কৃষিভিত্তিক বিপ্লবের পর আরও বড় আকারের এবং অনেক জটিল কাঠামোর সমাজ গড়ে উঠতে শুরু করে। যেসব পৌরাণিক কাহিনী, লোকগাথা এবং কল্পকাহিনীর কারণে এই বড়সড় সমাজ গড়ে ওঠা সম্ভব হলো, সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে সেগুলো ডালপালা গজিয়ে সমাজে নিজেদের পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করল। ফলশ্রুতিতে, পুরাণ এবং কল্পকাহিনীগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল মানুষের জীবন। জন্ম থেকেই মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেল নানা বিধি-বিধান। মানুষের সামষ্টিক কল্পনাপ্রসূত এইসব গল্প মানুষের কাঙ্ক্ষিত চিন্তার ধরন, সামাজিক আচার-আচরণ, তার আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক রীতি-নীতি এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিতে শুরু করল। এইসব নির্দেশনা মেনে চলার ফলে মানুষের মাঝে গড়ে উঠল জন্মগত জৈবিক প্রবৃত্তির বাইরে পৌরাণিক কাহিনী বা কাল্পনিক বাস্তবতা নির্ভর আরেকটি নতুন পরিচয়। একসময় নতুন গড়ে ওঠা এই পরিচয় হয়ে উঠল তার সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। নিজেদের তৈরি করা নতুন এই পরিচয়ের ফলেই মানুষ অনেক বড় বড় গোষ্ঠী বা সমাজ গঠন করে একসাথে বসবাস করতে সক্ষম হলো। জন্মের পর নিজেদের চেষ্টায় শেখা মানুষের কৃত্রিম এইসব আচার-আচরণের সমষ্টিকেই আমরা এককথায় বলি ‘সংস্কৃতি’ বা ‘কৃষ্টি’।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পণ্ডিত ব্যক্তিরা আমাদের শেখালেন, প্রতিটি সমাজের সংস্কৃতিই পূর্ণাঙ্গ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রতিটি সংস্কৃতিরই আছে একটি শাশ্বত, অপরিবর্তনীয় রূপ সময়ের ছাপ যাকে মলিন করতে পারে না। পৃথিবী সম্পর্কে প্রতিটি মানব গোষ্ঠীরই আছে একটা নিজস্ব ধ্যান-ধারণা এবং আছে নিজস্ব সমাজ ব্যাবস্থা, আইন-কানুন এবং রাজনৈতিক বিধি-বিধান। সূর্যকে কেন্দ্র করে নিখুঁতভাবে গ্রহসমূহের প্রদক্ষিণের মত এসব নিয়মকানুনগুলোও একটি গোষ্ঠীর মানুষজনের ভেতরে সুষ্ঠুভাবে বয়ে চলে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীতে আবদ্ধ থাকা অবস্থায় সে সংস্কৃতির কোন পরিবর্তন হয় না। তা আগে যেমন ছিল তেমন ভাবেই, একই গতিতে চলতে থাকে। বাইরে থেকে কোন কিছু যদি এর পরিবর্তন করতে চায় তবেই কেবল তার পরিবর্তন সম্ভব। নৃতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ এবং রাজনীতিবিদরা তাই যখন “সামোয়ান সংস্কৃতি” বা “তাসমানিয়ান সংস্কৃতি”র কথা বলেন তখন মনে হয় যেন সামোয়ানরা কিংবা তাসমানিয়ানরা গোড়া থেকেই ঐ একই রকম বিশ্বাস ও রীতি-নীতি মেনে চলছে।
আজকাল বেশিরভাগ সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞরাই এই ধারণাকে ভুল বলে মেনে নিয়েছেন। প্রত্যেক সংস্কৃতির কিছু নিজস্ব বিশ্বাস, নির্দিষ্ট আচরণ এবং মূল্যবোধ আছে, কিন্তু এগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তিতও হচ্ছে। পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে বা আশেপাশের সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে একটি সংস্কৃতি বদলে যেতে পারে। শুধু তাই না, সংস্কৃতি তার নিজের ভিতরকার চিরায়ত গতিময়তার জন্যও আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে। এমনকি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং স্থিতিশীল জৈবিক পরিবেশেও একটি সংস্কৃতির পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। মানুষের তৈরি আইন-কানুনগুলো পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের মত নয় যে সেখানে কোন পরস্পরবিরোধিতা থাকবে না। বরং মানুষের তৈরি প্রায় প্রত্যেকটি আইন-কানুনের মধ্যেই অনেক রকম পরস্পরবিরোধিতা খুঁজে পাওয়া যাবে। সংস্কৃতি প্রতিনিয়তই এসব পরস্পরবিরোধিতা রোধ করার চেষ্টা করছে, আর তার ফলেই নিজেকে পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, মধ্যযুগীয় ইউরোপের অভিজাত সম্প্রদায় খ্রিস্টধর্ম ও নাইটদের বীরত্বের আদর্শে বিশ্বাস করতেন। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা সকালে চার্চে যেতেন এবং খ্রিস্টীয় পুরোহিতদের কাছ থেকে সাধকদের জীবনকথা শুনতেন। পুরোহিত বয়ান করতেন- তুচ্ছের থেকেও তুচ্ছ সব, সকল বস্তুগত অর্জনই বাহুল্য মাত্র। সম্পদ, কাম এবং সম্মান মানুষের জন্য খুবই বিপদজনক এবং লোভনীয়। তোমরা এই সবকিছুর উর্ধ্বে ওঠো এবং যিশুর পদাঙ্ক অনুসরণ কর। যিশুর মত নম্র ও ধৈর্যশীল হও, উগ্রতা পরিত্যাগ কর, সীমা অতিক্রম করো না এবং এক গালে চড় খেলে অন্য গালটা বাড়িয়ে দাও। বয়ান শেষে সবাই চার্চ থেকে নম্র ও ধৈর্যশীল, চিন্তামগ্ন অবস্থায় বাড়ি ফিরতেন। এর একটু পরে তারাই আবার সবচেয়ে ভাল ও দামী সিল্কের কাপড় পরে মনিবের প্রাসাদে যেতেন। সেখানে ছুটত ফুর্তি আর পানীয়ের ফোয়ারা, চারণ-কবিরা পুঁথি শোনাতেন প্রচলিত লোককাহিনী নিয়ে। অতিথিরা শোনাতেন চটুল, নোংরা কৌতুক অথবা রক্তাক্ত যুদ্ধের কাহিনী। ব্যারনরা সদর্পে ঘোষণা করতেন “লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভাল। কেউ তোমাকে অসম্মান করলে একমাত্র রক্তক্ষরণেই সে অসম্মানের প্রতিকার হতে পারে। প্রাণভয়ে শত্রুর পালিয়ে যাওয়া এবং তাদের সুন্দরী কন্যাদের অসহায় হয়ে তোমার পায়ে লুটোপুটি খাওয়ার দৃশ্যের চেয়ে আনন্দের দৃশ্য আর কী-ই বা হতে পারে?”
কোন কালেই মানুষের এধরনের বৈপরীত্যপূর্ণ আচরনের পুরোপুরি অবসান হয়নি। কিন্তু ইউরোপের অভিজাত-সম্প্রদায়, গির্জার যাজকমণ্ডলী এবং সাধারণ লোক একে সাদরে গ্রহণ করেছিল। ফলশ্রুতিতে, সূচনা হয়েছিল তাদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের। সেই পরিবর্তনের ফলাফলই হল ক্রুসেড (Crusade)। ক্রুসেডে নাইটরা তাদের সামরিক বীরত্ব বা ধর্মের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করত তরবারির আঘাতে। ঐ একই বিরোধের ফলে তৈরি হয় টেম্পলার (Templars) এবং হসপিটলার (Hospitallers), যারা খ্রিস্টীয় ও সিভালরিক ধারণাগুলো আরও বেশি মিশিয়ে ফেলতে চাইতো। মধ্যযুগীয় চিত্রশিল্প এবং সাহিত্যকেও তা ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। রাজা আর্থারের কাহিনী বা হোলি গ্রেইল (Holy Grail) তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেখানে ক্যামেলট (Camelot) ছিল মূলত একটা বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা: “একজন ভাল নাইট অবশ্যই একজন ভাল খ্রিস্টান হবে, অন্যভাবে বললে, ভাল খ্রিস্টানদের মধ্যে থেকেই শুধু ভাল নাইট পাওয়া যাবে”।
আরেকটি উদাহরণ হলো আধুনিক রাজনীতি। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে, সারা পৃথিবীর মানুষ সমতা এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার বলে মনে করে। অথচ এ দুটির মধ্যে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। একটি অপরটির প্রায় বিরোধী। সব মানুষের মধ্যে সমতা আনতে হলে কারও না কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতেই হবে। আবার সবাইকে যার যার ইচ্ছামতো চলতে দিলে সমতা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে যায়। ১৭৮৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাসে ঘটা সবকিছুই যেন এই বিরোধকে একটা সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থানে আনার প্রচেষ্টা।
চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস যারা পড়েছেন তারা জানেন যে, উনিশ শতকের ইউরোপীয় উদার শাসনব্যবস্থা ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছিল। সেটা করতে গিয়ে গরীব মানুষদের জেলে পুরতে আর অনাথ শিশুদের পকেটমার হতে বাধ্য করতেও পিছপা হয়নি তারা। আবার অন্যদিকে, আলেক্সান্দার সলঝেনিতসিনের উপন্যাস যারা পড়েছেন তারা সবাই জানেন যে, সাম্যবাদের আদর্শ ক্ষমতার এমন নির্মম ব্যবহার করেছে যে তা হয়ে উঠেছিল প্রত্যেকের প্রাত্যহিক জীবনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার সামিল।
সমকালীন আমেরিকার রাজনীতিও এই একই অসঙ্গতির ঘেরাটোপেই আবদ্ধ। ডেমোক্র্যাটরা(Democrats) সমতাভিত্তিক সমাজের পক্ষে। তারা প্রয়োজনের কর বৃদ্ধি করে হলেও গরিব, বৃদ্ধ এবং দুর্বলদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চান। কিন্তু, এর ফলে একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত অর্থ কিভাবে খরচ করবে সে স্বাধীনতা খর্ব হয়। যে টাকা দিয়ে আমি আমার সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে পারি, সে টাকা দিয়ে কেন আমাকে স্বাস্থ্য বীমা কিনতে হবে? অন্যদিকে রিপাবলিকানরা(Republicans) মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায়। এর জন্য যদি গরিব ধনীর পার্থক্য বাড়ে বাড়ুক, গরিবেরা আরো গরিব হোক, আর ধনীরা আরো ধনী, সবাই স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারুক বা না পারুক, তাতে কিছুই যায় আসে না। মানুষের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
মধ্যযুগীয় সংস্কৃতি যেমন খ্রিস্টধর্ম এবং সিভালরিকে মেলাতে পারেনি, তেমনই আধুনিক বিশ্ব সাম্য আর স্বাধীনতাকেও মেলাতে পারেনি। কিন্তু, এটাকে কোন খুঁত হিসেবে বিবেচনা করা সঙ্গত হবে না। এরকম অসঙ্গতি বা পরস্পরবিরোধিতা প্রত্যেক সমাজ-সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বরং এটাই সংস্কৃতির চালিকাশক্তি। আমাদের প্রজাতির সৃজনশীলতা এবং গতিশীলতার মূল উৎস এটাই। বিবিধ সুর ও তানের অসামঞ্জস্য যেমন একটি সঙ্গীতকে এগিয়ে নিয়ে যায় তেমনি আমাদের চিন্তা, ধারণা এবং মূল্যবোধের অসামঞ্জস্য আমাদের আরো চিন্তাশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে, নতুনভাবে দেখতে উৎসাহিত করে। চিন্তা ও কাজে সবসময়একই নীতির অনুসরণ হল অলস মস্তিষ্কের কাজ।
উত্তেজনা আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব যদি হয় যেকোনো সংস্কৃতিরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তাহলে সেসব সংস্কৃতির মানুষগুলোও স্ববিরোধী চিন্তাধারায় আচ্ছন্ন হবে এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যবোধের কারণে দ্বিধা বিভক্ত থাকবে। যে কোন সংস্কৃতির এটা এমন একটা বৈশিষ্ট্য যে এর একটা বিশেষ নামই আছে: চিন্তার অসঙ্গতি (cognitive dissonance)। চিন্তার অসঙ্গতি মানে আসলে মানবসত্ত্বারই একধরণের বিচ্যুতি। সত্যিকার অর্থে আসলে এটা বিরাট এক সম্পদ। মানুষ যদি সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী ধারণায় একই সাথে বিশ্বাস করতে না পারত তাহলে কোন রকম মানব সংস্কৃতিই তৈরি করা কিংবা রক্ষা করা সম্ভব হত না।
ধরুন একজন খ্রিস্টান, মুসলমানদেরকে ভালোভাবে বুঝতে চায়। তাহলে তাকে আসলে প্রত্যেক মুসলমানের মনের ভেতরে আগলে রাখা আদিম কিছু মূল্যবোধের দিকে তাকালে হবে না। বরং তাকে তাকাতে হবে মুসলিম সংস্কৃতির দ্বন্দ্বের জায়গাগুলোতে যেখানে নিয়ম কানুন আর মূল্যবোধগুলোর নিজেদের মধ্যে ঠোকাঠুকি লাগে। ঠিক যে জায়গাটাতে মুসলমানরা কোন পথে যাবে ভাবতে ভাবতে সংশয়ে আচ্ছন্ন হয়, সেখানেই তাদেরকে সবচেয়ে ভালোভাবে চেনা যাবে।
গুপ্তচরের স্যাটেলাইটের চোখে দেখা
মানুষের সংস্কৃতি নিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন কি এলোমেলোভাবে হয়, নাকি কোন নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে হয়? অন্য কথায় বলতে গেলে, ইতিহাসের কি চলার কোন নির্দিষ্ট দিক আছে?
হ্যাঁ, আছে। হাজার বছর ধরে ছোট ছোট, সরল সংস্কৃতিগুলো আস্তে আস্তে বড় বড় সংস্কৃতি এবং সভ্যতার সাথে একীভূত হয়েছে। ফলে পৃথিবীতে গড়ে উঠেছে অল্প সংখ্যক কিন্তু বিশাল আকারের কিছু “মহা-সভ্যতা”। এগুলোর প্রত্যেকটি অনেক বড় এবং জটিল আকার ধারণ করেছে। অবশ্য, স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে এটা খুবই সরলীকৃত একটা ব্যাখ্যা। আর খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে দেখা যাবে যে বেশ কিছু ছোট ছোট সংস্কৃতি মিলে যেমন বিশাল বড় আকারের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, আবার বড় সংস্কৃতি ভেঙেও টুকরো টুকরো হচ্ছে। মোঙ্গল সাম্রাজ্য পুরো এশিয়া এবং ইউরোপের আংশিক জুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল যেন কেবল ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার জন্যই। ওদিকে খ্রিস্টধর্ম লক্ষ লক্ষ মানুষকে দীক্ষিত করেছে এবং একই সময়ে অগণিত সম্প্রদায়ে বিভক্তও হয়েছে। ল্যাটিন ভাষা পশ্চিম এবং মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং তারপর আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। এ আঞ্চলিক ভাষার অনেকগুলোই জাতীয় ভাষার মর্যাদা পেয়েছে পরবর্তীতে। এই ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়াটা আসলে এক বিশাল ঐক্যের পথে সামান্য উল্টো যাত্রা মাত্র।
ইতিহাসের চলার পথটাকে বুঝতে চাওয়াটা আসলে অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পাওয়ার জন্য একটা উঁচু গাছের মগডালে উঠে বসার মতো। যখন আমরা “পাখির চোখ” দিয়ে ইতিহাসকে দেখতে পারবো, যেটা এক যুগ কিংবা শতক ধরে বয়ে চলা ঘটনাপ্রবাহকে আমাদের সামনে মেলে ধরবে, তখন বলা খুব মুশকিল হবে যে ইতিহাস কি আসলে ঐক্যের দিকে এগোচ্ছে নাকি বিভাজনের দিকে। সত্যি বলতে কি, মানব ইতিহাসের মত এতো দীর্ঘ কলেবরের বিষয়কে বোঝার জন্য আমাদের ঐ শখানেক বছরের দৃষ্টিসীমাটাও কম হয়ে যায়। তার চেয়ে আমরা যদি একটা মহাজাগতিক গুপ্তচর উপগ্রহের চোখ দিয়ে দেখতে পারতাম যেটা আমাদের শত সহস্র বছরের ঘটনা পরিক্রমা দেখাতে পারে তাহলে বরং একটা ভালো দৃষ্টিভঙ্গি পেতাম। সেরকম একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে এটা খুব পরিষ্কার হয়ে যেত যে ইতিহাস আসলে অবিশ্রান্তভাবে বয়ে চলেছে ঐক্যের দিকে। খ্রিষ্টধর্মের বিভাজন কিংবা মোঙ্গল সাম্রাজ্যের পতন আসলে ইতিহাসের মহাসড়কে ছোট ছোট গতি নিয়ন্ত্রক।
ইতিহাসের এই ঐক্যের দিকে পথ চলাকে সবচেয়ে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করার একটা উপায় হল ইতিহাসজুড়ে একই সময় মোট কতগুলো আলাদা মানব সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল সেটা গুনতে থাকা। আমাদের হয়তো এখন মনে হয় পুরো পৃথিবীটা মিলে একটাই মানব সভ্যতা, কিন্তু ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় জুড়েই পৃথিবীটা ছিল আলাদা আলাদা পরস্পর বিচ্ছিন্ন অসংখ্য মানব সভ্যতার এক মহাসমারোহ।
তাসমানিয়ার কথাই ধরা যাক, অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে মাঝারি আকারের একটা দ্বীপ। এটা অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় প্রায় দশ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। এর কারণ ছিল বরফ যুগের অবসানেরপর সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি। কয়েক হাজার শিকারি সংগ্রাহক থেকে গিয়েছিল সেই দ্বীপে। এরপর থেকে উনিশ শতকে ইউরোপীয়দের আগমনের আগ পর্যন্ত তাদের সাথে অন্য মানুষদের কোন যোগাযোগই আর সম্ভব ছিল না। প্রায় বারো হাজার বছর ধরে কেউ জানতই না যে তাসমানিয়ানরা ওখানে আছে। আর তাসমানিয়ানরাও জানত না পৃথিবীতে তারা ছাড়া অন্য মানুষও আছে। তাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক উত্থান পতন আর সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সবকিছুই হয়েছে। তাদের এই সবকিছুই বাকি পৃথিবী থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন ছিল যে চীনের সম্রাটদের কাছে কিংবা মেসোপটেমিয়ার শাসকদের কাছে তারা অনেকটা বৃহস্পতি গ্রহের বাসিন্দার মত। আসলে তাসমানিয়ানরা ছিল তাদের একেবারে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক জগতে।
আমেরিকা আর ইউরোপও কিন্তু ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়জুড়ে সম্পূর্ণ আলাদা দুই জগতে ছিল। ৩৭৮ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট ভ্যালেন্সকে (Valence) আদ্রিয়ানোপোলের যুদ্ধে পরাজিত এবং হত্যা করে গথরা। একই বছর টিকালের রাজা চাক টোক ইক’আককেও (Chak Tok Ich’aak of Tikal) পরাজিত ও হত্যা করে টিওটিহুয়াকান (Teotihuacan) সৈন্যরা। (টিকাল ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক মায়ান শহর, ওদিকে টিওটিহুয়াকান ছিল প্রায় আড়াই লাখ বসবাসকারি নিয়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহর – আকারে আর ক্ষমতায় সমকালীন রোমের মতই) রোমের পতন আর টিওটিহুয়াকানের উত্থানের মধ্যে কোন রকম যোগাযোগই ছিল না। ব্যাপারটা যেন এমন যে রোম আছে মঙ্গল গ্রহে আর টিওটিহুয়াকান আছে বুধে।
এবারে আমাদের শুরুর দিককার প্রশ্নে ফিরে যাই – একই সময়ে কতগুলো আলাদা রকমের মানব সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল পৃথিবীতে? দশ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রায় বেশ কয়েক হাজার আলাদা সভ্যতা ছিল। দুহাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এসে সেই সংখ্যাটা কমে কয়েকশতে এসে দাঁড়াল, কিংবা খুব বেশি হলে দু-এক হাজার। ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের সময় সেই সংখ্যাটা একেবারে কমে গেল। সেই সময়, ইউরোপিয়ানদের পৃথিবী অনুসন্ধানের ঠিক আগ দিয়ে, পৃথিবীতে তাসমানিয়ার মত বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট সভ্যতা ছিল। কিন্তু প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই বসবাস করতো এক বিশাল সভ্যতায়: তার নাম আফ্রো-এশিয়ান সভ্যতা। সেসময় এশিয়া, ইউরোপ আর আফ্রিকার বেশিরভাগই কিছু নির্দিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক সুতোয় বাধা ছিল।
সেসময়কার মানব জনগোষ্ঠীর বাকি দশভাগকে মোটামুটি আকারের চারটে সভ্যতায় ভাগ করা যেতে পারেঃ
১। মেসোআমেরিকান সভ্যতা, মধ্য আমেরিকার প্রায় পুরোটা আর উত্তর আমেরিকার কিছু অংশ নিয়ে।
২। আন্দিয়ান সভ্যতা, দক্ষিণ আমেরকার পশ্চিমভাগের প্রায় পুরোটা নিয়ে।
৩। অস্ট্রেলিয়ান সভ্যতা, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ নিয়ে।
৪। দ্বীপ সভ্যতা, প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ পশ্চিম থেকে শুরু করে হাওয়াই থেকে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত সবগুলো দ্বীপ নিয়ে।
এরপরের ৩০০ বছরের মধ্যে বিশাল ব্যাপ্তির আফ্রো-এশিয়ান সভ্যতা বাকি সব সভ্যতাকে একরকম গিলেই খেয়ে ফেলে। এটি মেসোআমেরিকান সভ্যতাকে গ্রাস করে ১৫২১ খ্রিস্টাব্দে, যখন স্প্যানিশরা অ্যাজটেকদের পরাজিত করে। দ্বীপ সভ্যতায় প্রথম আঘাতটা আসে ঐ একই সময়ে যখন ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান (Ferdinand Magellan) নৌকায় চড়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণে বেরোয়। আন্দিয়ান সভ্যতা ধ্বসে পড়ে ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দের দিকে যখন স্প্যানিশরা ইনকা সভ্যতাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রথম ইউরোপিয়ানরা পা রাখে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে আর তারপরই ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে সেই আদি-অকৃত্রিম সভ্যতাটির সমাপ্তি হয় বৃটিশ কলোনির অভ্যুত্থানে। এর ১৫ বছর পর ব্রিটিশরা তাদের প্রথম বাসস্থান গড়ে তাসমানিয়ায়, আর এর মাধ্যমেই সর্বশেষ স্বায়ত্তশাসিত সভ্যতাটাও আফ্রো-এশিয়ান সভ্যতার আওতায় চলে আসে।
দৈত্যাকার আফ্রো-এশিয়ান সভ্যতার এই সবকিছু গিলে খেতে বেশ কয়েক শতাব্দী সময় লেগেছিল। আর এই প্রক্রিয়াটা ছিল অপরিবর্তনীয়। আজকের দিনে প্রায় প্রতিটি মানুষ একই ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে (পুরো পৃথিবীটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অনেকগুলো দেশে বিভক্ত)। একই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (পুঁজিবাদী বাজার এখন এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে দূরবর্তী কোণেও পৌঁছে গেছে), একই আইনগত ব্যবস্থা (মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন এখন সর্বত্র বিরাজমান, অন্তত তত্ত্বীয়ভাবে হলেও) এবং একই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাও (ইরান, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া কিংবা আর্জেন্টিনার বিশেষজ্ঞরা সকলেই পরমাণুর গঠনের ব্যাপারে অথবা যক্ষ্মার চিকিৎসার ব্যাপারে একমত) মেনে নিয়েছে।
এই একটিমাত্র বৈশ্বিক সভ্যতা আবার সব জায়গায় ঠিক একই রকম নয়। ঠিক যেরকম একটা জীবন্ত দেহে বিভিন্ন রকম অঙ্গ কিংবা কোষ থাকে সেরকম আমাদের বৈশ্বিক সভ্যতার মধ্যেও আছে বিচিত্র সব মানুষ ও তাদের বিচিত্র জীবন যাপন। একইভাবে, নিউ ইয়র্কের শেয়ার বাজারের দালাল থেকে শুরু করে আফগান রাখাল পর্যন্ত সবাই এখন এই বৈশ্বিক সভ্যতার অংশ। মানবদেহের নানারকম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতই তারাও একে ওপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং একে অপরকে নানা উপায়ে প্রভাবিত করছে। পূর্বের অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন সভ্যতার মানুষদের মতোই তারা এখনও তর্ক করে কিংবা যুদ্ধ করে কিন্তু সেই তর্ক হয় একইরকম কতকগুলো ধারণা নিয়ে আর সেই যুদ্ধও হয় একইরকম কিছু অস্ত্র দিয়ে। আজকের দিনে সত্যিকার “সভ্যতার সংঘাত” এর ধরনটি কয়েকজন বধিরের কথোপকথনের প্রচলিত প্রবাদটির মতো। সকলেই কিছু বলছে কিন্তু কেউই বুঝতে পাচ্ছে না অন্য জন কি বলছে। সেকারণেই জাতি, রাষ্ট্র, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক অধিকার আর পরমাণু পদার্থ বিজ্ঞানের মতো একই সাধারণ বিষয়গুলোতে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও একে অপরের বিরূদ্ধে রণসজ্জায় মেতে উঠছে ইরাক আর যুক্তরাষ্ট্রের মত দুটি দেশ।
আমরা এখনও মৌলিক সংস্কৃতির কথা বলি, এই মৌলিকতা বলতে যদি আমরা বোঝাতে চাই এমন এক সভ্যতা যা নিজে নিজেই গড়ে উঠেছে এবং যা বাইরের সকল সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে এখনও প্রাচীন সব আঞ্চলিক প্রথা ধরে রেখেছে, তাহলে বলতেই হয় পৃথিবীতে আর কোন মৌলিক সভ্যতা অবশিষ্ট নেই। গত কিছু শতাব্দী ধরে প্রায় প্রতিটি সভ্যতাই বৈশ্বিক প্রভাবে এমনভাবে বদলে গেছে যে তাদের আলাদা করে চেনাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই বিশ্বায়নের অন্যতম উদাহরণ হল “ঐতিহ্যবাহী” খাবার দাবার। একটা ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে আমরা আশা করি টমেটো সস দেয়া স্প্যাগেটি। আমরা ধরেই নিই যে কোনো পোলিশ কিংবা আইরিশ রেস্টুরেন্টে থাকবে অনেক অনেক আলু, আর্জেন্টিনিয়ান রেস্টুরেন্টে পাওয়া যাবে গরুর মাংসের কয়েক ডজন পদ, একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্টে প্রায় সবকিছুর সাথেই থাকবে ঝাল মরিচ আর সুইস ক্যাফের বিশেষত্বই হল ক্রিমসহ গরম চকলেট। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এসব খাবারের কোনোটাই কিন্তু তাদের নিজস্ব নয়! টমেটো, মরিচ আর কোকো সবগুলোই মূলত মেক্সিকো থেকে আসা। এগুলো ইউরোপ আর এশিয়াতে পৌঁছায় স্প্যানিশদের মেক্সিকো জয়ের পর। জুলিয়াস সিজার কিংবা দান্তে আলিঘিয়েরি কখনই কাঁটাচামচ (এমনকি কাঁটাচামচও তখন আবিষ্কার হয়নি) দিয়ে টমেটো-চুপচুপে স্প্যাগেটি খাননি। উইলিয়াম টেল কখনও চকলেটের স্বাদই পাননি এবং বুদ্ধও কখনও তাঁর খাবারে একগাদা ঝাল মরিচ দেননি। আলু পোল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে আসে বড়জোর ৪০০ বছর আগে। ১৪৯২ সালের দিকে আর্জেন্টিনার একমাত্র মাংস ছিল আসলে লামার মাংস।
হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো আমেরিকার সমতলের আদিবাসীদের সবসময় খুব সাহসী ঘোড়সওয়ার হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে। এসব চলচ্চিত্রে দেখা যায় তারা নিজেদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুব বীরত্বের সাথে ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের যানবাহনে আক্রমণ করছে । কিন্তু এই আদিবাসীদের ঘোড়ায় চড়াটা কোনোভাবেই তাদের প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ নয় বরং এটা হল ইউরোপীয় ঘোড়ার আগমনের পর সপ্তদশ আর অষ্টাদশ শতকে উত্তর আমেরিকার পশ্চিমে ঘটে যাওয়া সশস্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলাফল। সত্যি কথা বলতে ১৪৯২ সালে আমেরিকায় কোন ঘোড়াই ছিল না। উনবিংশ শতাব্দীর সিওক্স (Sioux) আর অ্যাপাচি (Apache) সভ্যতার অনেক আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য আছে কিন্তু এগুলো আসলে আধুনিক সভ্যতা এবং বৈশ্বিক প্রভাবের ফলাফল – মোটেই মৌলিক কিছু নয়।
বৈশ্বিক দর্শন
বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে, বৈশ্বিক ঐক্যের পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপ সেটা ঘটেছে সাম্প্রতিক কিছু শতাব্দীতেই, সাম্রাজ্যগুলো বিস্তৃত হওয়ার এবং বাণিজ্য আরও জোরদার হওয়ার পর। আফ্রো-এশিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং দ্বীপ সভ্যতার মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে অনেক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। সেই কারণেই মেক্সিকোর মরিচ চলে গেছে ভারতীয় খাবারে আর স্প্যানিশ পশু চরে বেড়াচ্ছে আর্জেন্টিনায়। আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ঘটেছে খৃষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে। এসময়ই বৈশ্বিক সাম্রাজ্যের একটা ধারণা প্রথম প্রকাশিত হয়। যদিও হাজার বছর ধরে ইতিহাস একটা ঐক্যের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল, তারপরও, এর আগে পর্যন্ত একটা বৈশ্বিক সাম্রাজ্য সারা পৃথিবী শাসন করছে এইরকম ধারণা কিন্তু বেশিরভাগ লোকের কাছেই ছিল অমূলক।
হোমো সেপিয়েন্স বিবর্তিত হয়েছে নিজেদেরকে “আমরা” এবং “তারা” এই দুভাগে বিভক্ত করে। “আমরা” হল আমার চারপাশের মানুষজন, আর “তারা” হল বাকিসব মানুষ। সত্যি বলতে, কোন সামাজিক প্রাণীই কখনই সামগ্রিক ভাবে তাদের পুরো জাতির কথা ভেবে এগোয়নি। কোনও শিম্পাঞ্জিই কিন্তু শিম্পাঞ্জি প্রজাতির কথা চিন্তা করে না, কোনও শামুকই সারা বিশ্বের শামুক জাতির জন্য তার শুঁড় উচু করে না, কোন সিংহ নেতা সারা বিশ্বের সিংহদের নেতা হওয়ার জন্য লড়াই করে না কিংবা কোনও মৌচাকের সামনেই – “দুনিয়ার মজদুর – এক হও!” শ্লোগান শুনতে পাওয়া যাবেনা।
কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের পর থেকে হোমো সেপিয়েন্স এই দিক থেকে অনেক বেশি আলাদা হতে থাকে। সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সাথেও তার সহযোগিতার সম্পর্ক আরও জোরদার হতে থাকে, যাদেরকে তারা “ভাই” কিংবা “বন্ধু” হিসেবে কল্পনা করতে থাকে। তবে তার এই ভ্রাতৃত্ববোধ তখনও বিশ্বজনীন ছিল না। সবাইকে তখনও তারা “নিজেদের” বলে ভাবতে শেখে নি। পাশেরউপত্যকা কিংবা পাহাড়ের ওপারেই তখনও “তাদের” দেখা পাওয়া যেত। প্রথম ফারাও মেনেস (Menes) ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে মিশরকে একতাবদ্ধ করলেন। তখন মিশরের মানুষদের ধারণা ছিল যে, মিশরের একটা সীমারেখা আছে, আর তার বাইরে যারা আছে তারা সবাই “বর্বর”। তাদের চোখে বর্বরেরা ছিল সম্পূর্ণ অচেনা কিছু, তারা ছিল একটা হুমকিস্বরূপ। তবে তাদের ব্যাপারে একমাত্র আগ্রহের বিষয় ছিল তাদের জমি আর সম্পদ, যা দখল করে নেওয়া যায়। এভাবেই মানুষ যত রকম কাল্পনিক কাঠামো বানিয়েছে সবখানেই তারা মানবজাতির একটা বড় অংশকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এসেছে।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে তিনটি বড় আকারের বৈশ্বিক রীতির আগমন ঘটল। এর অনুসারীরা প্রথমবারের মত পুরো পৃথিবীকে এবং পুরো মানব জাতিকে একটা নির্দিষ্ট সাম্রাজ্য হিসেবে কল্পনা করতে পারল, যে সাম্রাজ্য পরিচালিত হবে একটাই নির্দিষ্ট নিয়মে। সেখানে সবাই ছিল “আমরা”, অন্তত তত্ত্বগতভাবে। সেখানে আর কোন “তারা” অবশিষ্ট ছিল না। প্রথম বৈশ্বিক রীতি ছিল অর্থনৈতিক রীতি: টাকার রীতি। দ্বিতীয় বৈশ্বিক রীতি ছিল রাজনৈতিক: সাম্রাজ্যের রীতি। তৃতীয় বৈশ্বিক রীতি ছিল বৈশ্বিক ধর্ম যেমন বৌদ্ধধর্ম, খ্রিস্টধর্ম আর ইসলাম।
ব্যবসায়ী, সম্রাট আর ধর্মপ্রচারকরা হল প্রথম মানুষ যারা “আমরা বনাম তারা” এই দ্বৈত বিভক্তির সীমার বাইরে গিয়ে সমগ্র মানব জাতির ঐক্যের সম্ভাবনা অনুভব করতে পেরেছিল। ব্যবসায়ীদের জন্য পুরো পৃথিবীটা ছিল একটামাত্র বাজার আর সমস্ত মানুষই ক্রেতা। তারা চেষ্টা করেছিল এমন একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে যেটা সবার জন্য সর্বত্র প্রযোজ্য হবে। সম্রাটদের জন্য পুরো পৃথিবীটা জুড়ে একটাই সাম্রাজ্য আর সমস্ত মানুষ তার প্রজা। আর ধর্মপ্রচারকদের জন্য সমগ্র পৃথিবীতে ছিল একটাই সত্য আর সব মানুষই ছিল সেই সত্যে বিশ্বাসী। তারাও চেষ্টা করেছিল এমন কোন রীতি প্রতিষ্ঠা করার যেটা সবার জন্য সর্বত্র প্রযোজ্য হবে।
সর্বশেষ তিন সহস্রাব্দ ধরে মানুষ আরও বেশি বেশি করে চেষ্টা করেছে সেই বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত করার। সামনের তিন অধ্যায়ে আমরা দেখব কীভাবে টাকা, সাম্রাজ্য ও ধর্ম পৃথিবীকে আজকের এই অবস্থায় এনেছে। আমরা শুরু করব ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দিগ্বিজয়ী বীরকে দিয়ে যে অসম্ভব রকম সহ্যশক্তি এবং অভিযোজন ক্ষমতারর অধিকারী, যে সকল মানুষকে তার অনুগত শিষ্যে পরিণত করতে পারে। সেই দিগ্বিজয়ী বীর হল টাকা। যেসব মানুষ একই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেনা কিংবা একই রাজার প্রজা নয় তারাও একই টাকা ব্যবহারের সময় এক পায়ে খাড়া। ওসামা বিন লাদেন, যে কিনা আমেরিকার সংস্কৃতি, আমেরিকার ধর্ম আর আমেরিকার রাজনীতিকে প্রচণ্ড ঘৃণা করত তারও কিন্তু আমেরিকান ডলারের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ ছিল না। টাকা কিভাবে এমন অসাধ্য সাধন করল যেটা কিনা দেবতারা কিংবা রাজারাও করতে পারলো না?