০৯. ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে টুশকি

বিকেল পাঁচটার সময় ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে টুশকির একটা অনুষ্ঠান রয়েছে, নীলা আর বকুল সেটা দেখতে যাবে। একেবারে সামনে বসে দেখার জন্যে দুইটা টিকেট কেনা হয়েছে। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে এসে বকুল একেবারে হতবাক হয়ে গেল, এত সুন্দর যে একটা জায়গা হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব না। বেহেশত মনে হয় এরকম হবে। নীলা পৃথিবীর অসংখ্য জায়গা দেখেছে, তাকেও স্বীকার করতে হল জায়গাটা সুন্দর। বিরাট জায়গা নিয়ে এটা তৈরি করা হয়েছে। সামনে প্লেক্সি গ্লাসের বিশাল একটা ট্যাংক, তার সামনে গ্যালারির মতো চেয়ার উঠে গেছে। ট্যাংকটা একটা বড় সাইজের পুকুরের মতো, তার মাঝখানে দ্বীপের মতো জায়গা ভেসে আছে, সেখানে উজ্জ্বল রঙের নকশা। পুরো এলাকাটা উজ্জ্বল আলোতে আলোকিত করে রাখা আছে, দেখেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ভিতরে বিশাল স্পিকারে দ্রুত লয়ে বাজনা বাজছে, পুরো এলাকাটাতে একটা উৎসব উৎসব ভাব।

বকুল আগে কখনো এরকম জায়গায় আসেনি, সবকিছু দেখে সে হতবাক হয়ে গেল। বিশাল গ্যালারির মতো জায়গা, সেখানে আস্তে আস্তে মানুষজন এসে নিজেদের জায়গায় বসে। যারা এসেছে তাদের মাঝে কমবয়সী বাচ্চারাই বেশি। টিকেটের অনেক দাম, যারা আসতে পারে তাদের সবাই বড়লোকের ছেলেমেয়ে, চেহারায় জামাকাপড় সেটা বেশ স্পষ্ট।

ঠিক পাঁচটার সময় অনুষ্ঠান শুরু হল। নানারকম অনুষ্ঠান রয়েছে, ম্যাজিক শো, হাস্যকৌতুক, বানরের খেলা, পাখির খেলা, শারীরিক কসরত, নাচ-গান সবকিছুর শেষে হচ্ছে শুশুকের খেলা। অনুষ্ঠানগুলো ভালো–অন্য যে-কোন সময় হলে দেখে বকুল হেসে কুটিকুটি হত, কিন্তু এখন ভিতরে অশান্তি তাই একটা অনুষ্ঠানও সে মন দিয়ে দেখতে পারল না।

সবকিছুর শেষে হঠাৎ স্টেজে বিচিত্র একধরনের বাজনা বাজতে শুরু করে। সাথে সাথে পানির ট্যাংকের এক পাশে একটা গেট খুলে দেওয়া হল। বকুল প্লেক্সি গ্লাসের স্বচ্ছ দেয়ালের ভিতর দিয়ে দেখতে পেল একটা শুশুক দ্রুতবেগে পানির ট্যাংকে এসে হাজির হয়েছে। শুশুকটা এসে সজোরে দেয়ালে আঘাত করে, যেন সেটা ভেঙে ফেলতে চায়। বকুল উত্তেজনায় তার চেয়ারে দাঁড়িয়ে গেল–তার টুশকি!

নীলা ওর হাতে ধরে টেনে বসিয়ে দিল। বকুল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, টুশকি পাগলের মতো ভিতরে ছোটাছুটি করছে, দেয়ালে ধাক্কা দিচ্ছে, মাঝে মাঝে হঠাৎ লাফিয়ে উঠছে। সবাই মনে করছে এটা একধরনের খেলা, শুধু বকুল জানে এটা খেলা নয়, এটা একধরনের ক্রোধ। যে-টুশকি বিশাল নদীতে ঘুরে বেড়াত তাকে হঠাৎ করে এইটুকুন জায়গায় আটকে ফেললে সে কি সেটা সহ্য করতে পারে?

স্টেজে নীল পোশাক পরা একজন মানুষ এসে দাঁড়াল, এক হাতে চাবুকের মতো একটা জিনিস। অন্য হাতে একটা মাইক্রোফোন। মানুষটি স্টেজে এসে দাঁড়াতেই উপস্থিত সব দর্শকেরা আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করে। মানুষটা মাথা নুইয়ে সবার করতালি গ্রহণ করে বলল, “আপনারা এখন দেখতে পাবেন এক অভূতপূর্ব খেলা। লস এঞ্জেলস, ফ্লোরিডা, ভ্যানকুবারে ডলফিনের খেলা দেখানো হয়। আমরাও বাংলাদেশে আমাদের নিজস্ব ডলফিন শুশুকের খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করেছি। আপনারা দেখবেন পানির বিস্ময় এই শুশুকের বিচিত্র খেলা।”

বকুল আবার উঠে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, নীলা তাকে আবার টেনে বসিয়ে দিল। মানুষটি মাইক্রোফোনে বলল, “এই শুশুকটি আনা হয়েছে চন্দ্রা নদী থেকে। এটি একটি মেয়ে-শুশুক, এর ওজন প্রায় একশো কেজি এবং যে-জিনিসটা আপনাদের সবাইকে বলে রাখছি সেটা হল এটা একটা বন্য শুশুক। এটা বেপরোয়া শুশুক। এটা একটা খ্যাপা শুশুক!

“মানুষ বন্য হাতিকে পোষ মানায়, বন্য বাঘকেও পোষ মানায়। আমরা এই বন্য শুশুককেও পোষ মানানো শুরু করেছি। এটি লাফিয়ে রিঙের ভিতর দিয়ে পার হবে, একটা বলকে ছুঁড়ে দেবে, শূন্যে ডিগবাজি দেবে। যখন এটাকে পোষ মানানো হবে তখন সে আরও বিচিত্র খেলা দেখাবে। সেইসব খেল দেখার জন্য আপনাদেরকে এখনই আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখছি।

“বন্য শুশুককে পোষ মানানো খুব সহজ নয়। এটাকে দেখলেই বুঝতে পারবেন এর শরীরে হিংস্র সিংহের শক্তি। লেজ দিয়ে আঘাত করে মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে, মুখের কামড়ে শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দিতে পারে। শক্তিশালী মাথা দিয়ে মানুষকে পিষে ফেলতে পারে।

“এই ভয়ংকর জলজন্তুকে আমরা পোষ মানানো শুরু করেছি। সেই পোষ মানানোর জন্যে সুদূর আমেরিকা থেকে এসেছেন পি-টা-র-ব্লাংক! আপনারা করতালি দিয়ে এই মানুষটাকে অভ্যর্থনা জানান।”

সাথে সাথে পানির ট্যাংকে দ্বীপের মতো একটা জায়গায় একজন বিদেশি মানুষ এসে দাঁড়াল, তার শরীরে কালো রঙের বরারের একধরনের পোশাক। তার হাতেও চাবুকের মতো একটা জিনিস। সবাই প্রচণ্ড জোরে হাততালি দিতে শুরু করে।

মাইক্রোফোন-হাতের মানুষটা আবার কথা বলতে শুরু করল, “পিটার ব্ল্যাংক পৃথিবীর একজন সর্বশ্রেষ্ঠ ডলফিন-প্রশিক্ষক। তার হাতে রয়েছে ইলেকট্রিক চাবুক। যখন এই ভয়ংকর শুশুক তার কথার অবাধ্য হয় তিনি এই ইলেকট্রিক চাবুকের তিন হাজার ভোল্ট দিয়ে তাকে আঘাত করেন। হিংস্র শুশুক তখন নিরীহ মোরগছানায় পালটে যায়!”

মানুষটা মোরগছানার কথা বলার সময় হেসে উঠল এবং তার কথায় দর্শকেরাও আনন্দে হেসে ওঠে। মানুষটা এবারে হাত তুলে বলল, “এখন দেখবেন বন্য শুশুকের খেলা!”

সাথে সাথে প্রচণ্ড জোরে একধরনের আদিম বাজনা বাজতে শুরু করে, পিটার ব্ল্যাংক তার ইলেকট্রিক চাবুক ঘোরাতে শুরু করে এবং টুশকি ভয় পেয়ে পানি থেকে লাফিয়ে উপরে উঠে আসে। দর্শকেরা আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করল।

উপর থেকে একটা রিং ঝুলিয়ে দেওয়া হল, সেখানে কাপড় প্যাচানো, একটা দেয়াশলাই দিয়ে সেটাতে আগুন ধরিয়ে দিতেই পুরো রিংটা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করে। শব্দ আরও দ্রুত হতে থাকে, সবাই দেখতে পায় শুশুকটা পানির ট্যাংকে পাগলের মতো ঘুরছে, পিটার ব্ল্যাংক চাবুক দিয়ে আঘাত করতেই একটা আর্তচিৎকারের মতো শব্দ করে শুশুকটা লাফিয়ে আগুনের রিঙের ভিতর দিয়ে যেতে চেষ্টা করে, সেটা ভিতর দিয়ে যেতে পারল না–জ্বলন্ত রিঙে আঘাত করে আবার পানিতে পড়ে গেল।

বকুল আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না।”না-না-না–” বলে চিৎকার করতে করতে সে স্টেজের দিকে ছুটে যেতে থাকে। ছোট একটা মেয়েকে চিৎকার করে যেতে দেখে দর্শকেরা হতচকিত হয়ে গেল। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের লোকজন তাকে ধরার জন্যে ছুটে আসতে থাকে, তার আগেই বকুল পেক্সি গ্লাসের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে গেছে। পানির ট্যাংকের দেয়ালে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে ডাকল, “টুশকি!”

গ্যালারিভরা অসংখ্য দর্শক অবাক হয়ে দেখল শুশুকটি হঠাৎ তীরের মতো ছুটে আসে বকুলের দিকে। বকুল প্লেক্সি গ্লাসের দেয়াল থেকে নিচু পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পানি ছিটিয়ে পড়ল চারদিকে, তার মাঝে সবাই স্পষ্ট দেখতে পায় মাছের মতো সাঁতার কাটছে বাচ্চা একটা মেয়ে আর বিশাল একটা শুশুক এসে তাকে স্পর্শ করছে। মায়েরা যেভাবে সন্তানকে আলিঙ্গন করে ঠিক সেরকম ভালোবাসায় মেয়েটি আলিঙ্গন করছে শুশুকটিকে, দুজনে জড়াজড়ি করে পানির নিচে ঘুরপাক খেতে থাকে, ডিগবাজি খেতে থাকে। শুশুকটি তার মুখ দিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকে আদর করতে থাকে আর গভীর ভালোবাসায় মেয়েটি শুশুকের সারা শরীর হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। শুশুকটি মেয়েটিকে নিয়ে পানির ট্যাংকে ঘুরে বেড়াতে থাকে, আর মেয়েটি আদর করে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। সবাইকে অবাক করে মেয়েটাকে পিঠে নিয়ে শুশুকটা হঠাৎ পানি থেকে লাফিয়ে উঠে আবার পানির গভীরে চলে যায়।

উপস্থিত দর্শকেরা প্রথমে হতচকিত হয়ে বসে থাকে কয়েক মুহূর্ত, তারপর প্রচণ্ড জোরে হাততালি দিয়ে আনন্দধ্বনি দিতে থাকে। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের দুজন মানুষ স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মতো, কী করবে বুঝতে পারছে না তারা। মাইক্রোফোন-হাতের মানুষটি কয়েকবার উপস্থিত দর্শকদের শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু কাউকে শান্ত করানোর কোনো উপায়ই নেই। দর্শকেরা এরকম দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি।

ঠিক তখন দেখতে পেল পুতুলের মতো দেখতে আরেকটি মেয়ে স্টেজে উঠে গেছে, চিৎকার করে কিছু-একটা বলার চেষ্টা করছে সবাইকে। দর্শকেরা হঠাৎ মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুপ করে গেল, তারা শুনতে চায় এই মেয়েটা কী বলবে।

নীলা চিৎকার করে বলল, “এই শুশুকটা বুনো শুশুক না। এটা পোষা শুশুক। এর নাম টুশকি।”

দর্শকেরা চিৎকার করে বলল, “শুনতে পাই না। মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোন।”

নীলা নীল পোশাক পরা মানুষটার হাত থেকে মাইক্রেফোনটা প্রায় কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল, “এই শুশুকটা বুনো শুশুক না। এটা পোষা শুশুক। এর নাম টুশকি!”

দর্শকেরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “টুশকি! টুশকি!”

সাথে সাথে টুশকি বকুলকে পিঠে নিয়ে আবার পানির ভিতর থেকে ভুস করে ভেসে উঠল উপরে।

“ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের লোকেরা টুশকিকে চুরি করে এনেছে। চুরি করে এনে তাকে শাস্তি দিচ্ছে। কষ্ট দিচ্ছে, ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে, আমরা একে ছাড়িয়ে নিতে এসেছি।”

দর্শকেরা চিৎকার করে উঠল, “ছেড়ে দাও! টুশকিকে ছেড়ে দাও।”

“টুশকি থাকে চন্দ্রা নদীতে। পুরো নদীতে সে ঘুরে বেড়ায়, তাকে ডাকলে সে আসে, সে খেলে, সে আমাদেরকে ভালোবাসে। আর এইযে দেখছেন বিদেশি মানুষ তারা গিয়ে টুশকিকে নদী থেকে ধরে এনেছে। সবাইকে বলছে এটা হিংস্র প্রাণী! টুশকি হিংস্র না। একটুও হিংস্র না।

“তাকে আমরা ছাড়িয়ে নিয়ে যাব। নিয়ে তাকে নদীতে ছেড়ে দেব। সে তার নদীতে ঘুরে বেড়াবে।”

উপস্থিত দর্শকেরা চিৎকার করে বলল, “ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও!”

তারপর প্রায় সাথে সাথেই ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে ভাংচুর শুরু হয়ে গেল। লোকজন কিছু চেয়ার ভেঙে ফেলল, পর্দা ছিঁড়ে ফেলল, লাইট বাল্ব গুঁড়িয়ে দিল। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের লোকজনকে ধাওয়া করল। পানির ট্যাংকটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে অবশ্যি বেশি সুবিধে করতে পারল না। ট্যাংকের পিছনে খুঁজে নীলা টুশকিকে নেওয়ার জন্যে একটা জিনিস পেয়ে গেল। একটা চটের থলের মতো। থলেটাকে ভালো করে ভিজিয়ে তার মাঝে টুশকিকে শুইয়ে বকুল নীলা তাকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে, সাথে সাথে বেশ কয়েকজন মানুষ তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে ছুটে এল।

মানুষজনের ভিড় দেখে টুশকি অশান্ত হয়ে ওঠে, লেজের আঘাতে সে দুই একজনকে একেবারে কাবু করে ফেলল। বকুল মাথায় হাত বুলিয়ে ক্রমাগত কথা বলে বলে কোনমতে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।

বাইরে নীলাদের গাড়ি রাখা ছিল। বড় একটা মাইক্রোবাস, ভিতরে অনেক জায়গা। পিছনের সিটে টুশকিকে শুইয়ে রাখা হল।

দর্শকদের একজন বলল, “পানির মাছ শুকনোয় মরে যাবে না?”

চশমা-পরা একজন বলল, “মরবে না। এটা তো মাছ না, এটা একটা প্রাণী। এটা নিঃশ্বাস নেয়।”

“নিঃশ্বাস নেয়?”

“হ্যাঁ, তবে পানির ভিতরে শরীরের ওজনটা টের পায় না, বাইরে ওজনটার জন্যে কষ্ট পাবে। তা ছাড়া–”

“তা ছাড়া কী?” “শরীরটা যেন শুকিয়ে না যায়। নদীতে গিয়ে ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত শরীরটাকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে।”

সাথে সাথে উৎসাহী দর্শকদের একজন একটা বালতি করে পানি নিয়ে এল মাইক্রোবাসের ভিতরে।

গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসেছে শমসের। তার মুখে কখনো কোনো অনুভূতির চিহ্ন পড়ে না, এখনও মুখের ভাব দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। নীলা আর বকুল টুশকির পাশে বসেছে। টুশকির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “ড্রাইভার চাচা, চলেন।

“কোথায়?”

“লঞ্চঘাটে।”

অসংখ্য দর্শক তখনও হৈচৈ করছে তার মাঝে ভিড় ঠেলে মাইক্রোবাসটা বের হয়ে এল। গাড়িটা বড় রাস্তায় ওঠার পর শমসের একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ব্যাপারটা সামলানো কঠিন হবে।”

নীলা আর বকুল দুজনেরই নিজেদের যুদ্ধবিজয়ী বীরের মতো মনে হচ্ছিল তারা একটু অবাক হয়ে বলল, “কোন্ ব্যাপারটা?”

“এই যে টুশকিকে নিয়ে যাচ্ছি।”

“কেন?”

“মনে হয় না আমরা লঞ্চঘাটে যেতে পারব। তার আগেই আমাদেরকে ধরবে।”

“কে ধরবে?”

“পুলিশ। কিংবা মিলিটারি। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের মালিক খুব শক্তিশালী মানুষ। আমাদের আবার কোন বিপদ না হয়।”

শমশেরের গলার স্বর শুনে নীলা হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়। শুকনো গলায় বলল, “কী বিপদ?”

“এদের সাথে আসলে অর্গাইনাইজড ক্রিমিনালের দলের যোগাযোগ আছে। এরা ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করে ফেলতে পারে।”

“তা হলে আমরা কী করব শমসের চাচা?”

“দেখি কী করা যায়।”

শমসের চিন্তিত মুখে বসে বসে কিছু–একটা ভাবতে লাগল। হাতে একটা সেলুলার ফোন ছিল, সেটা দিয়ে কোথায় কোথায় জানি ফোন করল। বাইরে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোতে অন্ধকার কেটে কেটে মাইক্রোবাসটি ছুটে চলছে নদীর দিকে।

শমশেরের আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে মাইক্রোবাসটি একেবারে নদীর ঘাটে চলে এল। নীলাদের সাদা লঞ্চটি এখানে বাঁধা আছে, পাশে একটি ছোট কাজ চালানোর মতো জেটি। যখন মাইক্রোবাসের দরজা খুলে টুশকিকে ধরাধরি করে তারা নদীর দিকে যাচ্ছে ঠিক তখন যেন মাটি খুঁড়ে ডজনখানেক মানুষ তাদেরকে ঘিরে দাঁড়াল। নীলা ভয়ে চিৎকার করে উঠে বলল, “কে?”

অন্ধকারে সামনাসামনি দাঁড়ানো একজন মানুষ এগিয়ে এসে বলল, “আমরা স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক। আমাদের কাছে রিপোর্ট এসেছে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের পানির ট্যাংক থেকে একটা শুশুককে চুরি করা হয়েছে।”

বকুল চিৎকার করে বলল, “মিথ্যো কথা! আমরা চুরি করি নাই। তোমরা চুরি করেছ। তোমরা–”

অন্ধকারে পিছনে থেকে আরেকজন মানুষ বলল, “মিছিমিছি এদের সাথে আর্গুমেন্টে গিয়ে লাভ নেই। শুশুকটাকে ট্রাঙ্কুয়ালাইজ করো নিয়ে যেতে হবে এখনই।”

নীলা আর বকুল অবাক হয়ে দেখল বিদেশি সাহেবটা তার ব্যাগ খুলে একটা বড় সিরিঞ্জ বের করে টুশকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বকুল একটা চিৎকার করে সাহেবটার উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, কিন্তু তার আগেই দুজন পিছন থেকে বকুলকে ধরে ফেলল। বকুল আঁচড়ে কামড়ে মানুষ দুজনকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছিল কিন্তু তবু মানুষগুলো তাকে ছাড়ল না।

বকুল আর নীলা অসহায় আক্রোশে ছটফট করতে করতে দেখল মানুষগুলো টুশকিকে ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল, তারপর ছোট একটা পানির ট্যাংকে তাকে বসিয়ে দিল। ধরাধরি করে তখন সেই ছোট ট্যাংকটাকে বড় একটা পিকআপ টাংকে নিয়ে তুলে ফেলল। ঠিক যখন পিকআপ ট্রাকটা স্টার্ট নেবে তখন হঠাৎ করে পুরো এলাকা একটা গাড়ির হেডলাইটে আলোকিত হয়ে গেল। শমসের নিচু গলায় বলল, “আর চিন্তা নেই।”

“কেন?”

“স্যার এসে গেছেন।”

“সিঙ্গাপুর থেকে?”

“সিঙ্গাপুর থেকে আগেই এসেছেন। আমি গোলমাল দেখে খবর পাঠালাম স্যারকে।”

গাড়িটা নদীর ঘাটে থামল। সেখান থেকে ইশতিয়াক সাহেব খুব ধীরেসুস্থে নামলেন। তার সাথে যে-মানুষটি নামলেন তিনি নিশ্চয়ই খুব বড় কোন মানুষ হবেন। কারণ তাঁকে দেখে সাদা পোশাকের পুলিশেরা খুব জোরে স্যালুট দেওয়া শুরু করল।

ইশতিয়াক সাহেবকে দেখে নীলা প্রায় চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলল, “আব্বু দেখো টুশকিকে নিয়ে যাচ্ছে!”

ইশতিয়াক সাহেব খুব বিচলিত হলেন বলে মনে হল না। হাসিমুখে বললেন, “তাই নাকি?

“হ্যাঁ, আব্বু। তুমি কিছু–একটা করো, না হলে এক্ষুনি নিয়ে যাবে।”

“তোরা যা কাণ্ড করেছিস আমার আবার কি করতে হবে? পুরো ওয়াটার ওয়ার্ল্ড নাকি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিস?”

“আমরা মোটেই জ্বালাইনি আব্বু। পাবলিক জ্বালিয়েছে।”

ইশতিয়াক সাহেব হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “বাংলাদেশের পাবলিক খুব জ্বালাতে পোড়াতে পছন্দ করে, তাই না?”

নীলা রাগ হয়ে বলল, “আব্বু তুমি এখনও হাসছ? তুমি জান ওরা টুশকিকে কী করেছে?”

ইশতিয়াক সাহেব সাথে সাথে গম্ভীর হবার ভান করে বললেন, “ঠিক আছে মা, এই দেখ হাসি বন্ধ করলাম।

ইশতিয়াক সাহেব পিকআপ ট্রাকটার দিকে হেঁটে যেতে শুরু করলেন এবং প্রায় সাথে সাথেই পিকআপের ভিতর থেকে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের একজন দেশি এবং একজন বিদেশি মানুষ নেমে এল। ইশতিয়াক সাহেব এগিয়ে গিয়ে খুব হাসিহাসি মুখে বললেন, “আমার নাম ইশতিয়াক আহমেদ। এই ছোট ডেঞ্জারাস মেয়েটা দেখছেন তার নাম বকুলাপ্পু, তার যে বন্ধু সে হচ্ছে নীলা আর আমি হচ্ছি নীলার বাবা। শুনলাম আমার মেয়ে আর বকুলাপ্পু নাকি কী একটা গোলমাল করেছে?”

মানুষটা শুকনো গলায় বলল, “আমার নাম আবু কায়সার। আমি ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের জি. এম.। এখানে সব মিলিয়ে দশ মিলিওন ডলার ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে, আরও আসছে। আমরা এখানে এই ধরনের বাংলা নাটক–”

“আপনার কি আধঘণ্টা সময় হবে?”

মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, “আধঘণ্টা? কেন?”

“পুরো ব্যাপারটা তা হলে ভালো করে সেটল করে ফেলতে পারতাম।”

“আমি ঠিক জানি না আপনি কীভাবে সেটল করতে চাইছেন।” মানুষটা রাগ রাগ মুখে বলল, “কিন্তু আপনাকে আমি একেবারে পরিষ্কার করে দিচ্ছি আমরা এই প্রজেক্টে একেবারে কোনরকম ঝামেলা সহ্য করব না। নো ওয়ে।”

ইশতিয়াক সাহেব হাসি হাসি মুখে বললেন, “ঠিক আছে। কিন্তু আমার আধঘণ্টা সময় চাই।”

“ঠিক আছে।”

ইশতিয়াক সাহেব যেন খুব একটা বড় ঝামেলা মিটে গেছে সেরকম ভান করে ডাকলেন, “শমসের!”

শমসের নিঃশব্দে এগিয়ে এসে বলল, “জি স্যার?”

“আমার সময় মাত্র আধঘণ্টা। তার মাঝে আমি পুরো ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে চাই।”

“ঠিক আছে স্যার।”

“কতক্ষণ লাগবে তোমার?”

শমমের হাতে আঙুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “পুরোটাই কিনে ফেলবেন?”

“হ্যাঁ, ওয়াটার ওয়ার্ল্ড পুরোটাই কিনে ফেলব।”

“ফাইনালাইজ করতে সময় নেবে তবে ডিলটা পাকা করে আসতে পারি।”

“কতক্ষণ লাগবে?”

“আপনার গাড়িটা আর আপনার সেলুলার ফোনটা যদি ব্যবহার করতে দেন তা হলে কুড়ি মিনিট হয়ে যাবে স্যার।”

ইশতিয়াক সাহেব পকেট থেকে সেলুলার ফোন বের করে বললেন, “নাও।” শমসের নিচু গলায় বলল, “একটা চেক সাইন করে দিতে হবে স্যার।”

“ও আচ্ছা, ভুলেই গিয়েছিলাম।”

ইশতিয়াক সাহেব চেকবই থেকে একটা চেক ছিঁড়ে সেটা সাইন করতে করতে বকুলকে ডাকলেন, “বকুলাপ্পু মা, এদিকে শোনো।”

বকুল এগিয়ে এল, “জি চাচা।”

“তোমার হাতের লেখা কেমন? নীলার হাতের লেখা একেবারে জঘন্য, পড়ার উপায় নেই।”

“আমারটাও বেশি ভাল না।”

“পড়া যায় তো? পড়া গেলেই হবে।”

“জি পড়া যায়।”

ইশতিয়াক সাহেব পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে তার একটা কাগজ ছিঁড়ে বকুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নাও লেখো।”

“কলম নাই চাচা।”

শমসের একটা কলম এগিয়ে দিল। বকুল কলমটা হাতে নিয়ে বলল, “কী লিখব?”

“লেখো ওয়াটার ওয়ার্ল্ড-এর জি. এম. জনাব আবু কায়সার এবং সহযোগী জনাব–”ইশতিয়াক সাহেব হঠাৎ থেমে গিয় বললেন, “বিদেশি সাহেবটার যেন কী নাম?

নীলা বলল, “পিটার ব্ল্যাংক।”

“ও আচ্ছা, লেখো তা হলে ওয়াটার ওয়ার্ল্ড-এর জবাব আবু কায়সার এবং সহযোগী জনাব পিটার ব্ল্যাংককে”

বকুল লেখা শেষ করে বলল, “পিটার ব্লাংককে”

“তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল। তার নিচে আমার নাম লিখে রাখো, শমসের খবর নিয়ে ফিরে এলেই সাইন করে দেব।”

আবু কায়সার নামের মানুষটার চোয়াল ঝুলে পড়ল এবং সে মাছের মতো খাবি খেতে লাগল। সে এখনও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না। বিদেশি সাহেবটা কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে বৃথাই একবার ইশতিয়াক সাহেবের দিকে আরেকবার আবু কায়সারের দিকে তাকাতে লাগল। ইশতিয়াক সাহেব এবারে তাদের পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বকুল কাগজটা ইশতিয়াক সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে চাচা লিখেছি।”

“থ্যাংকু মা।” নীলা এগিয়ে এসে তার বাবার হাত ধরে বলল, “থ্যাংকু আব্বু।”

“ইউ আর ওয়েলকাম।”

“তুমি ওয়াটার ওয়ার্ল্ড কিনে ফেলবে জানলে আমরা একেবারে ভাংচুর করতে দিতাম না।”

“সেটা নিয়ে মাথা ঘামাসনে। নতুন ওয়াটার ওয়ার্ল্ড হবে চন্দ্রা নদীর তীরে পলাশপুর গ্রামে। সেখানে কোনো টুশকিকে বন্দি করা হবে না–তারা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবে। সেই খেলা দেখার জন্যে কোন পয়সাও দিতে হবে কাউকে।

“সত্যি বাবা?”

“সত্যি নয়তো কি মিথ্যা নাকি?” ইশতিয়াক সাহেব বকুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি পারবে না চালাতে?”

“পারব চাচা।”

“গুড। ভালো একটা নাম দিতে হবে। বাংলা নাম–ওয়াটার ওয়ার্ল্ড নাম হল নাকি? ছি!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *