শামসুদ্দিন সাহেব আছরের নামাজ পড়তে পারলেন না।
নামাজে দাঁড়ানোর পর থেকে তার হচি শুরু হয়ে গেল। তিনি নামাজ রেখে জায়নামাজে বসে পড়লেন। হাঁচি বন্ধ হলো না। এক সময় নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। হাঁচির সময় মাঝে মাঝে রক্ত যায় কিন্তু এরকম অবস্থা কখনো হয় না। শামসুদ্দিন সাহেবের পাঞ্জাবি রক্তে লাল হয়ে গেল।
খাটের উপর পৃথু পা ঝুলিয়ে বসে আছে। সে অবাক হয়ে বড় মামার নাক দিয়ে রক্ত পড়া দেখছে। একই সঙ্গে সে হাঁচির হিসাবও রাখছে। বিড়বিড় করে বলছে, থার্টি টু, থার্টি থ্রি, থার্টি ফোর। কিছুক্ষণের মধ্যে কার্টুন ঢ্যানেলে একটা মজার কার্টন হবে। পথ এসেছিল বড় মামার সঙ্গে কার্টুন দেখবে এই পরিকল্পনা নিয়ে। এখন মনে হচ্ছে তাকে একা একাই কার্টুন দেখতে হবে। কোনো ভালো জিনিস একা দেখে আরাম নেই। কিন্তু উপায় কী! যে লোকটার নাক দিয়ে ক্রমাগত রক্ত পড়ছে তাকে সে নিশ্চয়ই কার্টুন দেখতে বলতে পারে না।
পৃথু!
জি বড় মামা।
পানি খাওয়াতে পারবি?
পৃথু খাট থেকে নামল। পানি খাওয়াতে সে অবশ্যই পারবে। ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করে সেই বোতলের পানি গ্রীসে ঢেলে নিয়ে আসা। খুব সহজ কাজ। পৃথুর যেতে ইচ্ছা করছে না, কারণ সামনে থেকে গেলেই হাঁচি শুনতে গণ্ডগোল হয়ে যাবে! এখন যাচ্ছে ফিফটি থ্রি। পৃথু রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো।
ফ্রিজ ব্রা পৃথুর জন্যে নিষেধ। মা বলেছে পৃথুকে যদি কখনো দেখা যায় সে ফ্রিজ খুলছে তাহলে তাকে কানে ধরে তিনবার উঠবোস করাবে। আজ সেই ভয় নেই–মা কোথায় যেন চলে গেছে। যাবার সময় বলে গেছে আর কোনোদিন সে এ বাড়িতে ফিরবে না। ব্যাপারটা খুবই দুঃখের কিন্তু পৃথুর খুব বেশি দুঃখ লাগছে না। বরং একটু যেন ভালো লাগছে।
পৃথু পানি এনে দেখল বড় মামা জায়নামাজের উপর শুয়ে আছেন। আঙুল দিয়ে নাক চেপে ধরে মুখে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। পৃথু বলল, পানি এনেছি মামা। শামসুদ্দিন হাতের ইশারায় জানালেন পানি খাবেন না। পৃথু টিভির সামনে চলে গেল। বড় মামার হাঁচি বন্ধ হয়েছে, এখন আর হচি গুনতে হবে না। টিভি দেখতে দেখতে হাঁচি গুনতে হলে খুব সমস্যা হতো। সব মিলিয়ে আজ বড় মামা সেভেন্টি ওয়ান হাঁচি দিয়েছেন। হানড্রেডের অনেক নিচে। এটা খুব দুঃখের ব্যাপার বড় মামা কখনো হানড্রেড করতে পারেন না।
শামসুদ্দিন অবাক হয়ে রক্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। আশ্চর্য, এত রক্ত শরীর থেকে গেছে! হাঁচি বন্ধ হয়েছে। রক্ত পড়াও মনে হয় বন্ধ হয়েছে। জায়নামাজ থেকে উঠে রক্ত ধুয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলে ভালো লাগত। তিনি অনেক চেষ্টা করেও উঠে বসতে পারলেন না। একা একা উঠা যাবে না। একজন কাউকে লাগবে যে তাকে ধরে ধরে বিছানায় নিয়ে যাবে। বাসায় পৃথু ছাড়া কেউ নেই। রাহেলা সকালবেলায় রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়েছে। রফিক গেছে তাকে খুঁজে আনতে। তারা কখন ফিরবে কে জানে! যতক্ষণ না ফিরবে ততক্ষণ কি রক্তের বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে?
শামসুদ্দিন চোখ বন্ধ করলেন। মাথা দুলছে। চোখ বন্ধ করলে দুলুনিটা কম লাগে। কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে হতো। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। শরীর অতিরিক্ত ক্লান্ত হলে ঘুম আসে না। কেউ একজন মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ভালো লাগত। পৃথুকে কি ডাকবেন? না থাক, বেচারা আরাম করে টিভি দেখছে।
বীথির সঙ্গে বিয়ে হলে সে এই অবস্থা দেখলে কী করত কে জানে? নিশ্চয়ই খুব অস্থির হয়ে পড়ত। একজন মানুষের জন্যে অন্য একজন মানুষের অস্থিরতা দেখতে এত ভালো লাগে! এই অস্থিরতার নামই কি ভালোবাসা? আমি তোমাকে ভালোবাসি এই বাক্যটির মানে কি–আমি তোমার জন্যে অস্থির হয়ে থাকি? কে জানে ভালোবাসা মানে কী? তিনি কখনো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েন নি। প্রেমে না পড়েও তিনি বীথি নামের একটি মেয়ের জন্য প্রবল অস্থিরতা বোধ করেছিলেন। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর একদিন শুধু মেয়েটির সঙ্গে কথা হয়েছে। বীথির ছোট চাচি বীথিকে তার বাসায় ডেকেছিলেন, শামসুদ্দিনকেও ডেকেছিলেন। তিনি শামসুদ্দিনকে বললেন, তোমরা নিজেরা কিছুক্ষণ গল্পগুজব কর। বিয়ের আগে কিছুটা পরিচয় থাকা ভালো। যাও, ছাদে চলে যাও। আমি চা পাঠাচ্ছি।
শামসুদ্দিনের পিছনে পিছনে লজ্জিত ভঙ্গিতে বীথি ছাদে উঠছে। হঠাৎ সিঁড়িতে শামসুদ্দিনের পা পিছলে গেল। তিনি হুড়মুড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছেন, তখন বীথি চট করে তাকে ধরে ফেলল। শামসুদ্দিন খুবই লজ্জা পাচ্ছিলেন। বীথি তখন তার দিকে তাকিয়ে কোমল ভঙ্গিতে হাসল। হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল আপনি কেন শুধু শুধু লজ্জা পাচ্ছেন? লজ্জা পাবার মতো কিছু হয় নি।
ছাদে তাদের কোনো কথা হয় নি। রেলিং ধরে দুজন অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর শামসুদ্দিন বললেন, আমার খুব অদ্ভুত একটা ডাক নাম আছে। চৈতার বাপ। অদ্ভুত না?
বীথি হাসিমুখে হা-সূচক মাথা নাড়ল। শামসুদ্দিন ভেবেছিলেন, বীথি কোনো কথাই বলবে না। অথচ বীথি তাকে চমকে দিয়ে বলল, আমার কোনো ডাক নাম নাই। আমার ভালো নাম ডাক নাম দুটাই বীথি।
শামসুদ্দিন তখন ছোট্ট একটা রসিকতা করলেন। বীথির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ডাক নাম যদি চৈতার বাপ হয় তাহলে তোমার ডাক নাম চৈতার মা।
বীথি শব্দ করে হেসে ফেলল। শামসুদ্দিনের সেই হাসি শুনে কেমন যেন লাগল। মনে হলো সমস্ত শরীর দুলে দুলে উঠছে। চোখের সামনেও স্ব কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে গেল। তিনি হঠাৎ গাঢ় স্বরে বললেন, বীথি শোন, আমি খুব দুঃখ-কষ্টে বড় হয়েছি। মানুষের দুঃখ-কষ্ট আমি জানি। আমি সারা জীবন তোমাকে কখনো কোনো কষ্ট দেব না।
বীথি মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, মনে থাকে যেন।
এই পর্যন্তই তাদের কথাবার্তা।
বীথির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় নি। বিয়ের আসরে তাঁকে জানানো হয়েছে মেয়ে হঠাৎ কেন জানি বলছে বিয়ে করবে না।
আমেরিকায় পঁয়ত্রিশ বছর পর বীথির সঙ্গে তাঁর দেখা হবে। তিনি বীথিকে বলবেন–আমি বলেছিলাম সারা জীবনে তোমাকে কোনো কষ্ট দেব না। বীথি, আমি আমার কথা রেখেছি। তোমাকে কোনো কষ্ট দেই নি।
শামসুদ্দিনের খুব দেখার ইচ্ছা তাঁর কথা শোনার পর বীথি ঐ দিনের মতো মুখ টিপে হাসে কি না। বীথির ছেলেমেয়েগুলিকেও তার খুব দেখার শখ। এই ছেলেমেয়েগুলি তারও হতে পারত।
পৃথু শুনল বড় মামা আবার হাঁচি দিচ্ছেন। সে সঙ্গে সঙ্গে গুনতে শুরু করল সেভেন্টি টু, সেভেন্টি থ্রি, সেভেনটি ফোর। পৃথুর বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে মামা এবার হানড্রেড করে ফেলবে। হানড্রেড মানে সেঞ্চুরি। ক্রিকেট প্লেয়াররা সেঞ্চুরি করে। তাদের তখন খুব আনন্দ হয়। কলিংবেল বাজছে। মনে হচ্ছে বাবা এসেছে। পৃথু দরজা খুলতে গেল। সে এখন পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দরজা খুলতে পারে।
না, বাবা আসে নি। জয়নাল নামের মানুষটা এসেছে। জয়নাল হাসি হাসি মুখে বলল, কেমন আছ খোকা?
জয়নাল মানুষটা ভালো। সে যতবার এ বাড়িতে আসে ততবারই পৃথুর জন্যে কিটক্যাট নিয়ে আসে। আজ মনে হয় আনে নি।
পৃথু বলল, আমি ভালো আছি। আমার বড় মামার শরীর খুব খারাপ। আপনি তাকে নিয়ে হাসপাতালে যান।
তার কী হয়েছে?
পৃথু জবাব না দিয়ে টেলিভিশন দেখতে চলে গেল। সে সামান্য দুশ্চিন্তায় পড়েছে। জয়নাল নামের এই মানুষটা অবশ্যই বড় মামাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। তাকে একা বাসায় ফেলে যাবে না। তাকেও নিয়ে যাবে। হাসপাতালে টেলিভিশন নেই। সে কী করবে? একা একা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করবে? পৃথু খুবই দুশ্চিন্তা বোধ করছে। দুশ্চিন্তার কারণে বড় মামার হচি গুনতে ভুলে গেছে। তিনি হয়তো হানড্রেড করে ফেলেছেন অথচ হিসাবটা কেউ রাখতে পারল না। পৃথু টেলিভিশনে মন দিল। খুবই মজার একটা কার্টুন হচ্ছে। সব দুষ্ট লোক পটাপট মরে যাচ্ছে। ভালো লোকগুলি শত বিপদে পড়েও বেঁচে যাচ্ছে। পৃথু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, জীবনটা কার্টুনের মতো হলো না কেন? কার্টুনের জীবনে কোনো দুঃখ নেই। শুধুই আনন্দ। এই জীবনে ভালো লোকরা কখনো মারা যায় না। বড় মামা খুব ভালো লোক। কার্টুনে বড় মামা কখনো মারা যাবেন না। নাক দিয়ে অনেক রক্ত পড়ার পরও বেঁচে থাকবেন।
শামসুদ্দিন সাহেব চোখ মেলে ধাক্কার মতো খেলেন। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সবই কেমন অন্যরকম। সবই অচেনা। তিনি অপরিচিত একটা ঘরের অপরিচিত বিছানায় শুয়ে আছেন। ঝাড়বাতি জ্বলছে, কিন্তু আলো কম। সেই আলোয় সবই আবছা দেখাচ্ছে। কোনো কিছুই স্পষ্ট না। তার বিছানার পাশের চেয়ারে যে বসে আছে সে কে? বীথি? বীথি এখানে কোত্থেকে এলো? তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আবার চোখ খুললেন। অবশ্যই বীথি বসে আছে। তাকে তিনি একবারই দেখেছিলেন। চেহারা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আজ সেই চেহারা মনে পড়ল। কী সুন্দর কোমল মুখ! শামসুদ্দিন সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, কেমন আছ?
বীথি সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আগ্রহের সঙ্গে বলল, চাচাজি, আপনার ঘুম ভেঙেছে?
শামসুদ্দিনের সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। এই মেয়ে বীথি না। বীথির এত অল্প বয়স হবে না। বীথি তাকে চাচাজিও ডাকবে না। তা হলে এই মেয়েটা কে? বীথি তো বটেই; সেই চোখ, সেই মুখ। গলার স্বরও সে-রকম। শামসুদ্দিন সাহেব হতাশ চোখে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরা তরুণী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঘুম পাচ্ছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কষ্ট করে চোখ খোলা রাখতে হচ্ছে।
চাচাজি আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? আমার নাম ইতি। আমাকে চিনেছেন?
শামসুদ্দিন ঘুম ঘুম চোখে হা-সূচক মাথা নাড়লেন। ইতি বলল, আপনাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এখন আপনার শরীরটা কেমন লাগছে?
ভালো।
আপনি কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। শরীর থেকে অনেক রক্ত গেছে তো, এই জন্য আপনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আপনাকে তিন ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। আরো রক্ত দেয়া হবে।
শামসুদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, আচ্ছা।
চাচাজি, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না। বলুন তো আমি কে?
শামসুদ্দিন অস্পষ্ট গলায় বললেন, তুমি বীথি।
জি না চাচাজি, আমার নাম ইতি। আমি জয়নালের স্ত্রী। আমাদের বিয়ের সময় আপনি ছিলেন। আপনি ছেলে পক্ষের উকিল। এখন মনে পড়ছে?
হ্যাঁ। জয়নাল কোথায়?
ও আপনাকে নিয়েই ছোটাছুটি করছে। চলে আসবে।
শামসুদ্দিন অস্পষ্ট গলায় বললেন, আমি তোমাকে চিনতে পারি নি। তুমি কিছু মনে করো না। আমি খুবই লজ্জিত।
ইতি বলল, কী আশ্চর্য কথা! আমি কিছু মনে করব কেন? আপনার উপর দিয়ে যে ঝড় গিয়েছে আপনার তো কিছুই মনে থাকার কথা না। চাচাজি, আমি আপনার গায়ে হাত বুলিয়ে দেই?
দরকার নাই।
না বলার পরও ইতি হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার হাতে ভালো মায়া আছে। শামসুদ্দিনের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে শরীরে আরামদায়ক আলস্য।
ইতি বলল, চাচাজি আপনি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠুন। তারপর জয়নালকে নিয়ে আমেরিকা চলে যান। সেখানে অবশ্যই আপনি বড় ডাক্তার দেখাবেন।
শামসুদ্দিন বললেন, আমি একটু পানি খাব।
ইতি চামচে করে পানি শামসুদ্দিন সাহেবের মুখে দিচ্ছে। তিনি আগ্রহ করে পানি খাচ্ছেন। তার কাছে মনে হচ্ছে ঠিক এই ভাবে অনেককাল আগে কেউ একজন তাকে চামচে কবে পানি খাইয়েছে। সেই একজনটা কে তার মনে পড়ছে না। সেই জন্যে খুব অস্বস্তি লাগছে। অস্বস্তিটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাঁর মনে হচ্ছে নামটা মনে না পড়লে অস্বস্তিটা এক সময় খুবই বেড়ে যাবে। তার হাঁচি আবারো শুরু হয়ে যাবে।
পানি আর খাব না।
ইতি পানির গ্লাসটা টেবিলে রাখতে গেল। তখন শামসুদ্দিন সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন, যে চেয়ারটায় ইতি বসেছিল সেই চেয়ারে বৃদ্ধ একজন মানুষ পা গুটিয়ে বসে আছেন। তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইতির দিকে। সেই বৃদ্ধ মানুষটা আর কেউ না, তার বাবা।
শামসুদ্দিনের মনে হলো তিনি মারা যাচ্ছেন। মৃত্যুর আগে আগে মানুষ তার মৃত আত্মীয় স্বজনকে দেখে। তিনিও তাই দেখছেন। চেয়ারে বসা বৃদ্ধ ঝুঁকে এসে বলল, ও চৈতার বাপ, এই সুন্দরমতো মেয়েটা কে?
শামসুদ্দিন বললেন, এর নাম ইতি। জয়নালের বউ।
কোন জয়নাল? সিরাজদিয়ার জয়নাল?
বাবা, সিরাজদিয়ার জয়নাল চাচা না। আপনি তাকে চিনবেন না।
তোর শরীরটা তো দেখি ভালো না।
আমার শরীর খুবই খারাপ।
আমার নিজেরও শরীর খারাপ। পায়ে ব্যথা। গরম সেঁক দিতে পারলে হতো। যেখানে থাকি সেখানে গরম সেঁক দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই।
আপনি থাকেন কোথায়?
চিপাচাপায় পড়ে থাকি। মানুষকে ঠিকানা দিতেও ভয় লাগে। আচ্ছা তোকে একদিন নিয়ে যাব। তোর শরীরটা সারুক তারপর নিয়ে যাব। হাঁটাপথে যেতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে অবস্থা কাহিল। রাস্তাও ভালো না। পথে পথে কংকর।
শামসুদ্দিন চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তার চারপাশে কী হচ্ছে তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। তাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। এই ঘুমের মানেই কি মৃত্যু? ঘুম আর ভাঙবে না। সত্যি সত্যি যদি তাঁর মৃত্যু হয় তাহলে তো ইতিকে কিছু কথা বলা দরকার। যেমন তিনি ঠিক করে রেখেছেন জয়নালের আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকাটা তিনি দেবেন। বেচারা অনেক ছোটাছুটি করেও টিকিটের টাকা জোগাড় করতে পারছে না। সে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। বেচারাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করা দরকার।
ইতি!
জি চাচাজি?
একটু দেখ তো–চেয়ারে কি কেউ বসে আছে?
ইতি বিস্মিত হয়ে বলল, না তো।
আচ্ছা ঠিক আছে।
ইতি বলল, আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আমি একজন ডাক্তার ডেকে আনি।
ডাক্তার ভাকতে হবে না। কয়টা বাজে?
দশটা পঁচিশ।
ইতি ডাক্তার ডাকতে গেল। ঠিক তখনই শামসুদ্দিন হাঁচি দিলেন। চেয়ারে বসে থাকা বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। শামসুদ্দিন আবারো হাঁচি দিলেন। বৃদ্ধ বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। বৃদ্ধের মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে বৃদ্ধ খুব মজা পাচ্ছে।
রাত এগারোটা বাজে।
রফিকের মেজাজ ভয়ঙ্কর খারাপ। মেজাজ সামলানোর চেষ্টা করছে। সামলাতে পারছে না। সে পৃথুর সঙ্গে বসে আছে। তার দৃষ্টিও ছেলের মতোই টেলিভিশন সেটের দিকে। টেলিভিশনে কিছু একটা হচ্ছে, কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে পৃথু খিলখিল করে হেসে উঠছে, তখন সে তাকাচ্ছে পৃথুর দিকে। সেই দৃষ্টিতে কোনো মমতা নেই।
পৃথু বলল, বাবা, মা কখন আসবে?
রফিক বলল, জানি না।
রাতে ফিরবে?
সেটাও জানি না।
রাতে আমরা ভাত খাব না বাবা?
তোমার মার জন্যে আরো আধঘণ্টা অপেক্ষা করব। এর মধ্যে সে যদি না ফিরে তাহলে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসব।
বড় মামাকে খাবার দিয়ে আসতে হবে না?
তাও জানি না।
বড় মামা কি মারা যাবে বাবা?
মারা যাবে কেন? উদ্ভট ধরনের কথা বলবে না।
উদ্ভট ধরনের কথা কাকে বলে বাবা?
জানি না কাকে বলে। প্লিজ চুপ করে থাক।
মা যতক্ষণ না আসে ততক্ষণ কি আমি টিভি দেখতে পারব?
হ্যাঁ, পারবে।
মা যদি রাতে না ফিরে তাহলে কাল আমাকে স্কুলে যেতে হবে না, তাই না বাবা?
পৃথু, আর কোনো কথা শুনতে চাই না।
আচ্ছা আর কথা বলব না।
পৃথু শোন, আমার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। আমি দোকানে সিগারেট কিনতে যাব। তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে? না-কি টিভি দেখবে?
আমি টিভি দেখব।
একা একা ভয় পাবে না তো?
না।
তুমি থাক, সেটাই ভালো। বাড়িওয়ালার বাসায় তোমার মা টেলিফোন করতে পারেন। তোমাকে খবর দিলেই তুমি টেলিফোন ধরবে।
আচ্ছা।
টেলিফোনে কী বলবে শুনে রাখ। তুমি বলৰে যে তোমার বড় মামা খুবই অসুস্থ। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তোমার মা যেন এক্ষুণি চলে আসে।
আচ্ছা।
আমি বেশি দেরি করব না। যাব আর সিগারেট নিয়ে চলে আসব।
আচ্ছা।
রফিক সিগারেট কিনতে বের হলো। টেনশনের সময় ঘনঘন সিগারেট টানতে ইচ্ছা করে। দুঘণ্টার উপর হয়ে গেছে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে না। যেকোনো মুহূর্তে রাহেলা টেলিফোন করতে পারে এই ভেবে সে যায় নি। টেলিফোন এখনো আসে নি। রাগ করে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়া রাহেলার জন্যে কোনো নতুন ব্যাপার না। তবে যতবারই সে বাইরে গিয়েছে রাত দশটার আগে ফিরে এসেছে। তার যাবার জায়গাও সীমিত। যে সব জায়গায় তার যাবার সম্ভাবনা তার প্রতিটি রফিক খুঁজে এসেছে। রাহেলা নেই।
রফিক কী করবে বুঝতে পারছে না। শামসুদ্দিন সাহেব হাসপাতালে পড়ে আছেন। রফিকের উচিত তার পাশে থাকা। চিকিৎসার কী হচ্ছে না হচ্ছে তার খোঁজ নেয়া। অথচ সে পৃথুর সঙ্গে টিভি সেটের সামনে। জয়নাল নামের নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করছে। জয়নাল সম্পর্কে আগে যা ভাবা হয়েছিল তা ঠিক না। মানুষটা অবশ্যই ভালো।
রাহেলা টেলিফোন করল রাত বারটায়। বাড়িওয়ালার ছেলে খুবই বিরক্তমুখে খবর দিতে এলো। এত বিরক্ত হবার মতো কিছু ঘটে নি। ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন তৈরি হতেই পারে। ভয়ঙ্কর কোনো বিপদে রাত বারটার সময় ভাড়াটের টেলিফোন আসতেই পারে।
রফিক মাথা ঠাণ্ডা রেখে টেলিফোন ধরল। সে ঠিক করে রাখল রাহেলার সঙ্গে খুব শান্ত গলায় কথা বলবে। কোনোরকম রাগারাগি করবে না। ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসতে হবে।
টেলিফোন ধরতেই রাহেলা বলল, হ্যালো শোন, আমি নেত্রকোনা যাচ্ছি। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে টেলিফোন করছি।
নেত্রকোনা যাচ্ছি মানে কী? নেত্রকোনার কোথায় যাচ্ছ?
বাবার বাড়িতে যাচ্ছি। না-কি বাবার বাড়িতেও যেতে পারব না? বাবার বাড়িতে যেতে হলেও তোমার কাছ থেকে ভিসা নিতে হবে?
রাহেলা আমার কথা একটা কথা শোন…
রফিকের কথার মাঝখানে রাহেলা চেঁচিয়ে বলল, তোমার কোনো কথা শুনব নী। এখন থেকে আমি কথা বলব, তুমি শুনবে। তোমার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্কের এখানেই ইতি। তুমি যদি আমাকে আনতে যাও তাহলে গুণ্ডা দিয়ে তোমাকে জুতা পেটা করব। চরিত্রহীন বদ কোথাকার!
রাহেলী শোন, বাসায়…
আবার কথা বলে! খবরদার কথা বলবি না। খবরদার।
রাহেলা খট করে টেলিফোন লাইন কেটে দিল।
রাহেলার খুব মজা লাগছে। পৃথুর বাবা এখন চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হোক। ছোটাছুটি করতে থাকুক। রাহেলা নিশ্চিত পৃথুর বাবা কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে যাবে। স্টেশনের এ-মাথা ও-মাথা তাকে খুঁজবে। তার মাথায় সপ্ত আকাশ ভেঙে পড়বে। পক আকাশ ভেঙে। শিক্ষা হোক। রাহেলার সবাইকে শিক্ষা দিতে ইচ্ছা করছে। কঠিন শিক্ষা। যে-ই তার কাছে আসবে সে-ই শিক্ষা পাবে। সে-ই বুঝবে কত ধানে কত চাল।
সমস্যা হচ্ছে পৃথুর বাবা মানুষটা ভালো। শুধু ভালো না, বেশ ভালো। তারপরেও রাহেলা তাকে শিক্ষা দেবে। সে সুখে নেই, অন্যরা কেন সুখে থাকবে? তার গায়ে আগুন জ্বলছে, অন্যদের গায়ে কেন জ্বলবে না? অন্যদের গায়ে কেন ঠাণ্ডা বৃষ্টির ফোটা পড়বে?
রাহেলা খুব ঘামছে। সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার মন এখন খুবই ভালো, কিন্তু শরীর ভালো লাগছে না। রাহেলা এসে উঠেছে তার কলেজ জীবনের বান্ধবী শায়লার বাসায়। রাহেলা কলেজ পাশ করতে পারে নি, তার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। শায়লা ঠিকই কলেজ পাশ করেছে–মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হয়েছে। কোনো এক ক্লিনিকে ডাক্তারি করে। মাসে কুড়ি হাজার টাকা পায়। অথচ এই মেয়ে কলেজে হাবাগোবা ছিল। তাকে সবাই ডাকত হাবলি বেগম। হাবা থেকে বলি। সেই হাবলি মাসে কুড়ি হাজার টাকা পায়। স্বামী চাকরি করে। একটা মাত্র বাচ্চা। বাড়ি ভর্তি জিনিসপত্র। এর মধ্যে একটা হলো মাইক্রোওয়েভ ওভেন। বোতাম টিপলেই ঠাণ্ডা খাবার গরম হয়ে যায়। হাবলিটা কত সুখে আছে, আর তার কী অবস্থা!
রাহেলা সোফায় বসে হাঁপাচ্ছে। শায়লী বলল, তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?
রাহেলা না-সূচক মাথা নাড়ল।
শায়লা বলল, কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
পৃথুর বাবার সঙ্গে।
কঠিন রাগারাগি চলছে?
রাহেলা বলল, হ্যাঁ।
শায়লা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রাগরাগি ইওয়া ভালো। যত বেশি রাগারাগি হবে তাদের ভেতরের বন্ধন তত শক্ত হবে।
এটা কি তোর ডাক্তারি কথা?
ডাক্তারি কথা না, এটা আমার মনের কথা। আমি যখনই কোনো স্বামী-স্ত্রীকে ঝগড়া করতে দেখি আমার হিংসা হয়। ভালোবাসা আছে বলেই ঝগড়া হচ্ছে। আমার অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের কখনোই কোনো রাগারাগি হয় না। সে সারাদিন তার মতো অফিস করে। আমি ক্লিনিকে থাকি। রাতে এক সঙ্গে ডিনার খাই। টুকটাক গল্প করি। কিছুক্ষণ টিভি দেখে দুজনে দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে যাই। আবার সকালবেলা দুজন দুদিকে চলে যাই। তোদের ঝগড়া কী নিয়ে হয়?
সবকিছু নিয়েই হয়।
শায়লা মুগ্ধ গলায় বলল, কী রোমান্টিক! তুই রাগ করে বাসা থেকে চলে এসেছিস মিথ্যা করে বললি তুই আছিস কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেই বেচারা তোকে স্টেশনে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভাবতেই ভালো লাগছে। তুই চা-কফি কিছু খাবি?
রাহেলা বলল, না। আমি বাসায় যাব।
শায়লা অবাক হয়ে বলল, এখন বাসায় যাবি মানে কী? রাত একটা বাজে।
বাজুক রাত একটা। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। আমার শরীর খারাপ লাগছে। বুক ধড়ফড় করছে।
এত রাতে বাসায় যাবি কীভাবে?
তুই তো গাড়ি চালাতে পারিস। তুই আমাকে গাড়ি করে নামিয়ে দিবি। আর তা যদি না পারিস- দারোয়ান পাঠিয়ে রিকশা বা বেবিটেক্সি কিছু একটা এনে দে। আমি একা চলে যাব।
একী চলে যাবি?
হুঁ।
শায়লা বলল, তোর তো মাথা খারাপ। কোনো ভালো সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে তোর চিকিৎসা করানো উচিত।
রাহেলা বলল, চিকিৎসা করবি। এই মুহূর্তে তো আর চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। এখন আমি বাসায় যাব।
রাহেলা সোফা থেকে উঠে দাড়াল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে একাই দরজা খুলে বের হয়ে যাবে। শায়লা বিরক্ত গলায় বলল, দাড়া গাড়ি বের করছি। তোকে আমার দোহাই লাগে, আবার যদি তোদের মধ্যে রাগারাগি হয় আমাদের বাসায় আসবি না।
রাত দুটা বাজে।
হাসপাতালের বারান্দার রেলিং-এ হেলান দিয়ে জয়নাল দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে সিগারেট। হাসপাতালে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। রাত বারটার পর সব নিষেধই খানিকটা দুর্বল হয়ে যায় এই ভরসায় জয়নাল সিগারেট ধরিয়েছে। সাধারণত খালি পেটে সিগারেটে টান দিলে গা গুলায়। আজ গা গুলাচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে। ঠাণ্ডা বাতাস ছেড়েছে। বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। একটা পাটি থাকলে মেঝেতে পার্টি পেতে ঘুমিয়ে পড়ত।
জয়নালের মন অস্বাভাবিক ভালো। শামসুদ্দিন সাহেব এখন চোখ মেলে তাকাচ্ছেন। কথাবার্তা বলছেন। তাঁর প্রেসার নেমে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ডাক্তার বলছেন, ভয়ের কিছু নেই। রোগীর যা দরকার তা হলো–রেস্ট। হাসপাতালেও রোগী রাখার দরকার নেই। সকালবেলা বাড়িতে নিয়ে গেলেই হবে। জয়নাল ঠিক করেছে রাতটা হাসপাতালের বারান্দায় পার করে দিয়ে ভোরবেলা রোগী রিলিজ করে বাসায় ফিরবে। সার্বক্ষণিকভাবে সে নিজেই রোগী দেখবে। ইতি তো আছেই। যতই দিন যাচ্ছে ইতি মেয়েটাকে তুরি ততই পছন্দ হচ্ছে। এক সময় তার ধারণা ছিল ইতি চ্যাং ব্যাঙ টাইপ মেয়ে। এখন সে ধারণা পাল্টে গেছে। চ্যাং ব্যাঙ টাইপ মেয়ে অপরিচিত একজন অসুস্থ মানুষ নিয়ে এত ঝামেলা করে না। ইতি করেছে। এখন সে গিয়েছে চায়ের খোঁজে। রাত দুটার সময় চা পাওয়ার কথা না। তবে ইতি যেমন স্মার্ট মেয়ে ব্যবস্থা করবেই।
করিডোরের মাথায় ইতিকে দেখা গেল। তার হাতে লাল রঙের ছোট্ট ফ্লাস্ক? আরেক হাতে কাগজের ঠোঙ্গা। নিশ্চয়ই খাবারদাবার আছে। জয়নালের মন সামান্য খারাপ হয়ে গেল। নাশতা খেয়ে চা খাবার পর একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করবে। জয়নালের সঙ্গে সিগারেট নেই। শেষ সিগারেটটা সে একটু আগে শেষ করেছে।
ইতি প্যাকেট ভর্তি গরম সিঙাড়া এনেছে, কল এনেছে। এক রোগীর কাছ থেকে ফ্লাস্ক ধার করে ফ্লাস্ক ভর্তি চা এনেছে। ছোট্ট কাগজের পকেটে দুটা মিষ্টি পান। তারচেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা হলো–ইতি এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এবং একটা দেয়াশলাইও এনেছে। জয়নাল সিঙাড়ায় কামড় দিতে দিতে স্বাভাবিক গলায় বলল, সিগারেট কী মনে করে এনেছ? ইতি বলল, টেনশনে পড়ে তুমি যে হারে সিগারেট টানছু আমার ধারণা তোমার সিগারেট শেষ। চায়ের সঙ্গে তুমি আরাম করে সিগারেট খাও। যদি সিগারেট না থাকে এই ভেবে কিনেছি।
জয়নাল ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে বলল, আগামী দশ বছরে তুমি যে সব অপরাধ করবে তার প্রতিটি আমি অ্যাডভান্স ক্ষমা করে দিলাম।
ইতি হাসতে হাসতে বলল–তুমি মহান, তুমি একুশে ফেব্রুয়ারি।
জয়নাল বলল, চাচাজির লেটেস্ট খবর কিছু জানো?
ইতি বলল, জানি। উনি ভালো আছেন। আরাম করে ঘুমোচ্ছেন। উনার বোন এসেছেন। তিনি ভাইয়ের হাত ধরে বসে আছেন। বসার ভঙ্গিটা একবার আড়াল থেকে দেখে আসি। দেখলে ভালো লাগবে।
ভালো লাগবে কেন?
ইতি মুগ্ধ গলায় বলল, ভাইয়ের হাত ধরে উনি এমন কঠিন ভঙ্গিতে বসে আছেন যে দেখলেই মনে হবে–তার ভাইকে তার হাত থেকে নিয়ে যাবার ক্ষমতা কারো নেই। আজরাইলেরও নেই। আজরাইলকেও দরজার বাইরে থমকে দাড়াতে হবে।
জয়নাল আগ্রহের সঙ্গে বলল, চল তো দেখে আসি।
কিছুক্ষণ আগেই শামসুদ্দিন সাহেবের ঘুম ভেঙেছে। তিনি অবাক হয়ে রাহেলার দিকে তাকাচ্ছেন। একটু আগে ইতি যে চেয়ারটায় বসে ছিল এখন সেখানে অন্য একজন বসে আছে। যে বসে আছে সে দেখতে রাহেলার মতো, কিন্তু রাহেলা না। শামসুদ্দিন বললেন, কে?
মেয়েটা তার কাছে ঝুঁকে এসে বলল, ভাইজান আমি রাহেলা।
তোর রাগ কমেছে?
রাহেলা বলল, হ্যাঁ কমেছে।
রফিক কোথায়?
ও পৃথুকে নিয়ে বাইরে বারান্দায় বসে আছে। ডাকব?
ডাকতে হবে না। তোরা খামাখা কষ্ট করিস না তো। বাসায় গিয়ে আরাম করে ঘুমো। আমি ভালো আছি। সকালে আমাকে রিলিজ করে দেবে।
রাহেলা বলল, ভাইজান, তুমি মোটেও ভালো নেই। এই যে আমি তোমার বিছানার পাশের চেয়ারে বসেছি–তুমি পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি চেয়ার থেকে উঠব না।
শামসুদ্দিন হেসে ফেললেন। রাহেলা বলল, ভাইজান, হেসো না। আমি কোনো হাসির কথা বলি নি।
শামসুদ্দিন বললেন, আচ্ছা যা, হাসব না।
রাহেলা চাপা গলায় বলল, তুমি আরাম করে ঘুমাও ভাইজান। তুমি আরাম করে ঘুমাও। আমি তোমার পাশ থেকে এক সেকেন্ডের জন্যেও নড়ব না।
শামসুদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন।
হাসপাতালের বারান্দায় একটা বেঞ্চে পৃথু শুয়ে আছে। পৃথুর মাথা তার বাবার কোলে। যদিও বাবা হাত দিয়ে তাকে ধরে আছেন তারপরেও পৃথুর মনে হচ্ছে সে গড়িয়ে পড়ে যাবে। পৃথুর ঘুম আসছে না। তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। বাবা বলেছিল হোটেল থেকে খাবার আনবে, শেষ পর্যন্ত আনে নি। বাসায় একটার পর একটা সমস্যা। বাবা ভুলে গেছে। এখন তাকে খাবারের কথা বলতে তার লজ্জা লাগছে।
বাবা!
কী রে ব্যাটা?
মা সবচে বেশি কাকে পছন্দ করে বাবা? তোমাকে, আমাকে, না বড় মামাকে?
তোর বড় মামাকে।
তারপর?
তারপর তোকে।
আমি সেকেন্ড, তাই না বাবা?
হ্যাঁ।
আমার ফাস্ট হতে ইচ্ছা করে বাবা।
ইচ্ছা করলেই ফাস্ট হওয়া যায় না। ফাস্ট হওয়া খুবই কঠিনরে ব্যাটা। আর কথা বলিস না, ঘুমো।
পৃথু ঘুমুতে চেষ্টা করছে। রফিক তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।