এখন এই পরিবেশের মধ্যে হঠাৎ ছুটুকবাবু যে কেন ডেকেছেন বোঝা গেল না।
ঘরে গিয়ে ভূতনাথ সবে জামা কাপড় ছাড়তে শুরু করেছে, এমন সময় শশী এল। বললে—শালাবাবু ছুটুকবাবু আপনাকে ডেকেছে একবার।
ছুটুকবাবুর চাকর শশী। তোষাখানার কাছে দু একবার দেখেছে তাকে।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কেন রে? ডেকেছে কেন?
শশী বললে—বিরিজ সিংকে বলে রেখেছিলাম—আপনি এলেই খবর দিতে, বলেনি আপনাকে?
ভূতনাথ বললে—বলেছে সে, কিন্তু কি দরকার বুঝতে পারছিনে—জানিস কিছু তুই?
শশী বললে—ছুটুকবাবু আজ বিকেল বেলা আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, মাস্টারবাবুর ঘরে ড়ুগি তবলা বাজায় কে রে? আমি বললাম—মাস্টারবাবুর শালা, শুনে বাবু বললেন—আজ একবার ডাকিস তো, বেশ হাত—তা চলুন আজ্ঞে।
–বলে দে আমি আসছি এখুনি। বলে খাওয়া-দাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে ভূতনাথ সেদিনই ছুটুকবাবুর আসরে গিয়েছিল। অনেক দিন আগেকার কথা। স্মৃতির মণিকোঠায় সব কথা জমা করবার মতো হয় তো জায়গা নেই আর। তবু ছুটুকবাবুকে বোধহয় কখনও ভোলা যাবে না। শুচিবায়ুগ্রস্থ বিধবা বড়বউঠাকরুণের একমাত্র ছেলে। কার্তিকের মতো চেহারা। অমন স্বাস্থ্য। কিন্তু যে-বংশের ঐশ্বর্যের আর বিলাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শনি প্রবেশ করেছে তাকে কে বাঁচাতে পারবে।
বদরিকাবাবুর একটা কথা বার বার মনে পড়ে ভূতনাথের।
বদরিকাবাবু বলতে—এ সংসারে যে খেলতে জানে সে কাণাকড়ি নিয়েও খেলে—যে ভালো হতে চায়, ভালো থাকতে চায়, তার জন্যে সব পথই খোলা।
হয় তো তাই।
নইলে ছুটুকবাবুই বা অমন হবে কেন।
ছুটুকবাবু দেখেই বললে—আরে আসুন, আসুন স্যার, ঘরে বসে রোজ তবলা শুনি আর ভাবি, এ তো পেশাদারী হাত। কানির কাজ এমন তো শুনিনি আগে—কোন ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন ভাই?
ছুটুকবাবুর বন্ধুবান্ধবে ঘর ভর্তি। একজন তানপুরা ধরেছে। আর একজন হারমোনিয়ম। সকলেরই ঢেউ তোলা বাবরি ছাঁট চুল। চুনোট করা উড়নি। কোঁচানো ধুতি। মেঝের ওপর একহাত পুরু গদিতে ঘর জোড়া। ধবধবে সাটিনের চাদর। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ছুটুকবাবু বসে বসেই ঘামছে। পানের ডিবে, জরদার কৌটো। সিগারেট।
ঠুংরি গানের তানের সময় ছুটুকবাবু মাঝে মাঝে চিৎকার করছে—কেয়াবাৎ-কেয়াবাৎ
সমের মাথায় এসে তবলার চাটির সঙ্গে গানের ঝোক মিলে গেলেই বলছেন—শোহ-আল্লা—শোহন্-আল্লা–
অনেক দিন অভ্যেস নেই ভূতনাথের। গাঁয়ের ওস্তাদের কাছে শেখা। দারা, কাহারবা আর একতালা নিয়েই বেশি ঘাটাঘাটি ছিল। কচিৎ কদাচিৎ যৎ, মধ্যমান, চলত। পূজোর সময় রসিক মাস্টারের ইয়ার-বক্সির এলে ঠুংরি টপ্পা হতো। যাত্রার আসরে মেথর-মেথরাণীর গানের সঙ্গে খেমটারই বেশি চল।
ছুটুকবাবু চিৎকার করে বললে—আর ঠুংরি ভালো লাগছে না–এবার গজল হোক মাইরি-গজল গা বিশে।
ছুটুকবাবুর হুকুম। গজল ধরলো বিশে মানে বিশ্বম্ভর। গলাটা ভালো। ধ ধরতে না ধরতেই জমে উঠলো।
সঙ্গে ভূতনাথের কাওয়ালির আড়ির ঠেকা।
ছুকবাবু আর পারলে না। দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে— এবার গান জমে গিয়েছে মাইরি। তারপর উঠে গিয়ে পাশের পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। খানিক পরেই কাপড়ের কোঁচায় ঠোট মুছতে মুছতে আবার এসে তাকিয়ায় হেলান দিলে। গান তখন বেশ জমে উঠেছে। ছুটুকবাবু আরও ঘামতে লাগলো। লয় বাড়ছে। হাত তখন টন্ টন্ করছে ভূতনাথের। সমস্ত ঘরখানা মজে গিয়েছে সুরে।
বিশ্বম্ভর দুলছে। চোখ বোজা। উন্মাদ হয়ে গাইছে :–জখমী দিলকো না মেরে দুখায়া করো—
তারপর এক সময় সম পড়লো। হো হো হো করে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ছুটুকবাবু। এক এক করে সবাই এক-একবার পর্দার ভেতরে গিয়ে ঠোট মুছতে মুছতে ফিরে এসেছে। চোখ লাল সবার।
নেশার ঝেকে ছুটুকবাবু ভূতনাথের পা ছুঁতে এল।
–করেন কী, করেন কী, আহা হা—বলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় ভূতনাথ।
মোসাহেবরা বলে—তা পায়ে না হয় হাতই দিলেন ছুটুকবাবু, পা তো আর আপনার ক্ষয়ে যাচ্ছে না!
ছুটুকবাবু পায়ে হাত দেবার চেষ্টায় উপুড় হয়ে পড়লো। বললে বাড়ির মধ্যে এমন গুণী রয়েছে, আর তোরা গোঁসাইজীর খোশামোদ করিস, খবরদার—এই শশী, শশে।
পর্দার ভেতর থেকে শশী বেরিয়ে এল।
ছুটুকবাবু বললে—শোন বেটা, কাল থেকে যদি গোঁসাইজীকে বাড়িতে ঢুকতে দিবি তো তোকে খুন করে ফেলবো, ব্রিজ সিংকেও খুন করব আমি। তারপর হঠাৎ শ্রদ্ধায় ভক্তিতে ছুটুকবাবু মুখের কাছে মুখ এনে বললে-বড় খাটুনি গিয়েছে আপনার, একটু হবে নাকি স্যার?
ছুটুকবাবুর কথা কিছু বুঝতে পারলে না ভূতনাথ। মুখ দিয়ে মদের গন্ধ অবশ্য আসছিল। তবু ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে কী?
—ভালো জিনিষ ভাই, দিশি মাল নয়, বেশি নয়, একটুখানি, শ্যাম্পেন দিক একটু–
ভূতনাথ বড় বিব্রত বোধ করলো।
সামনের একজন বললে—ছুটুকবাবু ভালোবেসে দিচ্ছেন, না বলবেন না ভূতনাথবাবু—বলুন হ্যাঁ।
ছুটুকবাবু বললেন—বেশ, তা হলে–সিদ্ধির সরবৎ দিকতাও আছে। ওরে শশে—বেশ পেস্তা বাদাম দিয়ে যুং করে..পর্দার ভেতরে চলে যান, কেউ দেখতে পাবে না।
রাত বারোটা পর্যন্ত এমনি চললে সেদিন। গজলের পর টপ্পা। নিধুবাবুর টপ্পা। তারপর “চামেলী ফুলি চম্পা–”
শেষে যখন সবাই উঠলো, ছুটুকবাবুর তখন উথান শক্তি রহিত। তাকিয়ায় মাথা দিয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে। সমস্ত বাড়ি নিঝুম হয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ ভূতনাথেরও জ্ঞান ছিল না। সমস্ত পরিবেশটা যেন কেমন সব ভুলিয়ে দিয়েছিল। গানবাজনা বন্ধ হবার পর, বাইরে আসতেই আচমকা যেন একটা আঘাত পেলে ভূতনাথ।
ভূতনাথ বিশুবাবুকে বললে—আপনার গানটা বেশ জমেছিল আজ।
বিশ্বম্ভর বললে—মনের মতো সঙ্গত করেছিলেন স্যার—গান গেয়ে বেশ আয়েশ হলো।
সকলেই অল্পবিস্তর অপ্রকৃতিস্থ। সবাই প্রায় ভূতনাথের সমবয়স্ক।
পরেশ বললে—সবাই আমরা অমৃত খেলাম—আপনি স্যার একেবারে নিরস্তু—এ কেমন যেন এক যাত্রায় পৃথক ফল…
কান্তিধর বললে—আহা, আজকে প্রথম দিন, যাক না, তুই বড় তাড়াহুড়ো করিস পরেশ। ছুটুকবাবুও কি প্রথম প্রথম খেত, কত কষ্টে নেশাটি ধরিয়ে দিয়েছি—আর এখন?
দরজা পর্যন্ত সবাইকে এগিয়ে দিয়ে আবার ফিরে এসে নিজের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দাঁড়ালো ভূতনাথ। ব্রজরাখাল জানতে পেরেছে নাকি? বজ্ররাখালকে যাবার সময় জিজ্ঞেস করাও হয়নি। এখানে ব্ৰজরাখালের পরিচয়-সুবাদেই থাকা। যাতে ব্ৰজরাখালের কোনো মর্যাদা হানি হয়, এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়। আস্তে আস্তে ঘরের চাবি খুলে দরজায় খিল বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ কেমন থমকে দাঁড়ালো সে!
মনে হলো গাড়ি বারান্দার সদর রাস্তা দিয়ে কে যেন সন্তর্পণে বেরোলো। অস্পষ্ট মূর্তি। কিন্তু মেয়েমানুষ বলেই যেন মনে হয়। চারিদিকে নির্জনতা। সমস্ত ঘরের আলো নিভে গিয়েছে। ইব্রাহিমের ঘরের ছাদের ওপর একটা তেলের বাতি জ্বলছে, সেই আলোর কিছু রেখা এসে পড়েছে ইট-বাঁধানো দেউড়ির ওপর। আশে পাশে কেউ কোথাও নেই। শুধু গেটের এক পাশে বসে ব্রিজ-সিং বন্দুক হাতে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পাহারা দিচ্ছে। এমন সময় সদর-দরজা দিয়ে কে বেরোবে।
কেমন যেন কৌতূহল হলো ভূতনাথের।
আজকের মতন এত রাত্রে এ-বাড়ির এখনকার দৃশ্য কখনও দেখবার সৌভাগ্য হয়নি আগে। কিন্তু তবু, এ-বাড়ির আবহাওয়া আর হালচালের যতখানি পরিচয় সে পেয়েছে, তাতে যেন ওই নারী-মূর্তি দেখে অবাক হওয়ারই কথা।
উঠোন পার হবার পথে ওপরের আলোটা এসে পড়তেই যেন চেনা-চেনা মনে হলো। তারপর মূর্তিটা নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ালো ছুটুকবাবুর বৈঠকখানার সামনে।
সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে কে যেন দরজা খুলে দিলে। ভূতনাথ ঘরের ভেতরকার আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলে শশীকে। ছুটুকবাবুর চাকর শশী। আর নারী-মূর্তিটাও এক নিমেষের জন্যে ভূতনাথের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠলো!
গিরি! মেজগিন্নীর ঝি গিরি!
কিন্তু একটি মুহূর্ত। তারপরেই ঘরের দরজা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার সমস্ত অন্ধকার। একটা অন্যায় কৌতূহল ভূতনাথের সমস্ত মনকে যেন পঙ্কিল করে তুললে। এখনও কর্তারা কেউ বাড়ি ফেরেননি। আকাশের তারার দিকে চেয়ে রাতটা অনুমান করবার চেষ্টা করলে একবার। দ্বিতীয় প্রহর শেষ হবার উপক্রম। মেজকর্তা এখনও ফেরেননি। ছোটকর্তা ফিরবেন কিনা কোনো নিশ্চয়তা নেই। আজ না-ও ফিরতে পারেন। বন্ধ বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে শুধু দুজন—আধ-অচেতন ছুটুকবাবু, আর শশা। ওদের মধ্যে কে?
ঘুমে চোখ জুড়ে আসছিল কিন্তু শুতে গিয়ে ঘুম এল না তার।
ব্ৰজরাখাল সকাল বেলা দেখা হলেই জিজ্ঞেস করলে-কাল কোথায় ছিলে বড়কুটুম? তারপর সব শুনে বললে—তা ভালো তবে বুঝে শুনে চলে।
—কেন? ভূতনাথ একটু অবাক হয়ে গেল।
ব্রজরাখাল বললে—এখন সময় নেই আমার, আপিসে যেতে হবে, তবে একটা কথা বলি, ঠাকুর বলতেন—কাঁদলে কুম্ভক আপনিই হয়। গান-বাজনা টপ্পা-ঠুংরি ভালো বৈকি—কিন্তু মাঝে মাঝে একটু কেঁদো বড়কুটুম।
—কাঁদবো কেন মিছিমিছি।
—সে অনেক কথা বড়কুটুম, এখন আর আমার সময় নেই, আজকে আমার বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হবে, শীগ্রি নরেন আসছে, তারই তোড়জোড় হবে সব…
-নরেন কে—ব্রজরাখাল?
–ওই তোমার বিবেকানন্দ। ঠাকুর বলতেন,নরেন একদিন সমস্ত পৃথিবী কাপিয়ে দেবে—তা কাঁপিয়ে শুধু নয়, ভূমিকম্প লাগিয়ে দিয়েছিল আমেরিকায়। প্রতাপ মজুমদার, আনিবেশান্ত সব থ’ হয়ে গিয়েছেন। সেদিনকার ছোকরা নরেন তারই মধ্যে এত—তারা তো কেউ জানে না—এ শুধু ঠাকুরেরই লীলা.. তারপর থেমে আবার বললে—দেখবে বড়কুটুম, এবার আর ঠেকাতে পারবে না কেউ, একদিন এই নরেনই সমস্ত দেশকে বাঁচাবে। অনেক নেড়া-নেড়ী এসেছে, অনেক পাদরী এল, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনাও হলো অনেক—কিন্তু দরিদ্রনারায়ণদের কথা আগে কেউ অমন করে বলেনি।
ভূতনাথ চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো।
–আপিস যাবার দেরি হয়ে গিয়েছে। তবু ব্ৰজরাখাল বলতে লাগলোনরেন আমাদের চোখ ফুটিয়ে দিয়েছে এবার। বলেছে— সাত শ’ বছরের মুসলমান রাজত্বে ছ’ কোটি লোক মুসলমান হয়েছে, আর এক শ’ বছরের ইংরেজ রাজত্বে ছত্রিশ লক্ষ খৃস্টান—এটা কেন হয়? কেন হয়, এটা আগে কেউ এতদিন ভাবেনি বড়কুটুম, এবার মাদ্রাজে বক্তৃতা দিয়েছে নরেন তাতে বলেছে অনেক কথা। দাসত্ব বড় খারাপ জিনিষ বড়কুটুম—দেখো না, অনেকে কলম্বোতে গেল নরেনের সঙ্গে দেখা করতে—আমি পারলুম না।
আপিস যাবার সময় কোনো দিকে খেয়াল থাকে না আর। খানিক বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল ব্রজরাখাল। বললে— মাইনে পেয়েছে। বড়কুটুম? পেয়েছে শুনে বললে—একটা টাকা দাও তো আমাকে।
–কেন, তুমিও তো কাল পেয়েছে। মাইনে?
—পেয়েছি, কিন্তু…ব্রজরাখাল হাসলে। বললে-পেয়েছিলাম, কিন্তু বরানগরে গিয়ে দেখি গুরুভাইরা সব উপোস করছে, ঠাকুর দেহ রাখবার পর থেকে গুরুভাইদের বড় কষ্টে দিন কাটছে, ভিক্ষে করে পেট চালায় সব, কাল গিয়ে দেখি রান্না-বান্নার যোগাড় নেই —তা শুধু তো বেদ-বেদান্ত পড়লে পেট ভরবে না, কারো খাবার কথা মনেই ছিল না, নরেন আমেরিকা থেকে কিছু পাঠিয়েছিল— আর আমিও সব মাইনেটা দিয়ে এলাম গুরুভাইদের হাতে।
একটা টাকা দিয়ে ভূতনাথ বললে—তারপরে সারা মাস যে সামনে পড়ে আছে-তখন?
ব্ৰজরাখাল হাসতে লাগলো। বললে তোমাকে উপোস করাবো না বড়কুটুম, ভয় নেই। তারপর বললে-ঠাকুর বলতেন–কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে না পারলে ভজন-সাধন হয় না। তা তোমার বোন মরে একটা দিক থেকে আমার বাঁচিয়ে গিয়েছে। আর টাকা, সেটা কী করে যে ত্যাগ করি, আজই যদি চাকরিটা ছেড়ে দেই তো কালই অনেক গুলো পরিবার উপোস করতে শুরু করবে। প্রত্যেক মাসের শেষে আমার মুখ চেয়ে যে বসে থাকে তার। এক টাকা এগারো আনা জোড়া কাপড়—তা-ই একখানা কাপড়ে বছর চালায় সব হতভাগীরা।
বেশি সময় ছিল না। ব্রজরাখাল চলে গেল।
সেদিন ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিস থেকে আসবার পথে সেই কথাই মনে পড়লো। ফতেপুরে থাকতে মানুষের দারিদ্র এমন করে কখনও তত চোখে পড়তো না। এখানে কলকাতা শহরের মধ্যে থাকতে ক’মাস থাকতেই যেন চোখ খুলে গিয়েছে ভূতনাথের। চারদিকে বড় অভাব। বড় হাহাকার। রাস্তায় একটা ভিখিরী আধলা চাইতে চাইতে বড়বাজার থেকে একেবারে মাধব বাবুর বাজার পর্যন্ত পেছন পেছন আসে। বলে–একটা আধলা-পয়সা দাও বাবু—একটা আধলা-পয়সা দাও।
ভূতনাথ বলে—কোথায় বাড়ি তোমার?
বুড়ো মানুষ। গেরো দিয়ে দিয়ে কাপড়খানা কোনোমতে কোমরে জড়িয়ে আছে। বলে-বন্যে হয়ে আমাদের দেশ-গাঁ সব ড়ুবে গিয়েছে গো, ভাসতে ভাসতে ডাঙায় এসে উঠেছি—দু’দিন কিছু খাইনি—একটা আধা পয়সা দাও বাবু।
সেদিন শিব ঠাকুরের গলি দিয়ে আসতে আসতে আর একজন এক বাড়ির ভেতর থেকে ডেকেছিল।
—বাবা শুনছো—ও বাবা—
কেউ কোথাও নেই। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। রাস্তায় লোকজন কেউ নেই বললেই চলে। স্ত্রীলোকের গলার শব্দ।
—এই যে বাবা, আমি এই দরজার ফাঁক দিয়ে কথা বলছি।
–দরজা খুলুন না, কী হয়েছে আপনার?
—কিছু মনে নিও না বাবা, তুমি আমার ছেলের মতন, একখান কাপড় নেই যে বেয়েই সামনে, এই দুটো পয়সা দিচ্ছি, দু’ পয়সার মুড়ি কিনে ওই জানালা দিয়ে গলিয়ে ফেলে দাও না বাবা।
কোথায় মেদিনীপুরের দুর্ভিক্ষ, ফরিদপুরের বন্যা—সবাই বুঝি জড়ো হয়েছে এখানে। অথচ বড়বাড়িতে অতগুলো লোক, অকারণে কত অপব্যয় হয়, কেউ দেখে না। বিলেত থেকে কাঠের বাক্স ভর্তি নানান জিনিষ। কাঠ-গ্লাশের ঝাড়-লণ্ঠন। একবার এল সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি উড়ন্ত পরী! গায়ে কাপড় নেই। হাতে একটা সাপ জড়ানো। মেজবাবুর নাচ ঘর সাজানো হলো। হাতীবাগানের বাজার থেকে নীলেমে অর্কিড গাছ কিনে নিয়ে এল ভৈরববাবু। চীনে-অর্কিড। একটা বাচ্চা গাছের দাম তিন শ’ টাকা। কলকাতা কেন, সারা বাঙলা দেশে কারো বাড়িতে এ-গাছ পাবে না। এই এক চিলতে গাছের জন্যে খদ্দের হলো অনেক। সবাই এল কিনতে। খাস লাট সাহেবের বাড়ি থেকে বাগানের সাহেব মালী এল, এল ঠণ্ঠনে, পাথুরেঘাটা, হাটখোলা, সব বাড়ির লোক। পাঁচ টাকা থেকে হু হু করে দর উঠতে লাগলো।
ভৈরববাবু যদি বলে—পঞ্চাশ—
ঠনঠনের দত্তবাবুরা বলে—বাহান্নো—
মল্লিকবাবুর লোক বলে—পঞ্চান্নো–
সেই গাছ কেনা হলো শেষ পর্যন্ত তিন শ’ টাকা দিয়ে। ভৈরববাবু সগর্বে বুক ফুলিয়ে সকলকে হারিয়ে দিয়ে গাছ নিয়ে এলেন বড়বাড়িতে। গাছ দেখতে জড়ো হলো বার-বাড়ির সবাই। অন্দর মহলেও পাঠানো হলো। মেজগিন্নী দেখতে চেয়েছেন। তিন শ’ টাকার গাছ। সোনা-দানা নয়, কুকুর-বেড়াল নয়, কিছু নয়-গাছ। মরে গেলেই গেল।
তা হোক, ভৈরববাবু গোঁফে তা দিতে দিতে বলতে লাগলো— বাবু তো বাবু মেজবাবু—ছেনি দত্ত বাবুয়ানি করতে এসেছে কার সঙ্গে জানে না।
সেই গাছ প্রতিষ্ঠা হলো। তার জন্যে ঘর তৈরি হলো। মেজবাবু নিজে এসে তদারক করে গেলেন।
ওদিকে খবর পৌঁছুল লাট সাহেবের কাছে। চীনে-অর্কিড তিন শ’ টাকায় কিনে নিয়েছে বড়বাড়ির চৌধুরী বাবুরা। লাট সাহেব খবর পাঠালে—গাছ দেখতে আসবেন তিনি। সোজা কথা নয়। সাজ-সাজ রব পড়ে গেল। ভেলভেটের চাদর পড়লে নাচঘরে। ঝাড়-লণ্ঠন ঝাড়-পোছ হলো। চুনকাম হলো ভেতরে বাইরে। রাজা-রাণীর ছবি দু’খানা মুছে টাঙানো হলো মস্ত আয়নাটার মাথায়। তার ওপর লাল শালু দিয়ে লেখা হলোGod Save the King. লাট সাহেব এসে তো শুধু মুখে যেতে পারেন না। খানার ব্যবস্থাও হলো। খাসগেলাশের ভেতর গ্যাসের বাতি জ্বললো। বাড়ি সুদ্ধ লোকের নতুন সাজ-পোষাকের ফরমাশ গেল ওস্তাগরের কাছে।
তিন শ’ টাকা গাছের পেছনে কিছু না হোক তিন হাজার টাকা বেরিয়ে গেল নগদ।
সেকালের বনমালী সরকার লেন-এর চৌহদ্দি গাড়িতে গাড়িতে ছেয়ে গেল।
তখন বড়কর্তা বেঁচে। লাট সাহেবকে গিয়ে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন তিনি। লাট সাহেব আর লাট সাহেবের মেম।
অনেক খানাপিনা হলো। খানার চেয়ে পানীয়ই বেশি।
তা গাছ দেখে ভারি প্রশংসা করলেন লাট সাহেব। ইণ্ডিয়ায় এত সব ধনী মহাধনী রয়েছে। পরিচয় করে কৃতার্থ হলেন তিনি। খানা খেলেন। ঘুরে ঘুরে সমস্ত বাড়িটা দেখলেন। বাঈজীর দল এসেছিল লক্ষ্ণৌ থেকে। পাঁচ শ’ টাকার মুজররা। সে-নাচ দেখলেন। বেনারসী পান খেলেন।
যাবার সময় বড়কর্তা সামনে এগিয়ে গিয়ে চীনে-অর্কিড গাছটা নিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন। হুজর যদি গ্রহণ করেন তো চৌধুরী বংশ নিজেদের কৃতকৃতাৰ্থ বোধ করবেন।
লাট সাহেব নিজে হাতে করে আর নিলেন না। সঙ্গের লোক নিলে। যার জন্যে এত কাণ্ড, সেই গাছই চলে গেল শেষ পর্যন্ত লাট সাহেবের বাগানে।
কিন্তু ফল ফললো কয়েক বছর পরেই। বড়বাবু বৈদূর্যমণি চৌধুরী খেতাব পেলেন। তখন থেকে হলেন রাজাবাহাদুর বৈদূর্যমণি চৌধুরী।
বড়ভাই বৈদূর্যমণি চৌধুরী, মেজভাই হিরণ্যমণি চৌধুরী আর ছোট কৌস্তুভমণি চৌধুরী। বৈদূর্যমণির ইয়া পালোয়ানি চেহারা। কাশীর পালোয়ান বাড়িতে পুষেছিলেন শরীরটা গড়ে তোলবার জন্যে। লোহাকাঠের মস্ত দুটো মুগুর দু হাতে নিয়ে ভাজতেন দু’ ঘণ্টা ধরে। সংসারের মাথায় ছিলেন তিনি। ওদিকে জমিদারী দেখা, বাড়ির প্রত্যেকটি লোকের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রাখা, তা ছাড়া তাঁর ছিল নিজের কুস্তির সখ। পৈত্রিক সম্পত্তির শুধু রক্ষা নয় আয়তনও বৃদ্ধি করেছিলেন তিনি। তার আমলে বড়বাড়ির এ অবস্থা ছিল না। তখন এই বড়বাড়ির নাম করলে চিনতে পারতো সব লোক। আর এখন
এ সব গল্প বদরিকাবাবুর কাছে শোনা। কোথায় কোন্ পূর্বপুরুষ মুর্শিদকুলী খাঁ’র কাছে কানুনগোর কাজ করেছিল—তারই বংশধর।
বদরিকাবাবু বলেন–তাই তো বলি খেলতে জানলে কাণাকড়ি নিয়েও খেলা যায় হে—তা বড়বাবু যখন রাজাবাহাদুর হলো, চারদিকে কত ধুম-ধাম—সায়েব মেমের খানা-পিনা হলো—আমি এই ঘরটিতে চুপ করে বসে রইলাম। পিপে-পিপে মদ খেলে সবাই। আমি বললাম—তোমরা যাও, আমি ওর মধ্যে নেই, রাজাবাহাদুর হয়নি তত বড়বাবু, ‘রাজসাপ’ হয়েছে—যা বলেছিলুম সব ফলে গিয়েছে—সেই বড়বাবু মরলে একদিন, মরবার সময় এক ফোটা জল পর্যন্ত পায়নি।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করে—কেন?
বদরিকাবাবু রেগে গেল। বললে—তুই আবার জিজ্ঞেস করছিস, কেন? সাত শ’ বছর মোগল রাজত্বে ছ’ কোটি লোক মুসলমান হয়ে গিয়েছে, আর এক শ’ বছর ইংরেজ রাজত্বে ছত্রিশ লক্ষ লোক খৃস্টান হয়ে গেল—সে কি ভাবছিস ওমনি-ওমনি? নিমকহারামির গুনেগার দিতে হবে না? দেখবি সব যাবে—সব যাবে—কিছু থাকবে না, তাই দেখবো বলেই তো সারাদিন চিৎপাৎ হয়ে শুয়ে থাকি—আর টাক ঘড়িটার টিক-টিক শব্দ শুনি।
আজো ভূতনাথের মনে পড়ে বদরিকাবাবুর কথাগুলো বর্ণে বর্ণে কেমন মিলে গেল একে একে।
আপিস থেকে ফেরবার পথে বাড়ির সামনে আসতেই সেদিনও ব্রিজ সিং ডাকলে—শালাবাবু, ছুটুকবাবু বোলায়া আপকো।