০৯. আজ ইমনের জন্মদিন

আজ ইমনের জন্মদিন। জন্মদিনের ছোট্ট মানুষটা খালি গায়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ঘুমাবার সময় তার গায়ে লাল রঙের একটা টি-সার্ট ছিল। কখন খুলেছে কে জানে! নিশ্চয়ই গরম লাগছিল। গরম লাগার কথা। সিলিং ফ্যানে কোনো একটা সমস্যা আছে। প্রচণ্ড শব্দে ঘোরে, সেই তুলনায় বাতাস হয় না। শওকত ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব মায়া লাগছে। বেচারা যে আগ্রহ নিয়ে বাবার কাছে এসেছিল, সেই আগ্রহের ফল কি সে পেয়েছে? মনে হয় না। ছেলেকে আনন্দে অভিভূত করার মতো কিছু করতে পারে নি। গল্প করেছে। এই পর্যন্তই। গল্প করে কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা তার নেই।

ছেলেটাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে কোথাও যেতে পারলে হতো। যাওয়া হয় নি। কেন জানি ইচ্ছা করে নি। মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে, তার ইচ্ছাগুলিও ছোট হতে থাকে। তার এখন দিন-রাত ঘরে বসে থাকতেই ভালো লাগে। সমস্ত ইচ্ছা ছোট্ট একটা ঘরে বন্দি হয়ে গেছে।

শওকত বিছানা থেকে নামল। সে এখন মগভর্তি করে এক মগ চা বানাবে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম সিগারেটটা ধরাবে। প্রথম সিগারেট শেষ হবার পর দ্বিতীয় সিগারেট। মানুষ খুব সহজে রুটিনে আটকা পড়ে যায়। সে রুটিনে আটকা পড়ে গেছে। সকালে মগভর্তি চা তার রুটিনের অংশ।

আকাশে মেঘ করেছে। ঝুম বৃষ্টি হবে— এরকম মেঘ না। এই কদিনে একবারও ঝুম বৃষ্টি হয় নি যে ছেলেকে নিয়ে সে বৃষ্টিতে ভিজবে। আনন্দময় কোনো স্মৃতি কি এই ছেলে নিয়ে যেতে পারবে?

আজ ইমনের জন্মদিন। আজ সে থাকবে। আগামীকালও থাকবে। পরশু তাকে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসতে হবে। যেখান থেকে সে এসেছিল, সেখানে ফিরে যাবে। মিস্টার অ্যান্ডারসন নামের একজন মানুষের হাত ধরে সে লেকে মাছ ধরতে যাবে। বাড়ির পেছনের পোর্চে মিস্টার অ্যান্ডারসন বারবিকিউ করবেন। ইমন তাকে সাহায্য করবে। এখন যেমন সে তার বাবাকে সাহায্য করে সেরকম। চা বানানোর একটা বিদ্যা সে তার বাবার কাছ থেকে শিখেছে। এই বিদ্যা নিশ্চয় সে মিস্টার অ্যান্ডারসনকে দেখাবে।

শওকত চায়ের মগ নিয়ে মেঝেতে বসল। এই বাসা তাকে ছেড়ে দিতে হবে। এখানে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স হবে। মাপামাপি খোড়াখুঁড়ি শুরু হবে এই মাসের শেষ থেকে। শওকতকে নতুন কোনো আস্তানা খুঁজে বের করতে হবে। গ্রামের বাড়ি-ঘর ঠিক করে কিছুদিন গ্রামে গিয়ে থাকলে হয়। ইমনকে গ্রামের বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে এলে হতো। ঝোপ, বাঁশবন, ডোবা। বাড়ির পেছনে বিলের মতো আছে। সকালের দিকে সেই বিলে অনেক বক দেখা যায়। এইসব দৃশ্য দেখলে সে মজা পেত। তাকে কোনো কিছুই দেখানো হয় নি। মিস্টার অ্যান্ডারসনের একটা ছবি আঁকা হয় নি। আঁকা হবে এরকম মনে হচ্ছে না। ছবি বানানোর বিদ্যা তাকে ছেড়ে গেছে। মাথার কোনো এক রহস্যময় জায়গায় জট লেগে গেছে। হয়তো কোনো একদিন সেই জট খুলবে। সে আবারো ছবি আঁকতে শুরু করবে। তখন মিস্টার অ্যান্ডারসনের ছবিটা এঁকে পাঠিয়ে দিতে হবে। সঙ্গে একটা চিঠি। চিঠিটা সে বাংলায় লিখবে, তারপর ভালো ইংরেজি জানে এমন কাউকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে নেবে।

সে দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়ে চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে শুরু করল।

প্রিয় মিস্টার অ্যান্ডারসন,

জলরঙে আঁকা আপনার একটি ছবি পাঠালাম। ছবিতে আপনি এবং ইমন মাছ ধরছেন। আমার ছেলেটিকে আপনি যে মমতা এবং স্নেহ দেখিয়েছেন, সে তা মনে রেখেছে এবং আমার কাছে প্রতিটি গল্প অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করেছে। আপনি আমার পুত্রের প্রতি যে স্নেহ দেখিয়েছেন তা যেন বহুগুণে আপনার কাছে ফিরে আসে, আমি সেই প্রার্থনা করছি। ইমনের কাছে শুনে শুনে আমি আপনার একটি রূপক ছবি আমার মনে তৈরি করেছি। ছবিটি বটবৃক্ষের। যেন আপনি ছায়াদায়িনী বিশাল বটবৃক্ষ। আমার ছোট্ট ইমন তার ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে।

আমার দুর্ভাগ্য আমি আমার পুত্রকে কোনো ছায়া দিতে পারি নি। আমি একজন পরাজিত পেইন্টার। পরাজিত মানুষ ছায়া দিতে পারে না, কারণ তারা নিজেরাই ছায়া খুঁজে বেড়ায়।

আপনি আমার এই চিঠি পড়ে ভাববেন না যে আমি ছেলেকে কাছে না পেয়ে খুব মনঃকষ্টে থাকি। মানুষ অতি দ্রুত সমস্ত পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ইমন কেমন আছে, কী করছে–এইসব সেন্টিমেন্টাল বিষয় নিয়ে ভাবি না। শুধু তার জন্মদিনে ৯ ইঞ্চি বাই ১২ ইঞ্চি ইজেলে মনের সুখে লেমন ইয়েলো রঙ মাখাই। তার জন্মের পর-পর আমি তার নাম রেখেছিলাম

লেমন ইয়েলো। শওকত হঠাৎ হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে লম্বা চিঠি ফেঁদে বসেছে। কোনো মানে হয়? কাকে দিয়ে অনুবাদ করাবে? তারচে নিজেই একটা কাগজে লিখবে— With complements. from Imons dad. কিংবা শুধু লেখা থাকবে— With complements নিচে সে তার নাম সই করবে।

ইমন জেগে উঠেছে। বাবার সন্ধানে সে চলে এসেছে বারান্দায়। শওকত বলল, Hello!

ইমন বলল, Hello! Good morning.

আজ তোমার জন্মদিন। Happy birthday baby.

থ্যাংক য়্যু।

জন্মদিনে কী করতে চাও?

জানি না।

আমেরিকায় কীভাবে জন্মদিন করতে?

স্কুলের সব বন্ধুরা আসত। কেক কাটা হতো। গিফট ভোলা হতো।

এর বাইরে বিশেষ কিছু হতো না? আমার ধারণা মিস্টার অ্যান্ডারসন তোমার জন্মদিনে মজার কিছু করেন। ধারণা ঠিক না?

হ্যাঁ ঠিক। উনি ক্লাউনের পোশাক পরে ম্যাজিক শো করেন। উনি ম্যাজিক জানেন না-কি? খুব ভালো ম্যাজিক জানেন। আর তোমার মা? সে বিশেষ কিছু করে না?

কিছুই করে না?

মা শুধু কেক কাটার সময় তোমার হয়ে আমার কপালে চুমু দেয়।

আমার হয়ে চুমু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা কর।

মা বলে, লেমন ইয়েলো। হ্যাপি বার্থডে। তুমি তো আমাকে লেমন ইয়েলো নাম দিয়েছিলে, আমার জন্মদিনে মা একবার এই নামে আমাকে ডাকে।

শওকত শান্ত গলায় বলল, এতটা সম্মান তোমার মা আমাকে দেয়— এটা আমি চিন্তাও করি নি। যাও হাত-মুখ ধুয়ে আস। জন্মদিনে আমরা কী করব ঠিক করে ফেলি। তোমার মাকে দাওয়াত করে নিয়ে আসি।

মা আসবে না।

অবশ্যই আসবে।

আসবে না। মা আগেই বলে দিয়েছে এই জন্মদিনটা আমি যেন শুধু তোমার জন্যে করি।

শুধু তুমি আর আমি জন্মদিন করব?

তুমি তোমার বন্ধুদের বলো। তোমার বন্ধু নেই?

শওকত বলল, না। এক সময় অনেক বন্ধু ছিল, এখন আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।

কারো সঙ্গেই যোগাযোগ নেই?

অনেকের সঙ্গে হঠাৎ পথে দেখা হয়। তাদের বাসার ঠিকানা জানি না। শুধু একজনের ঠিকানা জানি তৌফিক। ধানমণ্ডিতে থাকে। বড় পেইন্টার হিসেবে নাম করেছে।

উনাকে আসতে বলো। তুমি কি আমার জন্যে কোনো গিফট কিনেছ বাবা?

না।

গিফট কিনতে হবে। মিস্টার অ্যান্ডারসন তুমি আমাকে কী গিফট দেবে সেটা আমাকে গোপনে বলেছেন। আমি দেখতে চাই তার কথা ঠিক হয় কি না।

ইমন মিটিমিটি হাসছে। বাবাকে বড় ধরনের চিন্তার মধ্যে ফেলে দিতে পারায় সে খুব মজা পাচ্ছে।

আজকের নাশতা বাইরে থেকে এসেছে। কিং বিরানি হাউসের তেহারি। বাংলাদেশের এই খাবারটা ইমনের পছন্দ হয়েছে। ইমনের ধারণা এই খাবারটা ম্যাকডোনাল্ডের বার্গারের কাছাকাছি। সে অবশ্যি তেহারি বলতে পারে না। বলে তোহারি।

নাশতার মাঝখানে আনিকা এসে উপস্থিত। সে ঢুকল বিব্রত ভঙ্গিতে। ইমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম বাবার বাসায় সে বাইরের কাউকে আসতে দেখল।

আনিকা ইমনের দিকে তাকিয়ে বলল, ইমন, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। শুভ জন্মদিন।

ইমন বলল, থ্যাংক ব্যু।

আমি তোমার জন্যে জন্মদিনের গিফট এনেছি। জানি না তোমার পছন্দ হবে কি-না।

কী গিফট এনেছ?

কচ্ছপের বাচ্চা।

কিসের বাচ্চা? কচ্ছপের বাচ্চা। কচ্ছপ চেন না! Turtle.

তোমাদের এখানে Pet shop আছে?

আছে।

আনিকা হ্যান্ডব্যাগের ভেতর থেকে পানি ভর্তি হরলিক্সের বোতল বের করল। বোতলের ভেতর ছোট ছোট দুটা কচ্ছপের বাচ্চা উঠা-নামা করছে। ইমন মুগ্ধ গলায় বলল, Oh my God. What a surprise! ইমন হাতের চামচ ছুড়ে ফেলে ছুটে এসে হরলিক্সের বোতল হাতে নিল।

আনিকা বলল, উপহার পছন্দ হয়েছে?

ইমন বলল, খুব পছন্দ হয়েছে। am so happy.

আমাকে ধন্যবাদ দিলে না তো?

আমি এত খুশি হয়েছি যে ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেছি। মিস, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।

আমাকে মিস কেন বলছ? আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে আমার এখনো বিয়ে হয় নি?

হ্যাঁ।

আনিকা শওকতের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো তোমার ছেলের জন্মদিনে আমাকে আসতে বলবে না, আমি নিজ থেকে চলে এসেছি। ভয় নেই, বেশিক্ষণ থাকব না। আমার অফিস আছে, আমি অফিসে চলে যাব।

শওকত বলল, চা খেয়ে যাও।

চা এক কাপ খেতে পারি।

আনিকা ইমনের চেয়ারটায় বসল। বাসায় দুটাই চেয়ার। ইমন তার চেয়ার খালি করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুগ্ধ দৃষ্টি সে একবারও কচ্ছপ দুটা থেকে সরাচ্ছে না।

আনিকা বলল, আমি তোমার এখানে আসতে আসতে ভাবছিলাম, খুব সুন্দর একটা ছেলে দেখব। কিন্তু এত সুন্দর কাউকে দেখব ভাবি নি। তোমার ছেলের চেহারায় কোথায় যেন দেবদূত দেবদূত ভাব আছে। ঠিক না?

শওকত জবাব না দিয়ে চা বানাতে গেল। ইমন আনিকার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কি এদের হাত দিয়ে ধরতে পারি? এরা কি কামড়ায়?

আনিকা বলল, এখন কামড়াবে না। তুমি ইচ্ছা করলে এদের হাতে নিতে পার। তবে এরা বড় হলে কিন্তু কামড়ায়। খুব শক্ত কামড়। এরা যখন কাউকে কামড়ে ধরে, তখন আর ছাড়ে না।

কামড়ে ধরেই থাকে?

হ্যাঁ।

তখন কী করলে এরা কামড় ছেড়ে দেয়?

কিছুতেই ছাড়ে না। মাঝে-মাঝে এমনও হয়েছে–গলা কেটে ফেলতে হয়েছে। তারপর ছেড়েছে।

খুব আশ্চর্য তো!

আশ্চর্যের কিছু নেই। মানুষের মধ্যেও এরকম কচ্ছপ স্বভাব আছে। কিছু মানুষ আছে যারা কচ্ছপের মতো। কাউকে কামড়ে ধরলে ছাড়ে না। যেমন আমি। আমি যদি কাউকে ধরি, তাহলে ছাড়ি না। মৃত্যু পর্যন্ত ধরে রাখি।

ইমন বলল, তুমি কাকে ধরেছ?

আনিকা বলল, আপাতত তোমাকে ধরেছি।

ইমন একটা কচ্ছপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। তার মাথায় কোনো পরিকল্পনা আছে।

শওকত চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আনিকা, তুমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময় সাবধানে বলবে। সে খুব স্মার্ট ছেলে। তুমি যা বলবে তা তো সে বুঝবেই, যা বলবে না তাও বুঝবে।

আনিকা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, আমি যদি কিছুক্ষণ তোমাদের সঙ্গে থাকি, তোমাদের অসুবিধা হবে?

শওকত বলল, অসুবিধা হবে কেন?

প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়ে দিও না। অসুবিধা হবে কি হবে না সেটা বলো।

অসুবিধা হবে না। বরং আমার খুবই লাভ হবে। আমি দুই-তিন ঘণ্টার জন্যে বাইরে যাব। ছেলেকে তোমার কাছে রেখে যেতে পারি। তিন ঘণ্টা থাকতে পারবে?

পারব।

তোমাকে অফিসে যেতে হবে না?

তোমাদের সঙ্গে আজ বেশকিছু সময় থাকব। দুপুরে তোমাদের রান্না করে খাওয়াব— এই ভেবে আমি আজ ছুটি নিয়েছি। তুমি থাকতে দেবে কি দেবে না— এই ভেবে শুরুতে অফিস থেকে ছুটি নেবার কথা বলি নি।

দুপুরে কী খাওয়াবে?

তোমার ছেলে যা খেতে চায়, তাই খাওয়াব।

তুমি রান্না করতে জানেনা তা জানতাম না।

আমি অনেক কিছুই জানি, যা তুমি জানো না।

রান্না যে করবে— জিনিসপত্র লাগবে না?

সেই ব্যবস্থা আমি করব। নিউমার্কেট থেকে বাজার করে আনব। তোমার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাব। সে কি যাবে আমার সঙ্গে?

যাবে। কচ্ছপ দিয়ে তুমি তারে কজা করে ফেলেছ।

আনিকা বলল, আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি যাদেরকে কজা করতে চাই তাদের কজা করতে পারি না। আর যাদের কজা করার আমার কোনো প্রয়োজন নাই, তারা কীভাবে কীভাবে যেন কজায় চলে আসে।

খারাপ কী? কেউ না কেউ তোকজায় আসছে।

খারাপ বলছি না তো! ইয়েলো ক্যাবের ড্রাইভারের কথা তোমার মনে আছে?

কোন ড্রাইভার?

আকবর নাম। যার গাড়িতে করে তোমাকে তুলে মগবাজার কাজি অফিসে গিয়েছিলাম। সে এখন কজায় চলে এসেছে। আমি যাতে গান শুনতে পারি, সেজন্যে সে তার গাড়ির ক্যাসেটপ্লেয়ার ঠিক করেছে। মাঝে-মধ্যেই সে বাসায় চলে আসে, আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবার জন্যে।

বিনা পয়সায় ট্যাক্সি চড়ায়, না-কি টাকা নেয়?

টাকা নেয়। ট্যাক্সিড্রাইভার ছাড়া আরো একজনকে কজা করেছি।

সে কে?

নাম জামাল। খামারের মালিক। গরু-ছাগল পুষে। পুকুরে মাছ চাষ করে। কাল সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় চা খেতে এসেছিল। তার চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝেছি, আমাকে তার অসম্ভব মনে ধরেছে। আমি খুবই অবাক হয়েছি।

অবাক হবার কী আছে? তুমি কি মনে ধরার মতো মেয়ে না?

এক সময় হয়তো ছিলাম, এখন নাই। আমার চেহারা কথাবার্তা সব কেমন জানি শুকনা হয়ে গেছে। দশটা-পাঁচটা চাকরি করি বলে হয়তো এরকম হয়েছে।

শওকত জবাব দিল না। আনিকা কেমন যেন দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে আছে। তার মুখ দেখে মায়া লাগছে।

আনিকা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার ছেলে কবে যাবে?

পরশু।

মন খারাপ?

শওকত জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আনিকাকে দেখে সে খানিকটা স্বস্তি বোধ করছে। ঘণ্টা দুই-তিন সময় তার আসলেই দরকার। পত্রিকা অফিসে যেতে হবে। ইলাসট্রেশনের কাজ করে দিয়ে আসতে হবে। দেরি হয়ে গেছে। মাসুম সাহেব এই দেরি সহজভাবে নেবেন বলে মনে হয় না। মেজাজ গরম মানুষ। হুট করে বলে বসতে পারেন আপনাকে আমাদের দরকার নেই। আপনি আপনার পথ দেখুন। আমরা আমাদের পথ দেখব। ইলাসট্রেশন হিসেবে কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং চালাচ্ছেন। কাক-বক দিয়ে আর চলবে না। মাসুম সাহেবের সঙ্গে দেখা করারও আগে ইমনের মার সঙ্গে দেখা করা দরকার। ছেলের জন্মদিনে উপস্থিত থাকার নিমন্ত্রণ। ইমন বলছে তার মা আসবে না। কিন্তু শওকতের ধারণা সে আসবে। অনেকদিন ছেলেকে দেখে নি। বিশেষ একটি দিনে ছেলের সঙ্গে থাকার সুযোগ সে নষ্ট করবে না। রেবেকা কঠিন মেয়ে, কিন্তু এত কঠিন না।

 

ইমন খুবই ব্যস্ত দুই কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজনে। আনিকা এই বিষয়ে তাকে সাহায্য করছে। মেঝেতে চক দিয়ে দুটা লাইন টানা হয়েছে। কচ্ছপ দুটিকে একসঙ্গে ছাড়া হচ্ছে। দুজনের একজন সোজাসুজি যাচ্ছে, অন্যজন শুরুতেই নব্বই ডিগ্রি টার্ন করছে। ইমন এবং আনিকা দুজন হাল ছাড়ার পাত্র না। তারা চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। আনিকা শুকনা মরিচের গুঁড়া এনে কচ্ছপের দৌড়ের জায়গা ছাড়া অন্য সব দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এতে তেমন কোনো লাভ হয় নি। শুকনা মরিচ ছড়ানো জায়গায় কচ্ছপ যাচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তারা দুজনই দৌড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে।

আনিকা বলল, দাঁড়াও, আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে। এই বুদ্ধিতে মনে হয় কাজ হবে।

ইমন আগ্রহের সঙ্গে বলল, কী বুদ্ধি?

বুদ্ধিটা এখনো ঠিকমতো জমে নি। মানে হলো মাথায় পুরোপুরি আসে নি। আসি আসি করছে।

বুদ্ধি আনার ব্যাপারে আমি কি তোমাকে হেল্প করতে পারি?

না।

আমি চা বানানো শিখেছি। তুমি কি চা খাবে?

চা বানানো কার কাছে শিখেছ?

আমার বাবার কাছে।

আর কিছু শিখেছ?

খিচুড়ি বানানো শিখেছি, তবে সেটা কঠিন।

দেখি চা বানাও তো। সাবধান, আবার হাত পুড়িও না।

ইমন আগ্রহের সঙ্গে চা বানাতে গেল। দুই কচ্ছপের দৌড় দেয়ানোর জন্যে মেয়েটার চেষ্টা দেখে সে মুগ্ধ। ছোটদের কোনো কাজে বড়রা কখনোই এত আগ্রহ দেখাবে না।

চায়ে চুমুক দিয়ে আনিকা বলল, তুমি তো আসলেই চা ভালো বানিয়েছ। ছোটদের বানানো চায়ে একটা সমস্যা সবসময় থাকে— চা-টা হয় ঠাণ্ডা! তোমারটা হয় নি।

চা কীভাবে গরম বানাতে হয় বাবা শিখিয়েছে।

আনিকা বলল, মায়েরা তার ছেলেমেয়েদের অনেক কিছু শেখায়। মায়ের শেখানো কোনো কিছুই ছেলেমেয়েরা মনে রাখে না। বাবারা যা শেখায় তাই মনে রাখে।

ইমন বলল, তোমার বাবা তোমাকে কী শিখিয়েছিলেন?

পানিতে চাক্তি মারা।

সেটা কী?

একটা চাক্তি নিয়ে পুকুরের পানিতে ছুড়ে মারা। চাক্তিটা এমনভাবে ছুড়তে হয় যেন সেটা পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। দেখলে মনে হবে একটা ব্যাং পানির উপর লাফ দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

তোমার বাবা এটা তোমাকে শিখিয়েছেন?

হ্যাঁ। আমরা গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। পুকুরপাড়ে বসে আছি। বাবা এসে উপস্থিত। বাবাকে দেখে খুব ভয় পেলাম। দৌড়ে পালিয়ে যাব ভাবছি, তখন…

বাবাকে ভয় পেলে কেন?

আমার বাবা অন্য বাবাদের মতো না। উনি কোনো কারণ ছাড়াই তার ছেলেমেয়েদের বকাঝকা করেন।

কিন্তু তিনি তোমাকে চাক্তি মারা শিখিয়েছেন।

হ্যাঁ, তা শিখিয়েছেন।

তুমি কি আমাকে শেখাতে পারবে?

হ্যাঁ পারব।

কখন শেখাবে?

এখনই শেখাতে পারি। আমার দরকার কয়েকটা চাক্তি আর একটা পুকুর।

চাক্তি এবং পুকুর কোথায় পাওয়া যায়?

ঢাকা শহরেই পাওয়া যায়। চল রমনা লেকে যাই।

কচ্ছপ দুটাকে কি রেখে যাব, না সঙ্গে নিয়ে যাব?

আমার মনে হয় সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভালো হবে।

 

আনিকার পুকুরের পানিতে চাক্তিমারা দেখে ইমন হতভম্ভ হয়ে গেল। আসলেই মনে হচ্ছে পানি স্পর্শ করে লাফিয়ে লাফিয়ে একটা ব্যাং যাচ্ছে।

ইমন বলল, তোমার এবং তোমার বাবা তোমাদের দুজনের অনেক বুদ্ধি।

এটা ঠিক না। আমরা দুজনই বোকা। বেশ বোকা। আমি একটু কম। আমার বাবা একটু বেশি।

পানিতে চাক্তি মারা ছাড়া তুমি আর কী জানো?

আর কিছু জানি না। তবে গান গাইতে পারি।

বাংলা গান?

হ্যাঁ, বাংলা গান। শুনবে?

শুনব।

আনিকা সঙ্গে সঙ্গেই গান শুরু করল মদিনাবাসী প্রেমে ধর হাত মম। স্কুলের অনুষ্ঠানের পর আনিকা আর গান গায় নি। বহু বছর পর আবার গাইছে। সে নিজেই অবাক হয়ে লক্ষ করল, খুব ভালো গাইছে তো! গলায় সুর আছে। ভালো মতোই আছে। গান গাইতে গাইতে আনিকার চোখ ভিজে গেল।

ইমন বলল, তুমি কাঁদছ কেন?

আনিকা বলল, গান গাইতে গাইতে আমি কল্পনায় দেখছিলাম আমি তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলের একটা পার্কে বসে গান করছি— সবাই খুব মজা করে আমার গান শুনছে।

ইমন ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এই অদ্ভুত মহিলার কথাগুলি সে বোঝার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারছে না।

আনিকা বলল, ইমন, আমার গান কি তোমার পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে। আরেকবার গাও।

আনিকা সঙ্গে সঙ্গে গাইতে শুরু করল। পার্কে লোকজন তেমন নেই। সকাল দশটা-এগারোটার দিকে রমনা লেকে কেউ বেড়াতে আসে না। তারপরও কিছু লোকজন আছে। তাদের কেউ কেউ কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। কয়েকজন আবার গান শোনার জন্যে এগিয়ে আসছে। আনিকা চোখ বন্ধ করে গাইছে। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ইমন খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। এই মহিলা এমন করে কাঁদছে কেন— সে বুঝতে পারছে না। তারচেয়েও বড় কথা তার নিজের খুব কান্না পাচ্ছে।

 

রেবেকা এবং শওকত মুখোমুখি বসে আছে। শওকত ভয়ে ভয়ে ছিল। রেবেকা প্রথমেই কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করবে— ছেলেকে কার কাছে রেখে এসেছ? সে তা করে নি। শওকত ছেলের জন্মদিনে তাকে নিতে এসেছে শুনে সে সহজভাবে বলল, আমরা দুজন একসঙ্গে উপস্থিত থাকলে ইমন বিব্রতবোধ করবে। সে মাকে খুশি রাখবে না বাবাকে খুশি রাখবে— এটা নিয়ে কনফিউজড হয়ে যাবে। তাকে নিয়ে আমি অনেক জন্মদিন একা একা করেছি। আজকেরটা তুমি কর। তুমি কি তার জন্যে কোনো গিফট কিনেছ?

শওকত বলল, না। কী কিনব বুঝতে পারছি না। সে কী পছন্দ করে?

বাচ্চা মানুষ তো, যা দেবে তাই পছন্দ করবে। তবে তুমি তাকে একটা সাইকেল কিনে দিতে পার। তার সাইকেলের খুব শখ। একা একা চালাতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করবে ভেবে আমি কিনে দেই নি।

সাইকেল?

হ্যাঁ। তার সাইকেলের খুব শখ।

সাইকেল তো সে সঙ্গে করে আমেরিকা নিয়ে যেতে পারবে না।

তা পারবে না। সাইকেল থাকবে তোমার কাছে। সেটা খারাপ কী? স্মৃতি থাকল। পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। সাইকেল কেনার মতো টাকা কি তোমার কাছে আছে?

আছে।

তাহলে তাকে একটা সাইকেল কিনে দাও। অ্যান্ডারসন তোমার ছেলেকে গোপনে বলেছে যে, তুমি তাকে একটা সাইকেল দেবে। অ্যান্ডারসনের কথা সত্যি হয় কি-না তা দেখার জন্যে ইমন মনে মনে অপেক্ষা করছে।

আমি অবশ্যই সাইকেল কিনে দেব।

তুমি তোমার নিজের জীবনটা গোছাবার চেষ্টা কর। ভেজিটেবল হয়ে বেঁচে থাকার মানে হয় না।

শওকত হাসল। রেবেকা বিরক্ত গলায় বলল, তোমার পাশ কাটানো হাসিটা হাসবে না। তোমার অনেক জিনিসের মতো তোমার নন কমিট্যাল হাসিও আমার পছন্দ না। সাইকেল কেনার টাকা না থাকলে আমার কাছ থেকে নিতে পার।

টাকা আছে।

শওকত উঠে দাঁড়াল। রেবেকাও সেই সঙ্গে উঠল। শওকত বলল, যাই? রেবেকা বলল, যাও। তোমাকে যে প্রতি রাতে বোবায় ধরত, সেই অসুখটা কি এখনো আছে?

আছে।

এই অসুখের ভালো চিকিৎসা বের হয়েছে। এটা একটা সাইকো সমেটিক ব্যাধি। টাইম পত্রিকার গত অক্টোবর সংখ্যায় এই রোগটার উপর বড় একটা আর্টিকেল বের হয়েছে। আমি টাইম পত্রিকাটা নিয়ে এসেছি। দেব তোমাকে?

দরকার নেই।

 

অনেক রাতে ইমন টেলিফোন করল তার মাকে। তার গলা কাঁদো কাদো। গলা শুনে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই সে কেঁদেছে। কান্না শেষ হয় নি। এখনো বুকে জমে আছে।

ইমন ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, বাবা আমাকে সাইকেল গিফট করেছে।

রেবেকা বললেন, এটা তো খুবই আনন্দের ঘটনা। অ্যান্ডারসনের সিক্সথ সেন্স কাজে লেগেছে। আনন্দের ঘটনায় তুমি বোকা ছেলের মতো কাঁদছ কেন?

জানি না। কেন জানি আমার শুধু কান্না পাচ্ছে।

তুমি কি আমার কাছে চলে আসতে চাও?

হ্যাঁ।

তোমার বাবাকে বলো, সে তোমাকে দিয়ে যাবে।

আচ্ছা।

আরেকটু ভেবে তারপর বললা। গাড়ি কি পাঠাব?

হ্যাঁ, পাঠাও।

পাঠাচ্ছি। লক্ষ্মীসোনা, কাঁদবে না।

ছেলের কান্নার শব্দে শওকত বের হয়ে এলো। তার নিজের বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগল। কেন ছেলেটা এমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে? তার ছোট্ট হৃদয়ে এত কী কষ্ট!

শওকত বলল, বাবা, কী হয়েছে?

ইমন ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি জানি না কী হয়েছে। আমি কনফিউজড।

কেন বাবা?

ইমন নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল, আমি কেন তোমাদের দুজনের সঙ্গে থাকতে পারছি না— এটা ভেবে কনফিউজড।

কাছে আসো, তোমাকে আদর করে দেই।

ইমন শান্ত গলায় বলল, না। Please, dont touch me.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *