০৯. এলিতার চিঠি

রাশিয়ান পরী আমাকে দীর্ঘ এক চিঠি লিখেছেন। চিঠি ডাকে বা কুরিয়ার সার্ভিসে আসে নি। আমার অনুপস্থিতিতে সে নিজেই এসে দিয়ে গেছে। চিঠি ইংরেজিতে লেখা। মাঝে মাঝে কিছু বাংলা শব্দ ঢুকেছে। তার বাংলায় যে কোন উন্নতি হয়েছে তা বলা যাবে না। প্রিয় হিমু লিখতে গিয়ে লিখেছে ‘পিত্ত হিমু।’ আমি মোটামুটি ঠিক করে দিলাম।

এলিতার চিঠি

প্রিয় হিমু, তোমার দীর্ঘরোগভোগের পেছনে আমার ভূমিকা আছে। আগে ব্যাখ্যা করি। ধোঁয়া বাবাকে দিয়ে শুরু করা যাক। আমি যখন ক্যামেরা ফেরত পেলাম। তখনই বুঝলাম লোকটি ভয়ংকর এক ক্রিমিনাল। ঢাকা ক্রাইম ওয়ার্ল্ডের গড ফাদার। তা-না হলে হারানো ক্যামেরা এত দ্রুত আমার হাতে আসবে না। কিন্তু আমি ভান করলাম ধোঁয়া বাবার অলৌকিক ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ। আমি তার শিষ্য হবার ইচ্ছাও প্রকাশ করলাম। ধোঁয়া বাবার পরিচয় আমার কাছে প্ৰকাশ হয়ে গেছে। এই তথ্য নিশ্চয়ই আমি জানাব না। আমার অভিনয় ভাল হয়েছিল। মনে হয় তুমি ধরতে পার নি।

তোমার সঙ্গে এমন একজন ক্রিমিনালের সখ্যতার বিষয়টা কিছুই বুঝলাম না। একজন সাধুর সঙ্গে পরিচয় হবে একজন সাধুর। ক্রিমিন্যাল চিনবে ক্রিমিন্যালকে।

তোমার কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটি আমি জানতে চাচ্ছিলাম বলেই তোমাকে রাতে হোটেলে থেকে যেতে বলি। আমার যৌন সঙ্গী হবার জন্যে না।

আমার প্রস্তাব শুনে তুমি অবাক হলে, আহত হলে এবং লজ্জিত হলে। আমার ধারণা তুমি ঘৃণাবোধও করেছ। তোমার সেই দৃষ্টি এখনো আমার চোখে ভাসে।

ঝড় বৃষ্টির রাতে তুমি বের হয়ে গেলে এবং নিজেকে কষ্ট দেবার জন্যে সারারাত বৃষ্টিতে ভিজলে। কি করে জানলাম? নিজেকে কষ্ট দেবার এই ধরনের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমি কয়েকবার গিয়েছি। একবারের কথা বলি, মা’র উপর রাগ করে তুষারপাতের মধ্যেই ঘর ছেড়ে বের হয়েছি। অর্ধমৃত অবস্থায় পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

হিমু শোন! আমি একজন ব্রোকেন পরিবারের মেয়ে। আমার বাবা স্কুলের ফুটবল কোচ ছিলেন। এলকোহলিক হবার কারণে তার চাকরি চলে যায়। চরম অর্থনৈতিক সংকটে আমি এবং মা দিশাহারা হয়ে যাই। মা সমস্যার সুন্দর সমাধান করেন। তিনি বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে গৃহত্যাগ করেন। আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ফোস্টার পিতামাতার কাছে।

আমার রূপ আমার কাল হয়ে দাঁড়ায়। তের বছর বয়সে আমার ফোস্টার পিতা এক দুপুরে আমার শোবার ঘরে ঢুকেন। দরজা বন্ধ করে আমার মুখ চেপে ধরেন যাতে আমি শব্দ করতে না পারি। আমার ফোস্টার মা বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তাঁর বৃদ্ধ পিতামাতাকে দেখতে গিয়েছিলেন।

এই ঘটনা আমি গোপন করে যাই। আমি আমার ফোস্টার মা’কে কষ্ট দিতে চাই নি। আমি সরকারের কাছ কোনো কারণ না দেখিয়েই ফোস্টার পরিবার বদলাবার আবেদন করি।

এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে সেখান থেকে অন্য জায়গায় এমন চলতেই থাকে। সব জায়গায় যে একই ঘটনা ঘটেছে তা না। আমার ভিতর তখন অস্থিরতা কাজ করছিল।

আমি আমার নারী সত্তার উপর এতই বিরক্ত হই যে পুরুষের পোশাক পরতে শুরু করি। নিজেকে পরিচয় দিতাম পুরুষ হিসেবে। আমার পুরুষ নাম ছিল ‘পিটার’। এই নাম আমি নিয়েছি পিটার দ্য গ্রেটের কাছ থেকে।

রাশিয়ান জার পিটার দ্য গ্রেটকে নিশ্চয়ই চেন। তোমার ব্যাপক পড়াশোনা, না চেনার কথা না। এই মহান জার রাজকীয় নৌকায় করে প্রমোদ ভ্ৰমণে বের হয়েছিলেন। হঠাৎ দেখলেন দূরে একটা সাধারণ জেলে নৌকা ডুবে যাচ্ছে। নৌকার আরোহী একটা বাচ্চা ছেলে সাঁতার না জানার কারণে ডুবে যাচ্ছে। পিটার তাকে রক্ষা করার জন্যে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শিশুটি উদ্ধার পেল। কিন্তু পিটার দ্য গ্রেট মারা গেলেন।

পুরুষ হতে গেলে এমন পুরুষই হতে হয়। তোমার মত পুতু পুতু পুরুষ না। বৃষ্টির পানি মাথায় লাগানো পনেরো দিনের জন্যে জ্বরে পড়ে কুকু করতে লাগলে।

তোমাকে দীর্ঘ চিঠি লিখলাম। কারণ পরশু ভোরবেলা আমি চলে যাচ্ছি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করছে না।

এই চিঠি লিখতে লিখতে একবার মনে হচ্ছে কি দরকার ফিরে গিয়ে। অদ্ভুত সুন্দর এই দরিদ্র দেশটায় থেকে যাই না কেন। যে হিমু আমার সঙ্গে Hide and seek খেলছে তাকে গোপন কামরা থেকে খুঁজে বের করে আনি।

আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি তখন একটি প্রেমপত্ৰ পাই। শুনলে অবাক হবে আমি পুরুষদের ভাষ্যমতে ভয়ংকর রূপবতী হলেও একটি প্রেমপত্র ছাড়া দ্বিতীয় প্রেমপত্ৰ পাই নি। প্রেমপত্রটি কে পাঠিয়েছে তাও কিন্তু অজানা। বেচারা সম্ভবত নিজেকে প্ৰকাশিত করতে লজ্জাবোধ করছে। সে যাই হোক প্রেমপত্রে একটা কবিতা লেখা ছিল।

I am your man
That is what I am
And I am hare to do
Whater I can.

সুন্দরভাবে কবিতা না? ‘এই মেয়ে শোন। আমি তোমার পুরুষ। তোমার জন্যে সম্ভব যা কিছু সবই আমি করব।’

আমি সুন্দর রেডিও বন্ড কাগজে এই চিঠির একটি জবাব লিখে রেখেছি।

I am your girt
that is what I am
And I am here to do
Whlater I cairn.

এখন ভাবছি এই জবাবটা তোমাকে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়। ভয় নেই, ঠাট্টা করছি।

এখন কি তুমি আমাকে কিছুটা বুঝতে পারছ? সাধারণত দেখা যায় একজন মানুষ অন্য একজনকে বুঝতে পারে না। মূল কারণ ‘হাইড এন্ড সিক’ গেম। মানুষ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। সে চায় অন্যরা তাকে খুঁজে বের করুক।

তোমাকে আমি একেবারেই বুঝতে পারছি না। একদিকে ধোঁয়া বাবার মত ভয়ংকর অপরাধীর সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব অন্যদিকে মানুষের প্রতি তোমার মমতা। তানিজা মেয়েটির কথা ভাব। তুমি চমৎকারভাবে তাদের বাবা মা’র সমস্যার সমাধান করে দিলে। Fairy tale এর মত তারা এখন সুখে আছে। এর মধ্যে তারা একদিন আমাকে লাঞ্চ খাইয়েছে। সারাদিন তাদের সঙ্গে থেকেছি। রাতেও থাকতে হয়েছে। কারণ তানিজা মেয়েটি কিছুতেই আমাকে হোটেলে ফিরতে দেবে না।

এই মেয়েটির মত আমারো বাবা মা’কে নিয়ে একটি সুখের সংসার হতে পারত। হয়নি। কারণ সেখানে হিমু বলে কেউ ছিল না।

তোমার আশেপাশে যারা থাকে তারা তোমাকে কি চোখে দেখে তা নিশ্চয়ই তুমি জান। একটা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। একদিন কাদেরের সঙ্গে গল্প করছি কি প্রসঙ্গে যেন তোমার কথা উঠল। আমি বললাম, তোমার হিমু ভাইজান একজন ধান্ধবাজ বদ লোক। কাদের বলল, হিমু ভাইজানেরে নিয়া কেউ যদি মন্দ কথা বলে আমি তার কল্লা ফালায়ে দিব।

আমি বললাম, সত্যি কল্লা ফেলবে।

কাদের বলল, অবশ্যই। মাটির কসম, পানির কসম আর আগুনের কসম। আমি ফলের ঝুরিতে রাখা ছুরি বের করে বললাম, এই নাও ছুড়ি। এখন আমার কল্লা ফেল। সে ছুড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তার চোখে আগুন ঝাক ঝক করছে। ঠিকমত দেখাশোনা না করলে এই ছেলেটি কিন্তু ভয়ংকর সন্ত্রাসী হয়ে বের হবে। সম্ভব হলে আমি তাকে নিয়ে আমেরিকা চলে যেতাম।

এই ছেলেটির জন্যে কিছু কি করা যায়? কাদের আমাকে কি ডাকে জান? ‘মাইজি’। আমি বললাম ‘মাইজি’ শব্দের মানে কি?

সে জবাব দেয় না। হোটেলের বাঙালি কর্মচারীদের কাছে শুনলাম, মাইজি মানে মা। একটি অজানা অচেনা ছেলে দিনের পর দিন আমাকে মা ডেকে যাচ্ছে আর আমি বুঝতেই পারি নি। আশ্চর্য না?

কাদেরের জন্যে আমি দশ হাজার ডলার রেখে যাচ্ছি। তুমি ব্যবস্থা করো।

তুমি ভাল থেকো।
এলিতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *