আপনি খুশি না আয়ে
না আপনি খুশি চলে,
লাই হায়াত আয়ে,
কাজা লে চলি চলে।
(পৃথিবীতে নিজের খুশিমতো আসি নি, খুশিমতো চলেও যাব না। জীবন হাত ধরে নিয়ে এসেছিল বলেই এসেছি। মৃত্যু হাত ধরে নিয়ে চলে যাবে, তখন চলে যাব।)
সম্রাট হুমায়ূন মশক বুকে জড়িয়ে গঙ্গা নদীর তীরে শুয়ে আছেন। কখন নদীর স্রোত তাকে তীরে এনে ফেলেছে, তিনি জানেন না। অবসাদে, ক্লান্তিতে, হতাশা ও বিষণ্ণতায় তার চোখ বন্ধ। তিনি ঘুম এবং জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থায় আছেন। তার চোখের পাতা বন্ধ। সেই বন্ধ পাতা ভেদ করেও সূর্যের আলো তার চোখে ঢুকে যাচ্ছে। চোখ কটকট করছে, কিন্তু তিনি মাথা ফেরাতে পারছেন না।
আপনার কী হয়েছে?
সম্রাট অনেক কষ্টে চোখ মেললেন। ঘোর কৃষ্ণবর্ণের এক রমণী কলসি হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে। সে গঙ্গার পানি নিতে এসেছিল। রমণীর বয়স অল্প। মুখশ্ৰী কোমল।
আপনি কে?
সম্রাট বললেন, আমি বাদশাহ হিন্দুস্থান।
রমণী বলল, বাদশাহ হিন্দুস্থান থাকবেন সিংহাসনে। কাদাপানিতে না।
পায়ে সামান্য কাঁটা ফুটলেও হাতির মতো প্ৰাণী অচল হয়ে যায়। আমি পায়ে কাঁটা-ফোটা হাতি। তুমি কি আমাকে কোনো খাবার দিতে পার?
আমার ঘরে ছাতু ছাড়া কিছু নেই। গুড় দিয়ে ছাতু মেখে দিলে খেতে পারবেন?
পারব। কিছু দুধ কি জোগাড় করতে পারবে? আমার শরীরের এই অবস্থায় দুধ বলকারক।
দুধের ব্যবস্থা করতে পারব।
তুমি যে সেবা আমাকে করবে তা হাজার গুণে আমি ফেরত দেব। আমি ঋণ রাখি না। তোমার নাম কী?
লছমি বাই। আমি বুঝতে পারছি আপনার নড়াচড়ার শক্তিও নেই।
আপনি শুয়ে থাকুন। আমি খাবার এবং লোকজন নিয়ে আসছি।
শুকরিয়া। আমি যে হিন্দুস্তানের সম্রাট এটা কি বিশ্বাস হচ্ছে না?
না। আপনি এক দুর্ভাগা মজনুন (পাগল)।
ভালো বলেছ, আমি এক দুর্ভাগা মজনুন।
লছমি বাই চলে গেল। তাঁর গায়ের উপর দিয়ে একটা শকুন চক্কর খাচ্ছে। এটা অলক্ষণ। শকুন আগেভাগে মৃত্যুর খবর পায়। এই শকুনটা কি বুঝে ফেলেছে তিনি মারা যাচ্ছেন? ক্লান্ত অবসন্ন সম্রাট উড়ন্ত শকুন দেখতে দেখতে আবারও ঘুমিয়ে পড়লেন।
বটগাছের নিচে দু’জন মোঘল চিন্তিত ভঙ্গিতে বসা। শের শাহ’র একদল সৈন্য বটগাছ ঘিরে আছে। তাদের কাছে খবর আছে এই দুজনের একজন দুর্ধর্ষ সেনাপতি বৈরাম খাঁ। বৈরাম খাঁকে হত্যা করে তার কাটা মাথা শের শাহ-কে দেখাতে হবে।
তোমাদের মধ্যে কে বৈরাম খাঁ?
দুজনই বলল, আমি বৈরাম খাঁ। দু’জনের একজন বৈরাম খাঁ। অন্যজন আবুল কাশেম খাঁ। তিনিও সম্রাট হুমায়ূনের একজন সেনাপতি।
তোমাদের মধ্যে একজন মিথ্যা কথা বলছ। সে কে? আঙুল তুলে দুজনই একে অন্যকে দেখালেন।
বৈরাম খাঁ’র চেহারা বৈশিষ্ট্যহীন। ছোটখাটো মানুষ। মুখের চামড়া কুঁচকানো। মাথার চুল খাবলা খাবলা করে উঠে গেছে। অন্যদিকে কাশেম খাঁ অসম্ভব রূপবান। স্বাস্থ্যু-সৌন্দর্যে ঝলমলে একজন মানুষ। কাশেম খাঁ’র মাথায় একটাই চিন্তা-যে-কোনোভাবেই হোক বৈরাম খাঁকে রক্ষা করতে হবে। অসহায় সম্রাট হুমায়ূনের এই মুহুর্তে বৈরাম খাঁকে দরকার। আবুল কাশেম খাকে না পেলেও সম্রাটের চলবে।
কাশেম খাঁ শের শাহ’র সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা চেহারা দেখে বুঝতে পারছি না কে বৈরাম খাঁ? ওই উজিবুকটা আমার নফর। সে মুনিবের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে বৈরাম খাঁ সেজেছে। তার কত বড় স্পর্ধা!
শের শাহু’র সৈন্যদের কাশেম খাঁ’র কথা যুক্তিযুক্ত মনে হলো। তারা সঙ্গে সঙ্গেই কাশেম খাঁকে হত্যা করে তার কাটা মুণ্ডু নিয়ে উল্লাস ধ্বনি করতে করতে শের শাহ’র তাঁবুর দিকে রওনা হলো। আসল বৈরাম খাঁ’র দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না।
ইতিহাস কাউকে কাউকে মনে রাখে। আবার কাউকে রাখে না। বৈরাম খাঁ’র বীরত্বগাথা ইতিহাস মনে রেখেছে। কাশেম খাঁ’র বীরত্বগাথা মনে রাখে নি।
প্রবল জ্বরে হুমায়ূন ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন। তিনি গঙ্গা নদীর তীরেই কাদামাখা অবস্থায় পড়ে আছেন। বর্ষার ক্লান্তিহীন বর্ষণ হচ্ছে। নদীর পানি ফুলে ফোঁপে উঠছে। পানি উঠে এসেছে কোমর পর্যন্ত। ধুপ ধুপ শব্দে নদীর পাড় ভাঙছে। হুমায়ূনের ধারণা হলো, পাড় ভেঙে তিনি আবারও নদীতে পড়বেন। এবার পড়লে আর রক্ষা নেই। মাশকের বাতাস বের হয়ে গেছে। সম্রাট চেষ্টা করলেন হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে। পারলেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার শকুনটা এখনো আছে। তার মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে। এই পাখিটির কাছে জীবন্ত প্ৰাণী অর্থহীন। মৃত প্রাণীই শুধু অর্থবহ। তিনি আবারও জ্ঞান হারালেন। অচেতন অবস্থায় তাঁর মনে হলো আকিকা বেগম তাকে ডাকছে—পিতাজি পিতাজি। তার মেয়ে কখনো তাকে পিতাজি ডাকে না। আজ কোন ডাকছে? তাকে পিতাজি ডাকে অম্বা নামের মেয়েটা। আকিকা কি অম্বার কাছ থেকে পিতাজি ডাক শিখেছে?
হুমায়ূনের কন্যা আকিকা বেগম এবং অম্বা আছে আচার্য হরিশংকরের সঙ্গে। হরিশংকর এই দুজনকে নিয়ে পালিয়েছিলেন। হরিশংকর বলেছিলেন, তোমরা আমার দুই কন্যা। আমার জীবন থাকতে তোমাদের কিছু হবে না। আমি তোমাদের লুকিয়ে রাখব। পরিস্থিতি শান্ত হলে দিল্লী পাঠানোর ব্যবস্থা করব।
হরিশংকর অম্বাকে তার গ্রামের মানুষদের হাতে তুলে দিলেন। সহমরণ থেকে পালিয়ে আসা মেয়ে হলো কলঙ্কের কলসি। এই কলসি চূৰ্ণ হওয়া প্রয়োজন। যারা এই কাজে সাহায্য করবে তারা সবাই পুণ্যের ভাগ পাবে। হরিশংকরের পুণ্য প্রয়োজন।
গঙ্গার তীরে রাতারাতি আগুন করে জ্বলন্ত অগ্নিতে অম্বাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ভয়াবহ চিৎকারে অম্বা ডাকল, আকিকা। আকিকা।
আকিকা বেগম বান্ধবীকে বাঁচানোর জন্যে দৌড়ে আগুনে ঢুকে গেল। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ স্পর্শ করছে। সেই আগুনের ভেতর দুই বান্ধবী দুজনকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে, পিতাজি! পিতাজি!
সম্রাট অচেতন জগৎ থেকে চেতন জগতে ফিরলেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, তিনি মাটির ঘরে দড়ির এক চৌপায়ায় শুয়ে আছেন। তাঁর গায়ে দুৰ্গন্ধ কাঁথা। মাথার কাছে কুপি জুলছে। কুপি থেকে বুনুকা বুনকা কালো ধোঁয়া উঠে ঘর অন্ধকার করে দিচ্ছে। গালভাঙা এক প্রৌঢ় খালি গায়ে তার পায়ের কাছে বসে আছে। প্রৌঢ় তার পায়ে তেল ঘষছে। চার-পাঁচ বছর বয়সের এক উলঙ্গ ছেলে কুকুরের মতো হামাগুড়ি দিয়ে বসে একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের ভেতর চুলা জুলছে। মাটির হাঁড়িতে কিছু রান্না হচ্ছে। ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। গঙ্গার পাড়ে দেখা হওয়া তরুণীই রাঁধছে। তরুণীর নাম সম্রাটের মনে পড়ল-লছমি বাই।
সম্রাটকে চোখ মেলতে দেখেই তরুণী প্রৌঢ়কে চোখে ইশারা করল। প্রৌঢ় এগিয়ে এসে সম্রাটের মাথা তুলে ধরল। লছমি মাটির ভাড় সম্রাটের মুখের কাছে ধরে বলল, মহিষের গরম দুধ। খেলে বল পাবেন।
হুমায়ূন দুধ পান করলেন। হ্যাঁ এখন কিছুটা ভালো লাগছে। সম্রাট বললেন, জায়গাটার নাম কী?
বীরভূম।
গ্রামের নাম কী?
নোকরা।
এই নামগুলি মনে রাখতে হবে। সম্রাট ঠিক করেছেন, তিনি যদি দিল্লীতে ফিরে আবার সিংহাসনে বসতে পারেন তাহলে হতদরিদ্র এই পরিবারের ভাগ্য ফিরিয়ে দেবেন। এই কারণেই নামগুলি মনে রাখা দরকার। তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, লছমি বাই, বীরভূম, নোকরা। লছমি বাই, বীরভূম, নোকরা। লছমি বাই, বীরভূম, নোকরা…
সম্রাটের কথায় বাচ্চা ছেলেটা মজা পেয়ে হেসে উঠতেই প্রৌঢ় এসে সশব্দে তার গালে চড় দিল। চড় খেয়েও বাচ্চাটির কোনো ভাবান্তর হলো না। তার মুখ এখনো হাসি হাসি।
আচার্য হরিশংকর ভীত চোখে তাকিয়ে আছেন শের শাহ’র দিকে। শের শাহের লোকজন তাকে ধরে এনেছে।
শের শাহ বললেন, সম্রাটের মেয়ে আকিকা বেগম কোথায়?
হরিশংকর বললেন, আমি জানি না। জেনানা মহলে যখন হইচই শুরু হলো সে ছুটে গেল নদীর দিকে। আমার ধারণা সে নদীতে ড়ুবে মরেছে।
তোমার সঙ্গে একটা পুঁটলিতে বেশ কিছু ধনরত্ন পাওয়া গেছে। এগুলি কোথায় পেয়েছ?
সম্রাট হুমায়ূন উপহার হিসেবে আমাকে দিয়েছেন।
ধনরত্বের মধ্যে কানের দুল আছে, গলার হার আছে। এগুলি কি তিনি তোমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছেন?
আমার এক কন্যার জন্যে এইসব উপহার।
আমি যে এখন দিল্লীর সম্রাট এটা কি জানো?
জানি।
সম্রাটের সামনে মিথ্যা বলা যায় না এটা জানো?
হরিশংকর চুপ করে রইলেন।
শের শাহ্ বললেন, হুমায়ূনের মেয়ে আকিকা বেগমের মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী। তোমাকে আমি মৃত্যুদণ্ড দিলাম। তুমি জ্ঞানী মানুষ। আমি জ্ঞানকে সম্মান করি। কাজেই তোমাকে একটা বিশেষ সুবিধা আমি দেব।
সম্রাট শের শাহ’র অনেক দয়া।
শের শাহ্ বললেন, হ্যাঁ আমার অনেক দয়া। তবে পরাজিত মোঘল সম্রাট হুমায়ূনের মতো দয়া আমার নেই। তোমাকে যে বিশেষ সুবিধা আমি দেব তা হলো কোন পদ্ধতিতে তুমি মৃত্যু চাও তা তুমি ঠিক করবে। আমার হাতে অনেক পদ্ধতি আছে। যেমন–
১. হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মৃত্যু।
২. শূলদণ্ড।
৩. তলোয়ার দিয়ে মাথা কেটে আলাদা করা।
৪. আগুনে পুড়ে মৃত্যু।
হরিশংকর শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ঠোঁট কাঁপছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। শের শাহ্ বললেন, তুমি নিজে যদি তোমার পছন্দের কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে মরতে চাও তাও করা হবে। বলো কী পদ্ধতিতে মরবে?
হরিশংকর কিছু বলতে পারলেন না। শের শাহ তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়ে দলবল নিয়ে বের হলেন—সম্রাট হুমায়ূনের খবর পাওয়া গেছে। গ্রাম নোকরা, জেলা বীরভূম।
লছমি বাইয়ের বাড়ি শের শাহ’র সৈন্যরা ঘিরে রেখেছে। লছমি বাইকে আনা হয়েছে শের শাহ’র সামনে। শের শাহ ঘোড়ার উপর বসে আছেন। তাঁর দুইপাশে দুই পুত্র। তারাও ঘোড়ার পিঠে। শের শাহ বললেন, তোমার নাম?
লছমি বাই।
হুমায়ূন কোথায়?
জানি না।
তুমি তাকে সেবা-শুশ্রুষা করেছ?
হ্যাঁ।
তুমি কি তাঁর পরিচয় জানতে?
উনি নিজেকে হিন্দুস্তানের সম্রাট বলেছিলেন। আমি বিশ্বাস করি নাই।
হুমায়ূন কোন পথে পালিয়েছেন?
লছমি জবাব দিল না। চুপ করে রইল।
তিনি কোন দিকে গেছেন তা জেনেও যদি না বলো তাহলে তোমার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। এখন বলো।
আমি বলব না।
শের শাহ তার বড় পুত্ৰ জালাল খাঁ’র দিকে তাকিয়ে বললেন, হুমায়ূন নামের ওই মানুষটার কী অদ্ভূত ক্ষমতা লক্ষ করেছ? মেয়েটি কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে ছিল। এই কিছুক্ষণেই তার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। সে হুমায়ূনকে রক্ষা করবে, বিনিময়ে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত। এই ঘটনা আমাদের জন্যে ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ।
দুঃসংবাদ কেন?
জাদুকরী ক্ষমতার হুমায়ূনের মতো মানুষরা যা কিছু হারায় সবই ফিরে পায়। মানুষের ভালোবাসার কারণে ফিরে পায়। মানুষের ভালোবাসা আমরাও যেন ফিরে পাই সেই চেষ্টা এখন থেকেই করতে হবে।
জালাল খাঁ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। শের শাহ্ লছমি বাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি একজন অসুস্থ, হতাশ এবং ভগ্নহৃদয় মানুষকে সেবা-যত্ন করে সুস্থ করেছ। তাঁকে রক্ষার চেষ্টা করেছ। মানুষটি আমার শক্র হলেও তোমার আচরণে আমি খুশি। এই স্বর্ণমুদ্রাটি রাখো। আমার বকশিশ।
লছমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, নড়ল না। লছমি বাইয়ের স্বামী মুখভর্তি হাসি নিয়ে এগিয়ে এল।
সম্রাট হুমায়ূন নদীপথে আগ্রার দিকে রওনা হয়েছেন। অতি সাধারণ মাছ ধরার নৌকা। নৌকার মাঝি তিনজনই বলশালী। তারা আরোহীর পরিচয় জানে না।
হুমায়ূন দুপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছেন। কয়েকবারই তাঁর মনে হলো, পৃথিবী এত সুন্দর কেন? তার হাতে কাগজ-কলম নেই, তিনি মনে মনে একটি শের রচনা করলেন। শেরটির ভাবাৰ্থ–
আমরা বাস করি সুন্দরের মধ্যে
সুন্দরকে ঘিরে থাকে অসুন্দর।
যেমন পুণ্যের চারদিকে থাকে
পাপের শক্ত খোলস।
ভাগ্যবান সেইজন যে অসুন্দরের পর্দা ছিঁড়ে
সুন্দর দেখে। পুণ্যের কাছে যায় পাপের
শক্ত খোলস ভেঙে।।
সম্রাট নৌকার পাটাতনে শুয়ে আছেন। আকাশ মেঘে ঢাকা। হিন্দুস্থানের কঠিন রোদ এখন আর তার চোখে লাগছে না। আরামদায়ক বাতাসে চোখ বুজে আসছে। তাকে ঘুমুলে চলবে না। জেগে থাকতে হবে।
তিনি চোখ বন্ধ করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে লাগলেন। শের শাহ্কে অতি দ্রুত পরাজিত করতে হবে। তিনি কি ভাইদের সাহায্য পাবেন? অবশ্যই পাবেন। ভাইদের প্রতি স্নেহ এবং মমতার কোনো অভাব তিনি দেখান নি। সাধারণ নিয়মে সিংহাসনে বসার পরপর ভাইদের হত্যা করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে কেউ বিদ্রোহ করতে না পারে। তিনি তা করেন নি। তিনি পিতার আদেশ মনে রেখেছেন।
মৃত্যুর আগে সম্রাট বাবর পুত্র হুমায়ূন মীর্জার হাত ধরে বলেছিলেন, আমার মন বলছে তোমার ভাইরা তোমাকে অনেক যন্ত্রণা দেবে, তারপরেও তুমি তাদের প্রতি কোমল থাকবে। যে ভাইদের প্রতি কোমল থাকে, আল্লাহপাক তার প্রতি কোমল থাকেন। নৌকার মাঝির কথায় তার চিন্তা বাধাগ্ৰস্ত হলো।
নৌকার মাঝি বলল, হুজুর, বিশাল একটা নৌকা আমাদের পিছনে পিছনে আসছে। আমাদের থামতে ইশারা করছে। আমরা কি থামাব?
হুমায়ূন শুয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না। তার কাছে কোনো জবাব নেই।
নৌকার মাঝি বলল, ওই নৌকায় সৈন্য আছে। আমরা না থামলে বিরাট সমস্যা হবে।
শের শাহ’র সৈন্য?
মাঝি বলল, সে রকমই অনুমান করি। চারদিকেই এখন শের শাহ’র সৈন্য।
হুমায়ূন বললেন, ছোট কোনো খালে নৌকা ঢুকিয়ে দিতে পার?
পারি। তাতে লাভ হবে না। আমরা ওদের নজরের মধ্যে আছি। খালে নৌকা ঢোকালে ওরাও খালে ঢুকবে।
হুমায়ূন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
হুজুর! ওরা খুব কাছে চলে এসেছে।
হুমায়ূন হতাশ গলায় বললেন, আসুক। আর তখনই শুনলেন ওই নৌকা থেকে কে একজন বলছে—হিন্দুস্থানের মহান সম্রাট হুমায়ূন কি নৌকায় আছেন?
কণ্ঠস্বর হুমায়ূনের পরিচিত। অবিকল বৈরাম খাঁ’র গলা। প্রচণ্ড মানসিক চাপে মানুষের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, তখন সে নানান ধরনের ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। তার বেলাতেও কি এরকম হয়েছে?
সম্রাট উঠে বসলেন। অবাক হয়ে দেখলেন, পনেরো জনের মতো মোঘল সৈন্য নিয়ে বৈরাম খাঁ নৌকায় দাড়ানো।
সম্রাটের চোখে পানি এসে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, বৈরাম খাঁকে পেয়েছি। আমার আর কোনো ভয় নেই।
বৈরাম খাঁ। ভালো আছেন?
সম্রাট ভালো থাকলেই আমি ভালো।
আপনাকে দেখে আমি বুকে এক শ’ হাতির বল পাচ্ছি। আল্লাহপাকের দরবারে হাজার শুকরিয়া। নৌকার তিন মাঝি হতভম্ব হয়ে তাকাচ্ছে। তারা ঘটনা কিছুই বুঝতে পারছে না।
হরিশংকরকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপের সব ব্যবস্থা সম্পন্ন। বৃষ্টির পানিতে কাঠ ভেজা থাকায় আগুন ধরাতে সমস্যা হচ্ছিল। কাঠে তাপিন এবং গালা ঢেলে এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। এখন সুন্দর আগুন জুলছে। হরিশংকর মন্ত্রমুগ্ধের মতো জ্বলন্ত আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন। অগ্নিমন্ত্র পাঠ করে সাধু-সন্তরা আগুন নেভাতে ও জ্বালাতে পারেন। হরিশংকর জানেন তিনি সাধু-সন্তদের একজন না। অগ্নিমন্ত্র তার ক্ষেত্রে কাজ করবে না, তারপরেও তিনি অগ্নিমন্ত্র জপ করার চেষ্টা করলেন। কিছুতেই মন্ত্রের প্রথম চরণ মনে এল না, মাঝখানের একটা লাইন শুধু মাথায় আসছে—
যা অগ্নিদায়েনো নমঃ ভূপে…
এই সময় হঠাৎ করে বিরাট হইচই শুরু হলো। সম্রাট হুমায়ূন নাকি ধরা পড়েছেন। তাকে এখানে আনা হচ্ছে। সম্ভবত হুমায়ূনকেও অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হবে। চরম বিশৃঙ্খলার সুযোগে হরিশংকর পালিয়ে গেলেন।
সম্রাট হুমায়ূনের ধরা পড়ার সংবাদ মিথ্যা। ধরা পড়েছে কামানচির এক সেনাপতি তোরাবি জান।
জুলন্ত অগ্নিতে তোরাবি জানকে নিক্ষেপ করা হলো।