০৯. এক আশ্চর্য ঘটনা

॥ ৯ ॥

বিকালে এক আশ্চর্য ঘটনা। ইনস্পেক্টর চৌবে পাঁচটা নাগাত এসে বললেন, ‘কেস খতম্‌। যা ভেবেছিলাম তাই। জগন্নাথ চাটুজ্যে নিয়েছিল পাথরটা। সার্চ করে কিছু পাওয়া যায়নি অবশ্য, কিন্তু তারপর একটু পুলিশী চাপ দেওয়াতে সত্যিটা বেরিয়ে পড়ে—আর সেই সঙ্গে পাথরটাও। একটা ফুলের টবে পুঁতে রেখেছিল।’

‘আপনি নিয়ে এসেছেন পাথরটা?’

‘ন্যাচারেলি।’

চৌবে পকেট থেকে পাথরটা বার করলেন। আবার নতুন করে সেটার ঝলমলে রং দেখে মনটা কেমন জানি হয়ে গেল।

‘আশ্চর্য!’ বলল ফেলুদা।

‘কেন?’

‘লোকটাকে দেখে চোর বলে বিশ্বাস করা যায়, কিন্তু জখমকারী বলে যায় না। একেবারে ভেতো বাঙালী।’

‘মানুষের চেহারা দেখে সব সময় তার ভেতরটা জাজ করা যায় মিঃ মিত্তির।’

‘সেটা অবশ্য আমার অভিজ্ঞতাই বলে।’

‘তাহলে পাথরটাকে এবার স্বস্থানে চালান দিই?’

‘চলুন।’

আমরা চারজনে দশ নম্বর ঘরের দিকে রওনা দিলাম।

পিটার দরজা খুলল।

‘ওয়েল, মিঃ রবার্টসন’, বললেন চৌবে, ‘আই হ্যাভ এ লিট্‌ল গিফ্‌ট ফর ইউ।’

‘হোয়াট?’

চৌবে পকেট থেকে কৌটোটা বার করে পিটারের হাতে দিলেন।

পিটার ও টমের মুখ হাঁ।

‘বাট, হোয়্যার—হোয়্যার…?’

‘সেটা না হয় আর নাই বললাম। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে সেটাই হল আসল কথা। মিঃ ম্যাক্সওয়েল নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে ভারতীয় পুলিশ বেশ করিৎকর্মা। এবার অবিশ্যি তোমরা এটা নিয়ে কী করবে দ্যাট ইজ আপ টু ইউ। বিক্রি করতে পার, ক্যালকাটা মিউজিয়ামেও দিয়ে দিতে পার।’

পিটার ও টম দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, দুজনেই এবার ধপ্ করে খাটে বসে পড়ল। পিটার মৃদুস্বরে বলল, ‘গুড শো! কনগ্র্যাচুলেশন্‌স।’

‘এবার তাহলে চলি?’ বললেন চৌবে।

‘আই ডোন্ট নো হাউ টু থ্যাঙ্ক ইউ।’ বলল টম ম্যাক্সওয়েল।

‘ডোন্ট। তোমার মনে যে ধন্যবাদ দেবার প্রশ্নটা জেগেছে সেটাই বড় কথা। আমরা তাতেই খুশি।’

‘কী মনে হচ্ছে মশাই?’ পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।

‘কোথায় যেন গণ্ডগোল’, বিড়বিড় করে বলল ফেলুদা।

‘আমি বলব কোথায় গণ্ডগোল? এই ফর দ্য ফার্স্ট টাইম দারোগার কাছে হেরে গেলেন ফেলু মিত্তির। সেইখানেই গণ্ডগোল।’

‘উঁহু। তা নয়। মুশকিল হচ্ছে কি আমি বিশ্বাস করছি না আমি হেরে গেছি।’

ফেলুদা চুপ করে গেল। তারপর বলল, ‘তোপ্‌সে—তুই এখন কিছুক্ষণ লালমোহনবাবুর ঘরে যা। আমি একটু একা থাকতে চাই।’

লালমোহনবাবুর ঘরে গিয়ে বসতে ভদ্রলোক বললেন, “আমার ভালো লাগছে না ভাই তপেশ। একটা সুযোগ এসেও কেমন যেন ফস্‌কে গেল। তাই বোধহয় কাল বাঁ চোখটা নাচছিল।’

তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তোমার দাদার শরীর-টরীর খারাপ হয়নি ত? দেখে কেন জানি মনে হচ্ছিল রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি।’

‘ঘুম হয়েছে, তবে অনেক রাত অবধি আপনার দেওয়া বইটা পড়েছে এটা আমি জানি। অবিশ্যি তাও সেই সকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠে যোগব্যায়াম করেছে।’

‘তোপ্‌সে!’

ফেলুদার গলা, সেই সঙ্গে দরজায় ধাক্কা। দরজা খুললাম।

ফেলুদা ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে বলল, ‘চলুন—বেরোতে হবে। চৌবের ওখানে। দেরি নয়—ইমিডিয়েটলি।’

আমরা তৈরিই ছিলাম, তিনজন বেরিয়ে পড়লাম।

দুবরাজপুর থানায় গিয়ে গাড়িটা থামল। আমরা তিনজন নামলাম। একজন কনস্টেবল জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে এল।

‘একটু ইনস্পেক্টর চৌবের সঙ্গে দেখা করব।’

‘আসুন।’

আমরা চৌবের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। ভদ্রলোক কাগজপত্র দেখছিলেন, আমাদের দেখে অবাক আর খুশি মেশানো দৃষ্টি দিয়ে আমাদের দিকে চাইলেন।

‘কী ব্যাপার?’

‘একটু কথা ছিল।’

‘বসুন, বসুন।’

আমরা তিনজন চৌবের টেবিলের উল্টোদিকে তিনটে চেয়ারে বসলাম।

‘চা খাবেন ত?’

‘নো থ্যাঙ্কস্। একটু আগেই ব্রেকফাস্ট খেয়েছি।’

‘তা বলুন কী ব্যাপার।’

‘মাত্র একটা প্রশ্ন।’

‘বলুন, বলুন।’

‘আপনি কি ক্রিশ্চান?’

চৌবের চোখ কপালে উঠে গেল। তারপর একটা সরল হাসি হেসে বললেন, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন?’

‘আমি জানতে চাই। প্লীজ বলুন।’

‘ইয়েস, আই অ্যাম এ ক্রিশ্চান—কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?’

‘আপনাকে আমি চারবার খেতে দেখেছি। প্রথমবার ঢানঢানিয়ার বাড়িতে লাড্ডু আর সরবত। লাড্ডু আপনি বাঁ হাতে খান। ব্যাপারটা দেখেছিলাম বটে, কিন্তু যাকে লক্ষ করা বলে তা করিনি। অর্থাৎ ওটার তাৎপর্য বুঝিনি। দ্বিতীয়বার, চায়ের দোকানে চায়ের সঙ্গে নানখাটাই খেলেন, তাও বাঁ হাতে। এটা আমার মনের কোণে নোট করে রেখেছিলাম। কাল চা বিস্কুট খেলেন আমাদের ঘরে, বিস্কুট বাঁ হাতে। তখনই বুঝতে পারি আপনি ক্রিশ্চান। কিন্তু এবারও তাৎপর্য বুঝিনি। এখন বুঝেছি।’

‘বহুৎ আচ্ছা। কিন্তু তাৎপর্যটা কী সেটা জানতে পারি? এই কথাটা বলতে আপনি একেবারে দুবরাজপুর চলে এলেন?’

‘তাহলে আরেকটা প্রশ্ন করি?’

‘করুন।’

‘আপনার ফ্যামিলিতে প্রথম কে ক্রিশ্চান হয়?’

‘আমার ঠাকুরদা।’

‘তাঁর নাম?’

‘অনন্ত নারায়ণ।’

‘তাঁর ছেলের নাম?’

‘চার্লস প্রেমচাঁদ।’

‘অ্যান্ড হিজ সন?’

‘রিচার্ড শঙ্কর প্রসাদ।’

‘তিনি কি আপনি?’

‘ইয়েস স্যার।’

‘আপনার ঠাকুরদাদার বাবার নাম কি হীরালাল?’

‘হ্যাঁ—বাট হাউ ডিড ইউ—?’

চৌবের মুখ থেকে খুশি ভাবটা চলে গিয়ে এখন খালি অবাক অবিশ্বাস।

‘এই হীরালালই কি রেজিন্যাল্ড ম্যাক্সওয়েলের পাংখা টানত?’

‘এ খবর আপনি পেলেন কি করে?’

‘একটা বই থেকে। পাদ্রী প্রিচার্ডের লেখা। যিনি আপনার ঠাকুরদাদাকে অনাথ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে তাকে ক্রিশ্চান করে তার ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন।’

‘এরকম একটা বই আছে বুঝি?’

‘আছে। দুষ্প্রাপ্য বই, কিন্তু আছে।’

‘তাহলে ত আপনি—’

‘কী?’

‘আপনি ত জানেন…’

‘কী জানি?’

‘সেটা আপনিই বলুন মিঃ মিত্তির। আমার বলতে সংকোচ হচ্ছে।

‘বলছি’, বলল ফেলুদা। ‘আপনার প্রপিতামহর সাহেবের বুটের লাথি খেয়ে প্রাণত্যাগ করার ঘটনা আপনি এখনো ভুলতে পারেননি। ছেলেবেলা থেকেই হয়ত শুনে এসেছেন রেজিন্যাল্ড খ্যাঁকশেয়াল কী জাতীয় লোক ছিলেন। যখন আপনি জানলেন যে সেই রেজিন্যাল্ডের নাতি এখানে এসেছে এবং যখন দেখলেন সেই নাতির মধ্যে রেজিন্যাল্ডের ঔদ্ধত্য আর ভারতবিদ্বেষ পুরোপুরি বর্তমান, তখন—’

‘ঠিক আছে, মিঃ মিত্তির, আর বলতে হবে না।’

‘তাহলে আমি যা ভাবছি সেটাই ঠিক ত?’

‘কী?’

‘আপনি প্রতিহিংসাবশত টমকে মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করেন। পাথরটা নেন যাতে সন্দেহটা ওই চারজনের উপর গিয়ে পড়ে।’

‘ঠিক। এখন এর জন্য আমার কী শাস্তি হওয়া উচিত বলুন।’

‘সেটাই আমি আপনাকে বলতে এসেছি।’

‘কী?’

‘আপনার কোনো শাস্তি হবে না। আপনার অবস্থায় পড়লে আমিও ঠিক এই জিনিসই করতাম। আপনি গুরু পাপে লঘু দণ্ড দিয়েছেন। আপনি নির্দোষ।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ, মিঃ মিত্তির—থ্যাঙ্ক ইউ।’

‘এখন আপনার কোন চোখ নাচছে, মিঃ সর্বজ্ঞ গঙ্গোপাধ্যায়?’

‘দু’চোখই। একসঙ্গে। আনন্দের নাচনি। আমি কেবল ভাবছি। একটা কথা।’

‘আমি জানি।’

‘কী বলুন ত?’

‘আপনার বন্ধু শতদল সেনকে ধন্যবাদ দিতে হবে, এই ত?’

‘মোক্ষম ধরেছেন। তিনি বইটা না দিলে—’

‘—এই মামলার নিষ্পত্তি হত না—’

‘আর জগন্নাথ চাটুজ্যে রয়ে যেতেন ক্রিমিন্যাল।’

‘অন্তত আমাদের মনে।’

‘ঠিক বলেছেন।’

‘হরিপদবাবু—চলুন ত দেখি পিয়ার্সন পল্লী। শতদল সেনের বাড়ি।’

রবার্টসনের রুবিটা শেষ পর্যন্ত মিউজিয়মেই গেল। কৃতিত্বটা যে ফেলুদার, সেটা বলাই বাহুল্য। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর মত বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা যখন ম্যাক্সওয়েলের ভারতবর্ষে আসার ব্যয়ভার গ্রহণ করেছে, তা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে ও যথেষ্ট নামকরা ফোটোগ্রাফার, এবং এই জাতীয় লোকের টাকার অভাব থাকার কথা নয়। আরো টাকার লোভে ও রুবিটা বিক্রি করতে চাইছিল। পিটার ম্যাক্সওয়েলের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হলেও ছোটবেলাকার বন্ধুত্বের কথা ভেবে ওর কথায় সরল বিশ্বাসে রুবিটা বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলেন। ফেলুদার কথায় তিনি পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির জন্য যা করতে এসেছিলেন তাই করলেন। ম্যাক্সওয়েলের রাগ ও আস্ফালন কোনো কিছুই তাঁকে টলাতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *