০৯. আস্তিক না নাস্তিক

মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়–আপনি কি আস্তিক? আল্লাহ বিশ্বাস করেন? এই সব ক্ষেত্রে হ্যাঁ বলা বিপদ, আবার না বলাও বিপদ। প্রশ্নকর্তা যদি নাস্তিক হন–আমি হ্যাঁ বললে অসংখ্য যুক্তিতর্ক ফাঁদবেন এবং প্রমাণ করতে চেষ্টা করবেন যে, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। একটাই আমাদের জীবন। এইসব যুক্তি সবই আগে শোনা। নতুন কথা কেউ বলতে পারেন না। পুরানো জিনিস বারবার শুনতে ভাল লাগার কথা না। আমার কখনো ভাল লাগে না। ভাল না লাগলেও এই প্রশ্ন আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়।

উত্তরে আমি সাধারণত বলি, আপনার কি মনে হয়? এই বলে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করি। আলোচনা নিয়ে আসতে চেষ্টা করি ভূত-প্রেতের দিকে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের চেয়ে ভূত-প্রেতের অস্তিত্বের আলোচনা সহজ।

তবে সমস্যা আছে। ভূত-প্রেত নিয়ে আলোচনা শুরু হলে অসংখ্য ভূতের গল্প শুনতে হয়। যিনি ভূতে বিশ্বাস করেন না তাঁর স্টকেও গোটা দশেক ভূতের গল্প জমা থাকে। তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করেন গল্প শোনাতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব ভূতের গল্পের ফমূলা এক। অশরীরী আত্মা এসে কিছু বলবে। ঠিকমত বলতে না পারলে এই জাতীয় গল্পগুলি অত্যন্ত হাস্যকর শোনায়। অধিকাংশ সময়ই গল্পকথক তা জানেন না।

মূল ব্যাপার হচ্ছে পরিবেশ সৃষ্টি। পরিবেশ সৃষ্টি অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। হাসির গল্প বলার জন্যে পরিবেশ তৈরি করার কোন প্রয়োজন নেই–গল্পটা বলে ফেললেই হল। দুপুর রোদে হাটের মাঝখানে ভূতের গল্প বলা যায় না। বর্ষার রাত, হারিকেনের আলো, অসম্ভব মনোযোগী কিছু শ্রোতা ছাড়া ভূতের গল্প হয় না।

একবার আমার এক বন্ধুর সঙ্গে রিকশা করে নিউ মার্কেট যাচ্ছি। ভরদুপুর–ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ। বন্ধু হঠাৎ কি মনে করে ভূতের গল্প শুরু করলেন। তাঁর বাড়ির ঘটনা। আমার ইচ্ছা করছিল কোন একটা ট্রাক এলে ধাক্কা দিয়ে তাকে ট্রাকের নিচে ফেলে দিতে। এতটা নির্বোধ মানুষ কি করে হয়? সে গল্পটা বলছেও খুব হেলাফেলা ভাবে–তখন মনে হল, আরে, এই লোক তো আসলে ভূতের গল্প বলবে বলে বলছে না। আমাকে ভয় পাওয়ানো তার উদ্দেশ্য নয়। সে তার বাড়ির একটি ঘটনা বর্ণনা করছে। আমি আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগলাম–গল্প শেষ হলে আতংকে দম বন্ধ হয়ে যাবার মত অবস্থা হল। এখান থেকে

একটা জিনিস শিখলাম–ভূতের গল্পের জন্যে পরিবেশ কোন অত্যাবশ্যকীয়। ব্যাপার নয়। মূল বিষয় হচ্ছে, বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্পটি বলা। শ্রোতার মনে ধারণা তৈরি করে দেয়া যে গল্পটা সত্যি।

ভূতের গল্পের প্রতি আমার দুর্বলতা সীমাহীন। রহস্যময়তার জন্যেই এই গল্পগুলি আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। খুব ছোটবেলায় মনোজ বসুর একটা গল্প পড়েছিলাম–লাল চুল। একটি মেয়ের বিয়ে হবে। বর আসবে সন্ধ্যায়। যেহেতু তাকে রাত জাগতে হবে তাকে অবেলায় শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হল। যাতে সে নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারে সেজন্যে ঘর খালি। মেয়েটি একা একা ঘুমুচ্ছে।

সন্ধ্যা বেলা বর এল। বর এসেছে, বর এসেছে খুব হৈ চৈ হচ্ছে। মেয়েটির ঘুম ভেঙে গেল। সে একা একা উঠে গেল ছাদে। ছাদ থেকে ঝুঁকে সে বর দেখার চেষ্টা করছে–হঠাৎ পা পিছলে গেল। দুতলা থেকে পাকা বারান্দায় মেয়েটি পড়েছে, মাথা ফেটে গেছে, গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে, তার কালো চুল হয়ে গেল টকটকে লাল।

গল্পের শুরু এখান থেকে–মেয়েটির মৃত্যুর পর। কি অভিভূত যে হয়েছিলাম গল্প পড়ে! গল্প শেষ করবার পর মনে হচ্ছিল মেয়েটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর রেশমী শাড়ির খসখস শব্দ কানে আসছে, গা থেকে চাপা ফুলের ঘ্রাণ আসছে।

আমার জীবনের প্রথম লেখা গল্পটিও ছিল ভৌতিক গল্প। স্কুল ম্যাগাজিনের জন্যে লেখা ভয়ংকর ভৌতিক কাণ্ডকারখানা আছে। অবশ্যি শেষের দিকে দেখা গেল পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে স্বপ্নে।

সচেতনভাবে ভূতের গল্প লিখি ৮৭ সনের দিকে। নাম দেবী। দেবী লেখার ইতিহাসটাও বেশ মজার–ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর জাফর মাহমুদের বাসায় এক সন্ধ্যায় গিয়েছি। স্যার বললেন, হুমায়ুন, আমার এক আত্মীয়া তোমাকে দেখতে চায়। ও বোধহয় কিছু বলবে। তোমার বই-টই পড়েছে।

আমি বললাম, নিয়ে আসুন স্যার।

স্যার ১৮/১৯ বছরের এক তরুণীকে নিয়ে ঢুকলেন। মেয়েটা রোগা।

অতিরিক্ত রকমের ফর্সা। তাকে রূপবতী বলা যায়, তবে চোখে এক ধরণে অস্বাভাবিকতা আছে। এই দৃষ্টি মানুষকে কাছে টানে না, দূরে সরিয়ে দেয়।

আমি হাসিমুখে বললাম, তুমি আমাকে কিছু বলবে?

সে কঠিন চোখে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে চলে গেল।

আমি অপ্রস্তুত। জাফর স্যারও অপ্রস্তুত। আমি বললাম, স্যার মেয়েটির বোধহয় লেখক পছন্দ হয় নি। সে হয়তো আরো ভারিক্তি কাউকে আশা করেছিল।

স্যার বললেন, ব্যাপার তা না। ওর কিছু সমস্যা আছে। পঁাড়াও, তোমাকে বলি–মেয়েটার বাড়ি পদ্মা নদীর তীরে। বাড়িতে টিউবওয়েল আছে, তবু বেশির ভাগ সময় নদীতেই এরা গোসল করে। মেয়েটির বয়স তখন বারো কিংবা তেরো। নদীতে গোসল করছে হঠাৎ তার কাছে মনে হল কে যেন তার দুপা জড়িয়ে ধরেছে। সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। পা ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল। পারল না। যতই ছাড়াতে চেষ্টা করে ততই জোরে দুটা মানুষের হাতের মত হাত তাকে চেপে ধরে। মেয়েটির চিৎকারে অনেকেই ছুটে এল। তাকে টেনে পারে তোলা হল। দেখা গেল একটি মৃতদেহ মেয়েটির পা জড়িয়ে ধরে আছে। মৃতদেহটির মাথা নেই। ভয়াবহ ঘটনা। মেয়েটির মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন তার চিকিৎসা চলে। ঢাকায় সে চিকিৎসার জন্যে এসেছে। এখন সে অনেক ভাল। আমরা মেয়েটির বিয়ে দেবার চেষ্টা করছি।

আমি গভীর আগ্রহে বললাম, স্যার, আমি মেয়েটাকে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই। আপনি কি তাকে একটু ডাকবেন?

স্যার উঠে গেলেন এবং ফিরে এসে বললেন, ও আসবে না। অনেক বুঝালাম।

দেবী উপন্যাসে আমি এই মেয়েটির গল্পই বলেছি।

ভূত-প্রেত বিষয়ক অনেক লেখা লিখলেও আমি কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন ভূত দেখি নি। আমার কোন রকম ভৌতিক অভিজ্ঞতাও নেই। বেশ কয়েকবার তীব্র ভয় পেয়েছি। এর বেশি কিছু না। ভয় পাওয়া এক ব্যাপার–ভূত দেখা অন্য ব্যাপার।

একটা ভয় পাওয়ার গল্প বলি–রাতে ঘুম আসছে না। আমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছি। শহীদুল্লাহ হলের যে বাসায় আমি থাকি তার বারান্দাটা দেখার। মত। তিনশ ফুটের মত লম্বা। আমি বারান্দার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছি, আবার ফিরে আসছি। বারান্দার সব বাতি নেভানো। তবু বেশ আলো আছে। বাসার সবাই ঘুমে অচেতন। আমার মেজো মেয়ের ঘুমের মধ্যে খিলখিল করে হাসার রোগ আছে। একবার সে হেসে আবার চুপ করে গেল।

বারান্দায় বুক শেলফের কাছে একটা বেতের চেয়ার আছে। বেশ খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমি ক্লান্ত হয়ে চেয়ারটায় বসলাম। বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আতংকে অস্থির হয়ে পড়লাম। এই আতংকের ধরন আলাদা। এর জন্ম আমাদের চেনা-জানা পৃথিবীতে নয়। অন্য কোথাও। আমার মনে হল আমার চেয়ারের ঠিক পেছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে যে তার বরফশীতল হাত এক্ষুনি আমার দুচোখের উপর রাখবে।

চিৎকার করে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার চিৎকার এতই ভয়াবহ ছিল যে আমার স্ত্রীর ঘুম ভাঙল। আমার কন্যাদের ঘুম ভাঙল।

এই ভয়াবহ ঘটনার আমি নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। ব্যাখ্যাটা বলি–অনিদ্রায় ক্লান্ত হয়ে আমি চেয়ারে বসামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমুবার সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

এই ব্যাখ্যা যে কোন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার কথা, আমার কাছে নয়–কারণ অনিদ্রা রোগ আমার দীর্ঘদিনের সাথী। ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়ার মত অবস্থা কখনো আমার হয় না। সেদিনও হয় নি।

তাহলে এমন ভয়ংকর ভয় কেন পেলাম? এই ভয় কি আমার অবচেতন মনের কোন অন্ধ গুহায় লুকিয়ে ছিল? শুনেছি, কোন মানুষ পাগল হবার আগে অকারণেই প্রচণ্ড ভয় পায়। তীব্র ভয়ে অভিভূত হবার পরপরই পাগলামি শুরু হয়। সে চলে যায় ভয় এবং আনন্দের উর্ধ্বে।

আমি আমার পরিচিত মানুষদের প্রায়ই জিজ্ঞেস করি–আচ্ছা, আপনি কি কখনো অকারণে তীব্র ভয় পেয়েছেন? আমার এই সহজ প্রশ্ন কেউই বুঝতে পারেন না। সঙ্গে সঙ্গে বলেন–হা হা, পেয়েছি। অবশ্যই পেয়েছি–একদিন কি হয়েছে শুনুন। রিকশা করে যাচ্ছি হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার এসে ধাক্কা দিয়ে রিকশাটা ফেলে দিল। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তার মাঝখানে–তাকিয়ে দেখি দানবের মত একটা ট্রাক ছুটে আসছে–ভয়ে আতংকে

আমি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এই ভয় তো অকারণ ভয় নয়। ভয় পাওয়ার আপনার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। আমি জানতে চাচ্ছি, ভয় পাওয়ার মত কিছুই ঘটে নি অথচ আপনি ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেলেন।

কি সব পাগলের মত কথা যে আপনি বলেন–ভয় পাওয়ার মত কিছু না ঘটলে আমি শুধু শুধু ভয় পাব কেন?

অনিবার্য নিয়তির সামনে দাঁড়ালে তীব্র ভয় এক সময় এক ধরনের প্রশান্তিতে পরিণত হয় বলে আমার ধারণা। ১৯৭১ সনে পাক মিলিটারী আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল। তীব্র ভয়ে আমি অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরপর আমার সব ভয় দূর হয়ে যায়। এক ধরনের প্রশান্তি বোধ করতে থাকি। প্রচণ্ড জ্বরে কাতর থাকার পর হঠাৎ জ্বর সেরে গেলে যেমন ক্লান্ত অথচ শান্তি শান্তি ভাব হয় অনেকটা সেরকম।

কে জানে ফঁসির আসামীও গলায় দড়ি পরাবার আগে এ-রকম বোধ করে কি-না। জানবার উপায় নেই। জল্লাদ নিশ্চয়ই দড়ি পরাবার আগে জিজ্ঞেস করে না, ভাই আপনার কেমন লাগছে?

অনিবার্য নিয়তি যে কত বিচিত্র ধরনের হতে পারে তার একটি ঘটনা বলি।

ঘটনাটা ঘটে রামপুরা রেলওয়ে ক্রসিং-এ আজ থেকে দুবছর আগে। ভোরবেলা মর্নিং ওয়াকের দলের একটি অংশ রেল লাইন ধরে হাঁটেন। তেমনি একজন মর্নিং ওয়াকে বের হয়েছেন। বয়স চল্লিশের মত। পায়ে স্যান্ডেল। রেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে পায়ের পাতা কেমন করে জানি লাইনে আটকে গেল। এমন কোন জটিল ব্যাপার না। পা টেনে বের করা যাবে। আশ্চর্য ব্যাপার! ভদ্রলোক পা টেনে বের করতে পারলেন না। আশেপাশে লোক জমে গেল। তারাও চেষ্টা করল–লাভ হল না। কিছুতেই পা বের হচ্ছে না।

ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল–চিটাগাংগামী আন্তঃনগর ট্রেন প্রভাতী ছুটে আসছে। ভদ্রলোক প্রাণপণ চেষ্টা করলেন এবং এক সময় বুঝলেন চেষ্টা করে। লাভ নেই।–ছুটে আসছে অনিবার্য নিয়তি। তিনি পা পেতে দিয়ে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এই ভদ্রলোকের মত আমরাও সবাই কি অনিবার্য নিয়তির জন্যে অপেক্ষা করছি না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *