০৮-১১. সাবরমতী পরিপূর্ণ

০৮.

বাড়ি ফিরে যশোমতী সত্যিই ভয়ে ভয়েই ছিল। কিন্তু লোকটা তাকে বাঁচিয়েই দিল মনে হয়। দিদি শুধু জানল, তার চাকরি হল না। আর সেটুকু শুনেই স্কুলের অজানা অচেনা কর্তাদের উদ্দেশে দিদি বিরূপ মন্তব্য করল দুই একটা। উল্টে যশোমতীকে সান্ত্বনা দিল, তুমি কিছু ভেব না, যা হোক কিছু হবেই। সম্ভাব্য গানের স্কুলের লোকেরা একবার তার গলা শুনলেই হয়তো তাড়াতাড়ি স্কুল শুরু করে দেবে। এই সঙ্গে স্যাণ্ডাল না কেনার জন্যেও ভাইকে কথা শুনতে হল।

একটা একটা করে দিন যায়। যশোমতীর মনে হয় এ-ভাবে থাকা উচিত নয়। বিবেকে লাগে। আবার এখান থেকে যাবার কথা ভাবতেও ভালো লাগে না। সকাল হলেই রাজুর হাত ধরে পুকুর-ঘাটে আসা চাই তার। এমনি রাত্রিতে বিছানায় শুয়েই সকালের ওই দেখার প্রতীক্ষায় থাকে।

তারপর যশোমতী বাগান পরিচর্যা করে খানিকক্ষণ। এও ভালো লাগে। এক-একদিন দিদি আসে, আর কাজের চাপ না থাকলে শঙ্কর সারাভাইও আসে। দুজনের খটাখটি লাগে অবশ্য, লাগে কারণ, ইচ্ছে করেই যশোমতী জ্বালাতন করে তাকে। তবু মনে হয়, রাগ হলেও লোকট। আগের মতো অত রূঢ় হতে পারে না।

বিশেষ করে দুপুরে কারখানা-ঘরে যেন তার প্রতীক্ষাতেই থাকে। কারখানা….যশোমতীর হাসিই পায়। বাবার কারখানা যদি একবার দেখত।

দুপুরে সেখানে হাজিরা দেওয়া নৈমিত্তিক কাজে দাঁড়িয়েছে যশোমতীর। ইদানীং আবার দুপুরের খাবারটা সে-ই নিয়ে যাচ্ছে। ঢেকে রাখতে বললে রীতিমত তাড়না শুরু করে দেয়, মুখ-হাত ধুয়ে শঙ্করকে খেতে বসতে হয়। বিকেলের চা নিয়েও সে-ই আসছে। এই চা নিয়েও সেদিন একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে।

যশোমতী বলে ফেলেছিল, কি যে জায়গা, একটু ভালো চা-ও মেলে না–এই চা গলা দিয়ে নামতে চায় না।

এ-বাড়িতে নিয়মিত চায়ের পাট ছিলই না। চা-বিহনে যশোমতীর দুই-একদিন মাথা ধরতে দিদি জানতে পেরে চায়ের ব্যবস্থা করেছে। শঙ্কর পেলে খায়, না পেলে খায় না। কিন্তু যশোমতী ভাবখানা এমন করল যেন এই লোকের জন্যেই চায়ের ব্যবস্থা।

দিদি অনেকবার ভাইকে বলেছে, মেয়েটার চাল-চলনে কথায় বার্তায় আচার-আচরণে সর্বদাই মনে হয় বড়ঘরের মেয়ে। এমন কি বিহারীও বলেছে, নতুন দিদিমণি নিশ্চয় খুব বড় ঘরের মেয়ে ছিল। তাকেও কিছু দেবে-টেবে–এই রকম প্রতিশ্রুতি পেয়েছে হয়তো।

চায়ের প্রসঙ্গে শঙ্কর বলে বসল, ভালো চা কি করে পাওয়া যাবে, আপনার মতো ভালো অবস্থার লোক তো এখানে বেশি নেই।

যশোমতীও ঝপ করে বলে বসেছে, নেই সে-কথা সত্যি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হেসে ফেলে মনোভাব গোপন করতে চেষ্টা করেছে। –আমার কি অবস্থা আমি খুব ভালো জানি, সেজন্যে অত খোটা দেবার দরকার কি!

কিন্তু দুপুর এলেই কে যেন টানে যশোমতীকে এখানে। কর্মরত মূর্তি দেখে পুরুষের। সংগ্রাম দেখে। কি অসম্ভব চেষ্টা, আর কতখানি আশা। এই কারখানা নাকি বড় হবে একদিন, মাথা উঁচিয়ে উঠবে। দিদির কাছে ভদ্রলোকের এই একমাত্র স্বপ্নের কথা শুনেছে, বিহারীর মুখেও শুনেছে। আর শুনেছে শঙ্কর সারাভাইয়ের নিজের মুখ থেকেও। বলেছে, একদিন এর এই চেহারা থাকবে না, দেখে নেবেন।

যশোমতীর বিশ্বাস হয় নি। কিন্তু সে বিশ্বাস করতে চেয়েছে।

ইতিমধ্যে সত্যিই নিজের হাতে তাকে দুখানা শাড়ি বানিয়ে দিয়েছে শঙ্কর সারাভাই। কাপড় পাওয়ামাত্র মুখ লাল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক অদম্য খুশির আবেগ অনুভব করেছে সে। শাড়ি অবশ্য দিদিই এনে দিয়েছিল তার হাতে।

কিন্তু শাড়ি হাতে নিয়েই যশোমতীর মনে হয়েছিল, যত্নের শাড়ি, অবজ্ঞার বা হেলাফেলার নয়। দুপুরে যখন ওই শাড়ির একখানা পরে এসেছে তখনো থেকে-থেকে মুখ লাল হয়েছে। বলল, চমৎকার শাড়ি, আপনি এত ভালো তৈরি করতে পারেন?

হাসল শঙ্করও। বলল, সরঞ্জাম থাকলে এর থেকে অনেক ভালো তৈরি করতে পারি, নেই তার কি করা যাবে।

না থাকার খেদ যেন বুকের ভেতর থেকে উঠে এলো। সেই দিনই যশোমতী দিদির কাছে শুনেছিল, বিশ হাজার টাকা দেবে এমন একজন অংশীদার যোগাড় করার জন্য তার ভাই কত চেষ্টাই না করেছে–কিন্তু কে দেবে তাকে টাকা? ওই টাকা পেলেই নাকি কারখানার ভোল বদলে যেত।

কথায় কথায় যশোমতী সেই প্রসঙ্গই তুলল। অবাক হবার মত করে জিজ্ঞাসা করল, মাত্র বিশ হাজার টাকা পেলেই আপনার সমস্ত সমস্যা মিটে যায়?

শঙ্কর সারাভাই জবাব দিতে যাচ্ছিল, বিশ হাজার টাকা একসঙ্গে দেখেছেন? তা না বলে হাসল। অতটা অভদ্র না হয়েও জব্দ করা যেতে পারে। হালকা শ্লেষে জবাব দিল, মাত্র। আপনি দেবেন?

হঠাৎ কি মনে পড়ল যশোমতীর। তার চোখে-মুখে উদ্দীপনার আভাস। সমস্যার সমাধান তো তার হাতের মুঠোয়। সাগ্রহে বলল, দিতে পারি না মনে করেন?

এ আলোচনা ভালো লাগছিল না শঙ্করের। হয়তো বড়ঘরের মেয়েই ছিল, তা বলে সদ্য বর্তমানের অবস্থা ভোলে কি করে? হেসেই টিপ্পনি কাটল, আপনি রাজুকে কি সব দেবেন বলেছেন, বিহারীও হয়তো কিছু পাবার আশ্বাস পেয়েছে, নইলে চোখ-কান বুজে ও এত প্রশংসা কারে করে না।….আমাকেও ওদের দলে ফেলাটা কি তার থেকেও একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

-না, যাচ্ছে না। যশোমতীর নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। আরো জোর দিয়ে বলল, দিতে পারি, আপনি যদি দিদিকে বা কাউকে কিছু না বলে দেন। নিজের দুটো হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিল।–এই দেখুন, আমার এই বালা দুটোর হীরেগুলোর দামই সাত-আট হাজার ছিল, আর হারের লকেটের এই একটা হীরের দামই তার থেকে অনেক বেশি। তাছাড়া সোনা আছে, আংটি আছে, বিশ হাজার কেন, তার থেকে বেশিই হবে, আপনি চেষ্টা-চরিত্র করে দেখুন না কি পান, এগুলো দিয়ে আমি আর কি করব? আপনার কাজে লাগলে সার্থক হবে–

শঙ্কর সারাভাই বিস্ময়ে নির্বাক। গায়ের গয়নাগুলো এই প্রথম যেন লক্ষ্য করে দেখল সে। চোখ ঠিকরোবার মতই ঝকঝক করছে তার পরেও মুখে কথা নেই। যশোমতীকে দেখছে, গয়না দেখছে,– দুই-ই দেখছে। গয়নাগুলোর দাম এত হতে পারে, আর তা কেউ অনায়াসে খুলে দিতে চাইতে পারে, সে ভাবতেও পারে না।

যশোমতী আবার বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এসব আমার দাদার নয়, বাবার দেওয়া। এগুলো আমারই। এর জন্যে আপনাকে কারো কাছে কোনদিন জবাবদিহি করতে হবে না। কাজ আরম্ভ হোক তো, তারপর বাকি টাকাও যোগাড় হয়ে যাবে। নেবেন তো?

শঙ্কর সারাভাই এই একান্ত অনুরোধ সত্ত্বেও লোভ দমন করেছে বটে, কিন্তু জীবনে সে যেন এক পরম বিস্ময়ের মুখোমুখি হয়েছে। সমস্ত রাত ঘুমুতে পারেনি। সে ভেবে পাচ্ছে না, সত্যিই কে তার ঘরে এসে উঠেছে। ওই একটা মাত্র প্রস্তাব যে তাকে কোন্ অনুভূতির রাজ্যে নিয়ে গেছে তা শুধু সে-ই জানে। কারখানা দাঁড়াবে, কারখানা অনেক বড় হবে জীবনে এর থেকে বেশি কাম্য আর কিছু নেই। যে এতখানি দেবার জন্য এগিয়ে এলো, সে নিজে কখনো সরে যাবে না এরকম প্রতিশ্রুতি নিয়ে সত্যি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া যায় কিনা, সেই প্রলোভনও মনে অনেকবার আনাগোনা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন থেকে সায় মেলে নি। শুধু প্রতিশ্রুতিটুকু আদায় করার লোভ বার বার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে।

কিন্তু এ চিন্তার খবর যশোমতী রাখে না। প্রস্তাব নাকচ করা হয়েছে এইটুকুই সে বুঝেছে, আর এই জন্যই সে ক্ষুণ্ণ মনে মনে।

জিজ্ঞাসা করেছে, নিতে আপনার আপত্তি কেন?

শঙ্কর সারাভাই হাসিমুখে পাল্টা প্রশ্ন করেছে, আপনার গায়ের গয়না আমি নেব কেন?

তর্ক করতে গিয়েও যশোমতী হেসে ফেলেছিল, তবে কার গায়ের গয়না নেবেন?

শঙ্কর জবাব দিতে পারেনি। লোভ সামলে মুখ টিপে হেসেছে।

ছাড়বার পাত্রী নয় যশোমতী, গলায় ঝগড়ার সুর।–নেবেন না-ই বা কেন, আমি আপনার বাড়িতে চড়াও হয়ে বসেছি কি করে?

ঠাট্টার সুরেই শঙ্কর সারাভাই জবাব দিয়েছে, বসেছেন সে-কি আমার হাত? এই জবাবে পাছে অহিত হয় সেই জন্যেই আবার বলেছে, আমি গরীব বটে, কিন্তু মনটাকে গায়ের গয়না খুলে নেবার মতো গরীব ভাবা গেল না।

ক্ষুণ্ণ হলেও জবাবটা ভালো লেগেছিল যশোমতীর।

পরদিনই আবার আর এক প্রস্তাব নিয়ে সোৎসাহে হাজির সে। বলল, আচ্ছা, কটন চেম্বারের এগজিবিশনে শাড়ি পাঠান না কেন? তাদের বিচারে প্রথম হতে পারলেও তো পঁচিশ হাজার টাকা পুরস্কার পেয়ে যাবেন?

শঙ্কর সারাভাই অবাক।–কটন চেম্বারের খবর আপনি রাখেন কি করে?

ছদ্মবিস্ময়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ টান করে ফেলে যশোমতী।–ও মা, কাগজে বেরোয়, কত ঘটা হয়, খবর রাখব না কেন? আমার এক বন্ধুর দাদাই তত একবার পেয়েছে।

মিথ্যে বলেনি। তবে বন্ধুর দাদার পুরস্কার পাওয়ার মধ্যে তারও যে পরোক্ষ হাত ছিল, সেটাই শুধু গোপন। পুরস্কার পাওয়ানোর জন্য বিচারকদের আগের থেকে বশ করতে হয়েছিল।

শঙ্কর সারাভাই জবাব দিল, আপনার বন্ধুর দাদার তাহলে মুরুব্বির জোর আছে। সাধারণ বেড়ালের বেলায় ওই ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে না।

খুব ছেড়ে। এভাবে হাল ছাড়তে দিতে রাজি নয় যশোমতী।– আপনি চেষ্টা না করে বলছেন কেন? কখনো পাঠিয়েছেন? পাঠান নি? আচ্ছা, ও-সব ভাবনা ছেড়ে এবারে তাহলে খুব ভাল দেখে একখানা শাড়ি পাঠান, কার কপালে কখন কি লেগে যায় কে বলতে পারে! আমার মন বলছে আপনিই পেয়ে যাবেন।

এ প্রস্তাবটা আগেরটির থেকেও অর্থাৎ গায়ের গয়না খুলে নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টার থেকেও অবাস্তব মনে হয়েছিল শঙ্কর সারাভাইয়ের। কিন্তু তবু ভাল লাগল। তার জন্যে এতখানি মন দিয়ে কেউ ভাবছে, এই যেন এক দুর্লভ ব্যাপার। তবু, এ প্রস্তাবও হেসেই উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল সে। বলল, মনে মনে আপনি নিজেই বিচারক হয়ে বসেছেন কিনা, তাই মন বলছে।

কিন্তু এই এক ব্যাপার নিয়ে যশোমতী রোজ উৎসাহ দিতে লাগল, রোজ তর্ক করা শুরু করল। আর এই প্রেরণাটুকুই হয়তো শঙ্কর সারাভাইয়ের নিজের অগোচরে মনের তলায় কাজ করতে লাগল। খুব অগোচরেও নয়। পুরস্কার পাক না পাক, তার শুকনো হতাশ মনটাকে যে চাঙা করে তুলতে পেরেছে এই প্রাপ্তি টুকুরও দুর্লভ স্বাদ। যশোমতীর উৎসাহ দেখে আর তার অবুঝ ঝোঁক দেখে শেষ পর্যন্ত তাকে খুশি করার জন্যেই যেন রাজি হল, এগজিবিশনের বিচারে শাড়ি পাঠাবে। পাঠানটা খুব কঠিন ব্যাপার তো কিছু নয়, খুব ভেবে-চিন্তে খেটেখুটে করা।

এই নিয়েই তারপর দুজনের আলাপ-আলোচনা চলতে লাগল। আর, এই আলোচনার ফল সত্যিকারের কাজের দিকে গড়াতে লাগল। শঙ্কর সারাভাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, পাড়, আঁচল ইত্যাদির বৈশিষ্ট্যের দিক নিয়ে জল্পনা-কল্পনাও এই মেয়ের মাথায় বেশ আসে। অন্তত অজ্ঞ বলা চলে না। এই বিস্ময়ই ক্রমশ তাকে আশার দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কিনা কে জানে।

সেদিন শঙ্কর সারাভাই যশোমতীর নৈমিত্তিক তাগিদের ফলেই জানালো, সামনের পনেরো দিনের মধ্যেই দেব-উঠি-আগিয়ারস, এর উৎসব, এই উৎসবের দিন সারবতীতে চান করে এবং পুজো দিয়ে রাত্রিতে কারখানার প্রথম কাজ শুরু করেছিল। অবশ্য তার ফল যে আশাপ্রদ হয়েছে তা নয়। তবু, সেই দিনটা এলেই নতুন করে আবার আনন্দ করতে ইচ্ছে করে…. এগজিবিশনের শাড়ির ব্যাপারেও তাই করবে। খুব ভোরের ট্রেনে চলে যাবে, দুপুরের মধ্যে চান আর পুজো সেরে চলে আসবে, বিকেলে দুজনে একসঙ্গে পুরস্কারের শাড়ির কাজ শুরু করবে। প্রতি বছরেই ওই দিনটিতে সে নাকি সাবরমতীতে গিয়ে থাকে।

শুনে যশোমতী ভারী খুশি। পুরস্কারটা যে এবারে এখানেই আসবে তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই। ও কোথায় আছে না জানিয়ে বাবাকে যদি সে এই শাড়ির দিকে চোখ রাখার জন্যে একটা চিঠি শুধু লিখে দেয়, তাতেই কাজ হবে।….চিঠি লিখলে আবার ডাকের ছাপ দেখে হদিস পেয়ে ফেলতে পারে। দূরের কোনো জায়গা থেকে পোস্ট করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যাক, চিঠি লিখবে কি অন্ত কিছু ব্যবস্থা করবে সেটা পরের ভাবনা, এখন দুর্গা বলে আরম্ভ তত করা যাক।

কিন্তু ওপরঅলার ইচ্ছে অন্যরকম।

 বিকেলের দিকে রাজুর হাত ধরে যশোমতী এদিক-সেদিক বেড়াত একটু। সেদিন দেখল, দূর থেকে একজন লোক যেন তাকে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করছে। লোকটার বয়েস বেশি নয়, চাউনিটাও যেন কি রকম।

বিরক্ত হয়ে সেদিন যশোমতী ঘরে চলে এলো। শহরে পুরুষের এই রোগ কম দেখে নি, গাঁয়ে ইতিমধ্যে আর এই উৎপাত ছিল না। পরদিন সকালে তরকারীর বাগানে ঘুরতে ঘুরতে আবার সেই লোকটাকে দেখা গেল। বিকেলেও। যশোমতী রেগেই গেল, ভাবল শঙ্কর সারাভাইকে বলে দেবে। লোকটার নির্লজ্জতা স্পষ্ট। কিন্তু বলতে লজ্জা করল। দরকার হলে এ-রকম দু-একটা লোককে নিজেই ঢিট করতে পারে। বলল না। তবে বললে প্রতিক্রিয়া কি হয় তা দেখার লোভ হয়েছিল।

বিরক্তির একশেষ। এর পরদিন অত সকালে মামা-ভাগ্নের চান দেখতে ঘাটে এসেও দেখে, অদূরে সেই লোক। তার দিকেই নিস্পলক চেয়ে আছে।

এবারে হঠাৎ এক অজ্ঞাত সন্দেহ দেখা দিল যশোমতীর মনে। তাড়াতাড়ি সে বাড়িতে ঢুকে গেল।

কিন্তু দু’ঘণ্টার মধ্যে যশোমতী শঙ্কর সারাভাইয়ের দেখা পেল না। পেলেও তাকে কিছু বলত কিনা জানে না। রাজু বলল, একজন লোকের সঙ্গে মামা কি কাজে গেছে।

এমন প্রায়ই যায়। সন্দেহের কোনো কারণ ঘটল না তখনো। কিন্তু শঙ্কর সারাভাই ফিরল যখন, তার কথা শুনে যত না, তার মুখের দিকে চেয়ে অবাক সকলে। এমন কি পাঁচ বছরের রাজুও। মামার এত ব্যস্ততা আর বুঝি দেখে নি। শুধু ব্যস্ততা নয়, চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা।

এসেই খবর দিল যশোমতীর জন্য খুব একটা ভালো চাকরি যোগাড় হয়েছে, এখান থেকে মাইল পনেরো দূরে, ট্রেনে যেতে হবে এক্ষুনি, মেয়েদের হাইস্কুলের হেডমিস্ট্রেসের চাকরি। কথা-বার্তা একরকম পাকা হয়ে গেছে। ভালো মাইনে, থাকার বাসা পাওয়া যাবে, আধঘণ্টার মধ্যে রওনা না হলেই নয়।

শোনামাত্র দিদি আনন্দে আটখানা। কিন্তু তক্ষুনি মনে হল রান্না যে কিছুই হয় নি, মেয়ে খেয়ে যাবে কি? আর তারপরেই ভাইয়ের বুদ্ধি দেখে অবাক। হাতের ঠোঙা আর কাগজের বাক্স আগে লক্ষ্যই

ঠোঙায় ভাল ভাল মিষ্টি। আর কাগজের বাক্সয় দামী স্যাণ্ডাল একজোড়া। যশোমতী পাথরের মতো স্তব্ধ হঠাৎ। শঙ্কর সারাভাইকে দেখছে। দেখতে চেষ্টা করছে। কিন্তু যে ভাবে দেখতে চাইছে, দেখতে পারছে না। কারণ সে ব্যস্ত-সমস্ত। সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে না।

দিদি যশোমতীকে সাজগোজ করালো, জোর করে খাওয়ালো। তার এই নীরবতা বিচ্ছেদের দরুন বলেই ধরে নিল। নানাভাবে সান্ত্বনা দিল তাকে। রিকশা অপেক্ষা করছে। একটা নয়, দুটো। শঙ্কর সারাভাইয়ের আজ দরাজ হাত।

নির্বাক মূর্তির মতো যশোমতী রিকশায় এসে উঠল।

রিকশা চলল। বাড়ির দোরে দিদি দাঁড়িয়ে, রাজু দাঁড়িয়ে, বিহারী দাঁড়িয়ে। যশোমতী ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তাদের একবার। কিন্তু একটি কথাও বলতে পারল না, বা বলল না।

পাশের রিকশাটা ঠিক পাশে পাশে চলছে না! দু’চার হাত পিছিয়ে আছে। যশোমতী ফিরে তাকালো। কিন্তু তার সঙ্গী এদিকে ফিরছে, অন্যদিকে চেয়ে আছে। তা সত্ত্বেও লোকটার মুখখানা যেন লালচে দেখাচ্ছে।

স্টেশন। যশোমতী দেখছে লোকটা হন্তদন্ত হয়ে টিকিট কেটে আনল। গাড়ির অপেক্ষায় যে পাঁচ-সাত মিনিট দাঁড়াতে হল, তখনো শঙ্কর সারাভাই সামনা-সামনি এলে না। দূরে দূরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তখনো যেন অকারণেই ব্যস্ত সে। যশোমতীর আবারও মনে হল, কি এক চাপা উত্তেজনায় লোকটার সমস্ত মুখ জ্বলজল করছে।

গাড়ি এলো। তারপরই যশোমতী আরো ঠাণ্ডা, আরো নির্বাক। সাদরে তাকে নিয়ে একটা ফাস্ট ক্লাস কামরায় উঠে বসল শঙ্কর সারাভাই। সে কামরায় দ্বিতীয় লোক নেই।

গদির ওপরেই একটা কিছু পেতে দিতে পারলে ভালো হত যেন, আর কিছু না পেয়ে নিজের রুমালে করেই গদীটা ঝেড়ে মুছে দিল শঙ্কর সারাভাই।

বসুন–

যশোমতী বসল। বসে এবার সোজাসুজি দুটো চোখ তার মুখের ওপর আটকে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারা গেল না। লোকটা এখনো যেন ব্যস্ত। এদিক-ওদিক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

যশোমতী দেখছে। দেখছে দেখছে দেখছে। যতখানি দেখা যায় দেখছে। চলন্ত গাড়ির ঝাঁকুনিতে দেহ দুলছে বটে, কিন্তু সে মূর্তির মতোই বসে আছে, আর নিষ্পলক চোখে দেখছে।

একটা স্টেশন এলো। একটা কথারও বিনিময় হয় নি। শঙ্কর সারাভাই তাড়াতাড়ি ঝুঁকে কাগজ কিনল একটা। তারপর গভীর মনোযোগে দৃষ্টিটা কাগজের দিকে ধরে রাখল।

যশোমতী দেখছে। গাড়ি চলছে।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

এত ঠাণ্ডা নিরুত্তাপ প্রশ্ন যে চমকে উঠল শঙ্কর সারাভাই। হঠাৎ যেন জবাব খুঁজে পেল না।

গোটা মুখখানা দু’চোখের আওতায় আটকে রাখতে চেষ্টা করে ধীর অনুচ্চ স্বরে যশোমতী আবার জিজ্ঞাসা করল, ফার্স্ট ক্লাসে চড়ে আমরা কোথায় যাচ্ছি?

হাসল শঙ্কর সারাভাই। এ-রকম কৃত্রিম বিনীত হাসি আর দেখে নি যশোমতী। এ-রকম চাপা অস্বস্তি আর চাপা উদ্দীপনাও আর দেখে নি।

–চলুন না, কাছেই।

চেয়ে আছে যশোমতী–পঞ্চাশ হাজার টাকা তাহলে অনেক টাকা….কেমন?

কাগজের ওপর মুখ নেমে এসেছে শঙ্কর সারাভাইয়ের। তার উদ্দেশ্য গোপন নেই বোঝার ফলে প্রাণান্তকর অস্বস্তি।

একটু অপেক্ষা করে যশোমতী আবার বলল, আমি যদি পরের স্টেশনে নেমে যাই, আপনি কি করবেন?

চমকে তাকালো শঙ্কর সারাভাই। উত্তেজনা সামলে হাসল। বলল, আপনি সে চেষ্টা করবেন না জানি। তাহলে আমাকেও নামতে, হবে, স্টেশনের লোককে বলতে হবে। মনে যা আছে খোলাখুলি ব্যক্ত করল এবার, বলল, আপনার বাবার কাছে লোক চলে গেছে, টেলিগ্রাম চলে গেছে, আর তারপরে ট্রাঙ্ক-টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথাও হয়ে গেছে। এতক্ষণে তাঁরা সকলে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন–তাঁরা জানেন এই গাড়িতে আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।

যশোমতীর দেখার শেষ নেই। এতদিন যা দেখে এসেছে তা যেন সব ভুল।

আপনার জীবনের তাহলে একটা হিল্লে হয়ে গেল, আর কোনো সমস্যা নেই?

শঙ্কর সারাভাই সানুনয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল তাকে, সে কিছু অন্যায় করছে না, দুদিন আগে হোক পরে হোক বাবার কাছে ফিরে যেতে তো হবেই তাকে। কাগজে ছবি দেখেই পাড়ার লোকের সন্দেহ হয়েছে, ক’দিন আর এভাবে থাকা যেত। রাগের মাথায় সে চলে এসেছে, ফিরে গেলে তার বাবা নিশ্চয় অনুতপ্ত হবেন, টেলিফোনে তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলেন ভদ্রলোক, তাছাড়া এভাবে বেরিয়ে এসে যে বিপদের ঝুঁকি যশোমতী নিয়েছিল সেটাও কম নয়, কত রকমের লোক আছে সংসারে।

কত রকমের লোক আছে সংসারে তাই যেন নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে দেখছে যশোমতী। দেখছে, একটা স্টেশন এলেই অস্বস্তিতে ছটফট করছে লোকটা। আর তারপর আবার ট্রেন চলার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশ হাজার টাকার আলো দেখছে ওই মুখে।

সমস্তক্ষণ আর একটিও কথা বলল না যশোমতী। শুধু দেখল। একই ভাবে একই চোখে দেখে গেল।

গন্তব্য স্থানে ট্রেন এসে দাঁড়াল। আর তারপর শঙ্কর সারাভাই যেন হকচকিয়ে গেল কেমন। ছোট স্টেশনে বহুলোক এসেছে যশোমতীকে নিতে। মিল-মালিক আর কটন চেম্বারের প্রেসিডেন্ট চন্দ্রশেখর পাঠক এসেছে, আর তার স্ত্রী এসেছে, ছেলে ছেলের বউ এসেছে। রমেশ চতুর্বেদী, বীরেন্দ্র যোশী, বিশ্বনাথ যাজ্ঞিক, শিবাজী দেশাই, ত্রিবিক্রমও এসেছে। যশোমতীর অনেক বান্ধবীও এসেছে।

এই ব্যবস্থা যশোমতীর বাবা-মায়ের। স্টেশনে এসে মেয়ের কি মূর্তি দেখবে ভেবে ভরসা করে শুধু নিজেরা আসতে পারেনি। অনেক লোক দেখলে মেয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করবে। স্ত্রীর ব্যবস্থায় এবারে আর বাদ সাধে নি তার কর্তাটি।

তাই হল। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে যশোমতীর এতক্ষণের মুখভাব বদলে গেল। হাসি-ভরা মুখেই নামল সে। আর তাই দেখে আত্মীয় পরিজনেরাও কলহাস্যে মুখরিত হয়ে উঠল। বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, এমন কথা কেউ উচ্চারণও করল না। যেন অতি আদরের কেউ অনেকদিন বাদে অনেক দূর থেকে ফিরে এলো–সেই আনন্দ আর সেই অভ্যর্থনা।

হাসিমুখেই যশোমতী বাবা-মাকে প্রণাম করল, আর যারা এগিয়ে এলো তাদের কুশল সংবাদ নিল।

একপাশে দাঁড়িয়ে শঙ্কর সারাভাই চুপচাপ দেখছে। তার দিকে তাকানোর ফুসরত কারো নেই। এই মেয়ে তাদের গরীবের বাড়িতে এতদিন কাটিয়ে গেল এযেন আর ভাবা যাচ্ছে না।

ফিরে চলল সকলে। পায়ে পায়ে শঙ্করও এগোচ্ছে। তার মুখে সংশয়ের ছায়া। স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ ফিরে তাকালো যশোমতী। তারপর বাবাকে কি বলতেই ভদ্রলোক শশব্যস্ত এবার শঙ্করের দিকে এগলো। সানন্দে তার দুই হাত ধরে ঝাঁকানি দিয়েই থমকালো একটু।–তোমাকে….আপনাকে কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে।

শঙ্কর সারাভাই মাথা নাড়ল। অর্থাৎ দেখেছে ঠিকই। দ্বিধা কাটিয়ে মেসোর পরিচয় দিল। এই বাড়তি পরিচয়টুকু পেয়ে চন্দ্রশেখর পাঠক কৃতজ্ঞতার উচ্ছ্বাস বর্ষণ করতে করতে তাকে একটা গাড়িতে তুলে দিল। নিজে সকন্যা আর সস্ত্রীক অঙ্গ গাড়িতে উঠল। এখন আর বাড়ি ধাওয়া করা ঠিক হবে না ভেবে এক ছেলে-বউ ছাড়া অন্য সকলে স্টেশন থেকে বিদায় নিল।

আঙিনায় গাড়ি ঢুকতে শঙ্কর সারাভাইয়ের দুই চক্ষু বিস্ফারিত। বাড়িতে ঢুকল কি কোনো রাজপ্রাসাদে, হঠাৎ ঠাওর করে উঠতে পারল না।

গাড়ি থেকে নামতে যে প্রকাণ্ড হলঘরে তাকে নিয়ে যাওয়া হল, তার ব্যবস্থা আর সাজ-সরঞ্জাম দেখেও শঙ্কর সারাভাইয়ের চোখে পলক পড়ে না। কোন্ বাড়ির মেয়ে এতগুলো দিন তাদের ভাঙা ঘরে কাটিয়ে এলো, এখানে এসে বসামাত্র সেটা এখন ঘন ঘন মনে পড়তে লাগল।

ঘরে ঢুকেই যশোমতী ধুপ করে একটা সোফায় বসল। বাবা-মা দাদাবউদি তখনো দাঁড়িয়ে। বসেই শঙ্করের দিকে তাকালো একবার। শঙ্কর সারাভাইয়ের মনে হল, চকচকে দৃষ্টিটা যেন মুখের ওপর কেটে বসল হঠাৎ।

–আমার চেকবই আনতে বলো।

কার উদ্দেশ্যে এই আদেশ যশোমতীর শঙ্কর বুঝে উঠল না। হুকুম শুনে বাবা বুঝল চেক বইয়ের দরকার কেন। বলল, তুই ব্যস্ত হচ্ছিস কেন, আমি দেখছি–

দ্বিগুণ অসহিষ্ণুতায় ঝাঁঝিয়ে উঠল যশোমতী।–আমার চেকবই আনতে বলে এক্ষনি! যেটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম সেটা চুরি হয়ে গেছে, অন্য যা আছে আনতে বলো শিগগীর।

হন্তদন্ত হয়ে দাদাই ছুটল। শঙ্কর সারাভাইয়ের বুকের ভিতরটা দুর করছে।

দু’মিনিটের মধ্যে দুটো চেক-বই হাতে নিয়ে দাদা ফিরল। যশোমতী সেই ট্রেনের মতোই স্তব্ধ এখন। একটা চেকবই টেনে নিতেই বাবা তাড়াতাড়ি কলম খুলে ধরল তার সামনে।

খস খস করে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক লিখে পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে যশোমতী ছুঁড়ে দিল সারাভাইয়ের দিকে।–এই নিন। ভালো করে দেখে নিন। তারপর চলে যান!

জ্বলন্ত চোখে এক পশলা আগুন ছড়িয়ে নিজেই সে দ্রুত ঘর ছেড়ে প্রস্থান করল। চেকটা ছুঁড়ে দেওয়ায় সেটা মাটিতে গিয়ে পড়েছিল। গণেশ পাঠক সেটা তুলে নিয়ে বোবামূর্তি শঙ্কর সারাভাইয়ের হাতে দিল। বিমুঢ় মুখে চেকটা নিল সে। যশোমতীর মা তাড়াতাড়ি মেয়ের পিছনে পিছনে চলে গেল। বউদিও।

চন্দ্রশেখর পাঠক মেয়ের ব্যবহারে অপ্রস্তুত একটু। কাছে এসে বলল, কিছু মনে কোরো না, মেয়েটার এই রকমই মেজাজ। টেক গিলে জিজ্ঞাসা করল, আসার সময় গণ্ডগোল করে নি তো?

শঙ্কর সারাভাই মাথা নাড়ল।

চন্দ্রশেখর তার পিঠে হাত রাখল, তারপর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল, তারপর অফিসে তার সঙ্গে দেখা করতে বলল, আর তারপর মেয়ের উদ্দেশে প্রস্থান করল।

শঙ্কর সারাভাই রাস্তায় এসে দাঁড়াল। আয়নায় এই বোকামুখ দেখলে নিজেই অবাক হত। পরক্ষণে সর্বদেহে এক অননুভূত রোমাঞ্চ। বুকপকেটে চেকটা খসখস্ করছে। বার করে দেখল। হাত কঁপছে। পড়ল। চোখে ধাঁধা লাগছে।

যা হয়ে গেল, সব সত্যি কিনা নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এক মেয়ে কলম নিয়ে খসখস করে পঞ্চাশ হাজার টাকা লিখে দিল বলেই এই কাগজটার দাম সত্যি পঞ্চাশ হাজার কিনা, সেই অস্বস্তিও মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।….পঞ্চাশ হাজার….পঞ্চাশ হাজার টাকা….কপর্দকশূন্য শঙ্কর সারাভাই পঞ্চাশ হাজার টাকার মালিক। আজ এই মুহূর্তে, সে-কি সত্যিই বিশ্বাস করবে? তার হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা, একি সে স্বপ্ন দেখছে?

ব্যাঙ্কের সময় পার হয়ে গেছে আজ। একবার মেসোর বাড়ি যাবে কিনা ভাবল। কিন্তু সোজা স্টেশনের দিকেই চলল শেষ পর্যন্ত।

উড়েই চলল। চিন্তা একটু স্থির হতেই মনে হল, পকেটের কাগজটা টাকাই–পঞ্চাশ হাজার টাকা। যে লোকটা কাগজে ছবি দেখে সন্দেহ করেছিল, আর তাকে সকালে ডেকে নিয়ে কাগজ দেখিয়েছিল, তাকে অন্তত হাজার পাঁচেক টাকা দেওয়া উচিত।…. দিতে ভালো লাগছে না বটে, কিন্তু তাই দেবে। তাহলেও পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা থাকল।

গলা ছেড়ে হাসতে ইচ্ছে করছে শঙ্কর সারাভাইয়ের।

.

০৯.

দিদি শুনে একেবারে আকাশ থেকেই পড়ল বুঝি। বিহারীও তাজ্জব।

আর এদের উত্তেজনা এবং উদ্দীপনা দেখে ক্ষুদ্রকায় রাজুরও মনে হল তাজ্জব হবার মতো ব্যাপারই কিছু ঘটে গেছে।

বড়ঘরের মেয়ে এ-অবশ্য দিদির বরাবরই মনে হয়েছিল। কিন্তু সে-যে সাক্ষাৎ কুবেরনন্দিনী–এ ভাবে কি করে? প্রাথমিক উত্তেজনা কমার পর দিদির কেবলই মনে হতে লাগল, মেয়েটার কত রকমের অসুবিধা-হয়েছে। অথচ হাসিমুখেই সে তার মধ্যে কাটিয়ে গেছে। অসুবিধের কথা বলে ফেলে বা অসুবিধেটা ধরা পড়ে গেলে নিজেই লজ্জা পেয়েছে। ভাইকে অনুযোগও করেছে দিদি, বলেছে, তুই তো এর ওপর আবার ঠাস ঠাস কথা শুনিয়েছিস মেয়েটাকে, যা নয় তাই বলেছিস।

সেকথা শঙ্কর সারাভাইয়ের এক-এক বার যে মনে হয় নি তা নয়। নিজের আর যশোমতীরও অনেক কথাই মনে পড়ছে তার। আর কেমন যেন অজ্ঞাত অস্বস্তি একটু। তাই তার ফলে যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর মাথা না ঘামাতেই চেষ্টা করেছে সে।

ভাঙা কারখানা-ঘরে এসে বসেছে। সেই ভাঙা ঘর চোখের সামনে চকচকে ঝকঝকে নতুন হয়ে উঠছে যেন। পুরনো মেশিনের জায়গায় নতুন মেশিন দেখছে সে। একটার জায়গায় তিনটে দেখছে। চোখের সামনে একটা ভর ভরতি ফ্যাক্টরি দেখছে।

রাতে ভালো ঘুম হল না। পরদিন সকালে পুকুরে চান করতে করতে বুকের তলায় কেমন যেন খচ করে উঠল একটু।….ভাগ্নের হাত ধরে হাসিমুখে একজন এসে দাঁড়াত। কালও দাঁড়িয়েছিল। ঘুম ভাঙলেই মুখ-হাত ধুয়ে চলে আসত। মুখখানা ভেজা-ভেজা লাগত। দু’দিন যেতে শঙ্কর বলতে গেলে অপেক্ষাই করত তার জন্যে।

আর কেউ এসে দাঁড়াবে না।

না, ভাবতে গেলেই কেমন অস্বস্তি। বড়লোকের মেয়ের ভাবনায় কাজ নেই।

তাড়াতাড়ি চান সেরে কারখানা-ঘরে গিয়ে ঢুকল। সকাল আটটা বাজতে বিহারী খাবার নিয়ে এলো। শঙ্করের আর একবার মনে হল যশোমতীর কথা। সে-ই খাবার নিয়ে আসত। এই স্মৃতিটাও শঙ্কর বাতিল করে দিল তক্ষুনি। ফ্যাক্টরিটা এবারে কোন্ প্ল্যানে দাঁড় করাবে সোৎসাহে বিহারীর সঙ্গেই সেই আলোচনা শুরু করে দিল। দেরি হয়ে যাচ্ছে খেয়াল ছিল না, খেয়াল হতেই ছুটল স্টেশনের দিকে।

ট্রেন থেকে নেমে বাসে চেপে ব্যাঙ্কে যখন এলো, তখন বারোটা বেজে গেছে। বুকের ভিতরটা দুরুদুরু করতে লেগেছে আবার। ব্যাঙ্কে চেক পেশ করতে একজন বলল, আজ তো হবে না….শনিবার, সময় পার হয়ে গেছে।

শঙ্কর সারাভাই যেন বড়সড় ধাক্কা খেল একটা। বার-টার সব ভুল হয়ে গেছে তার। টাকাটা সোমবার পাবে তাহলে। পেয়ে এইখানেই আবার নিজের নামে জমা করে যাবে।….কিন্তু পাবে তো?

দ্বিধা কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করল, চেকটা দেখুন তো, সোমবার এলে টাকাটা পাওয়া যাবে তো?

ভদ্রলোক চেকটার দিকে ভালো করে তাকালো একবার। টাকার অঙ্ক দেখে তার চক্ষুস্থির হল একটু। বেয়ারার চেকে এত টাকার চেক কাটা হয়েছে, এ যেন কেমন লাগল তার। শঙ্কর সারাভাইকে এক নজর দেখে নিল ভালো করে। পঞ্চাশ হাজার টাকা নেবার মত মর্যাদাসম্পন্ন লাগল না তাকেও। কৌতূহলবশতই খাতা খুলে চেক দাত্রীর সইটা মেলাল সে। মিলল বটে, কিন্তু দ্রুত স্বাক্ষর গোছের লাগল।

তাকে অপেক্ষা করতে বলে চেক হাতে নিয়ে লোকটি এক কোণে চলে গেল। শঙ্কর সারাভাই দেখল সে ফোন কানে তুলে নিয়েছে।

হ্যাঁ, চেক যে কেটেছে, অর্থাৎ চন্দ্রশেখর-কন্যা যশোমতীকেই ফোন করল সে।….এ রকম একটা চেক এসেছে, পেমেন্ট হবে কিনা।

–হবে। দিয়ে দিন। ঝপ করে টেলিফোনের রিসিভার প্রায় ছুঁড়েই ফেলেছে যশোমতী।

লোকটি ফিরে এসে বলেছে, সোমবার পেমেন্ট হবে, বেলা একটার মধ্যে আসবেন।

সেদিনও শঙ্কর মেসোর বাড়িতে গেল না। বাড়িই ফিরল। টাকাটা যে পাওয়া যাবে তা বোঝা গেল। নিশ্চিত বোধ করতে চেষ্টা করল। কিন্তু বিপুল আনন্দের বদলে কি রকম যে লাগছে সে ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারছে না।

পরদিন চানের সময় আবারও একটা মিষ্টি স্মৃতি চোখে ভেসে উঠল। ওদিকে রাজু দিন-রাতই মাসির কথা বলছে। সকালের খাবার সময় তাকে মনে পড়ে। দুপুরেও। কি কথা হত, কিভাবে কথা কাটাকাটি হত। শঙ্কর কাজ ভুলে গেল। গোড়ার দিনে বাসের যোগাযোগ থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত খুটিনাটি কত কি যে মনে পড়তে লাগল ঠিক নেই। শঙ্কর সারাভাই আপন মনে মিটিমিটি হাসে এক একসময়। চাকরির জন্যে দেখা করতে গিয়ে ওভাবে স্কুল থেকে চলে আসার কথা মনে পড়তে বেশ জোরেই হেসে উঠেছিল। কেন যে কাগজ হাতে নিয়েই অমন উধ্বশ্বাসে পালিয়েছিল, সেটা এখন আর বুঝতে বাকি নেই।

দুপুর না গড়াতে প্রায় লাফাতে লাফাতে মেসো এসে হাজির। সঙ্গে মাসি। তার হাজার টাকার সম্বন্ধে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করল না কেউ। আনন্দে আটখানা দুজনেই। একটা কাজের মতো কাজ করেছে শঙ্কর। তার আত্মীয় বলে বড়কর্তার কাছে মেসোরই নাকি কদর বেড়ে গেছে। মেসো বার বার অফিসে গিয়ে তাকে বড়সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে বলে গেল। আর দিদিকে বলে গেল, তার ভাই ইচ্ছে করলেই বড়সাহেবের মিলের একজন পদস্থ অফিসার হয়ে বসতে পারে এখন। চন্দ্রশেখর পাঠক নিজেই নাকি শঙ্করের মেসোকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করেছে।

আশ্চর্য, সোমবারেও চেক ভাঙাতে যাওয়া হল না শঙ্কর সারাভাইয়ের। হল না বলে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত। না যাওয়ার কোন কারণ ছিল না। হঠাৎ কেমন মনে হল, আজ না ভাঙিয়ে কাল ভাঙালেই বা ক্ষতি কি।

কিন্তু ওই একদিনে মনের কোণের সেই অজ্ঞাত অস্বতিটা যেন চারগুণ স্পষ্ট হয়ে ছেকে ধরতে লাগল তাকে। যশোমতীকে নিয়ে ফেরার সময়ে ট্রেনের দৃশ্যটা মনে পড়ল। হ্যাঁ, শঙ্কর জানে যশোমতীর সেই দৃষ্টিতে শুধু ঘৃণা ছাড়া আর কিছু ছিল না।….আর তারপর সেই চেক লিখে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার দৃশ্যটা চোখে ভাসতেই বুকের ভিতরে মোচড় পাড়তে লাগল। যেভাবে দিয়েছে–কোনো ভিখিরিকেও কেউ ও-ভাবে কিছু দেয় না।

সমস্ত রাত জেগে ছটফট করল শঙ্কর সারাভাই। নিজের সঙ্গেই ক্রমাগত যুঝছে সে। ভাবীকালের ফ্যাক্টরির চিত্রটা বিরাট করে দেখতে চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরেই যা আছে বর্তমানে, সেটাই যেন হাঁ করে গিলতে আসছে তাকে। না, শঙ্কর এই দারিদ্র্য আর সহ্য করতে পারবে না।

পরদিন সময়মতোই ট্রেন ধরল। সময় মতোই ব্যাঙ্কে পৌঁছুল। কিন্তু কি যে হল একমুহূর্তে কে জানে। কি এক দুর্ভর যাতনা আর যেন সে সহ্য করে উঠতে পারছে না।

চেক পকেটে নিয়েই সে সোজা চলে এলো চন্দ্রশেখরের বাড়িতে। কর্তা বাড়ি নেই। মেয়েকে ডেকে পাঠালো।

কিন্তু মেয়ে নিজেই তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে। যশোমতী আনলে লাফিয়ে উঠেছিল প্রায়। পরক্ষণে নিদারুণ আক্রোশ। এই লোক তার যেমন ক্ষতি করেছে তেমন যেন আর কেউ কখনো করে নি। চাকর এসে কিছু বলার ফুরসত পেল না। যশোমতী ঝাঁঝিয়ে উঠল, যেতে বলে দাও, দেখা হবে না।

চাকর হুকুম পালন করল। এসে জানালো দেখা হবে না।

শঙ্কর সারাভাই স্থির দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে ফিরে চলল।

জানলায় দাঁড়িয়ে যশোমতী দেখছে। তার চোখ-মুখ জ্বলছে।

 রাতে বাড়ি ফিরে শঙ্কর দিদিকে শুধু বলল, চেকটা চন্দ্রশেখর বাবুকে ফেরত দিয়ে এলাম। মেয়েকেই দিতে গেছলাম, সে দেখা করল না, তাই অফিসে গিয়ে তার বাবার হাতেই দিয়ে এলাম।

দিদি হতভম্ব কিন্তু একটি কথাও আর জিজ্ঞাসা করতে পারল না। ভাইয়ের পরিবর্তনটা এ ক’দিন সে খুব ভালো করেই লক্ষ্য করেছে।

.

জ্বালা জ্বালা-যশোমতীর বুকে রাজ্যের জ্বালা। তাকে দ্বিগুণ হাসতে হচ্ছে, দ্বিগুণ হৈ-চৈ করে বেড়াতে হচ্ছে। বাড়ির লোকেরা মাসের কতকগুলো দিন মুছে দিতে পেরেছে, ও পারছে না কেন? বাবা আবার ভাবা শুরু করেছে, বিশ্বনাথ যাজ্ঞিকের সঙ্গে এবারে বিয়ের আলোচনায় এগোলে হয়। মা রমেশ চতুর্বেদীকে বিয়ে করার জন্যে আগের মতোই তাকে তাতিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে। দাদা আবার তার শালা বীরেন্দ্র যোশর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠছে। শিবজী দেশাই আর ত্রিবিক্রম ঘন ঘন দেখা করার ফাঁক খুজছে।

সকলেই ডাকছে তাকে। সকলেই সাদরে নেমন্তন্ন করছে। নিজের বন্ধুরা, মায়ের বন্ধুরা। বাড়ি থেকে পালিয়ে যশোমতী যেন মন্ত একটা কাজ করে ফেলেছে। এদিকে বাবা-মা রীতিমত তোয়াজ করে চলেছে তাকে।

কিন্তু ভালো লাগে না। যশোমতীর কিছু ভালো লাগে না। সকালে ঘুম ভাঙলেই পুকুরঘাটে স্নানরত এক পুরুষের শুচি মূর্তি চোখে ভাসে বলেই যত যাতনা। এক কচি শিশুর ‘মাসি’ ডাক কানে লেগেই আছে। আর সেই ভাঙা কারখানায় কর্মরত পুরুষের মূর্তি আর তার রাগ আর তার অসহিষ্ণুতার স্মৃতি কতবার যে মন থেকে উপড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করেছে আর করছে, ঠিক নেই। লোকটা টাকা ছাড়া আর কিছু চেনে না, টাকা ছাড়া আর কিছু দেখতে শেখে নি–টাকার লোভে সে যেন তাকে জীবনের সব থেকে চরম অপমান করেছে। তাকে সে জীবনে ক্ষমা করবে না। কিন্তু তবু, তবু পুরুষের সেই সবল সংগ্রামের স্মৃতি কিছুতে ভুলতে পারে না। গাঁয়ের সেই কটা দিন যেন এক অক্ষয় সম্পদ। সেই সম্পদের ওপর এমন লোভের কালি মাখিয়েছে যে, তাকে সে ক্ষমা করবে কি করে?

অথচ এদিকে জলো লাগে সব। এই সম্পদ, এই আভিজাত্যে মোড়া দিন–এ-যে এত নিষ্প্রাণ এ-কি আগে জানত? ব্যাঙ্ক থেকে যেদিন তাকে ফোনে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল টাকা দেওয়া হবে কিনা, সেইদিন লোকটার ওপর যেমন দুর্বার আক্রোশে ঝলসে উঠেছিল তেমনি রাগও হয়েছিল নির্লজ্জের মতন আবার যেদিন সে দেখা করতে এসেছিল। তাকে দেখামাত্র মুহূর্তের জন্য যে আনন্দের অনুভূতি মনে জেগেছিল সেই জন্যে নিজেকেই যেন ক্ষমা করতে পারেনি যশোমতী।

টাকা-সর্বস্ব লোভ-সব অপদার্থ কোথাকার। ওই ভাবে অপমান করে তাকে বিদায় করতে পেরে একটু যেন জ্বালা জুড়িয়েছিল যশোমতীর।

কিন্তু তার এই মানসিক পরিবর্তনের ওপর কেউ যে তীক্ষ্ণ চোখ রেখেছে, যশোমতী তা জানেও না।

তার বাবা-মা।

চন্দ্রশেখর পাঠক চিন্তিত হয়েছে। আরো অবাক হয়েছে ছেলেটা অমন বেয়াড়া মুখে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেকটা ফেরত দিয়ে যেতে। বুদ্ধিমান মানুষ, মেয়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই টাকা ফেরত দেওয়াটা খুব বিচ্ছিন্ন করে দেখল না সে। একটা নিগুঢ় চিন্তা তার মনে উঁকি ঝুঁকি দিতে লাগল। যত টাকা আর যত প্রতিপত্তিই থাকুক, সে ব্রাহ্মণ মানুষ, অব্রাহ্মণ কোনো ছেলের হাতে মেয়ে দেওয়ার কথা সে চিন্তাও করতে পারে না। আর এই ব্যাপারে তার স্ত্রী তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

তাই টাকা ফেরত দেওয়া প্রসঙ্গে মেয়েকে কিছুই বলল না। ভদ্রলোক। তার মেসোর কাছে ছেলেটার সম্পর্কে খোঁজখবর নিল একটু। এবং প্রত্যেক দিনই তার চিন্তা বাড়তে লাগল। মেয়ে যেন তার সেই মেয়েই নয়। ভেবেচিন্তে দিন কয়েক বাদে মেসোর মারফত শঙ্কর সারাভাইকে ডেকে পাঠালো চন্দ্রশেখর পাঠক। প্রকারান্তরে ছেলেটিকে একটু বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। পঞ্চাশ হাজার টাকা তাকে আবার দিয়ে সেই সঙ্গে আরো বড় কিছু বিত্তের লোভ দেখিয়ে তাকে বশ করে এবাধা দূর করা যায় কিনা, সেই চেষ্টাটাই তার মাথায় এলো।

ওদিকে স্ত্রীও সহায়তা করল একটু। মেয়ের উদ্দেশে বার দুই বলল, গরীবের ছেলে, তোকে আদর-যত্ন করে রেখেছিল–খুব ভালো মনে হল।….কিন্তু অব্রাহ্মণের বাড়িতে এতদিন ভাত-টাত খেলি ভাবলেই কেমন খারাপ লাগে।

দ্বিতীয়বার এই কথা শুনে মেয়ে চটেই গেল।–প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না কি করতে হবে বলো?

মা আর ঘাঁটাতে সাহস করল না। সন্ধ্যার পর বাবা এসে বলল, ওই শঙ্কর ছেলেটিকে কাল একবার দেখা করতে বললাম, দেখি যদি কিছু করতে পারি।

যশোমতী চাপা রাগে ফুঁসে উঠল তৎক্ষণাৎ।– কেন, টাকা তো পেয়েছে, আবার কি করতে হবে?

চন্দ্রশেখরের আশা, ছেলেটা যদি আরো বড় টোপ গেলে। তাই টাকাটা ফেরত দেবার কথাটা বলি-বলি করেও বলল না। কিছু গ্রহণ না করার বৈশিষ্ট্যটা মেয়ের কাছে নিষ্প্রভ করে দিতেই চায় সে।

পরদিন বা অফিসে চলে যাবার পরেও যশোমতী গুম হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ কি মনে পড়তে উঠে পড়ল। বেরুবে। আধ-ঘণ্টার মধ্যেই প্রকাণ্ড ঝকঝকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েই পড়ল। বড় একটা স্টেশনারি দোকান থেকে অনেক দাম দিয়ে ছোট ছেলেদের একটা মোটর আর সাইকেল কিনল। সঙ্গে আরো টাকা আছে, বিহারীকে দেবে। বিহারীর দেশের বাড়ি-ঘরের সমস্যার কথা শুনে তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসেছিল। তারপর টানা মোটরেই সেই পরিচিত গ্রামে চলে এলো।

বাড়ির দোরের আঙিনায় হঠাৎ অমন একটা গাড়ি এসে থামতে দেখে দিদি অবাক হয়েছিল। ছেলে চেঁচামেচি করে উঠল, মাসি এসেছে।

গাড়ি থেকে নামল যশোমতী। চোখে জল আসতে চাইছে কেন জানে না। ভিতরে ভিতরে জ্বলে যাচ্ছে আবার। তাকে দেখে দিদির মুখে কথা সরল না হঠাৎ। ওদিকে ড্রাইভার রাজুর মোটর আর সাইকেল নামাতে সে আনন্দে লাফালাফি নাচানাচি শুরু করে দিল।

দিদি কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ঘরে এনে বসালো তাকে। ভাইকে অপমান করেছে, দেখা করে নি, অথচ নিজেই বাড়ি বয়ে চলে এলো।

বলল, শঙ্কর মেসোমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছে, তিনি বিশেষ করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

যশোমতী হাসিমুখেই বলে বসল, তিনি আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, বিশেষ করে বাবাই ডেকে পাঠিয়েছেন।

দিদি জানে। তবু মেসোমশাই ও-ভাবে অনুরোধ না করলে ভাই যে যেত না, সেটা আর বলল না। যশোমতী রাজুর সঙ্গে খেলা শুরু করে দিল। তাকে তার মোটর চালাতে শেখাল, সাইকেল চড়তে সাহায্য করল। তারপর ফাঁক মতো বিহারীকে ধরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কারখানার চেহারা কতখানি বদলানো হয়েছে সেই কৌতূহলও কম নয়।

কিন্তু দিদিও এলো সঙ্গে সঙ্গে।

ফ্যাক্টরির ভিতরে ঢুকে যশোমতী অবাক একটু। আরো যেন ছন্নছাড়া চেহারা হয়েছে ভিতরটা, ক’দিনের মধ্যে কিছু কাজ হয়েছে কিনা সন্দেহ।

বলেই ফেলল, সেই রকমই দেখি আছে, নতুন কিছুই তো হয় নি এখন পর্যন্ত–

দিদি ঠাণ্ডা জবাব দিল, কোত্থেকে আর হবে বলো, ক’দিন তো বই আছে।

সঙ্গে সঙ্গে ঈষৎ তীক্ষ্ণকণ্ঠে যশোমতী বলে উঠল, কেন? টাকা হাতে পেয়ে আর খরচ করতে ইচ্ছে করছে না?

দিদি বিমূঢ় প্রথম। তারপর বলল, তোমার দেওয়া চেক তো তোমার বাবার হাতে শঙ্কর ফেরত দিয়ে এসেছে, তোমার বাবা বলেন নি?

সেই মুহূর্তে কার সঙ্গে কথা বলছে তাও যেন ভুলে গেল যশোমতী। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, কক্ষনো না। ব্যাঙ্কের লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল টাকা দেবে কিনা, আমি নিজে দিতে বলে দিয়েছি।

দিদি যেন হকচকিয়ে চেয়ে রইল কয়েক নিমেষ। তারপর আত্মস্থ হল। সংযত হবার চেষ্টায় মুখ ঈষৎ লাল। বলল, তোমরা বড়লোক, তোমাদের টাকার কোন লেখাজোখা নেই শুনেছি। এই জন্যেই বোধহয় টাকার জন্যে গরীবেরা অনায়াসে মিথ্যে কথা বলতে পারে বলে ভাব তোমরা।

এবারে যশোমতীর বিস্ময়ের অন্ত নেই। ঘাবড়েই গেল সে। দিদি ডাকল, বিহারী, এদিকে আয়–

সোজা বাড়ির উঠোনে এসে আঁড়াল সে। পিছনে বিহারী আর সেই সঙ্গে যশোমতীও।

-ওই মোটর আর সাইকেল গাড়িতে তুলে দে। যশোমতীর দিকে ফিল, শঙ্কর এসে দেখলে রাগ করবে, তাছাড়া গরীবের ছেলের এসব লোভ থাকলে অসুবিধে–

যশোমতী কাঠ। পাঁচ বছরের রাজুও হতভম্ব হঠাৎ। ওইটুকু ছেলের মুখের আনন্দের আলো নিভেছে। অথচ মায়ের মুখের দিকে চেয়ে সাহস করে একটু প্রতিবাদও করতে পারছে না। বিমূঢ় বিহারী সত্যিই ওগুলো নেবার জন্যে হাত বাড়াতে ছেলেটার দিকে চেয়ে বুকের ভিতরটা ফেটে যাবার উপক্রম যশোমতীর।

হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে দিদির পায়ের কাছে বসে পড়ল যশোমতী। তার পা দুটো জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

দিদি সরবার অবকাশ পেল না। আঁতকেই উঠল।–ছি ছি বামুনের মেয়ে। তাড়াতাড়ি হাত ধরে টেনে তুলল তাকে। তারপর চেয়ে রইল। মুখখানা শান্ত কমনীয় হয়ে উঠল। বিহারীকে বলল, থাক তুলতে হবে না।

বাড়ি ফিরে যশোমতী হাতের প্যাকেটটা প্রথমে যত্ন করে তুলে রাখল। আসার সময় এটা সে দিদির কাছ থেকে চেয়ে এনেছে। ওতে আছে দুটো শাড়ি যে শাড়ি দুটো শঙ্কর সারাভাই নিজের হাতে তৈরি করে তাকে দিয়েছিল। তারপরেও নিজেকে সংযত করার জন্যেই ঘরে বসে রইল খানিক। তারপর বাবার কাছে এলো।

খুব ঠাণ্ডা মুখে জিজ্ঞাসা করল, শঙ্করবাবু সেই পঞ্চাশ হাজার টাকার চেকটা তোমার কাছে ফেরত দিয়ে গেছেন?

মেয়ের প্রশ্নের ধরনটা ভাল ঠেকল না কানে, চন্দ্রশেখর পাঠক এই প্রথম যেন পরিবারের কারো কাছে বিচলিত বোধ করল একটু। বলল হ্যাঁ, ছেলেটা কেমন যেন….

–ফেরত দিয়ে গেছেন আমাকে বলো নি তো?

–ওকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে আবার সেটা দিয়ে দেব ভেবেই বলি নি। ওর মেসোর সঙ্গে সেই রকমই কথা হল, তাছাড়া আরো কিছু করা যায় কিনা ওর জন্যে ভাবছিলাম….সেই জন্যেই তো আজ ডেকে পাঠিয়েছিলাম।

–চেক আজ দিতে পারলে?

বিব্রত মুখে চন্দ্রশেখরবাবু মাথা নাড়ল। পারেনি।

–আর, আর-কিছুও করতে পারলে?

নিজের চিন্তাধারার ব্যতিক্রম দেখে অভ্যস্ত নয় চন্দ্রশেখর পাঠক। তাই ঈষৎ বিরক্ত মুখে জবাব দিল, না, ছেলেটাকে খুব বুদ্ধিমান মনে হল না, কথাই শোনে না ভালো করে।

আরো একটু দাঁড়িয়ে বাবাকে দেখল যশোমতী। তার রাগ হবে কি, এক উৎকট আনন্দে বুকের ভিতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। এ আনন্দ যেন ধরে রাখা যাচ্ছে না। জীবনে এমন আনন্দ এই যেন প্রথমে।

.

১০.

দেব-উঠি-আগিয়ারস্।

সাবরমতীর মেলা। দেবতা উঠবেন। লোকে লোকারণ্য। এরই মধ্যে যশোমতী একটু ফাঁক খুঁজে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। সঙ্গে কেউ নেই আর। বাড়ির কেউ জানেও না। একা এসেছে। অপেক্ষা করছে।

চিঠির জবাব পায় নি যশোমতী। ছোট্ট দু’লাইন চিঠি লিখেছিল দিনকতক আগে। লিখেছিল, এর পরেও দেখা হবে আমি আশা করছি। দেবোত্থান একাদশীতে সাবরমতীতে আসার কথা ছিল। পুজো দেবার কথা ছিল। আমি অপেক্ষা করব।

অপেক্ষা করছে। নিশ্চিত জানে সে আসবে। দেখা হবে।

 এলো। দেখা হল।

চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। গম্ভীর। কিন্তু সেও পুরুষের ক্লান্তি। পুরুষের গাম্ভীর্য।

আশ্চর্য, সমুদ্র-পরিমাণ কান্না চেপেও যশোমতী হাসতে পারছে। হাসছে। একটু কাছে এগিয়ে এলো। চোখে চোখ রেখে বলল, অপেক্ষা করছি।

শঙ্কর সারাভাই জবাব দিল না। চুপচাপ চেয়ে আছে।

যশোমতীর তাড়ায় নদীতে নেমে চান করতে হল শঙ্করকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যশোমতী দেখতে লাগল। নদীর জলে অগণিত মাথার মধ্যে শুধু একজনকেই দেখছে সে।

চানের পর যশোমতী পুজো দেবার কথা বলল।

শঙ্কর সারাভাই জিজ্ঞাসা করল, কি জন্যে পুজো?

–যে জন্যে কথা ছিল। তেমনি চোখে চোখ রেখেই কথা বলছে যশোমতী। হাসছে। বলল, সত্যিকারের পুরুষমানুষ কথা দিয়ে কথার খেলাপ করে না–বিশেষ করে অবলা রমণীকে কথা দিলে। আজই বিকেলে ফিরে গিয়ে কটন চেম্বারের এগজিবিশনের শাড়িতে হাত দেবার কথা ছিল।

শঙ্করের মুখখানা গম্ভীর, কিন্তু ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা উঁকি দিতে চাইল একটু। বলল, কথা ছিল, কিন্তু এরপর আপনাদের অনুকম্পা আমার খুব ভালো লাগবে না।

যশোমতী গম্ভীর।–আপনাদের বলতে একজন তো আমি, আর সব কারা?

মুখের হাসি আরো একটু স্পষ্ট হল শঙ্করের। বলল, আপনার বাবা, আপনার মা

তাদের অনুকম্পা তো কত নিয়েছেন আপনি। আপনি চাইলে ওই কটু চেম্বারের পঁচিশ হাজার টাকা ছেড়ে আমি আপনাকে দু’পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে পারি। আপনিও চাইবেন না, আমিও এক পয়সা দেব না। অনুকম্পা বলছেন কেন, এখন আমার শিক্ষা হয় নি বলতে চান?

শঙ্কর সারাভাই পুজো দিল। যশোমতী নীরবে অপেক্ষা করল ততক্ষণ। পুজো শেষ হতে যশোমতী জিজ্ঞাসা করল, এখন কি করবেন?

বাড়ি যাব।

বাড়ি গিয়ে?

হেসেই শঙ্কর সারাভাই জবাব দিল, আপনার হুকুম পালন করব, মানে কারখানায় গিয়ে ঢুকব–

খাওয়া দাওয়া?

–তার পরে।

–কত পরে?

 শঙ্কর সারাভাইয়ের টানা বিষণ্ণ দুই চোখ আস্তে আস্তে তার মুখের উপর স্থির হল।হঠাৎ আমার ওপর আপনার এই অনুকম্পা কেন?

অনুকম্পা!

অস্ফুট কণ্ঠস্বরে, চোখে মুখে এক অব্যক্ত বেদনার ছায়া দেখল শঙ্কর সারাভাই। বলল, আপনিও সকাল থেকে না খেয়ে আছেন তো?

সেটা অনুকম্পা?

শঙ্কর সারাভাই চুপচাপ চেয়ে রইল খানিক। কি দেখল বা কি বুঝল সে-ই জানে। হাসল একটু।–আচ্ছা, আর বলব না। বাড়ি গিয়ে খেয়ে নেবেন। মিথ্যে কষ্ট পাবেন না।

যশোমতীর দুই ঠোঁটের ফাঁকে এবারে হাসির নাভাস একটু। জবাব দিল, কষ্ট পাওয়া কপালে থাকলে আর খাবো কি করে। বেশি কষ্ট যদি না দিতে চান তাহলে শুভ কাজ শুরু করা হলেই আগে খেয়ে নেবেন।

অর্থাৎ, তার আগে পর্যন্ত তারও মুখে আহার রুচবে না। শঙ্কর সারাভাই বিব্রত বোধ করল। কিন্তু এ নিয়ে আর কথা বাড়াতে মন সরল না। এই প্রাপ্তিটুকু নিঃশব্দে অনুভব করার মতোই শুধু। বলল, আচ্ছা।

কথা দিচ্ছেন?

হ্যা।

আর দেরি করে কাজ নেই তাহলে, চলুন আপনাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তারপর বাড়ি যাব।

এবারেও বাধা দিতে পারল না শঙ্কর সারাভাই। ট্যাক্সি করে দু’জনে স্টেশনে এলো। গাড়ি আড়াল না হওয়া পর্যন্ত হাসি মুখে যশোমতী স্টেশনে দাঁড়িয়েই থাকল।

কথা রেখেছে। বাড়ি ফিরে শঙ্কর সারাভাই কথা রেখেছে। বিহারীকে নিয়ে সোজা ফ্যাক্টরি ঘরে ঢুকে শুভ কাজে হাত দিয়েছে। একটু বাদে বিহারীর বিস্মিত চোখের ওপরেই কাজ বন্ধ করে খেতে গেছে।

তারপর ক’দিন তার এই কাজের তন্ময়তা লক্ষ্য করে করে দিদির খটকা লাগল কেমন। জিজ্ঞাসা করল, নতুন অর্ডার-টর্ডার পেলি নাকি কিছু?

শঙ্কর সারাভাই হাসি মুখেই দিদিকে জানিয়েছে ব্যাপারটা। তারপর বলেছে, পঁচিশ হাজার টাকা এবারে ঘরে আসছে, এটা ধরে নিতে পারো।

দিদি চেয়ে আছে। ভাইয়ের মুখের হাসি দেখছে। ওই হাসির আড়ালে পঁচিশ হাজার টাকা যে আসছে সেই আনন্দের ছিটে ফোঁটাও চোখে পড়ল না।

দিদি জিজ্ঞাসা করল, এগজিবিশনে শাড়ি পাঠাচ্ছিস কেন?

 শঙ্কর সারাভাই আবারও হাসল শুধু একটু, জবাব দিল না।

.

কিন্তু কটন চেম্বারের পঁচিশ হাজার টাকার প্রাইজ শঙ্কর সারাভাই পায় নি। পাবেই যে সেটা স্থিরনিশ্চিত জেনেও সমস্ত একাগ্রতা দিয়েই শাড়িটা শেষ করেছিল। আর মনে মনে আশা করেছিল, সঠিক বিচার হোক না হোক, মানের দিক থেকেও সে খুব পিছিয়ে পড়ে নি।

কিন্তু কাগজে যার শাড়ি প্রথম হয়েছে তার নাম দেখে সে অবাক হয়েছে। সেই নাম শঙ্কর সারভাইয়ের নয়। অপরিচিত একজনের। তার নাম দ্বিতীয়। সে শুধু সার্টিফিকেট পাবে।

বার বার পড়েছে খবরটা শঙ্কর সারাভাই। আর, শুধু হেসেছে নিজের মনে। এমন প্রসন্ন হাসি অনেক দিন তার মুখে দেখা যায় নি। কাগজে খবরটা দেখার পরেই সে যেন নিশ্চিত জেনেছে, কটন চেম্বারের পুরস্কারের বিচার এই প্রথম যথাযোগ্য হয়েছে। মান বিচারে এতটুকু কারচুপি হয় নি।

যশোমতী পাঠক হতে দেয় নি।

তাই সাগ্রহে সার্টিফিকেট নিতেই উৎসবে এসেছে শঙ্কর সারাভাই। এত আগ্রহ নিয়ে আসার আরো কারণ আছে। অন্যান্যবার পুরস্কার দিয়েছে মিসেস চন্দ্রশেখর পাঠক, কিন্তু কাগজের ঘোষণায় দেখা গেল এবারে পুরস্কার দেবে চেম্বার-প্রেসিডেন্টের কন্যা যশোমতী পাঠক।

প্রতিবারের মতোই সেই সাড়ম্বর অনুষ্ঠান। সাজের বাহারে ঝলমল করছে চেম্বারের সামনের বিরাট আঙিনা। প্যাণ্ডেলের আলোর বন্যা দিনের আলোকে হার মানিয়েছে। গোটা দেশের মানী জনের সমাবেশ।

এর মধ্যে প্রেসিডেন্টের পাশে পুরস্কার-দাত্রীকে দেখে অবাকই হয়েছে বহু বিশিষ্ট মেয়ে-পুরুষ। না, ঠিক যশোমতীকে দেখে নয়। এমন সমাবেশে তার সাজসজ্জা দেখে। বাড়িতে অবাক হয়েছিল যশোমতীর বাবা-মা। এখানে সকলে।

কাছাকাছি এক সারিতে বসে নিষ্পলক তার দিকে চেয়ে ছিল শঙ্কর সারাভাই। যশোমতীর গায়ে শুধু সেই গয়না, যে ক’টি গয়না পরে সে একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর তার পরনে সেই শাড়ি দুটোর একটা, যা শঙ্কর নিজের হাতে তাকে তৈরি করে দিয়েছিল। আর, যশোমতী ডায়াসে ওঠার সময় শঙ্করের বিমূঢ় দৃষ্টিটা তার পায়ের দিকেও পড়েছিল একবার। পায়ে সেই স্যাণ্ডেলজোড়া–যশোমতীকে তার ঘর-ছাড়া করার দিন যেটা সে তাড়াহুড়ো করে কিনে এনে দিয়েছিল।

প্রাথমিক বক্তৃতা আর অনুষ্ঠানাদির পর প্রথম পুরস্কৃতের নাম ঘোষণা হতে সেই ভদ্রলোক উঠে এগিয়ে এলো। যশোমতী বাড়িয়ে হাসিমুখে পঁচিশ হাজার টাকার চেক সমর্পণ করল তার হাতে।

দ্বিতীয় নাম ঘোষণা হল। শঙ্কর সারাভাই–

যশোমতী তখনো জানে না সে এসেছে কিনা। শুধু আশা করছিল আসবে। এত ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়া কঠিন। কিন্তু আগেও তার দুচোখ থেকে থেকে কাকে খুঁজেছিল, শঙ্কর সারাভাই জানে। সে উঠল। এগলো।

সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে যশোমতী দাঁড়িয়ে আছে।

 শঙ্কর সারাভাই এগিয়ে গেল। দেখছে দু’জনে দু’জনকে।

সার্টিফিকেটটা হাতে দেবার আগে সমাগত অভ্যাগতদের উদ্দেশে যশোমতী কয়েকটি মাত্র কথা বলল। বলল, আজ প্রথম পুরস্কার যিনি পেলেন তিনি অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু প্রথম পুরস্কার যিনি পেলেন না, তাঁরও চেষ্টার পুরুষকার একদিন ঠিক এই সার্থকতায় সফল হবে, তাতে আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। তার সেই চেষ্টার সঙ্গে আমার সমস্ত অন্তর যুক্ত থাকল।

চারদিক থেকে বিপুল করতালি।

সার্টিফিকেট নেবার জন্য দু’হাত বাড়াল শঙ্কর সারাভাই। দু’হাতে সার্টিফিকেট নিয়ে যশোমতী সার্টিফিকেটসহ নিজের হাত দুটিই রাখল তার হাতের ওপর। কে দেখছে যশোমতী জানে না। কে দেখছে শঙ্কর সারাভাই জানে না।

….কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। কয়েকটি নিমেষের নিষ্পলক দৃষ্টি বিনিময়।

.

১১.

 আসার সময় সাবরমতী দেখেছিলাম, আর, যশোমতীকে দেখছিলাম।

স্টেশনে অতিথি-বিদায়ের ঘটাটা মন্দ হল না। আমাকে গাড়িতে তুলে দেবার জন্য যশোমতী পাঠক এসেছে, শঙ্কর সারাভাই এসেছে, ত্রিপুরারি এসেছে, এখনকার নতুন বন্ধুরাও দু-পাঁচ জন এসেছে।

যশোমতীকে কিছু বলার ফাঁক খুজছিলাম আমি। ফাঁক পেলাম। বললাম, আপনার ট্রাজেডি পছন্দ নয় বলেছিলেন, এবারে লিখি যদি কিছু, সেটা কমেডিই হোক। কি বলেন?

শুনে হঠাৎ যেন এক প্রস্থ থতমত খেয়ে উঠল যশোমতী। তার পরেই সমস্ত মুখে সিদুরের আভা। সবেগে মাথা নেড়ে বলে উঠল, না, কক্ষনো না!

কাছেই ছিল শঙ্কর সারাভাই। সকৌতুকে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞাসা করল, কি হল? শুনলাম না–

তক্ষুনি চোখ পাকালো যশোমতী, চাপা গলায় বলল, সবেতে নাক গলানোর কি দরকার, ওদিকে যাও না–

হেসে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।

ট্রেন ছেড়ে দিল। সাবরমতী থেকে দূরে চললাম। সাবরমতীর নীলাভ জলের সঙ্গে কতটা ট্রাজেডির যোগ আর কতটা কমেডির, আমার জানা নেই। জানলায় ঝুঁকে যশোমতীকে দেখছি তখনো। হাসিমুখে রুমাল নাড়ছে। আর আমার মনে হচ্ছে, ট্রাজেডি হোক কমেডি হোক–দুই নিয়েই সাবরমতী পরিপূর্ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *