০৯. আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় বিধির প্রমাণ

৯. আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় বিধির প্রমাণ

নিউটনের মহাকর্ষীয় বিধির স্থলে আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় বিধি গ্রহণ করার কারণ অংশত প্রয়োগজ (empirical) এবং অংশত যৌক্তিক (logical)। আমরা শুরু করব প্রথমটা দিয়ে।

গ্রহ এবং তাদের উপগ্রহগুলির কক্ষ গণনায় প্রয়োগ করলে নতুন মহাকর্ষীয় বিধি এবং পুরানো মহাকর্ষীয় বিধির ফল প্রায় একই। তা না হলে নতুন বিধি সত্য হতে পারত না, তার কারণ, দেখা গিয়েছে প্রাচীন বিধি থেকে আহরিত ফলাফল পর্যবেক্ষণের সাহায্যে প্রায় নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আইনস্টাইনের নতুন বিধি প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। প্রাচীন বিধির তুলনায় তার নতুন বিধি যে ভাল সেটা দেখানোর জন্য তখন তিনি পরীক্ষালব্ধ একটি তথ্যই উপস্থিত করতে পারতেন। সেটা হল : বুধ (Mercury) গ্রহের অনুসুরের (perihelion) গতি।

অন্যান্য গ্রহের মতো বুধগ্রহও উপবৃত্তাকার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। সূর্য থাকে উপবৃত্তের একটি নাভিতে (focus-ফোকাস)। এই কক্ষের কোনো কোনো বিন্দুতে সূর্য কক্ষের অন্য বিন্দুর তুলনায় নিকটতর। যে বিন্দুতে গ্রহটি সূর্যের নিকটতম সেই বিন্দুর নাম অনুসুর (perihelion)। পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছিল সূর্যের নিকটতম হওয়ার একটি ঘটনা থেকে ঐরকম পরের ঘটনায় যেতে বুধগ্রহ ঠিক নির্ভুলভাবে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে না, করে তার চাইতে একটু বেশি। এই গরমিল অতি সামান্য। এক শতাব্দীতে এর পরিমাণ বিয়াল্লিশ সেকেন্ডের একটি কোণ । এক শতাব্দীতে বুধগ্রহ সূর্য প্রদক্ষিণ করে চারশ বারের চাইতে একটু বেশি। সুতরাং তাকে একটি অনুসুর থেকে অন্য অনুসুরে যেতে একটি আবর্তনের চাইতে ১/১০ সেকেণ্ড কোণ বেশি পরিভ্রমণ করতে হবে। নিউটনীয় তত্ত্বের সঙ্গে অতি সামান্য এই গরমিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধাঁধায় ফেলত। অন্য গ্রহগুলির প্রভাবের অভিক্রিয়ার একটি হিসাব ছিল কিন্তু এই প্রভাবকে হিসাবের ভিতরে নিয়েও সেই সামান্য গরমিল অবশিষ্ট থেকে যায়। নতুন তত্ত্ব নির্ভুলভাবে সেই সামান্য গরমিলের হিসাব মিলিয়ে দিয়েছে। অন্য গ্রহগুলির ক্ষেত্রেও এই ধরনের অভিক্রিয়া রয়েছে কিন্তু সেটা আরো অল্প। তাছাড়া এখনো সেগুলি নিশ্চিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। প্রথমে বুধগ্রহের গতির অনুসুর অভিক্রিয়াই ছিল পুরানো তত্ত্বের তুলনায় নতুন তত্ত্বের একমাত্র পরীক্ষালব্ধ সাফল্য।

দ্বিতীয় সাফল্য ছিল আরো বেশি চাঞ্চল্যকর। প্রাচীন মত অনুসারে, শূন্যস্থানে আলোকের সব সময়ই ঋজুরেখায় ভ্রমণ করা উচিত। পদার্থকণা দিয়ে গঠিত না হওয়ায় দরুন আলোকের মহাকর্ষ দিয়ে প্রভাবিত না হওয়াই উচিক। প্রাচীন চিন্তাধারার সঙ্গে কোনো বিশেষ বিরোধিতা না করেও কিন্তু একথা মেনে নেওয়া যেত যে সূর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আলোক পদার্থকণা দিয়ে গঠিত বস্তুর মতো ঋজুপথ থেকে বিচ্যুত হতে পারে। নতুন তত্ত্ব অনুসারে কিন্তু আলোকের বিচ্যুতি এর দ্বিগুণ হতে হবে, অর্থাৎ একটি তারকার আলো যদি সূর্যের খুব কাছ দিয়ে যায় তাহলে তারকা থেকে বহির্গত আলোকরশ্মি পৌনে দুই সেকেন্ডের একটু কম পরিমাণ কোণের বাক সৃষ্টি করবে। প্রাচীনপন্থীরা এর অর্ধেক পরিমাণ মানতে রাজী ছিলেন। অসুবিধা হল, সূর্যের সঙ্গে সমরেখায় অবস্থিত তারকাগুলি শুধুমাত্র পূর্ণগ্রহণের সময়ই দেখা যায়। এমনকি তখনো সূর্যের কাছাকাছি যথেষ্ট উজ্জ্বল তারকা না থাকতে পারে। এডিংটন (Eddington) দেখালেন এদিক থেকে বছরের সবচাইতে ভাল দিন ২৯শে মে। কারণ ঐ তারিখে সূর্যের কাছাকাছি অনেকগুলি উজ্জ্বল তারকা থাকে। এক অবিশ্বাস্য সৌভাগ্যের ফলে ১৯১৯ সালের ২৯শে মে সূর্যের পূর্ণগ্রহণ ছিল। দুটি ব্রিটিশ অভিযান এই গ্রহণের সময় সূর্যের নিকটবর্তী তারকাগুলির ফটো তোলে। ফটো নতুন তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করে। এর ফলে সে সময় বিরাট উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তবে পর্যবেক্ষণে অনেক ভুলের উৎস থাকতে পারত এবং পরীক্ষাফল দ্বন্দ্বের সম্পূর্ণ মীমাংসা করেছে একথা বলা যায়, না। পরবর্তী গ্রহণ পর্যবেক্ষণে তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর অর্ধেক থেকে দ্বিগুণ পর্যন্ত ফল পাওয়া গিয়েছে।

তবে ইদানীং আবিষ্কৃত হয়েছে কোয়াসার নামক এক তারকা জাতীয় শক্তিশালী বেতার তরঙ্গের উৎসগুলির কতকগুলি থেকে নিগর্ত তরঙ্গ সূর্যের বেশ কাছ দিয়ে যায়। বছরের কোনো কোনো সময় ব্যাপারটা পৃথিবীর থেকে দেখা যায়। নতুন তত্ত্বে আলোকের বিচ্যুতি সম্পৰ্কীয় ভবিষ্যদ্বাণী বেতার তরঙ্গে বিচ্যুতি সম্পর্কেও সমভাবে প্রযোজ্য। কুড়ি মাইল কিংবা তার কাছাকাছি দূরত্বে দুটি কিংবা বেশি সংখ্যক বেতার দূরবীক্ষণ (রেডিও টেলিস্কোপ) যন্ত্র ব্যবহার করে অতি নির্ভুলভাবে বিচ্যুতি মাপা সম্ভব। পরীক্ষাফলের সঙ্গে নতুন তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর ঘনিষ্ঠ ঐক্য রয়েছে।

নতুন তত্ত্বের তৃতীয় পরীক্ষামূলক ভবিষ্যদ্বানীর সত্যতাও খুব নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অবশ্য আইনস্টাইন পরীক্ষাটা প্রথমে যেভাবে করার প্রস্তাব করেছিলেন এখন আর সেভাবে পরীক্ষা করা হয় না। আলোচ্য অভিক্রিয়া (effect) ব্যাখ্যা করার আগে কয়েকটি প্রাথমিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একটি মৌলিক পদার্থ তাপদীপ্ত হলে তার বর্ণালীতে নানারকম রেখা থাকে-তাপদীপ্ত মৌলিক পদার্থ থেকে নির্গত আলোকের বর্ণালী নানা রঙের রেখা দিয়ে গঠিন। সেগুলিকে ত্রিপার্শ্ব (prism) কাঁচ দিয়ে পৃথক করা যায়। মৌলিক পদার্থটি পৃথিবী, সূর্য কিংবা তারকা যেখানেই থাকুক না কেন বর্ণালী তার একই থাকে (ঘনিষ্ঠ আসন্নতা পর্যন্ত to a close approximation)। প্রতিটি রেখাই একটি নির্দিষ্ট রঙের এবং তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যও নির্দিষ্ট। দীর্ঘতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলি থাকে বর্ণালীর লাল প্রান্তের দিকে, হ্রস্বতরগুলি থাকে বেগুনি প্রান্তের দিকে। আপনি যখন বাতাসের বিপক্ষে চলেছেন তখন সমুদ্রের ঢেউগুলি দ্রুততর আসে। ঠিক তেমনি আপনার এবং আলোকের উৎসের ভিতরে দূরত্ব যখন কমতে থাকে আপাতদৃষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য তখন বাড়তে থাকে। এর সাহায্য আমরা বুঝতে পারি তারকাগুলি আমাদের নিকটতর হচ্ছে না, আমাদের কাছ থেকে দূরতর হচ্ছে। দূরত্ব যদি কমতে থাকে তাহলে একটি মৌলিক পদার্থের বর্ণালীর সমস্ত রেখাগুলিই বেগুনির দিকে একটু সরে যাবে। দূরত্ব যদি বাড়তে থাকে তাহলে সরবে লালের দিকে। শব্দের ক্ষেত্রে একই রকম অভিক্রিয়া আপনি যে কোনো দিন লক্ষ্য করতে পারেন। আপনি যদি একটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং হুইসল দিতে দিতে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন আসে তাহলে ট্রেনটি আপনার কাছ থেকে চলে যাওয়ার সময়ের স্বরের তুলনায় ট্রেনটি যখন আপনার দিকে আসছে তখনকার স্বর অনেক বেশি তীক্ষ্ণ (shrill) মনে হবে। অনেকে হয়তো ভাবেন স্বরের সত্যিই কোনো পরিবর্তন হয়েছে। আসলে কিন্তু শ্রুতির পরিবর্তনের কারণ ট্রেনটা প্রথমে আপনার দিকে আসছিল তারপরে আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। গাড়ির ভিতরের লোকের ক্ষেত্রে কিন্তু স্বরের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল এটা সে অভিক্রিয়া নয়। নতুন তত্ত্ব অনুসারে একটি পরমাণু যেখানেই থাকুক না কেন তার অভ্যন্তরে সংঘটিত যে কোনো পর্যাবৃত্ত ক্রিয়া (periodic process) একই কাল ‘অন্তর’ (interval) স্থায়ী। কিন্তু এক জায়গায় কাল অন্তর অন্য জায়গায় একই কাল অন্তরের নির্ভুল অনুরূপ হয় না। তার কারণ : যে স্থান-কাল মহাকর্ষ গঠন করে তার ‘পাহাড়ি’ (hilly) চরিত্র।

তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী : ভূমিতলে অবস্থিত একটি পরমাণুর ভিতরে সংঘটিত একটি পর্যাবৃত্ত ক্রিয়ার (periodic process) হার (rate) খুব উঁচু একটা বাড়িতে ছাতে অবস্থিত একই পরমাণুর ভিতরে সংঘটিত একই পর্যাবৃত্ত ক্রিয়ার হারের চাইতে একটু মন্থরতর (silghtil slower rate)। আলোকরশ্মি উৎসর্জন (emis sion) আসলে একটি পর্যাবৃত্ত ক্রিয়া। এ ক্রিয়া যদি মন্থরতর হয় তাহলে দুটি তরঙ্গ শীর্ষের (wave crest) মধ্যবর্তী স্থান অধিকতর হওয়া অনুমোদিত হবে সুতরাং দীর্ঘতর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সম্পন্ন আলোক উৎপাদিত হবে। অতএব আলোক যখন ভূমিতল থেকে বাড়ির ছাদে প্রেরিত হয় তখন বাড়ির ছাদে অবস্থিত পর্যবেক্ষকদের মনে হবে সেই আলোকের বর্ণালীর একটি বিশেষ রেখা, আলোকটি যদি তাদের নিজেদের তল থেকে প্রেরিত হয় তাহলে তার বর্ণালীর ঐ রেখার তুলনায়, বর্ণালীর লাল প্রান্তের নিকটতর।

আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী সূর্যে অবস্থিত পরমাণুগুলি থেকে উৎসারিত আলোক তরঙ্গের সঙ্গে পৃথিবীতে অবস্থিত পরমাণুগুলি থেকে উৎসারিত আলোকতরঙ্গের তুলনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভূ-পৃষ্ঠের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের তুলনায় সূর্যপৃষ্ঠের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। সুতরাং ভূমিতল এবং ছাদের ক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্য পার্থক্যের তুলনায় এ ক্ষেত্রে তরঙ্গদৈর্ঘ্যর পার্থক্য বৃহত্তর কিন্তু। সূর্যালোকে মাপনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। সে ক্ষেত্রেও একই অভিক্রিয়া হওয়া উচিত। প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর সময় পার্থিব (terrestrial) মাপন অসম্ভব ছিল। কিন্তু গত পঁচিশ বছরে আবিষ্কৃত নতুন পদ্ধতিগুলির সাহায্যে অতীব নির্ভুলভাবে জানা তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলোকসঙ্কেত প্রেরণ সম্ভব হয়েছে এবং যে অভিক্রিয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল সে অভিক্রিয়া বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাহায্যে নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

নতুন মহাকর্ষীয় বিধি এবং প্রাচীন বিধির ভিতরে আরো অনেক পার্থক্য রয়েছে। তার অনেক গুলির সত্যতা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাহায্যে নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর ভিতরে সবচাইতে নির্ভুল হল কাল বিলম্বী’ (time delay) অভিক্রিয়া। এ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী ১৯৬৪ সালের আগের করা হয়নি। অর্থাৎ নতুন তত্ত্ব উপস্থাপনের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর এই তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে।

এর কারণ বোধ হয় : আলোচ্য কাল বিলম্ব এক সেকেন্ডের দশ লক্ষ ভাগের কয়েক শত অংশ মাত্র (few hundred millionth of sccond)। তার বেশি নয় এবং এত ক্ষুদ্র কাল মাপন সম্ভব হয়েছে সম্প্রতি। ভবিষ্যদ্বাণীটি হল : নিকটে যখন মহাকর্ষীয় পাহাড় এই তখনকার তুলনায় মহাকর্ষীয় পাহাড় যখন রয়েছে তখন একটি নির্বাচিত স্থান থেকে অন্য নির্বাচিত স্থানে যেতে একটি আলোকসঙ্কেতের সময় বেশি লাগবে। রাডার (radar) সঙ্কেত সম্পর্কেও এ ভবিষ্যদ্বাণী সমভাবে প্রযোজ্য। এই পরীক্ষাগুলিতে পৃথিবী থেকে একটি রাডার সঙ্কেত অন্য একটি গ্রহ কিংবা একটি কৃত্রিম উপগ্রহে পাঠানো হয় এবং সঙ্কেতগুলি প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে। প্রতিফলকটি (reflecting agent) যখন সূর্যের দূরতর পার্শ্বে অবস্থিত মাপন তখনই করা হয়। এক্ষেত্রে সূর্য মহাকর্ষীয় পাহাড়ের ভূমিকা পালন করে। পরীক্ষাফল অতি নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা পালন করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুলের পরিমাণ এক সহস্রাংশের চাইতেও কম।

মহকাশে বস্তুপিণ্ডগুলির গতি সম্পর্কে যে সমস্ত ক্ষেত্রে নতুন তত্ত্ব এবং পুরাতন তত্ত্বে মতভেদ হয় সেই সমস্তক্ষেত্রে নতুন তত্ত্বই নির্ভুল ফল প্রদান করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এ তথ্য বিশ্বাস করাতে প্রাগুক্ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলিই যথেষ্ট। নতুন তত্ত্বের সপক্ষে পরীক্ষামূলক ভিত্তি যদি নিঃসঙ্গও হতো, তাহলেও সে ভিত্তি হতো প্রামাণ্য। নতুন বিধি নির্ভুল সত্যের প্রতিরূপ হোক কিংবা না হোক, প্রাচীন বিধির তুলনায় যে নতুন বিধি সত্যের নিকটতর সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অথচ প্রাচীন বিধিতে ভুল ছিল অতীব সামান্য।

প্রথমে যে কারণগুলি ছিল নতুন বিধি আবিষ্কারের পথিকৃৎ সেগুলি কিন্তু এত বিস্তৃতি ছিল না। এমন কি বুধগ্রহের অনুসুর সম্পর্কীয় যে ফল সেটাও আহরণ করা সম্ভব ছিল শুধুমাত্র তত্ত্বটি সম্পূর্ণ হওয়ার পর এবং পূর্বেকার পর্যবেক্ষণের সাহায্যেই বুধগ্রহ সম্পৰ্কীয় তথ্য প্রমাণ করা যেত। তবুও এ তথ্য কোনোক্রমেই এরকম একটি তত্ত্ব আবিষ্কারের প্রাথমিত কারণের কোনো অংশ হতে পারে না। এ কারণগুলির চরিত্র ছিল আরো বিমূর্ত এবং যৌক্তিক। এ কথা আমি বলছি না যে এগুলি ছিল পূর্বত : সিদ্ধ (a priori) কল্পনা অর্থাৎ প্রাচীনকালে দার্শনিকরা যা করতেন সেইরকম। আমি বলতে চাইছি : এগুলি আহরণ করা হয়েছিল ভৌত অভিজ্ঞতার কয়েকটি সাধারণ চরিত্র থেকে। সেগুলি থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে প্রাচীন বিধি নিশ্চয়ই ভুল এবং নতুন বিধির মতো কিছু একটা প্রতিস্থাপন করতেই হবে। . আগের অধ্যায়গুলিতে আমরা দেখেছি গতির আপেক্ষিকতা সম্পর্কীয় যুক্তিগুলি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী (quite conclusive)। দৈনন্দিন জীবনে যখন আমরা বলি একটা কিছু চলছে তখন আমরা বোঝাতে চাই সেটা চলছে পৃথিবী সাপেক্ষ। গ্রহগুলির গতি বিচারের সময় আমরা ভাবি সেগুলি চলছে সূর্য সাপেক্ষ কিংবা সৌরতন্ত্রের ভরের কেন্দ্র সাপেক্ষ। যখন আমরা বলি সৌরতন্ত্র নিজেই চলমান। তখন আমরা বোঝাতে চাই-এটা চলছে তারকাপুঞ্জ সাপেক্ষ। এমন কোনো ভৌত ঘটনা নেই যার নাম দেওয়া যেতে পারে পরম গতি (absolute motion)। সুতরাং ভৌতবিধির বিচার্য হতে হবে আপেক্ষিক গতি। কারণ একমাত্র সেইরকম গতিই বাস্তবে ঘটে।

এখন আমরা গতির আপেক্ষিকতাকে এই পরীক্ষামূলক তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে গ্রহণ করতে চাইছি; দুটি বস্তুপিণ্ড যেভাবেই চলমান হোক না কেন আলোকের বেগ একটি সাপেক্ষ যা অন্যটি সাপেক্ষও তাই। ঐ তথ্যই দূরত্ব এবং কালের আপেক্ষিকতার পথিকৃৎ। এ তথ্যই আবার দেখিয়ে দেয় : এমন কোনো বস্তুনিষ্ঠ ভৌত ঘটনা নেই যাকে বলা যায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে দুটি বস্তুপিণ্ডের অন্তবর্তী দূরত্ব। কারণ কাল এবং দূরত্ব দুটোই নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের উপর। সুতরাং প্রাচীন মহাকর্ষীয় বিধি যৌক্তিক বিচারে গ্রাহ্য নয়। কারণ এ বিধি ‘একটি নির্দিষ্ট কালে দূরত্ব’ ব্যবহার করে।

এ থেকে বোঝা যায়-আমরা প্রাচীন বিধি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। কিন্তু তার জায়গায় কি প্রতিস্থাপন করতে হবে সেটা বোঝা যায় না। এখানে কয়েকটি বিষয় এসে পড়ে। প্রথমত আমাদের রয়েছে ‘মহাকর্ষীয় ভর এবং জড়ত্বীয় ভরের সমতা’। এর অর্থ হল : একটি বস্তুপিণ্ডের প্রতি একটি নির্দিষ্ট বল* প্রয়োগ করলে সেটা যদি হাল্কা হয় তাহলে তাকে যতটা ত্বরণ দান করা সম্ভব, ভারী হলে সেটাকে ততটা ত্বরণ আপনি দান করতে পারেন না। একটি বিশেষ ত্বরণ দান করতে যে পরিমাণ বল প্রয়োজন হয় সেটাই একটি বস্তুপিণ্ডের জড়ত্বীয় ভরের মাপ (measure)।

ভূ-পৃষ্ঠের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে ‘ভর’ (mass) এবং ওজন (weight) আনুপাতিক। দাঁড়িপাল্লা দিয়ে যেটা মাপা হয় সেটা ঠিক ওজন নয় সেটা আসলে ভর। ওজনের সংজ্ঞা : একটি বস্তুপিণ্ডকে পৃথিবী যে বল দিয়ে আকর্ষণ করে সেটাই ওজন। এ বল বিষুবরেখাতে যতটা, মেরু প্রদেশে তার চাইতে বেশি। তার কারণ বিষুবরেখাতে পৃথিবীর আবর্তন একটি অপকেন্দ্র (centrifugal)’ বল সৃষ্টি করে। সেই বল আংশিকভাবে মহাকর্ষের বিরোধী। অতি উচ্চে কিংবা অতি গভীর খনির তলদেশের তুলনায় ভূ-পৃষ্ঠে পৃথিবীর আকর্ষণী বল বৃহত্তর। দাঁড়িপাল্লায় কিন্তু এই পরিবর্তনগুলি বোঝা যায় না কারণ ওজন করার বাটখারা এবং যে বস্তুপিণ্ড ওজন করা হবে দুইয়ের উপরই এই পরিবর্তনগুলি সমান ক্রিয়া করে। তবে স্প্রিং-এর ওজন কল ব্যবহার করলে পরিবর্তনগুলি বোঝা যায়। ওজনের এই সমস্ত পরিবর্তনের সময় ভরের কোনো পরিবর্তন হয় না।

মহাকর্ষীয় ভরের সংজ্ঞা ভিন্ন। এর অর্থ দু’রকম হতে পারে। আমরা অর্থ করতে পারি–

(১) মহাকর্ষের তীব্রতা যেখানে জানা আছে সেখানে একটি বস্তুপিণ্ডের প্রতিক্রিয়ার ধরন–উদাহরণ : ভূ-পৃষ্ঠে কিংবা সূর্য-পৃষ্ঠে ।

(২) বস্তুপিণ্ডটি যে মহাকর্ষীয় বল সৃষ্টি করে তার তীব্রতা উদাহরণ : পৃথিবীর তুলনায় সূর্য বেশি শক্তিশালী মহাকর্ষীয় বল সৃষ্টি করে। পুরানো তত্ত্ব বলে: দুটি বস্তুপিণ্ডের অন্তর্বর্তী মহাকর্ষীয় বল তাদের ভরের গুণফলের আনুপাতিক। এইবার বিচার করা যাক– একই বস্তুপিণ্ডের (ধরুন-সূর্য) প্রতি বিভিন্ন বস্তুপিণ্ডের আকর্ষণ। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বস্তুপিণ্ড যে বল দ্বারা আকর্ষিত হয় সে বল তাদের ভরের আনুপাতিক। সুতরাং সেই বলগুলি সবার ভিতরে নির্ভুলভাবে একই ত্বরণ সৃষ্টি করে। অতএব আমরা যদি মহাকর্ষীয় ভর’ বাক্যে বোঝাতে চাই প্রথম অর্থ (১) অর্থাৎ মহাকর্ষ সাপেক্ষ একটি বস্তুপিণ্ডের প্রতিক্রিয়া, তাহলে আমরা দেখতে পাই ‘জড়ত্বীয় এবং মহাকর্ষীয় ভরের সমতা’। কথাটা শুনতে ভয়াবহ হলেও এর অর্থটা হল : একটি নির্দিষ্ট মহাকর্ষীয় পরিস্থিতিতে সমস্ত বস্তুপিণ্ডের আচরণ নির্ভুলভাবে এক। ভূ-পৃষ্ঠ সাপেক্ষ গ্যালিলিও-র প্রধান আবিষ্কারগুলির ভিতরে এই আবিষ্কারটিও ছিল। অ্যারিস্টটল ভাবতেন হাল্ক বস্তুপিণ্ডের তুলনায় ভারী বস্তুপিণ্ডের পতন হয় দ্রুততর। গ্যালিলিও দেখিয়েছিলেন বাতাসের বাধা না থাকলে এ তথ্য সত্য নয়। শূন্যস্থানে একটি পালক এক ডেলা সীসার মতোই তাড়াতাড়ি পড়ে। গ্রহ পুঞ্জ সম্পর্কে অনুরূপ তথ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিউটন। সূর্য থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত একটি ধূমকেতু এবং একটি গ্রহের দূরত্ব এক হলেও সূর্যের অভিমুখে তারা একই রকম ত্বরণ অনুভব করবে। অথচ ধুমকেতুর ভর অত্যন্ত কম। সুতরাং একটি বস্তুপিণ্ডকে মহাকর্ষ কিভাবে প্রভাবান্বিত করে সেটা নির্ভর করে তার অবস্থানের উপর, কোনোরকমেই বস্তুপিণ্ডের ধর্মের (nature) উপর নির্ভর করে না। এ থেকে মনে হয় মহাকর্ষীয় অভিক্রিয়া অঞ্চলের চরিত্রের (characteristic of the locality)। আইনস্টাইন এই মতই প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন।

দ্বিতীয় অর্থে (২) মহাকর্ষীয় ভর বিষয়ে অর্থাৎ একটি বস্তুপিণ্ড যে বল উৎপন্ন করে তার তীব্রতা সম্পর্কে নতুন তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী : প্রথম অর্থে মহাকর্ষীয় ভর এবং দ্বিতীয় অর্থে মহাকর্ষীয় ভর অভিন্ন। এ ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রমাণ করে এরকম একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা অন্তত করা হয়েছে।

যদি একটি সান্নিধ্যের বৈশিষ্ট্য (characteristic of neighbourhood) হতে হয় তাহলে মহাকর্ষীয় বিধির কি রকম হওয়া আবশ্যিক (must be) সে সম্পর্কে আমাদের আর একটি ইঙ্গিত রয়েছে। কারণ, সান্নিধ্যের বৈশিষ্ট্য হতে পারে এ রকম অনুমান করার যুক্তি আমরা দেখেছি। এটা এমন একটা বিধিতে প্রকাশ করা উচিত যে বিধি আমরা অন্য রকম স্থানাঙ্ক গ্রহণ করলেও অপরিবর্তিত থাকে। আমরা আগেই দেখেছি–শুরু থেকে আমরা কখনোই আমাদের স্থানাঙ্কগুলির কোনো ভৌত গুরুত্ব আছে একথা মনে করব না, স্থানাঙ্কগুলি স্থান-কালের বিভিন্ন অংশের সুসম্বন্ধ নামকরণের পদ্ধতিমাত্র। এগুলি শুধুমাত্র রীতিরক্ষা করে (con ventional)। সেইজন্য এগুলি কোনো ভৌতবিধির অংশ হতে পারে না। একথা বলার অর্থ যদি এক গুচ্ছ (set) স্থানাঙ্ক সাপেক্ষও একই সঙ্কেতের (formula) সাহায্যে সে বিধিকে অবশ্যই প্রকাশিত হতে হবে। কিংবা আরো নির্ভুলভাবে বলা যায় : বিধিটিকে প্রকাশ করে এমন একটি সঙ্কেত অবশ্যই আবিষ্কার করা সম্ভব হতে হবে যে, স্থানাঙ্কের পরিবর্তন আমরা যে ভাবেই করি না কেন, সে সঙ্কেত অপরিবর্তিত থাকবে। সে রকম সঙ্কেত নিয়ে কাজকর্ম করার দায়িত্ব টেন্সর সম্পৰ্কীয় তত্ত্বের (theory of tensors)। টেন্সর তত্ত্ব দেখিয়েছে : সম্ভাব্য মহাকর্ষীয় বিধিরূপে এমন একটি সঙ্কেত রয়েছে যে সঙ্কেতকে অন্য সঙ্কেতগুলির চাইতে বেশি উপযুক্ত মনে হয়। পরীক্ষা করলে দেখা যায় এই সম্ভাব্যতাই সঠিক ফল দান করে। পরীক্ষামূলক সত্যতা নির্ধারণের প্রশ্ন আসে এখানেই। যদি দেখা যেত যে নতুন বিধির অভিজ্ঞতার সঙ্গে ঐক্য নেই তাহলেও কিন্তু আমরা পুরানো বিধিতে ফিরে যেতে পারতাম না। যুক্তি আমাদের এমন একটি বিধি খুঁজে বার করতে বাধ্য করত– যে বিধিতে গতি, দূরত্ব এবং কালের আপেক্ষিকতা প্রথিত। এ বিধি প্রকাশিত হতো টেন্সরের বাগ্বিধিতে। গণিত ছাড়া টেন্সর তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। গণিত যিনি জানেন না তাঁকে এই জ্ঞান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে যে এটা প্রযুক্তির এমন একটি পদ্ধতি যার সাহায্যে আমরা আমাদের মাপন এবং বিধি থেকে রীতিগত উপাদান বাদ দিতে পারি এবং এইভাবে এমন সমস্ত ভৌতবিধিকে পেতে পারি যে বিধি পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গির অধীন নয়। এই পদ্ধতির সবচাইতে চমৎকার উদাহরণ আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় বিধি।

—–
* আগেই দেখানো হয়েছে নতুন তত্ত্বে মহাকর্ষীয় বল–কে আর গতিবিদ্যার (dynamics) মৌল কল্পনরূপে বিচার করা হয় না–একে ব্যবহার করা হয় বলার সুবিধার জন্য। ঠিক যেমন আমরা সূর্যোদয় ‘সূর্যাস্ত’ শব্দ ব্যবহার করি মহাকর্ষীয় বল’-ও তেমনি ব্যবহার করা যেতে পারে। অবশ্য আমাদের বুঝতে হবে আমরা কি বলতে চাইছি। অনেক সময় বল শব্দটি এড়ানোর জন্য অত্যন্ত ঘোরানো অনেক কথা ব্যবহার করতে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *