৮ ২৩৫টি ধর্ষণ, ৮৩টি আত্মহত্যা, ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
২৩৫টি ধর্ষণ, ১৫০টি খুন, ৯৭টি বাস দুর্ঘটনা, ৮৩টি আত্মহত্যা, ১২২টি স্ত্রীহত্যা, ৬৫টি নৌকোডুবি, ৫০৫০টি ডাকাতি, পুলিশ ১২ কোটি, মাস্তানরা ১০ কোটি, আমলারা ১৫ কোটি, ব্যাংক থেকে শিল্পপতিরা ১০৫ কোটি, সেনাপতিরা ২২ কোটি, মন্ত্রীরা ২৫ কোটি, রাজনীতিকরা ২৭ কোটি, উদ্দিন মোহাম্মদ ও তার পত্নী ও উপপত্নীরা ৩৫ কোটি, রাস্তার ভিখিরিটা ১ টাকাও না, রিকশাঅলাটা ১ টাকাও না, আমি ১ টাকাও না-আজকের বাঙলাদেশে-দাড়ি কামাতে কামাতে মনে মনে জাতীয় হিশেব করছিলো রাশেদ, এমন হিশেব করতে করতে দাড়ি কামালে সে দাড়ি কামানোর বিচ্ছিরি ব্যাপারটাকে ভুলে থাকতে পারে, তখন বুঝতে পারলো চারপাশে বা একেবারেই পাশে একটা ঘটনা ঘটেছে। গাড়ির পর গাড়ি আসছে, সামনের রাস্তা ভরে গেছে পাজেরো জিপ টয়োটা বেবি আর যা যা আছে সে-সবে, সবাই পাশের বাসায় উঠছে নেমেও আসছে, বেশ কয়েকটা পুলিশও দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। পুলিশগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করছে নিজেদের, কিন্তু মাঝেমাঝে সামাল দিতে গিয়ে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে, তখন কালোবস্তুটা মুখের সামনে নিয়ে চিৎকার করছে। রাশেদের মনে পড়লো পাশের বাসার কাজের মেয়েটি, মাসখানেক ধরে, মাঝরাতে আর হঠাৎ চিৎকার করে উঠছে না, ওর রোগটা হয়তো সেরে গেছে, বা হয়তো এখন চিৎকারের বদলে মাঝরাতে খিলখিল করে হাসে। হাসি এক বাসা পেরিয়ে আরেক বাসায় আসার কথা নয়, হাসি হৃদয়ের অন্তরঙ্গ সম্পদ, জড়িয়ে জড়িয়ে থাকে; চিৎকারই দূরে যায় হাসি যায় না। কয়েক দিনের মধ্যে মেয়েটিকে দেখেছে বলে তার মনে পড়ছে না, বা একদিন দেখেছে, মুখটি বেশ ভরাট আর শরীরটি আরো ভরাট হয়ে উঠেছে, ভরাট বালিকা দেখলে রাশেদের গ্রামকে মনে পড়ে, সুযোগ পেলে সিনেমায় নেমে এমএ পাশ ধুমশিগুলোকে সে দেখিয়ে দিতে পারতো, এ-সময়ের মহান শিল্পটাকে উল্টেপাল্টে দিতে পারতো; বেগম মজুমদারকেও দেখা যাচ্ছে না, তিনি হয়তো কাবার আলো’ নিয়ে ব্যস্ত আছেন; মহৎ একখানা বই লিখছেন মহীয়সী মহিলা, এমন একখানা কেতাবের খুব দরকার ছিলো মুসলমানের, ইসলামি সাহিত্যের অমর উদাহরণ হয়ে থাকবে বইখানি। তবে তিনি ইসলামকে একটুখানি অমান্য করছেন, লেখাটির সাথে তিনি নিজের নাম ছাপছেন, এটা ইসলামসম্মত হচ্ছে না; কয়েক দিন আগে রাশেদ একখানা ইসলামি বই পড়েছে, পাতায় পাতায় মারহাবা করতে ইচ্ছে হয়েছে, তাতে হজরত মাওলানা সাব লিখেছেন নারীদের বই লেখা উচিত নয়, তাতে পর্দা নষ্ট হয়, আর লিখলেও তাতে নিজের নাম দেয়া পাপ, কেননা তাতে পরপুরুষের সাথে সম্পর্ক হয়, যা জেনার সমান। তবে বেগম মজুমদারের বইখানি পড়লে ওই হজরত মাওলানা সাব পাগল হয়ে যাবেন; বইখানি বেরোলে রাশেদ কিনে সোনার পানি দিয়ে বাধিয়ে রাখবে, পৌত্রপৌত্রীরা পড়বে, তখন হয়তো অন্যান্য বই পড়া নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। স্নানাগার থেকে বেরিয়েই রাশেদ শুনলো পাশের বাসার কাজের মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে; একটুও চমকালো না সে, কাজের মেয়েদের মুখ বুক শরীর ভরাট ভরাট হয়ে উঠলে তো তারা আত্মহত্যা। করবেই। এটা সভ্যদের কাজ, সভ্যরাই আত্মহত্যা করে; কাজের মেয়েগুলো যেমন সভ্য হয়ে উঠছে আজকাল, তাদের সাংস্কৃতিক মান যেমন উন্নত হচ্ছে, শহরে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের শরীর যেমন ভরাট হয়ে উঠছে, তাতে আত্মহত্যার সভ্য কাজটি অনতিবিলম্বে সম্পন্ন করা অবধারিত হয়ে উঠছে তাদের জন্যে। কোন পাড়াগা থেকে একটা অসভ্য মেয়ে এসেছিলো, এসেই সভ্য হচ্ছিলো, মাঝরাতে শুধু একবার হঠাৎ অসভ্য চিৎকার করে উঠছিলো, এখন সে সভ্যতার পরিণতি হয়ে উঠেছে। রাশেদ। পাটখেতের গন্ধ পাচ্ছে, বড়ো একটা পাটখেত মনে হচ্ছে শহরটাকে, একটি কিশোরী যাচ্ছে পাটখেতের ভেতর দিয়ে, টয়োটা পাজেরো শীততাপনিয়ন্ত্রণ থেকে কাস্তে হাতে নেমে আসছে নৃশংস কৃষকেরা, লাশ পড়ে থাকছে খেতের ভেতরে, উরুতে জমে থাকছে চাক চাক রক্ত।
রাশেদকে পাশের বাসায় যেতে হবে, মমতাজ বারবার বলছে গিয়ে দেখে আসতে, যদিও তার যাওয়ার ইচ্ছে করছে না; তবে মজুমদার সাহেব ও বেগম মজুমদারকে সহানুভূতি জানানো দরকার, প্রতিবেশীর প্রতি প্রতিবেশীর অন্তত এটুকু দ্ৰ দায়িত্ববোধ থাকা উচিত, আর সে না গেলে কেউ কেউ তা খেয়াল করতে পারে, গোপনে হলেও মনে করতে পারে মেয়েটির আত্মহত্যায় তার একটা সংগোপন ভূমিকা রয়েছে। তার বরং ইচ্ছে করছে, মমতাজকে আর পৃথিবীর সবাইকে না জানিয়ে, চোখ বন্ধ করে মেয়েটির মুখ একবার দেখতে। কিন্তু তাকে যেতে হবে, অপরাধীর মতো রাশেদ পাশের বাসায় গিয়ে ঢুকলো; এটা তার এক বড়ো সমস্যা, কোন পরিস্থিতিতে কেমনভাবে যেতে হয় তা সে বুঝে উঠতে পারে না, ভাবলো অপরাধীর মতো যাওয়াই উচিত হবে; কিন্তু কাউকেই অপরাধী মনে হচ্ছে না, কেউ তো অপরাধ করে নি, যে অপরাধ করেছে সে। অপরাধের ফল পেয়েছে, বারান্দায় লাশ হয়ে পড়ে আছে। তাকে দেখা যাচ্ছে না, কাপড়ে ঢাকা পড়ে আছে সে; রাশেদের একবার দেখার ইচ্ছে হলো, কিন্তু বুঝতে পারলো দেখতে চাওয়া ঠিক হবে না, কেউ দেখতে চাইছে না। বেগম মজুমদার আজ আরো বিস্তৃতভাবে বোরখা পরেছেন, নাকের নিচে তার গোঁফের রেখাঁটি স্পষ্ট দেখা। যাচ্ছে, তিনি ছোটো একটি বই হাতে গুনগুন করে দোয়াকলমা পড়ছেন, তাকে ঘিরে আছে শোকের পাকপবিত্র আবহাওয়া; মজুমদার সাহেবকে উদ্বিগ্ন দেখালেও তার হাসিটাকে পবিত্রই দেখাচ্ছে। তিনি আজ দাড়িটা মসৃণ করে ছাঁটার সময় পান নি, পেলে আরো পবিত্র দেখাতো। পুলিশ আর পাড়ার যুবরাজরা মেয়েটির লাশ কোথায় যেনো নিয়ে যাচ্ছে, হয়তো থানায় বা অন্য কোথাও; সে আত্মহত্যা করেছে, তাকে তো এসব জায়গায় যেতেই হবে। সে আর এ-বাসায় ফিরে আসবে না, তাকে আর বারান্দায় দেখা যাবে না, সে আর মাঝরাতে হঠাৎ একবার চিৎকার করে উঠবে না। তার রোগটাকে গত রাতে সে সারিয়ে ফেলেছে।
মমতাজ বিশ্বাস করছে না, পাড়ার লোকেরাও তার মতোই গোপনে গোপনে বিশ্বাস করছে না আত্মহত্যাটিকে, যেমন তারা কিছুই বিশ্বাস করছে না আজকাল যদিও তারা পাগল হয়ে উঠছে বিশ্বাস করার জন্যে; মেয়েটির পেট ফেড়ে একটা ছোট্ট বাচ্চাও পাওয়া গেছে-এমন কথাও রটছে। কিন্তু বাচ্চাটা কি প্রমাণ করে যে মেয়েটি আত্মহত্যা করে নি? বাচ্চাটা বড়োজোর প্রমাণ করে এটি একটি বাচ্চা, বা আরো কয়েক সপ্তাহ গেলে বাচ্চা হতে পারতো, এখনো ওটি এক টুকরো তুচ্ছ বস্তুই, যা মেয়েদের জরায়ুতে কখনো কখনো দেখা দেয়। ওই বস্তুটি অবশ্য প্রমাণ করছে যে মেয়েটির পেটে ওটির। আবির্ভাবের পেছনে একটা পবিত্রভূতের ভূমিকা ছিলো; হয়তো তাও করছে না, এমনও হতে পারে আজকাল নিজেদের আঙুলের ঘর্ষণেই কাজের মেয়েদের জরায়ুতে এসব বস্তু দেখা দিচ্ছে। মেয়েটি ফাঁসি দিয়ে মরেছে, দড়িটা বেশ উৎকৃষ্ট, ছিঁড়ে পড়ে নি, ভোরে নামাজ পড়তে উঠে বেগম মজুমদার দেখেন মেয়েটি বারান্দায় ঝুলছে। পুলিশ শুরুতে অন্য কথা বলার চেষ্টা করেছিলো, পুলিশের মতো কথা বলার চেষ্টা পুলিশ করবেই, কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেছে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। প্রমাণ না হয়ে উপায় নেই, সকালে বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়ির যে-ভিড় হয়েছে তাতেই প্রমাণ হয়ে গেছে কাজের মেয়েটি নিশ্চিতভাবে আত্মহত্যা করেছে। মজুমদার সাহেবের ড্রয়িংরুম আর বারান্দা ভরে আছে প্রমাণে; সেখানে হাঁটছে, বসে আছে, কথা বলছে উদ্দিন মোহাম্মদের দুটি মন্ত্রী, আর পাঁচ-সাতটি দলের গোটা বিশেক নেতা, যাদের কেউ মুক্তিযুদ্ধ করছে এখনো, কেউ আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউ গণতন্ত্র ও গণমানুষ ছাড়া কিছু বোঝে না, এবং পাঁচজন রয়েছে, যারা মুক্তিযুদ্ধটুদ্ধ স্বাধীনতাটাধীনতায় বিশ্বাস করে না, একটা পাকস্থান বানানোর জন্যে লড়াই করে চলছে। পাড়ার যুবরাজরা রয়েছে ঘরবাড়ি ভ’রেই, মজুমদার সাহেবকে সহানুভূতি জানাচ্ছে তারা আন্তরিকভাবে; মজুমদার সাহেবকে থানায় যেতে হবে না, তবে ব্যাংকে যেতে হবে, যদিও তিনি নিশ্চয়ই যাবেন না, যুবরাজদেরই কেউ যাবে। বাড়িটি হয়ে উঠেছে এক বহুদলীয় সমাবেশস্থল; রাশেদ মনে করতো এরা মুখ দেখে না পরস্পরের, এখন মনে হচ্ছে পরস্পরের মুখ না দেখে এরা। থাকতে পারে না, মেয়েটি আত্মহত্যা করে ভোরবেলা এদের কাছাকাছি আসার ব্যবস্থা করেছে বলে মেয়েটির কাছে এরা যেনো কৃতজ্ঞ। মেয়েটি আত্মহত্যা না করলে আজ ভোরে মজুমদার সাহেবের বাসায় আসা হতো না রাশেদের, কয়েক বছর পাশাপাশি থেকেও আসা হয় নি; মেয়েটি ম’রে আজ ভোরবেলা রাশেদের হাতে জ্ঞানের অনেকগুলো নুড়ি তুলে দিয়েছে; বুঝিয়ে দিচ্ছে সে আর তার মতো সাধারণ মানুষের বিশ্বাসগুলো খুবই হাস্যকর, নেতারা কাজ করে নেতাদের মতে, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অনুসারে করে না, করলে তারা নেতা হতে পারতো না।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বহু দিন পর দেখা হলো সেলিমার সাথে; রাশেদ তাকে প্রথম চিনতেই পারে নি, কাজের মেয়েটির কথা ভাবছিলো বলে বা মজুমদার সাহেবের বাসায় অভোগুলো নেতা দেখেছে বলে নয়, যখন চিনতে পারলো তখন একটা ধাক্কা খেলো। সেলিমাকে দেখা আনন্দের ব্যাপার ছিলো, সে নিজেও বুঝতো সেটা, ব্যবহারও করতো; বাহু একটু বেশি দেখাতো, ওর বাহু সুন্দর ছিলো, যদিও বুক দেখাতো না, ব্লাউজের নিচপ্রান্তের নিচের ঢেউগুলো তার সুন্দর দেখাতো। তার চেয়ে সুন্দর ছিলো। তার প্রগতিশীলতা, সমাজতন্ত্র আর মুক্তিযুদ্ধের কথা তার লাল ঠোঁট থেকে যখন ঝরতো চারপাশ রঙিন হয়ে উঠতো। সে পদার্থবিজ্ঞান পড়াতো, তারপর মার্কিনদেশে চলে যায়, অনেক বছর তার খবর রাখে নি রাশেদ। সেই সেলিমা দেশে ফিরেছে, ডক্টরেট করেছে, পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছে, হয়তো ক্লাশে গিয়ে আর পড়াচ্ছে না; সেলিমা এখন আপাদমস্তক কালো বোরখায় নিজেকে ঢেকেছে, গলায় কারুকাজকরা চাদর ঝুলিয়েছে, কথায় কথায় ইনশাল্লা আলহামদুলিল্লা বলছে, মওলানা সাহেব মনে হচ্ছে তাকে। তার মুখোমুখি বসতে কেমন কেমন লাগছে রাশেদের, বমি এসে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। ডক্টরেট করে সে মার্কিনদেশে থাকে নি, টাকাপয়সা সেও চেনে, সেখান থেকে পড়াতে চলে গিয়েছিলো রিয়াদে, পাঁচবার হজ করেছে, খুব পরহেজগার স্ত্রীলোক হয়ে ফিরে এসেছে, কেউ দোজখের দ্বারে এখন দাঁড়ালে সেখানে স্ত্রীলোকের সংখ্যা একটি কমেছে দেখতে পাবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়টি একটি পরহেজগার স্ত্রীলোক পেয়ে ধন্য বোধ করছে, বিজ্ঞানের দরকার নেই, পরহেজগার স্ত্রীলোকই বেশি দরকার, যতো বেশি উৎপাদন হয় ততোই মঙ্গল। মার্কিনদেশে সেলিমার কোনো প্রেমকামিক ছিলো না, রাশেদের মনে প্রশ্ন জাগে, মার্কিন প্রেমকামিক? বাঙালি মেয়েরা বিদেশে গিয়ে বিদেশি প্রেমকামিকই পছন্দ করে, পুলকের পরিমাণ বেশি হয়, দেশি ছোঁকরাগুলো বেশিক্ষণ পারে না; আর দেশে ফেরার পর কোনো কেলেঙ্কারিও হয় না। রিয়াদে যাওয়ার আগে দেশে এসেছিলো সেলিমা বিবি হওয়ার জন্যে; গিয়ে পরহেজগার হয়ে ফিরেছে, বেহেশতে একটা স্ত্রীলোকের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বেড়েছে, তবে বেহেশতে স্ত্রীলোকের জায়গাটা কোথায় রাশেদ এখনো ঠিক করে উঠতে পারে নি। কিন্তু প্রগতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যার কথা সেলিমা উঁচু গলায় বলতো? তার সারা শরীর ঢেকে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, আর ভেতরটাও নিশ্চয়ই ওই চেতনায় পরিপূর্ণ। রাশেদ জানতে চায় এমন কিম্ভুত বদল ঘটলো কী করে? শুনে খুব ক্ষুব্ধ হয় আলহজ ডক্টর সেলিমা, কয়েকবার তওবা তওবা করে, তারপর বলে হজ করতে গিয়ে তার হৃদয়ে মহাপরিবর্তন ঘটেছে, বিজ্ঞান দিয়ে কিছু হবে না। সে এখন খাঁটি মুসলমান, রাশেদ যে মুসলমান হয়ে ওঠে নি এতে সে আঁতকে উঠে কয়েকটা দোয়া পড়ে ফেললো। আলহজ সেলিমাকে রাশেদ জিজ্ঞেস করে, এখন ক্লাশে কী পড়ান, রোজা নামাজ হজ জাকাত পতিসেবা? চিৎকার করে উঠে যায় আলহজ সেলিমা, সে একটা কাফেরের সাথে কথা বলতে চায় না।
বাসায় ফিরে রাশেদ শোনে দুপুরে একটি ছেলে পাড়ার শান্তিশৃঙ্খলা কয়েক মিনিটের জন্যে বিপন্ন করে তুলেছিলো। মজুমদার সাহেবের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে সে ‘রাজাকারের বিচার চাই’ বলে চিৎকার করে, রাস্তাটিতে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। দিন যতোই যাচ্ছে যাকে তাকে রাজাকার বলা স্বভাবে পরিণত হচ্ছে কিছু ছেলের, পথে . পথে রাজাকার দেখতে পাচ্ছে তারা, পিতার মুখেও তারা হয়তো রাজাকার দেখতে পায়, দেশের অভিভাবকদের মুখেও দিনরাত রাজাকার দেখে। রাজাকার শব্দটা উচ্চারণ করতে রাশেদ পছন্দ করে না, কোনো কোনো পশুর নাম নিতে যেমন তার ঘেন্না লাগে; তবে ওই ছেলেদের রাশেদ দোষ দিতে পারে না, সেও তো তা-ই দেখছে, যদিও একাত্তরে সে এতো রাজাকার দেখে নি। একাত্তরের রাজাকারগুলো অনেক ভালো ছিলো আজকেরগুলোর থেকে, সেগুলোর ছদ্মবেশ ছিলো না, দেখলেই চেনা যেতো; আজকেরগুলো ব্ল্যাকম্যাজিক চলচ্চিত্রের শয়তানের মতে, প্রথম যখন দেখা হয় মনে হয় একান্ত আপনজন, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তার ভয়ঙ্কর মুখটি দেখা দেয়;-রাশেদ এমন একটির সাথে মাঝেমধ্যে গল্প করতে দেখা হলে, কথা শুনে মনে হতো সে মহামুক্তিযোদ্ধা, কিছু দিন পরে রাশেদ বুঝতে পারে সে একটা রাজাকার, যদিও একাত্তরে সে রাজাকার ছিলো না। বিকেলে দরোজায় ঘণ্টা বাজে, রাশেদ দরোজা খুলে কয়েকটি তরুণের মুখোমুখি হয়; দেখেই রাশেদের রক্তে ঠাণ্ডা আতঙ্ক বইতে থাকে-হয়তো ভোরে সে কোনো অপরাধ করে এসেছে মজুমদার সাহেবের বাসায়, এখন এই বিধাতামণ্ডলির কাছে তার কারণ দর্শাতে হবে; কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধ আর। মুক্তিযোদ্ধার কথা বললে রাশেদ বিস্মিত হয়। যার সাথেই দেখা হয় আজকাল সে-ই। মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য গল্প বলে, তার সে যোগ্যতা নেই; ওই মহৎ উদ্যোগে, দশ কোটি মানুষের মতো, সে অংশ নিয়েছে শুধু বেঁচে থেকে; মুক্তিযুদ্ধের বইপত্রও বেশি পড়ে নি, পড়তে পারে নি, ওগুলো মুক্তিযুদ্ধের বই হয় নি বলেই তার মনে হয়। যে-কটি বই পড়েছে, তার প্রতিটি শেষ করেই মনে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে গেলেই কেউ মুক্তিযুদ্ধকে উপলব্ধি করতে পারে না। ছেলেরা বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে একটি কথা তারা খুব শুনছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না তা কী, আসলেই তেমন কিছু আছে কিনা, ছিলো কিনা? রাশেদ খুব ব্ৰিত হয়, সে কি বলবে এটা সে নিজেও বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না; নাকি বলবে যারা এর কথা বলে তারাও বোঝে না, অন্তত বিশ্বাস করে না, তাদের মধ্যেও অমন কোনো চেতনা নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো কারো কাছে ক্ষমতা, কারো কাছে কোটি টাকা, ব্যাংক উপচে পড়া, গাড়ি, ব্যাংককে প্রমোদ, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা, আর হজ, ওমরা, মিলাদ। রাশেদ এসব কিছুই বলে না। তার বলতে ইচ্ছে হয় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা দুটিই তার কাছে একই সাথে স্বপ্নলোক ও বস্তুলোকের সামগ্রী; মুক্তিযুদ্ধ এক বাস্তব ঘটনা যা দেশ জুড়ে ঘটেছে, তবে তার চেয়ে বেশি ঘটেছে স্বপ্নলোকে, আর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছে বাস্তবে, সে বাস্তব মানুষ, কিন্তু তার বাস্তব রূপের থেকে স্বপ্নলোকের রূপই দখল করেছে আমাদের মন। তাকে যখন বাস্তবে দেখি, তখন স্বপ্ন। অনেকটা ভেঙে যায়, সে হয়ে ওঠে আমাদের মতোই সামান্য। শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সে-ই যে কখনো বাস্তবলোকে ধরা দেয় না, চিরকাল থাকে স্বপ্নলোকে। কিন্তু রাশেদ এসব বলে না, সে শুধু জানতে চায় তার কাছে তাদের আসার আসল উদ্দেশ্য কী?
ছেলেরা তখন আসল উদ্দেশ্যটি প্রকাশ করে। বেশ ঝানু ছেলেই তারা, রাশেদকে আগে বাজিয়ে দেখে নিয়েই এগোতে চায়, কে জানে রাশেদও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তারা বলে যে মজুমদার সাহেব রাজাকার, একাত্তরে যশোরে কোথাও শান্তিকমিটির সভাপতি ছিলেন, এতেও তারা এতোদিন আপত্তি করে নি, আজো করছে না; তার কাজের মেয়েটি যে আত্মহত্যা করে নি এতে তাদের কোনো সন্দেহ নেই, তাকে খুন করা হয়েছে বলেও তারা মজুমদার সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু করছে না। কথা শুনে তাদের খুব চমৎকার ছেলে বলে মনে হয় রাশেদের, তার কাছে না এসে তাদের মায়ের বুকের পুষ্টিকর দুগ্ধ খাওয়া উচিত ছিলো এ-বিকেলবেলা, বা স্নানাগারে ঢুকে বিকেলটা তারা উপভোগ করতে পারতো। তারা জানায় তাদের এক বন্ধু দুপুরে ‘রাজাকারের বিচার চাই’ বলে চিৎকার করে বিপদে পড়েছে, তাকে বিপদ থেকে বাঁচাতে হবে। ছেলেটি দুপুরে কয়েকবার চিৎকার দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বাসায় ফিরে যায়, কেউ কেউ তার প্রশংসাও করে অন্তত একজন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে বলে; তবে বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পর, সে যখন মায়ের হাতে বাড়া ভাত খাচ্ছিলো মায়ের হাতের বাড়া ভাত না খেলে আজো সোনার বাঙলার সোনার ছেলেদের পেট ভরে না, পাড়ার যুবরাজরা তাদের বাসায় ঢোকে, মায়ের সামনে থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশ হলেও ভাবনা কম ছিলো, কিন্তু তাকে নিয়েছে যুবরাজরা, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যুবরাজরা পাড়ার রাস্তা মোটর সাইকেলের শব্দে সন্ত্রস্ত করে তুলছে, আর তারা ওই প্রতিবাদকারীর বিবেকসম্পন্ন বন্ধুরা, বিপন্ন বোধ করছে। রাশেদকে তারা একটি কাজের ভার দেয়, তাকে মজুমদার সাহেবের সাথে দেখা করে মুক্ত করে। আনতে হবে তাদের বন্ধুটিকে, আর মজুমদার সাহেব যদি চান তবে তারা খত লিখে দিতে প্রস্তুত যে তারা আর তাকে রাজাকার বলবে না। প্রতিবাদকারী ছেলেটির জন্যে।
খুব মায়া হয় রাশেদের, ছেলেটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিজের বুকের মধ্যে ধারণ না করে প্রকাশ করে ফেলেছে, ও কখনো ক্ষমতায় যাবে না, শক্তিমান হবে না; ওর উচিত ছিলো ওর বন্ধুদের মতো চেতনা ধারণ করে মার বুকের পুষ্টিকর দুগ্ধ খাওয়া। রাশেদ কি এ-বিবেকসম্পন্ন ছেলেগুলোকে বলবে যে তোমাদের কথা শুনে মুগ্ধ হলাম, তোমরা তোমাদের পিতাদেরই যোগ্য সন্তান, আর কিছু দিন পর তোমরাও রাজাকার হয়ে উঠবে, যদি তোমরা একাত্তরে থাকতে তাহলে রাজাকার হতে? রাশেদ তা বলতে পারছে না, ওদের বুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বইছে, যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বইছে রাজনীতিবিদদের বুকে। রাশেদের নিয়তি পরিহাসপরায়ণ, একাত্তরে সে রাশেদকে কোনো শান্তিকমিটির সভাপতির কাছে পাঠায় নি, কিন্তু এখন পাঠাচ্ছে যখন চারপাশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জ্বলছে আগুনের মতো। : রাশেদ মজুমদার সাহেবের দরোজায় ঘন্টা বাজালে এক পাড়াযুবরাজ দরোজা খুলে দেয়; এরাই এখন দেখাশোনা করছে মজুমদার সাহেবের, বাজারও সম্ভবত করে দিচ্ছে, ব্যাংকেও হয়তো যাচ্ছে। মজুমদার সাহেবের বসার ঘর থেকে এখনো নেতারা বিদায় নেয় নি, দিন ভরেই তারা সঙ্গ দিচ্ছে তাকে; রাশেদ বসার ঘরে ঢুকতেই গোটা দুয়েকের সাথে দেখা হয়ে গেলো, যেগুলোর সাথে অনেক আগে তার পরিচয়ের মতো ছিলো, একটা এখন উদ্দিন মোহাম্মদের একটা মন্ত্রীর সাথে সাথে ফেরে, তারও একটা উপ বা প্রতি হওয়ার খুব সম্ভাবনা, এককালে মাও ছাড়া কোনো গান জানতো না সে, এখন মহামান্য ছাড়া আর কিছু জানে না; আরেকটা এখনো অনবরত মুক্তিযুদ্ধের রূপকথা বলে। দুটিই পাজেরো করে এসেছে, কতো টাকা করেছে রাশেদ জানে না, চর্বির পরিমাণ দেখে কিছুটা অনুমান করতে পারে। যেটার প্রতি বা উপ হওয়ার সম্ভাবনা সেটা এরই মাঝে মন্ত্ৰীমন্ত্রী ভাব আয়ত্ত করে ফেলেছে, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ দেখানোর অভিনয় করছে। রাশেদ মজুমদার সাহেবের পাশে বসে কথাটি তোলে। একটা রাজাকারকে সে কিছু অনুরোধ করতে যাচ্ছে ভাবতেই অস্বস্তি লাগে রাশেদের, কিন্তু সে-মুহূর্তে সে শহর ভরে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায়, বুটের আওয়াজ শুনতে পায়, শুনতে পায় পাশের বাড়ির দুটি ছেলেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে মিলিটারি, দূরে শুনতে পায়। একটি যুবতীর চিৎকার, হঠাৎ বোমার শব্দ শোনে এবং চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে; তার মনে হয় ছোটোভাইটিকে ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারি, সাত দিন ধরে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, মা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, ওই দুষ্ট মুখটি দেখার জন্যে তার বুক ব্যাকুল হয়ে আছে, সে ভাইটিকে খুঁজতে খুঁজতে শেষে দেখা করতে এসেছে। শান্তিকমিটির সভাপতির সাথে। রাশেদ আর অস্বস্তি বোধ করে না; সে বলে দুপুরে যে-ছেলেটি বেয়াদবি করেছে, তার বেয়াদবির জন্যে রাশেদ খুব দুঃখিত, ছেলেটি আর। কখনো বেয়াদবি করবে না। মজুমদার সাহেব গম্ভীর হয়ে ওঠেন। রাশেদ বলে, ছেলেটিকে ধরে নিয়ে গেছে কয়েকটি যুবক, যুবকগুলো নিশ্চয়ই খুব ভালো, পাড়ার। ভালোমন্দ তারা তো দেখবেই; মজুমদার সাহেব পাড়ার অভিভাবক, তিনি যদি বলে। ছেলেটিকে ফেরত এনে দেন, তাহলে সবাই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। কথাগুলো বলার সময় রাশেদের মনে হয় সান্ধ্য আইনের মধ্যে বসে কথা বলছে সে, চারপাশে মিলিটারি জিপের আর গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, দূরে কোথাও আগুন জ্বলছে, পাশের বাড়িতে সবাই চিৎকার করছে। মজুমদার সাহেব ব্যাপারটি দেখার আশ্বাস দেন, আরো বলেন যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভেবে পাড়ার ছেলেরা যাতে নষ্ট না হয় রাশেদ যেনো একটু লক্ষ্য রাখে। রাশেদ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসে, দুটি যুবরাজ তাকে দরোজা খুলে দেয়। একাত্তর একাত্তর লাগছে রাশেদের, যদিও একাত্তরে সে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে নি, কোনো শান্তিকমিটির সভাপতির সাথে দেখা করতে তাকে যেতে হয় নি; মিলিটারির ভেতর দিয়ে চলে গেছে, কয়েকটি রাজাকারের সাথে একবার ঝগড়াও করেছে, মনে। হচ্ছে এখন সে আরো গভীর একাত্তরে পড়েছে, যখন কোনো স্বপ্ন নেই, যখন কোনো আলো নেই। একাত্তরে স্বপ্ন ছিলো, পোকামাকড়ও স্বপ্ন দেখতো তখন, এখন মানুষও স্বপ্ন দেখে না। সন্ধ্যার বেশ পরে বিবেকসম্পন্ন ছেলেগুলো আবার আসে, রাশেদকে খবর দেয় যুবরাজরা তাদের বন্ধুটিকে বাসার সামনে একটি পাজেরো থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে, সে দাঁড়াতে পারছে না, কথা বলতে পারছে না, তার সারা শরীর কালো হয়ে। গেছে। রাজাকারকে রাজাকার বললে তুমি দাঁড়াতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না, শরীর দাগে ভরে যাবে, তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রূপ উপভোগ করে ক’র জর্জরিত হয়ে উঠছে রাশেদ, চারদিকে তার রূপ দেখছে, সে-ই শুধু ওই চেতনা থেকে দূরে বলে মনে হচ্ছে, আর সবাই উজ্জীবিত ওই চেতনায়। অনেকের কাছে তাকে বারবার বুঝতে হচ্ছে আলহজ সেলিমাকে তার ওসব কথা বলা ঠিক হয় নি, বুদ্ধিমানের মতো বাঁচতে হবে এখন, প্রগতিশীল শুভানুধ্যায়ীরা তাকে বুঝিয়েছে রোজা নামাজ হজ জাকাতের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধ নেই, বিরোধ নেই জানালা লাগানো বোরখার সাথেও, এসবের সাথে মিলন ঘটিয়েই থাকতে হবে। তারাও রাশেদের মতো ভুল বুঝতো এক সময়, এখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারছে, নিয়মিত নামাজ পড়ছে, শুক্রবার দল বেঁধে প্রতিযোগিতা করে পড়ছে, মনে শান্তি পাচ্ছে। দেশের দিকে তো তাকাতে হবে, গরিব আর অশিক্ষিত মানুষদের মন জয় করতে হলে, এবং তাদের ঠকাতে হলে ধর্ম ছাড়া আর কোনো পথ নেই; তারা অন্য কোনো চেতনাই বোঝে না। তারা আর কিছু চায় না; না খেয়ে তারা থাকছে হাজার হাজার বছর ধরে, দরকার হলে আরো হাজার হাজার বছর তারা না খেয়ে থাকবে, আরো হাজার বছর তারা চিকিৎসা চায় না, ঘর চায় না, তারা চায় শুধু ধর্ম। ধর্মই শুধু শান্তি দিতে পারে। তারা যে খুব শান্তি পাচ্ছে তাদের মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। রাশেদ দেখতে পাচ্ছে ছাত্ররাও খুব শান্তি পাচ্ছে, জিন্স পরে বিসমিল্লা বলে তারা বক্তৃতা শুরু করছে, কিছু দিন পর সালোয়ারও পরবে, সালামুআলাইকুম বলে শেষ করছে, তাতে মুক্তিযুদ্ধের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। ডক্টর জালালের মেয়েটিও কোনো ক্ষতি করে নি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, ওই চেতনার ক্ষতি কেউ করতে পারে না। ডক্টর জালাল শহীদ হয়েছিলেন, চোদ্দো তারিখে আলবদররা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো, তার লাশটিও পাওয়া যায় নি; তবে তিনি একটা অমর। চেতনা রেখে গেছেন। তার লাশ না পাওয়া গেলেও তাঁর ছবি ছাপা হয় ডিসেম্বরে, ওই ছবি ছাপার মধ্যেই ধরা পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আমরা দূরে সরে যাই নি, তাঁর মেয়েটি যা-ই করুক, আমরা যা-ই করি। ডক্টর জালাল শহীদ হওয়ার আগে থেকেই রাশেদ দেখে আসছে তার মেয়েটিকে, রিনাকে, পাঁচ-ছ বছর বয়স থেকেই, কোলেও নিয়েছে; দেখতে দেখতে সে বড়ো হয়ে উঠেছে, সুন্দর, বেশ মেধাবী, ডাক্তারি পড়ছে। ডক্টর জালালকে যখন বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদররা, রিনা তার কোলেই। ছিলো, মেয়েটিকে তিনি কোলে রাখতেই ভালোবাসতেন। বছর খানেক আগে রাশেদ তাকে দেখে অবাক হয়, আহতও বোধ করে; কালো বোরখা পরেছে রিনা, তার। বোরখায় জালের জানালা লাগানো, রাশেদ বুঝতেই পারতো না যদি না মমতাজ বলতো ওই বোরখার ভেতরে রিনা রয়েছে। রিনা নিজেই শুধু ধর্মকর্ম করছে না, মাকেও ধর্মকর্ম শেখাচ্ছে; মা শিখতে রাজি হচ্ছে না বলে মাকে সে ছেড়ে যাবে বলে হুমকি দিচ্ছে। সে পাঁচ সাত বেলা নামাজ পড়ছে, রোজা রাখছে মাঝেমাঝেই; ডাক্তারি বইয়ের থেকে বেশি পড়ছে কোরানহাদিস, কিনতে হচ্ছে না, পাওয়া যাচ্ছে নানা দিক থেকে। এ-বছর সে পাশ করে বেরিয়েছে, কয়েক দিন আগে সে বিয়ে করেছে একটি আলবদরের ছেলেকে, বিয়ে করে বাসায় ফেরে নি, আলবদরটির বাসায় গিয়ে উঠেছে। ছেলেটা এখনো পাশ করে নি, ছেলেটাকে রাশেদ দেখেছে একদিন। বেশ দাড়ি রেখেছে সে, যদিও ওর আলবদর বাপটা এখনো দাড়ি রাখে নি, কিন্তু ছোঁকরাটা দাড়ির দৈর্ঘে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে। বেগম জালাল মেয়ের মুখ দেখেন নি, মেয়েও মায়ের মুখ দেখতে চায় না, মাকে তার মুসলমানই মনে হয় না। এটা তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ, এমন বিকাশই ঘটছে চারদিকে, এমন বিকাশ দেখেই শান্তিতে থাকতে হবে রাশেদকে। রাশেদকেও একটু রোজানামাজে মন দিতে হবে, পকেটে একটা টুপি রাখতে হবে।
মমতাজের একটি মামাতো না খালাতো না চাচাতো ভাই যেনো দেশে ফিরেছে, এক যুগ পড়ে ছিলো মানচেস্টার না ব্র্যাডফোর্ড না কার্ডিফ না কোথায়, দেখা করতে এসেছে রাশেদের সাথে, দেখেই রাশেদ মুগ্ধ হলো, অদ্ভুত জীবের মতো লাগছে তাকে। মাথায় লম্বা চুলও রেখেছে, আবার শরীর ভ’রে স্যুটকোটের বাহারও দেখার মতো, নতুন কিনেই গায়ে চাপিয়ে প্লেনে উঠেছে মনে হচ্ছে, ঝকঝক করার চেষ্টা করছে, কিন্তু মনে হচ্ছে বাঙলাদেশেরই কোনো মফস্বল, ভুরুঙ্গামারি ছাগলনাইয়া ঝালকাঠি, থেকে। এসেছে; বাঙলাটা আগের যে-আঞ্চলিক ছিলো এখন তার থেকেও আঞ্চলিক হয়েছে, মাঝেমাঝে ইংরেজি বলছে, তাও ওখানকার কোনো অঞ্চলের। আনন্দের কথা বাঙালি পৃথিবীর যেখানেই যাক বাঙালিই থাকে, নিউইয়র্ক শিকাগো লন্ডনকে বাঙলাদেশের মফস্বল শহরে পরিণত করে; পৃথিবীর বাইরেই থেকে যায়। জনাব দ্যাশে ফিরতেনই না, ফিরেছেন দয়া করে, বিবাহ করার জন্যে; তিনি একটি সতীসাধ্বী গৃহকর্মনিপুণা পরহেজগার বিবি সংগ্রহের জন্যে দ্যাশে ফিরেছেন। কোনো বিদেশিনী বা বাঙালি বা ভারতি মেয়েকে তিনি কেননা বিয়ে করলেন না, রাশেদ জানতে চায় তার কাছে; সে। অনেকটা নাউজুবিল্লা নাউজুবিল্লা করে ওঠে। দেশে থাকার সময় সে বিশেষ খাঁটি। মুসলমান ছিলো না, এখন বিলেতে মুসলমান ভাইদের সাথে খাঁটি মুসলমান হয়ে উঠেছে, দাড়ি এখনো রাখে নি হয়তো ফিরে গিয়ে রাখবেন, নামাজটা ঠিক মতো আদায় করেন, রোজা রাখেন। সে বলে যে বাঙালি মাইয়াগুলিন একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে ওই দ্যাশে, যার তার সাথে ঘুমোয়, বিদেশিদের সাথেই বেশি ঘুমোয়, ওই রকম। মাইয়ালোক তিনি বিয়ে করতে পারেন না। তিনি একটি অক্ষত মেয়েলোক চান, যার ভেতরে তিনিই প্রথম ঢুকবেন, হয়তো ঢোকার আগে খুঁজে দেখে নেবেন পাতলা পর্দাটা ঠিকঠাক আছে কিনা। কিন্তু তিনি যে এক যুগ ধরে ওখানে পড়ে আছেন, তিনি এতোদিন চালিয়েছেন কীভাবে, দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়েই কি চালিয়ে দিয়েছেন? গার্লফ্রেণ্ড টার্লফ্রেণ্ড কি একেবারেই জোগাড় করতে পারেন নি, এমনকি কোনো আইরিশ পতিতা, বা দু-একটা বাঙালি মেয়ে? তা তিনি জোগাড় করেছেন, তিনি একেবারে নপুংসক নন; একটা গ্রিক মাইয়ালোকের সাথে তিনি কয়েক মাস ছিলেন, একটা। ইউরেশীয় মেয়ের সাথেও তিনি ছিলেন বছরখানেক, দু-তিনটা বাঙালি মুসলমান মেয়ের সাথেও তিনি ঘুমিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে, স্বীকার করতে চাইছেন না, তবে তার হাসি থেকেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি মাইয়ালোকের সাথে ঘুমোতে পারেন, কিন্তু নিকা করতে পারেন না; যে-মাইয়ালোক পরপুরুষের সাথে ঘুমোয় অমন নষ্ট মেয়েলোককে তিনি শাদি করতে পারেন না। তবে ওই মেয়েলোকগুলোকে কি তিনি বদল করেছেন, না ওই নষ্ট মেয়েলোকগুলোই তাকে ছেড়ে গেছে? মেয়েলোকগুলোই তাকে ছেড়ে গেছে, ওইগুলো খানকিই, একজনকে নিয়ে থাকতে পারে না; আর তাদের সাথে তিনি পেড়ে ওঠেন নি। বাঙালি মেয়েগুলোও ওখানে গিয়ে রাক্ষুসী হয়ে গেছে, কিছুতেই ক্ষুধা মেটে না; একটায় তারা তৃপ্তি পায় না, একটার পর একটা চায়, ঠোঁট চায় মুখ চায় আঙুল চায়; তিনি তা পারেন না। তাই তিনি দ্যাশে ফিরেছেন একটা খাঁটি বাঙালি মুসলমান পরহেজগার বিবি সগ্রহ করতে।
একটি বই কিনবে বলে চৌরাস্তাটায় গিয়েছিলো রাশেদ, বইটা পাওয়া গেলো না; তাতে খুব খারাপ লাগলো না তার, সে জানে বহু শ্রেষ্ঠ বই সে কোনোদিন প’ড়ে উঠতে পারবে না, হাতের কাছে পেয়েও বহু অমর বই সে পড়ে নি, এটা না পড়লেও তার জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে না; তবে দোকানের তাক ভরে সাজানো রাশিরাশি রঙিন। মলস্থূপ, উপচে উছলে পিছলে পড়ছে, চারপাঁচটি বালকবালিকা এসেই একটার পর একটা মলস্তূপের নাম বলতে লাগলো, আরো মলতূপ যার নাম তারা জানে না বেরিয়েছে কিনা, কবে বেরোবে, কেনো বেরোচ্ছে না বারবার জানতে চাইলো। মলত্যাগকেরা কেনো আরো বেশি করে মলত্যাগ করছে না, তারা আরো বেশি মলত্যাগ না করলে এই বালকবালিকারা কী ভোজন করে বাঁচবে? রাশেদ দোকান থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছিলো, কয়েকটি বোমা ফাটার শব্দ পেলো, ছাত্রাবাসগুলোতে ছাত্ররা গণতন্ত্রের প্রস্তুতি নিচ্ছে; শব্দ শুনলে একাত্তর থেকেই সে আঁতকে ওঠে, আজো আঁতকে উঠলো, কিন্তু অন্যদের মতো সেও আর ভয় পায় না। হাঁটতে হাঁটতে সে একটি মসজিদের পাশের ফুটপাতে এসে উঠলো; মসজিদটিকে ঘিরে নানা রকমের দোকান, কয়েকটা বইয়ের দোকানও আছে, মুসলমানদের এটা রাশেদের খুব ভালো লাগে যে তারা আধ্যাত্মিকতাকে পার্থিবতা দিয়ে ঘিরে রাখে; এক অনুরাগী যুবক বেশ আগে তাকে এখন দিয়ে যাওয়ার সময় সাবধানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলো। সাবধানে যাওয়া কেননা সাবধানে কোনো কিছু করাই এখনো সে শিখে ওঠে নি, উঠবে বলেও মনে হচ্ছে না, তবে ছেলেবেলায় যেমন একটা গাবগাছের আর একটা তেঁতুলগাছের পাশ দিয়ে। যাওয়ার সময় হঠাৎ সাবধান হয়ে পড়তে কে একজন তাকে সাবধান করে দিয়েছিলো বলে, এখানে এলেও সে সাবধান হয়ে পড়ে, সেই ছেলেটিকে মনে পড়ে, আজো তেমন হলো। কয়েকটি যুবক তার দিকে এগিয়ে আসে, পোশাকে আর মুখাবয়বে দেখতে বেশ ধার্মিক, সামনের ছেলে দুটির গাল বেশ ভাঙা, কোনো অতিরিক্ত অনৈসলামিক কাজের। ফলে হয়তো এ-ধস নেমেছে, তবে হাল্কা দাড়িতে ঢেকে আছে বলে বেশ মানিয়েছে। একাত্তরে হয়তো তাদের জন্ম হয় নি, হলেও চারপাঁচের বেশি বয়স হবে না, তবে এখন। মনে হচ্ছে বারো তেরো শো বছর বয়স হবে, তারও বেশি হতে পারে। একটি ছেলে তাকে একটা সম্পূর্ণ সালাম দেয়, যা সে অনেক দিন শোনে নি, এখন সংক্ষিপ্ত সালামই রীতি, রাশেদ মাথা নেড়ে সালাম নেয়। সামনের ছেলেটি বলে, শুনছিলাম আপনে। মুসলমান না, এখন ত দ্যাখতে পাইতাছি মুসলমানই, তবে মুখ খুইল্যা হাত তুইল্যা সালাম লইতে শিখবেন। রাশেদ বিব্রত হয়ে দাঁড়ায়, ছেলেগুলোকে একবার দেখে নেয়, এবং বলে যে আজকাল ভুল সংবাদই বেশি প্রচার পাচ্ছে, তাতে কান দেয়া ঠিক নয়। আরেকটি ছেলে বলে, ভুল খবর আমরা রাখি না, খাঁটি খবরই রাখি, সাবধান হইয়া। যান, চইদ্দই ডিশেম্বর আবার আসব, লিস্টিতে নাম আছে। রাশেদ জানতে চায় তাকে কী করতে হবে? একটি ছেলে বলে, রোজানামাজ কইরেন, আর মুক্তিযুদ্ধ প্রগতিফ্রগতি। ছাইরা দেন। আরেকবার যখন সময় আসব পলাইবার পথ পাইবেন না। রাশেদ তাদের বলে পালানোর কথা সে কখনো ভাববে না, আরেকবার সময়ও আসবে না। রাশেদ, তাদের জিজ্ঞেস করে আধুনিক সময়ের মানুষ হয়ে তারা কেনো মধ্যযুগে চলে যাচ্ছে? ছেলেটি বলে, আমাদের সঙ্গে আপনেরেও মধ্যযুগে যাইতে হবে বাঁচতে চাইলে। রাশেদ বলে, তার সম্ভাবনা নেই, মধ্যযুগে যেতে হবে না বলেই সে বিশ্বাস করে, সে সামনের দিকেই যাবে। এমন সময় দুটি ছেলে রিকশা থেকে নেমে রাশেদের পাশে দাঁড়ায়, রাশেদ তাদের চেনে না, তবে তাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে মনে হয় ৩০৩ রাইফেল দিয়ে তারা একটি দেশকে স্বাধীন করতে পারে, আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারে ৯৩। হাজার মধ্যযুগকে। তাদের দেখে মধ্যযুগের প্রতিনিধিরা মসজিদের চারপাশের দোকানগুলোতে ঢুকে পড়ে, রাশেদ ছেলে দুটিকে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে।