ও মা, মাগো, কতোদিন যাই নাই, এইবার বাপের বাড়ি যাব
দুই ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি যেচি। ছোট ছেলেটো ত্যাকন একটু ভঁটো হয়েছে। মাঝখানে পরপর দু-বছর বাপের বাড়ি যাওয়া হয় নাই সাংসারের হ্যাঙ্গামে। বিয়ের পর থেকে পিতিবারেই গরমকালে বাপের বাড়ি যাওয়া হয়েছে। আবার পিতি বছরেই বাপের বাড়ি থেকে ভাদর মাসের শেষে, নাহয় আশিন মাসে মা কতো যি খাবার-দাবার, পিঠেপুলি, ফলমূল, কাপড়-জামা পাঠাইত তার সীমা নাই। সৎ-মা বলে যি কোথাও গাফিলি হবে, তার জো ছিল না। ভারা কাঁধে নিয়ে লোক আসত, সঙ্গে আসত বাগদিবউ। অ্যানেকরকম জিনিশ আসত। কুনো কুনো বছর আবার বড় মিরিক লয়তো রুই মাছও আসত। শাশুড়ি ইসব যেমন খুব পছন্দ করত, তেমনি নিজের কত্তব্যও করত। ফেরত যাবার সোমায় বাগদিবউকে খুশি করে দিত। ভারাটো-ও ফাঁকা যেত না। আমি বাপের বাড়ি যাই আর না যাই মায়ের কিন্তুক উসব পাঠানোর কুনোবছর কামাই ছিল না।
মাঝখানে দু-বছর যাই নাই। যাই নাই কিন্তুক ইবার যেই যাবার কথা হলো, কত্তাও মত দিলে, ত্যাকন জান যেন ছেড়ে যেতে লাগল। কি করে ভুলে ছেলম মা! কোন্ নিব্বাসনে পড়ে আছি? কাদের নিয়ে কি করতে সোদর ছেড়ে এত দূরে আছি? কোথা রইল মা-বাপ, কোথা রইল ভাই-বুন, কোথা রইল গাঁ-ঘর–এইসব মনে করে বুকের মদ্যে হু হু করতে লাগল।
আমি বাপের বাড়ি য্যাতম আমাদের নিজেদের মোষের গাড়িতে আর ফিরে আসতম বাপের বাড়ির গরুর গাড়িতে। গাড়ি বিহানবেলায় যাবার লেগে তৈরি হলো। গাড়িতে খ্যাড় বিছিয়ে তার ওপর মোটা মোটা চারটো ফুল-তোলা কাঁথা বিছিয়ে বিছেনা তৈরি হলো। নতুন টপ্পরের পেছনের মুখ শাড়ি দিয়ে বাঁধা, ছামনের মুখ-ও শাড়ি দিয়ে বাঁধা। একবার ভেতরে ঢুকলে আর কিছুই দেখবার উপয় নাই। মাহিন্দার ছোঁড়াটো গাড়ি ডাকিয়ে নিয়ে যাবে, পাকা বাঁশের লাঠি নিয়ে পেছু পেছু হেঁটে যাবে হলা বাগদি। পৌছে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরে আসবে।
দুই ছেলে সাথে করে গাড়িতে উঠে টপ্পরের ভেতরে ঢোকলম,, কবরের ভেতরে ঢোকলম! বড় খোঁকা ত্যাকন অ্যানেকটো সেয়ানা হয়েছে। সে ভেতরে থাকবে ক্যানে, গাড়োয়ানের কাছে যেয়ে বসবে। আমি খালি ভাবচি পাড়াটো শুধু পেরুইলে হয়, মাঠে যেয়ে পড়তে বাকি, টপ্পরের ছামনের শাড়িটো তুলে দোব। গাড়ির কাঁচ কাঁচ আওয়াজ হচে, টপ্পর লতুন রঙ করা হয়েছে, তার গন্দো আসছে, টপ্পরের সরু একটো ফাঁক দিয়ে রাস্তার লাল ধুলো দেখতে পেচি। বোঝলম, পাড়াটো পেরিয়ে এসে গাঁয়ের ঠিক বাইরে বড় দিঘিটোর দখিন পাড় দিয়ে যেচি। শুকনো ডহরে হড় হড় করে গাড়ি নেমে আবার রাস্তায় উঠতেই আমি খোঁকাকে বললম, ছামনের কাপড়টো সরিয়ে দে তো বাপ।
কাপড় সরিয়ে দিতেই এমন ভালো লাগল সি আর কি বলব! সকালবেলার হাওয়া এসে গায়ে লাগল, জানটো যেন তর হয়ে গেল। ইদিকে নদীনালা তেমন নাই, শুদু ধানের জমি। বিরাম জমি লয়, সেই লেগে মাঠ ধু ধু করে না। ফসলি ধানের জমির মাঠ, তার কি অরম্ব, শ্যাষ নাই? যিদিকে তাকাই, চোখ যেচে যেচে যেচে, কোথাও আটকাবে না। উঁচু-নামো-ও নাই কোথাও। শ্যাষে অ্যানেক দূরে চোখ যেয়ে ঠেকছে কুনো একটো গায়ে। মাথার ওপরের আসমানের মতনই মাঠের আসমান।
সেই সোমায় রাস্তাঘাট তেমন ছিল না। পাকা রাস্তা তো লয়-ই, কাচা সরান-ও লয়। মাঠের ওপর দিয়ে পায়ে-চলার রাস্তা চ্যাওড়া আলের ওপর দিয়ে। লোকে বলে পথ-আল। আর আছে গরু-মোযের গাড়ি চলার অনেক অ্যানেক রাস্তা। কিলবিল করছে। এঁকে-বেঁকে হয়তো দশটো রাস্তার একটো যেয়ে গাঁয়ে ঢুকেছে। ইসব রাস্তা ধান-কাটার সোমায় জাড়কালে খুব ব্যবহার হয়েছে। অ্যাকন খরানির কালে আস্তে আস্তে ঘাসে ঢেকে যেচে। শুদু একটো-দুটো রাস্তা এক গাঁ থেকে আর এক গাঁ হয়ে মাঠের বুক চিরে কোথা গেয়েছে কে জানে! গাড়ি যেয়ে যেয়ে সিসব রাস্তায় খুব ধুলো। বাতাসে উড়ছে, আর বেশি বাতাস হলে ধুলোয় ধুলিষ্কার শাদা মেঘ হয়ে উড়ে বেড়াইচে।
মাঠের মাঝে এসে দেখলম, কুনোদিকে লোকজন দেখা যেচে না। অ্যাকন থাকবেই বা ক্যানে লোক? সেই মাঘ-ফাগুনে ধান কাটা হয়ে গেয়েছে। সব একফসলা বোয়া আমন ধানের জমি, ধান ছাড়া আর কিছু হয় না। ধান কাটার পরে জমি সব অ্যাকন ফাঁকা পড়ে আছে, নাড়াগুলিনও ধুলোয় ঢেকে গেয়েছে। আবার জষ্টি মাসে পানি হয়ে জমিতে বাত না হলে গরু-মোষের নাঙল নিয়ে মানুষ মাঠে নামবে না।
আমি তাই টপ্পরের দু-মুখের শাড়িই খুলে দিতে বললম। কে আর দেখছে? দুই পুত নিয়ে বাপের বাড়ি যেচি, ভয় তো কিছু নাই! সঙ্গে লোকও আছে। গাছপালা ইদিকে তেমন নাই বটে, তাই বলে বনকুল শেয়াকুল, র্যালপাতি ইসবের ঝোপ-ঝাড় কি নাই? আর আছে যিখানে সিখানে থ্যালানে থ্যালানে পুকুর। অ্যাকন শুকিয়ে কাঠ। দু-একটোয় সামান্য পানি আছে, অ্যাকটো-দুটো আছে বেশ পানিতে ভরা। সি পানি খাওয়া-ও যায়। ইসব মেঠো দিঘির পাড়ে বেরাট বেরাট বট-পাকুড় গাছ। তাদের হেঁয়ায় খানিকক্ষণের লেগে গাড়ি থামিয়ে গরু-মোষের বিঘ্রাম হয়। উদের পানি খাওয়ানো-ও হয়।
আমরা তা-ই করলম, অ্যাকটো বড় পাকুড় গাছের তলায় গাড়ি থামিয়ে গাড়োয়ান মোষদুটোকে পানি খাওয়াইতে নিয়ে গেল। আমি-ও কঁকালটো একটু ছাড়ানোর লেগে ছেলেদুটোকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলম। দ্যাখলম, হলা বাগদি ত্যাল-চুকচুকে পাকা বাঁশের লাঠিটি বগলে রেখে দু-হাত জোড় করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ভয় কিছু নাই। জানি যি হলা বাগদি কুনো বেপদ এলে জানকে জান করবে না, তাকে না মেরে আমার কি আমার সন্তানদের গায়ে কেউ একটো আঁচড় পয্যন্ত দিতে পারবে না।
আমি এট্টু ইদিক-ওদিক হাঁটছি, বড় খোঁকা বটগাছটোকে ঘুরে ঘুরে দেখছে কি কি পাখি আছে। দোপরবেলা, তাই পাখি ডাকছে না বটে কিন্তুক অত বড় গাছে অনেক পাখি নড়েচড়ে বেড়াইছে বেশ বোঝা যেচে। গাছটো মনে হচে জ্যান্ত, কথা বলছে। গাছতলায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলম। হ্যাঁ, অ্যাকন মনে হচে, মাঠের ঠিক মাঝখানে এয়েছি। কুন্ দিকে কুন্ গাঁ তা আর বোঝা যেচে না। ধুলোয় লেপুটে গেয়েছে। অ্যাকন আসমানও লাগছে গোল, মাঠও লাগছে গোল। একটু ভয় লাগল, ক্যানে তা জানি না। খালি মনে হতে লাগল কুনো রাস্তাই আর শ্যাষ হবে না। কি করে কোথা শ্যাষ হবে কে বলতে পারবে? মনে হচে, ঘরবাড়ি পুকুরঘাট সবুজবন আর কি দেখতে পাওয়া যাবে! ইকথা মনে করে নিজের মনেই হাসলম। কতোবার ই পথ দিয়ে বাপের বাড়ি গেয়েছি। যতোদূরই হোক, পথ কি ফুরোয় নাই, মায়ের কাছে কি যাই নাই?
দোপর গড়িয়ে পেরায় বৈকালবেলায় একটো চটিতে পৌছুলম। আর গাঁ দূরে লয়। কিন্তুক চটিটো তেপান্তর মাঠের মাঝখানেই। ইদিকে-উদিকে দু-চারটো মেটেঘর। মোটে একটো-দুটো ভদ্রাসন। এমন জায়গায় কুনো গেরস্ত কি নিয়ে থাকতে পারে? তবু এই তেপান্তরে বাস করছে দু-একটো পরিবার। আর মেটে ঘরগুলিন হচে দোকান–মুদির দোকান, হাঁড়িকুড়ির দোকান আর মিষ্টির দোকান। যতোবার আসি মিষ্টির দোকানে একবার গাড়ি থামে। ভাইবুনদের লেগে মিষ্টি লি, ছেলেপুলেরা খায়। মিষ্টি কি-ই বা আর পাওয়া যায়। রসগোল্লা, মন্ডা, জিবে-গজা, চিনির ছাঁচ, কদমা-বাতাসা এইসব। ছেনার মিষ্টি-রসগোল্লা আর মন্ডা খুব ভালো হয়। কুনো ভ্যাজাল থাকে না। উপয় থাকলে ময়রা লিশ্চয় ভ্যাজাল দিত, নিরুপায় হয়েই ভ্যাজাল দেয় না। ছেনা আর চিনি দিয়ে মিষ্টি, ভ্যাজালটো কি দেবে? খুব বেশি হলে ছেনায় সুজি দিতে পারে। তা কতোটেই বা দিতে পারে আর সুজি তো খারাপ কিছু লয়। যাই হোক, ছেলেরা, গাড়োয়ান আর হলা বাগদি মিষ্টি খেলে। আমি রাস্তাঘাটে কিছু খাই না। ভাইবুনদের লেগে মিষ্টি নেওয়া হলো শালপাতার বড় বড় ঠোঙায়!
সাঁঝবেলায় মুখ-আঁধারি রেতে বাপের বাড়ি পৌছুলম। সাঁঝ বেলাটোর মুখে কুথাও যেয়ে পৌছুইতে আমার ভালো লাগে না। পিদিম ঘরে ঘরে, নাইলে হেরিকেন জ্বালাইচে, মিটমিট করে আলো জ্বলছে–কিছুই ভালো দেখা যেচে না, মনটো খারাপ লাগে, বৈকালি এসে পেঁৗছুতে পারলে আমি ছেলেদুটিকে তাদের নানি-খালার কাছে রেখে পাড়া বেড়াইতে চলে য্যাতম, নাইলে পাড়ার লোকেরাই আসত বাড়িতে দেখা করতে অ্যাকন আর তা হবার বাগ নাই।
বাড়িতে মা বাপজি ছাড়া এক ভাই, তিন বুন রয়েছে। সৎ-ভাইটো বেশ বড়সড়ো হয়েছে, দুটি বুনও অ্যানেকটো ডাগর হয়েছে। শুদু একটা বুন দুধের শিশু। আমার মা মরে গেলে কি হাল হয়েছিল ই সসাংসারের সব পেরায় ভেসে গেয়েছিল। সৎ-মা এসে আবার ভর-ভরন্ত সোনার সোংসার করেছে। শুদু একটো কথা আচ্চয্যি! বাপজি সি কালের হিসেবে বিদ্বেন লোক, বাংলা জানে, ফারসি জানে, ফারসি বয়েত পয্যন্ত লিখতে পারে, নিজে একটো শুভঙ্করি বই লিখেছে কিন্তুক ছেলেমেয়েদের ল্যাখাপড়ার দিকে ক্যানে তার মন নাই কে জানে! আমাকে নাহয় পাঠশালে পাঠায় নাই, মা মরেছে, ছোট ভাইটো কোলের, সোংসারে বেপৰ্য্যয় বেপদ, মেয়ের ল্যাখাপড়া না হয় না-ই হলো। তা বাদে মেয়েমানুষের আবার ল্যাখাপড়া কি, বারো হাত শাড়িতে মেয়েমানুষ লিকিনি ল্যাংটো, ইসব পাড়াগাঁয়ের মেয়ে কুনোদিন তো জজ-ব্যালেস্টার হবে না, তাইলে তাদের আবার ল্যাখাপড়া শেখার কি দরকার? হ্যাঁ, বোঝলম ইকথা। কিন্তুক ভাইটো কি দোষ করলে? বড়টোর দায়ভার তো নিতে হয় নাই, আমার মামারাই সি ভার নিয়েছে। তাইলে ই ভাইটো ক্যানে ল্যাখাপড়া শিখবে না? দেখলম সে আর স্কুলে যায় না। কুনোমতে পাঠশালের পড়া শ্যাষ করেছে। স্কুলে আর যায় নাই। তাকে শুদিয়ে জানতে পারলম, স্কুলে ভত্তি হতে টাকা লাগবে। বাপজি বলেছে টাকা আসবে কোথা থেকে! স্কুলে পড়ে কাজ নাই।
হঠাৎ একদিন ঠিক দোপরবেলায় ক-ক রোদে আমার ছোট ভাইটি এসে হাজির হলো। অ্যানেকদিন থেকে দেখি নাই। ইয়াকেই দুবছরেরটি রেখে আমার মা দুনিয়া থেকে চলে গেয়েছিল। তাপর বেশিদিন আর বাপজির সোংসারে থাকতে হয় নাই তাকে। মামুরা এসে নিয়ে গেয়েছিল। তারাই তাকে বড় করবে, মানুষ করবে, যা যা করার সবই করবে। আপন লোকদের কাছেই গেল বটে ভাইটো কিন্তুক বাপজি ক্যানে ছেলে ছেড়ে দিলে, সি আমি ত্যাকননা বুঝি নাই, অ্যাকনো বুঝি নাই। অভাবের সোংসার লয়, কিছু লয়। লতুন সোংসার হয়েছে তাতেই বা কি, আমি বড় বুনটা তো আছি ভাইকে দেখার লেগে! তাইলে ছেলে দিয়ে দিলে ক্যানে? সে মামুদের কাছে চলে যাবার পরে আমার সাথে কমই দেখা হয়েছে, মামুদের গাঁয়ের পাঠশালে ভত্তি হয়েছিল। সেখানকার পড়া শ্যাষ হলে আমার শ্বশুরবাড়িতে কত্তার কাছে এয়েছিল। আমার কাছেই আসলে এয়েছিল। বললে, মামুরা তো আর পড়াইতে পারবে না। সে সোমায়ে উ গাঁয়ে বড় স্কুল ছিল না। ত্যাকনকার দিনে বড় স্কুল আর কটো ছিল? খুবই কম আর যে কটোই ছিল, অ্যানেক দূরে দূরে। সেই লেগে দূরের কুনো গাঁয়ে থাকা-খাওয়া থেকে স্কুলের মাইনে পয্যন্ত যি খরচ হবে তার জোগান দেবার শ্যামতা মামুদের নাই। তারা আর কিছু করতে পারবে না। ইসব কথা শুনে আমি কিন্তু কিছুই বলি নাই। হোক মায়ের পেটের ভাই, তবু বাপের বাড়ির আত্মীয়। তার লেগে বলতে যেয়ে আমি ক্যানে শ্বশুরবাড়িতে দোষের ভাগী হব! শাশুড়ি-ননদ য্যাকন বেঁচে আছে। তা আমাকে কিন্তু কিছুই বলতে হলো না। কত্তাই বললে, বেশি কথার লোক লয়, একটো কথাই বললে, আমি দেখছি।
তার পরের দিনই ভাইটিকে নিয়ে কত্ত বেরিয়ে গেল আর সেইদিনই অ্যানেক রাতে একা ফিরে এসে বললে, ট্রেনে কাটোয়া যেয়ে সেখান থেকে দু-কোশ দূরের একটো গাঁয়ের এক নামজাদা ইশকুলে ওকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে আর এক মোকাদিম মোসলমানের বাড়িতে তার জায়গিরের ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে। সে ঐ বাড়িতে থাকবে, খাবে, ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াবে আর ইশকুলে নিজের পড়া পড়বে।
সেই থেকে সে ঐ ইশকুলেই পড়ছিল। কেমন আছে, কি খেচে আমি যি তার খুব খবর লেতম তা নয়। আমার শ্বশুরবাড়িতে সে আসত কমই। য্যাকন আসত সুবিদা-অসুবিদার কথা বলতেই আসত কত্তাকে। তাকে বাপের মতুনই মান্যি করত, ঠিক যেন বটবিরিক্ষের ছোয়ায় বসে আছে। ইশকুলের ছুটি হলে নানার বাড়িতেই চলে যেত বেশিরভাগ সোমায় বলতে গেলে সিটোই তার নিজের বাড়ি। বাপজির কাছে বোধায় তেমন যেত না। সৎ-মা আছে বলে লয় কিন্তুক, বাপজির কারণেই মনে হয় তার উ বাড়ি যেতে মন করত না। সি যি মামুদের কাছে থাকে সিটি বাপজির পছন্দ লয়। সি যি এত কষ্ট করে ল্যাখাপড়া শিখচে সিটিও তার পছন্দ লয় অথচ নিজে কিছু করবে তার লেগে।
তা সেই দোপরবেলা–কাকচিলের আওয়াজ নাই, আসমান থেকে আগুন ঝরছে, এমন সোমায় ভাইটি আমার বাড়ি ঢুকে ছামনে এসে দাঁড়ালে। অ্যানেকদিন দেখি নাই, হঠাৎ চিনতে পারলম না। কে এই ছেলেটি? গোরো ধপধপে, গোঁপদাড়ি অ্যাকনো হয় নাই, হবে-হবে করছে, কে গো এই ছেলেটি? পরেই তাকে চিনতে পারলম। দখিন-দুয়োরি উসারায় একটা মোড়ায় তাকে বসালম। মা এল, ভাইবুনেরা এল। মা আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে পাখার বাতাস করতে লাগল। বড় বুনটো শরবত করে আনলে। এই ভাই তত উদের সবারই বড়। শরবত-টরবত খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে সে যা বললে তাতে আমি ভয় পেয়ে গেলম। তার ইশকুলের শ্যাষ ক্লাসের পড়া শ্যাষ, আর কমাস বাদে শ্যাষ পরীক্ষা। সি পরীক্ষা তো গাঁয়ের স্কুলে লয়, সি পরীক্ষা হবে কাটোয়া শহরে। অ্যানেক টাকা লাগবে। কে দেবে এই টাকা? মামুদের তো দুটো টাকা বার করারও খ্যামতা নাই। যি বাড়িতে থাকে, খায়–তারা তো আর টাকা দেবে না।
দামাদ-ভাই এত করেছে, যা করবার সব করেছে, তার কাছেই বা যাব কেমন করে। তাই বাপজির কাছে এয়েছি। বাড়িতে মরাই বাঁধা রয়েছে, একটা নয়, দু-দুটো–ক-মণ ধান বেচলেই তো পরীক্ষার ফি-র টাকা হয়ে যায়।
তা বেশ, বাপজি অ্যাকন বাড়িতে নাই, আসুক, দোপরের ভাত খা, বিছাম কর, তারপর বলিস বাপজিকে।
আমার কথা শুনে সে জোরে মাথা নাড়লে। ভাত দোপরে সে খাবে না। বাপজিকে এগু বলে তাপর অন্য কাজ।
তাকে তো সবাই চেনে, কিছুতেই পয়সা খরচ করতে চায় না। যি লোকের এত বুদ্ধি, দুনিয়ার লোককে বুদ্ধি-ফুদ্ধি দেয়, টাকাপয়সা : খরচের কথা উঠলেই সি লোকের বুদ্ধি কোথা যায় কে জানে! বাড়িসুদু সবাই কাটা হয়ে থাকল, না জানি আজ কি অঘটন ঘটে।
খানিক বাদে বাপজি এল। ত্যাল মেখে গা ধুতে যাবে। অ্যামন সোমায় বড় ছেলে এসে ছামনে দাঁড়িয়ে মাথা হাট করে বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। বাপজি তার দিকে তাকিয়ে ত্যাল মাখা বন্ধ করে ঠান্ডা গলায় শুদুলে, কিছু বলবে? কি বলবে বলো। এই কথা শুনে ভাইয়ের আমার গলা কাঁপতে লাগল, কথা ঠেকে ঠেকে যেতে লাগল। বহুত কষ্ট করে কুনোরকমে কথাগুলিন সে বললে। তাপর যেন তার সাহস এট্টু বাড়ল।
আমার পরীক্ষার ফল খুব ভালো হচ্ছে, এই শেষ পরীক্ষাতেও ফল ভালোই হবে। আমি কলেজে পড়ব, বি এ পাশ করব।
সব কথা শুনে বাপজি অ্যানেকক্ষণ চুপ করে থাকলে। মনে হলো। কুনো কথাই যেন সে শুনতে পায় নাই। ওমা, তাপর সে উঠে দাঁড়িয়ে দড়ি থেকে গামছাটো তুলে কাঁধে ফেলে গা ধুতে যাবার লেগে উসারা থেকে নামতে নামতে বললে, ধান বেচা যাবে না। মরাইয়ে যে কটো ধান আছে তা সবারই মুখের গ্রাস। বেশি যা আছে, তা বেপদ-আপদের লেগে রাখতেই হবে। ধান বেচা যাবে না।
এই কথা বলে বাপজি শা-দিঘিতে গা ধুতে বেরিয়ে গেল। সে-ও গেল আর আমি দেখলম, ভাইয়ের আমার মুখটি লাল টুকটুকে হয়ে উঠল। কদবার পাত্তর সে লয়, ঐ বাপেরই ছেলে তো, আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে একপা-দু-পা করে এনে পেরিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেচে, আমরা সবাই যেয়ে তাকে ধরলম। মা বললে, আর কিছু হোক আর না হোক, ভাতের ওপর রাগ করিস না, ভাত খেয়ে যা বাপ। মুখ ঘুরিয়ে ভাই ত্যাকন বললে, মা, তোমার ভাত হলে খেতম। এ যে আমার বাপের ভাত-যেদিন খাব জোর করে খাব, না হলে খাব না। এই বলে আমাদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে চলে গেল। কিন্তুক বললে কেউ পেত্যয় যাবে না, গা ধুয়ে এসে সব শুনে বাপজি একটিও কথা না বলে খেতে বসলে আর রোজ যেমন খায়, তেমনিই খেলে। একটি ভাত যি কম খেলে তা লয়।
এই ঘটনার পরে দুটো দিনও পার হয় নাই, একদিন কা এসে হাজির। বাপজি ত্যাকন বাড়িতেই ছিল। সোজা তার কাছে যেয়ে বললে, আপনার বড় ছেলের পরীক্ষার ফি-র টাকা লাগবে। নগদ টাকা আপনার কাছে নাই তা জানি। কিছু ধান বেচেই এই টাকা জোগাড় করতে হবে। বিপদ-আপদের কথা বলেছিলেন, ছেলের এইরকম বিপদের সময়েই তো এই ধান কাজে লাগবে।
কথা শুনে বাপজি চুপ করে রইল, মুনিষ বৈকালি আসবে মোকামে ধান বেচে বেলাবেলিই ফিরবে।
সিদিন দেখেছেলম, বাপের কথায় ছেলের মুখ কেমন রেঙেছিল, আজ দ্যাখলম জামাইয়ের কথায় শ্বশুরের মুখ কেমন রাঙা টুকটুকে হলো। ই যি বাপজির ভায়ানক চাপা রাগ তা বুঝতে আমার বাকি থাকল না। কিন্তুক বাপজি একটি কথা বললে না–হ্যাঁ কি না একটি আওয়াজ বেরুল না তার মুখ থেকে।
বৈকালি লোক এল, মরাই ভাঙলে। গাঁয়ের কয়াল এয়েছিল, সে ধান মাপলে। কত্তা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে আর বাপজি দোপরে খেয়ে ঘরে ঢুকে ঘর আঁদার করে সেই যি শুয়ে থাকলে, একবার বেরিয়ে এল না। আমরা সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলম, কপাল পয্যন্ত লাজ কেড়ে সৎ-মা হেঁশেলের দরজার আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলে, সৎ-ভাই আর বুনগুনো ভয়ে কেমনধারা করে চাইতে লাগলে, কত্তা কিন্তু কিছুই গেরাজি করলে না।
গাড়ি বোঝাই করে য্যাখন ধান মোকামে বেচতে নিয়ে যেচে, কত্তাও ত্যাকন আর থাকলে না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মা তাকে কিছুই বলতে পারলে না, রাতটো থেকে যেতে বলবে কি কিছু, সিকথা মুখ দিয়ে বার করতেই পারলে না। অ্যামন রাশভারি মানুষ ছিল উ। কত্তা য্যাকন চলেই গেল, মা ত্যাকন হেঁশেল থেকে বেরিয়ে বাপজির ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলে। আমিও কি মনে করে মায়ের পেচু পেচু আসছেলম। দরজা পয্যন্ত এয়েচি, কানে এল বাপজি বলছে, আমার মরাই ভেঙে আমারই ছেলেকে যখন সে পর করে দিলে, ওর ছেলেকেও আর বেশিদিন স্কুলে যেতে হবে না
হায় কি বললে, হায় কি বললে, ওগো, হায় কি বললে–দড়াম করে আমি মাটিতে আছড়ে পড়লম, হায়, ই কি বললে? কই, আমার মানিকরা কই, আমার জাদুরা কই! ওমা, আমি এখুনি বাড়ি যাব, আমার বুকের ধন মানিকদের নিয়ে এখুনি বাড়ি যাব। ই বাড়িতে আর এক দণ্ড লয়। এই রেতেই যাব।
সেই রেতে কি আর আসা হয়? সারারাত কিছুই খ্যালম না, পানি পয্যন্ত লয়, কারও সঙ্গে একটি কথা বললম না, দু-চোখের পাতা একবার এক করলম না, দুই ছেলেকে বুকে আঁকড়ে ধরে রাতটো কাটিয়ে সকালবেলাতেই শ্বশুরবাড়িতে ফিরে অ্যালম। মা ভাই বুন সব আসার সোমায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে, চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে কিন্তুক একটি কথা কেউ উশ্চারণ করতে পারলে না।