আল্লাহ হাফেজ
বেইজিং-এ অথবা মস্কোতে বৃষ্টি হলে অনেক কমিউনিস্ট নাকি ঢাকা-কলকাতায় ছাতা খোলেন। তার কারণ, কমিউনিষ্ট আদর্শের প্রতি তাদের অতিভক্তি। তেমনি ইদানীং ধর্মের নামে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি অনেকের আনুগত্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যে-পুণ্যালোভাতুর ঠিকাদার অসৎভাবে এন্তার টাকা করছেন, তিনি বেশি পুণ্য লাভের আশায় গরু কোরবানি না-দিয়ে উটি কোরবানি দেওয়ার কথা চিন্তা করেন। অর্থাৎ ধর্মের আদর্শ অনুসারে সৎ না-হলেও, আনুষ্ঠানিকতায় এঁরা কেবলমুখী। এই মনোভাব থেকেই সম্প্রতি দেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের প্রতি হিড়িক পড়ে গেছে। তা না-হলে জন্মে কোনো দিন ঈদে মিলাদুন্নবীতে শোভাযাত্রা দেখিনি। কিন্তু এখন গাঁটকাটাদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের জাঁকজমকও তেমন বৃদ্ধি পেয়েছে।
সত্য কথা বলা শক্ত। জীবনে সৎ থাকাও শক্ত। বিপদগ্ৰস্ত মানুষকে সাহায্য করা আরও শক্ত। কিন্তু পড়শির ঘাড় মটকে তার সম্পত্তি দখল করবো–এ কথা চিন্তা করতে করতে এক বেলা ধর্মীয় আচার পালন করা সহজ। জীবনাচরণে পুণ্যের পথে চলা কঠিন। কিন্তু ঘুষ খেয়ে তীৰ্থস্থান ঘুরে আসা সহজ। ধর্মের স্পিরিট নয়, বরং আনুষ্ঠানিকতা পালনের প্রতি এই যে আগ্রহ বৃদ্ধি— তার প্রতিফলন ঘটছে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার একটি গল্প আছে–শওকত ওসমানেরকাঁকড়ামণি। চালের মধ্যে পাথর মিশিয়ে বিক্রি করছে এক দোকানদার। খদের তাতে আপত্তি করলে, দোকানদার বললো: এ পাথর খোদ আরব দেশ থেকে আনা। খেলে পুণ্য হবে। বর্তমান অবস্থা সে রকমই।
যখন ঢাকা হলে থাকতাম, তখন সেখানে একটি প্রেয়ার রুম ছিলো নীচ তলায়। কিন্তু সেখানে কেউ প্রার্থনা করতে যেতেন বলে দেখিনি। এখন সেই ঢাকা হলে মসজিদ হয়েছে। ভালো কথা। এ থেকে বোঝা যায় যে, যারা ধর্ম পালন করেন, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তাই বলে সৎ মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, এটা কেউ বলতে পারবেন না। বরং হাইজ্যাকার, চাঁদাবাদ, সন্ত্রাসী, দলীয় টাউট, নকলাবাজ, বেয়াদব বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে— খবরের কাগজ খুললেই তার প্রমাণ মেলে।
ধর্মের মূলের দিকে ফিরে যাওয়ার একটা প্রবণতা সাম্প্রতিক কালে দেখা দিয়েছে প্রবলভাবে। সহজ বাংলায় এটা হলো মৌলবাদী মনোভাবের প্রতিফলন। এই মনোভাব থেকে বাংলা বা ফারসি ভাষার বদলে আরবি ভাষা ব্যবহারের প্রতি আগ্ৰহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বঙ্গদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়েছিলো ফারসি ভাষায়। সে জন্যেই সালাত, রমজান, আল্লাহ, রসুল, জান্নাত এবং জাহান্নামের বদলে বঙ্গদেশে বলা হয় নামাজ, রোজা, খোদা, পয়গম্বর, বেহেসৎ এবং দোজোখ। কিন্তু এখন খোদা শব্দ দিয়ে আর পরম ঈশ্বরের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তাকে ডাকতে হচ্ছে আল্লাহ নামে।
আমার ছাত্র জীবনে— অর্থাৎ ৬০-এর দশকের গোড়ায় বিদায়ের সময় কাউকে “খোদা হাফেজ” বলতে শুনেছি বলে মনে পড়ে না। পাকিস্তানীকরণের ফলে ধীরে ধীরে খোদা হাফেজের মতো ধর্মীয় বিদায় সম্ভাষণ জনপ্রিয় হতে থাকে। তারপর তা সাৰ্বজনিক সম্ভাষণে পরিণত হয় ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে। স্বাধীন হওয়ার পর যে-নব্য সাম্প্রদায়িকতা দেখা দেয়, তারই অন্য পিঠে ছিলো মৌলবাদী আন্দোলন। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রেডলারের আনুকূল্যে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে যে ধর্মপ্রচার শুরু হয়, তার ফলে ধর্মীয় পরিভাষা যদ্দুর সম্ভব আরবীমুখী হতে থাকে। এরই প্রভাবে খোদার আসনে বসলেন আল্লাহ। শুধু খোদার নামই নয়, মানুষের ফারসি নামের জায়গাও দখল করলো নব্য-আরবী নাম। এমন কি, রাতারাতি বহু লোকের নামের সঙ্গে লেজুড়ের মতো যুক্ত হলো ইবনে, বিনতে। ষাটের দশকে বাংলা নাম রাখা একটা ফ্যাশানে পরিণত হতে আরম্ভ করেছিলো। সত্তরের দশকে তা-ও জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। আল্লাহ হাফেজ এই প্রক্রিয়ারই একটা অংশ।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: এর পেছনে কী কী মনোভাব থাকতে পারে?–হতে পারে এঁরা ভাবেন আল্লাহ বলে ডাকলে সেটা সৃষ্টিকর্তার কাছে বেশি আবেদন সৃষ্টি করবে; দুই, ফারসি (এবং বাংলা) আল্লাহ। বুঝতে পারেন না; তিন, সমাজতাত্ত্বিক কারণ— আভিজাত্য দেখানোর প্রয়াস। সমাজতত্ত্বের পরিভাষায় একে বলা হয় সংস্কৃতায়ন।
আল্লাহ যদি সব কিছু সৃষ্টি করে থাকেন, তা হলে বাংলা, ইংরেজি, হিব্রু, য়নীজ, তামিল, তেলেগু–সব ভাষাই তো তার বোঝার কথা। বস্তুত, একজন বাঙালি যদি বলেন, হে পরম করুণাময়, হে দয়াময়–সেটা নিশ্চয় রহমানউর রাহীম বলার চেয়ে কম আন্তরিক নয়। বরং না-বুঝে ভালো ভালো মন্ত্র জপ করার চেয়ে বুঝে বলাই কি ভালো নয়?
আসলে যারা খোদা হাফেজ না-বলে আল্লাহ হাফেজ বলেন, তাদের অনেকে বেশি পুণ্য হবে এই আশায় বলেন। কিন্তু আল্লাহ শব্দটির ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এটি ইসলামী শব্দ নয়। প্ৰাক-ইসলামী আমল থেকেই আরবি ভাষায় এ শব্দ চালু ছিলো। সবচেয়ে প্রধান দেবতার নামই ছিলো আল্লাহ। অনেকেরই নামের অংশ ছিলো আল্লাহ। যেমন, ইসলাম ধর্ম প্রবর্তকের পিতার নাম ছিলো আবদুল্লাহ–আল্লাহর আবদুল। যারা আল্লাহ হাফেজ-পন্থী তাদের ভোলা উচিত নয় যে, সে নামটা ইসলাম প্রচারিত হওয়ার পরে তাকে দেওয়া হয়নি! বস্তুত, সর্বশক্তিমান স্রষ্টা বোঝাতে এই আল্লাহ শব্দটিকেই ইসলাম ধর্মে ব্যবহার করা হয়েছে। এবং গোলাপকে আপনি যে-নামেই ডাকুন না কেন, সে সুগন্ধ দিতেই থাকবে। খোদা ঈশ্বর, গড়–যে-নামেই ধাৰ্মিক তাকে স্মরণ করুন না কেন, তার শুনতে পাওয়ার কথা। বোঝারও কথা। যদি তিনি না-বোঝেন, তবে তিনি কিছুতেই সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ নন।
আল্লাহ হাফেজ শুনলে তাই আমার মনে তুলনামূলকভাবে বেশি ভক্তির উদয় হয় না, বরং ভয় হয় মৌলবাদীর সংখ্যা আরও একটি বেড়ে গেলো–এই চিন্তা থেকে। আমার এই আশঙ্কা ভুলও হতে পারে, কিন্তু এ যে অন্ধভাবে ধর্মীয় আচার পালন করার দৃষ্টান্ত, তাতে ভুল নেই।
সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ বলেছেন যে, পাপের অন্য পিঠে থাকে ধর্ম। পাপ বোধ থেকেই নাকি ধর্মের উদ্ভব। এ নিয়ে এন্তার বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে যাবো না। কথাটা মনে পড়লো এ জন্যে যে, সম্প্রতি চারদিকে অসাধুতা, দুনীতি এবং অমানুষিক ক্রিয়াকাণ্ড যেমন দারুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা পালনের হুজুক। তা হলে পাপ আর পুণ্য কি হাত ধরাধরি করে এক সঙ্গে চলে?
(প্রথম আলো, ২০০৬)