হাবীব খানের বাড়িতে মাওলানা এসেছেন। তিনি ময়মনসিংহ জামে মসজিদের পেশ ইমাম। নাম মাওলানা তাজ কাশেমপুরী। জনশ্রুতি আছে, তিনি একটি জ্বিন পালেন। জিনের নাম খামজী। জ্বিনের মাধ্যমে তিনি জ্বিনের দেশ থেকে গাছগাছড়ার ওষুধ এনে চিকিৎসা করেন। খামজার সঙ্গে না-কি জ্বিনের বাদশার সখ্য আছে। জ্বিনের বাদশা তার প্রিয় একজনকে মানুষের হাতে বন্দি দেখে ক্ষুব্ধ। মাওলানা তাজ কাশেমপুরী কঠিন লোক বলেই এখনো কিছু করে উঠতে পারছে না। তবে যে-কোনো সময় অঘটন ঘটবে। মাওলানা তাজ কাশেমপুরী অত্যন্ত সাবধানে জীবনযাপন করেন। পুকুরে বা নদীতে গোসল করেন না। মানুষকে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে মারতে জ্বিনরা না-কি পারদর্শী। তিনি তোলা পানিতে গোসল করেন। গলায় একটা তাবিজ পরেন। তাবিজটা আল্লাহর এক অলি স্বপ্নে তাকে দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করে তিনি ঘুমুতে গেছেন, তখন স্বপ্নে দেখেন সাদা আলখাল্লা পরা এক সুফী দরবেশ তাঁকে বলছেন, তাজ! জ্বিনের বাদশার হাত থেকে সাবধান। একটা তাবিজ তোকে দিলাম। সবসময় গৃলায় পরে থাকবি। না হলে মহাবিপদ। মাওলানা তাজের ঘুম ভাঙল। তিনি দেখেন, তার হাতের মুঠিতে রুপার এক তাবিজ। সেই থেকে তিনি তাবিজ গলায় পরছেন।
মাওলানাকে আনা হয়েছে দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে ফু দেওয়ার জন্যে। সিঁড়ির শেষ ধাপে অনেকবার হাবীবের পা পিছলিয়েছে। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে ঘটতে ঘটেনি। তার ধারণা সিড়ির এই ধাপে দোষ আছে। দোষ কাটানোর ব্যবস্থা।
মাওলানা তাজ কাশেমপুরী সিড়িতে ফু দিলেন। একটা তাবিজ সিড়ির রেলিং-এ বেঁধে সিঁড়ি বন্ধন দিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘দোষী’ জিনিসটা থাকে পুকুরঘাটে। সেখান থেকে উড়ে আসে। জিনিসটা যথেষ্ট শক্তিধর। তাকে পুকুরঘাট থেকে বিদায় করা যাবে না। তবে সে যেন মূলবাড়িতে আসতে না পারে সেই ব্যবস্থা তিনি করে দিচ্ছেন। তবে বাড়ির মেয়েদের চুলখোলা অবস্থায় এবং হয়েজ-নেফাজ চলাকালে পুকুরঘাটে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। খারাপ জিনিস মেয়েদের খোলা চুলের মুঠি ধরে বাড়িতে ঢোকে।
নাদিয়া বাবার পাশে দাঁড়িয়ে মাওলানার কথা শুনছিল। সে বিরক্ত গলায় বলল, খারাপ জিনিস বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
মাওলানা বললেন, এটা একটা হাওয়া। খারাপ হাওয়া।
এর জীবন আছে?
অবশ্যই আছে। তবে তাদের জীবন এবং মানুষের জীবন একরকম না। মানুষ খাদ্যগ্রহণ করে, এরা খাদ্যগ্রহণ করে না।
নাদিয়া বলল, যার জীবন আছে তার মৃত্যুও আছে। এরা কি মারা যায়?
হাবীব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মা, চুপ কর তো। সব বিষয় নিয়ে কথা বলা ঠিক না।
নাদিয়া বলল, একটা খারাপ জিনিস আমাদের পুকুরঘাটে বসে থাকবে, আর তার বিষয়ে জানতে চাইব না—এটা কেমন কথা! আমি এখনই এলোচুলে একা পুকুরঘাটে যাব। কিছুক্ষণ পুকুরঘাটে বসে থাকব। তারপর ঘরে ফিরব। খারাপ জিনিসটা আমার চুলের মুঠি ধরে ঘরে ঢুকবে। তখন তাকে আমি শায়েস্তা করব।
হাবীব বললেন, কীভাবে শায়েস্তা করবি?
নাদিয়া বলল, আমি কানে ধরে তাকে উঠবোস করাব।
হাবীব গম্ভীর হয়ে রইলেন। প্রণব শব্দ করে হেসে ফেলে চারদিকের পরিস্থিতি দেখে হাসি সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। হাবীব বললেন, মা, ঘরে যা।
নাদিয়া বলল, আমি ঘরে যাব না। আমি পুকুরঘাটে যাব।
সে সত্যি সত্যি সিড়ি বেয়ে নামতে থাকল। হাবীবের মনে হলো মেয়েকে কঠিন ধমক দেওয়া প্রয়োজন। ধমক দিতে পারলেন না। বাইরের একজন মানুষ আছে। তাছাড়া মেয়েটার সাহস দেখে তার ভালো লাগছে।
মাওলানা তাজ বললেন, উচ্চশিক্ষার কিছু কুফল আছে জনাব। প্রধান কুফল মুরুব্বিদের অবাধ্য হওয়া। ধর্মশিক্ষা না হলে এটা হয়।
হাবীব বললেন, আমার মেয়ের ধর্মশিক্ষা আছে। তাকে মুনশি রেখে কোরানপাঠ শিখানো হয়েছে। প্রতি রমজান মাসে সে কোরান খতম দেয়।
মাওলানা বললেন, আপনার মেয়ে সত্যি সত্যি পুকুরঘাটে গিয়েছে, এটা চিন্তার বিষয়। আমি একটা তাবিজ পাঠায়ে দিব। চেষ্টা নিবেন যেন তাবিজটা পরে। আমার কেন জানি মনে উঠছে, আপনের মেয়ের উপর খারাপ বাতাসের নজর আছে। লক্ষণ বিচারে সেরকম পাই।
হাবীব বললেন, তাবিজ পাঠিয়ে দিবেন। আমি ব্যবস্থা করব যেন সে পরে।
সময় সন্ধ্যামাখা বিকাল। নাদিয়া ঘাটে, পানিতে পা ডুবিয়ে বসেছে। পুকুরভর্তি শাপলা ফুল। ফুল রাতে ফোটে। দুপুরে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
নাদিয়া মাথার বাঁধা চুল খুলে দিতে দিতে মনে মনে বলল, আয় খারাপ বাতাস আয়। আমার চুল ধরে ঝুলে পড়। তোকে আমি নিজের ঘরে নিয়ে পুষব।
এই সময় একটা ঘটনা ঘটল। হঠাৎ নাদিয়া দেখল, শাপলা ফুলের ঝাঁকের মধ্যে একটি ডুবন্ত মেয়ের মুখ। মেয়েটির চোখ খোলা। সে পানির ভেতর থেকে নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
নাদিয়া বিকট চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে ঘাটে পড়ে গেল। বাড়ির প্রায় সবাই। ছুটে এল। সবার আগে উপস্থিত হলেন প্রণব। তিনি অজ্ঞান নাদিয়াকে কোলে তুলে নিলেন।
হাবীব বললেন, কী সর্বনাশ! মাওলানা সাহেবকে আবার খবর দাও। ডাক্তার ডাকো।
নাদিয়ার জ্ঞান ফিরল এক ঘণ্টা পর। ততক্ষণে বাড়িতে কোরান পাঠ শুরু হয়েছে। মাদ্রাসার একদল তালেবুল এলেম এসে দোয়া ইউনুস খতম দিচ্ছে। এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার এই দোয়া পাঠ করা হবে।
হাবীব শম্ভুগঞ্জ থেকে ভাইপীরকে আনতে লোক পাঠালেন। যত রাতই হোক ভাইপীর যেন উপস্থিত হন। হাবীব একটা গরু সদগার ব্যবস্থা করলেন।
নাদিয়ার মা জায়নামাজে বসলেন। মেয়ের জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত তিনি জায়নামাজ ছেড়ে উঠবেন না।
নাদিয়ার জ্ঞান ফিরল রাত আটটা পঁচিশ মিনিটে। সে বাবার একটা হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। সে থরথর করে কাঁপছে। হাবীব বললেন, মা, আর কোনো ভয় নাই। ভাইপীর সাহেব চলে এসেছেন। তিনি এখনো দোয়াতে আছেন।
নাদিয়া বলল, বাবা, আমি ভয় পেয়েছি। আমি খুব ভয় পেয়েছি।
হাবীব বললেন, আর ভয় নাই মা। আমার সারা দুনিয়া একদিকে আর তুমি একদিকে। কেন ভয় পেয়েছ বলতে চাও? বলতে না চাইলে বলতে হবে না।
নাদিয়া বলল, বাবা, দিঘির পানির নিচ থেকে একটা মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা মৃত না বাবা, জীবিত। মেয়েটা চোখের পাতা ফেলছিল। মেয়েটা খুব সুন্দর। গায়ের রঙ কাঁচা হলুদের মতো।
থাক, আর বলার দরকার নাই। তোমার মা আজ সারা রাত তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকবে।
হাজেরা বিবি তখন থেকে ‘ও হাবুরে, ও হাবুরে’ বলে চিৎকার করছেন। তার কাছে কেউ নেই। সবাই নাদিয়াকে ঘিরে আছে। তার চিৎকার সবাই শুনেও শুনছে না।
হাবীব মায়ের ঘরে ঢুকলেন। হাজেরা বিবি বললেন, শুনলাম তোর মেয়ে নাকি মারা গেছে?
হাবীব বিরক্ত হয়ে বললেন, কেন ক ডাক ডাকো? নাদিয়া মারা যাবে কেন? সে ভালো আছে, সুস্থ আছে। একা পুকুরঘাটে গিয়েছিল। সেখানে কী দেখে যেন ভয় পেয়েছে।
কী দেখছে?
কী দেখেছে সেটা জানার কোনো প্রয়োজন নাই মা।
অবশ্যই প্রয়োজন আছে। বল কী দেখছে?
হাবীব বললেন, সে দেখেছে দিঘির পানির নিচে একটা মেয়ে। নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
হাজেরা বিবি বললেন, এক্ষণ দিঘিতে জাল ফেলার ব্যবস্থা কর।
জাল ফেলতে হবে কেন?
হাজেরা বিবি বললেন, কোনো এক মাইয়ারে খুন কইরা দিঘির পানিতে ফেলছে। নাদিয়া দেখছে মরা লাশ। জাল ফেলার ব্যবস্থা কর।
হাবীব মা’র ঘর থেকে বের হলেন। থানায় খবর দিলেন। জাল ফেলার সময় পুলিশের উপস্থিতির প্রয়োজন আছে।
রাত দশটায় জেলেরা পুকুরে জাল ফেলল। ঘাটে চারটা হ্যাজাক লাইট জুলছে। থানার ওসি সাহেব এবং সেকেন্ড অফিসার এসেছেন। তাদের জন্যে ঘাটের কাছে চেয়ার-টেবিল পাতা হয়েছে। তারা অন্ধকারে বসেছেন। সন্ধ্যার পর ওসি সাহেবের সামান্য পানের অভাস আছে। তার জন্যে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট রুম থেকে জিনিস এসেছে। জিনিসের সঙ্গে চিকেন কাটলেট এসেছে। (সে সময় রেলের রিফ্রেশমেন্ট রুমে বিয়ার, ভদকা এবং হুইস্কি পাওয়া যেত।) প্রণব তাদের দেখাশোনা করছেন। ওসি সাহেব বললেন, হাবীব ভাইয়ের ব্যবস্থা নিখুঁত। সবদিকে তাঁর নজর এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার। এই ধরনের মানুষ দেশের লিডার হলে দেশ পাল্টে যেত।
প্রণব বললেন, রাতে কিন্তু স্যার খাওয়াদাওয়া করে তারপর যাবেন। খাসি জবেহ করা হয়েছে। হাজি নূর মিয়া বাবুর্চি চলে এসেছে।
ওসি সাহেব বললেন, তার কোনো প্রয়োজন নাই। যা ব্যবস্থা করে রেখেছেন, তারচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা আর কিছু হতে পারে না।
প্রণব বললেন, স্যার প্রয়োজন আছে। খাওয়াদাওয়ার পর স্যার আপনাকে বিশেষ কিছু কথা বলবেন। জরুরি কথা।
হাবীব ভাই কোথায়? তাঁকে দেখছি না তো।
প্রণব বললেন, গভর্নর সাহেব ঢাকা থেকে টেলিফোন করেছেন নাদিয়ার খোঁজ নিতে। এই নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
ওসি সাহেব থতমত খেয়ে বললেন, অবশ্যই। অবশ্যই।
পুকুরে জাল ফেলে কিছুই পাওয়া গেল না। দুটা বিশাল সাইজের কাতল মাছ ধরা পড়ল। গায়ে শ্যাওলা পড়া কাতল। প্রণবের নির্দেশে একটা মাছ ওসি সাহেবের বাসায়, একটা মাছ সেকেন্ড অফিসারের বাসায় চলে গেল।
সেকেন্ড অফিসার ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, জমিদারি আইনের সময় এমন মেহমানদারি দেখেছি, তার পরে দেখি নাই।
রাতের খাবার শেষ হয়েছে। হাবীব ওসি এবং সেকেন্ড অফিসারকে নিয়ে চেম্বারে বসেছেন। প্রণব নিজেও উপস্থিত আছেন। হাবীব বললেন, খানা কি মনমতো হয়েছে ওসি সাহেব?
ওসি আখলাকুর রহমান বললেন, গত দশ বছরে এমন খানা খাই নাই। পেট ফেটে মারা যাওয়ার অবস্থা। হজমি বড়ি খাওয়া লাগবে। এখন হাবীব ভাই বলেন, আপনার জন্য কী করব?
আমার জন্য কিছু করা লাগবে না। আপনাদের সামান্য সাহায্য করতে চাই। কইতরবাড়িতে যে খুন হয়েছে, সেই খুনের আসামিকে আমি খবর দিয়ে এনেছি। ফরিদ নাম। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান।
আখলাকুর রহমান প্রণবের দেওয়া পান মুখে দিয়ে সরু চোখে তাকালেন। হাবীব বললেন, প্রণব, ওসি সাহেবকে ঘটনা খুলে বলো। বাড়িতে এত ঝামেলা! পরিষ্কার করে কিছু চিন্তাও করতে পারছি না। বলতেও পারছি না। দুনিয়ার কথা বলার দরকার নাই! সারসংক্ষেপ বলে।
প্রণবের মুখভর্তি পান। তিনি চিলুমচিতে মুখের পান ফেলে দিয়ে বললেন, ফরিদ ছিল হাসান রাজা চৌধুরীর খাস কামলা। উনার কাপড় ধােয়া, হাত-পা টিপে দেওয়া, গোসল দেওয়া সব দায়িত্ব তার। হাসান তাকে নিয়ে পাখি শিকারে যাবেন। বন্দুক পরিষ্কার করতে বললেন। বন্দুক পরিষ্কারের সময় দুর্ঘটনা। আচমকা গুলি বের হয়ে গেল। কাছেই হাসানের মামা ফজরের নামাজে বসেছিলেন। এক গুলিতে শেষ। স্যার, ফরিদকে নিয়ে আসি?
নিয়ে আসুন।
ফরিদ ঘরে ঢুকে জড়সড় হয়ে রইল। তার মাথায় টুপি। পরনে পাঞ্জাবি, হাতে তসবি। সে এতক্ষণ তালেবুল এলেমদের সঙ্গে দোয়া ইউনুস খতম দিচ্ছিল।
আখলাকুর রহমান বললেন, তুমি হাসান সাহেবের খাস লোক?
জি স্যার।
শিকারে যাওয়ার আগে কি উনার বন্দুক আগেও পরিষ্কার করেছ?
জি স্যার।
সেফটি ক্যাচ কাকে বলে?
ফরিদ হতাশ চোখে একবার হাবীবের দিকে আরেকবার প্রণবের দিকে তাকাল।
সেফটি ক্যাচ কী জানো না?
জি-না।
পাখি শিকারের জন্যে ছররা গুলি ব্যবহার হয়। ফায়ার করলে একসঙ্গে অনেক ছোট ছোট গুলি বের হয়। এতে পাখি মরে। মানুষের গায়ে লাগলে মানুষ জখম হয়। মরে না। সেদিন বন্দুকে ছররা গুলির বদলে বুলেট ছিল কী জন্যে?
স্যার, আমি জানি না।
বন্দুকে ট্রিগার থাকে। ট্রিগার চাপলে গুলি বের হয়, এটা তো জানো?
জি স্যার।
তোমার হাসান স্যারের বন্দুকে ট্রিগার কয়টা?
জানি না স্যার।
মোহনভোগ বলে একটা মিষ্টি আছে। মিষ্টিটা কী?
হালুয়া স্যার।
এই হালুয়াকে অল্প আঁচে অনেকক্ষণ জ্বাল দিলে হালুয়ার রস কমে যায়। হালয়া টাইট হয়। থানায় নিয়ে আমরা প্রথম যে কাজ করি, রস কমিয়ে হালয়া টাইট করি। তুমি বন্দুক জীবনে কোনোদিনও দেখো নাই। আর বলছ বন্দুক দিয়ে গুলি করে মানুষ মেরেছ? অপরাধ করেছে অন্য একজন। দোষ নিজের কাঁধে নিচ্ছ। ঘটনা তো এইটা?
ফরিদ হতাশ চোখে হাবীবের দিকে তাকাল।
হাবীব বললেন, ওসি সাহেব ঠিকই ধরেছেন। এইটাই ঘটনা।
আখলাকুর রহমান বললেন, আপনার মতো অতি বুদ্ধিমান লোক এত বড় ভুল করে! আসামি শিখিয়ে পড়িয়ে নিবেন না?
হাবীব বললেন, ওসি সাহেব, শিখানোর জন্যে দায়িত্ব আপনার। আপনি শিখিয়ে নিবেন। আপনাদের জন্যে ভালো নজরানার ব্যবস্থা করা আছে। প্রণব! নজরানার পরিমাণ ওসি সাহেবকে কানে কানে বলো। উনার দিলখোশ হবে।
প্রণবের কথা শুনে ওসি সাহেবের দিলখোশ হলো না। তিনি বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে বললেন, হাবীব ভাই, আপনি হয়তো জানেন না আমি জুমনপুরের পীরসাহেবের মুরিদ হয়েছি। এইসব কাজ ছেড়ে দিয়েছি। পীর বাবার পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি, বাকিজীবন দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করব। এর অন্যথা হবে না।
হাবীব সিগারেট ব্রাতে ধরাতে বললেন, এটা অত্যন্ত ভালো খবর। এরকম অফিসারই আমাদের দরকার। সেকেন্ড অফিসার সাহেব কী বলেন?
সেকেন্ড অফিসার শুকনামুখে বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।
হাবীব বললেন, যেহেতু পীরসাহেবের মুরিদ হয়েছেন, আপনার উচিত কোনো নির্জন জায়গায় বসে আল্লাখোদার নাম নেওয়া। গর্ভনর সাহেবকে বলে কাল-পরশুর মধ্যে আপনাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেই। নির্জন পরিবেশ পাবেন। আল্লাখোদার নাম নিবেন চিল্লায় চলে যাবেন।
আখলাকুর রহমান ছোটখাটো ধাক্কার মতো খেলেন। হাবীব বললেন, আপনি মদ্যপান বেশি করেছেন বলে কার সঙ্গে কী কথা বলছেন হিসাব নাই। এইজন্যেই আল্লাহপাক কোরান মজিদে বলেছেন, মদ এবং জুয়া উভয়ের মধ্যেই কিঞ্চিৎ উপকার আছে। তবে উপকারের চেয়ে অপকার অধিক। ইহার পরেও কি তোমরা মদ্যপান থেকে বিরত হবে না? ওসি সাহেব! আপনি তো জুয়াও খেলেন, তাই? সালাহউদ্দিনের বজরায় জুয়ার আড্ডা বসে। নটবাড়ির অল্পবয়স্ক একটা নটি মেয়েকে মাঝেমধ্যে বজরায় নিয়ে যান। মেয়েটার নাম রানী। তাকে আপনি একটা সোনার চেইন বানিয়ে দিয়েছেন। চেইনটা কেনা হয়েছে সুবল স্বর্ণকারের দোকান থেকে। ঠিক বলছি? না-কি কোনো ভুলত্রুটি করলাম?
আখলাকের নেশা সম্পূর্ণ কেটে গেছে। তার চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। হাবীব বললেন, আমি বলেছিলাম রানী মেয়েটার সঙ্গে আপনার কিছু ঘনিষ্ঠ ছবির ব্যবস্থা করে দিতে। কিছু ছবি তারা পাঠিয়েছে। ছবি ভালো আসে নাই। আপনার চেহারা বোঝা যায়, কিন্তু রানী মেয়েটার চেহারা স্পষ্ট আসে নাই। প্রণব, ওসি সাহেবরে ছবি তিনটা দেখাও।
প্রণব দ্রুত আদেশ পালন করল।
হাবীব বললেন, ওসি সাহেব কিছু বলবেন? রানী মেয়েটাকে দিয়ে আমি একটা মামলা করতে পারি, অপহরণ এবং ধর্ষণ মামলা। দশ বছরের জন্যে জেলে চলে যাবেন। আপনার সুবিধা হবে, জুমনপুরের পীরসাহেবের তরিকায় চলার সুযোগ পাবেন।
আখলাকুর রহমান বিড়বিড় করে বললেন, আমি আপনাকে বড়ভাইয়ের মতো দেখি। এখানে আপনি আমার মুরুব্বি। ছোটভাইয়ের ভুলত্রুটি বড়ভাই যদি ক্ষমা না করে, কে করবে?
হাবীব বললেন, নজরানা যেটা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা কি ঠিক আছে? অবশ্যই ঠিক আছে। অবশ্যই।
হাবীব বললেন, আসামি দিচ্ছি, আসামি নিয়ে যান। তাকে ভালোমতো শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবেন। হাসান রাজা চৌধুরী এবং তার পরিবারের যেন কোনো ঝামেলা না হয়।
আপনি যেভাবে বলবেন ঠিক সেই মতো কার্য সম্পন্ন হবে। আমার পীর সাবের দোহাই।
আখলাকুর রহমান আসামি নিয়ে চলে গেছেন। ঘরে প্রণব এবং হাবীব। পাংখাপুলার রশিদ পাংখা টানছে। যদিও পাংখার প্রয়োজন নাই। আবহাওয়া শীতল। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া আসছে।
প্রণব বললেন, শোকের মুখে নুন পড়েছে। সাধারণ নুন না। সৈন্ধব লবণ।
হাবীব বললেন, লবণ এখনো পড়ে নাই। লবণ পড়বে চার-পাঁচ দিনের ভিতরে। যখন তারে বদলি করা হবে রামু থানায় কিংবা খাগড়াছড়িতে।
প্রণব বললেন, এখন তাকে বদলি করলে তো আমাদের সমস্যা।
হাবীব হাই তুলতে তুলতে বললেন, আমাদের কোনো সমস্যা নাই। ওসি আমার কাছে ছুটে আসবে তদবিরে। আমি তদবির করে বদলি বন্ধ করব। ওসি আমার কাছে বাকিজীবনের জন্যে বান্ধা থাকবে। এখন বুঝেছ?
জলের মতো পরিষ্কার বুঝেছি।
মেয়েছেলের কান্না শুনছি। কে কাঁদে।
ফরিদের বউ।
অল্পদিনেই দেখি স্বামীর প্রতি তার বিরাট দরদ হয়েছে।
প্রণব বললেন, তা হয়েছে।
হাবীব বললেন, হাসান রাজা চৌধুরীকে বলবে আমার বাড়িতে থাকার তার আর প্রয়োজন নাই। সে এখন নিশ্চিন্ত মনে তার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারে।
জি বলব। আপনার সঙ্গে ছোট্ট একটা কথা ছিল।
বলো। তোমার কোনো কথাই তো ছোট না। ডালপালায় বিশাল বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের যেমন ঝুড়ি নামে তোমার কারও তেমন ঝুড়ি নামে। বলো কী কথা?
প্রণব বললেন, নাদিয়া মামণির এক শিক্ষক এসেছেন ঢাকা থেকে। নাদিয়া মামণির সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। তাঁকে অতিথঘরে থাকতে দিয়েছি। খাওয়দাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। বাড়িতে এত ঝামেলা, এইজন্যে আপনাকে কিছু জানাই নাই।
হাবীব বললেন, না জানিয়ে ভালো করেছ। এখন না জানিয়ে সকালে জানালে আরও ভালো হতো।
হাবীব উঠে পড়লেন। তার ভুরু কুঁচকে আছে। তালেবুল এলেমরা নিচুগলায় দোয়াপাঠ করেই যাচ্ছে। এদের গলা ছাড়িয়ে শোনা যাচ্ছে ফরিদের স্ত্রীর কান্না।
নাদিয়াকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। লাইলী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন। ঘরে হারিকেন জ্বালানো। জ্বলন্ত অগ্নির কাছে খারাপ কিছু আসতে পারে না। খাটের নিচে একটা মালশায় সরিষা এবং একগোছা চাবি রাখা হয়েছে। নাদিয়ার গলায় তিনটা ভারী তাবিজ। দুটা দিয়েছেন শম্ভুগঞ্জের পীরসাহেব। একটা মওলানা তাজ কাশেমপুরী। নাদিয়ার ঘরে দুজন কাজের মেয়ে। তারা ঘোমটা দিয়ে জায়নামাজে বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নিঃশব্দে কোরান পাঠ করছে।
হাজেরা বিবির মাথা আজ মনে হয় একেবারেই ঠিক নেই। তিনি সুর করে মাতম করছেন—আমার নাতনি মারা গেছে গো! কেউ আমারে খবর দিল না গো! নাতনির মরামুখ আমারে কেউ দেখাইলো না গো! আমি তার শাদি দেখলাম না গো!
রাত তিনটায় নাদিয়ার ঘুম ভাঙল। সে চাপা গলায় ডাকল, মা!
লাইলী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এই যে আমি।
নাদিয়া বলল, পুকুরের পানির নিচে আমি যে মেয়েটাকে দেখেছি সে কাঁদছে। আমি তার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ মা?
লাইলী বললেন, পাচ্ছি। কাঁদছে ফরিদের পোয়াতি বউটা।
কেন কাঁদছে?
লাইলী বললেন, এরা গরিব দুঃখী মানুষ। এদের নানান কষ্ট। কোন কষ্টে কাঁদে কে জানে!
একটু খোঁজ নিবে মা?
সকালে খোঁজ নিব। এখন তোক ছেড়ে যাব না।
নাদিয়া বলল, অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছি মা। স্বপ্নটা বলি?
দিনের বেলা বলিস। রাতে স্বপ্ন বলতে নাই।
কিচ্ছু হবে না মা। শোনো। আমি স্বপ্নে দেখি পানিতে বিরাট বড় একটা ডেগ। আমি সেই ডেগের ভেতর বসে আছি। ডেগটা ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমি ডেগের ভেতর থেকে মাথা বের করছি। তখন দেখি চারদিকে পানি। সমুদ্রের মতো, কিন্তু কোনো ঢেউ নেই। বাতাসও নেই। তারপরেও ডেগটা ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। ৩য়র স্বপ্ন, কিন্তু আমার একটুও ভয় লাগছে না!
লাইলী বললেন, ভালো কোনো তফসিরকারীর কাছে স্বপ্নটা বলে পাঠাব। উনি তফশির করবেন।
আমার যে স্যারের কথা তোমাকে বলেছি উনি যে-কোনো স্বপ্নের লৌকিক ব্যাখ্যা করতে পারেন।
তোর ওই হিন্দু স্যার?
হুঁ। উনার অনেক বুদ্ধি। ছাত্রদের কাছে স্যারের অনেকগুলি নাম আছে। একটা নাম হলো মালাউন শার্লক হোমস।
স্যারের কথা থাকুক মা। তুই আরাম করে ঘুমা। আমি সারা রাত তোর মাথায় বিলি করে দেব। এক গ্লাস গরম দুধ খাবি?
খাব। মা, আমার দাদির সঙ্গে ঘুমাতে ইচ্ছা করছে।
লাইলী বললেন, তুই এইখানেই ঘুমাবি।
হাবীব নাদিয়ার স্যারের সঙ্গে বসেছেন। মেহমানদের সঙ্গে তিনি বাংলাঘরে বসেন। মামলা-মোকদ্দমার লোকজনের সঙ্গে চেম্বারে।
জনাব, আমার নাম বিদ্যুত কান্তি দে।
হাবীব বললেন, আপনার নাম আমি আমার কন্যার কাছ থেকে শুনেছি। সে আপনার কাছ থেকে কী একটা ম্যাজিকও যেন শিখেছে। রাতে আপনার থাকার কি কোনো সমস্যা হয়েছিল?
না।
খাওয়াদাওয়ায় কোনো তকলিফ কি হয়েছে? আমার মেয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তাকে নিয়ে ব্যস্ততা গেছে।
এখন সে কেমন?
সে ভালো আছে।
তার সঙ্গে একটু দেখা করব।
হাবীব বললেন, আমাদের এই বাড়ি একটা প্রাচীন বাড়ি। প্রাচীন বাড়ির প্রাচীন নিয়মকানুন। অনাত্মীয় পুরুষমানুষের অন্দরমহলে প্রবেশ নিষেধ। নাদিয়ার শরীরের এখনো এমন অবস্থা না যে সে বাইরে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করবে। আপনার স্কলারশিপের কী যেন সমস্যার কথা নাদিয়া বলেছিল। কাগজপত্রগুলি যদি রেখে যান, তাহলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারি।
বিদ্যুত কান্তি দে বললেন, স্কলারশিপের সমস্যা সমাধানের চেয়ে নাদিয়ার সঙ্গে দেখা করা এখন আমার অনেক জরুরি।
হাবীবের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ হলো। তিনি তাঁর সামনে বসা যুবকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যুবকের কথাবার্তার মধ্যে উদ্ধত ভঙ্গি আছে। তবে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছেলে। আত্মবিশ্বাস চোখের তারায় ঝলমল করছে। হিন্দুদের চোখেমুখে একধরনের কাঁচুমাচু নিরামিষ ভাব থাকে, এর মধ্যে তা নেই। হাবীব বললেন, আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা হওয়া অত্যন্ত জরুরি কেন?
বিদ্যুত বললেন, এন্টিগ্র্যাভিটি একটা ম্যাজিক শেখার তার খুবই শখ ছিল। ম্যাজিকের আইটেমটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। যেহেতু তার শরীরটা খারাপ, ম্যাজিকটা শিখলে ভালো লাগবে।
হাবীব বললেন, আপনি জিনিসটা রেখে যান, আমি মেয়ের কাছে পৌঁছে দেব।
ম্যাজিকটা কীভাবে দেখাতে হবে সেটা তো তাকে বলতে হবে।
আপনি কাগজে লিখে দিয়ে যান। তাতে হবে না?
হ্যাঁ হবে। আচ্ছা আমি আজ ছটা পর্যন্ত যদি আপনার বাড়িতে থাকি, তাহলে কি কোনো সমস্যা হবে?
কোনো সমস্যা নেই।
ঠিক সন্ধ্যা ছ’টায় আপনি কি আমাকে দশ মিনিট সময় দেবেন? তখন ম্যাজিকের বোতলটা আপনার হাতে বুঝিয়ে দেব।
হাবীব বললেন, ঠিক আছে। সন্ধ্যা ছ’টায় আমি চেম্বারে উপস্থিত থাকব। একসঙ্গে চা খাব।
বিদ্যুত বলল, আমার ছোট্ট আর্জি আমরা চা-টা খাব দিঘিরঘাটে। বিশেষ একটি কারণে দিঘিরঘাটে উপস্থিত থাকতে বলছি। যদি আপনার তেমন কোনো সমস্যা না হয়।
হাবীব কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালেন।
ছ’টা বাজে। সূর্য ডুবিডুবি করছে। হাবীব দিঘিরঘাটে উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে প্রণব আছেন। রশিদ এসেছে ট্রেতে করে চা নিয়ে। বিদ্যুত হাবীবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি ঘাটের ঠিক এই জায়গাটায় বসবেন? আপনার মেয়ে সন্ধ্যা ছ’টার দিকে এখানে বসে ভয় পেয়েছিল। কষ্ট করে বসুন। প্লিজ।
হাবীব বসলেন।
বিদ্যুত বললেন, এখন আপনি ডানদিকে তাকান। শেষ সূর্যের আলো আপনার গায়ে পড়েছে। সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়েছে দিঘিতে। আপনার কি মনে হচ্ছে—দিঘির পানির ভেতর আপনি নিজেকে দেখছেন?
হুঁ।
নাদিয়ার ক্ষেত্রে ঠিক এই ঘটনা ঘটেছে। সে ভয় পেয়েছে পানিতে নিজের ছায়া দেখে। যে-কোনো কারণেই হোক, সে আগে থেকেই ভয়ে অস্থির ছিল। দিঘির পানিতে নিজেকে দেখে সেই ভয় তুঙ্গস্পর্শী হয়েছে।
হাবীব চুপ করে রইলেন।
বিদ্যুত বললেন, সে নিজেকে চিনতে পারেনি, তার কারণ আছে। শেষ বিকেলের আলো হয় গাঢ় হলুদ থেকে লাল। অর্থাৎ Longer wave length এর আলো। নাদিয়ার গায়ের রঙ শ্যামলা। সে দেখেছে প্রায় হলুদ রঙের এক তরুণীকে।
প্রণব বললেন, আপনার বুদ্ধিতে চমকৃত হয়েছি। বিশেষভাবে চমৎকৃত হয়েছি। স্যার কী বলেন?
হাবীব বললেন, এমন জটিল একটি বিষয়ে এত সহজ ব্যাখ্যা চিন্তা করি নাই।
বিদ্যুত বললেন, আমরা প্রকৃতিকে অতি রহস্যময় কিছু ভেবে দূরে সরিয়ে রাখি। প্রকৃতি কিন্তু মোটেই রহস্যময় না। প্রকৃতি বিশাল একটা সরল অংকের মতো। যার উত্তর আমাদের জানা। হয় শূন্য আর নয় ১, এর বাইরে না। আমরা দিঘিরঘাটে বসে একটা সরল অংক কষেছি। উত্তর পেয়েছি শূন্য। অর্থাৎ ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই।
প্রণব বললেন, ঘাটে ভূত না থাকলেও এই বাগানে অবশ্যই আছে। একটা ঘটনা বলি—শীতের সময়, কার্তিক মাস, বাগানের দু’টা খেজুরগাছ কাটানো হবে। গাছি খবর দিয়েছি…
হাবীব প্রণবকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এই গল্প এখন থাকুক।
বিদ্যুত বললেন, এই খামটা আপনি রাখুন। নাদিয়াকে পৌঁছে দেবেন। এন্টিগ্র্যাভিটি ম্যাজিকের কৌশলটা এখানে লেখা আছে। আমি চা খেয়েই ঢাকার দিকে রওনা হব।
হাবীব মেয়েকে চিঠি দেওয়ার আগে খাম খুলে নিজে পড়লেন কাজটা যে অন্যায় তাও না। মেয়ে বড় হলে তার ওপর নজর রাখতে হয়। সন্তানের প্রতি অনেক কর্তববার মতো এটাও কর্তব্য। যারা কর্তব্য পালনে ভুল করে তারাই বিপদে পড়ে হাবীব মন দিয়ে চিঠি পড়লেন দু’বার পড়লেন। সাধারণ চিঠি, তারপরেও সাংকেতিক কিছু থাকতে পারে।
নাদিয়া,
তুমি অসুস্থ বলে তোমার সঙ্গে দেখা হলো না। অসুস্থতার মূল কারণ ধরে দিয়েছি, কাজেই তুমি দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে বলে আমার ধারণা।
তোমার অতি পছন্দের এন্টিগ্র্যাভিটি বটলের ম্যাজিকের কৌশলটা শোনো। বাদামি রঙের একটা কাচের বোতল এবং দড়ি দিয়ে যাচ্ছি। বোতলের মুখের ব্যাস দড়ির মুখের ব্যাসের চেয়ে বড়। কাজেই দড়ির মাথা কামড়ে ধরে বোতল শূন্যে ঝুলতে পারবে না। গ্র্যাভিটির কারণে পড়ে যাবে। বোতলের ভেতর কর্কের একটা গোল বল আছে। ম্যাজিকের মূল কৌশল ওই গোল বলে। ম্যাজিশিয়ান হিসেবে তোমার কাজ হলো কোনোভাবে দড়ি এবং বোতলের মুখের মাঝখানে কর্কটা নিয়ে আসা।
তাহলেই কার্য সিদ্ধি হবে। বোতল মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কলা দেখিয়ে দড়ির মাথা কামড়ে ঝুলতে থাকবে।
ভালো কথা, কর্কটা শুরুতে বোতলের ভেতর থাকলে হবে না। কারণ বোতলটা দর্শক দেখতে চাইবে। কর্কের বল পাম করে হাতে লুকিয়ে রাখতে হবে।
তুমি ভালো থেকো।
ইতি
বিদ্যুত কান্তি
পুনশ্চ : সাপ এবং আপেল বিষয়ের যে বইটি তুমি দিয়েছ, তার মতো খারাপ বই আমি অনেক দিন পড়িনি। সর্বমোট আটটি গল্প। প্রতিটি একটার চেয়ে আরেকটা খারাপ। বইটির
নাম হওয়া উচিত আটটি নিকৃষ্ট গল্প’।
হাবীব চিঠি শেষ করে ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন। নাদিয়া তার শিক্ষককে গল্পের বই কেন দিবে! তার সমস্যা কী?