৯৫.
প্রমাণকোটিতে গঙ্গার তীরে সন্ধ্যা নেমে আসছিল। উদকক্ৰীড়ন নামক অস্থায়ী আবাস-গৃহে একটু একটু করে আলো জ্বলে উঠছিল। জলবিহার সেরে শ্রান্ত-ক্লান্ত বালকদের কেউ কেউ ঠিক করলেন, ওই অস্থায়ী আবাস-গৃহেই থেকে যাবেন। তারা স্নানের পর পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে আলস্যে রাত কাটিয়ে দেবেন বলে ঠিক করলেন। কেউ থাকছেন, কেউ যাচ্ছেন, কেউ বস্ত্র পরিধান করছেন, কেউ খাবার খাচ্ছেন–এমন হট্টগোলের মধ্যে কে গেল, কে থাকল–এটা কেউ ভাল করে খেয়াল করলেন না।
ওদিকে অস্থায়ী আবাস থেকে বেশ খানিকটা দূরে যেখানে গঙ্গা থেকে উঠেই ভীম শুয়ে পড়েছিলেন ভূমিশয্যায়, সেখানে তার ওপর নজর রাখছিলেন শুধু একটি মাত্র লোক। তিনি দুর্যোধন। আমাদের ধারণা–পাকা খুনী মানুষ যদি তার নিচ্ছিদ্র পরিকল্পনার কথা কাউকে না জানায় এবং ঠান্ডা মাথায় খুন করে, তবে তার পরিকল্পনা সত্যিই নিচ্ছিদ্র হলে তার ধরা পড়বার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। কিন্তু পাকা খুনীও তার খুনের কথা চেপে রাখতে পারে না, অনেক সময় কাছের মানুষকে সে বলে ফেলে। বলে ফেলতে ইচ্ছে করে, না বলে পারে না। আর দ্যএইখানেই সব গণ্ডগোল হয়ে যায়। এই দৃষ্টে এই সতেরো আঠারো বছর বয়সেই দুর্যোধন পাকা খুনীর মতোই ব্যবহার করছেন। তার পরিকল্পনার কথা কেউ জানে না, এমনকি তার প্রিয় ভাই দুঃশাসনও না। ভীম জল থেকে ওঠার পর থেকেই তিনি শুধু নজর রাখছেন প্রমাণকোটির একান্তে দাঁড়িয়ে।
ভীমের বড় ঘুম আসছে। প্রমাণকোটির গঙ্গাতীরে সন্ধ্যাচ্ছায়া ঘনীভূত হবার সঙ্গে ভীমের চোখেও নেমে এল অনন্ত আঁধার। কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না, বিচার করতে পারছেন না, শুধু আঁধার ঘনিয়ে আসছে চোখে, শত রাত্রির আঁধার। ভীম সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে রইলেন নিশ্চিন্ত নিদ্রায়। ভীমকে সম্পূর্ণ স্থির হয়ে যেতে দেখে দুর্যোধন একা তাঁর কাছে এসে দাঁড়ালেন। তারপর শক্ত লতা-গাছিতে বেঁধে ফেললেন ভীমকে, যাতে কোনও ভাবে সংজ্ঞা ফিরে এলেও অন্য কোনও উপায়ে ভীম নিজেকে বাঁচাতে না পারেন। গঙ্গার তীরে একা এবং একা ভীমকে লতার বাঁধনে বেঁধে–তত বধ্বা লতাপাশৈ–ভমিং দুর্যোধনঃ স্বয়ম্-দুর্যোধন ভীমকে ফেলে দিলেন গঙ্গায়–স্থলাজ্জলমপাতয়ৎ।
দুর্যোধন ফিরে এলেন প্রমাণকোটির অস্থায়ী আবাসে। এসেই মিশে গেলেন ভাইদের সঙ্গে একই প্রক্রিয়ায়। তিনি এসে দেখলেন–চার পাণ্ডব-ভাই অনুমান করছেন–ভীম আগেই হস্তিনায় চলে গেছেন। কৌরবভাইরাও অনেকে বললেন–হ্যাঁ, ভীম বোধহয় আগেই চলে গেছেন। ভীমের ব্যাপারে কৌরব এবং পাণ্ডবদের একই রায় শুনে দুর্যোধন একেবারে নিশ্চিন্ত হলেন। যাঁরা প্রমাণকোটির অস্থায়ী আবাসে থাকতে চাইলেন, তারা রয়ে গেলেন, আর যাঁরা হস্তিনায় ফিরতে চাইলেন, তারা হাতী, ঘোড়া, রথযার যেমন ইচ্ছে, তেমন বাহনে চলে গেলেন। দুর্যোধন গেলেন একটু পরে। কৌরব-পাণ্ডবরা অনেকেই চলে যাবার পর। হয়তো নিশ্চিন্ত হতে চাইলেন–ভীম তার জলশয্যা থেকে আর উঠতে পারছেন না, অন্তত ওই সময়ের মধ্যে না।
সত্যিই তো ভীম উঠবেন কী করে? বিযের ঘোরে তার সর্ব শরীর অবশ হয়ে গেছে–বিযেণ চ পরীতাঙ্গো নিশ্চেষ্টঃ পাণ্ডুনন্দনঃ। তাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে দেওয়া হয়েছে গঙ্গায়। মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেই ভীম এসে পৌঁছলেন নাগ-বসতিতে। তার দেহভারে কত নাগ মারা গেল, কতক নাগে তাঁকে তীক্ষ্ণ দন্তে দংশন করল! বিয়ে বিক্ষয় হল। ভীম সংজ্ঞা ফিরে পেলেন–হতং সর্পবিযৌণব তদ্বিষং কালকূটজ। অনেক সাপ তখনও তাকে দংশন করবার চেষ্টা করছে, কিন্তু ভীমের কঠিন দেহে তারা দন্তস্ফুট করতে পারছিল না। বিষমুক্ত হয়ে চৈতন্য ফিরে পাবার সঙ্গে সঙ্গে ভীম তার দেহস্থিত লতালের বন্ধন ছিঁড়ে ফেললেন। কতগুলি নাগকে মাটিতে পিষে ফেললেন। হতাবশিষ্ট নাগেরা সভয়ে গিয়ে তাদের রাজা বাসকিকে এই অদ্ভুত সংবাদ জানাল।
আমাদের দৃষ্টিতে–এই নাগরা সাপের সমান বর্ণিত হয়েছে মাত্র। এরা আসলে নাগ জনজাতির মানুষ। আমরা আগেই দেখিয়েছি যে, নগর নাগ-সাহুয় (হস্তিনাপুর) থেকে আরম্ভ করে মথুরা এবং সমগ্র উত্তরভারতে নাগ জনজাতির মানুষেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। বিশেষত নদ-নদী হ্রদের সঙ্গে এদের একটা অদ্ভুত যোগ আছে! আর্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে নাগ-জনজাতির অনেকে আর্যদের বিরুদ্ধাচরণ করেন আবার অনেকে আর্যদের সভ্যতা-সংস্কৃতিতে নিজেদের সত্তা বিলীন করে। কৃষ্ণ-জীবনে যেমন নাগরাজ কালিয় এই বিলীনসত্ততার উদাহরণ, তেমনি পৌরাণিকতার বৃহৎ ক্ষেত্রে নাগরাজ বাসুকিও এই সত্তার অচিন্ত্য ভেদাভেদের উদাহরণ। আর্য সংস্কৃতি নাগরাজ বাসুকিকে এতটাই আত্মসাৎ করেছে যে তিনি পুরাণে-ইতিহাসে ভগবানের অংশাবতার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
আমাদের ধারণা–লতাজালমণ্ডিত ভীম গঙ্গার জলে কোনও ভাবে ভাসতে ভাসতে নাগবস্তিতে এসে পৌঁছন। হঠাৎই এক বিশাল চেহারার বরাকৃতি পক্ষকে দেখে নাগ–জনজাতির মানুষেরা তাঁকে বিষদিগ্ধ অস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত করার চেষ্টা করে। ফল উলটো হয় ভীমের শরীর বিষমুক্ত হয় তিনি সঙ্গে সঙ্গে লতার বঁধন ছিঁড়ে নাগ-জনজাতির মানুষদের আক্রমণ করেন, তাতে বেশ কিছু লোক হত হয় এবং আহতদের অবশিষ্টাংশ তাদের এই আকস্মিক বিপন্নতার কথা জানায় তাদের নেতা বাসুকিকে। ঠিক এরপরেই মহাভারতের কবির মানব-রূপক বৈচিত্র্য আর খুব প্রয়োজনীয় মনে হয় না। এমনি মানব-স্বরূপেই নাগদের আচরণ এখন বোঝা যায়।
বাসুকির লোকেরা ভীমের হাতে মার খেয়ে এসে তাদের নেতার কাছে নিবেদন করেছিল–মহারাজ! এ লোকটাকে কেউ বিষ খাইয়ে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছিল। তা না হলে, দেখুন, লোকটাকে প্রথম দেখেছি–একেবারে নিথর অজ্ঞান। কিন্তু আমাদের দংশনের ফলেই লোকটার জ্ঞান ফিরে এল। এখন দেখুন আমাদেরই কেমন মারছে, পিষে ফেলছে। আপনি একটু দেখুন মহারাজ–পোথয়ন্তং মহাবাহুং তং বৈ ত্বং জ্ঞাতুমহসি।
বাসুকি তার নাগচিহ্নধারী দল-বল নিয়ে ভীমকে দেখতে গেলেন। মহাভারতের কবি লিখেছেন–মহামতি বাসুকি ভীমকে মহারাজ আর্যক শূরের নাতি বলে চিনতে পারলেন–আৰ্য্যকেণ চ দৃষ্টঃ স পৃথায়া আৰ্য্যকেণ চ। আসলে চিনতে পারাটা হঠাৎ দেখে চিনতে পারা নয়। ভীমের সঙ্গে বাসুকির বাক্য-বিনিময় হয়েছে। ভীম তাঁর পিতৃ-মাতৃ কুলের পরিচয় দিয়েছেন। সেই পরিচয় প্রসঙ্গে দেখা গেল জননীর কুন্তীর মাতামহ আৰ্যক শূর নাগোত্তম বাসুকির নাতি হন। আশ্চর্য লাগবে শুনে। মনে হবে–তাহলে বাসুকির বয়স কত? আসলে এই সম্পর্কটা অত আক্ষরিক অর্থে ধরলে হবে না। বস্তুত অনেক কম বয়সের মানুষও পারিবারিক বৈচিত্র্যে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের দাদু-ঠাকুরদা হয়ে যান। তার ওপরে খেয়াল রাখতে হবে–নাগদের সঙ্গে তথাকথিত আর্য জাতির বৈবাহিক সম্পর্ক সেকালে যথেষ্টই চালু ছিল, কিন্তু তবু এই সম্পর্ক একেবারে এতটাই জল-ভাত নয়, যা তৎকালীন ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের মধ্যে দেখা যেত। ঠিক সেই কারণেই একটু দেরি লেগেছে ভীমকে চিনতে। কিন্তু পরিচয় পাবার সঙ্গে সঙ্গেই ওরে! এ যে আমার নাতির নাতি, বলে বাসুকি জড়িয়ে ধরেছেন ভীমকে–তদা দৌহিত্র-দৌহিত্রঃ পরিঃ সুপীড়িত।
বাসুকি ভীমকে পেয়ে পরম প্রীত হলেন। নাগদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ভীমকে তার আপন নাগভবনে প্রবেশ করলেন। আর্যক শূরের নাতি বলে ভীমকে অনেক ধন-রত্ন, অনেক উপহার দিয়ে বাসুকি তার মনের প্রসন্নতা জ্ঞাপন করতে চাইলেন। নাগ-জনজাতির লোকরাও এতক্ষণে ভীমকে বেশ বুঝে নিয়েছে। আর্যসংস্কৃতির প্রতিভূ হলেও এই মানুষটা যে একটু অন্যরকম এটা তারা বেশ বুঝে গেছে। তাছাড়া রতনে রতন চেনে অতএব বাসুকির নাগ-পার্ষদরা বলল–আপনি যদি এই মানুষটার ওপর এতই খুশি হয়ে থাকেন তবে একে এত ধনরত্ন উপহার দিয়ে কী হবে? একে আমরা বরং একটু নাগচিহ্নিত রস খাওয়াই–রসং পিবেৎ কুমারোয়ং ত্বয়ি প্রীতে মহাবল। আমাদের এই রস-কুণ্ডের একেক কুণ্ড রস খেলে এ ছেলে একশো হাতীর বল পাবে শরীরে। কাজেই যতক্ষণ এই রসচর্চা হয়, তার জন্য ছেলেটিকে ছেড়ে দিন আমাদের হাতে–যাবৎ পিবতি বালোয়ং তাবদস্মৈ প্রদীয়তা।
নাগদের মধ্যে অত সভ্যভব্য রুচিশীলতার ধ্বজা নেই, আর আর্যদের দেবকল্প সন্তান হলেও ভীমও এই ধ্বজাধারিত্ব পছন্দ করেন না। কাজেই নাগ-জনজাতির মানুষেরা ঠিক লোক চিনেছে। বাসুকি আর কী করেন, আপন লোকদের আগ্রহাতিশয্যে ভীমকে ছেড়ে দিলেন তাঁদের সঙ্গে। রস যে নাগ-জনগোষ্ঠীর আপন হাতে তৈরি এক উৎকৃষ্ট সুরা, তাতে আর সন্দেহ কী। কিন্তু এই নাগভবনে রসপানের একটু নিয়ম-কানুন আছে। সুরা যেহেতু এক অন্যতর আবেশ নিয়ে আসে শরীরে, অতএব সুরার প্রতি তাদের এক ধরনের সম্মানবোধও জড়িত আছে। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে তারা মদ্যপান করে না। ভীমকেও এসব নিয়ম মানতে হল। নাগরা মহা সমারোহে ভীমকে সুরাগৃহে বা রসায়নগৃহে নিয়ে গেল। নাগদের নিয়ম মেনে ভীমকে সেখানে বেশ হাত-পা ধুয়ে শুদ্ধ হয়ে বসতে হল–কৃতস্বস্ত্যয়নঃ শুচিঃ। এমনকি যেভাবে যে দিকে মুখ করে সন্ধ্যাবন্দনাদি মঙ্গলাচরণ করতে হয়, ভীম সেইভাবে পূর্বদিকে মুখ করে নাগদের রস পান আরম্ভ করলেন–প্রান্মুখশ্চোপবিষ্ট রসং পিবতি পাণ্ডবঃ।
কুণ্ডের রসায়ন শেষ হতে বেশি সময় লাগল না। পোক্ত মানুষ, ভবিষ্যতে মহাবীর হবেন, অতএব একেক নিঃশ্বাসে তার একেকটি কুণ্ড খালি হতে লাগল। এইভাবে আটটি রসকুণ্ড শেষ হবার পর ভীমের কিঞ্চিৎ ঝিমুনি এল। আর দেরি না করে নাগদের দেওয়া উৎকৃষ্ট শয্যায় শুয়ে পড়লেন ভীম।
এদিকে ভীম যখন রসপান করছেন, ততক্ষণে পাঁচ পাণ্ডবের চারজন বাড়ি ফিরে এসেছেন, কিন্তু ভীম আসেননি। ধর্মপ্রাণ সরলমতি যুধিষ্ঠির তো দুর্যোধনের প্যাঁচ-পোঁচ কিছুই বোঝেননি। তিনি বাড়িতে এসে কুন্তীর কাছে বললেন–মা, ভীম আসেনি এখানে? তার তো আগেই চলে আসার কথা। কিন্তু এখানেও তো তাকে দেখছি না, মা। সে গেল কোথায়–ক গতো ভবিতা মাতঃ নেহ পশ্যামি তং শুভে। আমরা তো আসার আগে প্রমাণকোটির বাগান, বন, গঙ্গাতীর সব খুঁজে এলাম। কিন্তু কোথাও তাকে দেখিনি, মা! কোথাও তাকে না পেয়ে ভাবলাম–ভীম আগেই বাড়ি চলে এসেছে–মন্যমানাস্ততঃ সর্বে যাতো নঃ পূর্বমেব সঃ। যুধিষ্ঠির খুব চিন্তান্বিত হয়ে বললেন–আমরা তাকে পেলাম না বলে খুব ব্যাকুল হয়েই এখানে এসেছি। ভাবলাম–এখানে তাকে ঠিক পাব। সে এখানে এসে আবার কোথাও যায়নি তো মা! তুমি তাকে কোথাও পাঠাওনি তো–ইহাগম্য ক নু গতত্ত্বয়া বা প্রেষিতঃ ক নু?
যুধিষ্ঠির এতক্ষণে বোধহয় একটু জটিলভাবে ভাবছেন। তিনি জানেন যে, অন্যদের সঙ্গে ভীমকে খুব মেলানো যায় না। ভীমের অভ্যাস আছে কাউকে না বলে এখানে-ওখানে চলে যাবার, যা ইচ্ছে খাবার, এমনকি যেখানে ইচ্ছে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস আছে ভীমের। যুধিষ্ঠির সেসব জানেন, কিন্তু এতক্ষণ দুর্যোধনের মতো মানুষের সঙ্গে থাকতে হয়েছে বলেই, অপিচ দুর্যোধন পাণ্ডবদের সবার সঙ্গে অত্যন্ত সুব্যবহার করেছেন বলেই যুধিষ্ঠিরের এখন নানা সন্দেহ হচ্ছে। তিনি বলেছেন–ভীমের ব্যাপারে আমার মন মোটেই ভাল কথা বলছে না–ন হি মে শুধ্যতে ভাবস্তং বীরং প্রতি শোভনে–সে যে কোথাও ঘুমিয়ে আছে একথা আমার মোটেই বিশ্বাস হচ্ছে না। এখন আমার কেবলই সন্দেহ হচ্ছে–তাকে কেউ মেরে ফেলেনি তো?
যুধিষ্ঠিরের এই দুশ্চিন্তা এবং এই ঘোরতর সন্দেহ দেখে জননী কুন্তী একেবারে হাহাকার করে উঠলেন। কিছুদিন আগেই প্রিয়তম স্বামী মারা গেছেন, এখন এই বলজ্যেষ্ঠ পুত্রটিকেও কি হারাতে হবে! কুন্তী কেঁদে বললেন–শীগগির যা বাবা, ছোট ভাইদের সঙ্গে নিয়ে আরও একবার দেখে আয় চারদিক–শীঘ্ৰস্তন্বেষণে যত্নং কুরু তস্যানুজৈঃ সহ–সে তো একবারও আমার কাছে আসেনি। অজানা ভয়ে ত্রস্তচকিত হয়ে কুন্তী মহামতি বিদুরকে ডেকে পাঠালেন। বিদুর ভূয়োদশী মানুষ, ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভায় তিনি মন্ত্রীও বটে। সবচেয়ে বড় কথা, হস্তিনার রাজবাড়িতে বিধবা অবস্থায় কুন্তী যখন তাঁর পঞ্চ পুত্র নিয়ে এসেছিলেন, তখন থেকে বিদুরই এই পরিবারটিকে সমস্ত সমব্যথা নিয়ে দেখে আসছিলেন।
আসলে পাণ্ডু মারা যাবার পরে ধৃতরাষ্ট্র যতই ক্রন্দন করুন, যতই রাজকীয়ভাবে তার শ্রাদ্ধ করুন, পাণ্ডুর পুত্র-পরিবারের প্রতি তার সমদৃষ্টি ছিল না। রাজবাড়ি থেকে ভরণ-পোষণ নিশ্চয়ই পেতেন পাণ্ডবরা। কিন্তু যে ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীনতা দিয়ে দুর্যোধনরা একদল ভাই মানুষ হচ্ছিলেন, সেই স্বাধীনতা বা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের সুযোগ পাণ্ডবদের ছিল না। লক্ষ্য করে দেখুন, প্রমাণকোটিতে জলক্রীড়া করার জন্য যে অস্থায়ী মহার্ঘ আবাসগুলি বানানো হয়েছিল, যে পরিমাণ ভোজ্য-পেয়র ব্যবস্থা করা হয়েছিল, এরজন্য সতেরো-আঠারো বছরের দুর্যোধনের কোনও অনুমতি লাগেনি। তার নিজের ইচ্ছে পূরণের জন্য রাজযন্ত্র ব্যবহার করাটাও কোনও অসম্ভব ব্যাপার হয়নি তার পক্ষে। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধ প্রশ্রয় না থাকলে দুর্যোধনের পক্ষে এই ধরনের বিলাস পরিকল্পনা করাটা যথেষ্ট কঠিন ছিল। অপরদিকে পাণ্ডবদের কারও পক্ষে এই স্বাধীন ব্যবহার করাটা মোটেই সহজ ছিল না। এমনকি তাদের দুঃখ-কষ্টের অভিযোগ দুর্যোধনের পিতা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে জানানোও এত সহজ ছিল না। ঠিক সেই কারণেই কুন্তী হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্র এবং তার নিকটতম আত্মীয় ভাশুর ধৃতরাষ্ট্রের কাছে না গিয়ে তিনি বিদুরকে স্বগৃহে ডেকে আনলেন।
কুন্তী বিদুরের কাছে নিজের অসহায়তার কথা জানিয়ে আবারও ভীমের অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে বললেন। বললেন–সকলে এক সঙ্গে মিলে বাগান-বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেছে। কিন্তু ভীম তাদের সঙ্গেও আসেনি, আলাদা করে একাও আসেনি। তুমি এই অবশিষ্ট পাণ্ডবদের সঙ্গে নিয়ে একবার সেই বাগান বা খেলার জায়গাটায় যাবে? বিদুর পাণ্ডবদের সঙ্গে নিয়ে গেলেন সেই প্রমাণকোটিতে। অনেকবার তারা ভীমের নাম ধরে ডাকলেন, অনেক বনে তাঁরা ভীমকে খুঁজে খুঁজে বেড়ালেন। কিন্তু পেলেন না কোথাও–বিচিন্তো বনং সর্বং ন তেপশ্যন্ত তং জনাঃ।
কুন্তী এবার ভীমকে না দেখে পরিষ্কার সন্দেহ প্রকাশ করলেন দুর্যোধন সম্পর্কে। বললেন–ভীমকে দেখে দুর্যোধন কখনও খুশি হয় না। দুর্যোধন খল-স্বভাব এবং দুষ্টবুদ্ধি। লজ্জা বলে তার কিছু নেই, উপরন্তু রাজ্যের লোভ তার এতই বেশি যে, সে হয়তো কোনও কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে ভীমকে মেরেই ফেলেছে। আমার মন তাই বলছে–নিহন্যাদপি তং বীরং জাতমনুঃ সুযোধনঃ। দুষ্টের প্রশ্রয়দাতা রাজার রাজত্বে বাড়িতে খুন হয়ে গেলেও যেমন সে খুনের কথা সোচ্চারে বলা যায় না, তাতে যেমন সেই বাড়িতেই আরও খুনের আশঙ্কা বেড়ে যায়, তেমনই আশঙ্কা করে বিদুর বললেন–এসব কথা এত জোরে উচ্চারণ করবেন না, কল্যাণী! আপনার শেষ পুত্রগুলিকে তো বাঁচাতে হবে। আপনি এইভাবে বললে লোক জানাজানি হবে তাতে ওই দুরাত্মা পরে আপনার আরও ক্ষতি করতে পারে–প্রত্যাদিষ্টো হি দুষ্টাত্মা শোনেপি প্রহরেত্তব। বিদূর সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–আপনি এত ভাববেন না। আপনার পুত্রেরা সব দীর্ঘায়ু। ভীম ঠিক ফিরে আসবে।
বিদুর সদুপদেশ দিয়ে নিজের ঘরে গেলেন। কুন্তী আর চার ভাই পাণ্ডব উদ্বিগ্নচিত্তে ঘরে বসে রইলেন–কুন্তী চিন্তাপরা ভূত্ব সহাসীনা সুতে-গৃহে। দুদিন-তিন দিন চলে গেল। ভীম তবু ফেরেন না বাড়িতে। মহাভারতের কবি লিখেছেন–ভীম যে বাসুকির গৃহে রস পান করে ঘুমিয়েছিলেন, তার ঘুমই ভাল আট দিন পর। বস্তুত এই আটদিনের সংখ্যাটা সত্য নাও হতে পারে। তবে সময় কিছু বেশিই লেগেছে। সে সময় এতটাই যে নাগমুখ্য বাসুকি পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের ধারণা–বাসুকির নাগবসতিতে অত্যুম ভোজ্যপানীয় লাভ করে ভীম বহাল তবিয়তে ছিলেন। বাড়ি ফেরার তাড়া বা তাল-তবা কোনওটাই তার ছিল না। আসলে এইটাই তার ঘুম। এতই ভাল তার দিন কাটছিল যে, বাড়ি ফেরার কোনও কথাই তিনি বলছিলেন না।
হয়তো আটদিনের দিন ভীমের মনে হয়েছে–না, এবার ফেরা দরকার। অর্থাৎ তার চেতনা হল, ঘুম ভাঙল–ততোষ্টমে দিবসে প্রত্যবুধ্যত পাণ্ডবঃ। সাতদিন নাগবসতিতে থেকে ভীমের শরীরটাও যেমন সেরেছে, তেমনই প্রভূত নাগজাতীয় সুরাপানে তার গায়ে জোরও এসেছে যথেষ্ট। নাগেরা বলেও ফেলল–তুমি যে রসপান করেছ, তাতে তোমার গায়ে শত হাতীর বল আসবে। যুদ্ধে তোমাকে কেউ হারাতে পারবে না–রণেধৃষ্যো ভবিষ্যসি। ওদিকে বাসুকি তো বেশ ব্যস্ত হয়েই উঠলেন। তিনি সব ঘটনা শুনেছেন বলেই বুঝতে পারছেন যে, বাড়িতে ভীমকে নিয়ে কত চিন্তা হচ্ছে। অথচ ভোলাভালা ভীমের সেদিকে খেয়ালই নেই। বাসুকি তাই বলেই ফেললেন–এবার তো বাড়ি যেতে হয়, বাছা-গচ্ছাদ্য স্বগৃহং স্নাতঃ। তুমি বাড়িতে নেই, তোমার জন্য তোমার ভাইরা কত-শত চিন্তা করছে, ভাব-ভ্রাতরস্তেনুতপ্যন্তে ত্বং বিনা কুরুপুঙ্গব।
ভীম যে নাগ-মাতামহের কথা শুনে খুব বিচলিত হলেন, তা নয়। তবে এটা বুঝলেন যে, যাওয়াটা দরকার। বাসুকির কথা শুনে ভীম খুব ভাল করে স্নান করে একটি শুভ্র নাগ-বসন পরিধান করলেন। নাগেরা খুশি হয়ে তার গলায় নাগকেশরের মালা পরিয়ে দিল, গায়ে ছড়িয়ে দিল সুগন্ধ-ওষধীভি-বিষণ্ণীভি সুরভীভিৰ্বিশেষতঃ। স্নান-সুগন্ধ সবই হল, খাওয়াটাই বা বাদ যায় কেন। ভীম খুব ভাল করে খেয়ে-দেয়ে, গায়ে নাগদত্ত অলঙ্কার পরিধান করে, নাগদের কাছ থেকে খুব ঘটা করে বিদায় নিলেন। যে জায়গা থেকে ভীমকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নাগ জনজাতির মানুষেরা সেইখানে পৌঁছে দিল ভীমকে–সেই প্রমাণকোটিতে, সেই গঙ্গার ধারে–তস্মিন্নেব বনোদ্দেশে স্থাপিতঃ কুরুনন্দনঃ।
ভীমের এখন খুব চেতনা হয়েছে। এখন তার মার কথা মনে পড়েছে, ভাইদের কথা মনে পড়েছে। ভীম এখন ঊধ্বশ্বাসে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চললেন। কুন্তী এবং চার ভাই পাণ্ডব ধৈর্য ধরেই বসেছিলেন। ক্ষত্রিয়ের ধৈর্য। ভীম বাড়িতে এসেই মা এবং যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করলেন, জড়িয়ে ধরলেন ছোট ভাইদের। সবার মুখে ওই একই কথা বারবার উচ্চারিত হল–ভাগ্যে ছিল, তাই আবার দেখা হল–অন্যোন্য-গত-সৌহাদ্দা দিষ্টা দিষ্ট্যেতি চাবন্।
ভীমের আর ধৈর্য থাকল না। তিনি চিৎকার করে দুর্যোধনের অপকীর্তি সব একে একে বলতে লাগলেন। সবাই শুনতে লাগলেন বটে, কিন্তু যুধিষ্ঠির ভীমের কথার মাঝখানেই হঠাৎ একটু রাগত স্বরে বলে উঠলেন–চুপ করো, ভীম! চুপ করো। এসব কথা আর কখনও বলো না–তুষ্ণীং ভব ন তে জল্প্যমিদং কাৰ্য্যং কথঞ্চন। আজ থেকে তোমরা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করবে। এই কথা বলার সময় যুধিষ্ঠির অবশ্যই তার পিতৃব্য বিদুরের কথা স্মরণ করেছিলেন। যুধিষ্ঠির বুঝেছিলেন–ভীমের চিৎকার কৌরবভাইদের মধ্যে আগুন ছড়াবে। বিশেষত দুর্যোধনের পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে গেল বলে তিনি নিজের মান রাখার জন্যই পুনরায় ভীমের নিধনে অন্যতর প্রয়াস নেবেন, হয়তো সে প্রয়াস আরও কুটিল হবে। আর চুপ করে থাকলে দুর্যোধনকে বোঝানো যাবে–তুমি যা করেছ, আমরা জানি। কিন্তু তুমি আমাদের কিছুই করতে পারনি। আমরা সে শক্তি রাখি।
অশেষ বুদ্ধিমত্তায় যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের তৎকালীন ক্রোধ বেড়ে ওঠার সুযোগ দিলেন না, বরঞ্চ অনুতাপের সুযোগ দিলেন। বাস্তবেও যা ঘটল, দুর্যোধন পুনরাগত ভীমকে দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন বারবার এবং সব সময় চিন্তাকুল হয়ে মনে মনে শুধু বিদ্বেষের উত্তাপ ভোগ করতে লাগলেন প্রতি পলে–নিশ্বসংশ্চিন্তয়ংশ্চৈবম্ অহনহনি তপতে। অন্যদিকে পাণ্ডবরা পরিষ্কার বুঝলেন–তারা রাজবাড়ির বিরুদ্ধ কক্ষে বাস করছেন। তারা পিতার রাজ্যে আশ্রয় পেয়েছেন বটে, তবে সে আশ্রয় মাত্র। কার্যনির্বাহী রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্রয়পুষ্ট দুর্যোধন এক পা বাড়িয়ে রয়েছেন রাজসিংহাসনের দিকে। আর পাণ্ডবরা নিজগৃহে পরবাসী হয়ে রইলেন ভাগ্যের বিড়ম্বনায়।
.
৯৬.
কৌরব-পাণ্ডবদের যেভাবে দিন কাটছিল, সেকালের দিনের অধিকাংশ রাজবাড়িতে এভাবে তাদের দিন কাটত না। একেক জনের সতেরো-আঠারো বছর করে বয়স হয়েছে, অথচ রাজকুমারদের অস্ত্র শিক্ষার নাম নেই। ক্ষত্রিয় বাড়িতে এমনটি চলে নাকি? হ্যাঁ, বালকদের উপনয়ন-সংস্কার ইত্যাদি হয়ে যাওয়ায় কালোচিত ব্রহ্মচর্য বা বেদপাঠ–এসব তাদের পালন করতে হয়েছে বটে, কিন্তু একজন ক্ষত্রিয়, ছোটবেলা থেকেই যার কাজ হল রাষ্ট্রকে ক্ষতমুক্ত করা, সেই ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রবিদ্যা তাদের কিছুই হয়নি। হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজকুমারদের আচার–ব্যবহার এবং কাণ্ডজ্ঞান দেখে বড়ই বিব্রত হচ্ছেন। দিন-রাত রাজকুমারেরা খেলে বেড়াচ্ছেন, এতখানি বয়সেও তাদের ক্রীড়া-কৌতুক শান্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। বালকদের এই ধরনের চপলতা দেখে–কুমারা ক্রীড়মানাংস্তান্ দৃষ্ট্ৰা রাজাতিদুর্দান্ ধৃতরাষ্ট্র একদিন কৌরব-পাণ্ডব নির্বিশেষে সমস্ত ভাইদের একত্রিত করে নিয়ে গেলেন গৌতম– গুরু কৃপাচার্যের কাছে। কৃপাচার্য গৌতম-গোত্রীয় ব্রাহ্মণ, তবে ব্রাহ্মণবাচিত যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা ত্যাগ করে ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রবিদ্যায় তিনি মন দিয়েছিলেন বেশি। ধৃতরাষ্ট্রর চেয়ে তিনি বয়সে অনেক বড়। ধৃতরাষ্ট্র বালকদের নিয়ে গিয়ে কৃপাচার্যের অস্ত্র-পাঠশালায় ভর্তি করে দিলেন–গুরুং শিক্ষার্থমন্বিষ্য গৌতমং তান্ ন্যবেদয়ৎ।
আমাদের কথা থেকে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, কৃপাচার্য হস্তিনাপুরের একান্তে একটি অস্ত্রশিক্ষার পাঠশালা খুলে বসেছিলেন। তিনি হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতেই থাকতেন। যদিও তিনি রাজবাড়ির আশ্রিত, তবু তার সম্মান বা মর্যাদা কিছু কম ছিল না। বস্তুত সেকালের দিনে এমনই হত। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও এমনই হত। আমাদেরই হয়েছে। সেকালের দিনের গ্রামে-গঞ্জে এমন মানুষ অনেক ছিলেন। তারা যে সব একেকজন বিদ্যা-দিগগজ তা নয়। তবে প্রাথমিক লেখাপড়া শেখানোর কাজটা তারা এমন নিপুণভাবেই করতেন যে, তাদের শ্রদ্ধা না করে পারা যেত না। গ্রামের একেকটি বাড়িতে এইরকম বিদ্যাব্যসনী ব্যক্তির দেখা মিলত, যার কাছে গ্রামের অনেক পিতাঠাকুরই তাদের ছেলে, ভাইপো ইত্যাদির গুষ্টি নিয়ে একদিন হাজির হতেন এবং বলতেন–কত্তা, এই ছেলেগুলিকে আপনার হাতে তুলে দিলাম। আপনি দেখবেন। গুরুমশাই যে সেই সব ছাত্রদের নানা পরীক্ষার জালে আবদ্ধ করে কাঁদে ফেলবার চেষ্টা করতেন তা মোটেই নয়। বস্তুত তিনি ছেলেদের ব্যাপারে দ্বিতীয়বার কথা বলতেন না। উলটে পিতাঠাকুরদের সংসার ভূ-সম্পত্তি এবং অমুকে এখন কী করছে, তমুকেই বা কী করছে (কারণ এরাও ছোটবেলায় এই গুরুঠাকুরের কাছেই পড়েছে)–এইসব পুরাতন কৌতূহল তৃপ্ত করে উপস্থিত বালকদের বলতেন–আসিস্ ক্যাল থিকা। বালকরা পরের দিন থেকে সেই বাড়ির সদস্য হয়ে যেত। কোথা থেকে তার টাকা আসত, কোথা থেকে তার সংসার নির্বাহ হত–এসব আমরা জানতাম না। শুধু জানতাম ইনি আমাদের পড়ান, ইনি আমাদের ভালবাসেন।
কৃপাচার্যও হস্তিনার রাজবাড়িতে এইরকম একজন মানুষ। তবে তফাত এই, ইনি এই রাজবাড়িতে এসেছেন অনেক আগে এবং তিনিও এই রাজবাড়িতে সদস্য হয়ে গেছেন। এখন তার মর্যাদা এতটাই যে, ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভায় কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় তার ডাক পড়ে সব সময়। গৌতম-গুরু কৃপাচার্য হস্তিনার রাজবাড়িতে কী করে এলেন, সে কথা আমাদের একটু বলতে হবে। তার কারণ আমরা যে মহাভারতের ইতিহাস বলবার জন্য ব্যগ্র হয়েছি, সেই ইতিহাসের সঙ্গে দুটি বহিরাগত ব্যক্তির ভয়ঙ্কর রকমের যোগ আছে। এঁদের একজন কৃপাচার্য, অন্যজন দ্রোণাচার্য। এঁদের দুজনের সম্পর্ক আবার শালা-জামাইবাবুর। কিন্তু এই দুটি বহিরাগত ব্যক্তিই হস্তিনাপুরের রাজনীতির ক্ষেত্রে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে এঁদের কথা আমাদের বলতেই হবে। কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার ব্যাপারটা আমাদের কাহিনীর পরম্পরায় আপনিই আসবে, কিন্তু এঁদের কথা না বলে নিলে মহাভারতের রাজনীতিটাই কিছু বোঝা যাবে না।
হস্তিনাপুরে এখন যে সময় চলছে, সে সময় থেকে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে সেই মহারাজ শান্তনুর সময়ে। আপনাদের মনে আছে কি না জানি না–শান্তনুর মৃগয়া করার অভ্যাস ছিল ভীষণ। এই মৃগয়ার দৌলতেই একদিন তিনি গঙ্গার দেখা পান এবং ওই মৃগয়ার সূত্রেই সত্যবতীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। একদিন এইরকমই তিনি মৃগয়ায় গেছেন। কিন্তু সেই মৃগয়ার আগেই আরও একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
মহর্ষি গৌতমের শরদ্বান নামে একটি পুত্র ছিল। ব্রাহ্মণের ছেলে, ঋষির ছেলে হওয়া সত্ত্বেও বেদ-অধ্যয়ন, পঠন-পাঠন, যজন-যাজনে তাঁর মন লাগত না। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের শরাসন তার বড় প্রিয় ছিল। বেদবিদ্যায় যতটাই তার বুদ্ধি কম, ধনুঃশর চালনায় তার বুদ্ধি ততটাই বেশি–যথাস্য বুদ্ধিরভব ধনুর্বেদে পরন্তপ। মহাভারতের কবি এমনভাবেই তার জন্মকথা লিখেছেন যাতে অনুবাদক পণ্ডিতেরা বড় সহজে লিখেছেন যে, কতগুলি শরের সঙ্গেই তার জন্ম হয়েছিল–জাতঃ সহ শরৈ বিভো–এবং সেই জন্যই তাঁর নাম শরদ্বান। আসলে কিন্তু ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও ধনুঃশরের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিই তাকে শরদ্বান নামে বিখ্যাত করেছে। মহাভারতের টীকাকারও এ কথা অবিশ্বাস করেন না সেই কারণে টীকাকার নীলকণ্ঠ লিখেছেন–ধনুঃশরগুলি তার বন্ধুর মতো প্রিয় ছিল বলেই–শরা এব বা অস্য বন্ধুবৎ প্রিয়াঃ–এমন কথা বলা হয়েছে যে, তিনি শরের সঙ্গেই জন্মেছিলেন।
শরদ্বানের সতীর্থ বন্ধুরা যখন তপশ্চর্যার সঙ্গে বেদ অধ্যয়ন করছেন, তখন শরদ্বানও তপশ্চর্যা করছেন, তবে সে তপশ্চর্যা অস্ত্রশিক্ষা। তার ধনুর্বেদের ক্ষমতা একদিন দেবরাজ ইন্দ্রকেও চিন্তিত করে তুলল। দেবরাজ তখন জানপদী নামে এক অপ্সরাকে পাঠালেন যাতে শরদ্বানের শরচর্চা বিঘ্নিত হয়।
কথাটা আমরা এত আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করতে চাই না। বস্তুত ইন্দ্র এখানে একটা রূপক মাত্র। শরদ্বানের অস্ত্রচর্চায় কোনও ক্ষত্রিয় রাজাই হয়তো চিন্তিত হয়েছিলেন এবং ভূতলবাসী রাজাকে অনেক সময়েই ইন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তাছাড়া স্বর্গের বজ্রধারী দেবরাজ মানুষের অস্ত্রচর্চায় কখনও চিন্তিত হয়েছেন শুনিনি। তিনি ব্রাহ্মণ মুনি-ঋষির তপশ্চর্যাতেই বেশি চিন্তিত হন। আরও একটা কথা এই অঙ্গরার নাম জানপদী। মহাভারতের অঙ্গরাকুলের তালিকায় জানপদীকে তেমন করে কোথাও পাই না। আসলে জানপদী অবশ্যই পূর্বোক্ত ভীত রাজার জনপদের সাধারণী কোনও গণিকা। তাকেই পাঠানো হয়েছিল, যাতে শরদ্বানের অস্ত্রচর্চা বন্ধ হয়। চর্চা না থাকলেই শরাসনের লক্ষ্যভেদ ভ্রষ্ট হয়, অতএব এটা সেই চর্চা বিঘ্নিত করার উপায়।
জানপদী বেশ্যা একটিমাত্র বসন পরে–সে বসন শুধু অধমাঙ্গেরই আবরণ হবে বোধ করি–সেই একবসনে শরদ্বানের কাছে এসে হাবেভাবে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলল– ধনুর্বাণধরং বাল লোভয়ামাস গৌতমম্। শরদ্বানও তো মানুষ। একাকী একান্তে আসা একবসনা সুন্দরীকে দেখার পর তামেক বসনাং দৃষ্ট্ৰা-শরদ্বানের চক্ষু দুটি একেবারে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। অত সাধের ধনুকবাণ তার হাত থেকে অমনিই পড়ে গেল মাটিতে–করাভ্যাম অপদ ভুবি। শরদ্বান আর স্থির থাকতে পারলেন না তিনি তাঁর অন্তরস্থায়ী সংযমের চেষ্টায় নিজের চিত্তবৃত্তি নিরুদ্ধ করার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু তার শরীর-প্রকৃতি মানল না। সবিকারী শরীর আপন শক্তিক্ষয় ঘটিয়ে মুগ্ধতার মূল্য দিল। তার তেজঃবিন্দু পতিত হল একটি শর-তৃণের ওপর। তৃণের কুশাগ্রভাগে বিন্দুটি দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় দুটি পুত্র-কন্যা জন্মাল। শরদ্বান সে কথা জানতেও পারলেন না। তিনি ধনুক-বাণ এবং পরনের কৃঞ্চাজিন ফেলে তথাকথিত জনপদী অপ্সরার পিছনে দৌড়লেন, হাবভাব-লীলায়িত রমণীকে ধরবেন বলে–ধনুশ্চ সশরং তত্ত্বা তথা কৃষ্ণাজিনানি চ।
পুত্র-কন্যা দুটি নল-খাগড়ার বনে শরতৃণের শয্যায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রইল। আমাদের বুদ্ধিতে যা বলে–তাতে এই তেজঃবিন্দুক্ষরণ এবং শরস্তম্বে সেই বীর্যবিন্দুর দ্বিবাভি হওয়ার ঘটনায় না বিশ্বাস করলেও চলে। সোজা কথায় শদ্বান সেই একস রমণীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন এবং তার গর্ভাধানও করেছিলেন। কিন্তু জনপদ বেশ্যার চরিত্র যেমন হয়, পুত্র-কন্যা হবার পর সেগুলিকে অস্থানে ত্যাগ করে আসাটাই তার সাধারণ স্বভাব। অতএব ওই নলখাগড়ার বনে শরদ্বানের ঔরসজাত যমজ পুত্র-কন্যাকে ফেলে দিয়ে জানপদী ভারমুক্ত হল। হয়তো এ ঘটনা ঘটেছে শরদ্বানের অজ্ঞাতসারে অথবা তিনি জানতেনই না যে ও দুটি তারই পুত্রকন্যা। কারণ যে ব্যক্তি এক জনপদী রমণীর জন্য তাঁর পরম প্রিয় ধনুকবাণ ত্যাগ করে পিতার আশ্রম ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে পারেন–স বিহায়াশ্রমং তঞ্চ তাগৈরসং মুনিঃ–তার কি ওই পুত্রকন্যার দিকে নজর থাকবে? বস্তুত পুরাকালে বিশ্বামিত্র এবং মেনকার মিলনে যেমন শকুন্তলার জন্ম হয়েছিল এবং মেনকা যেভাবে শকুন্তলাকে ফেলে রেখে পালিয়েছিলেন, এখানেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে।
যাই হোক ওদিকে ভরতবংশের গৌরব মহারাজ শান্তনু সৈন্য সামন্ত নিয়ে ওই সময়েই মৃগয়ায় এসেছেন। মৃগয়াব্যসনী রাজার আদেশে তার সৈন্যরা বন্য পশুর গতিবিধি লক্ষ্য করে ইতস্তত বিচরণ করছিল। হঠাৎই রাজার এক সৈন্য সেই শরবনের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় পরিত্যক্ত শিশু দুটিকে দেখতে পেল এবং সঙ্গে সঙ্গে খবর দিল মহারাজ শান্তনুকে। শান্তনু এসে দেখলেন–দুটি সদ্যোজাত শিশু শরবনের একান্তে পড়ে আছে। শিশুদুটির সম্ভাব্য বৃত্তান্ত কী হতে পারে, এটা ভাবতে ভাবতেই শান্তনু দেখলেন একটি ধনুকবাণ এবং একখানি কৃষ্ণাজিন পড়ে আছে শিশু দুটির কাছাকাছি এক জায়গায়। শান্তনু তাঁর রাজোচিত ভাবনায় ধারণা করলেন যে, ওই যমজ পুত্রকন্যা এমন এক ব্রাহ্মণের ঔরসজাত, যিনি বেদবিদ্যার পরিবর্তে ধনুকবাণের নৈপুণ্য অর্জন করেছেন–জ্ঞাত্বা দ্বিজস্য চাপত্যে ধনুর্বের্দান্তগস্য চ।
মহারাজ শান্তনু একটি দেশের রাজা! অরক্ষিত মানুষের জন্য তার মায়া থাকাই স্বাভাবিক। তিনি অন্তরের সমস্ত স্নেহ উজাড় করে দিয়ে পরিত্যক্ত শিশু দুটিকে কোলে তুলে নিলেন এবং বললেন–এরাই আমার ছেলে-মেয়ে–মম পুত্ৰাবিতি ব্রুবন্। অনাথ ছেলে-মেয়ে দুটিকে নিয়ে শান্তনু সোজা হস্তিনাপুরে ফিরলেন। পরমাদরে তাদের জাতকর্মাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করে তাদের নামকরণও করলেন শান্তনুই। ছেলেটির নাম হল কৃপ, মেয়ের নাম কৃপী। মহাভারতের কবি লিখেছেন–এক সময়ে শরদ্বানও ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, তার ঔরসজাত পুত্র-কন্যা দুটি শান্তনুর রাজবাড়িতে মানুষ হচ্ছে। আমরা মনে ক–এই ধ্যানযোগের মধ্যেই আসল সত্যটি লুকিয়ে আছে। শরদ্বান জানপদী স্ববেশ্যার মোহে এতটাই তখন মুগ্ধ ছিলেন যে, তার আপন পুত্র-কন্যাকে জানপদী যেভাবে পরিত্যাগ করেছিল তা তার অজ্ঞাতই ছিল। পরবর্তী সময়ে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে শরদ্বান বুঝতে পারেন যে, তার যমজ পুত্র-কন্যা পরিত্যক্ত হয়েছে এবং হয়তো এটাও তিনি খোঁজ পেয়ে যান যে, মহারাজ শান্তনুর গৃহে তারা মানুষও হাছ
আমরা মনে করি এই সম্পূর্ণ অন্বেষণ প্রক্রিয়াই শরদ্বানের ধ্যানযোগ। পুত্র-কন্যা দুটির জন্য তিনি দায়িত্ববোধ এড়িয়ে গেলেন না। সমস্ত ঘটনা জানবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হস্তিনাপুরে পৌঁছলেন মহারাজ শান্তনুর কাছে। এখানে তার প্রয়োজন ছিল একটাই। এই শিশু পুত্র-কন্যা দুটি যে নাম-গোত্রহীন কোনও জারজ সন্তান নয়–সেটা বলার জন্যই তিনি শান্তনুর কাছে উপস্থিত হলেন–আগত তস্মৈ গোত্রাদি সবখ্যাতবাংঔদা। পিতার মতো কৃপও বেদবিদ্যার নিগূঢ় তত্ত্বান্বেষণ বাদ দিয়ে ধনুর্বিদ্যায় আসক্ত হলেন। পিতা শরদ্বানও পুত্রের মতিগতি দেখে তার নিজের জানা সমস্ত অস্ত্র–রহস্য কৃপকে শিখিয়ে দিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই কৃপাচার্য ধনুর্বেদ-শিক্ষার অন্যতম আচার্য হয়ে উঠলেন। হস্তিনাপুরের রাজবাড়ি ছেড়ে তিনি আর কোথাও যাননি। মহারাজ শান্তনু নিজের হাতে তাঁকে রাজবাড়িতে তুলে নিয়ে এসে মানুষ করেছিলেন বলে পরবর্তী বংশজরা–সে তিনি ভীষ্মই হোন অথবা বিচিত্রবীর্য, তিনি ধৃতরাষ্ট্রই হোন অথবা পাণ্ডু–কেউ তার মর্যাদা অতিক্রম করেননি।
কুরুবাড়িতেই কৃপাচার্যের অস্ত্রশিক্ষার পাঠশালা ছিল। সেখানে ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছায় পাণ্ডব-কৌরবরা যেমন অস্ত্রশিক্ষা করতেন, তেমনই অন্যান্য জায়গা থেকেও কৃপাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে আসতেন রাজপুত্রেরা–নৃপাশ্চান্যে নানাদেশ-সমাগতাঃ। কৃপাচার্যের কাছে কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার হাতেখড়ি হওয়ার সঙ্গে অস্ত্রশিক্ষায় তাদের একটা উৎসাহ এল। ধৃতরাষ্ট্রও এইটাই হয়তো চেয়েছিলেন। কিন্তু কৃপাচার্যের প্রশিক্ষণ যে কাউকে ভারতবিখ্যাত ধানুল্কে পরিণত করবে না, এটা সবচেয়ে ভাল বুঝতেন মহামতি ভীষ্ম। তিনি তার এবং তার পরবর্তী সময়েরও অদ্বিতীয় যুদ্ধবীর বলেই এই তত্ত্বটা বুঝতেন যে, ভাল বীর তৈরি করতে হলে উত্তম গুরুর কাছে তার প্রশিক্ষণ দরকার। কেননা ভীষ্মের মতে–যিনি নিজে মহাবুদ্ধিমান নন, যিনি উপারস্বভাব নন এবং নানা যুদ্ধের অস্ত্রকৌশলে যিনি অভিজ্ঞ নন, তিনি কখনও কুরুবালকদের শিক্ষা দেবার উপযুক্ত হতে পারেন না–নাদেবসত্ত্বো বিনয়েৎ কুরুণস্ত্রে মহাবলান।
আসলে কৃপাচার্য কতটা শিক্ষা দিতে পারেন, গাঙ্গেয় ভীষ্ম সেটা বুঝতেন। বহুদিনের পরিচয় থাকার ফলেই সেটা আরও তার কাছে প্রকট হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া তাঁর পরমপ্রিয় নাতিগুলির মধ্যে দু একজন যে অস্ত্রবিদ্যায় পরম কুশলী হয়ে উঠতে পারেন, বহুদিনের অভিজ্ঞতায় সেটাও ভীষ্ম বুঝতেন। আর বুঝতেন বলেই একজন উপযুক্ত অস্ত্রগুরুর অন্বেষণে আগ্রহান্বিত ছিলেন ভীষ্ম। যোগাযোগটা ঘটে গেল অদ্ভুতভাবেই।
কৃপাচার্যের বাড়িতে এক ব্রাহ্মণ এসে বাস করছেন। বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। তিনি বাইরে বেশি বেরন না, কেউ তাকে চেনেও না ভাল করে। ব্রাহ্মণের গায়ের রঙ কালো, মাথায় পাকা চুল। শরীরটি চাবুকের মতো ছিপছিপে–শ্যাম আপন্নপলিতং কৃশ। এই ব্রাহ্মণের একটি ছেলে আছে, ছেলেটির সঙ্গে পাণ্ডব-ভাইদের বেশ ভাব হয়েছে। কৃপাচার্যের কাছে পাণ্ডব-কৌরবদের একত্র শিক্ষা শেষ হয়ে গেলে কৌরবভাইরা বাড়ি চলে যান। কিন্তু কুন্তীর ছেলেরা রাজনৈতিক এবং পারিবারিকভাবে খানিকটা কোণঠাসা অবস্থায় আছেন বলেই তাদের অস্ত্রশিক্ষার আকাক্ষা প্রবল। তারা সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরে যান না। তারা লক্ষ্য করেন–আগন্তুক ব্রাহ্মণের ছেলেটি বেশ। বয়সে তাদের চেয়ে সামান্য বড় হবেন হয়তো। কিন্তু এরই মধ্যে অস্ত্রবিদ্যার বেশ কিছু বিশেষ পাঠ তিনি রপ্ত করে ফেলেছেন। কৃপাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষার পর এই ব্রাহ্মণ পুত্রটি কুন্তীপুত্রদের কাছে নিজের অস্ত্রবিদ্যার কেরামতি দেখান, কিছু কিছু অস্ত্রপাঠ তিনি কুন্তীপুত্রদের শিখিয়েও দেন– অস্ত্রাণি শিক্ষয়ামাস কৃপস্যানন্তরং প্রভু। পাণ্ডুপুত্ররা তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন–তিনি কৃপাচার্যের ভাগনে। তিনি পিতা-মাতার সঙ্গে কৃপাচার্যের বাড়িতে এসেছেন কিছুকাল।
কিন্তু এই পিতাটিকে বাইরে আসতে দেখা যায় না কখনও–এবং স তত্র গঢ়াত্মা কঞ্চিৎ কালমুবাস হ। কিন্তু সেদিন হঠাৎই একটা ঘটনা ঘটে গেল। কুরুবাড়ির সমস্ত বালকেরা কাপড়-চোপড় গুটলি করে একটি খেলার বল বানিয়েছেন। সেই বলটি নিয়ে খেলার ধুম পড়ে গেল সকলের মধ্যে, নগরীর একান্তে গিয়ে ভোলা মাঠে তাদের বল খেলা শুরু হল। কিন্তু কোনও এক সময় বলটি গড়াতে গড়াতে একটি মজা কুয়োর মধ্যে গিয়ে পড়ল। ক্রীড়ামত্ত বালকরা বলটা ভোলার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন–ততন্তে যত্নমাতিষ্ঠ বীটামুদ্ধর্তুমাদৃতাঃ কিন্তু কুয়োটা মজে গেলেও যথেষ্ট গভীর। বালকরা তাদের ক্রীড়াগুটিকা উদ্ধার করতে পারল না। এ ওর মুখের দিকে তাকায়, সে তার মুখের দিকে। খেলার উন্মত্ততা এবং ঘোর তখনও মোটেই কাটেনি, কাজেই বলটি তোলার জন্য তাদের আগ্রহের কোনও খামতি হল না–ততোন্যোন্যমবৈশান্ত ভূশঞ্চোকণ্ঠিতাভবন।
ঠিক এই সময়েই ক্রীড়াভূমির একান্তে সেই ব্রাহ্মণের ওপর বালকদের নজর পড়ল–সেই শ্যামবর্ণ, ছিপছিপে চেহারার পাকাচুলো ব্রাহ্মণ। তিনি দৈনন্দিন অগ্নিহোত্রের অগ্নি আধান করে হোম করতে বসেছেন। ব্রাহ্মণের সামনেই বালকদের বহুক্ষণের আয়াস চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তারা। খানিকটা অপ্রতিভ হয়েই ছিল। ইংরেজিতে যাকে ক্রেস্ট ফলন বলে সেইরকম আর কি। ব্রাহ্মণও এতক্ষণ বালকদের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন এবং মজাও পাচ্ছিলেন প্রচুর। ফলত ব্রাহ্মণের দিকে তাকানো মাত্রই বালকরা নিজেদের লজ্জা লঘু করে দেখানোর জন্য ব্রাহ্মণের চারদিকে ঘিরে দাঁড়াল–ব্রাহ্মণং পৰ্য্যবারয়।
বালকদের খেলার আগ্রহ তখনও ফুরিয়ে যায়নি। ব্রাহ্মণ সেটা বুঝলেনও। তারপর একটু লজ্জা দিয়েই বললেন–ধিক্ তোমাদের ক্ষত্রিয়ের শক্তিতে, অস্ত্রশিক্ষাও তোমাদের তেমনই হয়েছে। প্রসিদ্ধ ভরতবংশে জন্মে একটা কুয়ো থেকে যারা বল তুলতে পারে না, তারা আবার ক্ষত্রিয়? ভরতস্যান্বয়ে জাতা যে বীটাং নাধিগচ্ছত। তোমরা দেখ–আমার হাতের আঙুলে এই ক্ষুদ্র আংটিটা দেখছো তো? আমি এটাকেও এই কুয়োর মধ্যে ফেলে দিচ্ছি, আর তোমাদের বলটি তো রয়েইছে। আমি নল-খাগড়া দিয়ে শর বানিয়ে সেই শরের সাহায্যে তোমাদের বল এবং আমার আংটি দুটোই তুলে আনব। কিন্তু তার বদলে একটাই শর্ত আছে বাছারা। আজকের সন্ধ্যার খাবারটা কিন্তু তোমাদের ব্যবস্থা করতে হবে–উদ্ধরেয়মীযিকাভি ভোজনং মে প্রদীয়তা। কথাটা বলেই ব্রাহ্মণ কুয়োর মধ্যে নিজের আংটিটি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন–কূপে নিরুদকে তস্মিয়পাতয় অরিন্দমঃ।
ভ্রাতৃজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির জানতেন যে এই ব্রাহ্মণ কৃপাচার্যের বাড়িতে এসে উঠেছেন। কিন্তু এতদিন তাকে কেউ দেখেননি। আজকে ব্রাহ্মণভোজনের শর্ত শুনেই তিনি বললেন–কৃপাচার্য একবার বললে এক বেলা কেন, আপনি চিরকালের অন্ন পাবেন রাজবাড়িতে। ব্রাহ্মণ হাসলেন। হেসে নল-খাগড়ার শরগুলি দেখিয়ে বালকদের বললেন–আমি একটি শর দিয়ে তোমাদের বলটিকে বিদ্ধ করব। তারপর সেই শরের পিছনে আরেকটি শর, তারপর আরেকটি, তারপর আরও একটি। এমনি করে শারের পরম্পরা আমার নাগাল পর্যন্ত এলেই তোমাদের খেলার বস্তুটি ওপরে উঠে আসবে–তামন্যয়া সমাযোগে বীটায়া গ্রহণং মম।
সেকালের দিনে যারা গ্রাম বাংলায় থাকতেন, তাদের খাগের কলমে লেখা অভ্যাস ছিল। সত্যকথা বলতে কী–খাগের দণ্ড দিয়ে ব্রাহ্মণের লেখনী এবং ক্ষত্রিয়ের বাণচালনা–দুটোই প্রাথমিকভাবে সম্পন্ন হত। এই ব্রাহ্মণ একাধারে ব্রাহ্মণও বটে ক্ষত্রিয়ও বটে। তিনি যেমন যেমন বলেছিলেন ঠিক সেই সেই ভাবেই নল-খাগড়ার বাণের পর বাণ যোজনা করে বলটি ওপরে তুলে আনলেন। বালকদের চোখ একেবারে ছানাবড়া হয়ে গেল। তারা ভাবল–বলটা তোলা গেছে বটে কিন্তু ক্ষুদ্র আংটিটি তোলা অত সহজ হবে না। তারা বললেন–এবার আংটিটি তুলে আনুন দেখি–মুদ্রিকামপি বিপ্রর্ষে শীঘ্রমেং সমুদ্ধর।
ব্রাহ্মণ তো সেই ক্ষমতা দেখানোর জন্য আগেই আংটি ফেলে দিয়েছিলেন। এবারে বিস্মিত বালকদের আরও বিস্ময়াপন্ন করে দিয়ে আংটিটিও বাণের মুখে বিধিয়ে তুলে আনলেন ওপরে। বালকরা ব্রাহ্মণের অসাধারণ ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে বললেন, আমাদের সকলের অভিবাদন গ্রহণ করুন–অভিবন্দামহে ব্রহ্ম। আপনি যা করে দেখালেন, পৃথিবীতে কারও এই ক্ষমতা হবে না। এখন আপনি বলুন–আপনি কে? কোত্থেকে এসেছেন এবং আমরাই বা আপনার কী করতে পারি–কোসি ক্যাসি জানীমো বয়ং কিং করবামহে?
বালকদের প্রশ্ন শুনে ব্রাহ্মণ বললেন–তোমাদের এত কিছু জানতে হবে না বাছা। তোমরা শুধু আমার চেহারাটা এবং আমি যা করে দেখালাম, সেই ক্ষমতার কথাটা মহামতি ভীষ্মের কাছে গিয়ে বলো। তারপর কী করতে হবে তিনিই বুঝবেন–স এব সুমহাতেজা সাম্প্রং প্রতিপৎস্যতে। আমরা আগে জানিয়েছি–ভীষ্ম কুমারদের জন্য উপযুক্ত অস্ত্র ওরুর অন্বেষণ করছিলেন। তিনি এই ব্রাহ্মণকে চিনতেন। কৃপাচার্যের বোন কৃপীর স্বামী তিনি। অতএব তাকে চেনাটাই ভীষ্মের পক্ষে স্বাভাবিক। এবং হয়তো তাকেই তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু যে বসতিতে এই ব্রাহ্মণ থাকতেন, এখন তিনি সেখানে থাকেন না। হঠাৎ যে তিনি হস্তিনানগরীতে কৃপাচার্যের বাড়িতে এসেই উঠেছেন, তাও তিনি জানতেন না। এই ব্রাহ্মণ কৃপাচার্যের মুখেই ভীষ্মের অন্বেষণের বৃত্তান্ত শুনে থাকবেন। পারস্পরিক যোগাযোগের এই ছিল উপযুক্ত দিন। বহিরাগত ব্রাহ্মণ বড় নাটকীয়ভাবে হস্তিনাপুরের রাজনীতির মঞ্চে প্রবেশ করলেন। বালকরা যখন গিয়ে ভীষ্মের কাছে ব্রাহ্মণের আকৃতি প্রকৃতি এবং অস্ত্রবিদ্যার মাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন, ভীষ্মের তখন এক মুহূর্তও লাগল না ব্রাহ্মণকে চিনতে। তিনি বুঝলেন–মহামতি দ্রোণাচার্য হস্তিনাপুরে এসেছেন।
.
৯৭.
পাণ্ডব-কৌরবরা ভীষ্মের কাছে দ্রোণাচার্যের প্রশংসা এবং আকৃতি-প্রকৃতি বর্ণনা করার সঙ্গে-সঙ্গেই তিনি বুঝে গেলেন যে, দ্রোণাচার্য হস্তিনাপুরে উপস্থিত হয়েছেন। ভীষ্ম জানতেন যে, বালকদের অস্ত্র শিক্ষার ব্যাপারে দ্রোণাচার্যের চেয়ে ভাল অস্ত্রগুরু আর কেউ হতে পারে না। অতএব সঙ্গে সঙ্গে তিনি লোক পাঠিয়ে দ্রোণাচার্যকে ডেকে আনলেন নিজের কাছে। অনেক আদর এবং সম্মান করে তিনি দ্রোণাচার্যকে হস্তিনাপুরে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। দ্রোণাচার্য যা উত্তর দিলেন তার বিস্তারে আমরা এখনই যেতে চাই না। শুধু সংক্ষেপে জানাই–দ্রোণাচার্য পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও পাঞ্চাল ছেড়ে তিনি হস্তিনাপুরে এসেছেন এবং তা অবশ্যই দ্রুপদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে। ভীষ্মকে তিনি সে সব কথা জানাতে কুণ্ঠিত হননি। কিন্তু হস্তিনাপুরের পাশের রাজ্য পাঞ্চাল থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে চলে আসা সত্ত্বেও মহামতি ভীষ্ম তাকে যে হস্তিনাপুরে থাকার জন্য অনেক যত্ন–আত্তি করলেন, তার পিছনে অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে বলে আমরা মনে করি।
আমরা এর আগে প্রধানত কুরুবংশের পরম্পরা বর্ণনা করেছি, বর্ণনা করেছি যদুবংশের পরম্পরাও। কিন্তু এই মুহূর্তে আরও একটি রাজ্যে আমাদের উত্তরণ করতে হবে। তা না হলে, মহাভারতের যুদ্ধভূমিতে উপস্থিত হলেই মনে হবে– এ কী হল? এই যুদ্ধ তো শুধু কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ নয়, সেই সঙ্গে এ যে আরও অনেক কিছু। এই অনেক কিছুর আরও একটা মূল হল পাঞ্চাল না, যে দেশের রাজা এখন দ্রুপদ। আমরা পাঞ্চাল দেশের কথা একেবারেই যে কিছু বলিনি, তা নয়। তবে যা বলেছি, তা কুরুদের বংশধারার সূত্র ধরে। তবে তার মধ্যে বৈশিষ্ট্য যেটা, সেটা হল–আজকে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর পুত্রবর্গের মধ্যে যে জ্ঞাতি-বিরোধের সূত্রপাত ঘটেছে, তার থেকে অনেক পুরুষ আগে আরও একটা জ্ঞাতি বিরোধের সূত্র তৈরি হয়েছিল কুরু এবং পাঞ্চালদের মধ্যে। এই প্রসঙ্গে আমাদের একটু পূর্বকথা স্মরণ করতেই হবে।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে–আমরা কুরুবংশের বহু পূর্ব পুরুষ অজমীঢ়ের নাম করেছিলাম এক জায়গায়। তাঁর তিন পত্নী ছিল– নীলিনী, কেশিনী এবং ধুমিনী। অজমীঢ়ের ঔরসে নীলিনীর গর্ভে সুশান্তি নামে একটি পুত্র হয়েছিল। সুশান্তির পুত্র পুরুতি। তাঁর পুত্র বাহ্যাখ। এই বাহ্যাশ্বের পাঁচটি উপযুক্ত বীর পুত্র হয়েছিল। তাদের নাম–মুগল, সৃঞ্জয়, বৃহদিষ্ণু, যবীনর এবং কৃমিলা। এই পাঁচ ভাই প্রত্যেকেই বীর ছিলেন এবং তারা প্রত্যেকেই বোধহয় একেকটি ছোট ছোট রাজ্য করেন। এই পাঁচ ভাই পাঁচটি রাজ্য জয় করা এবং রক্ষা করায় সমর্থ (অলং) ছিলেন বলেই তাদের সম্মিলিত ভূখণ্ডের নাম পঞ্চাল-পঞ্চৈতে রক্ষণায়ালং দেশানামিতি বিশ্রুতাঃ।
পুরাণকারেরা এই পঞ্চবীরকে এক সমৃদ্ধ জনপদের অধিকারী বলে বর্ণনা করেছেন পঞ্চানাং বিদ্ধি পঞ্চালান্ স্ফীতৈ–জনপদৈবৃতান্। এই পঞ্চালদের রাজ্যই হল পাঞ্চাল। পঞ্চাল দেশের অধিবাসীদেরও বলা হয় পাঞ্চাল। দেশ হিসেবে পঞ্চাল ঋগবেদের আমল থেকেই বিখ্যাত। অবশ্য বৈদিক সময়ে পঞ্চাল দেশের নাম ছিল কৃবি। যে ঋকমন্ত্রে কৃবির উল্লেখ রয়েছে সেখানে সিন্ধু এবং অসিকী (চেনাব)–এই নদী বা জায়গারও উল্লেখ আছে। ঋকবেদের কৃবিকে পাঞ্চাল দেশের সঙ্গে একাত্মীয় বাঁধা কঠিন হলেও শতপথ ব্রাহ্মণের সময়ে এসেই কৃবি পাঞ্চালের সঙ্গে একাত্মক হয়ে গেছে। শতপথ ব্রাহ্মণ পরিষ্কার বলেছে আগে পঞ্চাল-দেশকে কৃবি নামে ডাকা হত–কৃবয় ইতি হ বৈ পুরা পাঞ্চালান আচক্ষতে। কৃবি দেশটি পূর্বে পরিচিত ছিল এখন নেই–এটা বোঝানোর জন্য শতপথ ব্রাহ্মণ তার সময়ের পাঞ্চাল রাজার বিশেষণ হিসেবে কৃবিদেশকে ব্যবহার করছেন। বলছেন– এই অতিরাত্র যজ্ঞ করেছিলেন ক্রৈব্য পাঞ্চাল– অতিরাত্রস্তেন হৈতেন ক্রৈব্য ইজে পাঞ্চালঃ।
ইতিহাসের আরেকটি তথ্য হল–শতপথ ব্রাহ্মণ–এ পরিবা বা পরিচক্রা বলে একটি জায়গার নাম করেছে পাঞ্চালঃ পরিবায়াং সহস্র-শত দক্ষিণ এবং এই পরিচক্রা বা পরিবাকে হেববার সাহেব মহাভারতের একচক্রার সঙ্গে এক করে দেখেছেন। পরে আমাদের কাহিনীতে একচক্রার প্রসঙ্গ আসবে। জতুগৃহ-দাহের পর পাঞ্চালদেশে যাবার পথে এই একচক্রা নগরে পাণ্ডবরা বেশ কয়েকদিন ছিলেন।
ঋগবেদের সময় থেকে কৃবি-পঞ্চালের ইতিহাস একটু বললাম এই জন্য যে, কুরুদেশের মতো পঞ্চালও আর্যদের অত্যন্ত এক প্রিয় স্থান ছিল। স্বয়ং মনু-মহারাজ পাঞ্চাল-দেশকে ব্রহ্মর্ষি–দেশের মধ্যে গণ্য করেছেন। আমরা মহাভারতের মধ্যে যে পাঞ্চাল-দেশকে দেখেছি আধুনিক মানচিত্রে তার চেহারা হবে–এখনকার উত্তরপ্রদেশের বেরিলি (রায়বেরিলি নয়), বুদায়ুন, ফুরুখাবাদ, রোহিলখণ্ডের খানিকটা এবং গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলের খানিকটা। পুবদিকে পাঞ্চালের সীমানা হল গোমতী নদী, দক্ষিণে চম্বল-দক্ষিণাংশ্চাপি পাঞ্চালান যাবচ্চমতী নদী। পশ্চিমে মথুরা–শূরসেন অঞ্চল। মহাভারতে কুরুদেশের যেমন অবস্থিতি দেখেছি, তাতে কুরুদেশের চারপাশে যে সব দেশ আছে, তার মধ্যে পাঞ্চাল অন্যতম।
পণ্ডিতেরা মনে করেন, পাঞ্চাল দেশের সঙ্গে গঙ্গা এবং কুরুদেশের ব্যবধান রচনা করেছিল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ঘন-সন্নিবিষ্ট বিশাল বনরাজি। জতুগৃহ দাহের পর পাণ্ডবরা পাঞ্চালের অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন গঙ্গা পার হয়ে, ওই বিশাল অরণ্য পথ পেরিয়ে। আমরা যে পুরাণের কল্পনা অনুযায়ী পাঁচ জন সমর্থ রাজার পাঞ্চাল-অধিকারের কথা বলেছি, সেই পাঁচ রাজার নাম সর্বত্র একরকম নয়। বিশেষত বৈদিক শতপথ বা ঐতরেয়র মতো প্রাচীন ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিকে প্রমাণ হিসেবে ধরলে এই পাঁচ রাজার নাম দাঁড়াবে কৃবি, তুর্বশস্, কেশিন (কেশী), সৃঞ্জয় এবং সোমক। পণ্ডিতেরা এগুলিকে কোনও একক রাজার নাম মনে করেন না। বৈদিক জন-জাতির প্রথম বসতি, অধিকার এবং রাজনৈতিক-সামাজিক স্থিতি বিচার করলে এগুলিকে গোষ্ঠী নাম বলাই ভাল। আমরা যেমন ক্ৰব্য পাঞ্চালের নাম পেয়েছি তেমনই আর চার জনের বৈদিক পরিচয়ও বলা যাবে।
পাঞ্চাল সোন সাত্ৰাসাহর সঙ্গে তুবশ বা তৌবশস নামক গোষ্ঠী নামের যোগ যেমন প্রামাণিত তেমনি পাঞ্চাল দাভ্যর সঙ্গে কেশী হল গোষ্ঠী–নাম। অন্যদিকে গোষ্ঠীনাম হিসেবে সৃঞ্জয় এতই বিখ্যাত যে, অন্তত চার–পাঁচজন পাঞ্চাল রাজার নামের সঙ্গে সৃঞ্জয় শব্দটা বৈদিক কালেই যুক্ত হয়ে গেছে, যেমন দৈবরাত সৃঞ্জয়, প্রস্তোক সৃঞ্জয়, সৃঞ্জয় বীতহব্য অথবা সৃঞ্জয় সহদেব। বৈদিক ঐতিহ্য অনুসারে সহদেব সৃঞ্জয়ের পুত্র হলেন সোমক। তিনি বোধহয় নতুন একটি গোষ্ঠী প্রবর্তন করেন এবং তাঁরই নামে সোমক সাহদেব্যর নাম পাই আমরা।
কথাটা একটু সহজ করে বলি। গোষ্ঠী-নামের কথা ব্যক্ত দিন। আসলে সৃঞ্জয়, সোমক–এঁরা হলেন পাঞ্চাল-দেশের একেক জন বিখ্যাত রাজাদের একেক জনের নামেই একেকটি বংশধারা বিখ্যাত হয়ে গেছে। আমরা এর আগে সৃঞ্জয় এবং সোমকের কথা সবিস্তারে বলেছি। বলেছি সোমকের সেই বিখ্যাত ছেলেটির কথা, যাঁর নাম ছিল জন্তু। পাঠকের মনে পড়বে সোমকের এই একমাত্র ছেলেকে একটি পিঁপড়ে কামড়েছিল বলে তার স্ত্রীদের মধ্যে কী অসম্ভব ব্যাকুলতার সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা তখনই জানিয়েছিলাম যে, এক পুত্রের নানা সমস্যা নিয়ে বিব্রত হয়েছিলেন বলে সোমক শেষ পর্যন্ত জন্তুকে যজ্ঞে আহুতি দিয়ে শত পুত্র লাভ করেছিলেন, যাঁদের মধ্যে কনিষ্ঠটি ছিলেন পৃষত। ভাইদের মধ্যে পৃষতই সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন বলে তিনি পাঞ্চালের রাজসিংহাসনে বসেছিলেন। ভবিষ্যতে তিনিই পাঞ্চাল-রাজ দ্রুপদের পিতা হবেন–তেষাং যবীয়ান্ পৃষতো দ্রুপদস্য পিতা প্রভু।
আরও একটা খবর আপনাদের পূর্বে জনিয়েছিলাম, যেটা এই মুহূর্তে স্মরণ করতে হবে। আমরা বলেছিলাম– কুরুরাজ্যের সঙ্গে পাঞ্চাল দেশের সম্পর্ক মোটেই ভাল ছিল না। কুরুবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা সম্বরণের কথা বলবার সময় আমরা জানিয়েছিলাম যে, পাঞ্চালরা কুরুরাজ্য আক্রমণ করে সম্বরণ এবং তার স্ত্রী তপতাঁকে দেশছাড়া করে ছেড়েছিলেন। সম্বরণকে পুত্র-পরিবার নিয়ে সিন্ধু নদীর তীরভূমিতে গিরি গুহা আশ্রয় করে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে বহু সময়। সম্বরণ মহর্ষি বশিষ্ঠের সাহচর্যে কুরুরাজ্য পুনরায় দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন বটে, তবে সে আরেক কথা। আমরা আবারও সহজ করে বলি।
পাঞ্চাল সোমক এবং তারও পূর্বপুরুষ সৃঞ্জয়ের নাম এতটাই বিখ্যাত ছিল যে একেবারে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের সময় পর্যন্ত পাঞ্চালদের কখনও সৃঞ্জয়া কখনও বা সোমকা বলে ডাকা হয়েছে। ঋগবেদ এবং বায়ু পুরাণের তথ্য মিলিয়ে দেখা যাবে–সৃঞ্জয়ের বংশেই রাজা দিবোদাসের জন্ম হয় এবং সেই বংশেই চ্যবন বলে এক রাজা জন্মান। এই চ্যবন নামটা নিয়ে পুরাণে-পুরাণে বিবাদ আছে। কেউ বলেন, নামটা চ্যবন নয়, পঞ্চজন, আবার কেউ বলেন পঞ্চজনও নয়। নামটা পিজবন। আমরা নানা তথ্য বিচার করে দেখেছি– এই নামটি চিনতে হবে তথাকথিত চ্যবন বা পঞ্চজনের ছেলের নাম দিয়ে। এঁর ছেলের নাম ছিল সুদাস অথবা সুদা। ঋগবেদেও সুদাসের নাম বহুবার পাওয়া যাবে। এই সুদাসের পিতার নাম যে চ্যবনও নয়, পঞ্চজনও নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে মনুসংহিতায়। সেখানে সুদাস বা সুদার সঙ্গে তার পিতার নামও উল্লেখ করা হয়েছে– সুদা পৈজবনশ্চৈব অর্থাৎ পিজবনের ছেলে সুদাস।
পণ্ডিতেরা অনেকে মনে করেন সুদাসের সঙ্গেই সম্বরণের যুদ্ধ হয়েছিল এবং তারই আক্রমণে তাঁকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল সিন্ধু নদীর পার্বত্য অঞ্চলে। পুরাণ বলেছেরাজ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য সম্বরণ মহামুনি বশিষ্ঠকে মন্ত্রিত্বে বরণ করেন। বশিষ্ঠের মন্ত্রিত্ব বা মন্ত্রণা কতটা সফল হয়েছিল জানি না, কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হল, সম্বরণ একাই যে বশিষ্ঠের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন, তা নয়। পুরাণের তথ্য অনুযায়ী– ভরতবংশের সমস্ত ধারা–উপধারা সকলেই বশিষ্ঠের শরণাপন্ন হয়েছিলেন দুর্গত সম্বরণের সাহায্য-কল্পে-অর্ঘ্যমভ্যাহরৎ তস্মৈ তে সর্বেভারতাস্তদা।
রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির একটি বিশেষ সংখ্যায় এক গবেষক বিচার করে দেখিয়েছেন যে, এই ভারতাঃ বলতে শুধু ভরত-বংশের অধস্তনদের কথা ভাবলে ভুল হবে। পাঞ্চাল সুদা বা সুদাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য তখনকার উত্তর-পশ্চিম ভারতের সমস্ত রাজারাই সম্বরণের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মথুরার যাদবরা, উশীনর শিবিরা, গান্ধারবাসী হুরা, মৎস্যদেশের রাজা এবং আধুনিক রেওয়া অঞ্চলে বসবাসকারী তুর্বসুরা। শেষোক্ত তুর্বসুরা পূর্বে পাঞ্চালের কিছু অংশে রাজত্ব করতেন বোধহয়। এঁরা সবাই পাঞ্চাল সুদাসের বিরুদ্ধ-ভূমিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং এঁদের একত্র করার ব্যাপারে বশিষ্ঠ-বংশীয় ব্রাহ্মণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মনে হয়।
হস্তিনাপুর সম্বরণের হাতে এসেছিল এবং তার বিখ্যাত পুত্র কুরুর আমলে রাজ্যের বাড়বৃদ্ধি চূড়ান্ত হয়েছিল। তাঁর আমলে কুরু-রাজ্যের সীমানা সরস্বতীর তীরভূমিতে স্থিত কাম্যক বন থেকে আরম্ভ করে যমুনার কাছাকাছি খাণ্ডবপ্রস্থ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। অর্থাৎ এখনকার থানেশ্বর, মিরাট এবং দিল্লির লাগোয়া অংশ অপচ গঙ্গা নদীর ওপর বিস্তীর্ণ দোয়াব অঞ্চল তখন মহারাজ কুরুর অধীনে এসে গিয়েছিল। কুরুরাজ্যের এই প্রতিপত্তিতে পাঞ্চালদের ক্ষমতা অনেকটাই সীমিত হয়ে আসে এবং পাঞ্চাল সোমকের আমলে তার বংশ যখন প্রায় লুপ্ত হবার যোগাড় হল, সেই সময়ে যাঁকে আমরা রাজ্যের হাল ধরতে দেখেছি, তিনি সোমকের কনিষ্ঠ পুত্র পৃষত।
আমরা এইরকম একটা জায়গা থেকেই পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কথা শুরু করতে চাই। কারণ তার সঙ্গে পাঞ্চাল এবং কুরুদেশের রাজনীতি জড়িয়ে আছে। কিন্তু তারও আগে জানাই– পাণ্ডব-কৌরবদের প্রথম অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য, যাঁকে মহারাজ শান্তনু শিশু অবস্থায় তুলে এনে হস্তিনাপুরে স্থান দিয়েছিলেন, তার জন্ম কিন্তু পাঞ্চালদের বংশধারায়। আমরা পুরাণের প্রমাণে যে পাঁচজন সমর্থ রাজাকে পাঞ্চালের অধিকারী রাজা হিসেবে দেখিয়েছি তাদের প্রথম পুত্রের নাম মুগল। এই মুৰ্গলের ছেলেরা কিন্তু সকলেই ব্রাহ্মণ হয়ে যান, যাঁরা মৌগল্য বা মৌদগল্যায়ন ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত হন–সর্ব এতে মহাত্মানঃ ক্ষত্রোপেতা দ্বিজাতয়ঃ। এঁরা জাতে ক্ষত্রিয় কিন্তু পেশায় বামুন বলে পৌরাণিকেরা এঁদের ক্ষত্রোপেত দ্বিজ বলেছেন, পারজিটার সাহেব এঁদের ইংরেজি নাম দিয়েছেন– ক্ষত্রিয়া ব্রাহ্মিস্।
মুগলের ছেলে মৌলের নাতি হলেন বর্ধশ্ব। বর্ধশ্ব কোনও সময়ে স্বর্গসুন্দরী মেনকার মোহে পড়ে দুটি যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দেন, পুত্রটির নাম দিবোদাস, যাঁর কথা আগে বলেছি। আর কন্যাটির নাম অহল্যা। অহল্যার সঙ্গে যাঁর বিবাহ হয়, তার নাম শরদ্বত, অন্তত হরিবংশে তাই আছে। আমরা কৃপাচার্যের পিতার নাম বলেছি শরদ্বান। তবে হরিবংশের বক্তব্য শুনে মনে হয় শরদ্বান হয়তো তাঁর কুলনাম বা বংশ নামমাত্র। কারণ হরিবংশে দেখেছি– যে রমণীর গর্ভে কৃপ-কৃপীর জন্ম হল, সেই রমণীর গর্ভাধান করেছিলেন সত্যধৃতি নামে এক পুরুষ, যিনি শরদ্বানের নাতি। আমাদের ধারণা কুল-নাম যোজনা করে নিলে কৃপাচার্যের পিতার নাম হওয়া উচিত সত্যধৃতি শরদ্বান। হরিবংশে সত্যধৃতিকেও ধনুর্বেদ ব্যসনী এক ক্ষত্রোপেত ব্রাহ্মণ হিসেবেই দেখতে পাচ্ছি। কুলনাম অনুসারে মহাভারত তাকে শুধুই শরদ্বান বলেছে, কিন্তু আসলে তিনি সত্যধূতি শরদ্বান, যিনি সেই জানপদী কন্যার গর্ভে কৃপ-কৃপীর জন্ম দিয়েছিলেন। সত্যধৃতির সময়ে যিনি পাঞ্চালের রাজা ছিলেন, তারই কোনও কূট-কৌশলে জানপদীকে সত্যধৃতি-শরদ্বানের কাছে পাঠানো হয়েছিল কিনা জানি না, কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে কৃপাচার্যের জন্ম কিন্তু পাঞ্চাল–বংশের ধারায়। মহারাজ শান্তনু কৃপাচার্যকে শিশু অবস্থায় নিয়ে এসে মানুষ করেছিলেন বটে কিন্তু এর মধ্যেও তার বংশগত পাঞ্চাল-বিদ্বেষ কাজ করছিল কিনা সেটা তৎকালীন রাজনৈতিক স্থিতিতেই বুঝে নেওয়া ভাল। অর্থাৎ কৃপাচায়ের রক্তে কোনও পাঞ্চাল-বিদ্বেষ ছিল বলেই হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ ঘটেছিল কিনা, সে বিষয়টা আমাদের অভীষ্ট একটি অনুমানের মধ্যে রয়ে গেল। এবারে দ্রোণাচার্যের কথায় আসি।
দ্রোণাচার্যের জন্মও খুব স্বাভাবিকভাবে হয়নি। অর্থাৎ এখানেও এক অপ্সরার কাহিনী আছে। মহাভারতের বক্তব্য অনুযায়ী দ্রোণাচার্যের জন্মদাতা পিতা হলেন মহর্ষি ভরদ্বাজ। তিনি ভরদ্বাজ গোত্রীয় অন্য কোনও মুনিও হতে পারেন, যাঁকে শুধুই ভরদ্বাজ বলে ডাকা হয়েছে। তিনি একদিন হোম করার জন্য আশ্রম থেকে বেরিয়েছেন। তার ইচ্ছে– গঙ্গাস্নান সেরে তিনি হোম সমাপন করবেন। কিন্তু গঙ্গায় স্নান করতে যাবার পথেই তার জীবনে এক বিড়ম্বনা নেমে এল। হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন–স্বর্গসুন্দরী ঘৃতাচী গঙ্গায় স্নান করার পর ভিজে কাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরছেন। পুরাতন এবং নবীন বস্ত্রের পর্যাবর্তনের মাধ্যমিক সময়টুকুতে ঘৃতাচীর গায়ে কোনও আবরণ ছিল না। ভরদ্বাজের চিত্তবৃত্তি চঞ্চল হল রমণী-শরীরের বাসনায়। তিনি ঘৃতাচীকে কামনা করলেন–ব্যপকৃষ্টাম্বরাং দৃষ্ট্ৰা তাং ঋষিশ্চকমে ততঃ। ভরদ্বাজ মিলন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন না। তাঁর তেজ স্খলিত হয় এবং তিনি সেই ক্ষরিত তেজোবিন্দু হাতে ধরা কলসের মধ্যে ধারণ করেন। কলসের পর্যায় শব্দ হল দ্রোণ। এই কলস থেকে যিনি জন্মেছেন, তার নামও তাই দ্রোণ।
দ্রোণ তথা কলসের অলৌকিক বৃত্তান্ত নিয়ে বেশি আলোচনা না করে আপনারা যদি গর্ভ বস্তুটাকেই কলসের রূপকে মেনে নেন, তাহলে কোনও অনামা রমণীর গর্ভেই দ্রোণের জন্ম হয়েছিল বলে আমরা বুঝে নিতে পারি। অপ্সরা-সুন্দরী ঘৃতাচীর নাম এখানে বাহুল্যমাত্র। যাইহোক, দ্রোণাচার্য একটু বড়ো হালে মহর্ষি ভরদ্বাজ তাকে অগ্নিবেশ্য মুনির কাছে অস্ত্র শিক্ষার জন্য রেখে দেন। ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণেরা মুনি-ঋষি হলেও এঁরা অস্ত্রশিক্ষা খুব ভালভাবেই করেছিলেন। বাল্মীকি রামায়ণে দেখবেন–রামচন্দ্র বনবাসকালে কোনও এক ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণের কাছ থেকে অস্ত্রলাভ করেছিলেন।
ভরদ্বাজ কোনও সময় অগ্নিবেশ্য মুনিকে একটি আগ্নেয় অস্ত্র দান করেছিলেন। কিন্তু দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষায় খুশী হয়ে সেই আগ্নেয় অস্ত্র দ্রোণকেই দান করেন অগ্নিবেশ্য। মহাভারতের কবি কাব্য করে অগ্নিবেশ্য মুনিকে অগ্নির পুত্র বলে বর্ণনা করেছেন–অগ্নেস্ত জাতঃ স মুনিঃ–কিন্তু আমাদের ধারণা এই বিশেষ ব্রাহ্মণ-গোষ্ঠী, অগ্নিবেশ্য যাঁদের অন্যতম, এঁরা আগ্নেয় অস্ত্র–চালনায় সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন। আগ্নেয় অস্ত্র–চালনা সেকালের দিনে অত সহজ ছিল না। একটি বাণ ছাড়ার সময়েই তাতে অগ্নি-সন্নিবেশ করে শত্রুপক্ষের মধ্যে সেই বাণের নিপতন পর্যন্ত অগ্নি অক্ষুণ্ণ রাখা অত সোজা ব্যাপার ছিল না। মুনিবর অগ্নিবেশ্য সেই বিদ্যা জানতেন এবং দ্ৰোণকে তিনি তা শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
দ্রোণকে ছোটবেলায় বেদ–বেদাঙ্গ সবই শিখিয়েছিলেন ভরদ্বাজ। কিন্তু বয়সকালে দেখা গেল ব্রাহ্মণের বেদ–বিদ্যার চেয়ে অস্ত্রবিদ্যাই তার আসে ভাল। অতএব ভরদ্বাজ তাকে অগ্নিবেশের হাতেই সঁপে দেন অস্ত্রশিক্ষার জন্য। মনে রাখতে হবে, এই সমস্ত ঘটনার পটভূমি কিন্তু পাঞ্চাল রাজ্য এবং তখন পাঞ্চাল শাসন করছেন মহারাজ পৃষত, যিনি পরবর্তী পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের পিতা। রাজা পৃযত দ্রোণ-পিতা ভরদ্বাজের বন্ধু-মানুষ-ভরদ্বাজসখা চাসীৎ পৃষতো নাম পার্থিবঃ দ্রোণাচার্য যখন ঘোট, তখন পৃষতের প্রিয়তম পুত্র দ্রুপদ ভরদ্বাজের আশ্রমে খেলা করতে আসতেন। দ্রোণ একটু বড় হতে যখন অগ্নিবেশ্য মুনির কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে গেলেন, তখন হয়তো বা ভরদ্বাজের পরামর্শেই–রাজা পৃষত পুত্র দ্রুপদকে পাঠিয়ে দিলেন অগ্নিবেশ্যর কাছে। দুজনেরই অস্ত্রশিক্ষা চলতে লাগল একসঙ্গে।
সেকালের দিনে গুরুগৃহে বাস এবং শিক্ষালাভ অত আরামের কিছু ছিল না। ব্রহ্মচারী হয়ে সংযতচিত্তে গুরুশুশ্রূষা করতে হত দিনের পর দিন। অনেক বছর এইভাবে থাকতে থাকতে দ্রোণের চুলে জটা ধরে গিয়েছিল–ব্রহ্মচারী বিনীতাত্মা জটিলো বহুলাঃ সমাঃ। গুরুগৃহে অস্ত্রচর্চার এই সময়গুলিতে দ্রোণের সঙ্গে পাঞ্চলরাজ পৃষতের পুত্র দ্রুপদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ়তর হয়। গুরুশুশ্রষা এবং অস্ত্রশিক্ষার ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলতে বলতেই এই দ্রোণ এবং দ্রুপদের বন্ধুত্ব এক চরম সীমায় পৌঁছায়।
.
৯৮.
দ্রুপদ এবং দ্ৰোণ একই ব্রহ্মচর্যের নিয়ম মেনে একই গুরুর কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতেন বটে, তবে তাদের মানুষ হওয়ার পূর্ব পরিবেশ এবং জাতি মর্যাদা যেহেতু অন্যরকম ছিল, তাই সতীর্থতার প্রগাঢ় সাহচর্যের মধ্যেও দুজনেরই স্বভাব ফুটে বেরত। দ্রুপদ রাজার ছেলে ক্ষত্রিয় এবং দ্রোণাচার্য ব্রাহ্মণের ছেলে, কিন্তু বামুন হওয়া সত্ত্বেও তিনি যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা ত্যাগ করে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে এসেছেন। আসলে ওই দিকেই তাঁর রুচি ছিল। একালের দিনে ব্রাহ্মণের স্বকর্ম বা স্বধর্মত্যাগের মধ্যে কোনও লাঞ্ছনা নেই, কারণ সময় পালটেছে। আমরা এখন জাতের বিচারে এবং আচারে মনুষ্যত্বকে লঙ্ঘন করতে চাই না বলেই জন্মের মর্যাদায় মানুষের বিচার করি না। কিন্তু সেকালে কোনও ব্রাহ্মণ যখন নিজের যজন-যাজন-অধ্যয়ন ছেড়ে ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রশিক্ষায় মন দিতেন, তখন তার মানে হত একটাই। শম-দম-তপস্যা তার কাম্য নয়, তার কাম্য অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ইত্যাদি।
দ্রুপদ এবং দ্ৰোণ যখন একত্রে অস্ত্রশিক্ষা করেছেন, তখন যে কোনওভাবেই হোক দ্রোণের ওই প্রতিপত্তিকামিতা দ্রুপদের কাছে প্রকট হয়ে পড়েছিল। একসঙ্গে কষ্ট করছেন একই গুরুর কাছে। অতএব সেই সময়ে দ্রুপদের কাছেও দ্রোণের ওই আকাক্ষার কোনও কদৰ্থ ছিল না। অর্থাৎ দ্রুপদও দ্রোণকে খারাপভাবে নেননি। বন্ধুত্বের মর্যাদাতেই তিনি দ্রোণকে বলতেন–ভাই। আমি আমার পিতার প্রিয়তম পুত্র। পিতা আমাকেই তার রাজ্যে অভিষিক্ত করবেন এবং পিতার অবর্তমানেও পাঞ্চাল রাজ্যের সিংহাসন আমারই হাতে থাকবে। সেই সুদিনে তোমাকে আমি ভুলব না ভাই। আমি যদি রাজ্য পাই, তবে সে রাজ্য তোমারও ভোগে আসবে, এ আমার প্রতিজ্ঞা–তদূভোগ্যং ভবিতা রাজ্যং সখে সত্যেন তে শপে। তুমি এও জেনো–আমার ধন-সম্পত্তি, আমার সুখ–সে সব তোমারও।
দ্রোণের সঙ্গে দ্রুপদের এই শেষ কথা। অস্ত্রশিক্ষা শেষ করে দ্রুপদ যেদিন পাঞ্চাল-রাজ্যে ফিরে যাচ্ছেন, সেদিন এই সব কথা হল দুই বন্ধুর মধ্যে। দ্রুপদ পাঞ্চালে ফিরে যাবার পর দ্রোণও ফিরে এসেছেন পিতার আশ্রয়ে। পিতা ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণ-গুরু। তিনি যজন-যাজননিয়েই থাকেন। তার অবস্থা এমন নয় যে, দ্রোণকে তিনি ঐশ্বর্যের আস্বাদ দিতে পারেন। ব্রাহ্মণের যজন-যাজনশিক্ষা করলেও না হয় যাগ–যজ্ঞের অনুষ্ঠান করার জন্য ডাক পেতেন কোথাও। ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রবিদ্যা শিখে ব্রাহ্মণ পিতার বাড়িতে দীনহীন অবস্থায় থেকে দ্রোণের মতো যুদ্ধবীরের ভাল লাগবার কথা নয়। কিন্তু তার পিতাই বা কী করবেন? তাঁকে যাজন করতেও পাঠাতে পারছেন না, আবার স্বধর্মত্যাগী পুত্রকে অর্থের জন্য ক্ষত্রিয় রাজার বাড়িতে যাচনা করতে পাঠাতেও তার মর্যাদায় লাগে। অতএব তিনি কী আর করেন।
কিছুই না পেলে তখনকার দিনে বিয়ে করাটাই ছিল সবচেয়ে কাজের কাজ। পিতা ভরদ্বাজ দ্রোণকে বললেন–বিবাহ করো। পরবর্তী সময়ে দ্রোণ তার বিবাহের ঘটনা খুব সহজ করেই বলেছেন। যেন এই বাবা বললেন বিয়ে করো; আর তারপর একটি বুদ্ধিমতী মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হল। কিন্তু দ্রোণাচার্যের বক্তব্যের তির্যক ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায় যে, তাঁর বিবাহের মধ্যেও কিছু কথা আছে। মহাভারতের কবি যেহেতু সে সব কথা স্বকণ্ঠে বলেননি, তাই আমরাও সে কথা উচ্চারণ করার সাহস পাই না। তবে কিনা দ্রোণের বক্তব্য শোনার পর যদি এমন মনে হয় যে, সত্যিই এর মধ্যে কিছু কথা আছে, তবে তা উচ্চারণ করলে দোষ নেবেন না মহাভারতের কবি।
দ্রোণ নিজের জীবন-কাহিনী বলবার সময় ভীষ্মকে বলেছিলেন–পিতার আদেশ অনুসারে এবং পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষায় আমি তারপর একটি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী কন্যার পাণিগ্রহণ করলাম–মহাপ্রজ্ঞামুপযেমে মহাব্রতা। একটাই ব্যাপার, মেয়েটির মাথায় খুব একটা চুল ছিল না–নাতিকেশী। তবে তিনি যথেষ্ট ব্রতপরায়ণা ছিলেন, এবং আমার অগ্নিহোত্র বা যজ্ঞকার্যেই শুধু নয়, আমার ইন্দ্রিয়দমনের ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ সহায়তা করতেন অগ্নিহোত্রে চ সত্রে চ দমে চ সততং রতাম্।
দেখুন, সেকালের ব্রাহ্মণ যদি তার স্বধর্ম এবং স্বকর্ম ত্যাগও করতেন, তবু অগ্নিহোত্র বা যাগ-যজ্ঞাদি তার নিত্য-কর্মপদ্ধতির অন্তর্গত ছিল। দ্রোণ যাঁকে বিবাহ করে আনলেন, তার গুণ ছিল যথেষ্টই। তিনি বুদ্ধিমতী এটা তো খুব বড় কথা বটেই। তিনি ঘর-কন্না সামলেও দ্রোণের অগ্নিহোত্রের যোগাড় করে দিতেন, নিজের ইচ্ছেতে যজ্ঞাদি করতে চাইলে তারও সহায়তা করতেন। কিন্তু এটা ভারী আশ্চর্য কথা যে নববিবাহিতা বধূর সম্বন্ধে অনেককাল পরে স্মরণ করতে গিয়ে দ্রোণ বলছেন–তিনি আমার ইন্দ্রিয়দমনেরও সহায় ছিলেন।
দ্রোণ এমন কিছু উঁচু দরের ব্রাহ্মণ ঋষি ছিলেন না যে, শমদমাদিসাধনের মাধ্যমে নিজেকে তিনি ক্রমেই ব্ৰহ্ম–জিজ্ঞাসার উপযুক্ত করে তুলছিলেন। সাধারণ অগ্নিহোত্র, সন্ধ্যাবন্দনা যে কোনও জন্ম–ব্রাহ্মণই করতেন, কিন্তু বিবাহিত স্ত্রীর সহবাসেও ইন্দ্রিয়দমনের প্রয়োজন যে তার। খুব ছিল, সে কথা আমাদের মনে হয় না। আর মনে হয় না বলেই আরও একটা কথা মনে হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠকালে আমাদের এক সহপাঠিনীকে আমরা খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি পড়াশোনায় খুবই ভাল ছিলেন, ক্যাট্রক্যাটু করে কথা বলতেন এবং অতিশয় অসুন্দরী ছিলেন। আমার দু-একটি নিন্দাপ্রবণ বন্ধু–অবশ্য তাদেরই বা কী দোষ দেব–তাদের সামনে ওই কঠিনহৃদয়া সহপাঠিনীর নাম উচ্চারণ করলেই তাঁরা বলতেন– বলিস না, কি বলিস না ভাই, ওঁর সম্বন্ধে। চিত্তশুদ্ধির এমন যন্ত্র কোনও বৈজ্ঞানিক তৈরি করতে পারবেন না। দেখামাত্রই মনে হয় এ জীবনে ব্রহ্মচর্যই একমাত্র শ্রেয় বস্তু।
মহাভারতের কবি কিছু না বললেও দ্রোণের কথা থেকেও তার স্ত্রীর সম্বন্ধে এমনই এক ধারণা আসে। দ্রোণ বলেছিলেন আমার সেই বুদ্ধিমতী স্ত্রী আমার ইন্দ্রিয়দমনের সহায়িকা এক রমণী– দমে চ সততং রতাম। মহাভারতের কোনও ব্রহ্মবাদী ঋষিকেও নিজের স্ত্রীর সম্বন্ধে এ ধরনের কথা বলতে শুনিনি। তার মধ্যে দ্রোণ নিজেই বলেছেন– মেয়েটির মাথায় চুল বলতে কিছু ছিল না– নাতিকেশীং মহাপ্রজ্ঞাম্। যৌবন বয়সেই যে রমণী কেশহীনতার জন্য যুবক দ্রোণের মনে ছায়া ফেলেছেন, তিনি যে তার স্বামীকে রূপে না ভুলিয়ে ভালবাসাতেই ভুলিয়েছেন, সে কথা আমরা জোর দিয়েই বলতে পারি।
আমরা বউ-পরিচয় করিয়ে দিই– দ্রোণাচার্যের স্ত্রীটি হলেন প্রসিদ্ধ কৃপাচার্যের ভগিনী কৃপী। কেন যে কৃপীর সঙ্গে তার বিবাহ হল, সে প্রসঙ্গ নিয়েও একটি অনুমান আছে। আগেই জানিয়েছি কৃপ এবং কৃপীর জন্ম এক জানপদী কন্যার গর্ভে, আবার দ্রোণাচার্যের জন্মও অন্যতরা এক অপ্সরা ঘৃতাচীর গর্ভে। দুই পক্ষেরই জন্ম স্বাভাবিক বিবাহযোগে নয়। জন্ম হয়েছে দুই ব্রাহ্মণের কামোন্মত্ততায়। তাদেরই ঔরসে। মাতৃপরিচয়হীন এই দুই জাতক-জাতিকার বিবাহটাই তাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিবাহের কিছুকালের মধ্যে দ্রোণাচার্যের পুত্র হল দ্রোণ-পুত্রের নাম হল অশ্বত্থামা। কিন্তু পুত্রলাভের সৌভাগ্য লাভ করেও দ্রোণের অবস্থার কোনও উন্নতি হল না। এত অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেও তার কোনও সমৃদ্ধি নেই, অথচ ক্ষত্রিয়রা অনেকেই পৈতৃক রাজ্য লাভ করে যথেষ্ট সমৃদ্ধির মধ্যে আছেন। দ্রোণের কোনও রাজ্যও নেই এবং একটি রাজ্য অধিকার করতে যে পরিমাণ সৈন্য-সামন্ত এবং অর্থের প্রয়োজন হয়, তাও তার নেই। তাঁর দিনই চলে না, তো সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করবেন কোন অর্থ দিয়ে।
দ্রোণাচার্য ভীষ্মের কাছে নিজের দুঃখ–কাহিনী বিবৃত করছিলেন। যে ঘটনাটা তার অর্থনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বেশি আঘাত করল সেটি তার পুত্রকে নিয়েই। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা বড় হচ্ছিলেন বটে, তবে একটি শিশুর প্রাপ্য যে গোদুগ্ধটুকু, তারও আস্বাদ তিনি জানতেন না। একদিন পাড়ার মধ্যেই এক সম্পন্ন গৃহস্থবাড়িতে তার ছোট ছোট ছেলেরা দুধ খাচ্ছিল। অশ্বত্থামা সেটা দেখে খুবই লুব্ধ হলেন এবং পিতা দ্রোণের কাছে এসে দুধ খাওয়ার বায়না করলেন। দ্রোণাচার্যের মনে সেদিন চরম আঘাত লেগেছিল। ছেলেকে একটু দুধ পর্যন্ত খাওয়াতে পারেন না–এই দৈন্যদশা তাকে অত্যন্ত দুঃখিত করে তুলল।–অশ্বত্থামারুদ বালস্তন্মে সম্মোহয়দ্দিশঃ। অথচ ব্রাহ্মণের ছেলে হওয়ার দরুন দ্রোণাচার্যের কিছু গুমোরও আছে। কোনও লোকের কাছে কিছু না চাওয়াটাই ব্রাহ্মণের গৌরব। এ গৌরব তখনও পর্যন্ত তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
আর কিছু নয়, পুত্রের দুগ্ধপানের জন্য তিনি একটি গোরু চেয়েছিলেন। দ্রোণাচার্য ব্রাহ্মণের কর্মগুলি করেন না। যজন-যাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা কিছুই করেন না। এগুলি চালিয়ে গেলে অন্তত একটি গোরু যোগাড় করতে তাঁর অসুবিধে হত না। কিন্তু এগুলোও তিনি করবেন না, আবার ব্রাহ্মণের জাতি-গৌরব মেনে কারও কাছে যাচনা-প্রতিগ্রহও করবেন না; ফল যা হবার তাই হল। দেশ-দেশান্তর ঘুরে দ্রোণ একটি দুগ্ধবতী গোর যোগাড় করতে পারলেন না। দ্রোণ নিজেই বলেছেন, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরেও ছেলেকে দুধ খাওয়ানোর মতো একটা গোরু আমি যোগাড় করতে পারলাম না– অন্তদন্তং পরিভ্রম্য নাধ্যগচ্ছং পয়স্বিনীম।
এর পরে যে ঘটনা ঘটল, দ্রোণের পক্ষে তা আরও মর্মবিদারক। অশ্বত্থামা প্রতিদিনই দুধের লোভে লোভে পাড়ায় সেই বড়লোকের বাড়িতে যান। একদিন বালকেরা দুষ্টুমি করে পিটুলিগোলা জল একটি পানপাত্রে রেখে অশ্বত্থামাকে খেতে দিল। অশ্বত্থামা নিজেকে পরম অনুগ্রহান্বিত মনে করে পরম আনন্দে সেই পিটুলিগোলা জলকে দুধ মনে করে পান করলেন এবং পিতার কাছে এসে সেই জলের বর্ণনা দিয়ে সোচ্ছ্বাসে বললেন–দুধ খেয়েছি, দুধ খেয়েছি–পীত্বা পিষ্টরসং বালঃ পীতং ক্ষীরং ময়াপি চ। অশ্বত্থামা পিতাকে তার আনন্দের খবর দিয়েই আবার নাচতে নাচতে সেই ছেলেদের দলে গিয়ে পড়লেন। অশ্বত্থামা নাচতে লাগলেন দুধ খাওয়ার আনন্দে আর ধনীর পুত্রেরা তাকে ঘিরে নাচতে লাগল উপহাসের আনন্দে–হাস্যতামুপসপ্রাপ্তং বালৈঃ পরিবৃতং সুতম্।
দূর থেকে এই করুণ দৃশ্য দ্রোণের চোখে পড়ল। দুঃখে, লজ্জায়, ঘৃণায় নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলেন তিনি। ভাবলেন– গৃহকর্তা হয়ে যে মানুষ পুত্র-পরিবার ভরণের জন্য সামান্য অর্থ উপায় করতে পারে না, ধিক্ তাকে দ্রোণং ধিগস্তু অধনিনং যো ধনং নাধিগচ্ছতি। পাড়ার ছোট্ট ছোট্ট ছেলেরা তার ছেলেকে যেভাবে অপমান করেছিল, তাতে দ্রোণের মাথাটাই খারাপ হয়ে যাবার যোগাড় হল। তিনি ভাবলেন– অর্থার্জন আমাকে করতেই হবে। তবে তাই বলে পরের সেবা করে ধনলাভ করব না। অর্থ উপার্জন করব নিজের ক্ষমতায় পরোপসেবাং পাপিষ্ঠাং ন কুৰ্যাং ধনলিপ্সয়া।
আমরা আগেই জানিয়েছি– ব্রাহ্মণের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ক্ষত্রিয়োচিত অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিলেন বলে সামাজিক ব্রাহ্মণরা দ্রোণকে রীতিমতো বর্জন করেছিলেন। দ্রোণ নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন যে, ব্রাহ্মণসমাজ তাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছিল এবং তিনি ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁকে নিন্দাও সইতে হয়েছে যথেষ্ট অপি চাহং পুরা বিবৈর্জিত গহিতো ভূশ। পরিষ্কার বোঝা যায়– দ্রোণাচার্যের অবস্থা প্রায় না ঘরকা, না ঘাটকা। ব্রাহ্মণসমাজ তাকে বর্জন করেছে, অথচ ক্ষত্রিয়ের বিদ্যা শিখে তিনি অর্থোপার্জনও করতে পারছেন না। এখন পুত্রের এই করুণ অবস্থা দেখে দ্রোণ সিদ্ধান্ত নিলেন– অর্থোপার্জন তাকে করতেই হবে। তবে তিনি যে বেশ জুগুপ্সা দেখিয়ে মন্তব্য করলেন– আমি পরের সেবা করে ধন উপার্জন করব না–সেটা খুব কাজের কথা নয়। এটা মৌখিক আড়ম্বর মাত্র, ব্রাহ্মণ্য বীর্যের অকর্মণ্য দম্ভ মাত্র। এরপর তিনি যা সিদ্ধান্ত নিলেন অথবা এর পর তিনি যা করতে থাকবেন, তা পরের সেবা ছাড়া অন্য কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞাত হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই।
দুঃখ এবং উদ্বেগের দিনে দ্রোণের মনে পড়ল পুরাতন বন্ধু পাঞ্চাল দ্রুপদের কথা। তিনি কথা দিয়েছিলেন যে, রাজ্যে অভিষিক্ত হলে বন্ধু দ্রোণও তাঁর রাজভোগে অংশীদার হবেন। তার ধন-সম্পত্তি এবং সুখের ভাগেও দ্রোণের অধিকার থাকবে। দ্রুপদ তাঁকে কথা দিয়েছিলেন। আজকে এই চরম দুর্ভাগ্যের দিনে দ্রোণ তাই তাঁর পত্নী কৃপীকে নিয়ে এবং পুত্র অশ্বত্থামার হাত ধরে পাঞ্চাল রাজ্যে দ্রুপদের সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবলেন সদারঃ সৌমকিং গতঃ। পাঞ্চাল রাজ্যে উপস্থিত হয়ে দ্রোণ শুনলেন যে, দ্রুপদ রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন পূর্বাহ্নেই। দ্রুপদের রাজা হবার কথা শুনেই দ্রোণ ভাবলেন তার কাজ হয়ে গেছে– অভিষিক্তন্তু ত্বৈব কৃতার্থোস্মীতি চিন্তয়। অর্থাৎ দ্রুপদের কাছে গেলেই তিনি তার রাজ্য বা সম্পত্তির কিছু অংশ পাবেন।
দ্রোণ সপুত্র-পরিবারে দ্রুপদের ভবনে উপস্থিত হয়ে তার সঙ্গে দেখা করলেন। মনে তার কত আনন্দ– পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কত কীই না পাওয়া যাবে। দারিদ্র্যের চরম ক্লান্তি আর তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না বলেই তার পুরাতন আশাটাও বড় বেশি হয়ে উঠল। তিনি দ্রুপদকে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন বন্ধুকে মনে আছে তো? আমি তোমার সেই শিক্ষাকালের বন্ধু ছিলাম, আমার নাম তোমার মনে আছে কি, আমার নাম দ্রোণ– সখায়ং বিদ্ধি মামিতি। পূর্বের বন্ধুত্ব-গৌরবে দ্রোণ প্রায় দ্রুপদকে আলিঙ্গন করবার জন্য হাত বাড়ালেন। কিন্তু দ্রুপদের দিক থেকে তেমন সাড়া মিলল না বলেই দ্রোণ একটু থতমত খেলেন যেন।
দ্রোণের কথা শুনে পাঞ্চাল দ্রুপদ এমন একটা ভাব করলেন যেন এক অপকৃষ্ট রোগীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। তার মুখে একটু তাচ্ছিল্যের হাসিও দেখা গেল– স তং নিরাকার মিব প্রহসন্নিদম্ অব্রবীৎ। দ্রুপদ বললেন– ব্রাহ্মণ তোমার বুদ্ধির শুদ্ধি হয়নি এখনও। তাই দেশের রীতি সামাজিক রীতি কিছুই শেখনি। তুমি যে এই জোর করে বললে আমি তোমার সখা, সেটা ঠিক করনি। কারণ, মনে রেখো মানুষ যেমন সময়কালে বুড়ো হয়, তেমনই বন্ধুত্ব জিনিসটাও বুড়িয়ে যায়, তার তীক্ষ্ণতা থাকে না। সঙ্গতানীহ জীৰ্যন্তে কালেন পরিজীৰ্যতঃ। তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল বটে, কিন্তু তার একটা কারণও ছিল। একসঙ্গে পড়তাম, একসঙ্গে অস্ত্রশিক্ষা করতাম, তোমার আমার লক্ষ্য ছিল একেবারেই এক। এইরকম একটা সমান-মনস্কতার জন্যই তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার– সৌহৃদং মে ত্বয়া হ্যাঁসীৎ পূর্বং সামর্থ্যবন্ধন। কিন্তু তুমি নিজেই ভেবে দেখ– অব্রাহ্মণ কি ব্রাহ্মণের বন্ধু হয়? কিংবা একজন যুদ্ধবীর রথী ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে যুদ্ধজ্ঞানহীন অরথীর বন্ধুত্ব? হয় কি কখনও? বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে, অসমান বন্ধুত্ব হয়ও না, টেকেও না–সাম্যান্ধি সখ্যং ভবতি বৈষম্যানোপপদ্যতে।
পাঞ্চাল দ্রুপদের তির্যক বাভঙ্গি দেখেই আমরা বেশ বুঝতে পারছি যে, তিনি দ্রোণাচার্যের সঙ্গে পূর্ব-বন্ধুত্ব অস্বীকার করতে চলেছেন। বাস্তব জীবনে, সত্যিই যে এমনটি না হয়, তা নয়। খুব ছোটবেলায় বিদ্যালয়-শিক্ষার পরিসরে কতই না বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সেই বন্ধুত্বের মধ্যে মায়া, পারস্পরিক অনুভব এবং পারস্পরিক প্রতিজ্ঞারও অভাব থাকে না কোনও। কিন্তু বয়স পরিপক্ক হতে থাকলে, জীবনের সহস্র হাজার প্রশ্ন তরঙ্গিত হতে থাকলে, মানুষের সামনে থেকে পূর্বকৃত মায়ার প্রতিজ্ঞাগুলি আস্তে আস্তে জীর্ণ হতে থাকে। দ্রুপদেরও হয়তো তাই হয়েছে। কিন্তু দ্রুপদ যে প্রথম থেকেই এত কঠিন ভাষায় দ্রোণকে এমন স্তব্ধ করে দিতে চাইছেন, সেটা একেবারে অস্বাভাবিক লাগলেও এর পিছনে কিছু স্বাভাবিক কারণও থাকতে পারে।
দেখুন, দ্রুপদ পাঞ্চাল চার-চক্ষু রাজা মানুষ। দ্রোণাচার্যের হাল-হকিকৎ তিনি কিছুই জানতেন না, তা নয়। তাছাড়া সেই বাল্যবন্ধুত্বের সময় হৃদয়ের প্রসারতায় যে কথা হয়েছে, এতকাল পরে তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, কিছু নেই, অথচ হঠাৎ করে সেই বাল্যবন্ধু এসে বাল্যপ্রণয় জানিয়ে বলল– বন্ধু। তুমি আমাকে রাজ্য দেবে বলেছিলে যে, এখন দাও। আপনিই ভাবুন– বহুদিনের সম্পর্কহীন এক প্রচীন বন্ধু যদি এসে সিংহাসনে থিতু হয়ে বসা এক রাজাকে রাজ্যখণ্ড দিতে বলে, তাহলে তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? তাছাড়া যে মানুষ তৎকালীন দিনে আপন বংশগৌরব উপেক্ষা করে নিজের অযাচিত-বৃত্তি পরিত্যাগ করে হঠাৎই একখণ্ড রাজ্য পাবার জন্য লোভী হয়ে পড়ে, যে মানুষ বন্ধু হলেও অপর বন্ধুর মনে খুব সুখকর প্রতিক্রিয়া হয় না। বাল্য বয়সেও যখন দ্রোণের সঙ্গে দ্রুপদের দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, তখনও এই লোভ যে কিছুই প্রকাশ হয়নি, তা মনে হয় না। নিজের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্যই হোক, সামাজিক ব্রাহ্মণদের দ্বারা একঘরে হয়ে যাবার ফলেই হোক, দ্রোণ বস্তুতই কিছু লোভী ছিলেন এবং সেই লোভ এতটাই প্রকট ছিল যে দ্রুপদ অন্তত এই বয়সে আর নতুন করে কোনও আশ্বাস দিয়ে নিজের ভার বাড়াতে চাননি।
দ্রুপদ বললেন– দেখ ভাই। বন্ধুত্ব জিনিসটা অজর অমর নয় কিছু, বিদীর্ণ সময় এই বন্ধুত্ব নষ্ট করে দেয়, কখনও বা অহেতুক ক্রোধন সখ্য অজরং লোকে বিদ্যতে কস্যচিৎ চিৎ। আমি স্বীকার করছি তোমার সঙ্গে বাল্যকালে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, কিন্তু অন্তর্বর্তী কাল সে বন্ধুত্ব গ্রাস করেছে। এমনিতেও বোধহয় বাল্যের এই সখিত্ব পবয়সের তর্কযুক্তিজর্জর মনোভূমিতে কাজ করে না কোনও। দ্রুপদ বললেন–এমনিতেও কি বড়লোকের সঙ্গে গরিবের বন্ধুত্ব হয় অথবা বিদ্বান ব্যক্তির সঙ্গে মূখের, অথবা যুদ্ধবীরের সঙ্গে নপুংসকের ন হ্যনাট্যঃ সখাঢ্যস্য নাবিদ্বান্ বিদুষঃ সখা? হয় না। একজন শ্রীহীন মর্যাদাহীন ব্যক্তির সঙ্গে একজন রাজার কীভাবে বন্ধুত্ব হতে পারে? সে যাই হোক, তুমি আমাকে প্রাচীন বন্ধুর গৌরব দান করে কী চাইতে এসেছ? আমি যে তোমাকে কখনও রাজ্যখণ্ড দেব বলে স্বীকার করেছি, সে কথা কিন্তু আমার কিছুই মনে পড়ছে না। তবে হ্যাঁ, তুমি বামুন মানুষ, তোমাকে আমি এক রাত্রির ভোজন সুখাদ্য নিশ্চয়ই দিতে পারি– একান্ত তে ব্রহ্ম কামং দাস্যামি ভোজনম্।
দ্রোণ মোটেই খুশি হলেন না। হবার কথাও নয়। নিজের দীন-হীন দশা আরম্ভ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই তিনি দ্রুপদের কাছে আসেননি। ভেবেছিলেন–দ্রুপদ রাজা হলে নিশ্চয়ই তাকে একদিন স্মরণ করে ডেকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু রাজা হবার প্রখর বাস্তব বাল্য-কৈশোরের কোমল স্মৃতিগুলি নষ্ট করে দিল দ্রুপদের। কিন্তু দ্রোণ যেহেতু এতকাল ধরে অর্থোপার্জনের বাস্তবতার মধ্যে যাননি, তাই শৈশবের স্মৃতিই তিনি সার্থক প্রতিজ্ঞা বলে ধরে রেখে দিলেন। পরে আস্তে আস্তে যখন তার অর্থনৈতিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল, তখনও তিনি স্বাভিমানে কোনও পরাধীনতার বৃত্তি গ্রহণ করলেন না। অনেক আশা নিয়ে স্বাধীন একটি রাজ্যখণ্ড ভোগের ইচ্ছায় তিনি দ্রুপদের কাছে উপস্থিত হলেন এবং প্রত্যাখ্যাত হলেন।
দ্রুপদের অপমান দ্রোণ সইতে পারলেন না। তার সমস্ত কল্পনা ভেঙে গেল। এক বেলা খাওয়া তো দূরের কথা, সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্ত্রী-পুত্র সঙ্গে নিয়ে রাজসভা থেকে বেরিয়ে পড়লেন–এবমুক্ত ত্বহং তেন সদারঃ প্রস্থিতস্তদা। দ্রুপদের সামনেই তিনি প্রতিজ্ঞা করে গেলেন যে, ওই অপমানের তিনি উপযুক্ত প্রতিশোধ নেবেন। রাগে-দুঃখে জ্বলতে জ্বলতে দ্রোণ পাঞ্চাল নগর ছেড়ে হস্তিনাপুরের পথে রওনা দিলেন। একেবারে পাশের রাজ্য বলেই ভরতবংশীয়দের সঙ্গে পাঞ্চালের সুসম্পর্ক মোটেই ছিল না এবং একথা আমরা আগেই জানিয়েছি। পাঞ্চাল এবং ভরতবংশীয়রা পূর্ববর্তী একই বংশ থেকে জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু কালে কালে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ চলেছে। কখনও তারা জিতেছেন, কখনও এঁরা, কিন্তু বিরোধটা ছিলই। এই মুহূর্তে যেটা লক্ষণীয়, সেটা হল– কৃপাচার্যকে অন্য জায়গা থেকে তুলে এনে হস্তিনাপুরে ঠাই দিয়েছিলেন শান্তনু। তিনি পাঞ্চালবিরোধী হিসেবেই চিহ্নিত। আবার দ্রোণাচার্যও পাঞ্চালদের চরম বিরুদ্ধতার প্রতিজ্ঞা নিয়েই হস্তিনাপুরে এলেন এবং হয়তো এই পাঞ্চালবিরোধী মনোভাবই হস্তিনাপুরে তার অবস্থিতি সুস্থির করবে।
.
৯৯.
পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে দ্রোণ বেশ অপমানিত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে তিনি যতই সহনীয়তা দেখান, প্রাথমিকভাবে অর্থলোভই যে তাকে খুব তাড়িত করেছিল, সেটার ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। আরও একটা ঘটনা তাই প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল। মহর্ষি ভরদ্বাজ তখন স্বর্গত হয়েছেন। দ্রোণের বিবাহও তখন হয়ে গেছে, তার পুত্রও জন্মলাভ করেছেন। দ্রোণ তখন পিতার আশ্রমে থেকেই ধনুর্বেদ অভ্যাস করে যাচ্ছেন। এমনই একদিন তার কাছে খবর এসে পৌঁছল যে মহাত্মা পরশুরাম ব্রাহ্মণ-সজ্জনদের প্রচুর অর্থ দান করছেন।
পরশুরাম তখনকার দিনে ক্ষত্রিয়হন্তা মহাবীর হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীকে বারংবার নিঃক্ষত্রিয় করার জন্য ঐতিহাসিকরা পরশুরামকে ক্ষত্রিয়বিদ্বেষী এক ব্রাহ্মণবীর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পণ্ডিতেরা বলেন–ভারতীয় ইতিহাসের পরম্পরায় একটা সময় এসেছিল, যখন ক্ষত্রিয় রাজারা ব্রাহ্মণদের অধিকার এবং সামাজিক প্রতিপত্তি মেনে নিতে অস্বীকার করেন। মহাবীর পরশুরাম তখন ব্রাহ্মণদের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে আসেন এবং বিরুদ্ধবাদী ক্ষত্রিয়দের শাস্তিদাতা হিসেবে চিহ্নিত হন। আমাদের ধারণা– পরশুরাম একটা ইনস্টিটিউশনের মতো। নইলে রামচন্দ্রের সময়ের পরশুরামের সঙ্গে মহাভারতের পরশুরামকে মেলানো যায় না। বংশ বংশ ধরে পরশুরামরা ক্ষত্রিয়বীরদের শিক্ষাদাতা ব্রাহ্মণবীর হিসেবে পরিচিত হন। এমনই এক পরশুরাম নিজের ব্রাহ্মণ্য এবং বৃদ্ধ বয়সের নিষ্কামতায় নিজের সম্পত্তি সমস্তই বিলিয়ে দিচ্ছিলেন ব্রাহ্মণদের। দ্রোণাচার্যের কাছেও এই খবর পৌঁছল।
দ্রোণাচার্য দুদিক থেকে তার সুযোগের কথা চিন্তা করলেন। এক, বিজিত ক্ষত্রিয় রাজাদের কাছ থেকে পাওয়া পরশুরামের অগাধ সম্পত্তির কিছু অংশ তো পাওয়া যেতেই পারে। দুই, পরশুরামের মতো মহাবীর সেকালের দিনে দ্বিতীয় ছিল না। তার কাছে গেলে অসাধারণ কিছু অস্ত্রের সন্ধান জানা যেতে পারে। কাজেই ধনলোভ অথবা মহার্ঘ অস্ত্রের লোভ তাকে তাড়িত করল পরশুরামের কাছে যেতে–স রামস্য ধনুর্বেদং… দিসন্তং বসু সর্বশঃ। মহেন্দ্র পর্বতে পরশুরামের আবাস। দ্রোণাচার্য সেখানে গিয়ে দেখা করলেন পরশুরামের সঙ্গে। মহর্ষি ভরদ্বাজের বংশে জন্মের গৌরব থেকে আরম্ভ করে নিজের কুল–শীল সব তিনি জানালেন পরশুরামকে।
পরশুরাম তখন জগৎ-সংসারে অনেকটাই নির্বিঘ্ন, ব্রাহ্মণদের দান-ধ্যান করে তিনি তখন বনে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন–ততস্তং সর্বমুৎসৃজ্য বনং জিগমিং তদা। অর্থাৎ দ্রোণাচার্যের কাছে পরশুরামের ধনবিতরণের খবর পৌঁছেছে দেরিতে। কিন্তু দেরিতে হলেও দ্রোণাচার্য পরশুরামের কাছে এসে তার মনের ভাব লুকোননি। বলেছেন–মহাশয়! আমি মহর্ষি আঙ্গিরস ভরদ্বাজের পুত্র। আমি ধনলাভের আশায় আপনার কাছে এসেছি–আগতং বিত্তকামং মাং বিদ্ধি দ্রোণং দ্বিজোত্তম। পরশুরাম একটু লজ্জায়ই পড়লেন। তার ধন-বিতরণ প্রায় শেষ। দ্রোণ ভাবলেন, তবু যদি কিছু পাওয়া যায়। শেষ মানে কী একেবারেই শেষ, এত বড়ো একজন মানুষ বলে কথা। তাই সামান্য একটু কথা ঘুরিয়ে তিনি বললেন–আপনি সকলকে ধন-রত্ন বিতরণ করছেন। আমি সেইজন্যই এসেছি। আমার টাকা-পয়সা দরকার, অনেক টাকা পয়সা চাই আমি–অহং ধন অনন্তং প্রার্থয়ে বিপুল-ব্রত।
পরশুরাম এমন অকপটোক্তি শুনে ভীষণ বিব্রত হলেন। বললেন–সোনা-রুপোর তৈরি জিনিস বা আদত সোনা-রুপো আমার কাছে যা ছিল, তা সবই তো আমি ব্রাহ্মণদের কাছে বিলিয়ে দিয়েছি–হিরণ্যং মম যচ্চান্যবসু কিঞ্চিদিহ স্থিত। এই গ্রাম, নগর ভূমির মতো স্থাবর সম্পত্তি যা ছিল তার সবটাই দিয়ে দিয়েছি মহর্ষি কশ্যপকে। আর তো বাকি কিছু নেই। থাকবার মধ্যে আছে এই শরীরটা আর কিছু মহামূল্য অস্ত্র। তা এর মধ্যে যেটা তুমি চাও, বলল। আমি দেব–অস্ত্রাণি বা শরীরং বা ব্রহ্মন্ শস্ত্রাণি বা পুনঃ।
দ্রোণ দেখলেন–পরশুরামের শুষ্ক-শরীর দিয়ে আর কী হবে! বরঞ্চ তার চেয়ে দুষ্প্রাপ্য মহার্ঘ অস্ত্রশস্ত্রগুলির মূল্য অনেক বেশি। দ্রোণ বললেন–তাহলে ওই অস্ত্রগুলি সবটাই আমাকে দিন–অস্ত্রাণি যে সমগ্রাণি সসংহারাণি ভার্গব। অবশ্য ওই সব অস্ত্রের ক্ষেপণোপায় এবং অস্ত্র–সম্বরণের উপায়ও আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে। রাম জামদগ্ন্য রাজি হলেন। নিজের ক্ষত্রিয়ঘাতী অস্ত্রগুলি দ্রোণের হাতে তুলে দিয়ে সেগুলির ক্ষেপণ-সম্বরণের উপায়ও তিনি সযত্নে শিখিয়ে দিলেন দ্রোণকে।
পরমেপ্সিত ধন-সম্পত্তি না পেলেও পরশুরামের তৃণীর থেকে যে অসাধারণ অস্ত্রগুলি তিনি লাভ করলেন, তারও মূল্য কিছু কম নয়। সেগুলি তাকে ধনস্ফীত না করলেও ধনুর্বেদী হিসেবে তার অভিমান অনেকটাই বাড়িয়ে দিল। হয়তো এই অভিমান নিয়েই তিনি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে গিয়েছিলেন। লক্ষণীয়, পরশুরামের কাছে যখন ধন-সম্পত্তি কিছু মিলল না, তখন সেই উদ্দেশ্য সার্থক করার জন্যই তিনি পাঞ্চালে গিয়েছিলেন। ভাবটা এই–পরশুরামের অস্ত্রসম্ভার এখন করতলগত, এবারে দরকার এক খণ্ড রাজ্য। অতএব পরশুরামের অস্ত্র নিয়েই তিনি রওনা হলেন দ্রুপদের কাছে–পূর্বপ্রতিজ্ঞাত রাজ্যের আশায়–প্রতিগৃহ্য তু তৎ সর্বং…জগাম দ্রুপদং প্রতি।
আমরা জানি দ্রুপদের কাছে কী ব্যবহার পেয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। দ্রুপদ তার পূর্ব প্রতিজ্ঞা স্বীকার করলেন না বলেই তার প্রতিহিংসায় দ্রোণাচার্য এখন হস্তিনাপুরে উপস্থিত। টাকা-পয়সা তার চাই-ই, চাই ভূ-সম্পত্তি এবং ক্ষমতা। হস্তিনাপুরে এসে সঙ্গে সঙ্গেই তার ভূ-সম্পত্তি লাভ হল না বটে, কিন্তু পাঞ্চাল-বিরোধী রাজগোষ্ঠীতে নাম লিখিয়ে তিনি যে প্রথম সুবিধেটি পেলেন, তা হল–প্রয়োজনীয় অর্থ এবং ক্ষমতা। হয়তো পাঞ্চাল-বিরোধী বলেই ভীষ্মের সঙ্গে সার্বিক পরিচয়ের প্রথম কল্পে দ্রোণাচার্য বলেছিলেন–আমি আমার প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য উপযুক্ত শিষ্যের খোঁজে হস্তিনাপুরে এসেছি–অভ্যাগচ্ছং কুরূ ভীষ্ম শিষ্যৈরথী গুণান্বিতৈঃ। একই সঙ্গে আমি হয়তো আপনার অভিলাষও পূরণ করতে পারি। আর সত্যি এই হস্তিনাপুর জায়গাটাও আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। অতএব বলুন–কী করতে পারি আপনার জন্য–ইদং নাগপুরং রম্যং ব্রুহি কিং করবাণি তে।
অর্থাৎ দ্রোণাচার্য খুব ভালই জানেন যে, ভীষ্ম তার নাতিদের জন্য একজন উপযুক্ত অস্ত্রগুরু খুঁজে যাচ্ছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে দ্রোণের কাছে তার জীবনের সমস্ত কাহিনী এবং শেষমেশ দ্রুপদের প্রতি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কথা শুনেও যে ভীষ্ম তাকে বরণ করে নিলেন, তার কারণ একান্তই রাজনৈতিক এবং সেটা পাঞ্চাল-বিরোধের একাত্মতা। নইলে একটি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে ভীষ্ম তার সমমানের একটি বিরাট ব্যক্তিত্বকে এইভাবে প্রশ্রয় দিতেন না। অবশ্য কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার কারণটাও এখানে খুব কম নয়। ভীষ্মের সেই স্বার্থের সঙ্গে অন্য এক রাজনৈতিক স্বার্থও মিলে গেল। অন্যদিকে দ্রোণাচার্যের হাতে বিপুল অস্ত্র–সম্ভার থাকলেও এবং তিনি নিজে সেই অস্ত্রের যোজনা জানলেও তার হাতে কোনও সৈন্যবাহিনী ছিল না। কৌরব-পাণ্ডবদের সম্ভাবনাময় সমস্ত ছেলেগুলিকে তিনি যদি পান, তবে ধীরে ধীরে আপন লক্ষ্যে পৌঁছতে দ্রোণাচার্যের দেরি হবে না, সেটা তিনি আগেই বুঝেছিলেন।
দ্রোণাচার্যের মুখ থেকে তাঁর ইচ্ছা শোনা মাত্রই মহামতি ভীষ্ম তাকে কুরুরাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ প্রশ্রয় দিয়ে বলেছেন–আপনি আপাতত নিশ্চিন্ত আশ্রয় লাভ করতে পারেন এই কুরুরাষ্ট্রে। আপনার ধনুকের গুণখানি খুলে রাখুন আপাতত। কুরুবালকদের উপযুক্ত অস্ত্রশিক্ষার ভার গ্রহণ করুন আপনি–অপজং ক্রিয়তাং চাপং সাধ্বস্ত্রং প্রতিপাদয়। এখানে আপনার সম্মানের কোনও অভাব হবে না এবং কুরুরাষ্ট্রর যা বিত্ত আছে, ধন আছে, যে ভূমি আছে, সব এখন থেকে আপনার–কুরূণামস্তি যবিত্তং রাজ্যঞ্চেদং সরাষ্ট্রক। বলতে গেলে আজ থেকে আপনিই এ দেশের রাজা হলেন, কুরু-কুমাররাও সব আপনার ত্বমেব পরমমা রাজা সর্বে চ কুরবস্তব।
ভীষ্মের মুখে দানের যে আড়ম্বর শোনা গেল, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ভীষ্ম যেন সমগ্র কুরু–রাজ্যটাই দিয়ে দিলেন দ্রোণাচার্যকে এবং তিনিই যেন রাজা হলেন কুরুরাষ্ট্রের। আসলে এই কথাগুলির একটা ব্যবহারিক তাৎপর্য আছে। মহাভারতের মধ্যে বহু জায়গায় দেখা যাবে–সম্মানিত ব্রাহ্মণ মহর্ষিরা রাজগৃহে আগমন করলেই রাজা তাঁর রাজ্যটি তার পায়ে নিবেদন করছেন–রাজ্যং চাস্মৈ নবেদয়ৎ। একবার নয়, দুবার নয়, এটা একটা ফেনোমেনন। সর্বত্র রাজারা বিনীতভাবে আত্মনিবেদন করার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের রাজ্য নিবেদন করছেন ব্রাহ্মণদের কাছে। আসলে সেকালের সামাজিক স্থিতিতে ব্রাহ্মণ-মহর্ষিদের সম্পূর্ণ অধিকার মেনে নেবার মধ্যেই এই রীতির তাৎপর্য। এর মানে এই নয় যে, সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্রাহ্মণ মহর্ষি রাজা হয়ে বসতেন আত্মনিবেদিত রাজার রাজ্যে। এটা রীতিমাত্র–রাজা সবটাই দিতেন, ব্রাহ্মণ নিতেন না। ঠাকুর সোজাসুজি ভক্তের দেওয়া অন্নপান খেয়ে ফেলেন না বলেই হয়তো এত দেওয়ার ধুম। তবে এই দানাদানের মধ্যে একটাই ইঙ্গিত আছে, তা হল–এ রাজ্যে আপনি যখন পদধূলি দিয়েছেন, তো আপনার উপযুক্ত ভোগ-সুখের কোনও অসুবিধে হবে না। খাওয়া-দাওয়া, পরিধান থেকে আরম্ভ করে যা প্রয়োজন সব পাওয়া যাবে। ভীষ্মের বক্তব্য–এ রাজ্য আপনার, আপনিই রাজা–মানে এ রাজ্যের সমস্ত ভোগসুখ আপনার ইচ্ছামাত্রেই পাবেন। টীকাকার নীলকণ্ঠের ভাষায়–ত্বদূভোগ্যং মম রাজ্যমিতি সঙ্কেতম্।
একশো ভাই কৌরব আর পাঁচ ভাই পাণ্ডব নাতিদের এক জায়গায় জড় করে ভীষ্ম একটু বাদেই এলেন দ্রোণাচার্যের কাছে। থলিতে করে স্বর্ণমুদ্রা আর বিবিধ রত্ন এনে নজরানা দিলেন দ্রোণাচার্যের পায়ে–পৌত্রানাদায় তা সর্বান বস্তুনি বিবিধানি চ। ভীষ্ম এত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে এত তাড়াতাড়ি তাকে গুরুবরণ করবেন–এ কথা দ্রোণাচার্য নিজেও ভাবেননি। যে কৃপাচার্য এতদিন ধরে এঁদের অস্ত্র-শিক্ষা দিচ্ছেন, সেই কৃপাচার্য তার শ্যালক। তারই বাড়িতে পুত্র–পরিবার নিয়ে তিনি এসে উঠেছেন। এখন তার মাথার ওপর বসে তার চাকরিটি খেয়ে নেবেন–দ্রোণাচার্যের একটু সঙ্কোচ হল। ভীষ্মকে তিনি বললেন–কৃপাচার্য আগেই আপনার নাতিদের অস্ত্রগুরু হিসাবে বৃত হয়েছেন। তিনি শাস্ত্রজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তার অজ্ঞাতসারে কুমারদের যদি আমার হাতে তুলে দেন তবে কৃপাচার্য অসন্তুষ্ট হবেন বলেই মনে হয়–ময়ি তিষ্ঠতি চেদ বিপজা বৈমনস্যং গমিষ্যতি। কাজেই আমি যা বলছিলাম–কিছু টাকা-পয়সা আমার দরকার ছিল, সেগুলো নিয়ে আমি আবার শান্তিতে আশ্রয়ে ফিরে যাই।
ভীষ্ম এতদিনের অভিজ্ঞ ব্যক্তি। সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে তিনি এও জানেন যে, কার হাতে ছেলেদের দিলে সবচেয়ে ভাল শিক্ষা পাবে। ভীষ্ম তাই সহাস্যে বললেন–আরে কৃপাচার্য তো আমাদের আছেনই। তাকে আমরা যে সম্মান এতকাল দিয়ে আসছি তাই দেব। তাকে যেমন পিতার আমল থেকে ভরণ করে আসছি, তেমনই ভরণ–পোষণ করব–কৃপস্তিষ্ঠতু পূজ্যশ্চ ভর্তব্যশ্চ ময়া সদা–তিনি তো আছেনই। কিন্তু আপনিও থাকুন এবং আপনাকেই এই কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার ভার নিতে হবে। কেন না আমার মতে আপনিই এত ছেলেদের উপযুক্ত শিক্ষক হতে পারেন–ত্বং গুরু র্ভব পৌত্রাণা আচার্যত্ত্ব মতো মম।
ভীষ্মের উপরোধ দ্রোণাচার্য আর এড়াতে পারলেন না এবং এড়ানোর কোনও ইচ্ছাও তার। ছিল না। এতটা বয়স পর্যন্ত পুত্র-পরিবার নিয়ে অনেক লড়াই করেছেন দারিদ্রের সঙ্গে। আজ যখন হস্তিনাপুরের রাজ-সম্মান হাতের মুঠোয় এসে পৌঁছেছে, তখন সেটাকে ছেড়ে দেবার বিলাসিতা তিনি দেখাতে পারেন না। দ্রোণ পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্রগুরু হবার দায়িত্ব স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলি শিষ্যের সঙ্গে প্রথম অর্থোপার্জনও সম্পন্ন হল। দ্রোণকে কুরু-রাজপ্রাসাদের একান্তে একটি সুন্দর বাড়ি দেওয়া হল। সে বাড়িতে রইল গোলা ভরা ধান আর দৈনন্দিন খরচ চালানোর মতো অর্থসম্পদ–গৃহঞ্চ সুপরিচ্ছন্নং ধনধান্য–সমাকুলম্। দ্রোণ পুত্র-পরিবার নিয়ে নতুন বাড়িতে আস্তানা গাড়লেন। পরদিনই কৌরব-পাণ্ডবরা সব ভাই একত্রে মিলে দ্রোণাচার্যের কাছে উপস্থিত হলেন অস্ত্রশিক্ষার জন্য।
দ্রোণাচার্য সানন্দে শিষ্যদের গ্রহণ করলেন এবং তাদের সকলকে বললেন–তোমাদের সঙ্গে একটা গোপন কথা আছে আমার। সমস্ত কৌরব-পাণ্ডব ভাইদের একটা নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে দ্রোণাচার্য বললেন–ছেলেরা সব! আমার একটা কথা তোমাদের রাখতে হবে। আমি তোমাদের অস্ত্রশিক্ষা দেব নিশ্চয়। কিন্তু আমার মনে একটা অভিলাষ আছে–কাৰ্য্যং মে কাঙ্ক্ষিতং কিঞ্চি হৃদি সম্পরিবর্ততে। তোমাদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পর আমার সেই অভীষ্ট কাজটুকু তোমাদের করে দিতে হবে।
কৈশোরগন্ধী বালকেরা গুরুর কথা শুনে একে অপরের মুখ চাওয়া-চায়ি করল। গুরু দ্রোণ ঠিক কী চাইছেন, কেন চাইছেন–এসব কথা তাদের হৃদয়ে তেমন করে সাড়া জাগাল না। কিন্তু সমস্ত বালকের মধ্যে একজন, যে কারও দিকে তাকাল না, কারও সঙ্গে পরামর্শ করল না। শুধুমাত্র গুরু বলেছেন, অতএব করতে হবে–এই বিচারে সে চরম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল–আপনি যা বলবেন, যা চাইবেন, তাই আপনাকে দেব–অর্জুনস্তু ততঃ সর্বং প্রতিজজ্ঞে পরন্তপঃ। এই বালক অর্জুন। বড় খুশি হলেন দ্রোণাচার্য। এমন নির্বিচারে কেউ তাকে এইভাবে বিশ্বাস করেনি। শিষ্যের মহত্ত্ব দেখে তিনি একদিকে যেমন খুশি হলেন, তেমনি একই সঙ্গে চিনে নিলেন তাঁকে–এ ছেলে অন্য সবার থেকে আলাদা। এখনও যে কোনও অস্ত্রশিক্ষাই পায়নি, কিন্তু শিক্ষালাভের পূর্বে যে প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন হয়, সেই আত্মবিশ্বাসেই সে ভবিষ্যৎকে এখনই জয় করে নিয়েছে। দ্রোণাচার্য বড় খুশি হলেন।
আমরা একে শুধু আত্মবিশ্বাস বলি না, আত্মসমর্পণও বলি। শিক্ষা এবং দীক্ষার আরম্ভেই গুরুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। নইলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। এই আত্মসমর্পণ শিষ্যকে দুর্বল করে না, তার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, যার ফলে অর্জুনের মতো বলা যায়–আপনি যা চান, তাই পাবেন। আরও একটা কথা–আমাদের শাস্ত্রে গুরু-শিষ্যের পরিচয়ে দুজনেরই দুজনকে পরীক্ষা করে নেবার কথা বলা আছে। মনে রাখবেন–শিষ্যদের কাছে দ্রোণাচার্য আগে সেই পরীক্ষা দিয়েছেন–কৃপের মধ্য থেকে বালকদের ক্রীড়নক–গুলিকা তুলে এনে, নিজের আংটি ফেলে দিয়ে এবং তুলে এনে। এইভাবে তিনি তাঁর শিষ্যদের কাছে পরীক্ষা দিয়েছেন এবং তাদের বিশ্বাস উৎপাদন করেছেন। অনুরূপভাবে শিষ্যদেরও দায় থেকে যায় গুরুর বিশ্বাস উৎপাদন করার। দ্রোণাচার্য সবাইকে একসঙ্গে ডেকে তার অভিলাষ জানিয়েছেন। কিন্তু কেউ তার বাসনাপূরণ করতে সাহসী হয়নি। সকলে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল–তচ্যুত্ব কৌরবেয়াস্তে তৃষ্ণীমাসন্ বিশাম্পতে। কিন্তু একা অর্জুন সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে নির্বিচারে গুরুকে জানিয়েছেন–আমি পারব, আপনি যা চাইবেন, তাই আমি দেব।
দ্রোণাচার্য বড় খুশি হয়েছেন। খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরেছেন অর্জুনকে, বারবার তার মস্তক আঘ্রাণ করেছেন সস্নেহে, আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের আশায় আনন্দাশ্রু মোচন করেছেন–প্রীতিপূর্বং পরিজ্য প্ররুরোদ মুদা তদা। প্রথমেই এই যথার্থ শিষ্যের সঙ্গে আত্মবন্ধন বাড়ানোর জন্য দ্রোণাচার্য তাঁর ছেলে অশ্বত্থামাকে ডেকে এনে অর্জুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন–এই অর্জুনকে তুমি তোমার সখা বলে জানবে, বৎস। এই সুযোগে তোমাকে একটা ভাল বন্ধু দিলাম, মনে রেখো–সখায়ং বিদ্ধি তে পার্থং ময়া দত্তঃ প্রগৃহ্যতাম।
প্রাচীন সামাজিক আচারে গুরু যদি নিজের পুত্রটিকে শিষ্যের সখা বলেও চিহ্নিত করেন, তবু তার সামাজিক মূল্য ছিল অন্যরকম। গুরুপুত্রেরা সকলেই গুরুবৎ মান্য ছিলেন। বয়সে ছোট হলেও তাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হত। আত্মসমর্পণের এও এক ধারা। অর্জুন সেই প্রথম বয়সেই এতটা পরিণত যে, দ্রোণাচার্যের উচ্চারিত সখা শব্দটির সম্মান রেখেও নিজের আচারটুকুও ঠিক ঠিক পালন করলেন। অর্জুন প্রথমে সম-বয়সের চেতনায় আলিঙ্গন করলেন গুরুপুত্র অশ্বত্থামাকে। তারপরেই বললেন–আজ থেকে আমি তোমার অধীন হলাম, ভাই। কেন না শাস্ত্রের নিয়মই তাই–পরবানস্মি ধর্মতঃ। আজ থেকে আমি শুধু দ্রোণাচার্যেরই শিষ্য নই তোমারও শিষ্য। কথাটা বলেই অর্জুন সেকালের সামাজিক সংস্কার অনুযায়ী ব্রাহ্মণ গুরুপুত্রের চরণ-বন্দনা করলেন পায়ে হাত দিয়ে–ইত্মা তু তদা পার্থঃ পাদৌ জগ্রাহ পাণ্ডবঃ।
দ্রোণাচার্যের অস্ত্র-পাঠশালা আরম্ভ হয়ে গেল পুরো দমে। এখন আর তার কোনও অভাব নেই। অর্থাভাব, খাদ্যাভাব, এমনকি প্রতিপত্তিরও অভাব নেই কোনও। কুরুবাড়ির রাজকুমারেরা তাঁর শিষ্য। তিনি রাজগুরু। অর্থাভাব নেই বলেই তার পূর্ববর্তী লোভও এখন অনেক প্রশমিত। কিন্তু এখনও তিনি শুধু পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের সেই অপমানটুকু মনে রেখে দিয়েছেন মর্যাদার শেষ সোপান হিসেবে।
উপযুক্ত দিন দেখে দ্রোণাচার্য সমস্ত কুমারদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন। শিক্ষা আরম্ভ হল। অস্ত্রগুরু হিসেবে দ্রোণাচায়ের হাত এতটাই ভাল ছিল যে, তাঁর বিদ্যাবত্তা এবং শিক্ষাদানের শৈলী চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। খবর পেয়ে যাদব-রাজ্য শূরসেন–মথুরা থেকে বৃষ্ণি-অন্ধককুলের বালকেরা এবং আরও অন্যান্য জায়গা থেকেও শিক্ষাকাম বালকেরা দ্রোণাচার্যের শিক্ষাশ্রমে এসে শিক্ষা আরম্ভ করল। দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষা নিতে আরম্ভ করলেন অধিরথি কর্ণ। তিনি ধৃতরাষ্ট্রের সখা-সুহৃৎ অধিরথের বাড়িতেই মানুষ হচ্ছিলেন এবং কুরুবাড়িতে দ্রোণাচার্যের পাঠশালা খুলেছে দেখে তারও সেখানে যোগ দিতে দেরি হল না। অর্জুন যেহেতু প্রথম থেকেই দ্রোণাচার্যের সামান্য পক্ষপাত লাভ করেছিলেন, অতএব কর্ণ সেটা সহ্য করতে পারলেন না। অর্জুনের সঙ্গে তাঁর প্রতিযোগিতার আরম্ভ এইখান থেকেই–স্পর্ধমানস্তু পার্থেন–এবং এই সূত্রেই কুমার দুর্যোধনের সঙ্গে তার প্রথম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
দুর্যোধন পাণ্ডবদের দেখতে পারেন না জ্ঞাতিশত্রুতার কারণে আর কর্ণ অর্জুনকে দেখতে পারেন না অস্ত্রবিদ্যায় তিনি কর্ণের সমান পারদর্শী বলে। কিন্তু দুজনের বিরোধিতার গতি-প্রকৃতি আলাদা হলেও দুর্যোধন-কর্ণের বন্ধুত্ব হল বিরোধের একাত্মতায়। দুর্যোধনের সুবিধা হল–তাকে এখন আর নিজে পাণ্ডবদের অপমান করতে হয় না, তার কটুকথা বলার সাধটি তিনি পুরিয়ে নেন কর্ণকে দিয়ে। কর্ণই পাণ্ডবদের অপমান করেন এবং দুর্যোধন সেটা উপভোগ করেন–দুর্যোধনং সমাশ্ৰিত্য সোবমন্যত পাণ্ডবান্। যাঁরা ভাবেন সেই অস্ত্র পরীক্ষার রঙ্গমঞ্চে অর্জুনের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে কর্ণের অপমান হল আর দুর্যোধন তাঁকে অঙ্গরাজ্যের রাজমুকুট পরিয়ে দিয়ে তার অকৃত্রিম বন্ধু হলেন, তারা জানবেন–দুর্যোধন কর্ণের বন্ধুত্ব শুরু হয় দ্রোণাচার্যের আখড়া থেকেই।
যদি বলেন–এই তো অন্যায় আরম্ভ হল। দ্রোণ আচার্য বলে কথা। তিনি অর্জুনের প্রতি অযথা পক্ষপাতিত্ব করবেন কেন? তিনি গুরু, সমদর্শিতাই তার প্রধান গুণ হওয়া উচিত। মানি, একথা খুব মানি। দীর্ঘকাল ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে এবং তার চেয়েও বেশি সময় আমার পরম পূজ্য শিক্ষকদের দেখে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সমদর্শিতা যে কোনও শিক্ষক বা গুরুর পক্ষে নিতান্তই বড় গুণ এবং নীতিগতভাবে আমরা শিক্ষকরা সকলেই তা মেনে নিই। কিন্তু একই বিদ্যালয়ে বা একই শিক্ষাস্থলে সকলের মধ্যে যদি অতি-মেধাবী ছাত্র একটি থাকে তবে সেই ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের পক্ষপাতিত্ব তৈরি হতে বাধ্য। আর যদি তা না হয়, তবে বুঝতে হবে যে, তিনি শঙ্করাচার্যের ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যার তত্ত্বে সম্পূর্ণ সমাধি লাভ করেছেন। ঠিক এই কারণেই, বিশেষত এই পক্ষপাতের কথা একবার মাত্র উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মহাভারতের কবিকে তাই পরিষ্কার করে বলতে হয়েছে–শিক্ষা, বাহুবল, উদ্যোগ, পরিশ্রম এবং অস্ত্রবিদ্যার প্রতি অত্যন্ত অনুরাগ থাকায় অর্জুনই কিন্তু দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় সবার মধ্যে সবচেয়ে ভাল ছেলে হয়ে উঠলেন–অস্ত্রবিদ্যানুরাগাচ্চ বিশিষ্টোভবদৰ্জুনঃ।
পক্ষপাতটা কীভাবে তৈরি হল? মহাভারতের কবিকে বাড়তি শ্লোক লিখতে হচ্ছে। সকলেই একই অস্ত্রের অনুশীলন করছে, দ্রোণাচার্যও তাঁদের সবাইকে একই অস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছেন–তুল্যেম্বস্ত্র-প্রয়োগেযু। কিন্তু তারই মধ্যে হাতের ক্ষিপ্রতা, হাতের কৌশল–এগুলিই চরম অভ্যাসবশে, এমনভাবেই অর্জুনের মাথায় আসতে লাগল, যে সকলের মধ্যে অর্জুন আপনিই প্রধান হয়ে পড়লেন–সর্বেষামেব শিষ্যাণাং বভূবাভ্যধিকোজুনঃ। দ্রোণ বুঝলেন– এ ছেলে সাধারণ নয়, এ সবার থেকে আলাদা। একই বিদ্যা সকলকে একইভাবে দেওয়া সত্ত্বেও যে চরম অভ্যাসে অর্জুন সেটাকে করতলগত করেছেন–সেটা দেখেই দ্রোণাচার্যের পক্ষপাত তৈরি হল। তিনি বুঝলেন–এ সবার থেকে আলাদা–ঐন্দ্রিম্ অপ্রতিমং দ্রোণ উপদেশমন্যত।
.