতা। তাকে আবার স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের গভর্নর করা হয়েছে।
আমি জানি, বাবারা। তোমরা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ও ঢাকায় আসছে চার দিনের এক সম্মেলন উদ্বোধন করতে। সম্মেলনে অংশ নেবে ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা। সব তথ্যই খবরের কাগজ থেকে পাওয়া। এ সময়ে একটা অপারেশন করতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান বুঝবে ওরা। দুররানিকেও বোঝানো দরকার। তারপর করাচিতে ফিরে
প্রভুদের বলবে ঢাকার ঘটনা।
ছেলেদের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আকমল হোসেন ভাবেন, ওদের মুখের দিকে তাকালে নিজের বয়স কমে যায়। তিনি ওদের বলেন, তোমাদের জন্য যে জিলাপি আর বাখরখানি এনেছি, তোমরা তা খাও।
ছেলেরা প্যাকেট খুলে ওগুলো বের করে। হুটোপুটি করে খায়। তাঁর দিকে এগিয়ে দিলে তিনি বলেন, তোমরাই খাও। আমি বাড়িতে যাই।
জয় বাংলা মামণি এখন কেমন আছেন?
ভালো আছেন। সুস্থ হয়েছেন।
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।
ঘরের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ধ্বনি। ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলে মনে হয়, ওরা আছে বলে শহরের বাতাসে জীবন আছে। শত্রুপক্ষের পায়ের নিচে পড়ে গিয়েও শহর মাথা তুলে রাখে ওদের জন্য। তিনি ফুটপাত ধরে হটেন। আর্মি ক্যাম্পের পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের গা-ছুঁয়ে যখন নিজের গাড়ির কাছে আসেন, দেখতে পান, সিনেমা হলের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সেপাইটির মাথার ওপর কাক উড়ছে। তিন-চারটে কাক। কা কা শব্দ তার কানে ঢুকলে তিনি মনে করেন এরাও শহরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গোলাবারুদের বিপরীতে বেঁচে থাকার সূত্র। নির্মীয়মাণ সিনেমা হলের দালান ছাড়িয়ে আরও খানিকটুকু হাঁটতে হলো তাকে। দেখলেন, নিমগাছের ডালে সাদা ফুল। দেখলেন ফড়িং ও প্রজাপতি। একঝাক চড়ুইও আছে। ভাবলেন, বেঁচে থাকা সুন্দর। এর সঙ্গে যোগ হবে স্বাধীনতা।
বাড়ি ফিরে দেখলেন, মেরিনা ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। বেশ উত্তেজিত। বাবাকে দেখে খানিকটা দম ফেলে। ইদানীং মেয়েটি এমন আচরণ করছে। শান্ত মেজাজ হারাচ্ছে। যুদ্ধ ওকে একরোখা করেছে। অনেক কিছুই ও সহজে মেনে নিতে চায় না। তিনি বিষয়টি আঁচ করার জন্য বললেন, কী হয়েছে, মা?
আমি তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। সবই বলব। আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন, আব্বা। খিদে পায়নি?
হ্যাঁ, তা পেয়েছে। বেলাও তো কম হয়নি।
আম্মাও খাননি। আপনার জন্য বসে আছেন। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। খেতে খেতে কথা বলব। মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেছে। চেনা কারও আছাড় খাওয়া দেখলে খুবই খারাপ লাগে। মানতে পারি না।
শান্ত হ মা। বুঝেশুনে এগোতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপই সতর্ক পদক্ষেপ হতে হবে।
বুঝি, আব্বা। আপনি কাপড় চেঞ্জ করে আসুন। আম্মা, আসেন।
আকমল হোসেন শোবার ঘরে আসেন। আয়শাও যান। জিজ্ঞেস করেন, পরবর্তী অপারেশন কোথায় হবে? ছেলেরা কী বলল?
স্টেট ব্যাংক ভবন। ওরা একবার রেকি করে এসেছে।
রাইট সিদ্ধান্ত। কাগজে দেখলাম দুররানি আসবে। ওদের অপারেশনের সময় কখন?
সন্ধ্যা ছয়টায়। বেলা বারোটায় রেকি করবে দুলাল।
আকমল হোসেন বাথরুমে ঢোকেন। গরমে ঘেমে গেছেন। শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালেন। যেন তাঁর প্রিয় নদী তিতাস এখন শরীরের ওপরে। মহা আনন্দে ভিজতে থাকেন। ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালোবাসতেন। ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজতেন। নয়তো সিঁড়ির সামনের পার্কে বা দূরের মাঠে। কেউ তাকে শাসন করে ফেরাতে পারত না। আর বাড়ির কারও কাছ থেকেই বকুনি শুনতে হয়নি। কারণ, কোনো দিন জ্বর হয়নি বা ঠান্ডা লাগেনি। মা বলতেন, আমার ছেলেটার গায়ের ওপর দিয়ে বৃষ্টি গড়িয়ে যায়। কখনো ভেতরে ঢোকে না। বৃষ্টি ওর সঙ্গে খেলা করে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শৈশবের কথা ভেবে ভীষণ আনন্দ হয় তার। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। জলকে নির্বিঘ্নে গড়াতে দেন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ পর আয়শা দরজায় শব্দ করেন।
কী হলো? এত সময় নিয়ে গোসল করছ কেন? তুমি সকালেও গোসল করেছ।
আকমল হোসেন ট্যাপ বন্ধ করেন। সব কাজের ব্যাখ্যা সব সময় হয় না। যে আচরণটি করে, তার ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। যদি সেই আচরণটি খুবই ব্যক্তিগত হয় ও অন্যকে বিব্রত না করে। এমন এক সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়ে তিনি মনে করেন, সব কেনর উত্তর খুঁজতে গেলে অকারণ আনন্দ লাভ কীভাবে হবে? অন্যরা যখন আরেকজনের আচরণের কারণ জানতে চায় সেটার উত্তর না দেওয়াই ভালো। তিনি গা মুছে দরজা খুললেন।
কী হয়েছে? আয়শা ভুরু কুঁচকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
কিছু হয়নি তো। আকমল হোসেন নির্বিকার কণ্ঠে হাত নাড়েন। ভাবটা এমন যে, দেরি করেছি তো কী হয়েছে? গোসল করব তার জন্য তোমাকে জবাব দিতে হবে। কেন, আশা? আমি তোমাকে ভালোবাসি। দুজনে ছাব্বিশ বছর সংসার করেছি। সুখ-দুঃখে ভালোই তো দিন কাটিয়েছি। তিনি আয়শার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলেন।
আয়শা তাঁর হাসির অর্থ বুঝতে পারেন না। অবাক হয়ে বলেন, ছেলেমানুষি করলে?
মনে করো তা-ই। আকমল হোসেনের কণ্ঠ আগের মতোই নির্বিকার।
কার সঙ্গে করলে?
আকমল হোসেন জোরে হেসে ওঠেন, যেন নদীর কল্লোল তাঁর শরীরজুড়ে ছলছল করছে। সে শব্দ আয়শা খাতুনের কানে এসেও পৌঁছায়। তার ভালোই লাগে।
তিনি কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, নদীর সঙ্গে। তিতাস নদী।
আয়শা নিজেও হাসিমুখে বলেন, কী যে পাগলামি করো। চলো, খাবে। মেরিনা বসে আছে। মেয়েটা বলছিল ওর খিদে পেয়েছে।
তুমি যাও। আমি আসছি। মাথা আঁচড়ে নিই। আবার চুল থেকে পানি পড়তে দেখলে মেয়েটা আবার বলবে, আব্বা ডাইনিং টেবিলের ম্যানারই শিখল না।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবার চুল নিয়ে ছেলেমানুষি করবে না তো? আমার আশঙ্কা হচ্ছে।
করতেও পারি। তোমার আশঙ্কা ঠিকই আছে। আজ আমি মনে মনে ছেলেমানুষি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বেশ করেছ। এবার কোন নদী?
নদী না। এবার গাছ। ঝকড়া নিমগাছ। একটু আগে দেখে এসেছি। এতই ঝকড়া যে ওটার নিচে দাঁড়ালে আকাশ দেখা যায় না। আমি ফার্মগেট গেলে ওই গাছের নিচে দাঁড়াই। দু-পাচটা নিম ফল কুড়িয়ে নিই। আজও গাছটা ভালোই মিলিয়েছ।
তোমার মাথার ঝাকড়া চুলের সঙ্গে মিলবে। যুদ্ধের সময়ও তোমার মাথা থেকে গাছ আর নদী সরে যায় না। পায়রা বাপু।
আমি গেলাম।
মাকে টেবিলে দেখে মেরিনা ভুরু কোঁচকায়—আব্বা, গোসল হয়নি? আজ কেন আব্বা এত সময় লাগিয়ে গোসল করছেন? আব্বার কী হয়েছে?
তোমার আব্বার কিছুই হয়নি। বরং আমি দেখে এসেছি যে বেশ আনন্দে আছেন। বলা যায়, তোমার আব্বা খেলছেন।
মানে? কী খেলা খেলছেন? কার সঙ্গেই বা খেলছেন?
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে খেলেছেন তিতাস নদীর সঙ্গে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খেলছেন ফার্মগেটের নিমগাছের সঙ্গে।
বুঝেছি। আব্বা আনন্দে আছেন। স্টেট ব্যাংক অপারেশন সাকসেসফুল হবে। ওয়াও-ও-ও-
মেরিনা উচ্ছাসে হইচই করে ওঠে। ভাতের থালায় চামচ দিয়ে টুংটুং শব্দ করে বলে, জয় বাংলা।
আকমল হোসেন ততক্ষণে টেবিলের সামনে আসেন। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়েছেন। নীল রঙের পাঞ্জাবি পরেছেন। যদিও লুঙ্গি পরা এবং পায়ে স্যান্ডেল, তার পরও তাকে খুব স্মার্ট দেখাচ্ছে। আয়শা তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকান এবং বুকের ভেতরে টুং করে ওঠে। তিনি প্লেটে ভাত দেওয়ার জন্য চামচের দিকে হাত বাড়ান। তাঁর দৃষ্টি মানুষের ওপর থেকে বস্তুর ওপরে আসে।
মেরিনা কলকল করে বলে, কনগ্রাচুলেশনস, আব্বা।
আকমল হোসেন চেয়ার টেনে বসে নিজের প্লেটে হাত রাখেন। পরে মেরিনার দিকে ঘুরে বলেন, বলল, কী করেছি? সাফল্য কোথায়?
আপনি আনন্দে আছেন, একটি সাকসেসফুল অপারেশনের জন্য। সাফল্য আপনার দোরগোড়ায়, আব্বা।
ঠিক বলেছ। কনগ্রাচুলেশনস এ বাড়ির সবাইকে। দাও প্লেটভর্তি ভাত দাও। পেট পুরে খাই।
আয়শা মৃদু হেসে বলেন, কতটুকু খেতে পারবে তা তো আমি জানি। নিজেই তো বলো, যতকাল বেঁচেছ তাতে অনেক খাওয়া হয়েছে। এবার খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে। আমি তো দেখেছি কমিয়েছ।
আকমল হোসেন মৃদু হাসেন। আয়শার কথার জবাব দেন না। কত কথাই তো জমে আছে বুকের ভেতরে। সব কথা কি আয়শাকে বলা হয়েছে? না, হয়নি। যত দিন বাঁচবেন, তত দিন বলেও শেষ করতে পারবেন না। কিছু কথা অনুক্তই থাক।
আকমল হোসেনের প্লেটে ভাত দিলে তিনি প্রথমে লালশাক ভাজি দিয়ে খেতে শুরু করেন। দুলোকমা খেয়েই বলেন, এবার তোমার কথা বলো, মা।
আপনি তো জানেন, আব্বা, নুসরাতের ভাই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ট্রেনিং শেষ করেছে। ওর অ্যাটিচুড খুবই আক্রমণাত্মক, আব্বা।
আকমল হোসেন খাওয়া বন্ধ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
মেরিনা আবার বলতে থাকে, গেরিলাযোদ্ধারা তো ঠিক করেছে, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে গ্যাস বেলুনে বেঁধে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হবে। আমি, নুসরাত, হাসনা, ঝর্না পতাকা বানানোর দায়িত্ব নিয়েছি। নওশীন একদিন হঠাৎ করে বাড়িতে এসে নুসরাতকে পতাকা সেলাই করতে দেখে। কাপড়গুলো মেঝেতে টেনে ফেলে পায়ের নিচে রেখে দাঁড়ায়। তারপর ওকে শাসিয়ে বলে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে নুসরাতকে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে দিয়ে আসবে।
কী? কী বললে?
আব্বা, ও এত দূর বেড়েছে। নুসরাত আমাকে কাঁদতে কাঁদতে এসব বলেছে। আরও বলেছে, মেরিনা, ও বোধ হয় আমার আপন ভাই না। আপন ভাই হলে ও আমাকে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে দিয়ে আসার কথা বলতে পারত না। মা গো, কী করে ও এসব কথা মুখে আনল!
নুসরাতের আব্বা-আম্মা…
তাঁদের জীবন তো অতিষ্ঠ। নুসরাতের বাবা নাকি ওকে ছাতা দিয়ে তাড়া করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। কিন্তু সবাই খুব তটস্থ। ছেলেটা কী ঘটাবে চিন্তা করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। চাচা বললেন, ছেলেটি যদি আরেকবার বিরক্ত করতে আসে, তবে বাড়িতে তালা দিয়ে গ্রামে চলে যাবেন।
আকমল হোসেন ভাত খেতে পারেন না। হাত থেমে থাকে প্লেটের ওপর। আয়শা মৃদুস্বরে বলেন, তুমি ভাত খাও। সবকিছু সহ্য করতে হবে। ভাতও খেতে হবে।
আকমল হোসেন প্লেটের ভাত রেখে উঠতে গেলে মেরিনা তড়িঘড়ি বলে, আব্বা, আমার কথা তো শেষ হয়নি।
বলো, মা। আকমল হোসেন এক গ্লাস পানি শেষ করেন। আকস্মিকভাবে মনে করলেন, তার বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তিনি মরুভূমির মতো বিরান জনপদে একা একা পানির জন্য ঘুরছেন।
আব্বা, আপনি ভাত শেষ করেন। আমিও খেয়ে নিই।
আকমল হোসেন খুব বিষণ্ণ বোধ করেন। তার পরও খেতে শুরু করলে আয়শা তার প্লেটে পাবদা মাছ তুলে দেন।
মাছটা ভাতের মাঝখানে টেনে এনে বলেন, মারুফ পাবদা মাছ খুব ভালোবাসে।
আব্বা, এভাবে মনে করে মন খারাপ করবেন না। পাবদা মাছটা আপনি আয়েশ করে খান। এ বাড়িতে সবাই পাবদা মাছ ভালোবাসে।
মাছ দিয়ে এক লোকমা ভাত মুখে পুরে বলেন, গত সাত দিন ছেলেটার ফোন পাইনি।
ও ফোন করেছিল। আপনি বাইরে ছিলেন, আম্মা অসুস্থ। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে।
আমাদের তো বলোনি, মা।
ইচ্ছে করে বলিনি। ভাইয়া মনে করছে এ বাড়িতে আমার আর থাকা ঠিক হবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়ায় বাড়িটা আশপাশের লোকদের নজরে পড়তে পারে বলে ভাইয়া মনে করছে। সে জন্য আমাদের সতর্ক হতে হবে। নওশীনের এই হুমকি শুনে আমার মেজাজ আর ঠিক নেই।
মেরিনা থেমে এক গ্রাস ভাত খায়। পানিও।
ও কি তোমাকে ত্রিপুরা নিতে চায়?
হ্যাঁ, আব্বা। বিশ্রামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে হাসপাতাল করা হয়েছে, ওখানে নার্স হিসেবে কাজ করব। ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন মেয়ে গেছে।
আকমল হোসেন চিন্তিত মুখে ভাতের প্লেটের ওপর মুখ নামান। আকস্মিকভাবে গবগবিয়ে তিন-চার গ্রাস ভাত খেয়ে ফেলেন। আয়শা খাতুন পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলেন, পানি খাও।
আকমল হোসেন পানির গ্লাস নেন। হাতে নিয়ে আবার টেবিলে রাখেন। বুঝতে পারেন, পানি খাওয়ার ইচ্ছে তার নেই।
আব্বা, আমার আরেকটা কথা আছে।
আয়শা ধমকের সুরে বলেন, এসব কথা এখন বন্ধ রাখ, মেরিনা। খাওয়ার পরে নিরিবিলি এসব কথা বলা যাবে। কী করা হবে, সেটাও আমরা চিন্তা করতে পারব। তোমার কোনো ভাবনা থাকলে তা-ও আমাদের জানাবে।
এবার অন্য কথা, আম্মা। পতাকার কথা।
আকমল হোসেন চোখ তুলে সরাসরি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, পতাকার কথা কী?
আমার আরও কিছু কাপড় দরকার হবে, আব্বা।
আগে যেভাবে কিনেছিলাম, সেভাবে?
আগের মতো টুকরো টুকরো আনতে হবে। সবুজ লুঙ্গি, লালসালু আর হলুদ কাপড়।
বুঝেছি। একসঙ্গে আনলে ওরা সন্দেহ করবে। তুমি চিন্তা কোরো না, মা। আমি বিকেলেই বের হব। কতগুলো বানাবে ঠিক করেছ?
পাঁচ শ। দেখা যাক কতগুলো পারি। মানচিত্রটা কেটে সেলাই করতে সময় লাগে। তবে সবাই মিলে তিন শ তো হবেই।
ভেরি গুড। আমি উঠছি।
তোমার আব্বা কাজ পেলে সবচেয়ে খুশি হয়। তাই বলে ভেবো না যে মাছ-তরকারি কিনতে বললে খুশি হয়।
মেরিনা হাসতে হাসতে বলে, তা আমি জানি, আম্মা। যুদ্ধ আব্বাকে নতুন মানুষ করেছে।
আমাদেরকেও। আয়শা জোরের সঙ্গে বলেন।
হ্যাঁ, আমাদেরকেও নতুন মানুষ করেছে, আম্মা।
যেতে যেতে আকমল হোসেন ফিরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, পতাকা ওড়ানোর সময় মারুফ কি ঢাকায় থাকবে?
ও আসবে বলেছে। তবে কবে আসবে, তা নিশ্চিত নয়।
বাড়িতে কি আসবে?
তা কিছু বলেনি।
আচ্ছা, দেখা যাক।
আকমল হোসেন হাত ধোয়ার জন্য বাথরুমে যান। মেরিনা প্লেটের ভাতটুকু শেষ করে বলে, ভাইয়া বলেছে, মাকেও খালাদের কারও বাড়িতে সরিয়ে দেব।
তোর বাবা কি একা থাকবে?
আলতাফ ভাই থাকবে।
না, তা হবে না। তোর বাবাকে একা রেখে আমি কোথাও যাব না। ছাড়তে হলে সবাই এই বাড়ি ছাড়ব।
এই অনিশ্চিত সময়ের সিদ্ধান্ত এক রকমই হওয়া দরকার। আমরা এখন থেকেই ভাবব, মা।
মেরিনা প্লেট-বাটি-গ্লাস গোছাতে থাকে। মন্টুর মা এসে নিয়ে যায়। দুপুর গড়িয়ে যায়। বিকেল সূচিত হয় মাত্র, তখন আকমল হোসেন পতাকার জন্য কাপড় কিনতে বের হন।