হিরোসিমা, মাই লাভ
১ মে।
কাল ফিউনারাল। জেফ সত্যিই কামাল করেছে। কলকাতায় ওদের কোনও আমেরিকান সমস্যার কথা উঠলে রঞ্জন সুমিতাকে বলত, ও নিয়ে ভেবো না। জেফ জানে। ও ঠিক ম্যানেজ করবে। সুমিতা বিশ্বাসও করত। তা, সে খুব ভুল করত না।
আজ গোটা বে-এরিয়ার এবং এখানকার সমস্ত কাগজে ফিউনারালের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়ে গেছে। সকলকে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে অঞ্জনের নামে। জেফ আমার নাম দিতে চেয়েছিল। আমি বারণ করি। ফিউনারালের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে আইভার্স অ্যান্ড অ্যালকর্ন ফিউনারাল হোম। আজ ১টার সময় ফিউনারাল সার্ভিস হবে মে-ফেয়ার গ্রাউন্ডের কাউন্টি হলে। সেখানে তিনটি ক্যাসকেটের মধ্যে থাকবে তিনটি কফিন। ডাঃ চ্যাটার্জি ও মিসেস চ্যাটার্জির জন্য জেফ ৭৫০ ডলার দামি দুটি ক্যাসকেট কিনতে বলেছে, যা ওদের মর্যাদার উপযুক্ত। জীয়নের জন্য ৩২৫ ডলারের ক্যাসকেট। সাক্ৰামেন্টো থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের অনাথানন্দ স্তোত্রপাঠ করতে আসছেন। খ্রিস্টীয় মতেও কিছুটা হবে। পাদ্রী আসবেন। স্কুলের মেয়েরা শোকগীতি গাইবে।
অতিথিদের রাত্রিবাসের জন্য একটা মোটেল পুরোটা ভাড়া করা হয়েছে। ২০টা ঘর। “কাছেদূরে বেকার্সফিল্ড, ওকল্যান্ড, ফ্রেজনো, হেওয়ার্ড, বার্কেলে, হ্যামেট, সানহোজে, সানফ্রান্সিসকো, ডেভিস, মারিপোজে, মডেরা—সর্বত্র থেকে ওদের বন্ধু ও গুণগ্রাহীরা কাল থেকেই আসতে শুরু করেছে। ডেভিস থেকে আসছেন ডাঃ গ্রেওয়াল এবং তাঁর স্ত্রী সুজানা। উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়াটল থেকে রঞ্জনের বেলুড়ের বন্ধু চুনী ফোন করেছিল। সেই হরি সিং ট্রাভেল এজেন্ট যেচারমূর্তিকে থার্ড ক্লাসে তুলে ১৯৬১-তে বিলেত পাঠায়, তাদের একজন। বিলেতে ১০ বছর একসঙ্গে ছিল, শীতে দুজনে একটা কালো ওভারকোট ভাগাভাগি করে পরেছে, চুনী বলল, সে আসছে। ইস্ট কোস্ট থেকেও একটি দম্পতি আসছে। দেবেন ব্যানার্জি ও তাঁর স্ত্রী অমিয়া। এরা আটলান্টা থেকে প্লেন ধরেছে বলে ওদের মেয়ে একটু আগে আমাকে জানিয়েছে। গত দুদিনে ইন্টারস্টেট ফোন বেজেছে বার কুড়ি। সবাই ফিউনারালে আসতে পারা বা না-পারার কথা জানাচ্ছে। খাবারে আর ফুলে দুটি ঘর ভরে গেছে।
ফ্রিমন্ট থেকে এসেছে ধূর্জটি পালিত। বিকেল ৪টের সময় ৭০ মাইল দূরে মডেস্টো শহরের ক্রিমেশান হোমে ইলেকট্রিক চুল্লিতে শবদাহ। রাতে এ বাড়ির আউট-ইয়ার্ডে শ্মশানবন্ধুদের একটি বুফে-টাইপ ডিনারে নিমন্ত্রণ। এত কিছু ব্যবস্থা সে, জেফ, একা করেছে। এ ছাড়া কামপারাটা আমি যাতে ব্যবহার করতে পারি, সে জন্যে সুবিবেচক সে একজন ড্রাইভার নিয়োগ করেছে। মুভমেন্ট ব্যাপারে কারও ওপর নির্ভর করা আমার পক্ষে উচিত হবে না, ছন্দারা ফিউনারালের পরদিন চলে যাচ্ছে। তাছাড়া, অ্যাজ ইট গোজ হিয়ার, ইউ নো, ইফ ইউ ডু নট পজেস ইওর ওন কার, ইউ আর নট নেসেসারিলি অ্যান আন-আমেরিকান জেফ রসিকতা করে বলল, বাট ইউ সার্টেনলি আর অ্যান আন-ক্যালিফোর্নিয়ান।
এহ বাহ্য, অঞ্জনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মল-এর বিখ্যাত দোকান পারভিন্স থেকে একদিনের মধ্যে কালকের দিনের জন্য একটা কালো স্যুট করিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু অঞ্জন আমাকে ধরাছোঁয়া দিচ্ছে না। পাত্তা দিচ্ছে না একদম। অলমোস্টইগনোর করছে। ডাকলে সাড়া দিচ্ছে, নইলে কথা বলছে না। ও আমাকে বরাবরই পছন্দ করে না। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখনও সেই পোর্ট অফিসেই চাকরি করছ? ঠেসটা হল, অর্থাৎ কিনা, সেই গরিবই আছ? এত দূর স্পর্ধা! আমি ওকে অনেক চিঠি দিয়েছি, উত্তর দেয়নি। কলকাতায় এলে অনেক ভালবাসার চেষ্টা করেছি, উপহার দিয়েছি, কিন্তু সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেনি। বাবার গরিব আত্মীয়দের ও পছন্দ করে না। এবং অপছন্দ বা ঘৃণা করার চেয়ে যা বেশি, ওর মনে তাদের সম্পর্কে কোনও কৌতূহল নেই। জিজ্ঞাসা নেই।
ও নন্দিনের সঙ্গেও আগাগোড়া খুবই খারাপ ব্যবহার করেছে। নন্দিন আমাকে লিখত। তুমি কেন এসেছো? এই ছিল ওর মুখের বুলি।
আমি জানি, এর জন্যে দায়ী রঞ্জন। সে দেশ ও আত্মীয়দের তথা দেশজ কোনও কিছুকেই ছেলেদের শ্রদ্ধা করতে শেখায়নি। আমরা যা গরিব ছিলাম না! বাক্যটিকে ভূরিভোজনের পর ভাজামৌরি হিসেবে ব্যবহার করতে করতে, শুধু দারিদ্র্য নয়, ও ছেলেদের ওর দেশের দরিদ্রদের ঘৃণা করতে শিখিয়ে গেছে। নিজের হঠকারিতাকে জাস্টিফাই করার জন্যে ওকে এটা করতে হয়েছে, আমি ভাল করেই জানি যে, যারা দেশে আছে তারা ভাল নেই। সুখে নেই। কারণ, তারা গরিব। আমরা সুখে আছি। আমরা ভাল আছি। কারণ, আমরা বিদেশে থাকতে বাধ্য হলেও, বড়লোক। দেশের গরিবের চেয়ে বিদেশের বড়লোক ভাল।
কাল সন্ধেবেলা সুইমিং পুল থেকে ফিরে দেখলাম ও সুমিতা-রঞ্জনের বেডরুমে দরজা বন্ধ করে মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে জ্যাজ শুনছে। ওর ফোন এলে ঘরে কানেকশান দিতে বলছে। ছন্দা বলল এখন ডাকলে খেপে যাবে। আমি তবু ডাকতে যাচ্ছিলাম, লেদু বলল, না-, নকাকা, এখন ডেকো না। আমি ওর হাত ছাড়িয়ে উঠতে যাচ্ছি, ছন্দা বলল, ওর সঙ্গে বন্ধু ন্যান্সি রয়েছে। ও ঘরের কাঠের মেঝে থেকে পদাঘাতের দপদপ শব্দ ভেসে আসে। ওরা ব্রেক-ড্যান্স করছে।
কাল রাতে তো ও আমাকে সবার সামনে অপমানই করল। রাত ২টো পর্যন্ত টিভি দেখল। আমরা বসে ফিউনারালের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলছি। ও একটা কথাও বলছে না। যেন, এটা আর কারও বাবার ফিউনারাল। ওঠার সময় পা দিয়ে টিভি সুইচটা অফ করল।
দিস ইজ নট ডান অঞ্জন। এই প্রথম আমি ওকে বাধা দিই।
হোয়াট ইজ নট ডান আঙ্কল?ও যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং ঘাড় পুরোটা ঘোরায় না। লক্ষ্য করি জেঠ বলে না, এবং আঙ্কল শব্দটি স্বাধীন সিলেবলে কেটে যে-ভাবে তাতে বিদ্রুপের নুন ছড়াল, আমি তার জ্বালা অনুভব করি।
পা দিয়ে সুইচ কেউ নেবায় না।
মাই ড্যাড উড নট হ্যাভ ডেয়ার্ড টু টেল মি দ্যাট। বলে ও ঘরে চলে গেল।
অঞ্জন! ইউ শুট নট স্পিক দ্যাট ওয়ে টু ইওর এল্ডার্স ওকে শুনিয়ে বলল বটে ছন্দা, কিন্তু অমিয় মনে হল খুশিই হয়েছে। আমাদের মধ্যে একটা খটাখটি লাগুক, ও মনে হয় এটাই চায়। রাতে লেদু শুচ্ছে অঞ্জনের আগেকার ঘরে। একদম পাশেই। কাল নন্দিনের ঘরে দরজা বন্ধ করে ফিসফাস করে লেদু জানাল, ও সারারাত জেগে থাকেনকাকা। লেট নাইট থ্রি-এক্স ফিল্ম দ্যাখে ওর টিভিতে। টেলিফোন করে সারারাত।
তুমি ওর সঙ্গে ওভাবে কথা বোলো না। লেদু ভীতভাবে বলল।
থাম তুই। আমি চিৎকার করে বললাম, তুই ম্যাদা মারতে এসেছিস, মেরে যা। আমেরিকা বেড়াতে এসেছিস, বেড়িয়ে যা। আমাকে আমার কর্তব্য করতে হবে। আমি ওর জ্যাঠামশাই। ওর বাবা আমার ছোট ভাই। আমি ওর বাপের দাদা।
আধঘণ্টা পরে ন্যান্সি আর অঞ্জন বেরল। মেয়েটা অঞ্জনের চেয়ে ঢ্যাঙা, বয়েসে বড় তো বটেই।
গ্যারেজ খোলার শব্দ।
ওরা পোসাটা নিয়ে বেরচ্ছে। ঘণ্টায় ১৫০ মাইল স্পিড। মেয়েটা গাড়ি চালায়। অঞ্জন ছমাস পরে লাইসেন্স পাবে। তখন ১৬ হবে। মেজর হবে আঠারোয়।
রাতে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হল। আমি নন্দিনকে বললাম, একটা ক্যাসেট চালাতে। নিজের ছোট্ট রেকর্ডারে নন্দিন অজয় চক্রবর্তীর একটা ক্যাসেট খুব লো ভলিউমে চালিয়ে দিল। দিয়ে শুয়ে পড়ল। ওঃ হো, কী না ভেবে যে…
অজয় চক্রবর্তীর রাগাশ্রয়ী গান।
ক্যাসেটটা আমিই গতবার সুমিতার হ্যান্ডব্যাগেপুরে দিই। মূলত জ্ঞান ঘোষের গান। গৌড়সারঙ্গ। ভালই গেয়েছেন অজয় চক্রবর্তী। কিন্তু জ্ঞানবাবুর কণ্ঠের সেই গ্রেন ও বন্দিশ, সেটা বরং কিছুটা ছিল সুমিতার অবিস্মরণীয় হাস্কি গলায়, যখন, যেদিন, চিনুর সঙ্গে মানকুণ্ডুতে তার কোনও এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ঘুরে এসে, ঘরে ঢুকে নতুন পোর্টেবল স্কেল-চেঞ্জিং হার্মোনিয়মটির মুখোমুখি হয়ে সহসা, বিপুল বেপরোয়া আগ্রহে সেভাবে যন্ত্রটির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল সে যেভাবে অগ্রসর হয়েছিল কদিন আগেই দীঘায় সমুদ্র-ঢেউ কেটে কেটে অকুতোভয়ে, যদিও সেক্ষেত্রে আমার হাত ছিল তার হাত ধরে চেপে— আর এবার, এখন, হায়, হার্মোনিয়মের দিকে প্রহরী-হারা সে কত একা! বেলো-টেলো ঝপাঝপ খুলে, স্টপার টেনে ও বন্ধ করে, আবার খুলে, আপার-লোয়ার চেম্বার সর্বত্র সরগমে ভরিয়ে–সহসা সে গেয়ে উঠেছিল:
এই কাননে, ছড়িয়ে গেলাম,
মোর জীবনের করুণ কাহিনী…
বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে। আহা, অজয় চক্রবর্তীও বড্ডই ভাল গেয়েছেন। কিন্তু কোথায় সেই বন্দিশ, সেই গ্রেন, সেই জ্ঞানবাবু-ভাবাবেগে-ভরা হাস্কি নারীকণ্ঠ।
আমি শুনতে লাগলাম:
হায়, মালতী বিতান-তলে
দ্যাখো পড়ে আছে ঝরে
মোর বেদনার নীরব রাগিণী।
বাইরে মাঠে সারারাত আলো জ্বলে। বৃষ্টি-কাঠির আলোর ঝাঁটা, ঝাঁট দিয়ে যাচ্ছে সারা মাঠ। মেপল, রেড উড, চায়না বেরি—এক পাইন ছাড়া আউট-ইয়ার্ডের সব কটি গাছই আমার অচেনা— সোঁ সোঁ হাওয়া, সব কটা স্টপার ও বেলো খুলে, তাদের আপার ও লোয়ার চেম্বারে ধরে, শাশ্বত রাত্রির বুকে তারা বাজিয়ে চলেছে অন্য এক অপার্থিব, অমানবিক সুর! এখন তারা গাইছে: গোলাপ জানে, বকুল জানে মঞ্জরী আর মুকুল জানে মোর গগনে কোন ফাগুনে হেসেছিল কোন সে চাঁদিনী…
মার্সেদে এসে এই প্রথম আমি, নিঃশব্দে, কাঁদতে লাগলাম।
প্লেন থেকে বোম পড়ছে হিরোসিমায়। লিটল বয়। এপিসেন্টার থেকে উঠে তেজস্ক্রিয় মেঘের ছাতা ঢেকে ফেলছে আকাশ। আকাশ থেকে কালোয়-কালো হিমশীতল ভস্মবৃষ্টি ধীরে নেমে আসছে।
শত শত সৌরতাপময় অগ্নিবলয় থেকে ছেলে-কোলে ছুটে বেরিয়ে আসছে সুমিতা। জীয়নের চোখ পিটপিট করছে। সুমিতার বাঁ চোখ কোটর থেকে গড়িয়ে পড়ে চিবুকের কাছে ঝুলে আছে। মাড়ি থেকে রক্ত পড়ছে গলগল করে।
প্রথমে কয়েকজন নৃত্যরত হিজড়ে—তারপর রঞ্জন বেরিয়ে এল ওই অগ্নিপরিধির ভিতর থেকে। রঞ্জনের হাতে রক্তাক্ত গ্লাভস, হাতে উদ্যত সিরিঞ্জ, সুমি, তোমার কিছু হয়নি তো, জীয়ন বেঁচে আছে তো, সে জানতে চাইছে, অথচ, আমি দেখছি, তার মাথার খুলির ওপরের অংশটাই নেই–ফুটন্ত লাভা রঙের সেরিব্রাম ফুলে-ফেঁপে গজগজ করছে। আর, হায়, সে তা এখনও জানে না।
সুমিতা কিছু বলার জন্যে মুখ ফেরালে দেখি একটা ঝটপটে জ্যান্ত শিঙি মাছ, সে দাঁতে কামড়ে আছে।
তার মাড়ি থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে।
ঠিক এই সময় রঞ্জন আমাকে দেখতে পায়। দেখে, তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন? সাপের দুখণ্ড চেরা জিভে চিৎকার করে ওঠে সে। তার মাথার খুলি উড়ে গেছে, চোখের মণি বনবন করে ঘুরছে, আমাকে মূলসুষ্ঠু উপড়ে তুলে ফেলবে, এমন অবধারিতভাবে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলে যেতে থাকে,
তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন…
তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন…
তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন…
প্রবল কাঁপুনির মধ্যে ভয়াবহ ভয়ে শতসূর্য তাপের মধ্যে জেগে উঠে আমি, পরমুহূর্তেই, ঠিক তার উল্টো, শীতলতমতার মধ্যে জমে যাই।
বাইরে এখনও বৃষ্টি। কনকনে ঠাণ্ডা। করিডরে তাই সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনিং-এর রেগুলেটার কেউ কমাতে গিয়ে ভুল করে চরমে ঠেলে দিয়েছে। নিশ্চিত ছোঁড়াটার কাণ্ড।
হু-হু হিমঠাণ্ডা হাওয়া আসছে, আমার বিছানার পাশেই, মেঝের আউটলেট থেকে।
কার্পেট টেনে আমি ঝাঁঝরির মুখটা বন্ধ করে দিই।