০৯. আক্রমণ (১৯৭৪-৭৯)

৯. আক্রমণ (১৯৭৪-৭৯)

মৌলবাদী আক্রমণ বহু সেক্যুলারিস্টকে হতচকিত করে দিয়েছিল। তারা ধরে নিয়েছিল ধর্ম আর কোনও দিনই রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারবে না, কিন্তু ১৯৭০-র দশকের শেষের দিকে ধর্মবিশ্বাসের এক উগ্র বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৭৮-৭৯ সালে সারা বিশ্ব মহাবিস্ময়ের সাথে লক্ষ করে, এক অজ্ঞাত ইরানি আয়াতোল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচিত শাহ মুহাম্মদ রেযা পাহলভীর রাজত্বের পতন ঘটিয়েছেন। একই সময়ে বিভিন্ন সরকার যখন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের শান্তি প্রয়াস, ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন ও পাশ্চাত্যের প্রতি শান্তি প্রস্তাবের তারিফ করছিল, তখন পর্যবেক্ষকরা তরুণ মিশরিয়দের ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়া লক্ষ করেছিলেন। আধুনিকতার স্বাধীনতাকে এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে ইসলামি পোশাক পরছিল তারা, অনেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আগ্রাসীভাবে অধিকার করে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেরি ফলওয়েল ১৯৭৯ সালে প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীদের রাজনীতিতে অংশ নিয়ে ‘সেক্যুলার মানবতাবাদী’ এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে আসা রাষ্ট্র ও ফেডারেল আইনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মরাল মেজরিটি প্রতিষ্ঠা করেন।

ধর্মের এই আকস্মিক বিস্ফোরণ সেক্যুলারিস্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে হতবুদ্ধিকর ও বিকৃত মনে হয়েছে। দারুণ কার্যকর প্রমাণিত আধুনিকতার অন্যতম আদর্শকে আলিঙ্গন করার বদলে এই রেডিক্যাল ঐতিহ্যবাদীরা বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ডিসকোর্সে অচেনা ঐশীগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে ও প্রাচীন বিধান ও নীতির উল্লেখ করেছে। ওদের প্রাথমিক সাফল্য ব্যাখ্যার অতীত মনে হয়েছে; আধুনিক রাষ্ট্রকে এই নীতিমালার আলোকে পরিচালনা করা (নিশ্চিতভাবেই?) অসম্ভব ছিল? মৌলবাদীদের অতীতে অ্যাটাভিস্টিক প্রত্যাবর্তনকারী মনে হয়েছে। তাছাড়া, এইসব নীতিমালার অনুপ্রাণিত উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সমর্থন ছিল রীতিমতো আক্রমণের শামিল। যেসব আমেরিকান ও ইউরোপিয় ধর্মের দিন ফুরিয়ে গেছে ভেবেছিল, এবার তারা কেবল এটাই লক্ষ করতে বাধ্য হলো না যে প্রাচীন ধর্ম এখনও আবেগঘন আনুগত্যই অনুপ্রাণিত করছে না, বরং লক্ষ লক্ষ নিবেদিত ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিম তাদের এত গর্বের ধন সেক্যুলার, উদার সংস্কৃতিকে ঘৃণা করছে।

আসলে, আমরা যেমন দেখেছি, মৌলবাদী পুনর্জাগরণ আকস্মিক বা বিস্ময়কর কোনওটাই ছিল না। দশকের পর দশক বিভিন্ন কারণে অবহেলিত, নিপীড়িত এবং এমনকি সেক্যুলার সরকারের হাতে অত্যাচরিত অধিকতর রক্ষণশীল ধার্মিক লোকজন অসন্তোষে জ্বলছিল। অনেকেই নিজস্ব খাঁটি ধর্মের একটা পবিত্র সংরক্ষিত অঞ্চল নির্মাণের জন্যে আধুনিক সমাজ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ওদের ধ্বংস করার লক্ষ্যে অঙ্গীকারাবদ্ধ সরকারের হাতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার নিশ্চয়তা থেকে নিজেদের তারা যুদ্ধে লিপ্ত ও আত্মরক্ষায় নিয়োজিত ভেবেছে। বেঁচে থাকার সংগ্রামে বিশ্বাসীদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মতাদর্শ গড়ে তুলেছে। ধর্মের প্রতি নিস্পৃহ বা বৈরী বিভিন্ন সামাজিক শক্তিতে ঘেরাও হয়ে এক ধরনের অবরোধের মানসিকতা গড়ে তুলেছিল তারা যা অনায়াসেই আগ্রাসনের দিকে বাঁক নিতে পারে। ১৯৭০-র দশকের মাঝামাঝি সময় উপযুক্ত হয়ে উঠেছিল। ওদের শক্তি সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছিল সবাই, বিশ্বাস করেছিল যে সংকট অত্যাসন্ন, ইতিহাসের এক অনন্য মুহূর্তের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে তারা। পৃথিবী তাদের বদলে দেওয়ার আগেই উল্টে পৃথিবীটাকেই পাল্টে দিতে প্রস্তুত ছিল সবাই। তাদের চোখে ইতিহাস এক মারাত্মক বাঁক নিয়েছিল; সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এখন এমন সমাজে বাস করছে তারা যেখানে ঈশ্বরকে হয় প্রান্তিকায়িত বা সম্পূর্ণ নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীকে ফের পবিত্র করে তুলতে তৈরি ছিল তারা। সেক্যুলারিস্টদের অবশ্যই মানুষকে সবকিছুর পরিমাপকে পরিণত করা গর্বিত স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিসর্জন দিতে হবে, এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিতে হবে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেক্যুলারিস্ট পর্যবেক্ষকগণ এই ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সজাগ ছিলেন না। বিভিন্ন সমাজ এতখানি মেরুকৃত হয়ে পড়েছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীরা বা ইরানের মতো দেশগুলোর পাশ্চাত্যকৃত সেক্যুলারিস্টরা বছরের পর বছর বিকাশ লাভ করে চলা ধর্মীয় প্রতি-সংস্কৃতিকে খাট করে দেখতে প্ররোচিত হয়েছে। এই আগ্রসী ধার্মিকতাকে প্রাচীন বিশ্বের বিষয় ভেবে ভুল করেছে তারা; এগুলো ছিল ধর্মের আধুনিক ধরন, যেগুলো প্রায়শঃই শত শত বছরের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত দারুণভাবে উদ্ভাবনী ধরনের ছিল। তিনটি ধর্মের সকল মৌলবাদী আধুনিকতা প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি একই সময়ে আধুনিক ধারণা ও উদ্দীপনায়ও প্রভাবিত হয়েছে। তবে অনেক কিছু শেখার ছিল তাদের। প্রথম দিকের আক্রমণগুলো মৌলবাদী কালের স্বর্ণ সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু, পরের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, আধুনিক রাজনীতির বহুত্ববাদী, যৌক্তিক ও বাস্তববাদী বিশ্বে যোগদানের পর ধর্মীয়ভাবে অনুপ্রাণিত আন্দোলনের পক্ষে এর অখণ্ডতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিপ্লবই আরেক স্বৈরাচারে পরিণত হতে পারে; একটি সমন্বিত, হলিস্টিক রাষ্ট্র অর্জন করার লক্ষ্যে আধুনিকতার বিচ্ছিন্নতাকে বাতিল করার জন্যে পরিচালিত লড়াই সামগ্রিকতাবাদী হয়ে দাঁড়াতে পারে; মৌলবাদীদের অতীন্দ্রিয়বাদী, মেসিয়ানিক বা পৌরাণিক দর্শনকে রাজনৈতিক লোগোইতে পরিণত করা বিপজ্জনক। কিন্তু প্ৰথমে মৌলবাদীরা মনে করে, তাদের সহ্য করে আসা বহু দশকের অপমান ও নিপীড়নের পর তারা সত্যিই আবার ঈশ্বরের পক্ষে পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করতে যাচ্ছে।

ইরানি বিপ্লব ছিল মৌলবাদীদের সম্ভাবনা সম্পর্কে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণকারী প্রথম ঘটনা, তবে এটাই বিশ্ব রাজনীতিতে সফল উদ্যোগ পরিচালনাকারী প্রথম আন্দোলন ছিল না। আমরা দেখেছি, ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুরের যুদ্ধের পর কুকবাদীরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, ইহুদি জাতি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। যুদ্ধ ছিল একটা সতর্কবাণী; নিষ্কৃতি অত্যাসন্ন, কিন্তু সরকার মেসিয়ানিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার মতো কোনও নীতি অনুসরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকলে তাদেরই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কিছুটা বিস্ময়ের সাথেই সেক্যুলারিস্ট মিত্র পেয়ে যায় তারা, কুকের আদর্শে বিশ্বাস না করলেও যারা অধিকৃত এলাকা দখলে রাখার ব্যাপারে সমানভাবে নাছোড় ছিল। কুকবাদী বা ধার্মিক ইহুদি নয় এমন সব লোকজনও, যেমন সেনাবাহিনী প্রধান রাফায়েল এইতান বা পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও উগ্রজাতীয়তাবাদী য়ুভাল নে’ইমান ইসরায়েলের পক্ষে অধিকৃত অঞ্চলসমূহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ধার্মিক যায়নিস্টদের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইডিএফ-এ কাজ করা ও ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধ অংশ নেওয়া র‍্যাবাই, যুদ্ধবাদী তরুণ সেক্যুলারিস্ট, কুকবাদী ও অন্যান্য ধার্মিক যায়নবাদী গোষ্ঠী একটা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে, যার নাম তারা রেখেছিল গাশ এমুনিম, ‘বিশ্বাসীদের দল’।

এর অল্প পরেই নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে একটি পজিশন পেপার উপস্থাপিত করে তারা। গাশ রাজনৈতিক দল হবে না, নেসেটে আসন লাভের জন্যে প্রতিযোগিতা করবে না তারা, বরং এটা হবে একটা প্রেশার গ্রুপ, ‘যায়নবাদী লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইহুদি জাতির মাঝে মহাজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাবে, তাদের উপলব্ধি ছিল এই দর্শনের উৎস ইসায়েলের ইহুদি ঐতিহ্যে, এবং ইসরায়েল ও গোটা বিশ্বের নিষ্কৃতিই এর উদ্দেশ্য। প্রথমদিকের যায়নবাদীরা যেখানে ধর্মকে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, গাশ সেখানে তাদের আন্দোলনকে ইহুদিবাদে প্রোথিত করছিল। গাশের সেক্যুলার সদস্যরা যেখানে ‘নিষ্কৃতি’ শব্দটিকে অধিকতর শিথিল, অনেক বেশি রাজনৈতিক অর্থে ব্যাখ্যা করতে পারত, র‍্যাবাই কুকের হলিস্টিক দর্শন মেনে নেওয়া ধার্মিক অ্যাক্টিভিস্টদের বিশ্বাস ছিল যে মেসিয়ানিক নিষ্কৃতি ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, ইহুদি জাতি গোটা এরেত্য ইসরায়েলে বসবাস না করা পর্যন্ত বাকি বিশ্বে শান্তির কোনও অবকাশ নেই।

শুরু থেকেই গাশ এমুনিম সেক্যুলার ইসরায়েলের প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল। পজিশন পেপারে প্রাচীন যায়নবাদের ব্যর্থতার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। ইহুদিরা তাদের ভূমি রক্ষার লক্ষ্যে এক ভয়ঙ্কর সংঘাতে জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও,

আমরা পতন ও যায়নবাদী আদর্শ বাস্তবায়নের পথ থেকে কাজে ও কর্মে পশ্চাদপসরণের একটি প্রক্রিয়া লক্ষ করছি। এই সংকটের জন্যে চারটি সম্পর্কিত উপাদান দায়ী: প্রলম্বিত সংঘাতের ফলে সৃষ্ট মানসিক ক্লান্তি ও হতাশা; চ্যালেঞ্জের অভাব; স্বার্থপর উদ্দেশ্যের প্রতি অগ্রাধিকার ও ইহুদি বিশ্বাসের ক্ষয়।২

শেষের কারণটিই—ধর্মের দুর্বলতা-গাশের ধার্মিক সদস্যদের চোখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইহুদিবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন যায়নবাদের কোনও অর্থ থাকতে পারে না বলে বিশ্বাস ছিল তাদের। একই সময়ে কুকবাদীরা আরবদের কাছ থেকে দখলিকৃত এলাকা জয় করে নিতে চেয়েছিল, সেক্যুলার ইসরায়েলের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে লিপ্ত ছিল তারা। বাইবেলের ভাষায় তারা প্রাচীন সমাজতন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্স প্রতিস্থাপনও করতে চেয়েছিল। শ্রমিক যায়নবাদীরা যেখানে ইহুদি জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক ও ইহুদিদের ‘অন্যসব জাতির মতো’ করতে চেয়েছে, গাশ এমুনি ইসরায়েল জাতির ‘অনন্যতার’ উপর জোর দিয়েছে;৺ ইহুদিদের যেহেতু ঈশ্বর মনোনীত করেছেন, সুতরাং তারা অন্য জাতি থেকে আবিশ্যিকভাবেই ভিন্ন, একই নিয়মের অধীন নয়। বাইবেল এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে ‘পবিত্র’ জাতি হিসাবে ইসরায়েলকে এর নিজস্ব ধরনে আলাদা করা হয়েছে। শ্রমিক যায়নবাদ যেখানে আধুনিক পশ্চিমের উদার মানবতাবাদকে আত্মস্থ করতে চেয়েছে, গাশ এমুনিম সেখানে বিশ্বাস করেছে ইহুদিবাদ ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি পরস্পর বিরোধী। সুতরাং, কুকবাদীদের ক্ষেত্রে সেক্যুলার যায়নবাদের সফল হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না।৫ তাদের কাজ ছিল ধর্মের পক্ষে যায়নবাদকে অধিকার করে নেওয়া, অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে সংশোধন করা ও ইতিহাসকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা।

ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের প্রায় বিপর্যয় দেখিয়ে দিয়েছে যে সেক্যুলার যায়নবাদের ‘মিথ্যা’ নীতিমালায় রুদ্ধ হয়ে যাওয়া নিস্তার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্যে অবিলম্বে কাজ শুরু করা জরুরি। সম্পূর্ণভাবে সংগঠিত হতে গাশ এমুনিমের এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সদস্যদের তা এক পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার যোগান দিতে সক্ষম হয়। গাশ কায়দার পোশাক, সঙ্গীত, সজ্জা, গ্রন্থ ও বাচ্চাদের নামের পছন্দ, এমনকি কথা বলার বিশেষ ধরনের কায়দা থাকবে। বছর পরিক্রমায় গাশ সদস্যদের সময় পরীক্ষিত মৌলবাদী কৌশলে সেক্যুলার ইসরায়েল থেকে প্রত্যাহৃত হতে সক্ষম করে তোলা একটি প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। অবশ্য গাশের ধার্মিক সদস্যদের ধার্মিকতা ও তোরাহ পালন জাহির করার কায়দায় কিছুটা আগ্রাসন ছিল। রাষ্ট্রের প্রথম দিকের বছরগুলোয় সেক্যুলার ইসরায়েলিরা প্রথাগত কিস্তি টুপি মাথায় দেওয়া ইহুদিদের নিয়ে পরিহাস করত; এখন এইসব ধার্মিক অ্যক্টিভিস্টরা রেডিক্যাল ধর্মীয় শৈলীতে পরিণত হওয়া হাতে বোনা কিপা পরতে শুরু করেছিল।’ গাশের ক্যাডাররা নিজেদের শ্রমিকবাদীদের তুলনায় ঢের বেশি ইহুদি ও যায়নবাদী মনে করেছে, নিজেদের তারা প্রাচীন কালের পবিত্র যোদ্ধা জোশুয়া, ডেভিড ও ম্যাকাবিদের সাথেই নয় বরং একই ধরনের অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনের অন্তর্ভুক্ত এবং নিজেদের কালে উন্মাদ বিবেচিত থিওদর হার্যেল, বেন গুরিয়নের মতো যায়নবাদী নায়ক ও গোড়ার দিকের অগ্রগামীদের সাথেও সম্পর্কিত করেছে।

গাশের সেক্যুলার ও ধার্মিক সদস্যরা তাদের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার কাজে ব্যস্ত থাকার সময়ই কুকবাদীদের একটা দল প্রবীন বসতি স্থাপনকারী মোশে লেভিংগারের সহায়তায় পশ্চিম তীরের আরব শহর নাবলুসের এক রেলওয়ে ডিপোয় একটি গারিন (ক্ষুদ্র বসতির জন্যে একটি ‘বীজ’ বা নিউক্লিয়াস) স্থাপনের প্রয়াস পায়। ইহুদিদের জন্যে পবিত্র এলাকা ছিল এটা: নাবলুস জ্যাকব ও জোশুয়া সাথে সম্পর্কিত বাইবেলিয় শহর শেচেমের স্থান দখল করে আছে। বসতি স্থাপনকারীরা তাদের দৃষ্টিতে প্যালেস্তাইনিদের হাতে অপবিত্র ভূমিকে আবার পবিত্র করার প্রয়াস পাচ্ছিল। এই বসতির নাম দিয়েছিল তারা এলোন মোরেহ, শহরের অন্যান্য বাইবেলিয় নামের একটা, এবং রেলওয়ে ডিপোটিকে পবিত্র টেক্সট পাঠের লক্ষ্যে ইয়েশিভা হিসাবে চালানোর চেষ্টা করেছে। গাশ এমুনিমে যোগ দিতেও রাজি হয় তারা। গারিন অবৈধ বলে সরকার বসতি উচ্ছেদের চেষ্টা করে, কিন্তু ইহুদিরা অন্য লোকদের আইন পালন করতে বাধ্য নয় বলে অধিকৃত এলাকা থেকে ইসরায়েলের প্রত্যাহারের দাবি করে দেওয়া জাতি সংঘের ঘোষণা মেনে নেওয়ার কোনও প্রয়োজনই বোধ করেনি গাশ। ইসরায়েলে উল্লেখযোগ্য সমর্থন লাভ করে বসতি স্থাপনকারীরা, অন্যদিকে সরকারকে অক্ষম ও দ্বিধান্বিত দেখায়। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে মোশে লেভিংগার পশ্চিম তীরে বিশ হাজার ইহুদির মিছিলে নেতৃত্ব দেন। এলোন মোরেহর নিজের তাঁবু থেকে, নিজের ‘ওয়ার সিচুয়েশন রুম’ বলতেন তিনি ওটাকে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শিমন পেরেসের সাথে দরকষাকষি করেন। আইডিএফ সৈনিকদের সাথে একটা সংঘর্ষ ঘটে: কোনওরকম গুলি বর্ষিত হয়নি, তবে পাথর ছোঁড়া হয়েছে, বন্দুকের বাট ব্যবহার করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টারে চেপে হাজির হন পেরেস, তাঁবুতে লেভিংগারের সাথে আলাপ করেন, এই সভার পর ঝড়ের বেগে বের হয়ে আসেন র‍্যাবাই, শোকের প্রথাগত ভঙ্গিতে পরনের পোশাক ছিঁড়ে ফেলেন। নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় ধর্মীয় ভোট খোয়ানোর ভয় থেকে শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করে নেন পেরেস। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কাছের এক সেনা শিবিরে এলোন মোরেহ বসতি স্থাপনকারীদের তিরিশ জনকে স্থান দিতে সম্মত হন তিনি। লেভিংগারকে কাঁধে নিয়ে উল্লাসমুখর তরুণরা মিছিল করে। কৃশ, টোকো, ঝুলন্ত দাড়ি, পুরু চশমা ও স্থায়ীভাবে কাঁধে বন্দুক ঝোলানো ভদ্রলোক লেভিংগার এক নতুন ধরনের ইহুদি বীরে পরিণত হন। অনেকের চোখেই বসতি স্থাপনকারী তোরাহ বিশেষজ্ঞ যাদ্দিক ও হাসিদের পাশে স্থান করে নিতে যাচ্ছিলেন তিনি। সেক্যুলারিস্টদেরও সমর্থন লাভ করেন তিনি। ‘লেভিংগার যায়নবাদের প্রত্যাবর্তনকে প্রতীকায়িত করেছেন, ‘ বলেছে প্রবীন ও আত্মস্বীকৃত সন্ত্রাসী গেউলা কোহেন। ‘জুদাহ আর সামারায় [পশ্চিম তীরের বাইবেলিয় নাম] মোমের শিখার মতো দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তিনিই যায়নবাদী বিপ্লবের নেতা।৯

শেষ পর্যন্ত ১৬৪ বিসিইতে সেলুসিয়দের হাত থেকে ম্যাকাবিদের জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের বার্ষিকী ও মন্দিরের পুনঃনিবেদন উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হানুক্কাহর উৎসবের সময় এলোন মোরেহ, এখন তার নতুন নাম কেদামিন, প্রতিষ্ঠিত হয়। গাশ এমুনিমের মিথলজিতে গারিন পরিণত হয় নতুন হানুক্কাহয়, এক ঐশী সাফল্য, ঈশ্বরের বিজয়। এক গঠনমূলক মুহূর্ত ছিল এটা: স্রোত ঘুরে গেছে বলে মনে হয়েছে; সেক্যুলার যায়নবাদ ঐশী ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছে। ইতিহাসকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে এনেছেন লেভিংগার।

১৯৭৭-৭৮ সাল দুটি ছিল গাশ এমুনিমের স্বর্ণযুগ। সদস্যরা দেশময় ঘুরে বেড়িয়েছে, বক্তৃতা দিয়েছে, ওই অঞ্চলের বসতি করতে ইচ্ছুক সেক্যুলারিস্ট ও ধার্মিক দুরকম তরুণদেরই দলে টেনেছে। সারা দেশে গাশের শাখা খোলা হয়। গোটা পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে ক্যাডাররা একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে: লক্ষ্য ছিল হাজার হাজার ইহুদিকে এলাকায় আনা ও সব কৌশলগত পাহাড়ী ঘাঁটিতে উপনিবেশ তৈরি। এলাকার ভৌগলিক অবস্থান, জনমিতি ও বসতি স্থাপন বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করা হয়। পরিকল্পনা ও প্রচারণার জন্যে প্রশাসনিক সংস্থা স্থাপন করা হয়। এরই একটা ছিল বসতি প্রক্রিয়া সংগঠনের দায়িত্বে নিয়োজিত মেতে মিরতযাই।” প্রায়শঃই লেভিংগারের নেতৃত্বে স্কোয়ার্টাররা তাদের পুরোনো লক্করমার্কা ট্রেইলার নিয়ে রাতের অন্ধকারে জনশূন্য পশ্চিম তীরের কোনও পাহাড়চূড়ায় হাজির হত। সেনাবাহিনী তাদের উচ্ছেদ করতে হাজির হলে নেসেটে ডানপন্থী দলগুলো শ্রমিক দলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে ঠিক ব্রিটিশদের মতো আচরণের অভিযোগ তুলে বসত। চতুর কৌশল ছিল এটা। ইসরায়েলি সরকারকেই এবার নিপীড়কের ভূমিকায় স্থাপন করা হয়েছিল, গাশ বসতি স্থাপনকারীরাই যেন ইসরায়েলের বীরত্বব্যাঞ্জক অতীতকে ধারণ করেছিল।

অবশ্য, এই বছরগুলোতে গাশ মাত্র তিনটি বসতি স্থাপন করতে পেরেছিল। প্রধানমন্ত্রী ইত্যহাক রাবিন যুদ্ধোত্তর এই সময়ে মিশর ও সিরিয়ার সাথে বোঝাপড়ায় উদগ্রীব ছিলেন, ছোটখাট আঞ্চলিক ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি। গাশ ও ডানপন্থীদের অব্যাহত চাপ প্রতিহত করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রপাগান্ডা প্রয়াস অব্যাহত রাখে গাশ, গোটা পশ্চিম তীর জুড়ে বিশাল সব মিছিল ও পদযাত্রা আয়োজন করে। ১৯৭৫ সালে জনতা তোরাহ স্ক্রোল হাতে অধিকৃত এলাকায় গান গেয়ে, নেচে, হাত তালি দিয়ে মিছিল করে; সেক্যুলারিস্টদের সাথে যোগ দেয় ধার্মিক যায়নবাদীর। ১৯৭৬ সালের স্বাধীনতা দিবসে প্রায় বিশ হাজার সশস্ত্র ইহুদি পশ্চিম তীরে এক বনভোজনে যোগ দেয়, সামারিয়ার এক অংশ থেকে আরেক অংশে মিছিল করে।১১ প্রায়শঃই এমনভাবে এইসব জঙ্গী গণমিছিল ও বিক্ষোভগুলো আয়োজন করা হত যেন কোনও নতুন বসতি স্থাপন বা আরেকটি অবৈধ স্কেয়াটের সাথে মিলে যায়। এইসব কর্মকাণ্ড কোনও কোনও ইসরায়েলির মনে এই ধারণা জাগিয়ে দিয়েছিল যে, এইসব এলাকা আবিশ্যিকভাবেই ইহুদিদের, অধিকৃত এলাকায় বস্তি স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রচলিত সংস্কার ভেঙে ফেলতে সাহায্য করেছে।

গাশ ছিল বাস্তববাদী, চতুর ও বুদ্ধিমান। নাস্তিক ও সেকুলারিস্টদের প্রতি আবেদন সৃষ্টি করেছে, কিন্তু এর অর্থডক্স সদস্যদের জন্যে আবিশ্যিকভাবেই ধর্মীয় আন্দোলন ছিল এটা। র‍্যাবাই কুক হতে কাব্বালিস্টিক ধার্মিকতা লাভ করেছিল তারা। গাশের বিশ্বাস মতে ইহুদি ভূমিতে বসতি স্থাপন ছিল পবিত্রের আওতা বৃদ্ধি ও ‘অন্যপক্ষে’র সীমান্তকে দূরে ঠেলে দেওয়া। একটি বসতি ছিল ক্রিশ্চানদের ভাষায় অন্সুদীক্ষার মতো, অপবিত্র পৃথিবীতে নতুন ও আরও কার্যকরভাবে স্বর্গীয়কে উপস্থিতকারী সুপ্ত করুণার প্রতীক। ইসাক লুরিয়া যাকে বলেছেন তিক্কুন, পুনঃস্থাপনের একটি প্রক্রিয়া একদিন যা বিশ্ব ও মহাবিশ্বকে বদলে দেবে। গণমিছিল, মিছিল, সেনাবহিনীর সাথে যুদ্ধ ও অবৈধ বসতি স্থাপন ছিল পরমান্দ ও মুক্তির বোধ নিয়ে আসা এক ধরনের আচার। সেক্যুলার অগ্রগামী ও পণ্ডিতসুলভ হেরেদিমদের কাছে বহু বছরের হীনবোধের পর কুকবাদীরা সহসা নিজেদের সমস্ত ঘটনার কেন্দ্রে চলে এসে বলে মনে করেছে, এক মহাজাগতিক সংঘাতের সামনের কাতারে স্থান করে নিয়েছে। নিষ্কৃতির আগমন ত্বরান্বিত করে মহাবিশ্বের মৌল ছন্দের সাথে একাত্ম মনে করেছে নিজেদের। পর্যবেক্ষকরা উল্লেখ করেছেন, প্রার্থনার সময় সামনে-পেছনে দোল খেত তারা, শক্ত করে চোখ বুজে বিকৃত ও বেদনার্ত চেহারায় চিৎকার করে কাঁদত। এসবই কাব্বালিস্টের ভাষায় কাওয়ানাহ’রই চিহ্ন, বিশেষ কোনও নির্দেশনা পালনের সময় ইহুদিদের প্রতীকী ধরন ভেদ করে আচারের আবিশ্যিক তাৎপর্য অবলোকনে সক্ষম করে তোলা নিবিড় মনোসংযোগের প্রয়াস।১২ কাওয়ানাহর সাথে পরিচালিত কোনও কাজ উপাসককে কেবল ঈশ্বরের কাছাকাছিই নিয়ে যায় না, সেই সাথে স্বর্গ ও পার্থিব জগৎকে বিচ্ছিন্নকারী ভারসাম্যহীনতা সংশোধনেও সাহায্য করে। প্রার্থনার সময় গাশ অ্যক্টিভিস্টরা কেবল এই পরমানন্দই অনুভব করেনি; রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকেও তারা একইভাবে দেখেছে। নতুন বসতি স্থাপনের অনুষ্ঠানে র‍্যাবাই কুকের বয়ান ও কান্নার দৃশ্য ছিল ‘প্রত্যাদেশ’। ঠিক একইভাবে রামাল্লার কাছের পাহাড় থেকে সেনাবহিনী তাদের বিতাড়নের চেষ্টা করার সময় আর্তনাদ ছেড়ে প্রার্থনার চাদরে স্কোয়ার্টারদের নিজেদের ঢেকে পবিত্র ভূমি রক্তাক্ত নখে আঁকড়ে থাকার দৃশ্যও তাই।১৩ স্রেফ রাজনৈতিক মুহূর্ত ছিল না এগুলো। অ্যাক্টিভিস্টরা এইসব ঘটনাপ্রবাহের পার্থিব খোলস ভেদ করে বাস্তবতার উৎসমূলের স্বর্গীয় বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করার কথা বিশ্বাস করেছে।

এভাবে রাজনীতি পরিণত হয়েছিল উপাসনার (আভোদ) একটা কায়দায়। সিনাগগের উপাসনায় যোগ দেওয়ার আগে ইহুদি মিকভেহ-তে স্নান করে। ঠিক একইভাবে গাশ র‍্যাবাইরা ঘোষণা করেছিলেন: ‘যেন তা তোরাহর গোপন বিষয় অনুসন্ধানের মতো হওয়ায় রাজনীতির আবর্জনায় ডুব দেওয়ার আগে নিজেদের মিকভেহ-তে পবিত্র করে নিতে হবে।’১৪ উন্মোচক মন্তব্য ছিল এটা, কারণ তা গাশ ধার্মিকতার কেন্দ্রে দ্ব্যার্থবোধকতা প্রকাশ করেছে। রাজনীতি তোরাহর মতোই পবিত্র, কিন্তু-বহুদিন আগে প্রবীন কুক যেমন যুক্তি দেখিয়ে গেছেন—এটা আবর্জনাও। ১৯৬৭ সাল থেকে কুকবাদীরা প্রায়শঃই ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের ধাক্কাকে প্রবীন কুকের প্রিয় ইমেজ, ‘আলোর বিস্ফোরণ’ হিসাবে অনুভব করে এসেছে, কিন্তু রাজনৈতিক ব্যর্থতা, বিপর্যয় ও প্রতিবন্ধকতার অন্ধকারের ব্যাপারেও প্রবলভাবে সচেতন ছিল তারা। ইসরায়েলি বিজয়গুলোকে অলৌকিক ঘটনা বলে তারিফ করা হলেও সেগুলোকে আবার আধুনিক প্রযুক্তি ও সামরিক দক্ষতার হাতে আবির্ভূত বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে।

সুতরাং কুকবাদীরা আসলে সমানভাবে জাগতিক ও পবিত্রের ব্যাপারে সজাগ ছিল। ঈশ্বরের জন্যে তাদের আকাঙ্ক্ষা পার্থিব বাস্তবতার অস্বচ্ছতা ও অবাধ্য আপোসহীনতা দিয়ে ভারসাম্য পেয়েছিল। একারণেই তাদের প্রার্থনা ও অ্যক্টিভিজমের বাড়াবাড়ি ও যন্ত্রণা। জীবনের সামগ্রিকতাকে—এমনকি একেবারে অশুচি, গতানুগতিক ও বিকৃত অংশগুলোও-পবিত্রের আচ্ছাদনের নিচে নিয়ে আসাই ছিল তাদের মিশন। কিন্তু হাসিদিমরা যেখানে একাজে আনন্দ ও নতুন হালকা ভাব বোধ করেছে, গাশের পরমানন্দ প্রায়শঃই ক্রোধ ও অসন্তোষে পরিপূর্ণ ছিল। আধুনিক কালের নারী-পুরুষ ছিল তারা। ঈশ্বর ছিলেন আগের চেয়ে ঢের দূরে, লৌকিকতার চাপ সৃষ্টিকারী ও নাছোড় বাস্তবতাকে অতিক্রম করে যাওয়া ঢের বেশি কষ্টকর ছিল, এখন অনেকেই যাকে সবকিছু মনে করে। গাশ অ্যাক্টিভিস্টরা সেক্যুলার ইসরায়েল রাষ্ট্রে আরবদের কাছ থেকে ভুমি কেড়ে নেওয়ার প্রয়াসে ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতাকে জয় করেছিল। ইসরায়েলের সীমান্ত অতিক্রম করে বহুদিন আগে খোয়ানো ভুমিতে উপনিবেশ গড়ে নিজেদের উন্মুল করে মন স্থির করেছে তারা। এরেত্য ইসরায়েলে ‘প্রত্যাবর্তন’ বিভ্রান্তিকর বর্তমানের চেয়ে ঢের বেশি মৌলিক মূল্যবোধ ও মনের অবস্থা পুনরুদ্ধারের প্রয়াস ছিল।

ক্ষোভ ও রিকনকুয়েস্তার এই আধ্যাত্মিকতায় স্পষ্ট সমস্যা ছিল। ১৯৭৭ সালে ইসরায়েলের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো শ্রমিক দল সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়। ক্ষমতায় আসে মেনাচেম বেগিনের নেতৃত্বাধীন নতুন ডানপন্থী লিকুদ পার্টি। বেগিন বরাবরই জর্দান নদীর উভয় তীরে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলে এসেছেন, তো তাঁর নির্বাচিত হওয়াকে প্রথমে ঈশ্বরের আরেকটি কাজ মনে হয়েছিল। নির্বাচনের অল্পপরেই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সেটা, বেগিন অশীতিপর র‍্যাবাই কুকের সাথে মারকায হারাভে দেখা করতে গেলে তাঁর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নোয়ান তিনি। ‘মনে হচ্ছিল বুঝি শরীরের ভেতর আমার হৃৎপিণ্ড বিস্ফোরিত হচ্ছে,’ পরে স্মৃতিচারণ করেছেন এই ‘পরাবাস্তব দৃশ্যে উপস্থিত দানিয়েল বেন সিমন। ‘[কুকের] ফ্যান্টাসি ও কল্পনাগুলো আসলেই বাস্তব হওয়ার এরচেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে।’১৫ লেভিংগারের খোলামেলা ভক্ত ছিলেন বেগিন, গাশ এমুনিমকে ‘প্রিয় সন্তান’ বলতে ভালোবাসতেন, তাঁর যুদ্ধবাদী নীতি প্রচার করার সময় প্রায়শঃই বাইবেলিয় পরিভাষা ব্যবহার করতেন।

নির্বাচনের পর লিকুদ সরকার অধিকৃত এলাকাসমূহে এক ব্যাপক বসতি উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইসরায়েলের ভূমি কমিশনের নতুন প্রধান আরিয়েল শ্যারন বিশ বছরের মধ্যে পশ্চিম তীরে এক মিলিয়ন ইহুদির বসতি স্থাপনের ইচ্ছা ঘোষণা করেন। ১৯৮১ সালের মাঝামাঝি লিকুদ এইসব এলাকায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে বিশটি বসতি গড়ে তোলে, যেখানে প্রায় ১৮,৫০০ বসতি স্থাপনকারী বাস করে। ১৯৮৪ সালের আগস্ট নাগাদ সরকারীভাবে বসতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১১৩টি, এগুলোর ভেতর গোটা পশ্চিম তীর জুড়ে ছয়টি উল্লেখযোগ্য শহর ছিল। ৪৬,০০০ উগ্র বসতিস্থাপনকারীর হাতে ঘেরাও হয়ে আরবরা ভীত হয়ে ওঠে এবং কেউ কেউ সহিংসতার আশ্রয় নেয়।১৬ সরকারের সমর্থনপুষ্ট গাশ এমুনিমের পক্ষে এর চেয়ে জুৎসই রাজনৈতিক অবস্থা আর হতে পারে না। ১৯৭৮ সালে রাফায়েল এইতান পশ্চিম তীরের প্রতিটি বসতির নিরাপত্তার দায়িত্ব বসতিগুলোর হাতে তুলে দেন, সম্প্রদায়কে রক্ষা এবং রাস্তাঘাট ও ক্ষেত-খামার পাহারা দিতে শত শত বসতিস্থাপনকারীকে নিয়মিত সেনাবাহিনী থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছিল তাদের। ১৯৭৯ সালের মার্চে সরকার করারোপ, সরবরাহ সেবা ও শ্রমিক নিয়োগের ক্ষমতা দিয়ে পশ্চিম তীরে পাঁচটি আঞ্চলিক কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করে। পশ্চিম তীরের বসতিস্থাপনকারীদের মাত্র ২০ ভাগের যোগানদার থাকলেও গাশ সদস্যরাই সাধারণত মূল দায়িত্ব পেত।১৭ কার্যত সরকারী কর্মকর্তায় পরিণত হয়েছিল তারা, কিন্তু তা যতই বন্ধুসুলভ হোক না কেন, বহু বছরের সংঘাতের ফলে সরকারের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে উঠেছিল গাশ, লিকুদ পার্টির বিজয়ের পর সদস্যরা তাদের নিজস্ব বসতি কর্মকাণ্ড সংগঠিত ও ঐকবদ্ধ করার লক্ষ্যে আরমানা (‘কোভেন্যান্ট’) এবং তাদের কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়ার জন্যে গাশ বসতির কাউন্সিল মোয়েতযেত ইয়েশা প্রতিষ্ঠা করে।

সন্দিহান থাকা গাশের পক্ষে ঠিকই ছিল, কারণ লিকুদের সাথে মধুচন্দ্রমা ছিল সংক্ষিপ্ত। ২০শে নভেম্বর, ১৯৭৭, শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক জেরুজালেম সফর শুরু করেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত; পরের বছর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করেন বেগিন ও সাদাত। ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে দখল করে নেওয়া সিনাই পেনিনসুলা মিশরকে ফিরিয়ে দেবে, বিনিময়ে মিশর ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে ও সাধারণ সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। চুক্তি শান্তির জন্যে একটা ফ্রেমওয়ার্ক’, ইসরায়েল, মিশর, জর্দান ও ‘ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিদের’ মধ্যে পশ্চিম তীর ও গাযা স্ট্রিপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য শান্তি আলোচনার আশা প্রকাশ করেছে। উভয় পক্ষের ক্ষেত্রেই ক্যাম্প ডেভিড বাস্তব চুক্তি ছিল। মিশর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ফিরে পেয়েছে, শান্তি পেয়েছে ইসরায়েল। সিনাই পবিত্র ভূমি ছিল না; বাইবেলে বর্ণিত প্রতিশ্রুত ভূমির সীমানার অন্তর্ভুক্ত নয়। পশ্চিম তীর আরবদের কাছে ফিরিয়ে না দেওয়ার ব্যাপারে সব সময়ই অটল ছিলেন বেগিন; শান্তির ফ্রেমওয়ার্ক আলোচনা কোনওদিনই হবে না, নিশ্চিত ছিলেন তিনি, কারণ অন্য কোনও আরব রাষ্ট্র সেগুলো সমর্থন করবে না। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের দিন পশ্চিম তীরে বিশটি নতুন বসতি স্থাপন করার সরকারী সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন বেগিন।

এটা ধার্মিক যায়নবাদী, গাশ এমুনিম বা সাধারণভাবে ইসরায়েলি ডানপন্থীদের সন্তুষ্ট করেনি। ৮ই অক্টোবর, ১৯৭৯ র‍্যাবাই কুকের আশীর্বাদ নিয়ে ক্যাম্প ডেভিডের বিরুদ্ধে লড়াই ও আরও কোনও আঞ্চলিক ছাড় প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে নতুন তেহিয়া (‘রেনেইসাঁ) পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এযাত্রা ধার্মিক ও সেক্যুলার রেডিক্যালরা একই রাজনৈতিক দলে একসাথে কাজ করছিল। ১৯৮১ সালে কুকবাদী ও সাবেক গাহেলেত সদস্য হাইম দ্রুকমান পশ্চিম তীরে আরও বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে চাপ সৃষ্টি করতে নিজস্ব মোরাশা (‘ঐতিহ্য’) পার্টি গঠন করেন। গাশের চোখে ক্যাম্প ডেভিড মোটেই শান্তি ছিল না। তারা শালোম (‘শান্তি’) ও শ্লেমুত (‘সামগ্রিকতা’) শব্দ দুটির উৎপত্তিগত সম্পর্কের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে: সত্যিকারের শান্তির মানে আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের পূর্ণ ভুমির সংরক্ষণ। এখানে কোনও আপোস হতে পারে না। গাশ র‍্যাবাই এলিয়েযার ওয়াল্ডমান যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, ইসরায়েল, যার উপর গোটা পৃথিবীর নিয়তি নির্ভর করা অশুভের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লিপ্ত রয়েছে:

নিষ্কৃতি কেবল ইসরায়েলের নিষ্কৃতি নয়, বরং গোটা পৃথিবীর নিষ্কৃতি। কিন্তু ইসরায়েলের নিষ্কৃতির উপরই বিশ্বের নিষ্কৃতি নির্ভর করছে। এখান থেকেই সারা পৃথিবীর উপর আমাদের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সৃষ্টি। ইসরায়েলের গোটা ভূমিতে বাসকারী জনগণের কাছ থেকে মানবজাতির কাছে আবির্ভূত হবে আশীর্বাদ।১৮

কিন্তু বাস্তববাদী, সেক্যুলার ধারায় পরিচালিত বিশ্বে এই অতীন্দ্রিয়বাদী আজ্ঞা বাস্ত বায়ন অসম্ভব প্রতীয়মান হয়েছে। বেগিনের বাগাড়ম্বর যতই যুদ্ধংদেহী বা বাইবেলিয় হোক না কেন, রাজনীতির বাস্তব লোগোসের ভেতর মিথোসের হস্তক্ষেপের সুযোগ দানের কোনও ইচ্ছা তাঁর ছিল না। একেবারে গোড়া থেকেই দক্ষতা ও কার্যকারিতা ছিল আধুনিক চেতনার মূলকথা। বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক বিবেচেনা ও নীতিমালায় চরম নীতিমালাকে আশ্রয় দিতে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়োজন ছিল বেগিনের, শান্তি প্রক্রিয়া চেয়েছিল দেশটি।

আধুনিক রাজনৈতিক বিশ্বে ঈশ্বরের পক্ষে লড়তে চাওয়া মৌলবাদীদের জন্যে বরাবরই এটা বড় সমস্যা হয়ে থাকবে। এই বছরগুলোয় গাশ এমুনিম কিছু পরিমাণ সাফল্য লাভ করেছিল। ১৯৭৮ সালে সরবোন ও মারকায হারাভের ফরাসি স্নাতক শ্লোমো আবিনার পূর্ব জেরুজালেমের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় আতেরেত কোহানিম (‘ক্রাউন অভ প্রিস্ট’) ইয়েশিভা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে ইসলামি বিশ্বের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান ডোম অভ দ্য রকের অধিকৃত টেম্পল মাউন্টের কাছেই ছিল ইয়েশিভাটি। ইয়েশিভার লক্ষ্য ছিল মেসায়াহর আবির্ভাবের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ ও প্রাচীন স্থানে মন্দিরের পুনর্নির্মাণের লক্ষ্যে বাইবেলিয় মন্দিরের বিসর্জন ও প্রিস্টলি কাল্টের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন টেক্সট পাঠ করা। নতুন একটি মন্দির যেহেতু মুসলিম উপাসনালয়ের ধ্বংস বোঝাবে, খোদ ইয়েশিভার প্রতিষ্ঠাই ছিল উস্কানীমূলক, কিন্তু আতেরেত কোহানিম ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অগ্রাহ্য করে ইসরায়েলের অধিকার করে নেওয়া প্রাচীন জেরুজালেম শহরে একটি বসতি স্থাপন প্রক্রিয়ারও সূচনা করেছিল। ইয়েশিভা পুরোনো সিনাগগ নির্মাণ ও আরব জেরুজালেমে জোরাল ইহুদি উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করার জন্যে গোপনে মুসলিম মহল্লার আরব সম্পত্তি কিনতে শুরু করেছিল।১৯ ১৯৭৯ সালে গাশ এমুনিম নাবলুসের দক্ষিণ পুবের এলোন মোরেহর নতুন বসতি উচ্ছেদের জন্যে ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করলে এই বছরগুলোয় অর্জিত দ্বিতীয় সাফল্য দেখা দেয়। গাশ এমুনিম গৃহযুদ্ধ ও অনশন ধর্মঘটের হুমকি দেয়, শেষ পর্যন্ত ১৯৮০ সালের জানুয়ারির শেষে কেবিনেট বর্তমান বসতিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায় অনুসন্ধান ও সুপ্রিম কোর্টের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ভেতরে থেকেই নতুন বসতি স্থাপনের সুযোগ সন্ধানের জন্যে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। ১৫ই মে, সরকার পশ্চিম তীরে উনষাটটি নতুন বসতি স্থাপনের পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা ঘোষণা করে।২০

কিন্তু এইসব বিক্ষিপ্ত সাফল্য সত্ত্বেও গাশ এমুনিমের সোনালি দিনের অবসান ঘটেছিল। নতুন শান্তি ইসরায়েলি জনগণের কাছে জনপ্রিয় ছিল। ১৯৮২ সালে শোচণীয় পরাজয় বরণ করে গাশ। ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি পালনের উদ্দেশ্যে ইসরায়েল সিনাইয়ের উপকূলে শ্রমিক দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত সমৃদ্ধিশীল সেক্যুলার শহর ইয়ামিত বসতি থেকে জনগণকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যায়নবাদের ‘শান্তির ভাইরাসে’ আক্রান্ত হওয়ার ঘোষণা দেন মোশে লেভিংগার।২১ হাজার হাজার পশ্চিমতীরবাসীকে নেতৃত্ব দিয়ে ইয়ামিতে নিয়ে যান তিনি; পরিত্যক্ত বাড়িঘরে গিয়ে ওঠে তারা, তাদের উচ্ছেদ করার ব্যাপারে আইডিএফকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। বেপরোয়া পদক্ষেপ ছিল এটা। বসতি স্থাপনকারীদের রোমের (৬৬–৭২ সিই) বিরুদ্ধে ইহুদি বসতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন লেভিঙ্গার, এই সময় ৯৬০ নারী-পুরুষ ও শিশু রোমান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের বদলে মাসাদা দুর্গে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। গাশ র‍্যাবাইগণ ইসরায়েলের দুজন প্রধান র‍্যাবাইয়ের সাথে পরামর্শ করেন, এঁরা অবশ্য শাহাদৎ বরণের বিরুদ্ধে রায় দেন, এবং আরও একবার শোকে পোশাক ছেঁড়েন র‍্যাবাই লেভিংগার।২২ বসতিস্থাপনকারীদের উচ্ছেদ করতে আইডিএফ উপস্থিত হলেও ইহুদিদের কারও প্রাণহানি ঘটেনি, তবে শোডাউনের জন্যে প্রস্তুত ছিল গাশ; মুহূর্তের জন্যে ধার্মিক ও সেক্যুলার ইসরায়েল যুদ্ধক্ষেত্রের বিপরীত পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়েছিল।

ইয়ামিতের শেষ অবস্থান হয়তো ভীষণ সত্যিকে অস্বীকার করার কৌশল হয়ে থাকতে পারে। কুকবাদীদের এত আস্থার সাথে প্রত্যাশিত মহাজাগরণ ঘটেনি; হতে পারে নিষ্কৃতি আদৌ আসন্ন নয়? এমন ভীরু ভূমি ছাড়দানকারী একটি দেশ কীভাবে পবিত্র হতে পারে? গাশের ধার্মিক সদস্যরা তাদের আরও বেপরোয়া পদক্ষেপের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার এক মেসিয়ানিক প্রত্যাশার ‘মহা হতাশা’ বোধ করছিল। সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও গাশ বাস্তব জগতে ঈশ্বরের রাজনীতিকে কার্যকর করে তুলতে পারেনি। সিনাই থেকে প্রত্যাহারের অল্প আগে মারা যান র‍্যাবাই কুক, তাতে পরিত্যাগের অনুভূতি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। কুকের উত্তরাধিকারী হিসাবে একক কোনও ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেনি, আন্দোলনে ফাটল ধরে। কেউ কেউ ইসরায়েলের প্রকৃত চেতনার পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে ধৈর্য, প্রার্থনা ও শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিদানের পক্ষে কথা বলে। অন্যরা যুদ্ধের জন্যে তৈরি ছিল।

*

বেগিন একাই ক্যাম্প ডেভিড প্রশ্নে ধর্মীয় বিরোধিতার মোকাবিলা করছিলেন না। তাঁর মিশরিয় প্রতিপক্ষ আনোয়ার সাদাত নিজ দেশে মুসলিম বিরোধী পক্ষের সাথে আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন। সাদাতের শান্তি উদ্যোগ তাঁকে পশ্চিমে প্রিয়ভাজন ও জনপ্রিয় করে তুলেছিল, কিন্তু সমাজের বহু ক্ষেত্রেই শান্তি জনপ্রিয় হলেও মিশরিয়রা তাদের প্রেসিডেন্টের ব্যাপারে অনেক বেশি দোলাচলে ভুগছিল। ছয় দিনের যুদ্ধের বিপর্যয় সত্ত্বেও নাসেরকে জনগণ দারুণভাবে ভালোবাসত। সাদাত কখনওই সেই ধরনের ভক্তি অনুপ্রাণিত করতে পারেননি। তিনি সব সময়ই রাজনৈতিকভাবে তুচ্ছ বিবেচিত হয়েছেন, ১৯৭১ সালে প্রথমবারের ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি অভ্যুত্থান প্রয়াসকে ভণ্ডুল করতে হয়। ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের তুলনামূলক সাফল্য অবশ্য সেভাবে সাদাতের বৈধতাকে প্রতিষ্ঠা দেয়নি।২৩ যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করে এবং আরব আস্থা ফিরিয়ে এনে জনগণকে শান্তি প্রক্রিয়ার পথে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন তিনি, এই শন্তি মিশরকে সাহায্য করবে ও পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক মেরামত করবে বলে বিশ্বাস ছিল তাঁর।

১৯৬৭ সালের পরাজয়ের পর নাসের সমাজতন্ত্র থেকে কিছুটা পিছু হটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ধর্মীয় আবহও টের পেয়েছিলেন তিনি। মুসলিম ব্রাদাররা কারাগারে থাকলেও নাসের আবারও তাঁর ভাষণ ইসলামি বুলি দিয়ে সাজাতে শুরু করেছিলেন। সাদাতের অধীনে এই দুটো প্রবণতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে নাসের নিয়োজিত ১৫০০ সোভিয়েত উপদেষ্টাকে বরখাস্ত করেন তিনি এবং ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের পর মিশরকে পুঁজিবাদী বিশ্ব বাজারে নিয়ে আসার লক্ষ্যে একটি নতুন নীতিমালা ঘোষণা করেন। এই নতুন অর্থনৈতিক উদ্যোগের নাম দিয়েছিলেন তিনি ইনফিতাহ (খোলা দুয়ার’)।২৪ অবশ্য অর্থনীতিক ছিলেন না সাদাত, আর মিশরের অর্থনৈতিক সমস্যা সব সময়ই অ্যাচিলিসের গোড়ালি ছিল, ইনফিতাহর কারণে এর আরও অবনতি ঘটে। মিশরকে নিশ্চিতভাবেই উন্মুক্ত করে দিয়েছিল: বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক আমদানি পণ্য দেশে প্রবেশ করে। সুবিধাজনক কর ব্যবস্থার মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিনিয়োগকারীদের তোষামোদ করা হয়। ফলে মিশর সত্যিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে ওঠে। খোলা দুয়ার উদীয়মান স্বল্পসংখ্যক বুর্জোয়ার পক্ষেও লাভজনক ছিল, বিপুল অর্থের মালিক বনে গিয়েছিল মুষ্টিমেয় মিশরিয়। কিন্তু দুর্ভোগের শিকার হয়েছিল বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। অনিবার্যভাবে বিদেশী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি মিশরিয় ব্যবসা; দুর্নীতি ছিল, অভিজাত গোষ্ঠেীর বাড়াবাড়ি রকমের ভোগবাদ দারুণ বিতৃষ্ণা ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছিল। বিশেষ করে তরুণ সমাজ নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করেছে। এদের মাত্র চার শতাংশ শোভন কাজের প্রত্যাশা করতে পারত; বাকি অংশকে সামান্য সরকারী খাতের বেতনে বেঁচে থাকতে হচ্ছিল, বাড়তি সময়ে রাতে কাজ করে পুষিয়ে নিতে হত-প্রায়শঃই ট্যাক্সি ড্রাইভার, প্লাম্বার ও ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করতে হত তাদের। ভদ্র আবাস ছিল সাধ্যাতীত ব্যয়বহুল, এর মানে, তরুণ-তরুণীদের প্রায়শঃই বিয়ে করে সংসার পাতার জন্যে বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকতে হত। একমাত্র আশা ছিল অভিবাসন। হাজার হাজার মিশরিয় বাড়ি ছেড়ে লম্বা সময়ের জন্যে তেল সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে বাস করতে বাধ্য হয়েছে, এখানে তারা ভালো বেতন পেত, পরিবারের কাছে টাকাকড়ি পাঠাতে পারত ও ভবিষ্যতের জন্যে সঞ্চয় করতে পারত। কৃষকরাও উপসাগরীয় এই যাত্রায় যোগ দিয়েছিল, কেবল বাড়ি নির্মাণ বা ট্র্যাক্টর কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা জমানোর পরেই ফিরে আসত তারা।২৫ ইনফিতাহ সাদাতকে পশ্চিমের কাছে প্রিয় করে তুললেও এর মানে ছিল অধিকাংশ মিশরিয় স্রেফ নিজ দেশে বাস করতে পারছিল না, বাধ্য হচ্ছিল অভিবাসনে।

আমেরিকান ব্যবসা ও সংস্কৃতি শেকড় গেড়ে বসার সাথে সাথে বহু মিশরিয়র কাছে মিশর যেন অচেনা ও পাশ্চাত্য ঠেকছিল। জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন সাদাত। তিনি ও তাঁর স্ত্রী বিলাসী পশ্চিমা জীবনযাত্রা অনুসরণ করতেন, বেশ ঘন ঘন তাদের বিদেশী সেলিব্রিটি ও চিত্রতারকাদের আপ্যায়ন করতে দেখা যেত, তাঁরা অ্যালকোহল পান করতেন বলে সুবিদিত ছিল, অধিকাংশ জনগণের দুর্ভোগ থেকে দূরে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সাজ্জিত অসংখ্য জাঁকাল রেস্ট হাউসে বিলাস বহুল জীবন যাপন করতেন। সাদাতের সযত্নে গড়ে তোলা ধর্মীয় ইমেজের সাথে এর কোনও মিল ছিল না। সুন্নি ঐতিহ্যে একজন ভালো মুসলিম শাসককে জনগণের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বরং সহজ সরল জীবন যাপন ও যত দূর সম্ভব সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।২৬ দেশের নতুন ধর্মীয় জোয়ারের সাথে সম্পর্কিত হতে নিজেকে ‘ধার্মিক প্রেসিডেন্ট’ আখ্যায়িত করে ও দিনে পাঁচবার প্রার্থনায় নত হন বোঝাতে সংবাদ মাধ্যমকে কপালে স্পষ্ট ‘ছাইচিহ্ন’সহ মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায় তাঁর ছবি প্রকাশে উৎসাহিত করে অনিবার্যভাবে মুসলিমদের তাঁর অসল আচরণ ও আদর্শের ভেতর তুলনা করার আহ্বান জানাচ্ছিলেন সাদাত।

তারপরেও উপরে উপরে সাদাত ধর্মের জন্যে ভালো ছিলেন। নিজ শাসনের পক্ষে নাসের থেকে ভিন্ন পরিচয় গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল তাঁর। মুহাম্মদ আলির আমল থেকেই মিশরিয়রা বারবার আধুনিক বিশ্বে পা রাখার প্রয়াস পেয়েছে এবং সেখানে নিজেদের একটা অবস্থান পেতে চেয়েছে। পশ্চিমকে অনুকরণ করেছে তারা, পশ্চিমা নীতিমালা ও আদর্শ গ্রহণ করেছে, স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছে আর আধুনিক ইউরোপিয় ধারায় সংস্কৃতিকে সংস্কারের প্রয়াস পেয়েছে। এর কোনওটাই সফল হয়নি। ইরানিদের মতো অনেক মিশরিয় মনে করেছে এবার ‘নিজেদের মাঝে প্রত্যাবর্তন’ ও একটি আধুনিক অথচ স্পষ্টভাবে ইসলামি পরিচয় গড়ে তোলার সময় হয়েছে। সাদাত খুশি মনে এটিকে কাজে লাগিয়েছেন। পাশ্চাত্য কায়দায় ইসলামকে রাষ্ট্রের অধীন সরকারী ধর্মে পরিণত করতে চেয়েছিলেন তিনি। নাসের যেখানে ইসলামি গ্রুপগুলোর উপর নির্যাতন চালিয়েছেন, সাদাত সেখানে নিজেকে তাদের মুক্তিদাতা হিসাবে তুলে ধরেছেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের ভেতর বিভিন্ন কারাগার ও শ্রম-শিবিরে ভুগতে থাকা মুসলিম ব্রাদারদের মুক্তি দিয়েছেন। ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণকারী নাসেরের বিভিন্ন কঠোর আইন শিথিল করেছেন, তাদের সভা-সমাবেশ, প্রচারণা ও প্রকাশনার অনুমতি দিয়েছেন। মুসলিম ব্রাদারহুডকে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সোসায়েটি হিসাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া না হলেও ব্রাদাররা প্রচারণা চালাতে এবং নিজেদের পত্রিকা আল-দাওয়াহ (‘আহ্বান’) প্রকাশ করতে পারছিল। মসজিদ নির্মাণের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল, ইসলামের জন্যে রেডিওতে সময় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। ইসলামি ছাত্র গ্রুপগুলোকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন সাদাত, সমাজতন্ত্রী ও নাসেরবাদীদের কাছ থেকে ক্যাম্পাসের দখল ছিনিয়ে নিতে উৎসাহ দিয়েছেন তাদের। নাসের ধর্মকে দমন করতে চেয়েছিলেন এবং এই নির্যাতনমূলক কৌশল উল্টোফলদায়ী আবিষ্কার করেছেন। এর ফলে সায়ীদ কুতব প্রচারিত অধিকতর চরম ধার্মিকতার উত্থান ঘটেছিল। সাদাত এবার ধর্মকে নিজের মতলব হাসিলের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। এটাও করুণ ভ্রান্তি হিসাব প্রমাণিত হবে।

প্রথম দিকে অবশ্য সাদাতের নীতি সফল মনে হয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ, মুসলিম ব্রাদারহুড যেন যথার্থ শিক্ষা পেয়েছে বলে মনে হয়েছে। কারাগার থেকে মুক্তি প্রাপ্ত প্রবীন রাজনীতিবিদগণকে সায়ীদ কুতব ও সিক্রেট অ্যাপারেটাসের দায়িত্ব গ্রহণে অনিচ্ছুক মনে হয়েছে, হাসান আল-বান্নার অহিংস, সংস্কারমূলক নীতিমালায় ফিরে যেতে চেয়েছেন তাঁরা। ব্রাদাররা মুসলিম আইনে পরিচালিত একটি রাষ্ট্র দেখতে চাইলেও একে কেবল শান্তিপূর্ণ ও আইনসম্মত পথেই অর্জন সম্ভব একটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করেছে।২৭ কিন্তু তারপরেও সোসায়েটির আদি আদর্শে ফিরে যাবার দাবি করলেও বাস্তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংগঠনে পরিণত হয়েছিল ব্রাদারহুড। বান্না যেখানে বিশেষভাবে মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকশ্রেণীর কাছে আবেদন রেখেছিলেন, পণ্ডিতদের ভাষায় ‘নব্য ব্রাদারহুড’ সেখানে সাদাতের খোলা দুয়ার নীতি থেকে লাভবান হয়েছিল, বুর্জোয়াদের আকর্ষণ করেছিল। এরা ছিল সমৃদ্ধশালী, আরামপ্রিয় ও শাসকগোষ্ঠীর সাথে সহযোগিতায় প্রস্তুত। এই নতুন ব্রাদারহুড সাদাতের মিশর থেকে ক্রমবর্ধমানহারে বিচ্ছিন্ন বোধকারী ক্লান্তিকর বঞ্চনার শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাছে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেনি। শাসকের বিরোধিতা করার মতো ভিন্ন কোনও অনুমোদিত ধরন না থাকায় অসন্তুষ্টদের অনেকেই আরও চরম ইসলামি পন্থার খোঁজ করেছে।২৮

কিন্তু অচিরেই সাদাতের নীতিমালা এমকি নব্য ব্রাদাহুডকেও ক্ষিপ্ত করে তোলে। এর প্রায় ৭৮,০০০ প্রচার সংখ্যার জার্নাল আল-দাওয়াহ প্রতি মাসে ইসলামের চার ‘শত্রু’র সংবাদ প্রকাশ করছিল: পাশ্চাত্য ক্রিশ্চান ধর্ম (এর অন্তস্থঃ সাম্রাজ্যবাদকে তুলে ধরার জন্যে সাধারণভাবে আল-সালিবিয়াহ, দ্য ক্রুসেড), কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র (আতাতুর্ক কর্তৃক রূপায়িত) ও যায়নবাদ। বিশেষ করে ‘ইহুদিগোষ্ঠী’কে অন্য তিনশত্রুর সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত চূড়ান্ত অশ্লীলতা মনে করা হত। আল-দাওয়াহর নিবন্ধগুলো মদীনায় পয়গম্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী ইহুদিদের নিয়ে কোরানের অনুচ্ছেদসমূহ উদ্ধৃত করত, এবং ইহুদি বিশ্বাস সম্পর্কে ইতিবাচক বক্তব্য ধারণকারী অনুচ্ছেদগুলো বাদ দিয়ে যেত।২৯ আল-দাওয়াহ’র অ্যান্টি-সেমিটিজম পয়গম্বরের আমল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে দাবি করা হয়, কিন্তু আসলে তা সাম্প্রতিককালে ইসলামি উদ্ভাবন, ইসলামি উৎসের চেয়ে বরং দ্য প্রটোকল অভ দ্য এল্ডারস অভ যায়ন-এর উপর বেশি নির্ভর করেছে। সুতরাং, ক্যাম্প ডেভিডের পর নব্য ব্রাদারদের পক্ষে সাদাতের অনুগত থাকা আর সম্ভব ছিল না। গোটা ১৯৭৮ সাল জুড়ে আল-দাওয়াহ শাসক গোষ্ঠীর ইসলামি বৈধতাকে প্রশ্ন করে গেছে। ১৯৮১ সালের মে সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনী ডোম অভ দ্য রককে শেকলে জড়ানো ও স্টার অভ ডেভিডের ছবিঅলা তালা দিয়ে আটকানো অবস্থায় তুলে ধরে।

কিন্তু সাদাতের ঐতিহাসিক জেরুজালেম সফরের সময় অধিকতর চরমপন্থী মুসলিম গোষ্ঠী আলোয় বের হয়ে এসেছিল। এর নেতৃবৃন্দ বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতা ও সাবেক সরকারের মন্ত্রী মুহাম্মদ আল-দাহাবির হত্যার অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন। মিশরিয়রা এই মুসলিম যুবকদের কাছে প্রথম চার জন ‘সঠিক পথে পরিচালিত’ (রাশিদুন) খলিফার আমল থেকেই ইসলাম পতনের মুখে রয়েছে, সেই সময়ের পর অর্জিত সমস্ত ইসলামি বিকাশ বহুঈশ্বরবাদীতা ছাড়া আর কিছু না, গোটা মিশর প্রেসিডেন্ট ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ জাহিলিয়াহ যুগের জেনে ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিল। গোষ্ঠীটি ঘোষণা করেছিল যে এই জাহিলিকে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে এবং এর ধ্বংসস্তূপের উপর কোরান ও সুন্নাহ ভিত্তিক সত্যিকারের মুসলিম সমাজ গড়ে তুলতে হবে। গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা শুকরি মুস্তাফাকে আল্লাহ নতুন বিধান সৃষ্টি এবং মুসলিমদের ইতিহাসকে ফের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে মনোনীত করেছেন।৩১

১৯৬৫ সালে নাসের সরকারের হাতে সোসায়েটি অভ মুসলিম ব্রাদার্সের লিফলেট বিলির দায়ে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি হয়েছিলেন শুকরি, তখন তাঁর বয়স ছিল তেইশ বছর।৩২ এই সামান্য অপরাধের দায়ে ছয় বছর নাসেরের শিবিরে কাটিয়েছেন তিনি, এই সময় মাওদুদি ও কুতবের রচনা পাঠ করেছেন এবং আরও অনেক মুসলিম ব্রাদারের মতো নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। কারাগারে এইসব চরমপন্থী মুসলিমরা সায়ীদ কুতবের নির্দেশনা মোতাবেক কঠোর বিচ্ছিন্নতার অনুশীলন করেছে। অন্য কারাবন্দি ও প্রবীন, অধিকতর মডারেট ব্রাদারদের থেকে নিজেদের আলাদা কেরে নিয়েছে, জাহিলি ঘোষণা করেছে তাদের। অবশ্য কেউ কেউ নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কুতব বিশ্বাস করতেন যে, জাহিলি সমাজের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করতে তাঁর ভ্যানগার্ডের আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। প্রথমে অবশ্যই মুহাম্মদীয় কর্মসূচির প্রথম তিনটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে তাদের, নিজেদের আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। কারাবন্দি কোনও কোনও চরমপন্থী তারা এখন ‘দুর্বলতা’র একটা পর্যায়ে রয়েছে বলে একমত হয়েছিল, অশুভ শাসকগোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। উপযুক্ত সময় না আসা পর্যন্ত আপাতত জাহিলি সমাজেই স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে তারা। কিন্তু শুকরি ছিলেন ‘সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা’র (মাফসালাহ কামিলিয়াহ) পক্ষের আরও চরমপন্থী দলের সদস্য: তাদের গোষ্ঠীতে যোগ দেয়নি এমন যে কেউ বিধর্মী, প্রকৃত বিশ্বাসীদের তাদের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই। সতীর্থ বন্দিদের সাথে কথা বলতে অস্বীকার যেত তারা, প্রায়শঃই লেগে থাকত হাতাহাতি মারপিট।

১৬ই অক্টোবর, ১৯৭১-এ শুকরিকে আবু যাবাল ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেওয়া হলে একটি নতুন দল গঠন করেন তিনি; এর নাম দেন সোসায়েটি অভ মুসলিমস। এর সদস্যরা কুতবের ভ্যানগার্ড হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল, নিজেদের তাঁর কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজে নিবেদন করেছিল তারা। সেই অনুযায়ী জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের লক্ষ্যে মূলধারার সমাজ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। গোটা মিশরিয় সমাজই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মসজিদে উপাসনা করতে অস্বীকার করে তারা, ধর্মীয় ও সেক্যুলারিস্ট নির্বিশেষে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির (তাকফির) ফতওয়া জারি করে। কেউ কেউ শুকরির নিজ আবাস আসিউতের আশপাশের মরুভূমি ও পাহাড়ী গুহায় অভিবাসন করে। বেশিরভাগই বড় বড় শহরের উপকণ্ঠে সবচেয়ে বঞ্চিত পাড়ার আসবাবপত্রে সাজানো ঘরে থাকত, এখানে সত্যিকারের ইসলামি ধারায় জীবন যাপনের চেষ্টা করত তারা। ১৯৭৬ সাল নাগাদ সোসায়েটি অভ মুসলিমসের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার। তারা বিশ্বাস করেছিল যে আল্লাহ বর্তমান জাহিলিয়াহর ধ্বংসাবশেষের উপর খাঁটি উম্মাহ গঠনের লক্ষ্যে তাদের মনোনীত করেছেন। আল্লাহ’র হাতে রয়েছে ওরা। এখন তারা উদ্যোগ গ্রহণ করায় আল্লাহই বাকি কাজ শেষ করবেন। সোসায়েটির উপর কড়া নজর রেখেছিল পুলিস, কিন্তু নিরীহ উন্মাদ ও ঝরে পড়াদের দল বলে নাকচ করে দিয়েছিল তাদের।৪ কিন্তু সাদাত ও তাঁর পরমর্শকরা এই তরুণ, মরিয়া মৌলবাদীদের জীবনযাত্রার দিকে একবার নজর দেওয়ার কথা ভাবলে হয়তো দেখতেন এই মুসলিম সম্প্রদায়গুলো খোলা দুয়ার নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিবিম্ব ও আধুনিক মিশরের অন্ধকার দিক তুলে ধরেছে।

শুকরির গোটা মিশরিয় সমাজকেই অস্পৃশ্য ঘোষণা করা হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে থাকতে পারে, তবে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ছিল না। সাদাতের মিশরে যতবেশি মসজিদই নির্মিত হয়ে থাকুক না কেন, যে সমাজে একটি ছোট অভিজাত গোষ্ঠীর দখলে সব সম্পদ থাকে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নৈরাশ্যজনক দারিদ্র্যে বাস করে সেই সমাজে ইসলামি বলে কিছু থাকে না। সোসায়েটির সদস্যদের শহরের সবচেয়ে করুণ মহল্লায় হিজরা বা ‘অভিভাসন’ বহু তরুণ মিশরিয়র দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থাও তুলে ধরেছে, তাদের মনে হয়েছে মিশরে তাদের জন্যে কোনও জায়গা নেই, নিজ দেশ থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়েছে তাদের। সোসায়েটির কমিউনগুলো তরুণদের হাতে পরিচালিত হত, আরও অনেক মিশরিয় তরুণের মতো তাদের উপসাগরীয় রাষ্ট্রসমূহে পাঠিয়েছিলেন শুকরি। সোসায়েটির অনেক সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা লাভ করেছিল, কিন্তু শুকরি ঘোষণা করেছিলেন যে, সেক্যুলার শিক্ষা সময়ের অপচয়; মুসলিমের প্রয়োজন কেবল কোরান। এটা আরেকটা চরম অবস্থান, তবে এতে সত্যির খানিকটা অংশ আছে। ১৯৭০ দশকে বহু মিশরিয়র প্রাপ্ত শিক্ষা তাদের কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন ছিল। শিক্ষা ও তার পদ্ধতিই কেবল ব্যাপকভাবে অপর্যাপ্ত ছিল না, বরং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ডিগ্রি এমনকি একজন গ্র্যাজুয়েটের ভালো চাকরি লাভের নিশ্চয়তা দিত না: বিদেশের কোনও বাড়িতে আয়ার কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের চেয়ে বেশি বেতন পাওয়ার সুযোগ ছিল।৩৫

সোসায়েটি যতদিন লো-প্রোফাইল বজায় রেখেছে, শাসকগোষ্ঠী তাদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কিন্তু ১৯৭৭ সালে আড়াল ছেড়ে বের হয়ে আসেন শুকরি। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামি গ্রুপগুলো সোসায়েটির কিছু সদস্যকে প্রলুব্ধ করে নিজেদের দলে নিয়ে গিয়েছিল। এই দলত্যাগীরা শুকরির চোখে মৃত্যুদণ্ডের উপযুক্ত ধর্মদ্রোহীতে পরিণত হয়েছিল। তাঁর শিষ্যরা তাদের বিরুদ্ধে লাগাতার হামলা চালাতে শুরু করে, ফলে হত্যা প্রচেষ্টার দায়ে সোসায়েটির চৌদ্দজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাথে সাথে আক্রমণাত্মক অবস্থানে চলে যান শুকরি। ১৯৭৭ সালের পরবর্তী ছয় মাসে সতীর্থদের মুক্তির দাবিতে প্রচারণা চালিয়ে যান তিনি, খবর কাগজে নিবন্ধ পাঠান, এবং রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারণার প্রয়াস পান। এই শান্তিপূর্ণ উপায় ব্যর্থ হলে সহিংসতার আশ্রয় নেন শুকরি। সোসায়েটিকে ধর্মদ্রোহী হিসাবে নিন্দা করে একটি প্রবন্ধ লেখায় ৭ই জুলাই মুহাম্মদ আল- দাহাবিকে অপহরণ করেন। অপহরণের এক দিন পর, তিনটি মিশরিয় পত্রিকা এবং সেই সাথে অন্য কয়েকটি মুসলিম দেশ, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস ও লন্ডনেও একটি বার্তা প্রকাশ করেন শুকরি। শিস্যদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবি করেন, প্রচারমাধ্যমে সোসায়েটির পাওয়া নেতিবাচক প্রচরণার জন্যে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করার উপর জোর দেন এবং শাসকগোষ্ঠীর আইনি ব্যবস্থা ও গোয়েন্দা সেবা সম্পর্কে তদন্ত করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠনের আহ্বান জানান। সাদাত তাঁর গোপন পুলিসের কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে দেবেন, এমন সম্ভাবনাই ছিল না: স্পষ্টতই কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গেছেন তার প্রকৃতি বুঝে উঠতে পারেননি শুকরি। কয়েক দিন পরে দাহাবির লাশ আবিষ্কৃত হলে, শুকরি ও তাঁর শত শত শিষ্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। দ্রুত বিচার অনুষ্ঠানের পর স্বয়ং শুকরি ও সেসায়েটির পাঁচজন নেতৃস্থানীয় সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। সংবাদমাধ্যম প্রত্যাখ্যানবাদী ও নিন্দাবাদী আদর্শের জন্যে এই গোষ্ঠীটির নাম দিয়েছিল তাকফির আল হিজরা (‘সমাজচ্যুতি ও অভিবাসন’)।৩৬ অনেক মৌলবাদী ধর্মতত্ত্বের মতো ক্রোধ ও প্রান্তিকীকরণের অভিজ্ঞতা থেকে এর উদ্ভব হয়েছিল, কিন্তু শুকরির কাহিনী আমাদের এ কথাই মনে করিয়ে দেয় যে, এই ধরনের সমাজকে সব সময় উন্মাদ ভাবা ঠিক নয়। ভারসাম্যহীন ও করুণভাবে ভুল বোঝা শুকরি এমন এক প্রতি- সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন যা পশ্চিমে দারুণ উৎসাহের সাথে তারিফ করা তাদের নতুন মিশরের অন্ধকার দিক তুলে ধরেছে। আসলে কী ঘটছে তার এক বিকৃত, অতিরঞ্জিত রূপ এবং যাকে আর নিজেদের ভাবতে পারছিল না এমন এক দেশে অসংখ্য তরুণের বিচ্ছিন্নতা তুলে ধরেছে।

ঠিক একই রকম উন্মোচক, কিন্তু অধিকতর সফল ও স্থায়ী ছিল সাদাতের প্রেসিডেন্সির সময় বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে আধিপত্য বজায় রাখা ইসলামি ছাত্র সংস্থা জামাত আল-ইসলামিয়াহ। শুকরির সোসায়েটির মতো জামাত নিজেদের কুতবের ভ্যানগার্ড মনে করত; তবে মূলধারা থেকে রেডিক্যাল প্রত্যাহারের চর্চা করেনি তারা, বরং তাদের চাহিদার প্রতি অন্ধ মনে হওয়া এক সমাজে নিজেদের জন্যে স্থান তৈরি করতে চেয়েছে। মিশরিয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড বা সরবোনের মতো ছিল না। এগুলো ছিল বিশাল, হৃদয়হীন করুণ সুবিধা সম্পন্ন গণশিক্ষাকেন্দ্র। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৭ সালের ভেতর ছাত্র সংখ্যা ২০০,০০০ থেকে অর্ধ মিলিয়নে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে ভীতিকর জটলা সৃষ্টি হয়েছিল। দুই বা তিনজন ছাত্রকে একই আসনে বসতে হত, লেকচার হল ও ল্যাবরেটরিগুলোয় এমন ভীড় লেগে থাকত যে বিশেষত মাইক্রোফোনগুলো প্রায়ই ভাঙা থাকায় শিক্ষকের কণ্ঠস্বর শোনা ছিল কার্যত অসম্ভব। অতিরিক্ত ভিড় মেয়েদের জন্যে বিশেষ কষ্টকর ছিল, তাদের অনেকেই ঐহিত্যবাহী পটভূমি থেকে আগত ছিল বলে বেঞ্চে বা বাসে করে সমান ঠাসাঠাসি আবাসিক হলে নিয়ে যাওয়ার সময় তরুণদের সাথে ঠেলাঠেলি করা সমানভাবে অসহনীয় মনে করেছে। শিক্ষা ছিল মুখস্ত করার বিষয় এবং পরীক্ষায় সাফল্য নির্ভর করত লেকচার নোট ও প্রফেসরদের দেওয়া ম্যানুয়ালের যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তির উপর। হিউম্যানিটিজ, আইন, সমাজ বিজ্ঞান ‘গারবেজ ফ্যাকাল্টি’ হিসাবে পরিচিত ছিল, কার্যত বাতিল। ব্যক্তিগত প্রবণতা যাই হোক না কেন, ছাত্ররা চিকিৎসা বিজ্ঞান, ফার্মাকোলজি, ওডোন্টোলজি, এঞ্জিনিয়ারিং বা অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করতে বাধ্য হত, নয়তো সবচেয়ে বাজে প্রফেসরদের কাছে শিক্ষা লাভের জন্যে নিজেদের ছেড়ে দিতে হত; ফলে গ্র্যাজুয়েশনের পর ভালো একটা কাজ পাওয়ার সুযোগ আরও কমে যেত। এমনি পটভূমিতে ছাত্ররা মানবতা বা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে ভাববার প্রশিক্ষণ পেত না। বরং নিস্পৃহ ও প্রাণহীনভাবে বিভিন্ন তথ্য হজম করতে হত তাদের। তো আধুনিক সংস্কৃতির সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল পৌনঃপুনিকভাবে উপরিগত, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার থেকে গেছে সম্পূর্ণ স্পর্শের বাইরে।৩৭

জামাত অল্প কিছু বই-পুস্তক বা প্যামফ্লেট বের করেছিল, কিন্তু ১৯৮০ সালে আল-দাওয়াহর জন্যে ইসলাম আল-দিন আল-আরিয়ার রচিত একটি নিবন্ধ তাদের মূল ধারণাকে তুলে ধরে। স্পষ্টতই সায়ীদ কুতবই ছিলেন অনুপ্রেরণা; জামাত বিশ্বাস করেছে মিশরিয়দের সময় এসেছে বহুদিন ধরে দেশের উপর প্রাধ্যান্য বিস্তার করে থাকা পাশ্চাত্য ও সোভিয়েত আদর্শ ঝেড়ে ফেলে ইসলামে ফেরার। মিশর এখনও কার্যত বিধর্মীদের হাতে শাসিত হচ্ছে, মহান ধর্মীয় জাগরণ ছাড়া প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হবার নয়।৮ জামাত বিভিন্ন ধারণা নিয়ে আলোচনায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং নিজস্ব পরিস্থিতিতে সৃজনশীল ও বাস্তবভিত্তিকভাবে সেগুলো প্রয়োগ করেছে। ১৯৭৩ সালে ছাত্ররা প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে সামার ক্যাম্প স্থাপন করতে শুরু করে। ৩৯ এখানে কোরান পাঠ করত তারা, রাতে একসাথে প্রার্থনা করত ও ইসলামের সোনালি অতীত, পয়গম্বরের জীবন ও ব্রত এবং চার রাশিদুনদের জীবন কথা শুনত। দিনের বেলায় আত্মরক্ষার জন্যে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও ক্লাস করত। কয়েক সপ্তাহর জন্যে ছাত্ররা সম্পূর্ণ ইসলামি কায়দায় জীবন যাপন করত। এক অর্থে এটা ছিল সাময়িক হিজরা, মূলধারার সমাজ থেকে এমন জগতে অভিবাসন যেখানে কোরান অনুযায়ী জীবন যাপন করে জীবনে এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারত। সত্যিকার অর্থে ঐশীগ্রন্থের শিক্ষাকে সমর্থনকারী পরিবেশে বাস করার অভিজ্ঞতা লাভ করত। এই শিবিরগুলো শাসকগোষ্ঠীর অনৈসলামিক মুসলিম জীবনাচারের বিপরীতে ইসলামি ইউটোপিয়ার এক ধরনের স্বাদ যোগাত তাদের। যাজক ও বক্তাগণ আধুনিক অভিজ্ঞতার তিক্ত হতাশার কথা তুলে ধরতেন, ইউরোপ বা আমেরিকায় যা হয়তো চমৎকার ফল দিয়েছে, কিন্তু মিশরে কেবল ধনীদেরই কাজে এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ফিরে ক্যাম্পাসে তাদের অভিজ্ঞতার খানিকটা রূপায়িত করার প্রয়াস পেত ছাত্ররা। সরকারী পরিবহনে নিয়মিত হয়রানির শিকার থেকে নিস্তার দিতে নারী ছাত্রদের জন্যে মিনিবাস সেবা চালু করেছিল তারা। লেকচার হলে একই কারণে লিঙ্গের বিচ্ছিন্নতার উপর জোর দিয়েছে; নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই ইসলামি পোশাক পরার কথা বলেছে। দীর্ঘ আবৃতকারী জোব্বা পাশ্চাত্য কায়দার ডেটিং-এর প্রতি অনুকূল নয় এমন প্রথাগত সমাজে, যেখানে (অর্থনৈতিক কারণে বিয়ে কোনও পছন্দ ছিল না) যৌন হতাশা ছিল মিশরিয় তরুণ সমাজের একটি প্রধান সমস্যা, অনেক বেশি বাস্তবভিত্তিক ছিল। মসজিদে মসজিদে পুনরালোচনার অধিবেশনেরও আয়োজন করে জামাত, ছাত্ররা এখানে শোরগোলময়, জনাকীর্ণ আবাসিক হলে সম্ভব নয় এমন নিরিবিলি পরিবেশে পাঠ করার সুযোগ পেত। এইসব কৌশল কার্যকর ছিল। প্রথম নজীরে স্রেফ বিব্রত হওয়া থেকে বাঁচতে একজন ছাত্র ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরতে পারত বা লেকচার হলে বিচ্ছিন্ন সারিতে যোগ দিত, কিন্তু একই সময়ে সেই মেয়েটি সচেতন হয়ে উঠত যে তার মঙ্গলের ক্ষেত্রে জামাতের চেয়ে শাসকগোষ্ঠী কম উদ্বিগ্ন। মসজিদে পড়াশোনা করতে উত্তাল ডরমিটরি ছেড়ে ছাত্র ছোট প্রতীকী হিজরা পালন করত এবং ইসলামি পটভূমি তার পক্ষে বেশি কার্যকর বলে জানতে পারত। অনেক ছাত্রই গ্রামের পটভূমি ও ঐতিহ্যবাহী প্রাক আধুনিক সমাজ থেকে এসেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আধুনিকার অভিজ্ঞতা তাদের কাছে কেবল অচেনা, নৈর্ব্যক্তিক ও হতবুদ্ধিকরই ঠেকেনি, বরং মাঝারি মাপের শিক্ষা লাভের সময় শাসকগোষ্ঠীর সমালোচনায় তাদের সক্ষম করে তুলতে অন্য কোনও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ও দেওয়া হয়নি। এমনি এক বিশ্বে অনেকেই কেবল ইসলামই অর্থ প্রকাশ করে বলে আবিষ্কার করবে। পাশ্চাত্য পর্যবেক্ষকগণ বিশেষ করে নারীদের বোরখায় ফিরে যাবার দৃশ্যে হতাশ বোধ করেছেন, একে লর্ড ক্রোমারের আমল থেকে ইসলামি পশ্চাদপদতা ও পুরুষতান্ত্রিকার প্রতীক ভেবে এসেছেন তাঁরা। কিন্তু বাস্তব কারণে স্বেচ্ছায় ও পাশ্চাত্য পরিচয় প্রত্যাখ্যানের উপায় হিসাবে ইসলামি পোশাক বেছে নেওয়া মুসলিম নারীদের কাছে ব্যাপারটা সেভাবে অনুভূত হয়নি। বোরখা, স্কার্ফ ও দীর্ঘ পোশাক উত্তর উপনিবেশিক আমলে ইসলামিস্টদের দারুণ কষ্টের সাথে প্ৰয়াস পেয়ে আসা ‘সেই সত্তায় প্রত্যাবর্তনের’ প্রতীক হতে পারে। শত হোক পাশ্চাত্য পোশাকআশাকে পবিত্রতার কোনও ব্যাপার নেই। সব মহিলাকে এই পোশাক পরতে দেখার ইচ্ছা ইসলামিস্টদের কাছে ‘পশ্চিম’কে ‘বাকি’ বিশ্বের মেনে নেওয়ার মতো রীতি হিসাবে দেখার প্রবণতা মনে হয়েছে। বছর পরিক্রমায় বোরখা পরা নারী ইসলামি আত্ম-নির্ভরতা ও পাশ্চাত্য সাংস্কৃতির আধিপত্যের প্রত্যাখ্যানের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। আড়াল বেছে নিয়ে নারীটি ‘সবকিছু উন্মুক্ত করার’ বাধ্যবাধকতাসহ পশ্চিমের যৌন আচারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। পশ্চিমা নারী-পুরুষ যেখানে দেহকে জিম ও শরীরচর্চার ক্ষেত্রে মানবীয় ইচ্ছার অধীনে নিয়ে আসার প্রয়াস পেয়েছে এবং সময় ও বয়সের প্রক্রিয়ার কাছে দেহকে দুর্গম করে জীবনকে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছে, সেখানে আবৃত ইসলামি দেহ আভাসে ঘোষণা করছে যে এটা স্বর্গীয় নির্দেশের অধীন, এই বিশ্ব নয় বরং দুর্ভেয়মুখী। পশ্চিমে নারী-পুরুষ প্রায়শঃই তাদের অনেক ব্যয়ে অর্জিত তামাটে ও শানানো গায়ের রঙ প্রদর্শন করে বা অনেক সময় অধিকারের প্রতীক হিসাবে জাহির করে। একই রকম পোশাকের স্তরে আবৃত মুসলিম দেহও ইসলামি দর্শনের মানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। একইভাবে সেগুলো পাশ্চাত্য আধুনিকতার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের উপর সম্প্রদায়ের কোরানের আদর্শকে তুলে ধরে। অনেকটা একইভাবে শুকরির মুস্তাফা’স কমিউনসের মতোই আবৃত ইসলামি নারীরা আধুনিক চেতনার অন্ধকার দিকের ইঙ্গিতময় সমালোচনা।৪১

ইসলামি পোশাকের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী একজন নারীকে প্রাক আধুনিকতার প্রাচীন নারীসুলভ আত্মসমর্পণে ফিরে যেতে হবে, এমন কোনও কথা ছিল না। ১৯৮২ সালে মিশরে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, পাশ্চাত্য পোশাক পছন্দকারী নারীদের চেয়ে বোরখা বেছে নেওয়া মেয়েরা বেশি রক্ষণশীল হলেও, বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসলামপন্থীর লিঙ্গ প্রশ্নে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বোরখা পরিহিত নারীদের অষ্টাশি শতাংশ বিশ্বাস করে, নারী শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ (বোরখাবিহীন নারীদের ৯৩ শতাংশের বিপরীতে); বোরখা পরা মেয়েদের ৮৮ ভাগ বাড়ির বাইরে নারীদের কাজ করাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করেছে, এবং ৭৭ ভাগ গ্র্যাজুয়েশেনের পর কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে (৯৫ ও ৮৫ শতাংশ বোরখাবিহীন নারীদের তুলনায়)। অন্যান্য ক্ষেত্রে তফাৎ আরও ব্যাপক ছিল, তবে বোরখাধারী নারীদের একটা প্রধান অংশ এখনও মনে করে (৫৩ শতাংশ) নারী- পুরুষের সমান রাজনৈতিক ও অধিকার দায়িত্ব থাকা উচিত, এবং নারীদের রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে আসীন হওয়া উচিত (৬৩ শতাংশ)। বোরখাধারী নারীদের কেবল ৩৮ ভাগ মনে করে, নারী-পুরুষের সমান বৈবাহিক অধিকার থাকা উচিত, কিন্তু বোরখাবিহীন নারীদের মাত্র ৬৬ ভাগ বৈবাহিক সমতায় বিশ্বাস রাখে। এটাও কৌতূহলোদ্দীপক যে বোরখাধারী (৬৭ শতাংশ) ও বোরখাবিহীন নারীদের ৫২.৭ শতাংশ) সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই বিশ্বাস করে যে, শরীয়াহরই দেশের আইন হওয়া উচিত।৪২

এটা ঠিক যে সকল প্রাক আধুনিক আইনের মতো শরীয়াহ নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর অধঃস্তন অবস্থায় নমিত করেছে। কিন্তু উওম্যান অ্যান্ড জেন্ডার ইন ইসলাম- এ লেয়লা আহমেদ যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, এই নারীরা আল আযহারের মধ্যযুগীয় ফিকহের চেয়ে অতীতের আরও অনেক সুন্নি মুসলিম সংস্কারকের মতো কোরান ও সুন্নাহর ‘প্রকৃত ইসলামে’ ফিরে যাবার প্রয়াস পাচ্ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, ‘প্রকৃত ইসলাম’ নারীসহ সকলের পক্ষে সাম্য ও ন্যায়বিচারের কথা বলেছে। তবে আহমেদ এটা স্বীকার করেছেন যে, তারা পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দলে টানার শিকার হতে পারে, এবং উল্লেখ করেছেন, কোনও ইসলামি শাসকদল ক্ষমতায় এলেই সাধারণভাবে নারীদের মর্যাদায় অবনতি ঘটানোর দিকে চালিত করে।৪৩ পরিস্থিতি খারাপ থাকলে পুরুষদের নারীদের চেয়ে বেশি অধিকার দিয়ে সুপ্ত অসন্তে াষ দূর করাটা সহজ। তাসত্ত্বেও এটা ঠিক, ইসলামি পোশাক সব সময় নারী হৃদয়ে সমর্পণের ইঙ্গিত দেয় না। তুর্কি পণ্ডিত নিলুফার গোলে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বোরখাধারী নারীরা প্রায়শঃই জঙ্গী, স্পষ্টভাষী ও উচ্চ শিক্ষিত হয়ে থাকে।৪৪ বহু বোরখাধারী নারী নতুন মৌলবাদী আক্রমণে সক্রিয় ও অনেক সময় বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আহমেদ এও বলেছেন যে, মিশরে ইসলামি পোশাক অতীতে প্রত্যাবর্তন ছিল না। ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে বহু নারীর পছন্দের পোশাকে ট্র্যাডিশনাল কিছু ছিল না। এক নতুন ফ্যাশন ছিল এটা, দাদী-নানীদের জোব্বার চেয়ে (লম্বা হাতা ও স্কার্ট বাদে) পশ্চিমা ফ্যাশনের সাথেই বেশি মিল ছিল। প্রকৃতপক্ষেই, একে ‘হাফওয়ে হাউস’ ও আধুনিক সমাজে উত্তোরণের পোশাক বলা যেতে পারে। এই বছরগুলোতে আগের চেয়ে অনেক অধিক সংখ্যায় নারীরা উচ্চ শিক্ষা লাভ করছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইসলামি পোশাক বেছে নেওয়া নারীদের একটা বিশাল অংশ ছিল প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে অগ্রসর হতে পারা তাদের পরিবারের প্রথম সদস্য, গ্রামীন পটভূমি থেকে এসেছিল তারা। সুতরাং, তাদের পোশাক ছিল পরিবারের পোশাকের ‘আধুনিক’ রূপ। বড় বড় শহরের বিপজ্জনক আধুনিকতার মুখোমুখি হওয়ার পর-এর কসমোপলিটানিজম, আগ্রাসী ভোগবাদ, বৈষম্য, সহিংসতা ও জনসংখ্যাধিক্য-অতি সহজে পরাস্ত হতে পারত তারা। পোশাক তাদের উপরে দিকে চলিষ্ণুতা দাবি করেছে, তবে এটা আবার তাদের অতীতের পোশাকের একটা ধারাবাহিকতারও যোগান দিয়েছে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামি পরিচয় ও সম্প্রদায় অনেক সহজে ও শান্তিতে বেদনাদায়ক হতে পারত এমন একটি পরিবর্তন সম্পন্ন করায় তাদের সক্ষম করে তুলেছিল। আমরা দেখেছি, অতীতে ধর্ম মানুষকে একটি প্রচলিত জীবন ধারা ও আদর্শ থেকে অধিকতর আধুনিক জীবনে উত্তরণে সক্ষম করে তুলেছিল। ইসলামি পোশাক নারী-পুরুষ উভয়ের পক্ষেই এমন কৌশলের অন্যতম হতে পারে। ৪৫

অবশ্য সকল পরিবর্তনই বেদনাদায়ক। ১৯৭০-র দশকে ক্যাম্পাসে ইসলামি জামাত তরুণদের আন্দোলন ছিল, তরুণ সমাজকে তাদের হতাশা ও বিভ্রান্তি প্রকাশে সাহায্য করেছে।। অনেক সময়ই সহিংসতায় উপচে পড়েছে। ১৯৭০-র দশকে জামাত মিশরের ইসলামি আন্দোলনসমূহের ভেতর সবচেয়ে কম আগ্রাসী ছিল, কিন্তু অধিকতর উগ্র নেতাদের কেউ কেউ বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ লাভে আরও কঠোর কৌশল গ্রহণ করবেন। আমেরিকান আরব বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক গাফনি আপার ঈজিপ্টের নতুন ইউনিভার্সিটি অভ মিনিয়ার জামাহ আল- ইসলামিয়াহর উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন, এখানে ছাত্র সংগঠনটি তখনও অবিকশিত ছিল এবং ক্ষুদে ইসলামি ক্যাডারের প্রতিপক্ষ ছিল কম। ইসলামি যোন হিসাবে ছোট ছোট স্থান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু করেছিল তারা: বুলেটিন বোর্ড, কাফেটেরিয়ার একটা ছোট অংশ বা লনের স্টাডি স্পট। ১৯৭৭ সাল নাগাদ প্রতিপক্ষকে বিতাড়িত করার সুবাদে ইসলামিস্টরা ছাত্র ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। কলেজেস অভ আর্ট অ্যান্ড এডুকেশনের মিলিত মাঠে একটা মসজিদ স্থাপন করে তারা, ছাত্ররা এখানে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে মিলিত হত। ইসলামপন্থীরা জায়নামাজ বিছিয়ে, লাউডস্পিকারে প্রার্থনাকে উচ্চকিত করে জায়গাটা দখল করে নিয়েছিল; দাড়িঅলা ছাত্ররা সারাক্ষণ জায়গাটা দখলে রেখে কোরান পাঠ করত।৪৬

সেক্যুলার জায়গার এমনি আগ্রাসী অধিকারকে ইসলামকে নতুন করে গড়ে তোলার ও পাশ্চাত্যকৃত বিশ্বে তাকে স্থাপনের আনাড়ী প্রয়াস হিসাবে দেখা যেতে পারে। মিনিয়ার ইসলামপন্থীরা পাশ্চাত্য সভ্যতার সর্বজনীন সম্প্রসারণ মেনে নিতে অস্বীকার করেছে, মানচিত্র পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করছিল তারা। ইসলামি পোশাক বেছে নেওয়ার মতো পার্থিব জায়গাকে মসজিদে পরিণত করা পূর্ণ সেক্যুলারকৃত জীবন যাত্রার বিরুদ্ধে বিদ্রোহেরই শামিল বলা যেতে পারে। প্রায় শত বছর ধরে উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো মিশরিয়দের নিজস্ব ধারায় আধুনিক সভ্যতা গড়ে তোলার অযোগ্য ও ইতিহাস সৃষ্টির অনুপযুক্ত বলে মনে করে আসা হয়েছে। এখন যত ছোট মাত্রায়ই হোক না কেন, ইসলামপন্থীরা একটা কিছু ঘটাতে যাচ্ছিল। পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল তারা, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রান্ত থেকে আরও একবার লাইমলাইটে নিয়ে আসছিল। সিভিল রাইটস বা এথনিক মুভমেন্ট, নারীবাদ বা পরিবেশবাদের মতো মুসলিম সংগঠনগুলো তাদের কাছে শিল্পায়িত আধুনিকতার হাতে চাপা পড়া মূল্যবোধ ও বিভিন্ন ইস্যুকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল ও পাশ্চাত্যের চাপিয়ে দেওয়া বৈশ্বিক সমাজের সমরূপতার বিরুদ্ধে স্থানীয় ও নির্দিষ্টতার সজীবতার উপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করছিল। অন্য প্রাক আধুনিক আন্দোলনের মতো এটা ছিল প্রতীকী বিউপনিবেশীকরণের প্রয়াস, পশ্চিমকে কেন্দ্র থেকে অপসারিত করার চেষ্টা ও মানবজাতির জন্যে আরও ভিন্ন সম্ভাবনা থাকার সত্য তুলে ধরা। সাদাত যতই পশ্চিমের কাছাকাছি হচ্ছিলেন ও ইসরায়েলের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করছিলেন (ইসলামিস্টদের কাছে যা মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অল্টারইগো বলে বিবেচিত ছিল), শাসকগোষ্ঠীর সাথে বিচ্ছিন্নতা প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। মিনিয়ায় ছাত্ররা আরও বেশি করে সহিংস হয়ে ওঠে। তারা চার্চে আক্রমণ চালায়, ইসলামি পোশাক পরতে অস্বীকৃতি জানানো ছাত্রদের হামলা করে এবং ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক সপ্তাহের জন্যে মিনিউসিপ্যাল গভর্নমেন্ট অফিস দখল করে রাখে। পুলিস তাদের একটি মসজিদ বন্ধ করে দিলে ছাত্ররা এক গুরুত্বপূর্ণ সেতুর উপর মাঝরাস্তায় শুক্রবারের প্রার্থনা আয়োজন করে, গাড়িঘোড়া চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এরপর ইউনিভার্সিটি সিটি ও ছাত্রদের আবাসিক এলাকা দখল করে বসে এবং ক্রিশ্চান ছাত্রদের জিম্মি হিসাবে আটক করে। দুইদিন পরে বিদ্রোহ দমন করতে উপস্থিত হয় এক হাজার সৈনিক

১৯৭৭ সাল পর্যন্ত জামাত আল-ইসলামিয়াহকে সমর্থন দিয়ে গেছেন সাদাত, কিন্তু মিনিয়ার ঘটনাপ্রবাহ তাঁর মত পাল্টে দেয়। ১৪ই এপ্রিল, ১৯৭৯, আপার ইজিপ্ট সফর করে মিনিয়া ও আসিউতের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি: সরকার ধর্মের এমনি অপব্যবহার আর বরদাশত করবে না। জুন মাসে জেনারেল ইউনিয়ন অভ ইজিপশিয়ান স্টুডেন্টস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, বাজেয়াপ্ত করা হয় তাদের সকল সম্পত্তি। কিন্তু জামাত অদৃশ্য হয়ে যাবার মতো এত দুর্বল ছিল না। রমযানের উপবাসের শেষে মিশরের প্রধান প্রধান শহরে সভার আয়োজন করে তারা। কায়রোয় পঞ্চাশ হাজার মুসলিম প্রেসিডেনশল আবিদিন প্যালেসের বাইরে প্রার্থনায় মিলিত হয়ে আভাসে সাদাতকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে তাঁকে অবশ্যই আল্লাহ’র বিধান অনুযায়ী শাসন করতে হবে। গণ্যমান্য মুসলিম ব্রাদার ইউসুফ আল-কারাদাওয়ি সভার উদ্দেশে ভাষণ দিতে উপসাগর থেকে উড়ে আসেন। এখন দ্বিতীয় রামসেসের মামি সংরক্ষণের দিকেই বেশি মনোযোগি সাদাতকে মনে করিয়ে দেন:

মিশর মুসলিম দেশ, ফারাওর নয়…জামাত ইসলামিয়াহর তরুণরা মিশরের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী, অ্যাভিনিউ অভ দ্য পিরামিডস, থিয়েটার অভিনয়, চলচিত্র নয়…মিশর নগ্ন নারী নয়, বরং বোরখাধারী নারী যে স্বর্গীয় আইনের বিধিবিধান মেনে চলে। দাড়ি বেড়ে উঠতে দেওয়া মিশরিয় তরুণ…এটা আল-আযহারের দেশ!৪৮

দমন ও নির্যাতনের নিজস্ব পরিণতি রয়েছে। ইসলামপন্থী ছাত্ররা এবার ক্যাম্পাসগুলোকে ইসলামি ঘাঁটিতে পরিণত করার প্রয়াস দ্বিগুন করে দিয়েছিল; সিনেমা, থিয়েটার ও বোরখাবিহীন নারীদের উপর আক্রমণের সংখ্যা বেড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও সংবাদ প্রচার শুরু করে তারা। শাসকগোষ্ঠী ও এর সেক্যুলারাইজড রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। জামাতকে সংগঠিত হতে দেওয়া হচ্ছিল না, তাদের অনেক সদস্য সহিংস জিহাদে নিবেদিত গোপন সেলে যোগ দিয়েছিল।

ইরানি বিপ্লবের পটভূমিতে এইসব ঘটনা ঘটেছিল। সাদাত পশ্চিমের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রয়াসে গর্বের সাথে শাহকে বন্ধু ঘোষণা করার সময় মিশরে ইসলামি উগ্রপন্থীরা শাহর পতন ত্বরান্বিতকারী ইরানি বিপ্লবীদের বিভিন্ন সংবাদে উল্লসিত হত। ১৯৭৮-৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব ছিল সন্ধিক্ষণ। ধর্মকে আক্রমণের মুখে বলে মনে করা সারা বিশ্বের মুসলিমদের পক্ষে অনুপ্রেরণা। খোমেনির বিজয় দেখিয়েছিল, ধ্বংস ইসলামের নিয়তি নয়; শক্তিশালী সেক্যুলার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে পারে। কিন্তু বিপ্লব বহু পশ্চিমাকে ত্রাস ও হতাশায় ভরিয়ে তুলেছিল। যেন বর্বরতা আলোকনের বিরুদ্ধে জয় লাভ করেছে। বহু অপাদমস্তক সেক্যুলারের চোখে খোমেনি ও ইরান যেন ধর্মের সমস্ত ভ্রান্তি এবং এমনকি অশুভকেই—মূর্ত করে তুলেছিল—কারণ বিপ্লব সাধারণভাবে পশ্চিম ও বিশেষ করে আমেরিকার প্রতি বহু ইরানির অনুভূত ঘৃণা তুলে ধরেছিল।

১৯৭০-র দশকের গোড়ার দিকে ইরান যেন সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করে। আমেরিকান বিনিয়োগকারীরা ও ইরানি অভিজাত গোষ্ঠী শ্বেত বিপ্লবের কারণে সৃষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবাদে সমানভাবে বিপুল অর্থের অধিকারী হয়ে উঠেছিল। তেহরানে আমেরিকান দূতাবাস, এসপিওনাজের কেন্দ্রের চেয়ে (বিপ্লবীরা যেমন দাবি করেছিল) বরং ধনী আমেরিকানদের ধনী ইরানিদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার জায়গা ছিল।৪৯ তবে-আবার-কেবল অভিজাতগোষ্ঠীই লাভবান হয়েছিল। রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। সমাজের উচ্চ মহলে অনিয়ন্ত্রিত ভোগবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, পাতি বুর্জোয়া ও শহুরে দরিদ্রদের মাঝে দেখা দিয়েছিল বঞ্চনা ও দুর্নীতি। ১৯৭৩-৭৪ সালের তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর অত্যন্ত ধনী ব্যক্তি ছাড়া আর কারও বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় ব্যাপক সৃষ্টি হয়েছিল মূদ্রাস্ফীতির। এক মিলিয়ন লোক হয়ে পড়েছিল বেকার, বিদেশি পণ্যের অবাধ আগমনে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছে; ১৯৭৭ সাল নাগাদ মূদ্রাস্ফীতি এমনকি ধনীদেরও প্রভাবিত করতে শুরু করেছিল। এমনি অসন্তোষ ও হতাশার পরিবেশে দুটি প্রধান গেরিলা সংগঠন সক্রিয় হয়ে ওঠে, আমেরিকান সামরিক ব্যক্তি ও পরামর্শকদের হত্যা করতে থাকে। বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে মুনাফা লুটছিল বলে মনে হওয়ায় ইরানে আমেরিকান অভিবাসীদের ব্যাপারেও যথেষ্ট অসন্তোষ কাজ করছিল। এই বছরগুলোতেই শাহ’র সরকার আগের চেয়ে ঢের বেশি স্বৈরাচারী ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল।৫°

বহু বিরূপ ইরানি ভিন্নভাবে সংকটের প্রতি সাড়াদানকারী উলেমাদের শরণাপন্ন হয়েছে। কুমে সবচেয়ে প্রবীন মুজতাহিদ আয়াতোল্লাহ শরিয়তমাদারি শাসকগোষ্ঠীর সাথে যেকোনও ধরনের সংঘাতের বিরোধিতা করেন, যদিও ১৯০৬ সালের সংবিধানের পুনরুজ্জীবন দেখতে উদগ্রীব ছিলেন তিনি। সংবিধানের কঠোর প্রয়োগ ও শাসকগোষ্ঠীর বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার কারাবরণকারী আয়াতোল্লাহ তালেকানি মেহেদি বাযারগান ও আবোলহাসান বানি সদরের মতো সাধারণ সংস্কারকদের সাথে কাজ করেছেন, এঁরা ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র চাইলেও যাজকীয় শাসন দেখতে চাননি। তালেকানি যাজকগোষ্ঠীকে সরকারে সুবিধাজনক ভূমিকা দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না; তিনি নিশ্চিতভাবেই খোমেনির ক্যারিশম্যাটিক জুরিস্টের সরকার বেলায়েত-ই ফাকিহর দর্শনের সাথে একমত হননি।৫১ কিন্তু খোমেনি তখনও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অটল ও আপোসহীন প্রতিরোধের প্রতীক ছিলেন। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ফায়যিয়াহ মাদ্রাসার ছাত্ররা ১৯৬৩ সালে খোমেনির গ্রেপ্তারের বার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে এক বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। ভবনে আক্রমণ চালিয়ে পুলিস একজন ছাত্রকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে। সরকার মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়, এর নীরব শূন্য ক্যাম্পাস যেকোনও রকম অস্পষ্ট প্রতিবাদের প্রতি শাহ’র মৌলিক বিরোধিতা ও ধর্মের প্রতি তাঁর বৈরিতার প্রতীকী স্মারক হয়ে ছিল।৫২ জনপ্রিয় কল্পনায় ক্রমবর্ধমানহারে তিনি ধর্মের শত্রু, শহীদ হুসেইনের ঘাতক, এবং লোকে যাঁকে ইমাম সম্বোধন করে সেই খোমেনির শত্রু ইয়াযিদের মতো হয়ে উঠছিলেন।

১৯৭৭ সালের সূচনায় অবশ্য সরকার খানিকটা নরম হয়, এবং জনতার চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নিয়েছে বলে মনে হয়। জিমি কার্টার এর আগের বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁর মানবাধিকারের প্রচারণা ও ইরানের আদালত ও কারাগারের উপর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিরূপ প্রতিবেদন হয়তো শাহকে চলমান অসন্তোষের প্রতি কিছুটা ছাড় দিতে বাধ্য করে থাকতে পারে। তবে সত্যিকার অর্থে তেমন পরিবর্তন হয়নি, তবে সেন্সরশিপ বিধি শিথিল করায় সাহিত্যের এক প্রবল ধারা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের হতাশা তুলে ধরেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সরকারের হস্তক্ষেপের ফলে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ ছিল; কৃষকগণ কৃষিপণ্যের আমদানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে, পল্লী অঞ্চলে তা দারিদ্র্য বাড়িয়ে দিয়েছিল; ব্যবসায়ীরা মুদ্রাস্ফীতি ও দুর্নীতি নিয়ে ভাবিত ছিল; আইনবিদগণ সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা হ্রাসকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু তারপরও বিপ্লবের কোনও আহ্বান ছিল না। ইরানের অধিকাংশ উলেমা শরিয়াতমাদারির নেতৃত্ব অনুসরণ করছিলেন, প্রথাগত নীরবতার পথ অবলম্বন করে গেছেন তাঁরা। যাজক গোষ্ঠী নয়, বরং ইরানের লেখকগণই ১৯৭৭ সালে সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বাঙ্ময় প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছিলেন। ১০ থেকে ১৯শে অক্টোবর তেহরানের গ্যতে ইন্সটিটিউটে আনুমানিক ষাটজন নেতৃস্থানীয় ইরানি কবি ও লেখক হাজার হাজার প্রাপ্তবয়স্ক দর্শকের সামনে তাঁদের রচনা পাঠ করেন। সরকারের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা সত্ত্বেও সাভাক এই কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠানে বাধা দিতে যায়নি। ৫৪ মনে হচ্ছিল যেন সরকার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মেনে নিতে শিখছে।

কিন্তু নতুন এই কাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কবিতা সমাবেশের খুব বেশি দিন পরে নয়, শাহ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন, পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ৩রা নভেম্বর, ১৯৭৭, বেশ কয়েকজন পরিচিত ভিন্নমতাবলম্বীকে গ্রেপ্তার করা হয়, ইরাকে প্রায় নিশ্চিতভাবেই সাভাকের এজেন্টদের হাতে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু বরণ করেন খোমেনির ছেলে মুস্তাফা।৫৫ আরও একবার নিজেকে ইয়াযিদের ভুমিকায় স্থাপন করেছিলেন শাহ। খোমেনি ইতিমধ্যেই শিয়া আভা আবৃত হয়েছিলেন, নির্বাসিত গোপন ইমামের মতো লাগতে শুরু করেছিল তাঁকে; এবার ইমাম হুসেইনের মতো স্বৈরাচারী শাসকের হাতে তাঁর সন্তান মৃত্যু বরণ করেছেন। সারা ইরান জুড়ে জনতা প্রথাগত ঢঙে মুস্তাফা খোমেনির মৃত্যুতে শোক করার জন্যে কাঁদতে কাঁদতে বুক চাপড়ে সমবেত হয়েছিল। তেহরানে শোকপালনকরীদের উপর আক্রমণ চালায় পুলিস; ১৫, ১৬ ও ১৭ নভেম্বর তেহরানে কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে আরও ধরপাকড় ও মারধরের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত গণঅভ্যুত্থানের আলামত চোখে পড়েনি। নাজাফে খোমেনি, মুস্তাফাকে যিনি ‘চোখের মণি’ ডাকতেন, নীরব ছিলেন।

এদিকে ১৩ই নভেম্বর, ১৯৭৭ প্রেসিডেন্ট কার্টারের সাথে আলোচনার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান শাহ। প্রতিদিন আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ইরানি ছাত্ররা ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের সামনে শাহ’র উদ্দেশে শ্লোগান দেওয়ার জন্যে সমবেত হতে শুরু করে। এক আনুষ্ঠানিক ভোজ সভায় ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিশেষ সম্পর্কের গুরুত্বের উপর আবেগময় ভাষণ দেন কার্টার, ইরানকে ‘বিশ্বের উত্তাল এক কোণে স্থিতিশীলতার দ্বীপ’৫৬ আখ্যায়িত করেন তিনি। ৩১শে ডিসেম্বর ভারত সফর বিরতি দিয়ে ইরানে ঝটিকা সফরে তেহরানে যান কার্টার, এখানেও সরকারের প্রতি তাঁর সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কার্টার শাহ’র প্রতি তাঁর আস্থার কথা প্রকাশ করে গেছেন। তাঁর তেহরান সফর পবিত্র মহররম মাসের সাথে মিলে গিয়েছিল, যখন কারবালার ট্র্যাজিডি সবার মনে জ্বলজ্বল করতে থাকে; এই বছর খোমেনির কথা ভাবছিল সবাই: শাহ সবে মুস্তাফা খোমেনির প্রথাগত শোকের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষাণা করেছিলেন, সাধারণত মৃত্যুর চল্লিশ দিন পরে এটা অনুষ্ঠিত হত। এমনি ক্রান্তিকালে শাহ’র শাসনকে সমর্থন করার জন্যে বিশেষ সফর করে নিজেকে নিখুঁতভাবে মহাশয়তানের ভুমিকায় স্থাপন করে বসেন কার্টার।

বিপ্লব চলাকালে ও এর পরবর্তী সময়ে তাদের দেশকে শয়তানসুলভ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে শুনে আমেরিকানরা ধাক্কা খেয়েছিল। এমনকি যারা ১৯৫৩ সালের সিআইএ অভ্যুত্থানের পর থেকেই ইরানি জনগণের অনেকের মনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভের কথা জানত তারাও এই দানবীয় ইমেজারিতে বিতৃষ্ণা বোধ করেছে। আমেরিকার নীতি যত ভুলই হয়ে থাকুক, এভাবে নিন্দিত হওয়ার মতো সে নয়। এতে করে ইরানি বিপ্লবীদের সম্পর্কে ধর্মান্ধ, বিকারগ্রস্ত ও ভারসাম্যহীন বলে প্রচলিত ধারণাকেই যেন নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ পাশ্চাত্য জনগণ মহাশয়তানের ইমেজকে ভুল বুঝেছে। খৃস্টধর্মে স্যাটান এক মহাপরাক্রমশালী অশুভ চরিত্র, কিন্তু ইসলামে সে অনেক বেশি সামালযোগ্য। কোরান এমনকি এমনও আভাস দিয়েছে যে শেষ বিচারের দিনে শয়তানকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে, আল্লাহ’র সর্ববিজয়ী মহত্মের উপর এমননি তার আস্থা। যেসব ইরানি আমেরিকাকে ‘মহাশয়তান’ বলেছে, তারা আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দানবীয়ভাবে খারাপ বলছিল না, বরং আরও স্পষ্ট কিছু। জনপ্রিয় শিয়ামতবাদে প্রলুব্ধকারী শয়তান বরং চিরন্তনভাবে অদৃশ্য জগতের আধ্যাত্মিক মূল্য উপলব্ধিতে অক্ষম হাস্যকর এক চরিত্র। এক কাহিনীতে বলা হয়েছে মানবজাতির অধিকার নিয়ে আল্লাহ’র কাছে অভিযোগ করেছে সে, কিন্তু সহজেই তুচ্ছ উপহারে সামাল দেওয়া গেছে তাকে। পয়গম্বরদের বদলে বরং গণকদের নিয়েই বেশি সুখে থাকে শয়তান, বাজারই তার মসজিদ, গণস্নানাগারে সে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে, আল্লাহকে কামনা করার বদলে নারী ও মদ তালাশ করে।৫৮ প্রকৃতপক্ষেই নিরাময় অযোগ্যভাবে তুচ্ছ সে, বাহ্যিক (যাহির) বিশ্বের বলয়ে চিরকালের মতো বন্দি হয়ে গেছে, অস্তিত্বের আরও গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ মাত্রার অস্তিত্ব দেখতে অপারগ। বহু ইরানির চোখে মহাশয়তান আমেরিকা ছিল ‘মহাগুরুত্বহীনকারী।’ পশ্চিমের বার, ক্যাসিনো ও সেক্যুলারিস্ট রেওয়াজ উত্তর তেহরানের আমেরিকান রীতিকে মূর্ত করে যা স্বেচ্ছায় জীবনকে অর্থ প্রদানকারী একমাত্র বাস্তবতা গোপনকে (বাতিন) উপেক্ষা করে বলে মনে হয়। এছাড়াও, শয়তান আমেরিকা শাহকে প্রলুব্ধ করে ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ থেকে সরিয়ে এক উপরিগত সেক্যুলারিজমের জীবনে টেনে নিয়ে গেছে।৫৯

ইরানি শিয়াবাদ সবসময়ই দুটি আবেগে অনুপ্রাণিত ছিল: সামাজিক ন্যায়বিচার ও অদৃশ্য (আল-গায়িব)। শত শত বছর ধরে পাশ্চাত্যবাসী যেখানে যত্নের সাথে ইন্দ্রিয়জ অনুভূতিতে অনুভূত পার্থিব জগতের যৌক্তিক রীতির উপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে এসেছে, সেখানে অন্যান্য প্রাক আধুনিক জাতির মতো ইরানি শিয়ারা কাল্ট ও মিথ অনুপ্রাণিত এক গোপন (বাতিন) জগতের বোধ লালন করেছে। শ্বেত বিপ্লবের সময় ইরানিরা বিদ্যুৎ, টেলিভিশন ও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা লাভ করেছিল; কিন্তু দেশের ধর্মীয় পুনর্জাগরণ দেখিয়েছে যে, বহু লোকের কাছে এইসব বাহ্যিক (যাহিরি) সাফল্য স্রেফ যথেষ্ট ছিল না। আধুনিকায়ন অত্যন্ত দ্রুতগতির ও অনিবার্যভাবে উপরিগত ছিল। বহু ইরানি তখনও বাতিনের তৃষ্ণা বোধ করেছে, মনে করেছে এটা ছাড়া তাদের জীবনের কোনও মূল্য বা তাৎপর্য নেই। আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ উইলিয়াম বীম্যান যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, জীবনের বাস্তুগত তলে আটকা পড়ার অনুভূতি সম্পন্ন একজন ইরানি মনে করেছে তার আত্মা খোয়া গেছে। একটি খাঁটি অন্তস্থঃ জীবনের জন্যে প্রয়াস এখনও ইরানি সমাজের পরমমূল্য ধারণ করে, এত বেশি যে অন্য একজনকে সবচেয়ে সেরা প্রশংসা করতে গিয়ে বলতে পারে ‘তার অন্তর (বাতিন) ও বাহির (যাহির) একই রকম। ১৬০ আধ্যাত্মিকতার জোরাল অনুভূতি ছাড়া বহু ইরানি নিজেদের দিশাহারা মনে করেছে। শ্বেত বিপ্লবের সময় কারও কারও মনে বিশ্বাস জন্মেছিল যে বস্তুবাদ, ভোগ্যপণ্য, বিনোদনের বিদেশী কেতা ও বিদেশী মূল্যবোধ আরোপের ফলে তারা পাশ্চাত্য-আসক্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোৎসাহ সমর্থন পুষ্ট শাহকে যেন জাতির আধ্যাত্মিকতার উৎস ইসলাম ধ্বংসের জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হয়েছে। খোমেনিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন তিনি, ফায়যিয়াহ মাদ্রাসা বন্ধ করে দিয়েছেন, যাজকদের অপমান করেছেন, তাঁদের আয় হ্রাস করেছেন এবং ধর্মতত্ত্বের ছাত্রদের হত্যা করেছেন।

ইরানি বিপ্লব স্রেফ রাজনৈতিক ছিল না। নিশ্চিতভাবেই শাহ’র নিষ্ঠুর ও স্বৈরাচারী শাসন ও অর্থনৈতিক সংকট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে: সেগুলো ছাড়া অভ্যুত্থান হত না। কেবল শাহ’র কবল থেকে উদ্ধার লাভ করতেই আধ্যাত্মিক অস্থিরতা বোধ করেনি এমন বহু ইরানি সেক্যুলারিস্টও শেষ পর্যন্ত উলেমাদের সাথে যোগ দেবে; তাদের সমর্থন ছাড়া হয়তো বিপ্লব সফল হত না। তবে ধর্মকে বাতিল করে দেওয়া সেক্যুলারিস্ট রীতির বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ছিল এটা, এবং সাধারণ ইরানিরা ভেবেছিল জোর করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মহাশয়তান হিসাবে তুলে ধরার ভেতর দিয়েই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে এটা। সঠিক বা ভুলভাবে অনেকেই বিশ্বাস করেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উষ্ণ সমর্থন ছাড়া শাহ কখনওই এমন আচরণ করতেন না। পরিকল্পিতভাবে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নকারী সেক্যুলার রাজনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব বোধ করার কথা জানা ছিল তাদের; তারা জানতে পেরেছিল, বহু পশ্চিমা মনে করে কেবল যাহিরের প্রতি জোর দেওয়াই প্রশংসার্হ প্রয়োজন। এর পরিণাম, তারা যতদূর বুঝতে পেরেছিল, রাতের ফাঁকা সুখবাদী দক্ষিণ তেহরান। বহু আমেরিকানের ধার্মিক হওয়ার ব্যাপারে ইরানিরা সজাগ থাকলেও তাদের বিশ্বাস কোনও অর্থ প্রকাশ করে বলে মনে হয়নি। জিমি কার্টারের ‘ভেতর’ আর ‘বাহির’ ‘একরকম’ ছিল না। তারা বুঝতে পারেনি ১৯৭৮ সাল নাগাদ নিজ দেশের লোককে হত্যা করতে শুরু করেছেন এমন একজন শাসককে কীভাবে একজন প্রেসিডেন্ট সমর্থন করতে পারেন। ‘কার্টার শাহ’র সমর্থন করবেন এটা আমরা আশা করিনি, কারণ তিনি ধার্মিক মানুষ, মানবাধিকার রক্ষার দাবি তুলেছেন,’ বিপ্লবের পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আয়াতোল্লাহ হুসেইন মন্তেজেরি। ‘কেমন করে একজন ধার্মিক ক্রিশ্চান কার্টার শাহ’র পক্ষাবলম্বন করতে পারলেন?৬১

পবিত্র মুহররম মাসে নববর্ষের আগে আগে কার্টার শাহ’র শাসনকে চাঙা করে তুলতে তাঁর সাথে দেখা করেন যখন, চেষ্টা করলেও এর চেয়ে নিখুঁতভাবে নিজেকে খলনায়কের ভূমিকায় স্থাপন করতে পারতেন না তিনি। পরবর্তী উত্তাল বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার চরম কারণে পরিণত হয়েছিল। রাস্তার দেয়াল লিখন কার্টারকে ইয়াযিদের সাথে এক করে দেখেছে, শাহকে হুসেইন ও তাঁর ক্ষুদে সেনাদলকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পাঠানো সেনাপতি সীমার। রাস্তার এক ড্রয়িংয়ে খোমেনিকে মোজেস, শাহকে ফারাও হিসাবে হিসাবে আঁকা হতে দেখা গেছে, আর কার্টার হলেন ফারাও/শাহ’র পূজিত মূর্তি।৬২ মনে করা হয়েছিল যে আমেরিকা শাহকে দূষিত করেছে, এখন ক্রমবর্ধমানহারে শিয়া আলোকে সিক্ত খোমেনি বর্তমান অপবিত্র স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ইসলামি বিকল্প হিসাবে উপস্থিত হচ্ছিলেন।

১৯৭৮ সালের মুহররমের শেষে শাহ আবারও নিজেকে শিয়াদের প্রতিপক্ষ হিসাবে তুলে ধরলেন। ৮ই জানুয়ারি আধা সরকারী পত্রিকা এত্তেলাত খোমেনির বিরুদ্ধে একটি অপমানকর নিবন্ধ প্রকাশ করে, সেখানে তাঁকে ‘অ্যাডভেঞ্চারার, বিশ্বাসবর্জিত ও উপনিবেশবাদের সাথে সম্পর্কিত’ বলে উল্লেখ করা হয়। নিবন্ধে জোরের সাথে বলা হয়, তিনি অসচ্চরিত্র জীবন যাপন করেন, ব্রিটিশদের গুপ্তচর ছিলেন, এমনকি এখনও শ্বেত বিপ্লবকে খাট করতে উদগ্রীব বিট্রিশদের কাছ থেকে মাসোহারা নেন।৬৩ শাহর পক্ষে এই বিদ্রূপাত্মক ও অবিশ্বাস্য আক্রমণ ছিল মারাত্মক ভুল। পর দিন কুমের পথে-ঘাটে চার হাজার ছাত্র নেমে আসে: ১৯০৬ সালের সংবিধান প্রত্যাবর্তন, বাক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, ফায়যিয়াহ মাদ্রাসা খুলে দেওয়া ও খোমেনিকে ইরানে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়ার দাবি তোলে তারা। কিন্তু ওরা পেয়েছিল গণহত্যা। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি বর্ষণ করে পুলিস, এবং উলেমাদের মতে, সত্তর জন ছাত্র নিহত হয় (যদিও সরকার মাত্র দশ জন মারা গেছে বলে দাবি করেছিল)।[৬৪] ১৯৬৩ সালের দাঙ্গার পর এটাই ছিল ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন, শাহ’র জন্যে এটা ছিল শেষের সূচনা। উইলিয়াম বীম্যান যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, ইরানিরা অনেক কিছু সহ্য করতে পারলেও অপবিশ্বাসের একটি মাত্র কাজ ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয় ভাঙন ডেকে আনতে পারে। একবার এই সীমারেখা অতিক্রম করা হলে আর ফিরে যাবার উপায় থাকে না।৬৫ লক্ষ লক্ষ সাধারণ ইরানির কাছে কুমে সাভাককে মিছিলকারীদের উপর গুলি বর্ষণের নির্দেশ দিয়ে শাহ সেই রেখা অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। প্রবল ক্রোধ নিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের জবাব দিয়েছিল তারা, শুরু হয়েছিল বিপ্লবের।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বুদ্ধিজীবী, লেখক, আইনবিদ ও ব্যবসায়ীরা শাহ শাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। অবশ্য জানুয়ারি মাসে শিয়াহদের উপর এই প্রকাশ্য হামলার পর নেতৃত্ব উলেমাদের হাতে চলে যায়। হত্যাকাণ্ড এতটাই হতবুদ্ধিকর ছিল যে, এমনকি আয়াতোল্লাহ শরিয়তমাদারি পর্যন্ত তাঁর স্বভাবগত শান্তিবাদ ত্যাগ করেন, কঠোর ভাষায় এই গুলিবর্ষণের নিন্দা করেন তিনি। সারা দেশের উলেমাদের কাছে একটি সঙ্কেত পৌঁছে দেয় তা। কোনওকিছুই পরিকল্পিত বা আগে থেকে স্থির করা ছিল না। নাজাফ থেকে কোনও রকম কৌশলগত নির্দেশনা জারি করেননি খোমেনি। কিন্তু এত্তেলাতের নিবন্ধ প্রকাশের মুহূর্ত থেকেই অভ্যুত্থানের অদৃশ্য প্ররোচক ও অনুপ্রেরণায় পরিণত হয়েছিল তিনি। সংগ্রাম কোনও মৃত্যুর চল্লিশ দিন পরে অনুষ্ঠিত প্রথাগত শোকের দিনে কেন্দ্রিভূত হয়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে পরিণত হয়েছিল এগুলো, এই সময় আরও হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হত; এবং চল্লিশ দিন পরে শেষের শহীদদের স্মরণে লাগাতার মিছিল অনুষ্ঠিত হত। বিপ্লব অদম্য গতিবেগ অর্জন করেছিল। প্রতিটি বিক্ষোভের মধ্যবর্তী চল্লিশ দিন সময় নেতাদের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দিত, বিস্তারিত পরিকল্পনা বা প্রচারণা ছাড়াই নির্ধারিত সময়ে জানতা বুঝে যেত ঠিক কখন সমবেত হতে হবে।

এভাবে ১৮ই ফেব্রুয়ারি, কুম হত্যাকাণ্ডের চল্লিশ দিন পরে উলেমা ও বাজারিদের নেতৃত্বে শোকার্তদের মিছিল মৃতদের জন্যে শোক পালনের জন্যে রাস্তাঘাটে ভিড় করে নেমে আসে ইরানিরা। ছাত্রী, যাদের অনেকেই শাসকগোষ্ঠী থেকে নিজেদের পৃথক করার জন্যে বোরখা পরেছিল, আর বাজার থেকে আগত চাদরে ঢাকা নারীরা প্রায়ই মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছে, পুলিসকে যেন সরাসরি তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার চ্যলেঞ্জ করেছে। পুলিস গুলি করেছেও, ফলে আরও শহীদ হয়েছে। বিশেষ করে তাব্রিযের সংঘাত ছিল সহিংস। এখানে অন্তত একশো শহীদ প্রাণ হারিয়ে থাকতে পারে এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ছয়শো জনকে। মিছিল থেকে বের হয়ে সিনেমা হল, ব্যাংক ও মদের দোকানে আক্রমণ করেছে (মহাশয়তানের প্রতীক) তরুণরা, কিন্তু কোনও মানুষের উপর হামলা চালানো হয়নি।৬৬ চল্লিশ দিন পর, ৩০শে মার্চ, আরও একবার তাব্রিযের শহীদদের জন্যে শোক পালন করতে রাস্তায় নেমে আসে শোকপালনকারীরা। এইবার ইয়াযদ-এ মসজিদ থেকে বের হয়ে আসামাত্র আনুমানিক এক শো বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়। ৮ই মে, ইয়াযদের শহীদদের সম্মানে নতুন করে আবার মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।৬৭ রাজনৈতিক বন্দিতে ঠাসাঠাসি অবস্থা হয়েছিল জেলখানাগুলোর। মৃত্যুর সংখ্যা নিজ জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শাসকগোষ্ঠীর নগ্ন আগ্রাসন তুলে ধরেছে।

এটা ছিল চূড়ান্ত আবেগের নাটক। বিক্ষোভকারীরা ‘চারদিকে কারবালা, প্রত্যেক দিনই আশুরা’৮ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করত। শাহাদৎ বরণকারীদের জন্যে প্রযুক্ত শব্দ শহীদ-এর মানে ক্রিশ্চান ধর্মের ‘সাক্ষী’র মতো। মৃত্যুবরণকারী বিক্ষোভকারীরা অদৃশ্য আধ্যাত্মিক জগতের মূল্যবোধকে রক্ষা করতে ইমাম হুসেইনের মতো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্বের সাক্ষ্য বহন করছে, শাসকগোষ্ঠী যাকে লঙ্ঘন করার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনে হচ্ছে। লোকে বিপ্লব প্রসঙ্গে পরিবর্তনকারী ও পরিশুদ্ধকারী অভিজ্ঞতা হিসাবে কথা বলত; তাদের মনে হয়েছে ‘নিজেদের ও তাদের সমাজকে দুর্বল করে তোলা বিষ থেকে বিশুদ্ধ করে তুলছে তারা এবং সংগ্রামে আবার নিজেদের মাঝে ফিরে যাচ্ছে। এটা স্রেফ রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহারকারী কোনও বিপ্লব ছিল না। বিশেষ করে দরিদ্র ও অশিক্ষিতদের মাঝে শিয়া পুরাণই একে অর্থ ও পথনির্দেশ দিয়েছে, আরও কঠোর সেক্যুলারিস্ট আদর্শের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অটল থাকত তারা।৬৯

জুন ও জুলাই মাসে অবাধ নির্বাচন ও বহুদলীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে শাহ কিছু ছাড় দেন। এই মাসগুলোয় বিক্ষোভকারীরা অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিল। একটা বিরতি চলছে বলে মনে হচ্ছিল, এপর্যন্ত শোক মিছিলে যোগ না দিলেও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কেবল মৌখিক প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভকারীদের সমর্থন দিয়ে আসা পাশ্চাত্য শিক্ষিত সেক্যুলারিস্ট ও বুদ্ধিজীবীরা ধরে নিয়েছিল যে যুদ্ধে জেতা গেছে। কিন্তু ১৯শে আগস্ট, ১৯৫৩ সালের পাহলবী বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পঁচিশতম বার্ষিকীতে আবাদানের রেক্স সিনেমায় এক অগ্নিসংযোগের ঘটনায় চারশো মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ঘটনার জন্যে সাথে সাথে সাভাককে দায়ী করা হয়। দশ হাজার শোককারী নিমেষে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেয়, ‘শাহর মৃত্যু চাই! তাকে পুড়িয়ে মারো!’ শ্লোগান দিতে থাকে তারা। ওয়াশিংটন, লস অ্যাঞ্জেলিস ও দ্য হেগে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভের আয়োজন করে ইরানি ছাত্ররা। শাহ আরও ছাড় দেন: মজলিসের বিতর্ক আরও মুক্ত হয়, শৃঙ্খলাপূর্ণ বিক্ষোভের অনুমতি দেওয়া হয়, কিছু সংখ্যক ক্যাসিনো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং আবার ইসলামি ক্যালেন্ডার চালু করা হয়।৭১

কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। রমযানের শেষ সপ্তাহে মুসলিমদের সাধারণত মসজিদের রাত্রি জাগরণে ব্যস্ত থাকার সময় চৌদ্দটি ইরানি শহরে বিক্ষোভ চলে, এইসময় পঞ্চাশ থেকে একশো জন লোকের প্রাণহানি ঘটে। ৪ঠা সেপ্টেম্বর, রমযানের শেষ দিনে তেহরানে এক বিশাল শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। জনতা রাস্তায় নামাজের ভঙ্গিতে নত হয়, সৈনিকদের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেয় তারা। এই প্রথমবারের মতো গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকে পুলিস। এই পর্যায়ে-খুবই তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন-মধ্যবিত্ত শ্রেণী যোগ দিতে শুরু করে। মিছিলকারীদের একটা ছোট দল কিছু আবাসিক এলাকায় মিছিল করে এগোনোর সময় চিৎকার করে বলতে থাকে: ‘স্বাধীনতা! মুক্তি! এবং ইসলামি সরকার!’ ৭ই সেপ্টেম্বর, উত্তর তেহরান থেকে পার্লামেন্ট ভবনের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায় এক বিশাল মিছিল, খোমেনি ও শরিয়তির ছবিঅলা প্ল্যাকার্ড ছিল তাদের হাতে, পাহলভী বংশের অবসান ও ইসলামি সরকারের দাবি করছিল তারা।এই শরিয়তি, বাযারগান ও বানি সদরের মতো সাধারণ চিন্তকগণ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অভিজাতগোষ্ঠীকে আধুনিক ইসলামি শাসনের সম্ভবনা সম্পর্কে প্রস্তুত করেছিলেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি খোমেনি থেকে ভিন্ন হলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদারপন্থীরা বুঝতে পারছিল যে তৃণমূল পর্যায়ে সমর্থন রয়েছে তাঁর তাদের পক্ষে যা কোনওদিনই অর্জন করা সম্ভব নয়, শাহ থেকে নিস্তার পেতে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে প্রস্তুত ছিল তারা। সেক্যুলারিস্ট শাসন ইরানে মহা বিপর্যয়কর ছিল, ভিন্ন কিছুর জন্যে তৈরি ছিল তারা।

মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরিত্যাগ করার পর শাহ’র আর কোনও আশাই ছিল না। নিশ্চয়ই বিপদ টের পেয়েছিলেন তিনি। ৮ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার ভোর ৬:০০ টায় সামরিক আইন জারি করা হয়, সকল মহাসমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে সেদিন সকালে আরেকটি শান্তিপূর্ণ র‍্যালিতে যোগ দিতে জালেহ স্কোয়ারে সমবেত হওয়া বিশ হাজার বিক্ষোভকারীর একথা জানা ছিল না। তারা সভা ভাঙতে অস্বীকৃতি জানালে সৈনিকরা গুলি বর্ষণ করে, ফলে সম্ভবত নয় শো লোক প্ৰাণ হারায়। এই হত্যাকণ্ডের পর জনতা মহাক্ষিপ্ত হয়ে পথে পথে ব্যারিকেড তৈরি করে দালানকোঠায় আগুন ধরিয়ে দেয়, এদিকে ট্যাংক থেকে তাদের উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকে সৈন্যরা।৩ ১০ই সেপ্টেম্বর, রোববার, সকাল ৮:০০টায় প্রেসিডেন্ট কার্টার ক্যাম্প ডেভিড থেকে শাহকে ফোন করে তাঁর প্রতি সমর্থনের নিশ্চয়তা দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউস এই ফোনালাপ অনুষ্ঠানের কথা নিশ্চিত করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার বিশেষ সম্পর্কের কথা আবার নিশ্চিত করা হয়। বলা হয় যে, জালেহ স্কয়ারে প্রাণহানির জন্যে প্রেসিডেন্ট দুঃখ প্রকাশ করলেও তিনি শাহ কর্তৃক সদ্য সূচিত রাজনৈতিক উদারীকরণ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।৭৪

কিন্তু জালেহ হত্যাকাণ্ডের পর এমনকি মহাশয়তানের সমর্থনও আর শাহকে রক্ষা করতে পারত না। তেল শ্রমিকরা এবার ধর্মঘটে যোগ দিল; এবং অক্টোবরের শেষ নাগাদ আগের তুলনায় তেল উৎপাদন ২৮ শতাংশ হ্রাস পায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নীরব থাকা গেরিলা গ্রুপগুলো আবার সামরিক নেতা ও সরকারের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে শুরু করে। ৪ঠা নভেম্বর ছাত্ররা তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ থেকে শাহ’র মূর্তি টেনে নামায়: ৫ই নভেম্বর বাজার বন্ধ হয়ে যায়, ছাত্ররা ব্রিটিশ দূতাবাসে হামলা করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের অফিস, সিনেমা হল ও মদের দোকান বন্ধ হয়ে যায়।৫ এই দফা সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করেনি।

এই সময়ের ভেতর ইরাকি সরকার তেহরানের চাপের প্রতি সাড়া দিয়ে খোমেনিকে নাজাফ থেকে বাহিষ্কার করেছিল, প্যারিসে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। এখানে সম্প্রতি পুনর্জাগরিত ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতারা তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন, এক বিবৃতিতে খোমেনি এবং তাঁরা উভয়পক্ষই ১৯০৬ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকার কথা বলেন। ২রা ডিসেম্বর, মুহররম মাস এগিয়ে আসার সাথে সাথে রীতি মোতাবেক আবেগী নাটক রাওদাহ ও হুসেইনের শাহাদৎ বাষিকী পালনের অনুষ্ঠানের বদলে জনগণের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করা উচিত বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন খোমেনি। এইসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের রেডিক্যাল সম্ভাবনা সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে গিয়েছিল। মুহররমের প্রথম দিন রাতে লোকেরা সরকারের কার্য্য উপেক্ষা করে শাহাদৎ বরণে প্রস্তুতির প্রতীক হিসাবে শাদা কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় ছুটাছুটি করতে থাকে। অন্যরা ছাদ থেকে লাউডস্পিকারে শাহ বিরোধী শ্লোগান দিতে থাকে। বিবিসি দাবি করে যে কেবল এই কয়েক দিনের পুলিস ও সেনাবাহিনীর হাতে সাত শো লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল।৭৬ ৮ই ডিসেম্বর তেহরানের উত্তরে বেহেশত-ই যাহরা কবরস্থানে সমবেত হয় ছয় হাজার মানুষ, এখানে বহু শাহীদকে কবর দেওয়া হয়েছিল, ‘শাহর মৃত্যু চাই!’ শ্লোগান দিচ্ছিল তারা। ইস্ফাহানে বিশ হাজার মানুষ রাস্তায় মিছিল করে, তারপর ব্যাংক, সিনেমা হল ও আমেরিকান টেকনিশিয়ানদের আবাস বিভিন্ন ফ্ল্যাটে আক্রমণ চালায়। ৯ই ডিসেম্বর, আশুরার পূর্বক্ষণে সদ্য কারামুক্ত আয়াতোল্লাহ তালেকানি এক জাঁকাল মিছিলের নেতৃত্ব দেন, মিছিলটি টানা ছয় ঘণ্টা তেহরানের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে: ৩০০,০০০ থেকে দেড় মিলিয়ন লোক তাতে অংশ নেয়, নীরবে চারজন চারজন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হেঁটে যায়। তাব্রিয, কুম, ইস্ফাহান ও মাশাদেও শান্তিপূর্ণ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।৭৭

খোদ আশুরার দিন তেহরানে আরও বড় আকারের মিছিল অনুষ্ঠিত হয়, আট ঘণ্টা স্থায়ী হয়ে সেটি, প্রায় দুই মিলিয়ন লোক তাতে অংশ নিয়েছিল। মিছিলকারীরা সবুজ, লাল ও কালো পতাকা (যথাক্রমে ইসলাম, শাহাদৎ ও শিয়ার প্রতীক) বহন করে; বিক্ষিপ্তভাবে ‘ইরানের স্বৈরাচারকে আমরা খুন করব!’ ও ‘ইরানে ইয়াঙ্কি শক্তির নাশ ঘটাব!’ লেখা ব্যানারও ছিল সেখানে। আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় ঢের বেশি ঐক্যবদ্ধ ইরানি জনগণ পাহলভী রাষ্ট্র থেকে নিজেদের উদ্ধার করতে পারবে, এমন একটা আস্থা ক্রমশঃ বেড়ে উঠছিল।৮ অনেকেরই মনে হয়েছে যেন ইমাম হুসেইন স্বয়ং সেই আশুরায় তাদের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গোপন ইমামের মতো খোমেনি দূর থেকে নির্দেশনা দিচ্ছেন তাদের।” বিক্ষোভ শেষে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়: খোমেনির প্রতি ইরানের নতুন নেতা হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়, শাহ’র পতন না ঘটা পর্যন্ত ইরানিদের প্রতি ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়।৮০

তিন দিন পর সেনাবাহিনী শাহপন্থী মিছিল আয়োজনের চেষ্টা চালায়, বিপ্লবী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘাত আরও সহিংস রূপ নেয়। সাংবিধানিক সরকার গঠনের লক্ষ্যে সুপরিচিত উদারপন্থী শাহপুর বখতিয়ারকে নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার শেষ চেষ্টা করেন শাহ। সাভাক ভেঙে দেওয়ার, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দান এবং তাঁর অর্থনৈতিক ও বিদেশ নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এসব হয়েছিল এক বছর দেরিতে। চাপের মুখে জনগণ এত অসংখ্য প্রতিশ্রুতির কথা শুনেছিল যে, এইসব আর বিশ্বাস করতে পারেনি। ৩০শে ডিসেম্বরকে (ইসলামি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কুম হত্যাকাণ্ডের প্রথম বার্ষিকী ছিল) শোক দিবস ঘোষণা করেন খোমেনি। মাশাদ, তেহরান ও কাযরিনে আরও হত্যার ঘটনা ঘটে; শেষের এই শহীদদের ছবি খোমেনির পাশপাশি প্রদর্শিত হচ্ছিল। ২৩শে ডিসেম্বর মাশাদে সৈনিকরা খোমেনির ছবি ছিঁড়ে ফেললে সংঘর্ষ বাধে, নিহত হয় বারজন সাধারণ নাগরিক। সঙ্গে সঙ্গে অকুস্থলে সমবেত হয় জনগণ, সৈন্যদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তারা, জীবন উৎসর্গে প্রস্তুত তরুণরা ছিল তাদের নেতৃত্বে। সেনাবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে, জনতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে মাটি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে তারা। পরের দিন এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে লক্ষ লক্ষ লোক রাস্তায় নেমে আসে।

মধ্য জানুয়ারির দিকে সবকিছুর অবসান ঘটে। প্রধানমন্ত্রী বখতিয়ার শাহ’র বিদায় নিয়ে আলোচনা করেন, মুখ রক্ষা করতে একে সাময়িক বলে ঘোষণা করা হয়। রাজ পরিবার মিশরে চলে যায়, তাদের স্বাগত জানান সাদাত। বখতিয়ার রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দান, সাভাক বিলোপ, ইসরায়েল ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে তেল বিক্রিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন ও উল্লেখযোগ্য সামরিক ব্যয় হ্রাসের ঘোষণা দিয়ে বিপ্লব ঠেকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। জনতা, তাদের ভাষায়, ইমামের প্রত্যাবর্তনের জন্যে ফেটে পড়ছিল। ১লা ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯ খোমেনিকে ফিরে আসার অনুমতি দিতে বাধ্য হন বখতিয়ার।

তেহরানে খোমেনির প্রত্যাবর্তন ছিল বিশ্বকে চিরতরে বদলে দিয়েছে বলে মনে হওয়া বাস্তিলের পতনের মতো সেইসব প্রতীকী ঘটনার মতো। ইরান ও ইরানের বাইরের অঙ্গীকারাবদ্ধ সেক্যুলারিস্টদের কাছে এটা ছিল এক অন্ধকার মুহূর্ত, যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে কুসংস্কারের মহাবিজয়। কিন্তু ইসলাম নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে ভেবে ভীত সুন্নি বা শিয়া নির্বিশেষে বহু মুসলিমের কাছে এটা ছিল এক আলোকিত পুনর্জাগরণ। কোনও কোনও ইরানি শিয়ার কাছে খোমেনির প্রত্যাবর্তনকে অলৌকিক ঘটনার মতো মনে হয়েছে; অনিবার্যভাবে গোপন ইমামের অতীন্দ্রিয় প্রত্যাবর্তনের মতো মনে হয়েছে। তিনি তেহরানের রাস্তায় দিয়ে যাওয়ার সময় জনতা ‘ইমাম খোমেনি’র নামে শ্লোগান দিয়েছে, ন্যায়বিচারের এক নতুন সূচনার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল তারা। আয়াতোল্লাহ শরিয়তমাদারির মতো প্রবীন মুজতাহিদগণ ইমাম খেতাবের ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, খোমেনি গোপন ইমান নন দাবি করে সরকারীভাবে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারী নীতি যাই হোক না কেন, লক্ষ লক্ষ ইরানি জনতার কাছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খোমেনি ইমামই ছিলেন। তাঁর জীবন ও ব্রত স্পষ্টভাবেই আদতে ইতিহাসে ঐশীসত্তার উপস্থিতি ও সক্রিয় থাকার প্রমাণ মেলে। খোদ বিপ্লবের মতো খোমেনি যেন কোনও এক প্রাচীন মিথকে বাস্তবতায় পরিণত করেছিলেন।

খোমেনির প্রত্যাবর্তনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাহা হেজাযি একটি কবিতা প্ৰকাশ করেছিলেন যেখানে বহু ইরানির সাগ্রহ প্রত্যাশা ফুটে উঠেছে: ‘ইমামের প্রত্যাবর্তনের দিন’ এক সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের প্রত্যাশা করেছে। কেউ আর কখনও মিথ্যা বলবে না, চোরের হাত থেকে বাঁচতে দরজা আটকে রাখার দরকার হবে না, সবাই মিলেমিশে খাবে:

ইমামকে ফিরতেই হবে…
যেন ন্যায় আবার সিংহাসনে আসীন হতে পারে,
যাতে অশুভ, বিশ্বাসঘাতকতা আর ঘৃণা
চিরকালের জন্যে মুছে যায় পৃথিবী থেকে।
ইমাম যখন ফিরে আসবেন,
ইরান-এই বিধ্বস্ত, আহত মাতা-
চিরকালের জন্যে মুক্তি পাবে
স্বেচ্ছাচার ও অজ্ঞতা এবং লুটপাট,
অত্যাচার ও বন্দিত্বের শৃঙ্খল থেকে।৮২

পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) একটি হাদিস উদ্ধৃত করতে পছন্দ করতেন খোমেনি, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরার পথে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদে প্রত্যাবর্তন করছেন তিনি; শারীরিক, রাজনৈতিক যুদ্ধ নয় বরং নিজেকে জয় ও ন্যায়বিচারের মূল্যবোধ ও সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার অনেক কঠিন, জটিল ও কষ্টকর সংগ্রাম। তেহরানে ফেরার পর খোমেনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন যে ছোট জিহাদ শেষ হয়েছে এবার, অন্তহীন বড় জিহাদের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে।

*

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌলবাদী পুনর্জাগরণ ১৯৭০-র দশকের শেষের দিকে এতখানি নাটকীয় ছিল না। আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টদের এতটা চরম পন্থা বেছে নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। ইহুদিদের মতো তারা তখনও হলোকাস্ট ও গণহত্যার স্মৃতিতে তাড়িত হচ্ছিল না, কিংবা মুসলিমদের মতো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনেরও শিকার ছিল না। আধুনিক সেক্যুলার সংস্কৃতি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করেছে তারা, কিন্তু তাদের নেতারা অন্তত সমৃদ্ধি ও সাফল্য উপভোগ করেছেন। এটাই পরে তাদের অন্যতম সমস্যা প্রমাণিত হবে। বহিরাগত হিসাবে নিজেদের বিশ্বাস সত্ত্বেও আমেরিকায় প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীরা বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র বেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, শাস্তির ভীতি ছাড়াই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে পারছিল তারা এবং নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করছিল। তা সত্ত্বেও ১৯৭০-র দশকের শেষ নাগাদ, আমরা যেমন দেখেছি, মৌলবাদীরা তাদের বিগত পঞ্চাশ বছরের নীতি অনুযায়ী সমাজ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করার বদলে আসলে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠা উচিত বলে মনে করছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, একটা প্রভাব সৃষ্টি করে আমেরিকাকে ফের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার মতো সুযোগ তাদের রয়েছে। এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, পারিবারিক মূল্যবোধ, গর্ভপাত ও ধর্মীয় শিক্ষার মতো বিভিন্ন ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য ইভাঞ্জেলিকাল ভোটার সংগঠিত করা সম্ভব। প্রাচীন ভীতি রয়ে গেলেও নতুন আস্থাও সৃষ্টি হয়েছে।

এই পুনর্জাগরিত মৌলবাদের প্রতীক ছিল জেরি ফলওয়েলের নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মরাল মেজরিটি। অবশ্য খোদ মৌলবাদীদের তরফ থেকে নয় দলটির মূল অনুপ্রেরণা এসেছিল ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক অ্যাকশন কমিটি গঠনকারী তিনজন পেশাদার ডানপন্থী সংগঠকের কাছ থেকে। রিচার্ড ভিগনেরি, হাওয়ার্ড ফিলিপস ও পল ওয়েরিচ রিপাবলিকান পার্টির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন, এমনকি উদারপন্থী রিচার্ড শউইকারকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রানিং মেট হিসাবে বেছে নেওয়া রোনাল্ড রেগান হতেও নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন তাঁরা। প্রতিরক্ষা ও অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ হ্রাসের মতো বিভিন্ন ইস্যুতে রক্ষণশীল হওয়ায় ১৯৬০-র দশকে আমেরিকার সরকারী ও বেসরকারী জীবনে অনুপ্রবেশ করা নৈতিক ও সামাজিক উদারবাদের বিরোধিতার লক্ষ্যে একটি নতুন রক্ষণশীল দল গঠন করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। ইভাঞ্জেলিকাল ও মৌলবাদী প্রটেস্ট্যান্টদের শক্তি লক্ষ করেছিলেন তাঁরা এবং জেরি ফলওয়েলকেই তাদের প্রয়োজন মেটানোর উপযুক্ত মনে করেছেন। আগে থেকেই তাঁর নিজস্ব সমাবেশ, লিবার্টি কলেজ ও টেলিভিশন দর্শক ভিত্তিক এলাকা ছিল।৮৩ মরাল মেজরিটিতে প্রধান হয়ে ওঠা টিম লাহাই ও গ্রেগ ডিক্সনের মতো মৌলবাদীগণ ও সুপার চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, উল্লেখযোগ্য স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেছেন আর কোনও গোষ্ঠী থেকে কোনও রকম নিন্দার ভয় করতেন না তাঁরা। আগে থেকেই অন্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল তাদের: তাঁদের প্রায় সবাই ব্যাপ্টিস্ট ও ব্যাপ্টিস্ট বাইবেল সোসায়েটির ফেলোশিপের সদস্য ছিলেন।

মরাল মেজরিটি নিজেকে স্রেফ মৌলবাদীদের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখেনি। নেতৃবৃন্দ জাতিগত ও রাজনৈতিক ইস্যুতে দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল আছে এমন অন্য লোকদের সাথেও সহযোগিতা করতে চেয়েছেন ও আমেরিকার সকল রক্ষণশীলের জন্যে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চেয়েছেন। নতুন গ্রুপটির তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করতে হলে সমমনা রোমান ক্যাথলিক, পেন্টাকোস্টালিস্ট, মরমন, ইহুদি ও সেক্যুলারিস্টদের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল, কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ছিল ইভাঞ্জেলিকাল প্রটেস্ট্যান্ট।৮৪ প্রথমবারের মতো বাস্তবভিত্তিক বিবেচনায় চালিত হয়ে মৌলবাদীরা তাদের বিচ্ছিন্নতাকে একপাশে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল, ছিটমহল ছেড়ে আলিঙ্গন করেছিল আধুনিক জীবনের বহুত্ববাদকে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন ঘটেছিল। ফলওয়েল, লাহাই, ডিক্সন ও বব বিলিংটন মৌলবাদী ছিলেন, কিন্তু পল ওয়েরিচ ছিলেন ইহুদি ও হাওয়ার্ড ফিলিপস ও ভিগনেরি ছিলেন ক্যাথলিক। এই বহুত্ববাদ তাঁদের কিছু মৌলবাদী সমর্থন নষ্ট করেছিল: উদাহরণ স্বরূপ, দ্বিতীয় বব জোন্স ফলওয়েলকে ‘আমেরিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি৮৫ আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু আসলে মরাল মেজরিটির সাধারণ সমর্থন প্রধানত প্রটেস্ট্যান্টই ছিল। তৃণমূল সহানুভূতি কেন্দ্ৰিভূত ছিল দক্ষিণে, ডব্লুএএসপি বৃত্তের বাইরে আন্দোলনের তেমন একটা আবেদন ছিল না। রক্ষণশীল ক্যাথলিকরা মরাল মেজরিটির গর্ভপাত ও সমকামীদের অধিকার ও স্বাধীন স্কুলগুলোর কর অবকাশ সংক্রান্ত অবস্থানে সমর্থন করতে পারলেও অনেকেই মৌলবাদীদের রোমান ক্যাথলিকবাদের প্রতি ঘৃণার কথা ভুলতে পারেনি। একইভাবে ইহুদি, কৃষ্ণাঙ্গ ব্যাপ্টিস্ট ও পেন্টাকোস্টালিস্টরা আন্দোলনের প্রথমসারির নেতা ও পৃষ্ঠপোষকের বর্ণবাদে বিতৃষ্ণা বোধ করবে। উদাহরণ স্বরূপ, সিনেটর জেসি হেলমস সিভিল রাইটস আন্দোলনের উগ্র বিরোধী ছিলেন। ৬

মরাল মেজরিটির বার্তা নতুন ছিল না। উদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্যে যুদ্ধ করছিল তা। সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সভ্যতাকে অবশ্যই ধর্মীয় হওয়ারতে হবে বলে নিশ্চিত ছিল এবং এর নীতিমালা হবে বাইবেল ভিত্তিক। বর্তমানে আমেরিকা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুব উপকূলে কেন্দ্রিভূত একটি সেক্যুলার অভিজাতগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ফলওয়েলের ভাষায় এই উদারবাদীরা ‘নীতিহীন সংখ্যালঘুতে’ পরিণত হয়েছিল। রক্ষণশীলদের নিজেদের প্রতিক্রিয়াশীল, প্রান্তিক গ্রুপ হিসাবে কল্পনা করা ঠিক হবে না। প্রকৃতপক্ষে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করে, অবশ্যই তাদের প্রথাগত মূল্যবোধ রক্ষা করতে হবে। ‘আমরা কোটি কোটি-আর ওরা মাত্র কয়েক জন,’ দাবি করেছেন টিম লাহাই।৮৭ ‘প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের সাথে মিলে এই দেশ চালানোর মতো যথেষ্ট ভোট আমাদের আছে,’ দর্শকদের বলেছেন প্যাট রবার্টসন। ‘আর লোকে যখন বলে, “আমাদের যথেষ্ট হয়েছে,” আমরা তখন ক্ষমতা নিতে যাচ্ছি।’৮৮

১৯৭০ দশকের শেষ ও ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে কিছু মৌলবাদী পুরোনো প্রিমিলেনিয়াল দুঃখবাদের পরিমার্জনা শুরু করেছিল। বিশ্ব সামগ্রিকভাবে অভিশপ্ত, কিন্তু ক্রিশ্চানদের বিশ্বকে ইভাঞ্জেলাইজ করার, গস্পেলের বাণী প্রচার ও একে যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করার দায়িত্ব ছিল। ক্রিশ্চানরা তৎপর হলে পরমানন্দের আগেই আমেরিককে উদ্ধার করা যেতে পারে। আমাদের দেশের কোনও আশা আছে?’ ১৯৮০ সালে ওল্ড টাইম গস্পেল আওয়ারে প্রশ্ন রেখেছিলেন ফলওয়েল:

আমি তাই মনে করি। আমরা যেভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখি, প্রার্থনা করি, ক্রিশ্চান হিসাবে আমরা যেভাবে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছি, যেটা কিনা ইচ্ছামাফিক হত্যা, আমরা যেভাবে পর্নগ্রাফির বিরুদ্ধে, মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি, আমেরিকায় ঐতিহ্যবাহী পরিবার ব্যবস্থার ভাঙন, সমকামীদের বিয়ের পক্ষাবলম্বনের বিরুদ্ধে যেভাবে আমরা অবস্থান নিয়েছি, এবং আমরা যেভাবে এই দেশটি যাতে টিকে থাকতে পারে, আর আমাদের সন্তানরা যাতে আমাদের মতো আমেরিকাকে চিনতে পারে সেজন্যে শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছি…আমার মনে হয় ঈশ্বর আরও একবার আমেরিকাকে আশীর্বাদ করার মতো আশা আছে।৮৯

পঞ্চাশ বছরের নীরবতার পর নিউ ক্রিশ্চান রাইট হিসাবে পরিচিতি লাভ করতে যাওয়া মৌলবাদীরা আক্রমণে চলে গিয়েছিল, কিন্তু যত কিছুর পক্ষে ছিল তার চেয়ে বেশি বিষয়ের বিরোধিতা করেছে তারা। সকলে মরাল মেজরিটিকে বা এমনকি এর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দেয়নি। কিন্তু এই নতুন উগ্র ক্রিশ্চানরা ছিল গর্ভপাত বিরোধী, সমকামীদের অধিকারের বিরোধী, মাদক বিরোধী। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যেকোনও রকমের দাঁতাতের বিরোধিতা করেছে তারা, দেশটিকে সবসময়ই তারা শয়তানি সাম্রাজ্য মনে করেছে। টেলিভেঞ্জালিস্ট জেমস রবিসনের চোখে, [ক্রাইস্টের] প্রত্যাবর্তনের আগে শান্তির যে কোনও শিক্ষা ধর্মদ্রোহীতা…ঈশ্বরের বাণী বিরোধী; এটা অ্যান্টিক্রাইস্ট।৯০ মরাল মেজরিটি ও নিউ ক্রিশ্চান রাইটের এজেন্ডা বর্জনবাদী ছিল, আমেরিকাকে গ্রাস করার হুমকি সৃষ্টিকারী আসন্ন অশুভের বিরুদ্ধে ক্রুসেড।

পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের আলোকে যৌনতার উপর গুরুত্ব আরোপ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। নিউ ক্রিশ্চান রাইট ঠিক ইসলামপন্থীদের মতোই নারীর অবস্থান নিয়ে ভাবিত ছিল, কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ঢের বেশি ভয়ার্ত ছিল। নারী স্বাধীনতার আন্দোলন মৌলবাদী নারী-পুরুষকে সমানভাবে ত্রাসে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। মরাল মেজরিটির অন্যতম রোমান ক্যাথলিক নেতা ফিলিস শ্যাফির চোখে নারীবাদ একটা ‘রোগ,’ বিশ্বের সকল দুর্গতির কারণ। ইভ ঈশ্বরের অবাধ্য হয়ে নিজ মুক্তি দাবি করার পর থেকেই নারীবাদ এই পৃথিবীতে পাপ এবং এর সাথে ‘ভয়, রোগ, বেদনা, ক্রোধ, ঘৃণা, বিপদ, সহিংসতা ও সব ধরনের কদর্যতা বহন করে এনেছে। প্রস্তাবিত সমঅধিকারের সংশোধনী সরকারের কর বৃদ্ধি, সোভিয়েত কায়দার নার্সারি প্রতিষ্ঠা ‘ও আমাদের জীবনের অবশিষ্ট সমস্ত দিকের ফেডারালাইজেশনের’৯২ ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু না। বেভারলি লাহাইয়ের চোখে নারীবাদ ‘অসুস্থতার চেয়েও বেশি কিছু’; মার্ক্সবাদী মানবতাবাদীদের শিক্ষা ভিত্তিক ‘মৃত্যুর দর্শন এটা… রেডিক্যাল নারীবাদীরা আত্মধ্বংসী; তারা গোটা একটা সভ্যতার মরণ ডেকে আনার চেষ্টা করছে।’ এখন স্বামীদের মধ্যমঞ্চে আনার জন্যে সক্রিয় হওয়া ও নিজেদের নারীসুলভ আত্মসউৎসর্গের শিক্ষায় নতুন করে শিক্ষা লাভ করা ক্রিশ্চান নারীর দায়িত্ব। ‘আমাদের সমাজকে রক্ষা করা’, ‘সভ্যতা ও মানবজাতিকে একবিংশ শতাব্দীতে নিয়ে আসা’ তাদের দায়িত্ব।” মৌলবাদীদের কল্পনাকে দীর্ঘদিন ধরে তাড়া করে আসা অন্যান্য অশুভের সাথে নারীবাদের সম্মিলন ষড়যন্ত্রভীতিরই প্রমাণ। সমাজের অখণ্ডতা ও এমনকি স্থায়ীত্বকেও নারীদের প্রথাগত অবস্থানের সাথে সম্পর্কিত করেছে তারা।

প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদী ও অধিকাংশ গোষ্ঠীর ক্রিশ্চান রক্ষণশীলরা যেন সেক্যুলার মানবতাবাদের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের নপুংসক মনে করেছিল বলে মনে হয়। পুরুষের অক্ষমতা নিয়ে বেশি গভীরভাবে চিন্তিত মনে হয়েছে তাদের। টিম ও বেভারলি লাহাই তাঁদের বেস্ট সেলিং সেক্স ম্যানুয়াল দ্য অ্যাক্ট অভ ম্যারিজ: দ্য বিউটি অভ সেক্সুয়াল লাভ (১৯৭৬)-এ দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, আধুনিক পুরুষ ‘আগের চেয়ে নিজেদের পৌরুষ সম্পর্কে কম নিশ্চিত’। পুরুষরা অক্ষম, যৌনতার ক্ষেত্রে সমস্যাক্রান্ত, স্ত্রীদের সন্তুষ্ট করার ব্যাপারে বা অন্য পুরুষের সাথে তুলনায় নিজেদের দক্ষতায় উদ্বিগ্ন।৯৪ এর তুলে ধরে নারীর আত্ম-প্রতিষ্ঠা। এমনকি মৌলবাদী নারীরা পর্যন্ত এই সাংস্কৃতিক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে; ফলে পুরুষরা ‘মেয়েলী’ বা এমনকি ‘পুরুষত্বহীন’ হয়ে পড়ছে।৯৫ এই ভীতি মৌলবাদীদের সমকামীতা সম্পর্কে ভীতিও তুলে ধরে যাকে তারা নারীবাদের মতোই আমেরিকার পতনের কারণ মহামারী মনে করেছে।৯৬ ‘এটা সর্বোচ্চ ধরনের বিকৃতি,’ জোরের সাথে বলেছেন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সমকামীতার বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে খ্যাতি লাভ করা জেমস রবিসন। ‘এটা ঈশ্বর বিরোধিতা, ঈশ্বরের বাণীর বিরোধিতা, সমাজ বিরোধী, প্রকৃতি বিরোধী। এটা কল্পনা বা বর্ণনা করতে গেলেও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে।’৯৭ মৌলবাদীরা সমাকমীতাকে শিশুভোগের মতো ভাববার ক্ষেত্রে একমত ছিল। এটা ‘সেক্যুলার মানবতাবাদের’ শিকারে পরিণত ভাঙা ঘরের পরিণাম হওয়ার ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিল তারা।৯৮ পারিবারিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত মৌলবাদী লেখকগণ আমেরিকার প্রকৃত পুরুষের প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে একমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপকভাবে কোনও কোনও মৌলবাদী যেন নারীসুলভ মূল্যবোধের ধর্মে পরিণত হওয়া খোদ ক্রিশ্চান ধর্মেই নির্বীজকরণের সুপ্ত প্রবণতার অস্তিত্ব থাকার বিষয়ে উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে: ক্ষমা, করুণা এবং নমনীয়তা। কিন্তু জেসাস মেয়েলি স্বভাবের ছিলেন না, বলেছেন এডউইন লুই কোল: তিনি ছিলেন ‘নির্ভীক নেতা, শয়তানকে পরাস্তকারী, দুরাত্মাকে বিতাড়ন করেছেন, প্রকৃতির উপর ক্ষমতা দেখিয়েছেন, ভণ্ডদের ধরিয়ে দিয়েছেন।’৯৯ তিনি নিষ্ঠুর হতে পারতেন: ক্রিশ্চানদেরও আগ্রাসী হতে হবে, ব্যাটল ফর দ্য ফ্যামলি-তে জোরের সাথে বলেছেন টিম লাহাই। তাদেরও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে।১০০ এক উগ্র, পৌরুষদীপ্ত ক্রিশ্চান ধর্মের আকাঙ্ক্ষা মরাল মেজরিটির অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রতি বৈরিতার কারণও ব্যাখ্যা করে। এটাও তাদের প্রচারণার অংশ ছিল, ঋজু, সক্ষম ও যোদ্ধা পৌরুষকে নতুন করে জীবিত করে তোলা।

অংশত মৌল ভীতি থেকে নিউ ক্রিশ্চান রাইটের তৎপরতা সৃষ্টি হয়েছিল। মৌলবাদীরা অস্পষ্টভাবে নিজেদের নির্বীজ ও গভীরভাবে হীন ভেবেছে। তাদের আদর্শে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি, তবে এখন তারা তাদের গোষ্ঠীকে মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার বহু বছরের নির্দেশের পর সমাজ জীবনে রাজনৈতকিভাবে সক্রিয় করে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। অন্যান্য রাজনৈতিক প্রচারণামূলক আন্দোলনের মতোই কাজ শুরু করেছিল মরাল মেজরিটি নেটওয়ার্ক। ভোট দানের জন্যে সদস্যদের নিবন্ধন করাই ছিল তাদের মূল কাজ, তাদের সঠিকভাবে ভোট দানের পদ্ধতি শেখানো হয়েছে এবং ভোট দানে সক্ষম ছিল তারা। সক্রিয়তার প্রয়োজন ব্যাখ্যা করতে র‍্যালির আয়োজন করেছে তারা, জনগণকে লবিইং ও নিউজ লেটার তৈরির কাজে শিক্ষিত করে তুলেছে; প্রচার মাধ্যমকে প্রভাবিত করার শিক্ষাও দিয়েছে। যত নিম্ন বা স্থানীয় পর্যায়েরই হোক না, সরকারী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যে ক্রিশ্চানদের তাগিদ দেওয়া হয়। উদারপন্থী ও সেক্যুলারিস্টরা ক্রমে জনজীবনে উচ্চকিত নবজন্ম উপস্থিতি সম্পর্কে ধীরে ধীরে সজাগ হয়ে উঠতে থাকে। পরবর্তী এক দশকে উগ্র ক্রিশ্চানরা মূলধারার প্রতিষ্ঠানসমূহ উপনিবেশে পরিণত করতে শুরু করে। ১৯৮৬ সালে প্যাট রবার্টসন এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ক্রিশ্চানরা কোনও কোনও রাজনীতিবিদের পথের কাঁটা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। বছরের পর বছর পাবলিক অ্যাকশন কমিটিগুলো তাদের দৃষ্টিতে অনাকাঙ্ক্ষিত নীতি প্রচারকারীদেরই পদের জন্যে স্থির করে এসেছে। ‘রিপোর্ট কার্ড’ বের করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে সাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত করেছিল তারা। এবার ক্রিশ্চান অ্যাক্টিভিস্টরা গান ল-এ ‘ভুল’ ভোটদানকারী, গর্ভপাতের তহবিলে দানকারী বা সমঅধিকার সংশোধনীতে ভোটদানকারীদের নিশানা করতে শুরু করেছিল। প্রতিরক্ষা, স্কুলে প্রার্থনা বা সমকামীদের অধিকারের বেলায় ভুল দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা পরিবার বিরোধী, আমেরিকা বিরোধী ও ঈশ্বর বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমে মৌলবাদী অ্যাক্টিভিস্টদের যেন অদক্ষ মনে হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে আধুনিক রাজনীতির খেলা শিখে নেয় তারা। যাজক ও টেলিভিশন উপস্থাপক ছিলেন এরা, জন্মগতভাবে রাজনীতিক নন; কিন্তু তারপরেও বেশ সাফল্য অর্জন কিেছলেন। তাঁদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য সম্ভবত সমঅধিকার সংশোধনী প্রতিহত করা। প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্যে তেত্রিশটি রাজ্যের ভোটের দরকার ছিল, ১৯৭৩ সাল নাগাদ তিরিশটি রাজ্য পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ১০১ কিন্তু ফিলিস শ্যাফলির প্রয়াস ও স্থানীয় ক্রিশ্চান রাইট অ্যাক্টিভিস্টদের প্রচারণা সংশোধনীর গতি স্তব্ধ করে দেয়: নেব্রাস্কা, টেনেসি, কেনটাকি, ইন্ডিয়ানা ও দক্ষিণ ডাকোটা, তাদের আগের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। তা নাহলে মরাল মেজরিটি এমনকি স্কুলে প্রার্থনা বা গর্ভপাতের মতো বিষয়েও ফেডারেল বা রাজ্য বিধান বদলাতে পারেনি। আরকানস ও লুইসিয়ানায় অবশ্য স্কুলের পাঠ্যক্রমে ডারউইনের বিবর্তনবাদের পাশাপাশি জেনেসিসের আক্ষরিক শিক্ষা দেওয়ারও পক্ষে বিল গৃহীত হয়েছিল। সাফল্যের এই আপাত অভাব ক্রিশ্চান অ্যাক্টিভিস্টদের অবশ্য হতাশ করেনি, তারা যুক্তি দেখিয়েছে, কংগ্রেসের উভয় কক্ষে একটা অতিরক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠতা গড়ে তোলাই তাদের দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। সেটা অর্জিত হলে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার স্বাভাবিকভাবেই অগ্রসর হবে।

মরাল মেজরিটির এই ধরনের রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিজম চালু করার বিশ বছর পর এই বইটি লেখার মুহূর্তে এর দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা পরিমাপ করা সহজ নয়। প্রমাণ রয়েছে যে বিশেষ করে দক্ষিণে আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ক্রিশ্চানরা ভোট দিচ্ছে, কিন্তু এই ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা অনেক সময় হীতে বিপরীত হতে পারে। ক্রিশ্চান রাইট সমর্থক লিন্ডা শাভে ১৯৮৬ সালে মেরিল্যান্ড মধ্যমেয়াদী নির্বাচনের সময় প্রতিপক্ষকে কমিউনিস্ট ও শিশুঘাতক লেসবিয়ান বলে গালমন্দ করলে সেটা তার পরাজয়ে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে। ১০২ ১৯৯৮-৯৯ সালে মনিকা লিউনিস্কির সাথে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের যৌন সম্পর্ক ও পরবর্তী কথিত আদালত অবমাননার দায়ে তাঁকে অপসারণের প্রয়াসও উল্টো ফল দিয়েছিল। যৌন আচরণ সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের একান্ত উত্তর দান এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অনিবার্য রাজনৈতিক ডিসেকোর্সের তুচ্ছকরণ ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং সম্ভবত ক্লিন্টনের পক্ষে উদারপন্থীদের পাল্টা হামলার কারণ হয়।

তাসত্ত্বেও সত্যি কথা হচ্ছে কেলেঙ্কারীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় নেতাদের এক প্রাতরাশ সভায় ভাষণ দান ও কান্নাভরা কণ্ঠে পাপের স্বীকারোক্তি দেওয়া প্রয়োজন মনে করার বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছে যে, রাজনীতিবিদগণ এখন আর বিশ্বাসীদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে সেক্যুলারিস্ট পরিহাসের সাথে দেখতে পারছেন না। বিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ উত্তর আমেরিকায় ধর্ম বিবেচনায় আনার মতো শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। ফাউন্ডিং ফাদারগণ আলোকনের সেক্যুলার মানবতাবাদের জয়গান গাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক দূরের পথ অতিক্রম করেছে। বিপ্লবের পর থেকে আমেরিকার প্রটেস্ট্যান্টরা উদার প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ও আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার উপায় হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে; জেরি ফলওয়েল, প্যাট রবার্টসন ও ক্রিশ্চান রাইটের অন্য সদস্যদের মৌলবাদী প্রচারণা স্রেফ এই প্রবণতারই বিংশ শতাব্দীর শেষাংশের প্রকাশ। এইসব ক্রিশ্চান প্রয়াসের ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পবিত্রতা অনেক বড় ভূমিকা পালন করছে, ওইসব দেশে রাজনীতিবিদরা প্রকাশ্য ও আবেগঘন ধার্মিকতা প্রকাশ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

জাতীয় রাজনীতি ছাড়াও ১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে ক্রিশ্চান রাইটের কিছু বিশাল বিজয় স্থানীয় পর্যায়ের ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৪ সালে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার কানাওয়া কাউন্টির মৌলবাদী যাজকের স্ত্রী অ্যালিস মুর স্কুল পাঠ্য বইয়ে বাইবেল একটি মিথ বুঝিয়ে এর কর্তৃত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে এবং ক্রিশ্চান ধর্মকে কপটাচারী এবং নাস্তিক্যকে বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয় হিসাবে তুলে ধরা ‘সেক্যুলার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির’ বিরুদ্ধে প্রচারণায় নামেন। ক্রিশ্চানরা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে প্রত্যাহার করে ঘরে বন্দি করে। মুর বিশেষজ্ঞদের প্রতি আস্থাহীনতার দীর্ঘ আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্ট ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন। কানাওয়া কাউন্টির স্কুল কার নিয়ন্ত্রণ করা উচিত: ‘যারা এখানে বাস করে সেই জনগণ নাকি শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, প্রশাসক, অন্য জায়গা থেকে হাজির হওয়া লোকজন যারা আমাদের বলে আসছে কোনটা আমাদের সন্তানের জন্যে ভালো হবে তারা?’১০৩ ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে সেইন্ট ডেভিড অ্যারিযোনার স্থানীয় ক্রিশ্চানরা তাদের স্কুল থেকে উইলিয়াম গোল্ডিং, জন স্টেইনবেক, জোসেফ কনরাড ও মার্ক টোয়াইনের বই নিষিদ্ধ করতে সক্ষম হয়। ১৯৮১ সালে মেল ও নোরমা গাবলার ‘ঈশ্বরকে আবার টেক্সাসের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে’ একই রকম প্রচারণা শুরু করেন। বর্তমান ‘উদার পক্ষপাতের’ প্রতি আপত্তি তোলেন তাঁরা, যা কিনা

ছাত্রদের নিজস্ব উপসংহারে পৌছানোর প্রয়োজন হয় এমন উন্মুক্ত প্রশ্নে দেখা যাবে; ক্রিশ্চানিটি ছাড়া অন্য ধর্ম সংক্রান্ত বিবৃতি; এমন বিবৃতি যাতে তারা মুক্ত উদ্যোগ ব্যবস্থার প্রতি নেতিবাচক চিন্তা করতে চালিত হয়; এমন বিবৃতি যাতে তারা সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট দেশের (অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের নির্দিষ্ট শস্যের বৃহত্তম উৎপাদক); সংযমের কোনও দিক বাদে যৌনতার কোনও দিক; কৃষ্ণাঙ্গ, নেটিভ আমেরিকান ইন্ডিয়ান, মেক্সিকান – আমেরিকান বা নারীবাদীদের অবদানের উপর জোরদানকারী বিবৃতি; এমন বিবৃতি যেগুলো আমেরিকান দাসদের প্রতি সহানুভূতিশীল বা তাদের মালিকদের প্রতি বৈরী; এবং বিবর্তনবাদের সমর্থক সেইসব বিবৃতি, যদি সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা করার জন্যে সমান স্থান দেওয়া না হয়।১০৪

আদালত গাবলারদের বিরুদ্ধে রায় দেয়, কিন্তু প্রকাশকরা রাজ্যই সব স্কুলের জন্যে টেক্সট বই বাছাই করে বলে বিশাল টেক্সাসের বাজারের ক্ষতির সম্ভাবনায় এতটাই ভীত হয়ে উঠেছিলেন যে, নিজেরাই বই সংশোধন করে ফেলেন তারা।

প্রচারকারীরা মৌলবাদীদের আধুনিক সংস্কৃতি সম্পর্কে দীর্ঘকাল ধরে আক্রান্ত করে রাখা সকল ভীতি তুলে ধরেছিল: উপনিবেশিকরণ, বিশেষজ্ঞ, অনিশ্চয়তা, বিদেশী প্রভাব, বিজ্ঞান ও যৌনতার ভীতি। তারা অবশ্য মোটা দাগে নিউ ক্রিশ্চান রাইটের ডব্লুএএসপি-মুখীনতাও তুলে ধরেছিল। আমেরিকা হবে শ্বেতাঙ্গ এবং প্রটেস্ট্যান্টদের। ইহুদি ও মুসলিম অ্যাক্টিভিস্টদের মতো মরাল মেজরিটির ক্রিশ্চানরা পবিত্রের আওতা বৃদ্ধি, সেক্যুলারিস্ট রীতির আগ্রাসন ঠেকানো ও ঐশীসত্তাকে পুনঃস্থাপিত করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করছিল। তাদের বিজয়কে ছোট ও তাৎপর্যহীন মনে হতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কাজের ধারা শিখেছিল ক্রিশ্চান রাইট; নিজেদের তারা নতুন করে ক্ষমতাশালী করেছে এবং একটা মাত্রা পর্যন্ত এমনভাবে আমেরিকান রাজনীতিকে আবার পবিত্র করে তুলেছিল যা ইউরোপের অধিকতর সেক্যুলার দেশগুলোকে সব সময় বিস্মিত করে এসেছে।

টেক্সাসের বেলায় গাবলারদের বিপক্ষে লড়াইকারী উদারপন্থী সংগঠন পিপল ফর দ্য আমেরিকান ওয়ে যুক্তি দেখিয়েছিল, রক্ষণশীলরা এই ধরনের ১২৪টি বিরোধের ক্ষেত্রে মাত্র ৩৪টিতে জয় লাভ করেছে। উদারবাদীরা নিজস্ব সংগঠন তৈরি করে পাল্টা যুদ্ধ শুরু করছিল। সুতরাং, অগ্রগতি ছিল ধীর, এটা মৌলবাদীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল, তাদের ধারণা ছিল পরমানন্দ অত্যাসন্ন, এবং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ইতিহাসে সক্রিয়, আপন শক্তিতে ন্যায়পরায়ণদের রক্ষা করছেন। কোনও কোনও মৌলবাদী তাদের নেতারা বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন বলে বিশ্বাস করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮২ সারেল গর্ভপাতের পূর্ণ বিলুপ্তির দাবি করার বদলে জেরি ফলওয়েল এর প্রাপ্যতা সীমাবদ্ধ করার অধিকতর বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেন। প্রেসিডিন্ট নির্বাচনের প্রচারণাকালে প্যাট রবার্টসন মূলধারার বিভিন্ন গোষ্ঠী সম্পর্কে রয়েসয়ে শোভন বক্তব্য রাখেন, যদিও মৌলবাদী অর্থডক্সি দাবি করে যে ধর্মদ্রোহী চার্চগুলোকে প্রত্যেক সুযোগেই আক্রমণ করতে হবে।

প্রটেস্ট্যান্ট পুনর্জাগরণের গোড়ার দিকের এই বছরগুলোয় আধুনিক রাজনীতির সমঝোতা দাবি শিখেছিলেন ফলওয়েল ও রবার্টসন। গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে ক্ষমতার জন্যে প্রতিযোগিতা দরকষাকষি ও প্রতিপক্ষের জন্য কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিতে হয়, সেখানে চরম নীতিমালা সফল হতে পারে না। বিশেষ কিছু নীতিকে অলঙ্ঘনীয় ও সেকারণে আপোসহীন বিবেচনাকারী কোনও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে এর সাথে তাল মেলানো কঠিন। মৌলবাদীরা প্রতিযোগিতা করতে বাধ্য হওয়া সেক্যুলার রাজনীতির বিশ্বে তারা পছন্দ করুক বা না করুক, কোনও কিছুই এভাবে পবিত্র নয়। যেকোনও ধরনের সাফল্য অর্জনের জন্যে ফলওয়েল ও ববার্টসনকে শয়তান বিবেচনা করা প্রতিপক্ষকে ছাড় দিতে হয়েছে। একটা টানাপোড়েন ছিল: আধুনিক রাজনৈতিক বিশ্বে প্রবেশ করে মৌলবাদীরা আবিষ্কার করেছে যে, তারা কেবল অশুভের সাথে মিশছেই না বরং যেসব বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে রাজনীতির মাঠে নেমেছিল সেগুলোর কোনও কোনওটা তাদের প্রভাবিতও করছে। এটা ছিল তাদের সমস্যার একটি দিক মাত্র। শতাব্দীর শেষ দুই দশকে মৌলবাদীরা যেসব সমাধানের দিকে ধাবিত হয়েছে মনে করেছিল সেগুলোর কোনও কোনওটা খোদ ধর্মের পক্ষেই পরাজয় ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *