অমৃত কলস
অথর্ববেদ অতি স্পষ্ট নিরাবরণ ভাষায় বলেছে ‘কে কাকে এটি দিয়েছে? কাম দাতা, কাম প্রতিগ্রহীতা। কাম সমুদ্রে প্রবেশ করেছে। কামের সঙ্গে তোমাকে প্রতিগ্রহণ করছি। কাম, এই তোমার ভূমি, তোমাকে গ্রহণ করুক অন্তরীক্ষ।’[১] যৌন প্রেমের মূল কামনায়, মূল, কিন্তু শেষ পরিণাম নয়। তবু পৃথিবীর এই একটি মাত্র সম্পর্ক যার ভিত্তি যৌন কামনায়, যে কামনা অতল সীমাহীন সমুদ্রে প্রবেশ করেছে; তাই প্রেমিক বলছে তার প্রেমিককে গ্রহণ করুক অমনই অবাধ সীমাহীন অন্তরীক্ষ। এই মন্ত্রে কামনাসঞ্জাত প্রেমের গভীরতা সমুদ্র ও আকাশের অনুষঙ্গে অনুরণিত। খ্রিস্টপূর্ব পনেরোশো অব্দের মিশরী কবি আমেন মোসে-র কাব্যে শুনি প্রেমিক অসিরিসের মৃত্যুর পর আইসিসের বিরামহীন রোদন, যেন মাঝদুপুরে চিলনীর তীক্ষ্ণ করুণ রব। এই প্রেম পৃথিবীর অসংখ্য কাব্য উপন্যাস নাটকে অভিনন্দিত; সর্বত্র ধর্মীয় অতিকথায় প্রেমের দেবতা ও দেবী কল্পিত হয়েছেন এই আবেগটিকে একটি অতিপার্থিব মহিমায় মণ্ডিত করার উদ্দেশ্যে। একটা কারণ হল, সত্যকার প্রেম সকল মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে না; যার করে, স্পর্শমণির স্পর্শে তার সত্তার উত্তরণ ঘটে এক অপার্থিব লোকে, যেখানে প্রেম আপন মহিমায় বিরাজিত। এই বিষয়ে সারা পৃথিবীর সকল সাহিত্য শিল্পের সাক্ষ্যই এক। সকলেই এর যৌন মূল সম্বন্ধে অবহিত থেকেও উপলব্ধি করেছেন এর যথার্থ অবস্থান এক উজ্জ্বল মহিমায়।
[১. ক ইদং কস্মা অদাৎ? কামো দাতা কামঃ প্রতিগ্রহীতা। কামঃ সমুদ্রমাবিশ। কামেন ত্বা প্রতিগৃহ্ণামি। কামৈতত্ত্বে ভূমিস্ত্বা গৃহণাত্বন্তরীক্ষম্।। অথর্ব (৩:২৯:৬)]
সত্যকার ঐক্যদাম্পত্য-বিবাহের মূল এই প্রেম। তাই আমরা ভারতবর্ষে বলেছি, গান্ধর্ব বিবাহ অনুষ্ঠান নিরপেক্ষ, গুরুজনের অনুমতি বা নির্দেশনারও অপেক্ষা সে করে না। তাই এই বিবাহের গান্ধর্ব নামের সঙ্গে আছে সঙ্গীতের অনুষঙ্গ। যেন জাগতিক বাস্তবের মধ্যে থেকেও কোনও সুর-লোকের সঙ্গে এর আন্তর-যোগ। এই বিবাহ এমন এক সত্যে প্রতিষ্ঠিত যা প্রাত্যহিকের মধ্যে থেকেও প্রাত্যহিককে অতিক্রম করে একটি নিত্যকালের রমণীয়তাকে স্পর্শ করেছে। কাজেই ঐক্যদাম্পত্যের এই কল্পনাটি প্রাচীন; বাস্তবেও এর মূল নিহিত ছিল। এই দাম্পত্যের ভিত্তিতে রচিত পরিবারের মধ্যেও একটি মহিমা থেকে যায়। মহাভারত ভরতবংশের বংশধর পুত্র দৌষ্যন্তি ভারতকে সৃষ্টি করেছে গান্ধর্ব বিবাহের সন্তান রূপে। রূপক অর্থ নয়, কিন্তু গূঢ় কোনও সত্যের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে এ তথ্যটি। এবং এ তথ্যের গভীর তাৎপর্য বিবাহের যৌনমূলকে স্বীকার করেও তাকে অতিক্রম করে প্রেম ও বিবাহের পূর্ণ বিকাশের একটি সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করে। শুধু বৈষ্ণবসাহিত্য নয় সব চিরন্তন সাহিত্যই প্রেমের নানা অনুষঙ্গ স্বীকার করেছে। প্রেমে মোহ আছে। প্রেমিক-প্রেমিকা নাকি পরস্পরকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পায় না। যারা প্রেমিক-প্রেমিকা নয়, তারাই কি পায়? তাদের ভ্রম হয় না? কবি বলেন:
যদি প্রেম হয় অমৃতকলস
মোহ তবে রসনার রস।।
থাক না মোহ? দুটি বুদ্ধিমান বুদ্ধিমতী মানুষ মোহের চোখে পরস্পরকে দেখলেও তাদের বুদ্ধিবৃত্তি এমন আচ্ছন্ন বা কলুষিত হয় না যে, ভাবী জীবন সম্বন্ধে বিচার বা আলোচনা করতে তারা সম্পূর্ণ অক্ষম হবে। মোহ ছাড়াও প্রেমে আছে দুঃখ, বিরহ ও অপ্রাপ্তির আর্তি, নিজেকে অপরের যোগ্য নয় জানার গোপন দৈন্যবোধ ও আরও নানা আনুষঙ্গিক যন্ত্রণা পূর্বরাগে শুধু নয়, অনুরাগে, মিলনে, দাম্পত্য পর্বেও এ সবই আসে যায় নানা পর্বে, নানা লগ্নে প্রেমের উপলব্ধির স্তরে স্তরে।
প্রেমে প্রতিষ্ঠিত যে দাম্পত্য ও পরিবার তা বর-বধূকে ধ্বংস করে না বরং তা ‘সম্মুখপানে চলিতে চালাতে জানে’; প্রয়োজনে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করতে জানে। এ পরিবারে যে সন্তান আসে সে পায় মাধুর্যের একটি পরিবেশ এবং তার যথার্থ নিরাপত্তার ভিত্তি এই মাধুর্যের অন্তর্নিহিত শক্তিতে। সম্ভবত মানুষের জীবনে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ আকুতিই হল আর একটি মানুষের সঙ্গে সাহচর্যের সহমর্মিতার জন্যে। এই সাহচর্য সবচেয়ে ঋদ্ধ ও সুন্দর হয়ে ওঠে যথার্থ ঐক্যদাম্পত্যে। আবার বলা ভাল, মানুষের সমাজ ঐক্যদাম্পত্য পেয়েছে যৌন যুগ্মতার দীর্ঘ পরিক্রমার পরে। অসংখ্য দম্পতির ক্ষেত্রে এটা দেখা দেয় বিরূপ, বিকৃত, বেসুর ছন্দপাতে। কিন্তু সেটাই এর স্বরূপ নয়। মেকি টাকা বাজারে থাকা মানে কোথাও আসল টাকাও আছে। মেকি টাকার চাপের নীচে সেটি আপাতত অপরিদৃশ্যমান হলেও সে তো মায়ামাত্র হয়ে যায় না। এখন যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে তার প্রধান কারণ দুটি— প্রথমত, বহু যুগের ঐতিহ্যের প্রভাবে সারা পৃথিবীতে দাম্পত্যে নারীর অধোবর্তন ও অবনমন ঘটেছিল, বর্তমান সমাজ সেটির প্রতিকার চাইছে যাতে বিবাহবন্ধন উদ্বন্ধনে পরিণত না হয়। এ চাওয়া নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত: নারীকে দাম্পত্যের অর্ধাংশ রূপেই থাকতে হবে, অন্য কোনও ভূমিকায় শুধু নারীর অবমাননা নয়, দাম্পত্যেরই অপভ্রংশ ও বিকার ঘটে। দ্বিতীয়ত, বহু বিকৃতিতে, স্বার্থসংকীর্ণ, অহমিকানিষ্ঠ সংঘাতে যুগে যুগে দাম্পত্য থেকে প্রেম অন্তর্হিত হয়েছে। পড়ে থেকেছে শুধু বন্ধনটি। যে হতে পারত সহচর বা সহচরী সে হয়ে ওঠে কারা-প্রহরী। সহানুভূতির স্থান নেয় তিক্ত বিদ্বেষ, দু’জনের মধ্যে মানসিক আশ্রয়ের পরিবর্তে গড়ে ওঠে দুর্ভেদ্য প্রাচীর। বহু যুগ ধরে বহু দেশে পরিব্যাপ্ত দাম্পত্যের এই অপভ্রংশ মানুষকে সংশয়ী করে তুলেছে দাম্পত্যের আন্তর্নিহিত সত্য সম্পর্কে, বিবাহ ও পরিবার সম্পর্কে। এ সন্দেহ বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ভিত্তিহীন নয়, একে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রথমত সম্বন্ধ করে বিয়ে, যা এখনও বহুল-প্রচলিত, তাতে তরুণ দম্পতিটি কী অনুভব করে, তা নিতান্ত গৌণ হয়ে যায়। তাদের কাছে যে ভূমিকা চাওয়া হত সেটা ছিল ন্যূনতম। আমরা আগেই (দ্বিতীয় অধ্যায় ‘কনকাঞ্জলি’) দেখেছি, বিবাহ একটি দলগত খেলা। ফলে দলের খেলা ফুরোলে অনেক সময় দেখা যায় যে, বিবাহিত দুটি মানুষের কোনও আন্তরিক সাযুজ্য নেই। বোভোয়া বলছেন, একটি সামাজিক একক হয়ে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যই এবং সমাজের অংশ হিসাবে গণ্য হওয়ার জন্যই যেন দুটি মানুষ মিলিত হল।[২] অধিকাংশ আনুষ্ঠানিক বিবাহে বর ও কন্যার সম্মতি জানতে চাওয়া হয়। সম্মতি সব সময় স্বতঃস্ফুর্ত নাও হতে পারে: নানা রকম চাপে আর্থিক বা পারিবারিক প্রয়োজনে, নির্ভরযোগ্য বৃত্তি ও আয়ের প্রত্যাশায়, উপযুক্ত বংশমর্যাদার প্রলোভনে, বিবাহিত নামে সামাজিক সমর্থন ও নিরাপত্তার লোভে সম্মতি আসতে পারে। কিন্তু যথার্থ বিবাহের পক্ষে সম্মতি যথেষ্ট নয়, অন্তরের অন্তরতম প্রদেশের গভীর আগ্রহ ও তীব্র আকুতিই সেই প্রেমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে। প্রকৃত বিবাহিত দাম্পত্যের এটাই ভিত্তিভূমি।
[২. ‘Marriage is only a means of integration into society.’ The Second Sex, p. 447]
প্রাচীন ভারতে অশ্বারোহণ অনুষ্ঠানে বর বধূকে একটি শিলাখণ্ডের ওপরে দাঁড়াতে বলে, ‘ওই শিলার মতো দৃঢ় হয়ো আমার জীবনে’। কথাটায় খাঁটি সুর বাজত যদি শিলাখণ্ডের ওপরে দু’জনে দাঁড়িয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে দু’জনেই ওই কথা বলত। অরুন্ধতী দর্শনের অনুষ্ঠানেও যদি দু’জনে বলত ধ্রুব দ্যৌ, ধ্রুবা পৃথিবী, ধ্রুবা অরুন্ধতী, আমরাও পরস্পরের জীবনে যেন ধ্রুব হই। তা নয়, সমস্ত দাম্পত্যে নিষ্ঠা একনিষ্ঠতা ও দৃঢ়তার দায়টা দেওয়া হত বধূটির ওপরে, তার পাতিব্রত্য ছিল অপরিহার্য। তাকে সতী বধূ হতে হবে অথচ ওই সতীর কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দই নেই। তাই ফাঁকি থেকে যায় বিবাহে, তাই দাম্পত্য নড়বড়ে শিলার ওপরে স্থাপিত হয়। দু’জনে একই প্রেমের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে যুগপৎ স্থায়ী সাহচর্যের কথা উচ্চারণ করতে পারলে ভিতটা খাঁটি হত। এবং সেটা সম্ভব হতে পারত শুধুমাত্র প্রেমনিষ্ঠ বিবাহেই।
বিবাহে পরস্পরের কাছে শাস্ত্রোক্ত প্রত্যাশাও খুব তাৎপর্যবহ। দ্রৌপদী সত্যভামার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, ‘নিরন্তর দাসীর মতো স্বামীদের সেবা করি, তার বিনিময়ে পাই— সন্তান, শয্যা, মহার্ঘ্য, আসন, বসন, মাল্য, গন্ধ, স্বর্ণ ও অতুলনীয় যশ।’[৩] বস্তুগত প্রাপ্তি বিবাহে সর্বোচ্চ কাম্য— এ কথা উচ্চরণের মধ্যেই নিহিত দাম্পত্যের অপমান। বিবাহে পুরুষনির্ভর অনুপার্জিকা নারী বস্তুগত ব্যবহারিক নিরাপত্তা নিশ্চয়ই পেত, কিন্তু সেটা তো বিবাহের বহিরঙ্গ। এখানে আন্তর-প্রত্যাশা বা প্রাপ্তির কোনও কথাই নেই, তাই এর মধ্যে বিবাহের স্বরূপকে অনুধাবন করা যায় না। বুঝতে অসুবিধে নেই, এ যশ পতিব্রতার, এবং এর অনুরূপ কোনও যশ পুরুষের কাম্য নয়, কারণ পত্নীব্রত পুরুষ সমাজে অপযশস্বী, তার অভিধা হয় স্ত্রৈণ। এই যেখানে সমাজ অনুমোদিত অধিকাংশ বিবাহের চেহারা, সেখানে আজ এই ঐক্যদাম্পত্যে আস্থাহীন মানুষ যদি নানাবিধ বিকল্প খোঁজে তা হলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।
[৩. মহা. বনপর্ব (৩২২-৩২৩)]
কিন্তু তারও আগে পরে কথা থেকে যায়। একটি নারী ও একটি পুরুষ সমস্ত দেহমন দিয়ে পরস্পরের সান্নিধ্য কামনা করার ফলেই সূচনা হয় প্রেমনির্ভর বিবাহ ও দাম্পত্য। শরীরও এখানে গৌণ নয়, মনও নয়। সমস্ত জীবজগতের মধ্যে শুধু মানুষের মিলনেই মনের একটা মুখ্য ভূমিকা আছে। এটা না থেকে যে মিলন তা তো শুধু জৈব বা বৈষয়িক স্তরেই থেকে যায় এবং সেটা বিবাহের একটা মৌলিক অপূর্ণতা।
দু’জনের মধ্যে নিবিড় মানসিক বন্ধন গড়ে উঠলে দু’জন দু’জনের কাছে স্বতন্ত্র ব্যক্তি রূপে দেখা দেয়। না হলে বিপত্তি। মানসিক সংযোগ ও মিলন ঘটার পূর্বেই ফুলশয্যা, যা এখনও এ দেশে অধিকাংশ বিবাহেই চলে আসছে। তাতে ওই ব্যক্তিপরিচয়ও গড়ে উঠতে পারে, তবে না গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও খুবই প্রবল। সেখানে ব্যাপারটার মধ্যে একটা স্থূলতা ও অন্তর্নিহিত অপূর্ণতারও যেন আভাস মেলে। এমন ভাবে যে মিলনের সূচনা তাতে দেহ যেন মাত্রাতিরিক্ত একটা গুরুত্ব পায় যা, আজকে অন্তত, মানুষের রুচিকে পীড়া দেয়। ‘এই বিবাহ তত্ত্বগত ভাবে গ্লানিময়, কারণ (এ বিবাহ) দুটি মানুষকে পরস্পরকে শুধু শরীর হিসাবে জানার নরকে ঠেলে দেয়। ব্যক্তি হিসাবে জানতে দেয় না।’[৪] শরীর ও মন সমান প্রাধান্য পেলে তবেই দাম্পত্য সত্যকার একটি দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এবং এ ভিত্তির কোনও বিকল্প নেই। ‘বিবাহে মনের সাহচর্য, যাকে পাশ্চাত্য জগতে বলে সাহচর্যভিত্তিক বিবাহ, এটি সার্বত্রিক নয়।[৫] কিন্তু এই পরস্পরের সাহচর্য কামনা, সহমর্মিতা এগুলি প্রেমেরই অপরিহার্য অনুষঙ্গ, কামের নয়। কামনায় তীব্রতা থাকে পরস্পরের আসঙ্গের জন্য, সে-ও খাঁটি, কিন্তু অস্থায়ী, কামনা চরিতার্থ হওয়ার পরও পরস্পরের কল্যাণকামনায় প্রেমে নিরন্তর স্বার্থত্যাগে যে একটি মাধুর্যের সৃষ্টি হয়, শুধুমাত্র কামে তার স্থান নেই। এই সঙ্গকামনাকে স্থায়ী করাই ঐক্যদাম্পত্যের উদ্দেশ্য এবং শুধুমাত্র কামের সে সাধ্যই নেই। প্রেম থাকলে সংকীর্ণ সম্ভোগলিপ্সা নিজেকে অতিক্রম করে নিয়ে আসে সহিষ্ণু ও সুন্দরতর এক পরিবেশ, যেখানে দু’জনের মধ্যে একটি আকাশ থাকে। সেখানে কল্পনার বিহরণ, সেই কল্পনায় একজন অপরের ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্যে কী প্রয়োজন তা স্পষ্ট করে উপলব্ধি করে এবং প্রায়শই এই উপলব্ধির মধ্যেই তার কাছে প্রতিভাত হয় তার দিক থেকে অপরের বিকাশের জন্য কখন কতটা স্বার্থত্যাগ প্রয়োজন। ওই আকাশটুকু না থাকলে সে কল্পনা সক্রিয় হয় না, তখন আন্তঃব্যক্তিস্বার্থের কটু সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এক ধরনের সংকীর্ণ অহমিকাসর্বস্বতা মুখ্য হয়ে ওঠে। তখন বিবাহ অবাঞ্ছিত বন্ধন। প্রেমে মুক্তিও আছে:
আমার প্রেম রবিকিরণ হেন।
জ্যোতির্ময় মুক্তি দিয়ে তোমারে ঘিরে যেন।।
প্রেমে অবশ্যই পরস্পরের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে, কিন্তু তার মধ্যে সহজাত যে প্রত্যয় থাকে তার দ্বারা ঈর্ষার উদ্রেক ঘটতে পায় না। সংঘাতের বাস্তব কোনও কারণ থাকলেও প্রেমের সম্পর্কে দুটি নারীপুরুষ তা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারে; একবার নয়, বারবার। কারণ ‘প্রেমে ভয় নেই, পরিপূর্ণ প্রেম ভয়কে সরিয়ে দেয়… যে ভয় পায় সে প্রেমে পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। প্রেম মৃত্যুর মতোই শক্তিশালী এবং অমোঘ।[৬] এ প্রেম প্রকৃতিদত্ত বা সহজাত নয়, জীবনে এর উন্মেষ ঘটলে দীর্ঘ কঠিন সাধনার মধ্যে আত্মসমীক্ষার দ্বারা একে প্রতিদিন অর্জন করতে হয়। যাচাই করতে হয়; তবেই পূর্বরাগ অনুরাগের পথ ধরে প্রেম প্রতিষ্ঠিত হয়।
[8. ‘Marriage is obscene in principal in dooming them to know each other as bodies, not as persons.’ The Second Sex, p. 463
৫. ‘The Western concept of companinonship marriage is unusual. Elsewhere marriage is not entered into for the sake of companionship.’ Marriage and Love in England, p. 154
৬. ‘ There is no fear in love, perfect love casteth out fear… He who fears has not been perfected in love… Love is as strong as death.’ I John 4:18; Song of Solomom 8:6]
“ভয় ছিল না দময়ন্তীর: মধ্যযৌবনা, দুই সন্তানের জননী, দীর্ঘবিরহের মর্মান্তিক যন্ত্রণায় মায়ের কাছে গিয়ে বলেন, ‘নল বিনা তাঁর জীবন অর্থহীন, দুর্বহ। এবং তিনি নিশ্চিত জানেন, নল যেখানেই থাকুন না কেন, দময়ন্তী তাঁর জন্যে ব্যাকুল এ সংবাদ পেলে নিশ্চয়ই দেখা দেবেন।’ দেখা গেল, এটা তাঁর অনুমানমাত্র নয়, দৃঢ় প্রত্যয়; তাঁর নির্ভীক প্রেমের ভিত্তি সত্যিই দৃঢ় ছিল। নল এলেন।
এমনই তীব্র আকুতি ছিল রুরুর। প্রমদ্বরার মৃত্যুর পরে জীবন তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অর্থহীন বলে প্রতীত হল, নিজের পরমায়ুর অর্ধেকের বিনিময়ে তিনি প্রমদ্বরাকে উজ্জীবিত করেন।”
এর মধ্যে স্বার্থত্যাগ আছে। নিজের পরমায়ু ক্ষতিস্বীকার করে প্রমদ্বরার জীবন চাইলেন রুরু, কারণ প্রমদ্বরা বিনা দীর্ঘ জীবন তাঁর কাছে দীর্ঘ অভিশাপ মাত্র। পুরুষের প্রেমের তীব্রতার এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত। গ্রিক অতিকথায় আডমিটস-এর অবধারিত মৃত্যু নিবারিত হতে পারত কেবলমাত্র তার বিনিময়ে কেউ মৃত্যুবরণ করলে। অবশ্য কোনও আত্মীয়ই রাজি হয়নি, হল শুধু সদ্যপরিণীতা স্ত্রী আলকেস্টিস। এ সব কাহিনিতে প্রেমকে এক নতুন মাত্রায় মণ্ডিত করেছে প্রিয়জনের স্বার্থত্যাগ, আত্মত্যাগ।
যে-প্রেম শরীরনিষ্ঠ হয়েও শরীরকে ছাড়িয়ে মনকে আশ্রয় করছে তার ওপরে বিবাহের ভিত্তি হলে সে বিবাহ অন্য এক স্তরে উন্নীত হয়। অন্তত যতদিন সে প্রেম সজীব থাকে। যদি সে প্রেমের মৃত্যু আসেও একদিন, তবু তার ওই উজ্জ্বল পর্বটা তাতে মিথ্যা হয়ে যায় না।
প্রেম প্রথম দর্শনে হতেও পারে, না-ও হতে পারে। জীবনে যেমন ভাবেই তার আবির্ভাব ঘটুক, তাতে গভীরতা আনে দুটি মানুষের রুচি, আদর্শ, চিন্তাধারা এবং আবেগনির্ভর সূক্ষ্ম সংবেদনাগুলির সাযুজ্য। আরও একটা বড় উপাদানের অভাবে প্রেম হতমান ও নির্জীব হয়ে পড়ে; তা হল পারস্পরিক শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা মানুষ হিসেবে, প্রেমিক-প্রেমিকা হিসাবে, জীবনের সহযাত্রী হিসেবে। এর মধ্যে নিহিত থাকে পারস্পরিক বিশ্বাসও। (সংস্কৃত শুধু ধাতু, যার থেকে নিষ্পন্ন শ্রদ্ধা, তার মূল অর্থ, বিশ্বাস।) শ্রদ্ধা যদি হারিয়ে যায় তাহলে মানুষ হিসেবে পরস্পর পরস্পরের কাছে ছোট হয়ে যায়, তখন প্রেমের যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা অনুকম্পা বা করুণা হতে পারে; কিন্তু শ্রদ্ধা বিনা প্রেম বাঁচে না, বিনা শ্রদ্ধার দাম্পত্য অনেক সময় দুর্বহ হয়ে ওঠে। এই শ্রদ্ধা দর্শনে বা স্বল্প পরিচয়ে জন্মায় না, পরস্পরকে নিবিড় ভাবে চেনার দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যেই এর উন্মেষ ঘটে ধীরে ধীরে। প্রেমনিষ্ঠ দাম্পত্যে শ্রদ্ধা সম্পূর্ণ অপরিহার্য। এবং একই সঙ্গে এও সত্য যে, পরস্পরের কাছে শ্রদ্ধেয় থাকার জন্য নিরন্তর দু’জনের এক সাধনাও চলা চাই, যাতে দাম্পত্যের এই দৃঢ় ভিতে কোনও ঘা না লাগে। এর জন্য পরিচয় কিছু নিবিড় হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেটুকু ধৈর্য এবং সময় দিলে অনেক সময় হঠকারিতার দরুন অনুতাপ এড়ানো যায়। এ কথা ঠিকই, যে কিছুদিন মেলামেশার মধ্যেই দুটি মানুষের মনের সব দিক উদ্ঘাটিত হয় না, বিবাহের পরে প্রত্যহ পরস্পরের নতুন নতুন দিক চোখে পড়ে, তার মধ্যে অনাশঙ্কিত দোষত্রুটি বা মানসিক বৈষম্যও ধরা পড়তে পারে এবং তার দ্বারা সংঘাত আসতে পারে। এ-ও সত্য যে, প্রথম অনুরাগ স্বভাবতই অসহিষ্ণু: অদূরদর্শী গভীর ভাল লাগাকে ভালবাসা বলে ভুল করার ইতিহাসও বিস্তর। নতুন প্রেমের কাছে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা কতকটা বেরসিকের মতোই কাজ। তবু সেই মধুর অনুরাগ যাতে তার মাধুর্য অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে— এবং প্রেমিক প্রেমিকার কাছে প্রেমের পরমায়ু দীর্ঘায়িত করাও তো এক বাস্তব স্বার্থই— এ জন্যে নিজের আবেগ ও অন্য পক্ষের মানসিকতা একটু ভাল করে বোঝবার মতো সময় নিজেদের দিলে ফলটা শুভ হওয়াই স্বাভাবিক। অবশ্যই এ সব সতর্কতা সত্ত্বেও ভুলবোঝাবুঝি ও বিরোধ দেখা দিতে পারে কারণ:
সবচেয়ে দুর্গম যে মানুষ আপন অন্তরালে
তার পূর্ণ পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে।
তবু এত কথা উঠছে এই কারণে যে, বিবাহ আনুষ্ঠানিক বা আইনের দ্বারা সিদ্ধ হোক, অথবা গান্ধর্ব মতে একত্রবাসের পরওয়ানাই হোক, বিবাহের দ্বারাই দাম্পত্য প্রতিষ্ঠা হয় ও পরিবারের সূচনা হয়। এবং এখনও পর্যন্ত সমাজ যেখানে যতটা এগিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলে যে, এ ভাবে দুটি নারী পুরুষ যখন কাছাকাছি আসে, থাকে ও সন্তানকে আনে, দু’জনের রচিত গৃহনীড়ে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, দুর্গত, পীড়িত মানুষ যেখানে বিপদে, প্রয়োজনে আশ্রয় পায়, তখন এই সহাবস্থানকে আইনে অনুষ্ঠান নিরপেক্ষ ভাবেই বিবাহ আখ্যা দেওয়া চলে। যে নীতিটা দম্পতির পক্ষে অনুসরণ করা আবশ্যক তা হল, তারা যেন যথাসাধ্য পরস্পরের বা সন্তানের বা সে পরিবার-সম্পৃক্ত অন্য কারও কোনও ক্ষতির নিমিত্ত না হয়। দম্পতির যে কোনও একজন তৃতীয়ের প্রতি যদি এমন ভাব আসক্ত হয় যাতে তার কাছে পুরাতন প্রেম অর্থহীন হয়ে যায় ও সেই তৃতীয়ের সঙ্গে মিলনেই শুধু জীবন অর্থপূর্ণ হয়, তা হলেও পূর্ব সম্পর্কের সঙ্গীর সঙ্গে খোলাখুলি এ বিষয়ে কথা বলে সে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর এবং সন্তানের প্রতি যাতে যথাসম্ভব কম অবিচার হয় সে ব্যবস্থা করে বিচ্ছিন্ন হওয়াই ভাল। এর জন্যে প্রয়োজন দায়বদ্ধতার মানসিকতা; পরস্পরের প্রতি, সন্তানের প্রতি এবং পটভূমিকায় যে সমাজ আছে তারও প্রতি। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেও কখনও কখনও মানুষ সুফল পেয়েছে এবং উত্তরকালে সে নিজেই বলেছে, ভাগ্যে ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ সরে যায়নি! আবার সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেও নতুন আকর্ষণ থেকে সরে থেকেছে। সংসারটাকে বজায় রেখে বাইরে থেকে পরস্পরের প্রতি ও সন্তানের প্রতি পূর্ণ কর্তব্য পালন করার আনন্দে সান্ত্বনা পেয়েছে, নবতর আকর্ষণ থেকে সরে থাকার এমনও বহু দৃষ্টান্ত আছে। কখনও বা অসুস্থ স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি মমতাবশে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং আত্মার গভীরে পারস্পরিক দায়বদ্ধতার কাছে খাঁটি থাকার পুরস্কারে শান্তি পেয়েছে এমনও শোনা গেছে। কখনও বা প্রথম প্রেমের মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ করে নিজের অন্তরে আত্মসম্মানবোধকে অপ্রতিহত রাখবার পরিতৃপ্তিতে স্বস্তি পেয়েছে এমন ঘটনাও বিরল নয়।
শেষ কথা কে বলবে? অনুরাগ প্রেম-মিলন-বিবাহ-দাম্পত্য-সন্তান-পরিবার যে দীর্ঘ তন্তুতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তার সূচনাতে যদি নারীপুরুষ তলিয়ে দেখে যে একে অন্যকে বাদ দিয়ে থাকতে পারবে না, মিলিত হতে না পারলে জীবন নিরর্থক হবে এবং তার সঙ্গে যদি এ-ও অনুভব করে যে, এ প্রেম এমনই ঋদ্ধ যে এর জন্যে অনেক ক্ষতি, অনেক ত্যাগ স্বীকার করা যায় এবং তারা মনে মনে নিজেকে সে জন্যে প্রস্তুত করে, তা হলে অনেকটা স্থির ভিত্তির ওপরে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। দু’জনেরই জীবনে অন্য অনুরাগের সম্ভাবনা প্রথম থেকে স্বীকার করে দ্বার মুক্ত রাখার সাধনাও করা প্রয়োজন। হয়তো কোনও দিনই অন্য অনুরাগ দেখা দেবে না, কিন্তু দিতে পারে— এ সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা মূর্খতা। যদি দেখা যায়, তা হলে সে নিয়ে যেন তিক্ত সংঘর্ষ না হয় তেমন মানসিক প্রস্তুতি এবং সাধ্যমতো, অন্তত নিজের কাছে অপরকে যথাসম্ভব প্রসন্নচিত্তে মুক্তি দেওয়ার অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন। সত্যই এ কাজ সহজ নয়, কিন্তু নিজেকে বলা প্রয়োজন, ‘আকাঙ্ক্ষার ধন নহে আত্মা মানবের।’ প্রেম অপরের প্রতি যে অধিকার দেয়, তা ততক্ষণই সত্য, যতক্ষণ নূতন অনুরাগ পুরাতন প্রেমকে আচ্ছন্ন না করে। করলে অবশ্যই মর্মের গভীরে রক্তক্ষরণ হতে থাকবে এবং তা দুঃসহ, দুর্বহ; কিন্তু প্রেমের মূল্যও নানা ভাবেই মানুষকে দিতে হয়। এমনও বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, নবীন অনুরাগ দীর্ঘায়ু হয়নি। প্রথম প্রেমের কাছেই ফিরতে হয়েছে। তখন অপরপক্ষের রুষ্ট বা বিমুখ না হওয়ার সাধনাও প্রয়োজন। ভুললে চলবে কেন যে, কোনও বস্তু ভাঙা সহজ, জোড়া কঠিন এবং সেটি সাধনাসাপেক্ষ। এমন ভাবে দ্বিতীয়বারে জোড়ার পরেও দাম্পত্য মন্দাক্রান্তা ছন্দে প্রবাহিত হচ্ছে, তা-ও বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়।