অষ্টম পরিচ্ছেদ – হুমায়ুন ও আফগান রাজত্ব
১
হুমায়ুন
গৌড়ে প্রবেশের পর হুমায়ুন এই বিধ্বস্ত নগরীর সংস্কারসাধনে ব্রতী হন। তিনি ইহার রাস্তাঘাট, প্রাসাদ ও দেওয়ালগুলি মেরামত করিয়া এখানেই কয়েকমাস অবস্থান করেন। গৌড় নগরীর সৌন্দর্য এবং এখানকার জলহাওয়ার উৎকর্ষ দেখিয়া হুমায়ুন মুগ্ধ হইলেন। বাংলার রাজধানীর “গৌড়” নামের অর্থ ও ঐতিহ্য সম্বন্ধে হুমায়ুন অবহিত ছিলেন না। তিনি ভাবিলেন যে ঐ শহরের নাম “গোর” (অর্থাৎ ‘কবর’)। এইজন্য তিনি “গৌড়” নগরীর নাম পরিবর্তন করিয়া জন্নতাবাদ’ (স্বর্গীয় নগর) রাখিলেন। অবশ্য এ নাম বিশেষ চলিয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। অতঃপর হুমায়ুন বাংলা দেশের বিভিন্ন অংশ তাঁহার কর্মচারীদের জায়গীর দান করিয়া এবং বিভিন্ন স্থানে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করিয়া বিলাসব্যসনে মগ্ন হইলেন।
কিন্তু ইহার অল্পকাল পরেই আফগাননায়ক শের খান সূর দক্ষিণ বিহার অধিকার করিয়া লইলেন এবং কাশী হইতে বহরাইচ পর্যন্ত যাবতীয় মোগল অধিকারভুক্ত অঞ্চলে বারবার হানা দিতে লাগিলেন। তাঁহার অশ্বারোহী সৈন্যরা গৌড় নগরীর আশপাশের উপরেও হানা দিতে লাগিল এবং ঐ নগরীর খাদ্য সরবরাহ-ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করিতে লাগিল। ইয়াকুব বেগের অধীন ৫০০০ মোগল অশ্বারোহী সৈন্যের বাহিনীকে তাহারা পরাস্ত করিল, কিন্তু শেখ বায়াজিদ তাহাদিগকে বিতাড়িত করিলেন। হুমায়ুনের সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের আর্দ্র জলবায়ু এবং ভোগবিলাসের ফলে ক্রমশ অকর্মণ্য হইয়া পড়িতে লাগিল। এদিকে হুমায়ুনের ভ্রাতা মির্জা হিন্দাল আগ্রায় বিদ্রোহ করিলেন। হুমায়ুনের অপর ভ্রাতা আসকারি হুমায়ুনের কাছে ক্রমাগত বাংলার মসলিন, খোঁজা এবং হাতি চাহিয়া চাহিয়া বিরক্ত করিতে লাগিলেন এবং আসকারির অধীন কর্মচারী ও সেনানায়কেরা বর্ধিত বেতন, উচ্চতর পদ এবং নগদ অর্থ প্রভৃতির দাবি জানাইতে লাগিলেন। হুমায়ুনের অমাত্য ও সেনানায়কেরাও খুবই দুর্বিনীত হইয়া উঠিয়াছিলেন। ইহাদের অন্যতম জাহিদ বেগকে যখন হুমায়ুন বাংলার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন, তখন জাহিদ বেগ তাহা প্রত্যাখ্যান করেন।
শেষপর্যন্ত হুমায়ুন জাহাঙ্গীর কুলী বেগকে বাংলার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন এবং স্বয়ং গৌড় ত্যাগ করিলেন। মুঙ্গেরে তিনি আসকারির অধীনস্থ বাহিনীর সহিত মিলিত হইলেন এবং গঙ্গার তীর ধরিয়া মুঙ্গেরে গেলেন। চৌসায় হুমায়ুনের সহিত শের খানের যে যুদ্ধ হইল, তাহাতে হুমায়ুন পরাজিত হইলেন এবং কোন রকমে প্রাণ বাঁচাইয়া পলায়ন করিলেন (১৫৩৯ খ্রীষ্টাব্দ)।
২
শের শাহ
হুমায়ুনের সহিত যুদ্ধে সাফল্য লাভ করিবার পর আফগান বীর শের খান সূর বাংলার দিকে রওনা হইলেন এবং অবিলম্বেই গৌড় পুনরধিকার করিলেন। হুমায়ুন কর্ত্তৃক নিযুক্ত গৌড়ের শাসনকর্ত্তা জাহাঙ্গীর কুলী বেগ শের খানের পুত্র জলাল খান এবং হাজী খান বটনী কর্ত্তৃক পরাজিত ও নিহত হইলেন (অক্টোবর, ১৫৩৯ খ্রী)। বাংলা দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মোতায়েন মোগল সৈন্যদেরও শের খানের সৈন্যেরা পরাজিত করিল এবং ঐ সমস্ত অঞ্চল অধিকার করিল। চট্টগ্রাম অঞ্চল তখনও গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহের কর্মচারীদের হাতে ছিল এবং ইহাদের মধ্যে দুইজন-খোদা বখশ খান ও হামজা খান (পর্তুগীজ বিবরণে কোদাবস্কাম এবং আমরু-আঁকাও নামে উল্লিখিত) চট্টগ্রামে অধিকার লইয়া বিবাদ করিতেছিলেন। ইহাদের বিবাদের সুযোগ লইয়া “নোগাজিল” (?) নামে শের খানের একজন সহকারী চট্টগ্রাম অধিকার করিলেন, কিন্তু পর্তুগীজ কুঠির অধ্যক্ষ নুনো ফার্নান্দেজ ফ্রীয়ার তাঁহাকে বন্দী করিলেন। “নোগাজিল” কোনক্রমে মুক্তিলাভ করিয়া পলায়ন করিলেন। চট্টগ্রাম তথা ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল আর কখনও শের খানের অধিকারভুক্ত হয় নাই। ইহার কিছুদিন পর আরাকানরাজ চট্টগ্রাম অধিকার করেন এবং ১৬৬৬ খ্রী পর্যন্ত চট্টগ্রাম আরাকানরাজের অধীনেই থাকে।
বিহার ও বাংলা অধিকার করিবার পরে শের খান ১৫৩৯ খ্রীষ্টাব্দে গৌড়ে ফরিদুদ্দীন আবুল মুজাফফর শের শাহ নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। প্রায় এক বৎসরকাল গৌড়ে বাস করিয়া এবং বাংলা দেশ শাসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করিয়া শের শাহ হুমায়ুনের সহিত সংঘর্ষে প্রবৃত্ত হইলেন এবং হুমায়ুনকে কনৌজের যুদ্ধে পরাজিত করিয়া (১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দ) ভারতবর্ষ ত্যাগ করিতে বাধ্য করিলেন। এই সব যুদ্ধ বাংলার বাহিরে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল বলিয়া এখানে তাহাদের বিবরণ দান নিষ্প্রয়োজন। অতঃপর শের শাহ ভারতবর্ষের সম্রাট হইলেন এবং দিল্লিতে তাঁহার রাজধানী স্থাপিত করিলেন। পাঁচ বৎসর রাজত্ব করিবার পর ১৫৪৫ খ্রীষ্টাব্দে শের শাহ কালিঞ্জর দুর্গ জয়ের সময়ে অগ্নিদগ্ধ হইয়া প্রাণত্যাগ করেন। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে যে সমস্ত ঘটনা ঘটিয়াছিল, তাহাদের অধিকাংশেরই বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। ১৫৪১ খ্রীষ্টাব্দে শের শাহ জানিতে পারেন যে তাঁহারই দ্বারা নিযুক্ত শাসনকর্ত্তা খিজুর খান গৌড়ের শেষ সুলতান গিয়াসুদ্দীন মাহমূদ শাহের এক কন্যাকে বিবাহ করিয়া স্বধীন সুলতানের মত আচরণ করিতেছেন এবং সিংহাসনের তুল্য উচ্চাসনে বসিতেছেন এই সংবাদ পাইয়া শের শাহ ত্বরিতে পঞ্জাব হইতে রওনা হইয়া গৌড়ে চলিয়া আসেন এবং খিজুর খানকে পদচ্যুত করিয়া কাজী ফজীলৎ বা ফজীহৎকে গৌড়ের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করেন।
শের শাহের রাজত্বকালে বাংলা দেশ অনেকগুলি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত হইয়াছিল এবং প্রতি খণ্ডে একজন করিয়া আমীর শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তার বিদ্রোহ বন্ধ করিবার জন্যই পন্থা গৃহীত হইয়াছিল। শের শাহ ভারতবর্ষের শাসনপদ্ধতির সংস্কার সাধন করিয়াছিলেন এবং রাজস্ব আদায়ের সুবন্দোবস্ত করিয়াছিলেন। সমগ্র রাজ্যকে ১১৬০০টি পরগণায় বিভক্ত করিয়া তিনি প্রতিটি পরগণায় পাঁচজন করিয়া কর্মচারী নিযুক্ত করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, বাংলা দেশও তাঁহার শাসন-সংস্কারের সুফল ভোগ করিয়াছিল। শের শাহ সিন্ধুনদের তীর হইতে পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁও পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করান*। [* এই রাজপথের মধ্যের অংশ শের শাহের বহু পূর্ব হইতেই বর্তমান ছিল।] ব্রিটিশ আমলে ঐ রাজপথ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত হয়। তবে ঐ রাজপথের সোনারগাঁও হইতে হাওড়া পর্যন্ত অংশ অনেকদিন পূর্বেই বিলুপ্ত হইয়াছে।
৩
শের শাহের বংশধরগণ
শের শাহের মৃত্যুর পরে তাঁহার পুত্র জলাল খান সূর ইসলাম শাহ নাম গ্রহণ করিয়া সুলতান হন এবং আট বৎসর কাল রাজত্ব করেন (১৫৪৫-৫৩ খ্রীষ্টাব্দ)। কালিদাস গজদানী নমে একজনা বাইস বংশীয় রাজপুত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া সুলেমান খান নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইনি ইসলাম শাহের রাজত্বকালে বাংলা দেশে আসেন এবং পূর্ববঙ্গের অংশবিশেষ অধিকার করিয়া সেখানকার স্বাধীন রাজা হইয়া বসেন। ইসলাম খান তাঁহাকে দমন করিবার জন্য তাজ খান ও দরিয়া খান নামে দুইজন সেনানায়ককে প্রেরণ করেন। ইহারা তুমুল যুদ্ধের পরে সুলেমান খানকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই সুলেমান আবার বিদ্রোহ করেন। তখন তাজ খান ও দরিয়া খান আবার সৈন্যবাহিনী লইয়া তাঁহার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং সুলেমানকে সাক্ষাৎকারে আহ্বান করিয়া বিশ্বাসঘাতকতার সহিত তাঁহাকে হত্যা করেন। অতঃপর সুলেমান খানের দুইটি পুত্রকে তাঁহারা তুরানী বণিকদের কাছে বিক্রয় করিয়া দেন।
অসমীয়া বুরঞ্জীর মতে ইসলাম শাহের রাজত্বকালে সিকন্দর সূরের ভ্রাতা কালাপাহাড় কামরূপ আক্রমণ করেন এবং হাজো ও কামাখ্যার মন্দিরগুলি বিধ্বস্ত করেন।
ইসলাম শাহের মৃত্যুর পরে তাঁহার দ্বাদশবর্ষীয় পুত্র ফিরোজ শাহ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন, কিন্তু মাত্র কয়েকদিন রাজত্ব করার পরেই শের শাহের ভ্রাতুষ্পুত্র মুবারিজ খান কর্ত্তৃক নিহত হন। মুবারিজ খান মুহম্মদ শাহ আদিল নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার নিষ্ঠুর আচরণের ফলে আফগান নায়কদের মধ্যে অনেকেই তাঁহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং আফগানদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ কলহ চরমে উঠে; অনেক ক্ষেত্রে তাঁহারা প্রকাশ্য সগ্রামে লিপ্ত হন এবং অনেক প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দুর্বল মুহম্মদ শাহ আদিল ইহাদের কোন মতেই দমন করিতে পারিলেন না।
৪
রাজনীতিক গোলযোগ
এই সময়ে (১৫৫৩ খ্রী) বাংলার আফগান শাসনকর্ত্তা ছিলেন মুহম্মদ খান। তিনি এখন স্বাধীনতা ঘোষণা করিলেন এবং শামসুদ্দীন মুহম্মদ শাহ গাজী নাম গ্রহণ করিয়া বাংলার সুলতান হইলেন। অতঃপর তিনি একদিকে আরাকানের উপর হানা দিলেন এবং অপরদিকে জৌনপুর অধিকার করিয়া আগ্রা অভিমুখে অগ্রসর হইলেন। কিন্তু মুহম্মদ শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমু তাঁহাকে ছাপরঘাটের যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করিলেন (১৫৫৫ খ্রী)। এই বিজয়ের পর মুহম্মদ শাহ আদিল শাহবাজ খানকে বাংলার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন।
শামসুদ্দীন মুহম্মদ শাহের পুত্র খিজুর খান পিতার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ঝুসিতে (এলাহাবাদের পরপারে অবস্থিত) গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ নাম গ্রহণ করিয়া নিজেকে সুলতান বলিয়া ঘোষণা করিলেন এবং শাহবাজ খানকে পরাভূত করিয়া এই দেশের অধিপতি হইলেন (১৫৫৬ খ্রী)।
ইতিমধ্যে হুমায়ুন আফগান সুলতান সিকন্দর শাহ সূরকে পরাজিত করিয়া দিল্লি ও পঞ্জাব পুনরধিকার করিয়াছিলেন এবং তাঁহার অল্প পরেই পরলোকগমন করিয়াছিলেন (২৬শে জানুয়ারী, ১৫৫৬ খ্রী)। ইহার কয়েক মাস পরে হুমায়ুনের বালক পুত্র ও উত্তরাধিকারী আকবর এবং তাঁহার অভিভাবক বৈরাম খানের সহিত মুহম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতি হিমুর পাণিপথ প্রাঙ্গণে সংগ্রাম হইল এবং তাহাতে হিমু পরাজিত ও নিহত হইলেন (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ খ্রী)। মুহম্মদ শাহ আদিল স্বয়ং পরাজিত হইয়া পূর্বদিকে পশ্চাদপসরণ করিলেন, কিন্তু (সূরজগড়ের ৪ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত) ফতেহপুরে বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহ তাঁহাকে আক্রমণ করিয়া পরাজিত ও নিহত করিলেন।
অতঃপর বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দীন জৌনপুরের দিকে অগ্রসর হইলেন, কিন্তু অযোধ্যায় অবস্থিত মোগল সেনাপতি খান-ই-জামান তাঁহাকে পরাজিত করিয়া তাঁহার শিবির লুণ্ঠন করিলেন। তখন গিয়াসুদ্দীন স্বস্থানে ফিরিয়া আসিলেন এবং বাংলা ও ত্রিহুতের অধিপতি থাকিয়াই সন্তুষ্ট রহিলেন। ইহার পরবর্তী কয়েক বৎসর তিনি শান্তিতেই কাটাইলেন এবং খান-ই-জামানের সহিত পরিপূর্ণ বন্ধুত্ব রক্ষা করিলেন। তবে পূর্ব-ভারতের এখানে সেখানে ছোটখাট স্থানীয় ভূস্বামীদের অভ্যুত্থান তাঁহাকে দুই একবার বিব্রত করিয়াছিল। ১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়।
গিয়াসুদ্দীন বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর তাঁহার ভ্রাতা জলালুদ্দীন দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীন নাম গ্রহণ করিয়া সুলতান হইলেন (১৫৬০ খ্রী)। মোগল শক্তির সহিত তিনি বন্ধুত্ব রক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু এই সময়ে কররানী-বংশীয় আফগানরা দক্ষিণ-পূর্ব বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেকখানি অংশ অধিকার করিয়া দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীনের নিকট স্থায়ী অশান্তির কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।
১৫৬৩ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয় গিয়াসুদ্দীনের মৃত্যু হয় এবং তাঁহার পুত্র তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হন। এই পুত্রের নাম জানা যায় না; ইনি কয়েক মাস রাজত্ব করার পরে এক ব্যক্তি ইহাকে হত্যা করেন এবং তৃতীয় গিয়াসুদ্দীন নাম লইয়া সুলতান হন। ইহার এক বৎসর বাদে কররানী-বংশীয় তাজ খান তৃতীয় গিয়াসুদ্দীনকে নিহত করিয়া বাংলার অধিপতি হন।
৫
কররানী বংশ
১। তাজ খান কররানী : কররানীরা আফগান বা পাঠান জাতির একটি প্রধান শাখা। তাহাদের আদি নিবাস বঙ্গাশে (আধুনিক কুররম)। শের খানের প্রধান প্রধান অমাত্য ও কর্মচারীদের মধ্যে কররানী বংশের অনেকে ছিলেন; তন্মধ্যে তাজ খান অন্যতম। ইনি মুহম্মদ শাহ আদিলের সিংহাসনে আরোহণের পরে তাঁহার রাজধানী ছাড়িয়া পলাইয়া যান এবং বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গাঙ্গেয় অঞ্চলের একাংশ অধিকার করেন। কিন্তু মুহম্মদ শাহ আদিল তাঁহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ছিব্রামাউ-য়ের (ফরাক্কাবাদের ১৮ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত) যুদ্ধে তাঁহাকে পরাজিত করেন। তখন তাজ খান কররানী খওয়াসপুর টাণ্ডায় পলাইয়া আসিয়া তাঁহার ভ্রাতা ইমাদ, সুলেমান ও ইলিয়াসের সহিত মিলিত হন। ইহারা এই অঞ্চলের জায়গীরদার ছিলেন। ইহার পর এই চারি ভ্রাতা জনসাধারণের নিকট হইতে রাজস্ব আদায় করিতে থাকেন এবং সন্নিহিত অঞ্চলের গ্রামগুলি লুটপাট করিতে থাকেন। মুহম্মদ শাহ আদিলের এক শত হাতি ইহারা অধিকার করিয়া লন। বহু আফগান বিদ্রোহী ইহাদের দলে যোগদান করে। কিন্তু চুনারের নিকটে মুহম্মদ আদিল খানের সেনাপতি হিমু ইহাদিগকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন (১৫৫৪ খ্রী)। তখন তাজ খান ও সুলেমান বাংলা দেশে পলাইয়া আসেন এবং দশ বৎসর ধরিয়া অনেক জোরজবরদস্তি ও জাল-জুয়াচুরি করার পরে তাঁহারা দক্ষিণ-পূর্ব বিহার ও পশ্চিম বঙ্গের অনেকাংশ অধিকার করেন। ইহার পর তাজ খান তৃতীয় গিয়াসুদ্দীনকে নিহত করিয়া বাংলার অধিপতি হইলেন (১৫৬৪ খ্রী)। কিন্তু ইহার এক বৎসরের মধ্যেই তিনি পরলোকগমন করিলেন এবং তাঁহার ভ্রাতা সুলেমান তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইলেন।
২। সুলেমান কররানী : সুলেমান কররানী অত্যন্ত দক্ষ ও শক্তিশালী শাসনকর্ত্তা ছিলেন। তাঁহার রাজ্যের সীমাও ক্রমশ দক্ষিণে পুরী পর্যন্ত, পশ্চিমে শোন নদ পর্যন্ত পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। সূর বংশের বিভিন্ন শাখা বিধ্বস্ত হইয়া যাওয়ার ফলে আফগানদের মধ্যে সুলেমানের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী এই সময়ে কেহ ছিল না। দিল্লি, অযোধ্যা, গোয়ালিয়র, এলাহাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল মোগলদের হাতে পড়ার ফলে হতাবশিষ্ট আফগান নায়কদের অধিকাংশই বাংলাদেশে সুলেমান কররানীর আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহাদের পাইয়া সুলেমান বিশেষভাবে শক্তিশালী হইলেন। ইহা ভিন্ন তাঁহার সহস্রাধিক উৎকৃষ্ট হস্তী ছিল বলিয়াও তাঁহার সামরিক শক্তি অপরাজেয় হইয়া উঠিয়াছিল।
বাংলা দেশের অধিপতি হইয়া সুলেমান এই রাজ্যে শান্তি স্থাপন করিলেন। ইহার ফলে তাঁহার রাজস্বের পরিমাণ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাইল। সুলেমান ন্যায়বিচারক হিসাবে বিশেষ প্রসিদ্ধি অর্জন করিয়াছিলেন। তিনি মুসলমান আলিম ও দরবেশদের পৃষ্ঠপোষণ করিতেন। এদেশে তিনি শরিয়তের বিধান কার্যকরী করিয়াছিলেন। তিনি নিজে এই বিধান নিষ্ঠার সহিত অনুসরণ করিতেন।
শোন নদ ছিল মোগল অধিকার ও সুলেমানের অধিকারের সীমারেখা। সুলেমান মোগল সম্রাট আকবর এবং তাঁহার অধীনস্থ (সুলেমানের রাজ্যের প্রতিবেশী অঞ্চলের) শাসনকর্ত্তা খান-ই-জমান আলী কুলী খান ও খান-ই-খানান মুনিম খানকে উপহার দিয়া সন্তুষ্ট রাখিতেন। তিনি দুই একবার ভিন্ন আর কখনও প্রকাশ্যে মোগল শক্তির বিরুদ্ধাচরণ করেন নাই, তবে ভিতরে ভিতরে অনেকবার মোগল-বিরোধীদের সাহায্য করিয়াছেন। ১৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দে খান-ই-জমান আলী কুলী খান আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং হাজীপুরে অবস্থান করিয়া আত্মরক্ষা করিতে থাকেন। তিনি সুলেমান কররানীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। আকবর সুলেমানকে আলী কুলী খানের সহিত যোগদান না করিতে অনুরোধ জানাইবার জন্য হাজী মুহম্মদ খান সীস্তানী নামে একজন দূতকে প্রেরণ করেন। কিন্তু এই দূত সুলেমানের নিকট পৌঁছিতে পারেন নাই; তিনি রোটাস দুর্গের নিকটে পৌঁছিলে একদল বিদ্রোহী আফগান তাঁহাকে বন্দী করিয়া আলী কুলী খানের নিকট প্রেরণ করেন। অতঃপর সুলেমান কররানী আলী কুলী খানের সহিত যোগ দিয়া রোটাস দুর্গ জয়ের জন্য এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। রোটাস দুর্গের পতন আসন্ন হইয়া আসিতেছিল, এমন সময়ে সংবাদ আসিল যে আকবরের বাহিনী আসিতেছে। তখন সুলেমান রোটাস হইতে তাঁহার সৈন্যবাহিনী সরাইয়া লইলেন। ইহার পর আলী কুলী খান, হাজী মুহম্মদ সীস্তানী ও খান-ই-খানান মুনিম খানের মধ্যস্থতায় আকবরের সহিত সন্ধিস্থাপন করেন। সন্ধিস্থাপনের পূর্বাহ্ন পর্যন্ত সুলেমান কররানীর অন্যতম সেনাপতি কালাপাহাড় আলী কুলী খানের নিকট উপস্থিত ছিলেন। ইহার পর ১৫৬৭ খ্রীষ্টাব্দে আলী কুলী খান আবার আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং আকবর কর্ত্তৃক পরিচালিত বাহিনীর সহিত যুদ্ধ করিয়া পরাজিত ও নিহত হন। তখন আলী কুলী খান কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত জমানীয়া নগরের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আসাদুল্লাহ্ সুলেমান কররানীর নিকটে লোক পাঠাইয়া জমানীয়া নগর সুলেমানকে সমর্পণ করিবার প্রস্তাব করেন। সুলেমান এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং জমানীয়া নগর অধিকারের জন্য এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে খান-ই-খানান মুনিম খান দূত প্রেরণ করিয়া আসাদুল্লাহকে বশীভূত করেন; তখন সুলেমানের সেনাবাহিনী প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হয়। সুলেমানের প্রধান উজীর লোদী খান এই সময়ে শোন নদের তীরে উপস্থিত ছিলেন; তিনি খান-ই-খানানের সহিত সন্ধি করিলেন। ইহার পর সুলেমান কররানী খান-ই খানান মুনিম খানের সহিত পাটনার নিকটে দেখা করিলেন এবং আকবরের নামে মুদ্রাঙ্কন করাইতে ও খুৎবা পাঠ করাইতে প্রতিশ্রুত হইলেন। এই প্রতিশ্রুতি সুলেমান বরাবর পালন করিয়াছিলেন। সুলেমানের সহিত যখন মুনিম খান সাক্ষাৎ করেন, তিনি তাঁহার লোকজন লইয়া পাটনার ৫/৬ ক্রোশ দূরে পৌঁছিলে সুলেমান স্বয়ং গিয়া তাঁহাকে স্বাগত জানান এবং তাঁহার সহিত আলিঙ্গনবদ্ধ হন। অতঃপর মুনিম খান সুলেমানকে নিজের শিবিরে নিমন্ত্রণ করিয়া এক ভোজ দেন। পরদিন তিনি সুলেমানের শিবিরে যান। এই সময়ে কোন কোন আফগান নায়ক মুনিম খানকে বন্দী করিতে পরামর্শ দেন, কিন্তু লোদী খানের পরামর্শ অনুসারে সুলেমান এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন; অতঃপর লোদী খান ও সুলেমানের পুত্র বায়াজিদ মুনিম খানের শিবিরে যান। ইহার পর মুনিম খান জৌনপুরে এবং সুলেমান বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। সুলেমান ইহার পর আর কখনও আকবরের অধীনতা অস্বীকার করেন নাই। তিনি সিংহাসনে বসেন নাই, যদিও ‘আলা হজরৎ’ উপাধি লইয়াছিলেন এবং সম্পূর্ণভাবে রাজার মতই আচরণ করিতেন। বিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত প্রধান উজীর লোদী খানের পরামর্শের দরুণই সুলেমান কূটনৈতিক ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করিয়াছিলেন এবং কোন বিপজ্জনক অভিযানে প্রবৃত্ত হন নাই। সুলেমানের আমলে গৌড় নগরী অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হইয়া পড়ায় সুলেমান টাণ্ডাতে তাঁহার রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন।
এই সময়ে বাংলার প্রতিবেশী হিন্দু রাজ্য উড়িষ্যা একের পর এক শক্তিহীন রাজার সিংহাসনে আরোহণ এবং অমাত্য ও সেনানায়কদের আভ্যন্তরীণ কলহের ফলে দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল। হরিচন্দন মুকুন্দদেব নামে একজন মন্ত্রী এই সময়ে খুব শক্তিশালী হইয়া উঠিয়াছিলেন। চক্রপ্রতাপ দেব ও নরসিংহ জেনা নামে দুইজন রাজা অল্পকাল রাজত্ব করিয়া নিহত হইবার পর মুকুন্দদেব রঘুরাম জেনা নামে একজন রাজপুত্রকে সিংহাসনে বসাইলেন। কিন্তু ১৫৬০-৬১ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দদেব নিজেই সিংহাসনে আরোহণ করিলেন এবং রাজ্যে শৃঙ্খলা আনয়ন করিলেন। ইব্রাহিম সূর নামে মুহম্মদ শাহ আদিলের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী উড়িষ্যায় আশ্রয় লইয়াছিলেন। মুকুন্দদেব তাঁহাকে জমি দিয়াছিলেন এবং বাংলার সুলতানের নিকট তাঁহাকে সমর্পণ করিতে রাজী হন নাই। ১৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দদেব আকবরের আনুগত্য স্বীকার করেন এবং আকবরকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, সুলেমান কররানী যদি আকবরের শত্রুতা করেন, তবে তিনি ইব্রাহিম সূরকে দিয়া বাংলা আক্রমণ করাইবেন। মুকুন্দদেব নিজে একবার পশ্চিমবঙ্গের সাতগাঁও পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং গঙ্গার কূলে একটি ঘাট নির্মাণ করেন।
১৫৬৭-৬৮ খ্রীস্টাব্দের শীতকালে আকবর যখন চিতোর আক্রমণে লিপ্ত সেই সময়ে সুলেমান তাঁহার পুত্র বায়াজিদ এবং ভূতপূর্ব মোগল সেনাধ্যক্ষ সিকন্দর উজবকের নেতৃত্বে উড়িষ্যায় এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন। ইহারা ছোটনাগপুর ও ময়ূরভঞ্জের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইলেন। ইহাদের প্রতিরোধ করিবার জন্য মুকুন্দদেব ছোট রায় ও রঘুভঞ্জ নামক দুই ব্যক্তির অধীনে এক সৈন্যবাহিনী পাঠাইলেন, কিন্তু দুই ব্যক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাঁহারই বিরুদ্ধতা করিল। মুকুন্দদেব তখন কটসামা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন এবং অর্থ দ্বারা বায়াজিদের অধীন একদল সৈন্যকে বশীভূত করিলেন। অতঃপর মুকুন্দদেবের সহিত বিশ্বাসঘাতকদের যুদ্ধ হইল এবং এই যুদ্ধে মুকুন্দদেব ও ছোট রায় নিহত হইলেন। লায়ঙ্গগড়ের সৈন্যাধ্যক্ষ রামচন্দ্র ভঞ্জ (বা দুর্গা ভঞ্জ) উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করিলেন, কিন্তু সুলেমান বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাহাকে বন্দী ও বধ করিলেন। এইভাবে তিনি ইব্রাহিম সূরকেও প্রথমে আত্মসমর্পণ করিতে বলিয়া তাঁহার পর হাতের মুঠার মধ্যে পাইয়া বধ করিলেন।
জাজপুর অঞ্চল হইতে সুলেমানের অন্যতম সেনাপতি কালাপাহাড়ের* অধীনে একদল অশ্বারোহী আফগান সৈন্য পুরীর দিকে অসম্ভব দ্রুতগতিতে রওনা হইল এবং অল্পকালের মধ্যেই তাঁহারা একরূপ বিনা বাধায় পুরী অধিকার করিল। তাহারা জগন্নাথ-মন্দিরের ভিতর সঞ্চিত বিপুল ধনরত্ন অধিকার করিল, মন্দিরটি আংশিকভারে বিধ্বস্ত করিল এবং মূর্ত্তিগুলিকে খণ্ড খণ্ড করিয়া নোংরা স্থানে নিক্ষিপ্ত করিল। বহু সোনার মূর্ত্তি সমেত অনেক মণ সোনা তাহারা হস্তগত করিল। মোটের উপর, অল্প কিছু কালের মধ্যেই সমগ্র উড়িষ্যা সুলেমান কররানীর অধিকারভুক্ত হইল। এই প্রথম উড়িষ্যা মুসলমানের অধীনে আসিল।
——
[*সুলেমান কররানীর সেনাপতি কালাপাহাড় হিন্দু রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান এবং হিন্দুদের মন্দির ও দেবমূর্ত্তি ধ্বংস করার জন্য ইতিহাসে খ্যাত হইয়া আছেন। ইনি প্রথম জীবনে হিন্দু ও ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পরবর্তীকালে মুসলমান হইয়াছিলেন বলিয়া, কিংবদন্তী আছে। কিন্তু এই কিংবদন্তীর কোন ভিত্তি নাই। আবুল ফজলের আকবর নামা’, বদাওনীর নন্তখ-উৎ তওয়ারিখ এবং নিয়ামতুল্লাহর মখজান-ই-আফগানী’ হইতে প্রামাণিকভাবে জানিতে পারা যায় যে, কালাপাহাড় জন্ম-মুসলমান ও আফগান ছিলেন। তিনি সিকন্দর সুরের ভ্রাতা ছিলেন; তাঁহার নামান্তর “রাজু”, শেষোক্ত বিষয়টি হইতে অনেকে কালাপাহাড়কে হিন্দু মনে করিয়াছেন কিন্তু “রাজু” নাম হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত। এই কালাপাহাড় ইসলাম শাহের রাজত্বকাল হইতে সুরু করিয়া দাউদ কররানীর রাজত্বকাল পর্যন্ত বাংলার সৈন্যবাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক ছিলেন। দাউদ কররানীর মৃত্যুর সাত বৎসর পরে ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মোগল রাজশক্তির সহিত বিদ্রোহী মাসুম কাবুলীর যুদ্ধে কালাপাহাড় মাসুমের হইয়া সংগ্রাম করেন এবং তাহাতেই নিহত হন। ইনি ভিন্ন আরও একজন কালাপাহাড় ছিলেন, তিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পাদে বর্তমান ছিলেন। তিনি বাহ্লােল লোদী ও সিকন্দর লোদীর সমসাময়িক এবং তাঁহাদের রাজত্বকালে গুরুত্বপূর্ণ রাজপদসমূহে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কেন এই দুইজনের “কালাপাহাড়” নাম হইয়াছিল, তাহা বলিতে পারা যায় না। ‘রিয়াজ-উস্ সলাতীন’-এর মতে কালাপাহাড় বাবরের অন্যতম আমীর ছিলেন এবং আকবরের সেনাপতিরূপে উড়িষ্যা জয় করিয়াছিলেন : এই সব কথা একেবারে অমুলক। দুর্গাচরণ সান্যাল তাঁহার ‘বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে কালাপাহাড় সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়াছেন, তাহা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, সত্যের বিন্দুবাষ্পও তাঁহার মধ্যে নাই।]
——–
সুলেমান কররানীর রাজত্বকালের প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে কোচবিহারে এক নূতন রাজবংশের অভ্যুদয় হইয়াছিল। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহ অত্যন্ত শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন এবং “কামতেশ্বর” উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু বাংলার সুলতান ও অহোম রাজার সহিত তিনি মৈত্রীর সম্পর্ক রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার দ্বিতীয় পুত্র নরনারায়ণ (রাজত্বকাল আনুমানিক ১৫৩৮-৮৭ খ্রী) ও তৃতীয় পুত্র শুক্লধ্বজ (নামান্তর “চিলা রায়”) এই নীতি অনুসরণ করেন নাই। তাহারা অহোমরাজকে কয়েকবার আক্রমণ করিয়া পরাজিত করিলেন এবং অবশেষে সুলেমান কররানীর রাজ্য আক্রমণ করিলেন। কিন্তু সুলেমানের বাহিনী তাহাদের পরাজিত করিল এবং শুক্লধ্বজকে বন্দী করিল। অতঃপর সুলেমানের বাহিনী কোচবিহার আক্রমণ করিল এবং সুদূর তেজপুর পর্যন্ত হানা দিল, কিন্তু কোচবিহার ও কামরূপে স্থায়ী অধিকার স্থাপন না করিয়া তাহারা কেবলমাত্র হাজো, কামাখ্যা ও অন্যান্য স্থানের মন্দিরগুলি ধ্বংস করিয়া ফিরিয়া আসিল। কিংবদন্তী অনুসারে কালাপাহাড় এই অভিযানে নেতৃত্ব করিয়াছিলেন। সুলেমান স্বয়ং কোচবিহারে রাজধানী অবরোধ করিয়া প্রায় জয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন, কিন্তু উড়িষ্যার এক অভ্যুত্থানের সংবাদ পাইয়া তিনি অবরোধ প্রত্যাহার করিয়া ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হন। কয়েক বৎসর বাদে লোদী খানের পরামর্শে সুলেমান শুক্লধ্বজকে মুক্ত করিয়া দেন। এই সময়ে মোগলদের বাংলা আক্রমণ আসন্ন হইয়া উঠিতেছিল; কোচবিহারকে খুশী রাখিতে পারিলে হয়তো এই আক্রমণে তাঁহার সাহায্য পাওয়া যাইবে–এইরূপ চিন্তাই শুক্লধ্বজকে মুক্তি দেওয়ার কারণ বলিয়া মনে হয়। যাহা হউক, সুলেমানের জীবদ্দশায় মোগলেরা বাংলা আক্রমণ করে নাই। সুলেমান ১৫৭২ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই অক্টোবর তারিখে পরলোকগমন করেন।
৩। বায়াজিদ কররানী : সুলেমানের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়াজিদ তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইলেন। কিন্তু বায়াজিদ তাঁহার উদ্ধত আচরণ ও কর্কশ ব্যবহারের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই অমাত্যদের নিকট অপ্রিয় হইয়া উঠিলেন। ফলে একদল অমাত্য–ইহাদের মধ্যে লোহানীরাই প্রধানতাঁহার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করিলেন। সুলেমানের ভাগিনেয় ও জামাতা হনসু (বা হাঁসু) ইঁহাদের সঙ্গে যোগ দিয়া বায়াজিদকে হত্যা করিলেন; কিন্তু তিনি স্বয়ং লোদী খান ও অন্যান্য বিশ্বস্ত অমাত্যদের হাতে বন্দী হইয়া নিহত হইলেন। বায়াজিদ কররানী স্বল্পকালীন রাজত্বের মধ্যেই আকবরের অধীনতা অস্বীকার করিয়া নিজের নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা উৎকীর্ণ করাইয়াছিলেন।
৪। দাউদ কররানী : হসুকে বধ করিয়া অমাত্যের সুলেমানের দ্বিতীয় পুত্র দাউদকে সিংহাসনে বসাইলেন। তরুণবয়স্ক দাউদ কররানী অত্যন্ত নির্বোধ ও উত্তপ্তমস্তিষ্ক প্রকৃতির ছিলেন; উপরন্তু তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় দুশ্চরিত্র ও মদ্যপ। অমাত্যদের অপমান করিয়া এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞাতিদিগকে বিশ্বাসঘাতকতার সহিত হত্যা করিয়া তিনি অনতিবিলম্বেই বহু শত্রু সৃষ্টি করিলেন। কুত্ত্ব খান শুজুর কররানী প্রভৃতি স্বার্থপর অমাত্যদের কুমন্ত্রণায় দাউদ লোদী খানের মত সুযোগ্য ও বিশ্বস্ত মন্ত্রীর প্রতি অপ্রসন্ন হইলেন এবং লোদী খানের জামাতা (তাজ খানের পুত্র) য়ুসুফকে হত্যা করিলেন। দাউদও বায়াজিদের মত আকবরের অধীনতা অস্বীকার করিয়া নিজের নামে খুবা পাঠ ও মুদ্রা উত্তীর্ণ করাইলেন।
দাউদ বাংলার সিংহাসনে বসিবার পর আফগানদের প্রধান সেনাপতি গুজ্বর খান বায়াজিদের পুত্রকে বিহারের সিংহাসনে বসাইলেন। এ কথা শুনিয়া দাউদ বিহার নিজের দখলে আনিবার জন্য লোদী খানের অধীনে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী বিহারে পাঠাইলেন; ইতিমধ্যে আকবরও বিহার অধিকার করিবার জন্য খান-ই খানান মুনিম খানকে প্রেরণ করিয়াছিলেন; এই সংবাদ পাইয়া লোদী খান ও গুজুর খান নিজেদের বিরোধ মিটাইয়া ফেলিলেন এবং মুনিম খানকে অনেক উপহার দিয়া ও আনুগত্যে শপথ গ্রহণ করাইয়া শান্ত করিলেন।
তখন দাউদ লোদী খানের উপর ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে দমন করিবার জন্য স্বয়ং এক সৈন্যবাহিনী লইয়া বিহারে গেলেন; কোন কোন বিরোধিপক্ষীয় লোককে তিনি দমনও করিলেন। ইতিমধ্যে আকবর তাঁহার গুজরাট অভিযান সমাপ্ত করিয়া মুনিম খানকে আরও অনেক সৈন্য পাঠাইয়াছিলেন। ইহাদের পাইয়া মুনিম খান যুদ্ধযাত্রা করিলেন এবং ত্রিমোহনী (আরার ১২ মাইল উত্তরে অবস্থিত) পর্যন্ত অগ্রসর হইলেন। তখন দাউদ কুলু লোহানী ও গুজর খানের এবং শ্রীহরি নামে একজন হিন্দুর পরামর্শে লোদী খানের কাছে খুব করুণ ও বিনীতভাবে আবেদন জানাইয়া বলিলেন যে তাঁহার বংশের প্রতি আনুগত্য যেন তিনি ত্যাগ না করেন; লোদী খানকে তাঁহার শিবিরে আসিবার জন্য তিনি বিনীত অনুরোধ জানাইলেন। কিন্তু লোদী খান তাঁহার শিবিরে আসিলে দাউদ তাঁহাকে বধ করিলেন। ইহার ফলে আফগানদের মধ্যে বিরাট ভাঙন ধরিল। এদিকে মোগল বাহিনী সাবধানতার সহিত সুশৃঙ্খলভাবে অগ্রসর হইয়া পাটনার নিকটে পৌঁছিল। পাটনায় দাউদ প্রতিরক্ষা-ব্যুহ রচনা করিয়া অবস্থান করিতেছিলেন।
অতঃপর আকবর স্বয়ং বহু কামান ও বিশাল রণহস্তী সমেত এক নৌবহর লইয়া বিহারে আসিয়া মুনিম খানের সহিত যোগ দিলেন (৩রা আগস্ট, ১৫৭৪ খ্রী)। আকবর দেখিলেন যে পাটনার (গঙ্গার) ওপারে অবস্থিত হাজীপুর দুর্গ অধিকার করিতে পারিলে পাটনা অধিকার করা সহজসাধ্য হইবে। তাই তিনি ৬ই আগষ্ট কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর হাজীপুর দুর্গ অধিকার করিলেন এবং তাহাতে আগুন লাগাইয়া দিলেন। ইহাতে দাউদ অত্যন্ত ভয় পাইয়া গেলেন এবং সেই রাত্রই সদলবলে জলপথে বাংলায় পলাইয়া গেলেন; পলাইবার সময় অনেক আফগান জলে ডুবিয়া মরিল। দাউদের সৈন্যদের লইয়া সেনাপতি গুজর খান স্থলপথে বাংলায় গেলেন। মোগলেরা পরদিন সকালে পাটনার পরিত্যক্ত দুর্গ অধিকার করিল। তারপর আকবর স্বয়ং মোগল বাহিনীর নেতৃত্ব করিয়া এক দিনেই দরিয়াপুরে (পাটনা ও মুঙ্গেরের মধ্যপথে অবস্থিত) পৌঁছিলেন। ইহার পর আকবর ফিরিয়া গেলেন, কিন্তু মুনিম খান ১৩ই আগস্ট তারিখে ২০,০০০ সৈন্য লইয়া বাংলার দিকে রওনা হইলেন এবং বিনা বাধায় সূরজগড়, মুঙ্গের, ভাগলপুর ও কলহগাঁও অধিকার করিয়া তেলিয়াগড়ি গিরিপথের পশ্চিমে গৌছিলেন। দাউদ এখানে প্রতিরোধ-ব্যুহ রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার সেনাপতি খান-ই-খানান ইসমাইল খান সিলাহদার মোগল বাহিনীকে সাময়িকভাবে প্রতিহত করিলেন। কিন্তু মজনূন খান কাকশালের নেতৃত্বে মোগল অশ্বারোহী বাহিনী স্থানীয় জমিদারদের সাহায্যে রাজমহল পর্বতমালার মধ্য দিয়া তেলিয়াগড়িকে দক্ষিণে ফেলিয়া রাখিয়া চলিয়া গেল। তখন আফগানরা যুদ্ধ না করিয়াই পলাইয়া গেল এবং মুনিম খান বিনা বাধায় বাংলার রাজধানী টাণ্ডায় প্রবেশ করিলেন (২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৫৭৪ খ্রী)।
দাউদ কররানী তখন সাতগাঁও হইয়া উড়িষ্যায় পলায়ন করিলেন। মুনিম খান রাজা তোড়রমল্ল ও মুহম্মদ কুলী খান বরলাসকে তাঁহার পশ্চাদ্ধাবনে নিযুক্ত করিলেন। অন্যান্য আফগান নায়কেরা উত্তর-পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণ বঙ্গে গিয়া সমবেত হইলেন; কালাপাহাড়, সুলেমান খান মনক্লী ও বাবুই মনক্লী ঘোড়াঘাটে গেলেন; তাঁহাদের দমন করিবার জন্য মুনিম খান মজনূন খান কাকশালকে ঘোড়াঘাটে পাঠাইলেন; মজনূন খান সুলেমান খান মনক্লীকে নিহত এবং অন্যান্য আফগানদের পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া ঘোড়াঘাট অধিকার করিলেন; পরাজিত আফগানরা কোচবিহারে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ইমাদ খান কররানীর পুত্র জুনৈদ খান কররানী ইতিপূর্বে মোগলদের দলে যোগদান করিয়াছিলেন, কিন্তু এখন তিনি বিদ্রোহী হইলেন এবং ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া রায় বিহারমলু ও মুহম্মদ খান গখরকে পরাজিত ও নিহত করিলেন। এদিকে মাহমূদ খান ও মুহম্মদ খান নামে দুইজন আফগান নায়ক সরকার মাহমূদাবাদের অন্তর্গত সেলিমপুর নগর অধিকার করিয়াছিলেন। রাজা তোড়রমল কর্ত্তৃক প্রেরিত একদল সৈন্য মাহমূদ খানকে পরাজিত ও মুহম্মদ খানকে নিহত করিয়া সেলিমপুর অধিকার করিল। তখন জুনেদ খান আবার ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিলেন।
এদিকে মোগল সৈন্যাধ্যক্ষ মুহম্মদ কুলী খান বরলাস সাতগাঁওয়ের ৪০ মাইল দূরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তখন আফগানরা সাতগাঁও ছাড়িয়া পলায়ন করিল। মোগল বাহিনী সাতগাঁও অধিকার করিবার পর সংবাদ আসিল যে দাউদের অন্যতম প্রধান কর্মচারী ও পরামর্শদাতা শ্রীহরি (প্রতাপাদিত্যের পিতা) “চতর” (যশোর) দেশের দিকে পলায়ন করিতেছেন; তখন মুহম্মদ কুলী খান শ্রীহরির পশ্চাদ্ধাবন করিলেন, কিন্তু তাঁহাকে বন্দী করিতে পারিলেন না। রাজা তোড়রমন্ত্র বর্ধমান হইতে রওনা হইয়া মান্দারণে উপস্থিত হইলেন; দাউদ ইহার ২০ মাইল দূরে দেবরাকসারী গ্রামে শিবির ফেলিয়াছিলেন। তোড়মল্ল মুনিম খানের নিকট হইতে সৈন্য আনাইয়া মান্দারণ হইতে কোলিয়া গ্রামে গেলেন। দাউদ তখন হরিপুর (দাঁতনের ১১ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবিস্থত) গ্রামে চলিয়া গেলেন। তখন তোড়রমল্ল মেদিনীপুরে গেলেন। এখানে মুহম্মদ কুলী খান বরলাস দেহত্যাগ করিলেন, ফলে মোগল সৈন্যেরা খুব হতাশ ও বিশৃঙ্খল হইয়া পড়িল। তখন তোড়রমল্ল বাধ্য হইয়া মান্দারণে প্রত্যাবর্তন করিলেন। এই সংবাদ পাইয়া মুনিম খান নূতন একদল সৈন্য লইয়া বর্ধমান হইতে রওনা হইলেন, তোড়রমলুও মান্দারণ হইতে সসৈন্যে রওনা হইলেন, চেতোতে মুনিম খান ও তোড়মল্ল মিলিত হইলেন। তাঁহাদের কাছে সংবাদ আসিল যে, দাউদ হরিপুরে পরিখা খনন, প্রতিরোধ প্রাচীর নির্মাণ, এবং বনময় পথের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি অবরুদ্ধ করিয়া প্রস্তুত হইয়া আছেন। মোগল সৈন্যেরা এই কথা শুনিয়া ভগ্নমনোরথ হইয়া পড়িল এবং আর যুদ্ধ করিতে চাহিল না। মুনিম খান ও হোড়রমল্ল তাহাদের অনেক করিয়া বুঝাইয়া যুদ্ধে উৎসাহিত করিলেন এবং স্থানীয় লোকদের সাহায্যে জঙ্গলের মধ্য দিয়া একটি ঘুর-পথ আবিষ্কার করিলেন। এই পথ চলাচলের উপযুক্ত করিয়া লইবার পর মোগল বাহিনী ইহা দিয়া দক্ষিণ-পূর্বে অগ্রসর হইল এবং নানজুর (দাঁতনের ১১ মাইল পূর্বে অবস্থিত) গ্রামে পৌঁছিল। এখন দাউদকে পশ্চাৎ দিক হইতে আক্রমণের সুযোগ উপস্থিত হইল। দাউদ ইতিপূর্বে তাঁহার পরিবারবর্গকে কটকে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তিনি এখন উপায়ান্তর না দেখিয়া মোগল বাহিনীর সহিত যুদ্ধ করিলেন। সুবর্ণরেখা নদীর নিকটে তুকরোই (দাঁতনের ৯ মাইল দূরে অবস্থিত) গ্রামের প্রান্তরে ৩রা মার্চ, ১৫৭৫ খ্রী তারিখে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে দাউদের বাহিনীই প্রথমে আক্রমণ চালাইয়া আশাতীত সাফল্য অর্জন করিল। তাহারা খান-ই-জহানকে নিহত করিল ও মুনিম খানকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করিল। কিন্তু দাউদের নির্বুদ্ধিতার ফলে তাঁহার বাহিনী শেষপর্যন্ত পরাজিত হইল। তাঁহার প্রধান সেনাপতি গুজ্বর খান যুদ্ধে অসংখ্য সৈন্যসমেত নিহত হইলেন। পরাজিত হইয়া দাউদ পলাইয়া গেলেন। তাঁহার বাহিনীও ছত্রভঙ্গ হইয়া পলাইতে লাগিল। মোগল সৈন্যেরা তাঁহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া বিনা বাধায় বেপরোয়া হত্যা ও লুণ্ঠন চালাইতে লাগিল এবং বহু আফগানকে বন্দী করিল। পরের দিন ৮২ বৎসর বয়স্ক মোগল সেনাপতি মুনিম খান অভূতপূর্ব নিষ্ঠুরতার সহিত সমস্ত আফগান বন্দীকে বধ করিয়া তাহাদের ছিন্নমুণ্ড সাজাইয়া আটটি সুউচ্চ মিনার প্রস্তুত করিলেন।
তোড়রমল দাউদের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। দাউদ কোথাও দাঁড়াইতে না পারিয়া শেষপর্যন্ত কটকে গিয়া সেখানকার দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কিন্তু মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাফল্যলাভের কোন সম্ভাবনা নাই দেখিয়া তিনি ১২ই এপ্রিল তারিখে কটকের দুর্গ হইতে বাহির হইয়া আসিলেন এবং মুনিম খানের কাছে বশ্যতা স্বীকার করিলেন। ২১শে এপ্রিল তারিখে মুনিম খান দাউদকে উড়িষ্যায় জায়গীর প্রদান করিয়া টাণ্ডায় ফিরিয়া আসিলেন।
দাউদ খান নতি স্বীকার করিলেও ইতিমধ্যে ঘোড়াঘাটে মোগল বাহিনীর শোচনীয় বিপর্যয় ঘটিয়াছিল; মুনিম খানের রাজধানী হইতে অনুপস্থিতির সুযোগ লইয়া কালাপাহাড় ও বাবুই মনক্লী প্রভৃতি আফগান নায়কেরা কুচবিহার হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া ঘোড়াঘাটে অবস্থিত মোগলদের পরাজিত ও বিতাড়িত করিছিল। এই সংবাদ পাইয়া মুনিম খান সৈন্যবাহিনী লইয়া ঘোড়াঘাটের দিকে রওনা হইলেন। কিন্তু ঘোড়াঘাটে পৌঁছিবার পূর্বে তিনি গৌড় জয় করিলেন। বর্ষার সময় টাণ্ডার জলো জমিতে থাকার অসুবিধা হইত বলিয়া মুনিম খান ভাবিয়াছিলেন গৌড় জয় করিয়া সেখানেই রাজধানী স্থাপন করিবেন। কিন্তু গৌড় নগরী বহুকাল পরিত্যক্ত হইয়া পড়িয়াছিল বলিয়া সেখানকার ঘরবাড়ীগুলি অস্বাস্থ্যকর হইয়া উঠিয়াছিল। সেখানে কয়েকদিন থাকার ফলে মুনিম খানের লোকেরা অসুস্থ হইয়া পড়িল এবং কয়েক শত লোক মারা গেল। ফলে মুনিম খানের আর ঘোড়াঘাটে যাওয়া হইল না, তিনি টাণ্ডায় প্রত্যাবর্তন করিলেন। প্রত্যাবর্তনের দশদিন পরে ২৩শে অক্টোবর, ১৫৭৫ খ্রী তারিখে মুনিম খান পরলোকগমন করিলেন। তাঁহার ফলে মোগলদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। তাহাদের ঐক্যও নষ্ট হইয়া গেল। তখন শত্রুরা চারিদিক হইতে আক্রমণ করিতে লাগিল। বেগতিক দেখিয়া মোগলরা সকলে গৌড়ে সমবেত হইল এবং সেখান হইতে বাংলা দেশ ছাড়িয়া সকলেই ভাগলপুর চলিয়া গেল। সেখানে গিয়া তাহারা দিল্লি ফিরিবার উদ্যোগ করিতে লাগিল।
এই সময়ে আকবর হাসান কুলী বেগ ওরফে খান-ই-জহানকে বাংলার শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। তিনি ভাগলপুরে পৌঁছিয়া কিছু মুস্কিলে পড়িলেন। তিনি শিয়া বলিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী সৈন্যাধ্যক্ষেরা তাঁহার কথা শুনিতে চাহিত না। তোড়মল্ল মধ্যস্থ হইয়া মিষ্ট বাক্য, চতুর ব্যবহার এবং অকৃপণ অর্থদানের দ্বারা তাহাদের বশীভূত করিলেন।
খান-ই-জহান সংবাদ পাইলেন যে দাউদ কররানী আবার বিদ্রোহ করিয়াছেন এবং ভদ্রক, জলেশ্বর প্রভৃতি মোগল অধিকারভুক্ত অঞ্চল জয় করার পরে সমগ্র বাংলা দেশ পুনরধিকার করিয়াছেন; ঈশা খান পূর্ববঙ্গের নদীপথ হইতে শাহ বরদী কর্ত্তৃক পরিচালিত মোগল নৌবহরকে বিতাড়িত করিয়াছেন; জুনৈদ কররানী দক্ষিণ-পূর্ব বিহারে দৌরাত্ম করিতেছেন এবং গজপতি শাহ ডাকাতি করিতেছেন, কেবলমাত্র হাজীপুরে মুজাফফর খান তুরবতী অনেক কষ্টে মোগল ঘাঁটি রক্ষা করিতেছেন।
যুদ্ধ করিতে অনিচ্ছুক সৈন্যাধ্যক্ষদের তোড়রমল্লের সাহায্যে অনেক কষ্টে বুঝাইবার পরে খান-ই-জহান তাঁহাদের লইয়া বাংলার দিকে অগ্রসর হইলেন। তেলিয়াগড়ি তাঁহারা সহজেই অধিকার করিলেন এবং এখানকার আফগান সৈন্যাধ্যক্ষকে তাঁহারা বধ করিলেন। দাউদ পশ্চাদপসরণ করিয়া রাজমহলে গিয়া সেখানে পরিখা খনন করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। খান-ই-জহান তাঁহার মুখোমুখি হইয়া অনেকদিন রহিলেন, কিন্তু আক্রমণ করিতে পারিলেন না। তখন আকবর বিহারের সৈন্যবাহিনীকে খান-ই-জহানের সাহায্যে যাইতে বলিলেন এবং খান-ই-জহানকে কয়েক নৌকা বোঝাই অর্থ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম পাঠাইলেন। গজপতির ডাকাতির ফলে মোগলদের যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হইতেছিল, আকবর তাঁহাকে দমন করিবার জন্য তাঁহার অন্যতম সভাসদ শাহবাজ খানকে প্রেরণ করিলেন।
১০ই জুলাই, ১৫৭৬ খ্রী তারিখে বিহারের মোগল সৈন্যবাহিনী রাজমহলে খান-ই-জহানের সহিত যোগ দিল। ১২ই জুলাই মোগলদের সহিত আফগানদের এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হইল। বহুক্ষণ যুদ্ধ করিবার পরে আফগানরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হইল। এই যুদ্ধে জুনৈদ কররানী গোলার আঘাতে নিহত হইলেন, উড়িষ্যার শাসনকর্ত্তা জহান খানও মারা পড়িলেন, কালাপাহাড় ও কুলু লোহানী আহত অবস্থায় পলায়ন করিলেন। দাউদ কররানী বন্দী হইলেন। খান-ই-জহান তাঁহার প্রাণ রক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু আমীরদের নিবন্ধে তিনি দাউদকে সন্ধিভঙ্গের অপরাধে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করিলেন। দাউদের মাথা কাটিয়া ফেলিয়া আকবরের নিকট পাঠানো হইল।
অতঃপর খান-ই-জহান সপ্তগ্রামে গেলেন এবং যে সব আফগান সেখানে তখনও গোলযোগ বাধাইতেছিল, তাহাদের দমন করিলেন। দাউদের সম্পদ ও পরিবারের জিম্মাদার মাহমুদ খান খাস-খেল ওরফে “মাটি” তাঁহার নিকট পর্যদস্ত হইলেন। তখন আফগানদের নিজেদের মধ্যেই বিরোধ বাধিল এবং তাহাদের অন্যতম নেতা জমশেদ তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতেই নিহত হইলেন। অবশেষে দাউদের জননী নৌলাখা ও দাউদের পরিবারের অন্যান্য লোকেরা খান-ই-জহানের কাছে আত্মসমর্পণ করিলেন। “মাটি” আত্মসমর্পণ করিতে আসিয়া খান-ই জহানের আজ্ঞায় নিহত হইলেন।
বাংলার প্রথম আফগান শাসক শের শাহ এবং শেষ আফগান শাসক দাউদ কররানী। আফগানরা সাঁইত্রিশ বৎসর এদেশ শাসন করিয়াছিলেন। ১৫৭৬ খ্রীস্টাব্দে দাউদের পরাজয় ও নিধনের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার ইতিহাসের আফগান যুগ সমাপ্ত হইল। অবশ্য দাউদের মৃত্যুর পরেও বাংলা দেশের অনেক অংশে আফগান নায়কেরা নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন। তাঁহাদের সম্পূর্ণভাবে দমন বা বশীভূত করিতে মোগল শক্তির অনেক সময় লাগিয়াছিল।* [* বর্তমান পরিচ্ছেদে উল্লিখিত বিভিন্ন তথ্য জৌহরের ‘তজকিরৎ-উল্ ওয়াকৎ’, আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’, আবদুল্লাহর ‘তারিখ-ই-দাউদী’ প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে সংগৃহীত হইয়াছে।]